Subscribe to Magazines



পরবাসে
অংকুর সাহার

আরো লেখা


ISSN 1563-8685




মহাশ্বেতার গোড়ার কথা: সিপাহী বিদ্রোহের সমাজ সচেতন ইতিহাস

।। ১।।

ঠিকঠাক মনে পড়ে না কোন সাল সেটা - ১৯৭২, ১৯৭৩ না কি ১৯৭৪; খুব সম্ভবত ১৯৭৩; আজ আর মনে নেই কোন সিনেমা পত্রিকার শারদ সংখ্যা - উল্টোরথ, প্রসাদ অথবা জলসা; খুব সম্ভবত প্রসাদ। কোন বামপন্থী পত্রিকা নয়, কোন বুদ্ধিজীবি-নির্ভর লিটল ম্যাগাজিন নয়, বাজারি সিনেমার কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ দশাব্দের শ্রেষ্ঠতম উপন্যাসটি - “হাজার চুরাশির মা” - রক্তক্ষয়ী, সর্বনাশী, যন্ত্রণা আর বিলাপে আকীর্ণ সময়টির নির্যাস। নকশাল আন্দোলন ছিল খবরের কাগজের কাহিনী - দূরের জলপাইগুড়ির, কুচবিহারের অথবা মেদিনীপুরের ‘পাশাপাশি’ দুটি গ্রাম ডেবরা আর গোপীবল্লভপুরের - এবং ততদিনে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে মূল আন্দোলনের, চলছে বদলা আর প্রতিশোধের মহড়া - কিন্তু ব্রতী, সুজাতা আর দিব্যনাথের মাধ্যমে তার চিরকালের জন্যে প্রবেশ ঘটল মধ্যবিত্তের শয়নকক্ষে, ড্রইংরুমে অথবা হেঁশেলে। আর দিনে রাস্তায় পোস্টার বা দেয়াল লিখন দেখা আর রাতে গুলি বোমার শব্দ শোনাই নয়, এবার তাঁদের নিজের, ভাইয়ের অথবা সন্তানের আপন মুখচ্ছবি।

আমার সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর পরিচয় অবশ্য তারও বেশ কিছু বছর আগে, “সন্দেশ” পত্রিকার মাধ্যমে। অনিয়মিতভাবে হলেও সেখানে লিখতেন তিনি, শারদ সংখ্যায় তো বটেই। দ্বিপদ এবং চতুষ্পদ সব অসাধারণ চরিত্র - বিরে ডাকাত, ছিরে ডাকাত, ন্যাদোস। খুব সম্ভবত সেখানেই পড়েছি ‘এক কড়ির সাধ’ অথবা ‘আর্মানী চাঁপার গাছ’। আরেকটু বড় হবার পরে পড়েছি তাঁর রচিত দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। ইশকুলে পড়ি তখন, কোন কারণে মেদিনীপুর থেকে গিয়েছিলাম কলকাতায় এক দিনের জন্যে। বিকেলে হাওড়া স্টেশানে ফেরার পথে কলেজ স্ট্রীটে নেমে কিছু বইপত্তর কেনা; তার মধ্যে মহাশ্বেতা দেবীর “আঁধার মানিক”- বাংলা দেশে বর্গির আক্রমণের করুণ কাহিনী। রাজারাজড়ার বিলাসিতার বর্ণনা নয়; সাধারণ মানুষের রুক্ষ কঠোর জীবন যাপনের কাহিনী। বাঙালির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে ধরে রেখেছেন তিনি তাঁর সমাজ সচেতন ক্যানভাসে। পরবর্তী কয়েক দশকেও বর্গির আক্রমণ বা অত্যাচার বিষয়ে কোন প্রামান্য বাংলা গ্রন্থ চোখে পড়ে নি। আমার কাছে এই উপন্যাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং অবাক করে দেওয়া তথ্যটি হল বাঙালির বাস্তুচ্যূতি ও অভিবাসনের অন্তহীন পুনরাবৃত্তির - বর্গিরা ভয় পেত জলকে, তারা নদী পার হতে চাইত না। তাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে পশ্চিমবাংলার গৃহহীন সম্বলহীন মানুষেরা গঙ্গা ও পদ্মা পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পূর্ব বাংলায়। দুশো বছর পরে বিংশ শতকের মাঝামাঝি তাঁদের একটা বড় অংশকে ফিরে আসতে হয় পশ্চিমবাংলায়, আবার বাস্তুহীন, গৃহহীন, কপর্দকহীন!

আমি ‘আঁধার মানিক’ পড়ছি শুনে উৎসাহিত হলেন অগ্রজপ্রতিম কবি বীতশোক ভট্টাচার্য। তাঁরই প্রণোদনায় লাইব্রেরি থেকে এনে পড়লাম আর একটি মহতী উপন্যাস “কবি বন্দঘটী গাঞ্চির জীবন ও মৃত্যু”। আরো দুশো বছর পিছিয়ে ষোড়শ শতাব্দীতে - ধর্মগুরু ও সমাজ সংস্কারক মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৪) সমসময়ে। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক এই দুই বিপরীত স্রোতের টানাপোড়েনে গড়ে উঠেছে মহাশ্বেতার সাহিত্যবিশ্ব। এখানে কাহিনীর কেন্দ্রে মেদিনীপুরের চুয়াড় সমাজের এক আরণ্যক, আদিবাসী কবি। তিনি অন্ত্যজ মানুষ, তাঁর সৃষ্টির দিগন্তটি প্রসারিত - কিন্তু বর্ণহিন্দু শাসিত সমাজ মেনে নেয় না তাকে; ব্রাহ্মণ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের হাতে তাঁর কঠিন, অমোঘ, করুণ, অত্যাচারিত মৃত্যু। রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে পৌঁছে দেন সমাজ সচেতন রাজনীতির কঠিন বাস্তবে প্রোথিত তত্ত্বগুলিকে।

এসব অবশ্য অনেক বছর আগেকার কথা। ইদানীংকালে তাঁর বইপত্তর হাতে আসে না বিশেষ; মাঝেমধ্যে উত্তপ্ত, শাণিত, রক্তাক্ত কিছু অসাধারণ ছোটগল্প ছাড়া। ক্যালিফোর্নিয়ার স্থানীয় জনগ্রন্থাগারে তাঁর আধডজনের মতন বাংলা বই রয়েছে - সেগুলি পড়া হয়ে গেছে কবেই - তাদের প্রকাশনায় অযত্ন আর অবহেলা দেখে কান্না এসে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দেখি তাঁর সুপ্রকাশিত কিছু ইংরেজি অনুবাদ, অনেকগুলি হিন্দি অনুবাদ, আর গুজরাতি, মালয়ালম ও কানাড়া ভাষাতেও অল্প কিছু। বিভিন্ন ভাষাভাষী পাঠক পাঠিকার মননে পৌঁছে যাচ্ছেন তিনি, সেটা সুসংবাদ।

।। ২ ।।

সম্প্রতি মহাশ্বেতা দেবীর “ঝাঁসির রাণী” গ্রন্থটি পাঠের সুযোগ পেলাম - তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। রচনাটি উপন্যাস নয় জীবনী সাহিত্য(১) বা নন-ফিকশান। প্রথমে প্রকাশ সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঁচ মাস ধরে, ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। গ্রন্থাকারে প্রকাশ শ্রাবণ ১৩৬৩ (জুলাই - আগস্ট ১৯৫৬); প্রকাশক নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। ২৩৫ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির আরো তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে পরবর্তীকালে। হয়ত সিপাহী বিদ্রোহের আগতপ্রায় শতবর্ষ এই গ্রন্থের অন্যতম অনুপ্রেরণা। এবং শৈশবে দিদিমার কাছে ঝাঁসির রাণীর রূপকথার মত গল্প শোনার স্মৃতি লেখিকা উল্লেখ করেছেন গ্রন্থটির ভূমিকার শুরুতে।

মহাশ্বেতা দেবীর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে খগেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদিত “রংমশাল” কাগজে। তখন তিনি কলকাতার বেলতলা গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। রচনাটির বিষয় রবীন্দ্রনাথের “ছেলেবেলা” বইটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া। এর পরে মৌচাক পত্রিকায় কিছু শিশু ও কিশোর পাঠ্য রচনা লিখেছিলেন তিনি, তার মধ্যে একটির নাম “আলো হাতে”। ১৯৫২ সাল থেকে তিনি সুমিত্রা দেবী ছদ্ম নামে গল্প লিখতে শুরু করেন “সচিত্র ভারত” পত্রিকায় - গল্পগুলি হাল্কা মেজাজের এবং হাস্যপরিহাসের। এইভাবেই চলে তাঁর ঝাঁসির রাণীর প্রস্তুতিপর্ব এবং গ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকেই তাঁর সাহিত্যিক হিশেবে অর্থ উপার্জনের সূচনা।

লেখিকার জবানীতে “এ গ্রন্থ প্রচলিত অর্থে ইতিহাস নয়, রানির জীবনচরিত লেখার বিনীত প্রচেষ্টা মাত্র”। অন্য একটি নিবন্ধে তিনি জানিয়েছেন, “ঝাঁসির রাণী” উপন্যাস নয়। পণ্ডিতেরা পাত্তা দেবেন না যাকে, তেমন এক ইংরেজি ডিগ্রিধারী নির্বোধ মানুষের অক্ষম প্রচেষ্টা ইতিহাসাশ্রিত জীবনী রচনায়। জীবনভোর অনেক অদ্ভুত কাজ করে যাচ্ছি এভাবে। মূলধন নির্বোধিতা ও জেদ। “ঝাঁসির রাণী” তার প্রথম পরিচয়। অবশ্য মূল জায়গা থেকে আমি সরিনি। মূল জায়গার ব্যাপারটি হল, কোনো ব্যাপারের যথার্থ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত পেতে হলে কাগজে ও নথিপত্র গবেষণা যথেষ্ট নয়। লোকগাথা-গীতিকবিতায়, অর্থাৎ লোকবৃত্তে সে ব্যাপারটির যতটা পরিচয় মেলে তাকেও মর্যাদা দিতে হবে।” সত্যি সত্যিই গ্রন্থের তথ্য এবং মাটির মানুষের থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের সাবলীল মিশ্রণেই রূপ পেয়েছে গ্রন্থটি।

১৯৫২ সালে স্বামী বিজন ভট্টাচার্য আর শিশুপুত্র নবারুণকে সঙ্গে নিয়ে মহাশ্বেতা বোম্বাই গেলেন। বিজন সেখানে হিন্দি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখবেন। তাঁরা উঠেছিলেন মহাশ্বেতার বড়মামা শচীন চৌধুরীর চার্চিল চেম্বার্সের বাড়িতে। শচীন ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি কাগজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তাঁর গ্রন্থাগারে অন্যান্য ইতিহাস প্রসঙ্গের গ্রন্থের সঙ্গে তিনি পড়েছিলেন সাভারকার রচিত “১৮৫৭”। সেই থেকেই বিষয়টি ঘুরতে থাকে তাঁর মনের মধ্যে। স্বল্পকাল বোম্বাইতে কাটিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরলেন এবং সমানে চলতে থাকল উপাদান সংগ্রহের কাজ। কাজে উৎসাহ দিয়েছিলেন ডক্টর প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত এবং সাহায্য করেছিলেন বইপত্র দিয়ে। পদ্মপুকুর ল্যান্সডাউনের মোড়ে তাঁর বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে জাতীয় গ্রন্থাগারে যেতেন তথ্য সংগ্রহের কাজে। কাজকর্ম খানিকটা এগুলে তিনি আমেদাবাদের ইতিহাস কংগ্রেসে গেলেন রানির ভাইপো গোবিন্দরাম চিন্তামণি তাম্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সাহায্য করেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যেরা। ডক্টর মহাদেব প্রসাদ যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন ঝাঁসিতে তাঁর পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে।

এইভাবে গ্রন্থকীটের কাজের পাশাপাশি শুরু হল ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ - ঝাঁসী, গোয়ালিয়র, বুন্দেলখণ্ড - মধ্য পশ্চিম ভারতের গ্রামে ও শহরে; লোকগীতি, ছড়া, মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত উপকথা থেকে কাহিনির উপাদান সংগ্রহ করেন। লেখিকার নিজের কথায়, “এই বই লেখার সময় আমি প্রমাণ রেখেছি,

(১) আমি গণবৃত্তের ইতিহাসে বিশ্বাসী;

(২) সিপাহী বিদ্রোহ বা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম মূলত কৃষকদের সংগ্রাম;

(৩) ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে লোকবৃত্তের গান গাথা এসব মূল্যবান সম্পদ;

(৪) লক্ষ্মীবাঈ এজন্যে স্মরণীয়, ইংরেজ ঐতিহাসিকেরাও স্বীকার করেছেন যে রাণীকে কেন্দ্র করে মধ্যভারতে এক ব্যপক গণ অভ্যুত্থান গড়ে উঠেছিল।”

ঝাঁসী ও তার আশেপাশের অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করে রানির মৃত্যু হয়নি। অনেক জ্যোৎস্নারাতে সেই বাইশ বছর বয়েসি রানিকে নাকি দেখতে পাওয়া যায় শিশুপুত্রকে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি চলেছেন। লেখিকা দেখে এসেছেন রানির কেল্লা - সেখানে ইংরেজের কামানের গোলার ক্ষতচিহ্ন; রয়েছে রানির দুই প্রিয় কামান - ভবানীশঙ্কর আর কড়কবিজলী; দেখে এসেছেন গোয়ালিয়রে তাঁর অন্তিমশয্যার পুণ্য স্থানটি। এইভাবেই টুকরো টুকরো তথ্য থেকে গড়ে উঠেছে কাহিনি - রানির জীবনের, মৃত্যুর, শাসনের, সংগ্রামের। গ্রন্থের পটভূমি থেকে, “সেসব কথা জানতে হলে চলে যেতে হবে একশো বছর আগেকার বুন্দেলখণ্ডে। জানতে হবে ঝাঁসীকে। আর যেতে হবে তীর্থযাত্রার মন নিয়ে। কেন না রানি লক্ষ্মীবাঈ তো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং একক চরিত্র নন। শতাধিক বছর আগে ভারতবর্ষের বুকে বুটপরা পা রেখে মাড়িয়ে দিয়েছিল ইংরেজ। ভারতবর্ষের পাঁজর ভেঙে আর্তনাদ উঠেছিল সেদিন। সেই আর্তনাদই পরে মুখর হয়ে উঠেছিল একটি প্রতিবাদের সমুদ্রগর্জনে। কেঁপে গিয়েছিল তাতে শাসকের সিংহাসন।”

যাঁর আন্তরিক সহায়তায় রচিত হল গ্রন্থটি, সেই গোবিন্দরাম চিন্তামণি তাম্বের মৃত্যু ঘটল গ্রন্থটি প্রকাশের ঠিক আগেই। তাঁর পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশেই গ্রন্থটি উৎসর্গ করলেন মহাশ্বেতা।

।। ৩ ।।

“ঝাঁসির রাণী”র পরে আরো চার দশাব্দ পেরিয়ে, তাঁর ইংরেজিতে অনূদিত একটি গল্প সংকলনের ভূমিকায় মহাশ্বেতা লিখবেন, “I believe in documentation. After reading my work, the reader should face the truth of facts, and feel duly ashamed of the true face of India. To fully understand these stories, one must have a knowledge of the agriculture economy and land relations; because castle and class exploitations and the resistance of the exploited ones are rooted in India’s land system”. (Bitter Soil, Segull Books, 1998). ‘ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক বৈষম্য’ এবং ‘ভূমির জন্যে দরিদ্র মানুষের লড়াই’ মহাশ্বেতার তীক্ষ্ণ, ক্ষুরধার, সুসংহত, ক্ষমাহীন সাহিত্য সম্ভারের দুটি মূল্যবান ‘চাবি-শব্দ’। এবং এই দুটি আমোঘ কারণেই সংগঠিত হয় সিপাহী বিদ্রোহ - ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন ও গণ অভ্যুত্থান।

১৭৫৭ সালে ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলাদেশে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত। পরবর্তী একশো বছরে চলেছিল একদিকে অন্তহীন লুন্ঠন ও শোষণ সাধারণ মানুষের ওপর এবং অন্যদিকে সুপরিকল্পিতভাবে দেশজ শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিকর্মের তিল তিল করে ধ্বংস করা। ঔপনিবেশিক শক্তির প্রয়োজন দুটি জিনিশের - এক, স্বল্পমূল্যের বা প্রায় বিনামূল্যের অগাধ, অঢেল শ্রম, অর্থাৎ দরিদ্র, সর্বস্বান্ত জনসাধারণ এবং নিজের দেশে উৎপন্ন পণ্যদ্রব্যের রপ্তানীর জন্যে নিষেধহীন, খোলা বাজার। যে ভারতবর্ষের রেশম, পশম ও সুতির বস্ত্রশিল্প ছিল গুণে উৎকৃষ্ট ও পৃথিবী বিখ্যাত, উনবিংশ শতাব্দীতে তা হয়ে দাঁড়াল ব্রিটেন থেকে আমদানী করা বস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল।

জমি সংক্রান্ত বৈষম্যের শুরু ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বলপূর্বক রাজস্ব আদায়ের ফলে। ভারতবর্ষের কৃষিজীবি মানুষ চাষ করত নিজের জমি এবং কর দিত নবাব, রাজা বা সম্রাটকে। ১৭৫৭ সালের পর প্রতি বছর বাড়তে শুরু করল করভার - কর ও ঋণের দায়ে জর্জরিত চাষীরা একের পর এক হতে থাকল নিরন্ন, ভূমিহীন। ইংরেজ শাসনের প্রথম দশকে রাজস্ব আদায় বাড়ে অন্তত তিনগুণ। তার ফলে ১৭৭০-৭১ সালে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ - বাংলা ১১৭৬ সনে, যার নাম ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। বাংলা দেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি প্রাণ হারাল অনাহারে ও অসুখে। এর আগে শস্যশ্যামল বাংলায় এমন দুর্ভিক্ষের কথা শোনা যায় নি। আর নিরন্ন কৃষকদের অনেকেই বাধ্য হয়ে নাম লিখিয়েছিলেন ইংরেজের সেনাবাহিনীতে সেপাই হিশেবে।

সাড়ে চার কোটি বাঙালির দেড় কোটিকে নিকেশ করেও সাধ মিটল না ইংরেজদের। খাজনার পরিমাণ বেড়েই চলল বছরের পর বছর। তারপর ১৭৮৬ সালে ভারতবর্ষের শাসক হয়ে এলেন লর্ড কর্ণওয়ালিস (১৭৩৮-১৮০৫)। যাঁর তখনো পর্যন্ত কর্মজীবনের সবচেয়ে গৌরবময় কীর্তি - আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সেনার সেনাপতি হিশেবে লড়াই, পরাজয় ও আত্মসমর্পণ। ব্রিটেনে বদ্ধমূল ছিল যে শ্রেণীভিত্তিক, আর্থসামাজিক বৈষম্য, কর্ণওয়ালিস “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” নামে তাকে আমূল প্রোথিত করলেন ভারতের ভূমিতে। সৃষ্টি হল মধ্যস্বত্বভোগী, অলস, কর্মবিমুখ, অর্থপিশাচ এবং ইংরেজের পদলেহি জমিদারশ্রেণির - জমির সঙ্গে তাদের একমাত্র সম্পর্ক রাজস্ব আদায়। মোঘল বা নবাবী আমলে বন্যা, মহামারী বা দুর্ভিক্ষ ঘটলে রেহাই বা ছাড় পাওয়া যেত খাজনা থেকে, কিন্তু ইংরেজরা খারাপ সময়ে খাজনা মকুবের বদলে তার বৃদ্ধি ঘটাল। জমিদার ও পাইক বরকন্দাজ নিয়ে তৈরি তাদের মদত করতে। শুধু যে ইংরেজ সরকারের সিন্দুকে আয় বাড়ল তাই নয়, সপ্তদশ শতকের প্রথমে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পত্তনের পর থেকেই তার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদেরও ভাগ্য খুলে গেল - অত্যাচার, শোষণ ও শঠতায় অর্জিত অর্থে তারা অকল্পনীয় বিলাসে দিন কাটাতে লাগলেন দেশে ফেরার পর।

অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বিদ্রোহ করে মানুষ। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ - এই একশো বছরে ভূমিহীন কৃষক ও জনসাধারণ বিদ্রোহ করেছেন ৫৪ বার। কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে তাদের। গণবিদ্রোহগুলির সঠিক ইতিহাস লেখা হয়নি এখনও।

।। ৪ ।।

বারাণসীর এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয় ঝাঁসীর ভবিষ্যৎ রাণির, ২১ শে নভেম্বর ১৮৩৫; জন্মের সময় তাঁর নাম মণিকর্ণিকা, সংক্ষেপে মনু। ৮ বছর বয়েসে তাঁর বিবাহ ২৯ বছর বয়েসি ঝাঁসীর রাজা গঙ্গাধর রাও এর সঙ্গে। বিয়ের পর তাঁর নাম রাখা হয় লক্ষ্মীবাঈ। ১৮৫১ সালে তাঁর একটি পুত্র সন্তান জন্মে, কিন্তু তিন মাস বয়েসেই তার মৃত্যু হয়।

মহাশ্বেতা গ্রন্থটির শুরু করেছেন ঢিমে তেতালায়, বড়ো একটি ক্যানভাস নিয়ে। আকবরের সমসাময়িক বুন্দেলখণ্ড অঞ্চল ও তার আশেপাশের মারাঠা ও রাজপুত রাজ্যগুলি নিয়ে - অজস্র রাজা ও রাজত্বের নাম, তাদের শাসন, শত্রুতা ও যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনি। শিবাজী, আবুল ফজল, সেলিম, আওরংগজেব, পেশোয়া বাজীরাও - সবাইকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে ইতিহাস এগিয়ে চলে তিন শতাব্দী। তারপর কাহিনির মূল স্রোতটি ঘনীভূত হয় ঝাঁসীতে, রাজা ও রাণীর উপস্থিতিতে। তাঁদের দৈনন্দিন জীবন, “হরিদ্রাকুঙ্কুমের উৎসবে বড়ো আনন্দ করতেন মেয়েরা। সকলে সকলকে ফুল ও কুঙ্কুম দিতেন। রানির ব্যবহারে মুগ্ধ অন্তঃপুরিকারা তাঁর প্রশংসা করতেন এবং আনন্দে গঙ্গাধর রাও তাঁকে প্রায়শই স্নেহ-কৌতুকে বলতেন - তুমি কি তোমার নামের যোগ্য হবার জন্যে এত চেষ্টা করছ? …… বয়েসের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রানির সঙ্গে তাঁর স্বামীর একটি হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।”

স্বচ্ছন্দ ও স্বাদু গদ্য - উপন্যাসের মত পড়া যায়; চরিত্রগুলি পাঠকের খুব নিকটে সরে আসে, তাদের ঘরের মানুষ মনে হয়; ইতিহাস থেকে সেঁচে আনা তথ্য, কিন্তু নির্ভেজাল সাহিত্য রসে জারিত। অনেকদিন পরে একটি সাক্ষাৎকারে লেখিকা জানাবেন, “The details of the Rani’s habits, her clothes, her favourite things, attracted me very much. Probably because I am a woman, my perspective have been different… I was interested in not only learning about her army and such other things, her fights against the British and the facts of war, but wanted to get under the skin of the person. The different roles that she had to play interested me intrinsically”…..

১৮৫৩ সালের শরৎকালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন রাজা গঙ্গাধর রাও; তাঁর অবর্তমানে রাজ্যের কী অবস্থা হবে সেই নিয়ে দুশ্চিন্তা। অপুত্রক রাজা আইনগতভাবে দত্তক নিলেন আত্মীয়পুত্র আনন্দ রাওকে - পাঁচ বছর বয়েসি বালকটির নতুন নামকরণ হল দামোদর গঙ্গাধর রাও। পরের দিনই (২১ নভেম্বর ১৮৫৩) রাজার মৃত্যু হল। পুরো ব্যাপারটিই ঘটেছে ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধিদের চোখের সামনে, কিন্তু তাঁদের প্রভুরা মানতে পারলেন না এই উত্তরাধিকার। গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি এর আগেই “Doctrine of Lapse” নামে একটি প্রাচীন আইনের ধুলো ঝেড়ে বার করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন অনেকগুলি ভারতীয় রাজ্য - ঝাঁসীর ভাগ্যেও তাই ঘটল। রাণীকে সেই দুঃসংবাদ দিতে এলেন মেজর এলিস - উত্তরে পর্দার আড়াল থেকে ভেসে এল রাণির সুদৃঢ়, ঐতিহাসিক কণ্ঠস্বর –

“মেরী ঝাঁসী দুংগী নহী”। দিনটি ১৬ মার্চ ১৮৫৪।

শুরু হয়ে গেল সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরাক্রান্ত ব্রিটিশ বাহিনীর যুদ্ধ। যে রাজ্য এতদিন ছিল ব্রিটিশ রাজের একান্ত অনুগত, তার বিধবা অন্তঃপুরিকা রাণি নেতৃত্ব দিলেন এক সুদূরপ্রসারী বিদ্রোহের। অনেক ব্রিটিশ ঐতিহাসিকের মতে ঝাঁসী এবং অন্যান্য দেশীয় রাজ্যগুলির অন্যায় আত্মসাৎ না ঘটলে ভারতবর্ষে সেই গণ অভ্যুত্থান হবার সম্ভাবনা কমে যেত অনেকটাই।

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে ভারতের দরিদ্র কৃষিজীবি মানুষেরা বিদ্রোহ করেছে বার বার; কঠোর হাতে সেই সব অভ্যুত্থান দমন করেছে ব্রিটিশ বাহিনী। “এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় ১৮১৬ সালের বেরিলীর বিদ্রোহ, ১৮৩১-৩২ সালের কোল বিদ্রোহ, এবং ছোটনাগপুর ও পালামৌ অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী অভ্যুত্থান। ... ১৮৩১ সালে বারাসতে সৈয়দ আহমদ এবং তিতুমীরের নেতৃত্বে ফরায়েজী বিদ্রোহ, ১৮৪৭ সালে দিদুমীরের বিদ্রোহ, ১৮৪৯, ১৮৫১-৫২, ১৮৫৫ সালের মোপলা বিদ্রোহ এবং ১৮৫৪-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ স্মরণীয়।” এইরকম অসংখ্য স্ফুলিঙ্গের পটভূমিতেই ভারতের প্রথম মহাসংগ্রামের লেলিহান অগ্নিশিখা।

উত্তর এবং মধ্যভারতে ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব ছিলেন প্রধানত সামন্ততান্ত্রিক। দিল্লী, কানপুর বা লখনউতে এই বিদ্রোহের লক্ষ্য মুঘল সম্রাটকে কেন্দ্র করে। মধ্যভারতে নানাসাহেব এবং তাঁতিয়া টোপী ডাক দিয়েছিলেন মারাঠা পেশোয়ারশাহী পুনঃপ্রতিষ্ঠার। কিন্তু মারাঠা অধিকারের পেছনে সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল না। তাঁরা চেয়েছিলেন ইংরেজ অত্যাচার থেকে মুক্তি। কিন্তু এক বিলাসী শাসকে ক্ষমতাচ্যুত করে আরেক বিলাসী শাসককে গদিতে বসালে সেই ইচ্ছা চরিতার্থ হবে না। একমাত্র ঝাঁসীর রাণীর মধ্যেই জনসাধারণ ও সিপাহীরা দেখেছিলেন সংগ্রামী চেতনা। তিনিই গড়ে তুলতে পারতেন সুবিপুল, জনপ্রিয় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। ঝাঁসীর মানুষ তাঁর সঙ্গে ছিল, কিন্তু স্থানীয় দেশি সামন্তরাজারা বেশিরভাগই ইংরেজের হাতের পুতুল।

সিপাহীদের অভিযোগগুলি ছিল যুক্তিযুক্ত এবং যথার্থ। ইংরেজ অফিসারদের অবিচার এবং বৈষম্যের সীমা ছিল না। সেনাবাহিনীতে মোট তিন লক্ষ পনের হাজার সৈন্য, তার মধ্যে একান্ন হাজার শ্বেতকায়, বাকী দুই লক্ষ চৌষট্টি হাজার ভারতীয়। সেনাবাহিনীর বাৎসরিক খরচের পরিমাণ আটানব্বই লক্ষ পাউন্ড, তার মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের জন্যে প্রায় সাতান্ন লক্ষ এবং ভারতীয়দের জন্যে চৌত্রিশ লক্ষ। গড় মাথাপিছু খরচা একত্রিশ পাউন্ড; কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের মাথা পিছু একশো দশ পাউন্ড, যেখানে ভারতীয়দের মাথা পিছু সাড়ে পনেরো পাউন্ড। কেবল গড়ে মাথাপিছু সাতগুণ অর্থনৈতিক বৈষ্যমই নয়, তার সঙ্গে প্রহার, জেল, ফাঁসি, কোর্ট মার্শাল, ধর্মবিশ্বাসে আঘাত। সব মিলিয়ে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। এই বিক্ষুব্ধ মানুষদের সংঘবদ্ধ করে একটি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারলে তখনই নাভিশ্বাস উঠত অত্যাচারী, ঔপনিবেশিক শাসনের। তার বদলে ঘটল ছিন্নবিচ্ছিন্ন, বিশৃঙ্খল, পরিকল্পনাহীন সংগ্রাম। তাতেই ভিত কেঁপে উঠেছিল পরাক্রান্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের।

১৮৫৭ এবং ১৮৫৮ এই দুটি সালকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেবার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ। প্রথমত, তাদের শোচনীয় পরাজয় ও ব্যর্থতার কাহিনী; দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহীদের পরাস্ত করার পরে ভারতীয়দের ওপর নারী-শিশু নির্বিশেষে হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর অত্যাচারের কাহিনী। যে যুগে ব্যাংকের প্রচলন ছিল না, মানুষ সঞ্চিত অর্থ ও অলংকার লুকিয়ে রাখত নিজের গৃহে - এক একটি শহর গ্রাম জয় করার পরে চলেছে নির্বিচারে হত্যা ও লুন্ঠন - সেই কালিমালিপ্ত ইতিহাস যতটা সম্ভব লুকিয়ে রেখেছে ব্রিটিশ। অনেক কাগজপত্র, দলিল দস্তাবেজ ঘটনাস্থলেই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, বাকি সব পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্রিটেনে - তারা বস্তাবন্দী কোন সরকারী মহাফেজখানায়।

এক মহাসাগরের দূরত্বে থেকেও ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যটি সঠিক ধরতে পেরেছিলেন দার্শনিক কার্ল মার্কস (১৮১৮ - ১৮৮১) লন্ডনে বসে। তাঁর সুচিন্তিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ন্যু ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন সংবাদপত্রে - তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী এটি সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহ নয়, ঔপনিবেশিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা বেনজামিন ডিজরেইলি (১৮০৪-১৮৮১) এর মতে ঘটনাটি “জাতীয় বিদ্রোহ” কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন (১৭৮৪-১৮৬৫) এর মতে এটি “সামরিক বাহিনীর কিছু অংশের বিদ্রোহ”। পরবর্তীকালে সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিতে শার্লক হোমসের উপন্যাস লিখেছেন আর্থার কোনান ডয়েল (১৮৫৯-১৯৩০) এবং ফরাসি কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্যিক জুলস গ্যাব্রিয়েল ভার্ন (১৮২৮-১৯০৫) তাঁর ভুবন বিখ্যাত “সমুদ্রের কুড়ি হাজার লিগ নিচে” (প্রথম প্রকাশ ১৮৬৯-৭০) উপন্যাসের মূল চরিত্র ক্যাপটেন নিমোকে কল্পনা করেছিলেন ভারতবর্ষের বুন্দেলখণ্ডের রাজার পুত্র রাজকুমার দাক্কার (Prince Dakkar) হিশেবে, যিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শ্যেনচক্ষু এড়িয়ে পালিয়ে যান, বিজ্ঞান সাধনায় মন দেন এবং “নটিলাস” নামে সাবমেরিনটির নির্মাণ করে যাত্রা শুরু করেন। ঘটনাটি রয়েছে তাঁর ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত “রহস্যময় দ্বীপ” উপন্যাসে। উপন্যাসটির যখন ইংরেজি অনুবাদ হয় তখন দেশপ্রেমিক ব্রিটিশ অনুবাদক উইলিয়াম কিংস্টন (১৮১৪-১৮৮০) পুরো ব্যাপারটি বেমালুম চেপে যান, ফলে প্রায় একশো বছর ইংরেজি ভাষার পাঠকেরা জানতেন না যে ক্যাপটেন নিমোর প্রকৃত পরিচয়। একটি নতুন অনুবাদ প্রকাশ প্রায় বিষয়টি।

।। ৫।।

পরবর্তী দশকগুলিতেও ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়টি রয়ে গিয়েছিল মহাশ্বেতা দেবীর হৃদয় ও মননের খুবই নিকটে। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হল “ঝাঁসীর রাণী”র পরিপূরক গ্রন্থ “আগুন জ্বলেছিল” (দে’জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ১৯৯৪, ১১৯ পৃষ্ঠা, তিরিশ টাকা) - সেখানে বিষয়টির আরো বিস্তৃত আলোচনা এবং পরিণত বিশ্লেষণ। ইংরেজ সেনাপতিদের জবানীতে রাণিকে ও তাঁর দেশপ্রেমিক এবং বিদ্রোহী অস্তিত্বের ওপর নতুন আলো ফেলা হয়েছে। “রাণী তাঁর সামন্ত শ্রেণীর সীমাবদ্ধতা ও স্বার্থচিন্তার ওপরে উঠেছিলেন অন্যদের তুলনায়।”

এক অভিবাসী মা-মেয়ে জুটি বেঁধে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন “ঝাঁসীর রাণী” গ্রন্থটির; ম্যাডিসন শহরে অবস্থিত উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয় ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক সাগরী সেনগুপ্ত এবং তাঁর মা মন্দিরা সেনগুপ্তের অনুবাদে ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়েছে “The Queen of Jhansi”. প্রকাশক কলকাতার সিগাল বুকস। ২০০৭ সালে এই মহান সংগ্রামের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছে একগুচ্ছ নতুন গ্রন্থ - ইতিহাসের, রাজনৈতিক বিশ্লেষণের এবং ওই পটভূমির ওপরে নির্মিত কথাসাহিত্যের। এমনকী ব্রিটিশ লেখকদের রচনাতেও মিথ্যা ও প্রচারের পরিমাণ কমেছে অনেকটাই। সেই অর্থে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে রচিত মহাশ্বেতা দেবীর গবেষণা ও গণমুখী রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সার্থক হয়েছে। “ঝাঁসীর পথে পথে আমি অনেক বার ঘুরেছি। শীতের প্রবল বাতাসে, ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়ে পুরানো ছাউনির পথে বড়ো বড়ো পাথরের ছায়ায়, নির্জন কেল্লার পরিত্যক্ত কোনায় কোনায়, জীর্ণ ও অবহেলিত রানি মহালের ঘরে ঘরে, সেই শহরের জনাকীর্ণ পথে এবং ‘লছমীতালের’ বুকে বজরা নিয়ে ঘুরে অতীতের পদসঞ্চার শোনবার চেষ্টা করেছি।” শুরু হয়েছে তাঁর দীর্ঘ, সুদূরপ্রসারী সাহিত্যজীবনের- সেই অর্থে “ঝাঁসীর রাণী” মহাশ্বেতার গোড়ার কথা।


টীকা-

(১) হায়, ‘নন-ফিকশান’ এর কোন যোগ্য বাংলা প্রতিশব্দ নেই। ‘ফিকশান’ যদি কথাসাহিত্য হয়, তাহ’লে কি “অ-কথাসাহিত্য” অথবা “না-কথাসাহিত্য”? প্রবন্ধসাহিত্য, জীবনীসাহিত্য, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনী, রাজনৈতিক কলাম - এইসব জন্‌রাগুলি মিলিয়ে একটি সম্মিলিত নামের প্রয়োজন।

(২) অন্তত একটি উদাহরণ রয়েছে পাপার্জিত অর্থের কিছু অংশের ব্যয় জনহিতকর কাজে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকার এক শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ইলাইহু ইয়েল (১৬৪৯-১৭২১) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করেছেন তিরিশ বছর, তার মধ্যে পাঁচ বছর (১৬৮৭-১৬৯২) মাদ্রাস প্রেসিডেন্সির গভর্নর হিশেবে। ইয়েলের অত্যাচার ও শঠতার কাহিনি বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণে সুবিদিত। কিন্তু এই নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সৃষ্টিতে তিনি সহায়তা করেন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়টির নামকরণ হয় তাঁর নামে।


মহাশ্বেতা দেবীর গ্রন্থগুলির বেশির ভাগ আমি ঋণ নিয়েছিলাম শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে, ইন্টার-লাইব্রেরি লোন প্রকল্পের মাধ্যমে। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।




(পরবাস-৮৫, ১০ জানুয়ারি, ২০২২)