[ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬) সম্ভবত এখনও স্পেনের সবচেয়ে প্রিয় কবির আসনটি ধরে রেখেছেন। সবচেয়ে প্রিয় আধুনিক কবির আসনটিও, যদিও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে। ‘বুক অফ পোয়েমস’ ছাপা হয়েছিল তাঁর বাবার অর্থানুকূল্যে ১৯২১’এ। সে বছরেরই নভেম্বর মাসে লোরকা লিখে ফেলেন তাঁর পরবর্তী সংকলন ‘পোয়েম অফ দ্য ডিপ সঙস’–এর কবিতাগুলি। পরবাস-৮২ এবং ৮৩-তে লোরকার একশো বছর আগে লেখা কয়েকটি কবিতার অনুবাদ সংকলিত হয়েছিল। এই লেখায় তাঁর পরবর্তীকালের পাঁচটি কবিতা সংকলিত হল। Divan del Tamarit
(The Tamarit Divan)-এর কবিতাগুলি লেখা হয়েছিল ১৯৩৪-এর এপ্রিল মাসে। এগুলি প্রকাশিত হয় ১৯৪০-এ তাঁর মৃত্যুর পর। পাঠক দেখবেন এগুলিতে লোরকার কবিতার উপর প্রাচ্যের প্রভাব যতটা শিরোনামে আছে ততটা কবিতার দেহে নেই। শিরোনামে লোরকা আরবি শব্দ ‘গজল’ বা ‘কাসিদা’ ব্যবহার করেছেন বটে, অনুপ্রাণিতও হয়েছেন পারসিক গাথা থেকে, কিন্তু নির্মাণে তা সব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে একান্তভাবেই লোরকা। Tamarit শব্দও আরবিক উৎসের। এর মানে হল খেজুরের বাগান। লোরকার এক তুতোভাইদের খামারবাড়ি ছিল Tamarit Garden এবং সিরিজটি সেখানে থাকাকালীন লেখা। স্প্যানিশ না জানার আক্ষেপ নিয়েই ইংরেজি অনুবাদের আশ্রয় নিয়েছি। এই বিশেষ কবিতাগুলি পেঙ্গুইন মডার্ন ক্ল্যাসিক্স সিরিজের ‘সিলেক্টেড পোয়েমস অফ ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা’ (২০০১ সংস্করণ) থেকে নেওয়া হয়েছে। আমার অনুবাদে স্তবকবিন্যাস, যতি বা মাত্রা একটি দুটি প্রয়োজনীয় ব্যতিক্রম ছাড়া মূলানুগ রাখার চেষ্টা করেছি।]
খেজুর বীথির দিওয়ান
মূল রচনা: Divan del Tamarit (The Tamarit Divan; 1940)
১) পূর্বাভাসহীন প্রেমের গজল
কেউই সেই মৃগনাভি গন্ধটা বুঝে উঠতে পারে নি, কোনদিনঃ
তোমার নাভিদেশে ফুটে আছে এক অনপ্রভ ম্যাগনোলিয়া ফুল।
কেউই জানতে পারবে না তোমার দংশনে
প্রেমের হামিংবার্ড কিভাবে শহীদের পরিণতি পেল ।
তোমার ভুরুর মাঝে জ্যোৎস্নার প্রাচীন করিডর
এক হাজার পারসিক টাট্টুঘোড়া সেখানেই শুয়ে রইল,
অথচ চারটে নিবিড় রাত ধরে জেগে আছি আমি
তোমার কোমরখানি ছুঁয়ে, বরফও বৈরি হয়ে গেল ।
পলেস্তারা আর হাসনুহানার মধ্যে
তোমার নয়ন, বীজের ভিতর থেকে বিবর্ণ শাখার উদ্গম ।
আমি বুকের ভিতর খুঁজি আইভরি চিঠিখানা
যা তোমার হাতে দিয়ে বলা যেতে পারেঃ চিরন্তন।
চিরদিন, চিরন্তন, আমার বেদনা নিয়ে এই যে বাগান,
তোমাকে হারিয়ে ফেলা ছায়া ছায়া তোমার শরীরঃ
তোমার শিরা ও ধমনীর রক্ত আমার ওষ্ঠে ঢেলে দাও
তোমার মুখ হোক আমার মৃত্যুর পথ আঁধার গহ্বর।
মূল কবিতা: Gacela primera Del amor imprevisto (Ghazal of the love Unforeseen; 1940), স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown
২) নিষ্ঠুরের গজল
আমি চাই না জলের জন্য কোন পরিখা থাকুক
চাই না বাতাসের জন্য কোন গিরিখাত।
আমি চাই না রাত্রিকে দেখে নেবার চোখ
চাই না আমার হৃদয় সোনার পুষ্পে ঢাকা হোক।
এবং আমি চাই ষন্ডদের সাথে বড় বড় পাতাদের কথা হোক কিছু
আর শীতল ছায়ার ভারে মরে যাক কেঁচোদের দল।
এবং চাইতে পারি করোটির দাঁতগুলো ঝলসে উঠুক উজ্জ্বল
আর পীতবর্ণ স্রোতে ধুয়ে যাক আমাদের রেশমসকল।
দেখতে পাই রাত্রি আহত বটে তবু নিরন্তর
চেষ্টা তার মল্লযুদ্ধে দুপুরকে প্যাঁচে ফেলবার।
আমি সয়ে নিতে পারি সেই সুর্যাস্ত যা বিষের বর্ণে সবুজাভ
এবং ভেঙে পড়া আর্চগুলি যেখানে থমকে গেছে আহত সময়।
কিন্তু তোমার অপার্থিব নগ্ন শরীর আমাকে দেখতে বোলো না
যেমন কালো ক্যাকটাস কাশফুল বনে বেআব্রু মনে হতে থাকে।
বরং প্রত্যাশায় রাখো কোন শীতল তারার তাও ভালো
কিন্ত তোমার কটিদেশ, কখনও শীতল হলে, আমাকে দেখিও না।
মূল কবিতা: De la terrible presencia (Ghazal of the Terrible Prsence; 1940), স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown
৬) অদৃশ্য হাতের জন্য ধুন
আর কিছুই চাই না আমি, শুধু একটা হাত
একটা আহত হাত যদি তা অসম্ভব না হয়।
আর কিছুই চাই না আমি, শুধু একটা হাত
যদিও সহস্র রাত শয্যাবিহীন আমি কাটিয়ে দিতে পারি।
সেটা হবে বিবর্ণ লিলি চুনাপাথরের,
শিকলে বন্দী পায়রা কষে বাঁধা হৃদয়ের গায়।
চাঁদের পথ আটকে দাঁড়ানো পাহারাদার, আমার মৃত্যুর রাতে,
সেই হাত বলে দেবে তাকে, বিলকুল প্রবেশ নিষেধ।
আর কিছুই চাই না আমি, শুধু সেই হাতখানা ছাড়া
মালিশের তেল রোজকার আর কষ্টের দস্তরখানের জন্য
আর কিছুই চাই না আমি, শুধু একটা হাত
যে আমার মৃত্যুর কাছে একটা ডানা পৌঁছে দেবে একদিন।
আর সব কিছু চলে যায়, সব।
থাকে নামহীন ব্রীড়া। তারারাও আসে চলে যায়।
আর সব কিছু আদতে কিছু তো বটেইঃ দুঃখী বাতাস,
পাতারাও পলায়নপর বলে, ঘুরে ঘুরে পাক খেতে থাকে।
মূল কবিতা: De la mano imposible (Qasida of Impossible Hand; 1940), স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown
৭) গোলাপের জন্য বন্দিশ
গোলাপ
সে যে ঊষাকালকেই খুঁজছিল এমন নয়ঃ
প্রায় অনন্তকাল বোঁটায় অবিচল থেকে
সে অন্য কিছু খুঁজছিল,এসব নয়।
গোলাপ
সে যে বিজ্ঞানের সূত্রাবলি অথবা ছায়া খুঁজছিল তা নয়ঃ
শরীর আর স্বপ্নের সীমার মধ্যে বাঁধা পড়ে
সে অন্য কিছু খুজছিল, এসব নয়।
গোলাপ
সে যে ফুটে থাকা একটা গোলাপকেই খুজছিল তা নয়ঃ
আকাশ ফুঁড়ে মাথা তুলেছে স্থির ও অচঞ্চল
সে আসলে অন্য কিছু খুঁজছিল, এসব নয়।
মূল কবিতা: De la rosa (Qasida of the Rose; 1940), স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown
৯) কালো পারাবতের জন্য বন্দিশ
লরেল শাখার ফাঁক দিয়ে
আমি দুটো কালো পায়রা দেখতে পাই।
একটার নাম সূর্য,
অপরটা চাঁদ।
ক্ষুদে প্রতিবেশী তারা, যেমন তাদের আমি ডাকি বরাবর,
এখানে কোথায় বলো আমার কবর?
সূর্য বলল সে রয়েছে আমার ছটায়
চাঁদ বলল তোমার কবর, সে তো আমার গলায়।
এবং আমি হেঁটে চলেছিলাম পৃথিবীর কোমরে হাত রেখে
দেখলাম শরীরদুটো বরফে আচ্ছাদিত ঈগলপাখির
আর এক নগ্ন বালিকার।
ঈগল দুখানা, তারা একটি বোধহয় অন্যটিই হবে
মেয়েটির সুযোগ নেই এ দু’য়ের একটি হবার।
ছোট্ট ঈগলজোড়া, তাদের বলেছি ডেকে আমি
বল তো কোথায় আছে আমার কবর?
সূর্য বলল, আমার পুচ্ছপ্রান্তে
চাঁদ বলল, তা রয়েছে আমার গলায়।
লরেল পাতার ফাঁক দিয়ে
আমি দুটো কালো পায়রা দেখতে পাই।
এদের একটা আর একটাই হবে
এবং দু’য়ে মিলে কিছু নয় তারা, কেউ নয় নিজ অথবা পর।
মূল কবিতা: De las palomas oscuras (Qasida of the Dark Doves; 1940), স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown