কুশ আশ্চর্য হল। এত বদলেছে রিফিউজি কলোনি! কাঁচা রাস্তা, টিমটিম লাইটপোস্ট, ড্রেনে ভিনভিন মশা... সার সার টালির বাড়িফাড়ি... সব উধাও! পলকা সেলোফেন মোড়া, নকল বিদেশ বিদেশ গন্ধ। এটা প্রতাপাদিত্য নগর তো? ...
গত সপ্তাহের কথা। কুশ পড়িয়ে ফিরছিল... হঠাৎ লাল সিগন্যাল ডাক দিয়ে ওঠে।
'মাস্টার!'
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, ঠিক পিছনে একটা ফান্টুস লোক। চকচকে পাওয়ার উইন্ডো কাচ নামিয়ে, মুখে শার্সি হাসি।
কুশ রীতিমতো আশ্চর্য, 'কুন্তল!'
সবুজ সংকেত, কর্কশ যানবাহনকে ভাঁজ মেরে কানে এল কুন্তলের চুক্কি। 'মাস্টার, কত খুঁজেছি তোমাকে। হরিহরনগরেও গেছিলাম। বাড়িতে এসো একদিন। মনে আছে তো?'
কুশের চোখ ঝলমল করছে--'হুঁ, আছে । প্রতাপাদিত্য…'
কুন্তল ব্যালেনোকে সাইড করে। ডিপার জ্বালিয়ে হুড়মুড়িয়ে কুশের গায়ের ওপর উঠে আসে প্রায়।
'গুরুদেব লোক! হোয়াটস্-অ্যাপটা বলো।'
কুশ হাসল, 'ওসব নেই!'
'ঢপ দিচ্ছ? '
'সত্যি। আমার আনস্মার্ট নম্বরটাই নাও।'কুশ নম্বর বলতে থাকে।
কুন্তল কিচকিচ করল, 'তুমি সেই বাবরের আমলেই পড়ে রইলে। এনিওয়ে তোমায় মিসডকল দিচ্ছি, দেখো। শেষে ... .চারটে-জিরো।'
বটগাছের নিচে বিমলের ঠেক। ওখানেই শুরু প্রতাপাদিত্য নগর। ঠেকটা আর নেই। এমনকি চারপাশেও ভোলবদল। এই গলির সোজা বগলামন্দির। কুন্তলদের বাড়িটা ছিল ঠিক ওর পাশেই। কুশের এখন সবকিছু অন্যরকম লাগছে। জলা-জমির বাড়ি ঘরদোর, একটা কিস্যু নেই। নম্বরও মিলছে না। কাছেই ওয়ার্ড অফিস।
'ওরে বাবা, এই চকচকে অফিসটা আবার কবে গজালো!'
তবে কুশের নজরে পড়ল না একঝাঁক স্প্লিন্টার দৃষ্টি, ওয়াচ করছে। ওদেরই একজন উঁচু গলায় পথ আটকায়।
'কাউকে খুঁজছেন?'
'হুঁ।'
'কোথায় যাবেন?'
'কুন্তলদের বাড়ি।'
'কুন্তল, মানে আমাদের কুন্তলদা?'
কুশ বিরক্ত হলেও উত্তর দেয়। 'হ্যাঁ হ্যাঁ। ওরা কী উঠে গেছে?'
'এঃ আগে বলবেন তো'একদঙ্গল চারাপোনা বিশ্রী শব্দ করে হাসে। তারপর একটা বাক্স দেখিয়ে বলল, 'পোনামীটা... .ঐখানে।'
'প্রণামী মানে?'
'দাদার নিয়ম। এলাকায় নতুন ঢুকলে দিতে হয়।'
'দিতে হয় মানে! কী দিতে হয়?'
'ওই যে বললাম , পোনামী... তারপর... .দাদা বলবেন।'
'যদি না দিই?'
অম্লান বদনে ঝাঁক থেকে উত্তর আসে, 'দেখা হবে না।'
'আমি কুন্তলের মাস্টারমশাই। আমাকেও দিতে হবে?'
চোয়াড়ে চেহারার ছেলেটি অধৈর্য হয়ে উঠল। 'ওসব মাস্টারফাস্টারের জন্য আলাদা রুল নেই। দাদার সঙ্গে পোনামী ছাড়া কথা হয়না। এই এ্যালাকাটা দেকচেন…'চোখের সামনে হাত ঘুরিয়ে দেখায়... 'ডিরেক্ট দাদার কন্টোলে। আপনার পবলেম কী হেক্কোড়?'
কুশ দাঁত চিপে বলে, 'কুন্তলের সঙ্গে দরকার, ওকেই বলব। প্রণামী যদি দিতে হয়, ওখানেই দেব।'
'ও। আরজেন কেস । এই গেদু, কাকার সঙ্গে যা।'
'না না দরকার নেই। কাউকে সঙ্গে যেতে হবে না।'
পান্ডাছেলেটা ধমকে ওঠে। 'আহ! আপনি পোচুর টাইম লিচ্ছেন। কেউ না গেলে ঢুকতে দেবে না।'
কুশের মনে হল ফিরে যায়। তারপর কী ভেবে বলল, 'চলুন।'
গেদু এতক্ষণে মুখ খুলেছে। খৈনীর ছোপ ধরা দাঁত। গলায় চৌকো নিকেলের মাদুলি। কালো সুতোয় বাঁধা। লুঙ্গি, আর জালি গেঞ্জি পরা। বিড়িটায় শেষটান দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
'চলুন, সামনেই মন্দির, ওর পাশে।'
'দাদার কন্টোলে' ... কথাটার কুশের কানেচোঁয়াঢেকুর তুলছে। কন্ট্রোলটা কী তা মালুম হচ্ছে। কুন্তল এখন, 'কুন্তলদা'! কুন্তলের চেহারাছবিটা যেন গনগনে উনুন, নীল আগুন। সারি সারি শিক বেঁধানো মাংস, ঝলসাচ্ছে।
গেদু একটা বিশাল অ্যাপার্টমেন্টের সামনে থামে। উঁচু বাউন্ডারি। মোটা লোহার পাতে চাকা লাগানো গেট। ভিতরে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে। গেটে সিকিউরিটি। আটকাতে এসে থেমে গেল।
গেদুকে চেনে।
কুশ জিজ্ঞেস করে, 'কুন্তল থাকে?'
সিকিউরিটি কথাটা পাত্তা দিলনা। গেদুকে বলল, 'বাক্সে ভরেছে?'
'না। বলচে অ্যাপোন্মেন। ডিরেক্ট বাতচিৎ।'
সিকিউরিটি তক্ষুণি ঘুরে কুশকে হুমকির সুরে জিজ্ঞেস করল, 'নাম কী?'
কুশ নিরুত্তাপ। এদের নাম বলা বেকার। কুন্তল এখন উঁচু চড়াইপথ। এখানে মাস্টার নামের কোন মূল্য নেই।
বরং গেদুই বলল, 'বলচে তো ম্যাস্টর।'
সিকিউরিটি ধমকে ওঠে। 'তুই থাম। ম্যাস্টর শুনে ভড়কে গেলি। ঢপও হতে পারে। কত এলি তেলি ম্যাস্টর দেকলাম।'
'ঠিক আচে। আমি তো যাচ্চি। ঢপ হলে বুঝে নেব।'
'দাঁড়া দাঁড়া। হড়বড় করিসনা। ফোন করি।'
মাস্টার নামের ইতিহাস আছে। কুশ পড়াত কুন্তলকে। এইটে ও ফেল করেছিল। কুশ এইটের ফার্স্টবয়। বাড়ি কাছাকাছি। কুশেরা থাকত হরিহরনগর। কুন্তলরা, প্রতাপাদিত্য। ইস্কুলে যেত একসাথে।
কুন্তলের বাবাই একদিন বললেন,
'বন্ধুকে অঙ্কটা একটু দেখিয়ে দাও না। বছরটা নষ্ট হল…'
'কী যে বলেন কাকু!'
'লজ্জা পাচ্ছ? মাস্টার হতে বয়েস লাগে না। বড় হলেই মাস্টার হওয়া যায়? তুমি পারবে। অঙ্কের ভীতিটা কাটিয়ে দাও। আজ থেকে তুমিই ওর মাস্টার।'
সেই শুরু। কাকু 'মাস্টার' বলতেন। সেই সঙ্গে কাকিমাও। পরে কুন্তলের বোন চারুকেশীকেও পড়তো। এতবছর পর সেদিনও দেখা হলে কুন্তল মাস্টারই ডেকেছিল।
কুন্তলের সেদিনের মাস্টার ডাকে ছিল উতলা সুর। কিন্তু সে সুরের এত ঘেরাটোপ! সিকিউরিটির চোখে বিরক্তি আর সন্দেহ।
গতরাতেও কুন্তলের ফোনেও ছিল অনুনয়। 'আগামীকাল আসছ তো মাস্টার!'
'আসব।'
'মাস্টার, কথা দিলে কিন্তু।'
'হুঁ।'
কুশ ভাবেনি আজ এই পরিস্থিতি হবে। আসার আগে কি ফোন করা উচিত ছিল? বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকতে হত না। কিন্তু কেন, কুন্তল এতই ইম্পরট্যান্ট! ইচ্ছে করলেই আসা যায়না! তবে ডেকেছিল কেন? এখন যা ঘটছে, সবই তো ওর মদতে!
ইন্টারকমে কথা হচ্ছে। গার্ড দূর থেকেই বলল, 'আপনার নাম জানতে চাইছে।'
কুশ বুঝল মাস্টার নামটা এদের কাছে অচলসিকি। তবে কেমন যেন জেদ চেপে গেছে। বলল, 'বললাম যে মাস্টার।'
সিকিউরিটি বলল, 'দাদা বাড়িতে নেই।'
বাড়িতে নেই! আমাকে আসতে বলে বাড়ি নেই! কুশের কথাটা বিশ্বাস হল না, ইতস্তত করে। 'একবার উপরে যাব?'
'কোথায় যাবেন?'
'কুন্তলের… ওর মা-বাবার কাছে।'
'ওনারা নেই।'
লোকটা নির্ঘাত মিথ্যে কথা বলছে।'একবার দেখা করতে পারি?'
'কার সাথে?'
'ঐ যে, যিনি বললেন কুন্তল নেই। আমার জরুরি কথা ছিল। বলেই চলে আসব। ‘গেদুকে দেখিয়ে কুশ কনভিন্স করাতে চায়। ঐ তো গেদুবাবু থাকবেন।'... আবার ভাবল বলেই দেয়। আপনাদের দাদার সঙ্গে গতকালও ফোনে কথা হয়েছে। না, সেসব কথা থাক। নিজেকে প্রমাণ দিতে হচ্ছে। এতেই মনটা প্রবল বিদ্রোহ করছে। কুন্তলের সঙ্গে ফোনে কথা বলব? ওর 'দাদা'ইজম, তোলাবাজির অসভ্যতা... ভেঙে যাক। যদি ধরেও নিই জরুরি কাজে ... বেরিয়েছে বাড়িতে... বলে যেতে পারল না?….
সিকিউরিটি কৃপা করেছে। কুশকে ভেতরে আসতে দেয়। গেদুর পেছন পেছন কুশ, সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সঙ্কুচিত, বাধো-বাধো পায়ে নির্দেশিত ভঙ্গিতে হাঁটছে।
লিফট অবধি এল। গেদু লিফটের বোতাম টিপল, এগারো।
কুশের ইচ্ছে করছে গেদুকে আচ্ছামতো বুঝিয়ে দেয়... তোমরা যার পায়ের নিচে গড়গড়ি খাও আমি তার মাস্টারমশাই...। এসব শুনে হয়ত গেদুর ঘটে কিছুই ঢুকবে না। বোকার মত তাকিয়ে থাকবে... থাক... কী লাভ ... লিফটের সিলিংয়ে কাঁচে গেদুর বিন্দু প্রতিচ্ছবি...। কুশের মনে হয় এখানে কুশ ঐ বিন্দুর চেয়েও অস্তিত্বহীন।
লিফট থামল। গেদু লবিতে হেঁটে এগিয়ে যায়। গেদু বেল বাজায়। কুশ একটু দূরেই থাকে।
একটা বাচ্চা দরজা খুলেছে। লালগেঞ্জি, হলুদ প্যান্ট। হুবহু চারুকেশী। নিশ্চয়ই কুন্তলের ছেলে। গেদু কিছু বলতে যাচ্ছিল। কুশ এগিয়ে এসে তার আগেই জিজ্ঞেস করে, 'কুন্তল কোথায় গেছে?
বাচ্চাটা একটু থামে। বড় বড় চোখে তোতলামি দৃষ্টি। কচি গলার উত্তর, 'বাবা... .বাবা...’ঢোঁক গিলে বলল, ‘ইয়ে... বাবা... .তো নেই।'
'মাকে ডাকবে?'
'আপনি কোথা থেকে আসছেন?'
'মাকে বলো, বাবার মাস্টারমশাই এসেছেন।'
মাস্টারমশাই পরিচয়ে বাচ্চাটা থতমত। 'আপনি বাবার স্যার! ওয়েট, ওয়েট। কলিং মাম্মি।'
একটু পরে কুন্তলই এল। আশ্চর্য শান্ত, স্বাভাবিক।
কুশ খুবই বিস্মিত, কিছু বলতে যাচ্ছিল। কুন্তল বাধা দেয়, 'এক মিনিট মাস্টার। গেদুকে রঙবাজের মত হুকুম করে, 'এই তুই ফোট এখন।'
গেদু চলে যেতেই একগাল হাসে। 'মাস্টার! এসো এসো।'
কুশের রাগটা বেরিয়ে এল, 'সত্যিই চেয়েছিলে আসি?'
'অন গড।'
'তাহলে হেকল করলে কেন?'
'ওসব ছাড়ো। ও সিস্টেমটা ফালতুদের জন্য।'
'ছাড়ব মানে?'
কুন্তলের ঘরে ঢুকতে বিস্বাদ লাগছে। সারা শরীর তেতো। কুন্তল একরকম হাত টেনেই ঘরে ঢোকায় কুশকে। 'রাগ কোরো না মাস্টার। ভেতরে এসো। কী খাবে বলো, চা না কফি?’
'কিছু না, আদিখ্যেতা রাখো।'
'একটু বোসো...’ছেলের দিকে ইশারা করে।
'বেটা আঙ্কেলকে একটু কোম্পানি দাও। অ্যাম কামিং।'
কুন্তল ভেতরে গেল। বাচ্চাটা কুশের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।
অপমানে শরীর জ্বলছে। কুশের গুমোট মনে ঘুরপাক খায় ভাদ্রের ক্রোধ। স্কাউন্ড্রেল... দাদাগিরি দেখাতে ডেকেছিলে?নেহাত ফোনে জোর করেছিলে... তা... চমক ভেঙ্গে গেল,
'আঙ্কেল, প্লিজ সিট ...'
কুশ একঝলক নজর করে। দিনের আলোয় ঝলমলে বারোতলা। বিশাল জানলা। বাহারি গ্রিল। বাবুতলার মোড়টা দেখা যাচ্ছে। মোড়ের মাথায় একটা বিশাল মোবাইল টাওয়ার। রাস্তায় চোখে পড়েনি তো!সারা ঘর জুড়ে কেতাদুরস্ত ফার্নিচার। গমগমে হলঘর, দেওয়াল ঘিরে কাঠের কাজে কমার্শিয়াল স্পেস ক্রাফ্টস। ছোট্ট ডোকরার দুর্গা, কাচ বাঁধানো। আড়াআড়ি রাখা। পেছনে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে লেখা: 'ইনসাইড আউট'।
হিসেব করে সাজানো শো-পিস, বিদেশি মদ, পেগ, আইফেল টাওয়ার, স্ট্যাচু অব লিবার্টি…জাপানি পুতুল...
রাতের ফোটোগ্রাফে কুন্তলের সঙ্গে একজন, অল্পবয়েসি মহিলা, শীতের পোশাক। আন্দাজে মনে হল বউ। কে জানে।
ছবিটার আকাশ জুড়ে সবুজ-হলুদ আলো, অরোরা বোরিয়ালিস!
ফেংশুই, ঝাড়বাতির টুংটাং। শনশন বাতাসের হা হা গোল্লাছুট।
কুন্তলদের বাড়িটাই যদি ভেঙে ফ্লাট হয়, এতটা জমি ছিল! মনে হল না। কে জানে, হতেও পারে। রাস্তা চওড়া হয়েছে, টালির বাড়ি সব থেঁতলে গিয়ে ভিনভিন করছে মাল্টিস্টোরিড। শিশুটাকে মিথ্যের তালিম দিচ্ছে। কুশ একবার ভাবল চলে যায়। ভাবনায় আরও কত ছবি... .
মাস্টার ডাকটাই যা আগের। সমস্ত বদলে গেছে। কাকু-কাকিমা এতক্ষণেও এলেন না!... কুন্তলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ফোটোগ্রাফির কোর্স অবধি। ততদিনে কুশ কলেজে পড়াচ্ছে। কখনও কখনও বাসে দেখা হত।
কুন্তলের পিসেমশাইয়ের গ্রিলের কারখানা, বিশ্বকর্মায় উনি নেমতন্ন করতেন। ধুমধাম ঘুড়ি ওড়াতেন। কাকু তখনও এইচএমভিতে। ক্যাসেট, ডিভিডির জোয়ার শুরু হয়েছে। কোম্পানি পিছু হটে গুটিয়ে টিমটিমে। ওদের সংসারে অর্থকষ্ট ছিল। তবে মা-বাবার চমৎকার বোঝাপড়া, আন্তরিকতায় ভরাট।
ছোট দু'কামরা, এক চিলতে বারান্দা। রোদের চেয়েও বেশি ঝলমল মায়ের সৌন্দর্যে। গায়ের রঙ এলিজাবথ টেলরের ক্লিওপেট্রা। আঙুলের প্রান্তভাগ টকটকে চেরি! রক্ত যেন জমাট বেঁধেছে। চারুও রূপসী। বাবার চেহারায় বৈপরীত্যের দীনতা, বেঁটেখাটো চাপারঙ। তবে কাকু-কাকিমার কখনও অশান্তি দেখেনি। কত ঘটনা! দাগ কেটে আছে...
ভিড় বাস, প্রথম গেটে উঠেছিল কুশ। লোকের ফাঁক দিয়ে দিয়ে দেখেছিল বাসে কাকু। কন্ডাক্টর আসতেই দুটো টিকিট কাটল। ভিড় পাতলা হতে কাকু এগিয়ে এল। 'মাস্টার, টিকিট করে ফেললে। আমারই তো কাটা উচিত ছিল।'
'তাতে কী?কেন কাকু, আমি তো এখন চাকরি করি।'
'না না। এসব বললে হয়?'
ততক্ষণে হরিহরনগর এসে গেছে। কুশ উঠে দাঁড়িয়েছে। 'কাকু, আসছি।' কুশ নেমে গেল।
সে রাতেই কাকু এসেছিল। কুশ তখন ডার্করুমে। 'কাকু তুমি! এত রাতে?'
মুঠোয় খুচরো টাকা। কুশের হাতে দিয়ে বলল, 'মাস্টার রাগ কোরো না। বাসভাড়াটা রাখো।'
কুশ অবাক,'কাকু এমন করে ভাড়া ফেরত দিও না। খারাপ লাগে।'
কাকু ঘোরপ্যাঁচ বুঝত না। সরল মনেই সেদিন ভাড়া দিতে এসেছিল। বলল, 'মাস্টার, তুমি কুন্তল হলে ভাড়া আমি কাটতাম না?'
চারুকে পড়াত কুশ, টাকা নিত না। ওদের সঙ্কোচ ছিল না। ঘটনাটা আজও ভুলতে পারেনি। চারু ততদিনে মাধ্যমিক পাশ করে গেছে তিনবছর।।
কুশ কাকিমাকে দেখল। পাশে চারুও দাঁড়িয়ে। সোনার দোকানে। হাতের চুড়িগুলো খুলে খুলে রাখছে। কাকিমা গয়না বিক্রি করছে!
কুন্তল কি কিছুই করে না? না হলে...?
সেদিনই কাকিমা ফোন করেছিল। রাস্তার ফোনবুথ থেকে।'মাস্টার। সন্ধ্যায় একবার আসতে পারবে?’
'কাকুর শরীর ভালো?'
'ঐ চলছে। এসো কিন্তু।'
কুন্তলদের বাড়িতে এসেছিল। কুন্তল বাড়ি ছিল না।
খানিকপর চারু ফিরল ।
চারু বলল, 'মাস্টার! এসে গেছো। একমিনিট, আসছি।'
'এতক্ষণ কোথায় ছিলিস?'
'নাচ শেখাতে গেছিলাম।'
কুশ বলল, 'কী ব্যাপার রে?'
'কীসের?'
কাকিমা ফোন করেছিল, জানিস?'
'হুঁ।'
'কেন আসতে বলেছে?’
চারু হাসে, 'আমি কী জানি!'
তবে চারুর চোখের ভাষা অন্য।
'বলবি না?'
'সত্যি, জানি না।'
সাতটায় কাকু অফিস থেকে ফিরল।
চারু অনেক কথা বলে যাচ্ছিল, কুশ একমনে শুনছে। কাকু-কাকিমা এলেন। কাকুর হাতে খাম। এগিয়ে দিয়ে কাতর গলায় মিনতি করে, 'মাস্টার। এটা নিতেই হবে।'
'কী আছে এতে কাকু?'
কাকিমা উত্তর দেয়, 'মিথ্যে বলব না, মাস্টার। এতে চারুকে পড়ানোর বেতন আছে।'
কাকিমার কথার সারল্য, ধূপের ধোঁয়া। প্রতাপাদিত্য নগরের রাত ভ'রে ওঠে।
'বেতন কেন! আমি চেয়েছি?'
'না, চাওনি।'
কুশের অভিমানী সুর। 'ভরসা করতে পারলে না। তাই এতদিন পরেও...' কুশ গয়নার ঘটনাটা বলতে পারেনি।
কাকু চুপ। কাকিমার চোখে ক্ষীণ জলের আভাস। অভাবের নুড়ি-পাথর চাপা দীর্ঘশ্বাস ঝরনা। বলল, 'আচ্ছা বেশ নিও না।'
'একটা কথা বলো, এ টাকা কোথায় পেলে?'
জানতাম কাকু আবোলতাবোল উত্তর দেবে না। বলল, 'কোম্পানি বন্ধ হয়েছে পাঁচবছর। এতদিন মামলা চলছিল। কাল রায় বেরিয়েছে। ভিআরএসের এককালীন বেতন। পাকাপাকি চাকরিটা গেল।'
তিনবছর! মানুষের এত কৃতজ্ঞতাও থাকে। অনুরোধ ফেলতে মনটা খচখচ করছিল, গয়না বিক্রির টাকা নয়তো? অথচ না নিলে, সারল্য অসম্মানিত।
কুশ দোটানায় পড়ল।
'আচ্ছা বেশ। চারু চোখ বোজ। এই খামের টাকা আন্দাজে, সমান সমান দশভাগ করবি। একভাগ নেব, তোর হাত থেকে। ঠিক আছে?'
চারুকেশী গাঁইগুঁই করে শেষমেশ একভাগ তুলল। ... ওর টাকাভর্তি মুঠি চেপে ধরে কুশ।
'টাকাটা এখন আমার। আমি এবার আমার চারুকে দিলাম। বিয়ের উপহার।'
চারুর মুখ নিচু, মুখের ক্যানভাসে ধ্যাবড়ানো উচ্ছ্বাসরঙে হঠাৎ জল বেশি হলে যা হয়, রঙ গড়িয়ে যাচ্ছে।
'এখন নতুন কিছু করার কথা ভাবছ কি কাকু?'
'দেখি। মেয়েটার বিয়ে হলে শান্তি।' কাকুর গলায় কষ্ট, ড্রিবল করে হাসি ছুটছে। 'কুন্তল না হয় ব্যবসাপত্তর... . বুড়োবুড়ির ভাবনা কী?'
'কীসের বিজনেস?'
'এমন কিছু, যাতে মানুষকে ঠকাতে না হয়।'
কুন্তলের সঙ্গে বহুদিন আগে শেষবার দেখা হয়েছিল হঠাৎ। অ্যাকাডেমিতে নাট্যোৎসব চলছিল। চারুর নাটক ছিল।
'আরে, আজ তো বোনেরও নাটক আছে।'সেদিনের শেষ একাঙ্কটা চারুর । চমৎকার প্রমিসিং অভিনয়। কুন্তল তখনও বেকার। চাকরিবাকরির চেষ্টা করছে বলেছিল।
কুশ অনেকবার বলেছিল, 'কিছু করো। না হয় ফোটোগ্রাফিটাই শিখে ... .'
এসব কথা হত ডার্করুমে। নেগেটিভ ডেভেলপমেন্টের হয় ধূপের আলোয় কাজ। ছায়া ছায়া আলো... সেসব অনেক ইতিহাস। …
বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়েছিল কুশ। ক্রমশ জ্বালাধরা ভাবটা উবে যাচ্ছে।
ভালো করে দেখে, মুখের আদলে চারুর উপস্থিতি। বাচ্চাটার দৃষ্টিতে কৌতূহল, কুশের আন্তরিকতা প্রার্থনা করছে। কুশ ইঙ্গিতে ডাকল। বাচ্চাটাও যেন এমন অপেক্ষাতেই ছিল। খরগোশ লাফে সোফা পাল্টে কুশের গা ঘেঁষে বসে, নিঃসঙ্কোচ। কচি গলায় ফিসফিস করে।
'তুমি ড্যাডির টিচার!' মিষ্টি হাওয়ার ঝলকানি। কাঁপন ধরিয়ে উইন্ডচাইমের টুংটাং। কুশের 'ইয়েস'কে আহ্লাদে বুড়ি ছুঁয়ে শিশুটি অকপট। 'ড্যাডি ন্যু... ইউ আর কামিং?'
'অফকোর্স, ইয়োর ড্যাডি ইনভাইটেড মি।'কুশ জিজ্ঞেস করে, 'ডিড হি টেল য়্যু অ্যাবাউট দিস কামিং?
'নট এক্সাজক্টলি, বাট আই ইভস-ড্রপড। হোয়াইল টেলিং মম…'
কুশ বলল, 'এন্ড... হি কম্পেলড য়্যু টু টেল…’
কুন্তলের ছেলে চোখ মুছছে মুছতে বলল, 'আই... রিফিউজড, আই রিফিউজড... বাট... বাট...’
শব্দ উড়ে যাচ্ছে মোবাইল টাওয়ারের কাকতাড়ুয়া পাহারার স্তব্ধতার দিকে ।
কুশ জিজ্ঞেস করল, 'তোমার নাম কী?'
'রাজা।'
'ওহ, রা... জা.!আহা.আইমিন... কিং! গ্রেট নেম।'
'নট অ্যাট অল গ্রেট…হ্যাভ য়্যু এভার সিন ... আ.কিং ... লিভস ইন কেজ? আই হেট টু বি আ কিং আই..ডোন্নো…'শব্দগুলো হৃদয়স্থ টাইম-ক্যাপসুল, ফেটে পড়েছে। লক্ষকোটি অনুভবের ফসিল, বারোতলায় উইন্ডচাইমে পাগলাঘন্টি, ঢং ঢং ঢং...
'ওহ! নো...’ কুশ আদর করে কাছে টেনে নেয়, 'ওক্কে ওক্কে... হোয়াট য়্যু ওয়ান্ট…টু বি….'
'পিজিয়ন। হোয়াইট পিজিয়ন... ইন ডিপব্লু... স্কাই…' অস্পষ্ট সুর... বিষন্ন কচি কলাপাতা রঙ ছড়িয়ে যায়, 'পিসি ইউজড টু কল মি…সুদর্শন... ইভল... ড্যাডি... .কিকড দেম আউট...’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে ধীরে কান্নার মগ্নতায় ডুবে যাচ্ছে রাজা... .নির্জন ইচ্ছের পেঁজা মেঘভেসে বেড়ায়… 'ইফ আই ওয়্যার... আ... পিজিয়ন... আই'ল অলসো ... এসকেপ...’
এই শিশুকে 'চিয়ার আপ! মাই চাইল্ড' বলার জোর কুশের নেই। অবশ, অপ্রকাশ্য ক্রন্দন... বারোতলা গাঢ় অন্ধকার। বিবিধ আহত চোরাবালি। ডার্রুুশমে ... অসমাপ্ত অসংখ্য নির্বাক আনন্দচিত্র... ক্লোরোকুইনন ডেভলাপারের স্মৃতিতে ডুবোজাহাজ...
'মাস্টার!' ডাকে চমক ভাঙে।
উন্মুক্ত রাজা পুনরায় খোলসে, গম্ভীর। চট করে সোফায় 'ডিসেন্ট'। কুন্তল আসছে, মহাসমুদ্র পার হয়ে হয়ে... জলদস্যুর মত, ডার্করুমের অন্ধকার খানখান।
ট্রলিতে চায়ের সরঞ্জাম। পেছনে সেই ছবির মহিলা। পেয়ালার ঠুংঠুং।
'আমার বউ, মঞ্জু।'
প্রণাম করতে এলে কুশ বাধা দেয়। 'থাক। থাক।'
কুন্তল মুখোমুখি বসেছে। তৃপ্ত হাসি। মঞ্জুর দিকে কাঁধ নাচায়, 'তোমাকে বলেছিলাম না, এই হল সেই মাস্টার।'
মঞ্জু চা ঢালছে। গা ভর্তি গয়না। ঝিনিক ঝিনিক চুড়ি থামছে, উঠছে, নামছে। ঝুমকোর দুলুনি, বড় বড় গোপন আহ্লাদের ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ।
'চা খাই না।'
'ওহ। সরি। কফি?'
'না।'কুশ অধৈর্য, 'চারুকে দেখছি না। কাকু-কাকিমা?'
'মাস্টার, ওদের কথা ছাড়ো। সে অনেক ক্যাচাল। হেব্বি ঢ্যামনামি। সব ফুটিয়ে দিয়েছি। ওনলি আমি, বউ, ছেলে। হ্যাপি ফ্যামিলি।'
কুশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। কুন্তল এখন খুঁটিয়ে দেখার মতই। থুতনিতে চর্বির অত্যাচার। জামাকাপড়ে চেকনাই, সোনার মোড়ক, টেবিলে আইফোন, দামী সিগারেট।
'মাস্টার স্কচ খাবে তো বলো।'
সেলার টেনে নীল রঙের বোতল হাতে নেয়। কুশ খেয়াল করল বোতলটা এক লাস্যময়ী নগ্নিকার আদল।
'আরে একবার চেখে তো দেখো, হেব্বি জিনিস। সিক্সটি টু ইয়ার্স। চিভাস রিগাল, স্কটল্যান্ড।'
কুশের নিঃশব্দ অসম্মতি।
'মাস্টার। লাইফ এনজয় করে নাও।' কুন্তল হাসছে। আগে তো হাসলে দু'গালে টোল পড়ত। এখন চর্বির মানচিত্রে হারিয়েছে।
কুশের মনে উপড়ে যাওয়া ঘুড়ির অনুভব। যুৎসই প্রত্যুত্তরে হয়ত ভেতরটা শান্ত হত। দীর্ঘ বন্ধুত্বেকে মাড়িয়ে যাচ্ছে স্টীমরোলার। ইচ্ছের হাড়গোড়ের গুঁড়ো গুঁড়ো। কুশ তবু জিজ্ঞেস করল। ছাইওড়া গলার স্বর, 'কুন্তল, এখন কী করো?'
হিংয়ের কচুরির মত ফোলা ফোলা হাসিতে উত্তর দিল, 'ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট। নিজের কোম্পানি, বিভিন্ন কর্পোরেট ক্লায়েন্ট। হেকলিং ডিফিউজাল স্কোয়াড, ইনফিনিটি বিল্ডিংয়ে অফিস, ফিফথ ফ্লোর। একুশজন স্টাফ রেখেছি।'
কুশ বুঝেছে সবই। স্টাফ না হাতি! আসলে তো বাউন্সার… বলতে লজ্জা হচ্ছে হারামজাদা…?
'প্রতাপাদিত্য নগর দেখছ, এই শর্মার গড়া। সব বুলডোজারে ঝিনচ্যাক, হাইরাইজ ফিনিশ। মাস্টার একটা জিনিস দেখাই।’ কুন্তল ম্যাকবুক খুলল। পাওয়ার পয়েন্টে চিৎ হয়ে আছে হেভিওয়েট কেষ্টবিষ্টু, আমে-দুধে লুটোপুটি কুন্তল। ধেৎ এসব ভালো লাগছে না।
মঞ্জু, কুন্তল পাশাপাশি। ছেলে সিঙ্গল চেয়ারে।
কাকু-কাকিমা... চারু সবাই নিরুদ্দেশ…। আশা করেছিল দেখা হলে.. গল্পগাছা... চারুর অভিনয়টা… সব ... হারানো নীলকন্ঠ পালক...
অন্যমনস্ক কুশ। কানে ঢুকছে কুন্তলের খোয়াবনামা?
'নেক্সট-ইয়ার রাজাকে হংকংয়ে ... ... চাইনিজ শিখে ... অক্সফোর্ড ….’
কুশের ক্ষীণ স্বগতোক্তি, 'তারপর?'
'মাস্টার, জমানা বদল। তুমি চান্স পেয়েও ফালতু ফরেনে গেলে না। দেশে পেছন ঘষছো। ছেলেকে ট্রিকস শিখিয়েছি। বেটা গাছে চড়বি তো মগডালই বেস্ট। গো ফর দ্য মগডাল, নাথিং লেস। ওয়েল সেটেলড… এদেশটা ঝাড়…'
কুশ বলে, 'খুশি হও দূরে গেলে?'
'খুশি মানে! আওয়ার ওনলি ড্রিম, ফ্রি-লাইফ, নো হিকাপস...'
কুশের চারপাশ বক্রী অন্ধকার। ঘরে কুন্তলের আঁশওঠা গন্ডারের বহুশৃঙ্গ অহমিকা উড়ছে।
জানলায় একটা সাদা পায়রা উড়ে এসেছে। গ্রিলে ডানা ঝাপটায়। উচ্ছ্বসিত রাজা, আনন্দে ছুটে এল। নিমেষে গ্রিলের খাঁচা ভেঙে ছোট্ট দেহ, শিশু সুদর্শন, নীল নিঃসীম বিন্দু...
মঞ্জুদের তীক্ষ্ণ আতর্নাদ।
'মাস্টার ... রাজা!'
(পরবাস-৮৫, ১০ জানুয়ারি, ২০২২)