Subscribe to Magazines






পরবাসে
রবিন পালের

আরো লেখা

বই



ISSN 1563-8685




বিমল কর: শতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের বিশিষ্ট রচয়িতা বিমল করের জন্ম শতবর্ষ উদযাপনের সময় এসে গেল। নদীর অনেক বাঁক থাকে। বিমল কর একটা বাঁকের শিল্পী। একালের পাঠককে দু-চার কথায় তাঁর প্রতিভার পরিচয় দেওয়া আমার পক্ষে রীতিমত কষ্টকর।

ধানবাদে স্কুল জীবন, নানা বই পড়া, অসুস্থ অবস্থায় অতিবাহন, কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে আইএসসি, শ্রীরামপুরে টেক্সটাইল কলেজ, ফিরে এসে বিদ্যাসাগর কলেজ, গল্প লেখা, আসানসোলে ডিফেন্সে চাকরি, স্নাতক, রেলের চাকরি, চাকরি ছেড়ে কলকাতা, প্রেস, পত্রিকা, বইবিক্রির প্রচারে মফ:স্বল, পত্রিকা ১৯৫৪তে ‘দেশ’ পত্রিকায় যোগদান- তার ভাসতে থাকা জীবনের কয়েকটি তথ্য, ওখানেই ১৯৮২ পর্যন্ত, তারপর শিলাদিত্য, যুগান্তর, বর্তমান, সংসার তার জীবনকে শিথিল বন্ধনে যুক্ত করেছিল। ছোটগল্প রচনায় খ্যাতি এবং পাশাপাশি ঔপন্যাসিক খ্যাতি। আড্ডাপ্রিয়, তারুণ্যপ্রিয়, সংসারপ্রিয় জীবনযাপন। আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রথম দিকেই ত্রি পার্বিক ‘দেওয়াল’ (১৯৫৬-১৯৬২) তাঁর প্রতিভাকে নি:সংশয়িত করে তোলে। কলকাতার বউবাজার অঞ্চলের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে কেন্দ্রে রেখে তিনি সমকালীন চলিষ্ণুতার বৃহৎ পটটি উন্মোচনে তৎপর হন। তাতে আছে কলকাতায় বোমা পড়ার আতঙ্ক, কলকাতা ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে পালানোর প্রবণতা, ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপকতা, জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকা, অর্থনৈতিক ও নৈতিক জীবনে ধাক্কা, বেকার সমস্যা, অসামাজিক নানা কার্যকলাপ, অন্যদিকে রাজনীতির নানাদিক- গান্ধীবাদ, চরম পন্থা, সাম্যবাদ, আগস্ট আন্দোলন, যুদ্ধকালীন উল্লাস প্রভৃতির বিশ্বস্ত ছবি। প্রসঙ্গ আহরণে আছে প্রত্যক্ষতর স্বাদ অবশ্য পড়ে শুনে, ডকুমেন্টেশন নয়। ‘ছোটঘর’ পর্বে আহত উপলব্ধির কথা, সাইরেন বাজা, জিনিসপত্রের দুষ্প্রাপ্যতা, ট্রেন যাত্রার ভিন্নতা (জানালা গলে প্রবেশ), কালোবাজারী, অন্ধ নৃশংসতা, কেরানির অবরুদ্ধ জীবন ছোট ঘরের মানুষের ছোটমনের পরিচয় বহন করে। বাসুর সিভিক গার্ডের জীবন, গিরিজাপতির প্রেস জীবন, রত্নময়ীর মাতৃস্বভাবের অসহায়তা, সুধার সামান্য চাকরি ও স্বপ্নলালস, উমার দাদা নিখিলের সংসারছিন্ন পার্টিজীবন, ব্যক্তিজীবনকে গ্রথিত করেছে সমাজজীবনে। বাসু ও মীনাক্ষীর এবং সুধা ও সুচারুর প্রেম উপন্যাসটিকে সমৃদ্ধই করেছে। ৩য় পর্বের ‘খোলা জানলা’ অংশে আছে আত্ম উপলব্ধির স্তরান্তর। নি:সন্দেহে এই উপন্যাস একটা এপিক স্বাদ বহন করে। কেউ কেউ বলেছেন ‘খুবই ঘরোয়া ভঙ্গিতে লেখা প্রতীকী উপন্যাস।’ (উজ্জ্বল মজুমদার) দেওয়ালের প্রতীক তো তৎকালীন কবিতা বা উপন্যাসে এসে গেছে। আর একজন বলেছেন এখানে ‘পাওয়া গেছে এক সময়ের বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনের এক সর্বাঙ্গীন ছবি।’ (সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়) লেখক ‘যে বস্তুজ্ঞান ও ব্যক্তিবোধের পরিচয় এখানে দিয়েছেন তা পুনরায় অর্জিত হয়েছে যদুবংশ, শমীক প্রভৃতি উপন্যাসে। (ঐ) অন্য এক আলোচকের কিঞ্চিৎ ভিন্ন মত। তাঁর মতে লেখকের শক্তিমত্তা হলেও, আগস্ট বিপ্লব ও গান্ধীর অহিংসা মন্ত্রের সংঘাত ও কয়েকটি নতুন মানুষ আমদানী হলেও ‘সব কিছুই অগোছালো রয়ে গেল’ এবং রাজনৈতিক উপন্যাস রচনার সিদ্ধি এল না। (ক্ষেত্র গুপ্ত) ‘যদুবংশ' (৪র্থ সং ১৯৬৮) এবং ‘কেরানী পাড়ার কাব্য’ (১৯৭৪) উপন্যাস দুটিতে সামাজিক সংকট, সংঘাত পাধান্য পায় যদিও ‘অন্তর্জীবন’ বিমলবাবুর বহু উপন্যাসে ক্রমশ: প্রাধান্য পেতে থাকে।

‘খড়কুটো’ (১৯৬৩)-তে আছে ‘মৃত্যুর নিপুণ নির্মাণ’। এ ধরনের উপন্যাসে তিনি ‘আদ্যন্ত রোমান্টিক’, কখনো মনে হয় তা ‘কবিতার সগোত্র’। ‘মানুষের অন্তর্টানের একটি নিটোল ছবি’। ক্রমশ: তিনি জীবনের পূর্ণতা অপূর্ণতার যথার্থ্য সন্ধানে নামেন, যা উত্তরসূরী শীর্ষেন্দু-ও করেছেন ‘পার্থিব’ উপন্যাসে। ‘পূর্ণ অপূর্ণ’ উপন্যাসে সুরেশ্বরকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে, ভালোবাসার আলোয় হৈমন্তীকে রেখে লেখক আনতে চেয়েছেন সম্পর্ক নিরপেক্ষ নৈতিক ভাবাদর্শে। জ্ঞানী আলোচকের ভাষায় এখানে ‘বর্তমানের সত্তাতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্ব যুগলবন্দী রচনা করেছে।’ (তপোধীর ভট্টাচার্য) স্বভাবতই এধরনের উপন্যাস বস্তুসর্বস্ব জীবনানুসারী পাঠকের কাছে আকর্ষণ-বিস্তারী নয়। ফলে প্রেম-ও দূরাগত নিম সুরভির বার্তাবহ। (নিমফুলের গন্ধ) প্রসঙ্গত: স্মরণীয় মৃত্যু চেতনা, পূর্ণ চেতনা, একাকীত্ব চেতনা বিমল করের উপন্যাসে প্রাধান্য পেতে থাকে, ‘দেওয়াল’ প্রভৃতিতে যে এপিক চেতনা তা আর গুরুত্ব পায় না। যুগ চেতনা অপেক্ষা অন্তর্বীক্ষণ হয়ে ওঠে অন্বিষ্ট। ‘অসময়’ যেমন, প্রমাণ যাতে লেখক ‘মগ্নচৈতন্যের ডুবুরী’। (জহর সেন মজুমদার)।

এখানে লেখকের কিছু কথা প্রাসঙ্গিক। ক) বাল্যবধি আমি কিছুটা রুগ্ন। খ) বেনারসে কেরানির চাকরি জীবনে ‘মানসিক হতাশায় ভুগতাম। গ) ছোটগল্প লেখাই আমার প্রিয় ছিল। ঘ) রীতিমত তোড়জোড় করে ‘দেওয়াল’ লিখতে শুরু করলেও মনে হল ‘আমার আরও অনেক কথা বলার আছে অনেক কিছু দেখানোর রয়েছে।' ঙ) ‘দেওয়াল’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ ‘অনেক কিছুর আমি প্রত্যক্ষ দর্শক’, চ) খড়কুটো, পূর্ণ অপূর্ণ, অসময় প্রসঙ্গে বলছেন ‘কয়েকটি লেখাতে আমি আমার মানসিক দ্বন্দ্ব, কোনো কোনো ব্যক্তিগত অনুভূতি ও আত্মিক প্রশ্নকে নানাভাবে যাচাই করার চেষ্টা করেছি। … গোড়াকার দশ বারোটা বছরের সঙ্গে পরের পর্বের একটা তফাৎ আছে’। … ‘খড়কুটো’ উপন্যাসের মধ্যে যা ছিল আঁটো সাঁটো পূর্ণ অপূর্ণ উপন্যাসে আরও বৃহৎ করে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি’। …আমার অধিকাংশ লেখার মতন ‘অসময়’ উপন্যাসের কাহিনীগত অংশ অতি ক্ষীণ, শুধু চরিত্রগুলির মনের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, দুর্বলতা বিশ্বাস আত্মপ্রশ্ন ব্যক্ত করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল’। (আমার লেখা) বিমল করের উপন্যাস মালার দিকে সচেতন নজর দিলে পাঠক বুঝতে পারবেন ‘দেওয়াল’ প্রভৃতির মধ্যে যে যুগ অভিঘাত ছিল তা ক্রমশ: কমে এসেছে। যুগ চেতনা ও আত্মচেতনার দ্বন্দ্বে শেষোক্তই বড়ো হয়ে ওঠে। বিগ হাউসের চাকরিজীবী হিসেবে হয়তো এটাই হয়ে উঠেছিল পছন্দের। সুবোধ ঘোষের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। দুজনেই একই বিগ হাউসের কর্মী।

যুগ চেতনার গতিপ্রকৃতি অনুধাবন অপেক্ষা আত্মচেতনা এবং আঙ্গিক সচেতনায় বিমল কর উত্তর সূরীদের দৃষ্টি কাড়েন। ছোটগল্প নতুন রীতি আন্দোলনের তিনিই সারথী, এর লেখক ও লেখা দেশ / আনন্দবাজারের স্নেহধন্য। তাছাড়া একাকীত্ব, মৃত্যুভয়, দুর্নিবীক্ষ্য অসুখ, ভবঘুরেসি, বেকারত্ব নিরাসক্তি, প্রতীকাশ্রয় ইত্যাদির চেতনায় উত্তরপুরুষের বড়ো অংশের কাছে তিনি সমাদৃত।

ছোটগল্প রচনা মারফৎই তিনি রসিক পাঠক / লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অম্বিকানাথের মৃত্যু (১৯৪৩) পিয়ারী লাল বার্জ (১৯৪৮), ইঁদুর (১৯৫২), বরফ সাহেবের মেয়ে (১৯৫২), মানবপুত্র (১৯৫৩), পার্ক রোডের সেই বাড়ি (১৯৫৩) প্রথম দিকের দৃষ্টি আকর্ষণী গল্প। পাঁচের দশকেই গল্প সর্বাধিক, ছয়ের ও সাতের বা আটের দশকে ও প্রচুর, শেষ পর্বের ৫টি গল্প অন্য ধাঁচের, জনৈক আলোচক এই গল্প সাম্রাজ্যের ৭টি বিভাগ করেছেন- মধ্যবিত্তহীন, পতিতা জ(ঈবন, প্রেম, যৌবন পিপাসা, মনস্তাত্ত্বিক, শাশ্বত চেতনা (মৃত্যু), আত্মশুদ্ধির আকুলতা। এ হল বিষয় কেন্দ্রিকতা। আঙ্গিক চেতনা ও পৃথক ধাঁচের। দুটি ধরনেরই কিছু কিছু পরিচয় দেব।

চরিত্র প্রধান ‘পিয়ারীলাল বার্জ’ গল্পে লেখক চরিত্রটির নানা অদ্ভুতত্ব দেখাতে চান কোলিয়ারির পটভূমিকায়। মাউথ অর্গান বাজানো, বেপরোয়া ভাব, নারী আকর্ষণ এবং ফুটবল খেলা তাকে স্বতন্ত্র করেছে। সুক্ষ্মতা বিবর্জিত মানুষটি কৌশল্যা (পরস্ত্রী) সন্তানবর্তী করে। ‘ইঁদুর’ গল্পের মলিনা উপলব্ধি করে ‘ওর ইঁদুর তো বাইরে নেই- ঘরেই (মনে) রয়েছে। কুরকুর করে কাটছে দিনরাত। স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্যে ফাটলের এ গল্প প্রেমেন্দ্রকে স্মরণ করায়। সুবোধ ঘোষের স্পষ্ট প্রভাবে লেখা ‘যক্ষ’ (তুলনীয়- ফসিল) আবার ‘মানবপুত্র’ স্মরণ করায় কমলকুমারের ‘মতিলাল পাদরি’কে। রেস্টুরেন্টে কর্মরত কেষ্ট ও তার সঙ্গিনী ক্ষুধার্ত গঙ্গামণি মালিকের পদাঘাতে অকালে ভূমিষ্ট সন্তানের মধ্যে নির্বিশেষে মানবপুত্রকে আবিষ্কার করে। ‘আত্মজা’ গল্পের যূথিকা বাপ ও মেয়ের সম্পর্ককে কদর্থে ভাবে- ‘বীভৎস অন্ধকারের এ গল্প রক্ষণশীল পাথক সমাজে নিন্দিত হয়। ‘আঙুরলতা’ গল্প এক হা-ঘরে বেশ্যাকে নিয়ে লেখা, যার নিষ্ঠুর বাস্তবতা প্রেমেন্দ্রর বিক্ররত ক্ষুধার ফাঁদে’ স্মরণ করায়। ‘সুধাময়’ গল্পে ফোটে সংশয়, বিষাদ নি:সঙ্গতা বিচ্ছিন্নতা জনিত শূন্যতাবোধ যা যুগ প্রভাবিত কারণ বিমল- ঘনিষ্ঠ অনেক তরুণকে একই কারণে আকৃষ্ট করে। ‘সুধাময় গল্পের পর থেকে কয়েক বছর আমি যা লিখেছি তার বারো আনাই মানুষের দ্বিধা সংশয় ভয় উদ্বেগ এবং অসহায়তার কথা। তার গ্লানি এবং পাপের কথা’। এবং ‘বেঁচে থাকার কোনো সান্ত্বনা আমার নেই। এই জীবনেরই বা মূল্য কি? ‘জননী’ গল্পে কিঞ্চিৎ আত্মজৈবনিকতা। লেখক তার মাতৃবিয়োগের পর ভাই বোনেদের দোলাচল মনোবৃত্তি ও স্বীকারোক্তি- ‘মার হাতে কি দেবে?’ নিয়তির অমোঘ শক্তি ও পাশাপাশি। ‘শান্ত কাব্যময়তায় স্নিগ্ধ, পদবিন্যাসে পবিত্রতার আভাষমন্ডিত ভাষায় লেখা এই সব গল্প, কিন্তু অন্তর্নিহিত তীব্র চঞ্চল, আশ্রয় ভিখারী এক অসহায় যন্ত্রণা, অমোঘ মৃত্যুচেতনার দাহ, ঈশ্বরের বিকল্প সন্ধান গল্পগুলিকে একধরনের আশ্চর্য গতিবেগ দিয়েছিল। এই গল্পগুলি ততখানি বাস্তব যতখানি বাস্তব মানুষের রহস্যাবৃত অন্তর এবং তার জটিলতা’। (শীর্ষেন্দু) সিরিয়স গল্পের কেমিষ্ট্রি, চার তাস ইত্যাদি পূর্বজ চকিহু গল্পকারের মতো তিনি ও বিচিত্র অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের নানা চেহারা আনেন (যেমন- কাঁটালতা, নীরজা, মোহনা, সহচরী, মাছি প্রভৃতি) জীবনের সর্বত্র লক্ষ্য করেন নিয়তির অমোঘতা। প্রকৃতির ব্যাপ্ত ব্যবহার মনস্তত্ত্বের নানা দিক তুলে ধরতে সহায়ক হয়। যেমন- সন্ধ্যার সমুদ্রতটের ধূসরতা, সুধাময় চরিত্রের নি:সঙ্গতার দ্যোতক। ‘বেশ কিছুদিন ধরে আমি চার পাঁচটি গল্প লেখার কথা ভাবছি, যেগুলোর ধরন অ্যালিগরি গোছের। লেখাগুলো পড়লে আপাতত: মনে হবে, কোনও গ্রাম্য কিংবা লৌকিক কাইনী। যাতে থাকবে আধুনিক মনের পরিচয় বা পরম মানব সত্যের কথা। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯-এ লেখা এই পাঁচটি গল্প (সত্যদাস, কাম ও কামিনী, ফুটেছে কমলকলি, যুধিষ্ঠিরের আয়না, নদীর জলে ধরা ছোঁইয়ার খেলা) ‘উপাখ্যান মেলা’ নামে সংকলিত। কেউ কেউ এ গল্পগুলিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, কেউ বা টলস্টয়ের এ ধরনের গল্পের প্রসঙ্গ এনেছেন।

আঙ্গিক নৈপুণ্য তাঁর গল্প উপন্যাসকে উত্তরসূরী পাঠক ও লেখক দুই সম্প্রদায়ের কাছেই মনোযোগের বিষয় করেছে। কিছু কিছু কথা এ প্রসঙ্গে তোলা যাক। এক আলোচক বলেন, বিমল বাবুর গল্পে সত্যিকারের গল্প বলে কিছু নেই। তিনি কেবল ছবির পর ছবি তুলে ধরেন। তার মধ্যে অভিঘাত-ইঙ্গিত আনে পরিবেশ বর্ণনা, পাখির সেই বাড়ি, নিষাদ, জননী। তাঁর গল্প বড় বেশি মনন প্রধান, বিষাদ ঘন, অনুভববেদ্য। (সরোজমোহন মিত্র)।

শ্রীযুক্ত মিত্রে খেয়াল করেন নি তাই ভঙ্গিমাই গড়ে তোলে পরবর্তী গল্প, গল্পের আভাই যথেষ্ট আধুনিক গল্পে। কখনো নিয়তির অমোঘতা এসে যায় গল্পের সূচনা মন্তব্যে এবং সমাপ্তির মৃত্যুতে। যেমন- ‘নিষাদ’। শীর্ষেন্দুর ভাষায় ‘আত্মস্থ মগ্নতা’ বিমল করের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।

তাঁর অনেক গল্পে প্রতীকী ব্যঞ্জনা ধারণ করে থাকে সমগ্র গল্পটিকে। যেমন- ‘যযাতি’। গ্রামের পালাকার নীলকন্ঠ পালা লিখতে বসে। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুতে পালা এগোয় না। নীলকন্ঠ অবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী, সুখ আর ভোগের প্রত্যাশী। অন্যদিকে কুসুম, যার মুখে খুঁতের জন্যে বিয়ে হয় না। যৌবন ভিক্ষুক নীলকন্ঠ কুসুমে আকৃষ্ট, পুত্র প্রস্তাব করে কুসুমের সঙ্গে নীলকন্ঠের বিয়ের, পালা রচিত হয়- যযাতি। ‘ইঁদুর’ গল্পে প্রতীকায়িত মলিনার মন স্বামী যতিনের বেঁচে যাওয়া ‘ইঁদুর কল থেকে এবং বৃহত্তর পারিবারিক বিপর্যয় থেকে। কোনো কোনো গল্পে পরিণতির আভাস সূচনা থেকেই। যেমন- ‘আত্মজা’ এবং ‘নিষাদ’। হাবভাব সাজ পোষাকে পুতুলের মা যূথিকা, সমাপ্তিতে পঞ্চদশী কন্যার সঙ্গে স্ত্রীর তুলনা চেষ্টা। দ্বিতীয় গল্পের শুরুতে ‘ছেলেটি মরবে, লাইনে কাটা পড়েই মরবে একদিন’। শেষে ইঙ্গিতে জলকুর অনিবার্য মৃত্যু রেল লাইনেই। প্রকৃতির প্রতীক রূপ ব্যবহার আছে নানা গল্পে। যেমন- পলাশ, বকুল গন্ধ, উদ্ভিদ।

উপমা, চিত্রকল্পের ব্যবহারে তিনি নিপুণ শিল্পী। কিছু উদাহরণ-

১) দলে দলে গঙ্গামণিরা বেরিয়ে পড়লো গ্রাম ছেড়ে, ভিটেয় ভিটেয় পিত্তবমির থুথু ছিটিয়ে। (মানবপুত্র)।

২) বেলসেবুবের সাত অনুচর- সাত শয়তান অট্টহাস্য হাসছে’। (মানবপুত্র)। (অর্থাৎ কদর্য অবস্থা)

৩) ‘ধবধবে জ্যোৎস্নায় কাচঘর কুইকের রাজ্য যেন। দুধ- আলোর দেশ। তেপান্তর পুরী। (কাচঘর)।

৪) মনের বীজগণিত অয়াশোকের জানা ছিল না। (ভয়)।

৫) তার সামনে এক অভেদ্য অন্ধকারের নিটোল পর্দা ঝুলছে। (ঐ)।

৬) বিশ্বকর্মার অনুচরে গিস গিস করে উঠল পয়লা হল্ট। (যক্ষ)।

৭) রাজকুমারী ভিক্ষুণী সুপর্ণা নিষ্কম্প প্রদীপ শিখার মত স্থির জয়ে বসে আছে অশ্বপৃষ্ঠে। (ঐ)।

৮) কাঁচা রেল লাইনের পায়ে বাঁধা লিভারপুলের যন্ত্র- শাবক। (ঐ)

৯) এমন সময় বলাই এল- বসন্তের এক দমকা হাওয়ার মতই। (হাত)

১০) পান সাজার এই অবসরে মনটাকে একটু ছড়িয়ে দেয় চন্দনা। (পার্ক রোডের সেই বাড়ি)।

১১) শেষ দুপুরটুকু যেন ঘড়ির কাঁটায় টাইফয়েড জ্বরের মত জুড়ে বসে থাকল। (দুই বোন)।

১২) সদ্যক্রীত কাঁসার থালার মতন তাকে উজ্জ্বল ও বিচ্ছুরিত দেখাত। (উপাখ্যান)।

১৩) মীরার সুরক্ষিত স্তনযুগলের আকর্ষণ তাকে নতুন আলমারির চাবির মতন প্রলোভিত করে। (ঐ)

১৪) তুলোর আঁকা উড়লে দেখায় সেই রকম দৃষ্টি। (রামচরিত)।

উপন্যাসের ক্ষেত্রেও নানা নিরীক্ষা আছে।

ক) প্রথম স্মরণীয় উপন্যাস ‘দেওয়াল’ ত্রিপার্বিক- ছোটঘর, ছোটমন, ‘খোলা জানলা’।

খ) ‘অসময়’ উপন্যাসের গল্পটি হয়েছে ৬টি চরিত্রের মুখে- মোহিনী, অবিন, আয়না, সুহাস, জ্যাঠামশাই, শচিপতি। এখানে ‘বস্তুভার’ খুবই সামান্য।

গ) ‘খড়কুটো’ উপন্যাসের শুরু দেয়ালির বাজি পোড়ানোর উৎসবের ঔজ্জ্বলে। এর ১২টি অধ্যায়ে মঙ্গল সমাচারের বার্তা- ল্যাজেরাসের কাহিনী। ২য় অধ্যায়ে পুনরায় যীশু। এ উপন্যাস ভালোবাসার, যার উৎস বাইবেল। এ রচনা মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের অভিযান।

ঘ) ‘যদুবংশ’ উপন্যাসের প্রেরণা দি ইয়ং আসাসিন্স- লেখক নিজেই বলেন। ‘খোয়াই’ উপন্যাস প্রসঙ্গে লেখক বলেন আর্সকিন ক্যাল্ডওয়েল রচিত উপন্যাসের অভিঘাত আছে। (অনুমান- Tobacco Road এবং Gods Little Acre. তবে আঙ্গিক প্রসঙ্গে।

ঙ) ‘পূর্ণ অপূর্ণ’ উপন্যাসের ভাববস্তুতে আছে উপনিষদের প্রভাব।

‘ঔপন্যাসিকের বিষয়জ্ঞান প্রকৃতপক্ষে তার সময়জ্ঞান, সমাজজ্ঞান, ইতিহাসজ্ঞান এবং ব্যক্তিমানসের জ্ঞান এই সমস্তের সারাৎসার’। (সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়) মহৎ উপন্যাসের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ওয়ার অ্যান্ড পীস; ম্যাজিক মাউন্টেন, ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট প্রভৃতির উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে কমার্শিয়াল হাউসে স্থায়ী চাকরী পাবার পর বিমল করের বিষয়জ্ঞান নিয়ন্ত্রিত হতে লাগল পরোক্ষে। ফলে ‘দেওয়াল’-এ যে সম্ভাবনা তা ক্ষয়িত হল। ইতিহাস ও রাজনীতি তাঁকে গুরুত্বহীন করে দিতে হল। তবু তিনি শিল্প সন্ধানী, তাঁর লেখা থেকে শেখার আছে সদর্থক ও নঞর্থক অনেক কিছু। শতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলিতে এই কথাকটি না বললেই নয়।




(পরবাস-৮৪, ১০ অক্টোবর, ২০২১)