ISSN 1563-8685




সুখের দেশে

ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা


রাস্তা থেকে পাহাড়ের দৃশ্য

আমার সম্প্রতি ভুটান যাত্রার পিছনে একটা তুচ্ছ কারণ আছে। ২০১২ সালের আমেরিকার ইলেকশনে যখন ওবামা ও রম্‌নি একেবারে সমান সমান, আমার এক ডেমোক্র্যাট বন্ধু প্রতিজ্ঞা করে বসল যে রম্‌নি নির্বাচিত হলে সে দেশ ছেড়ে ভুটানে চলে যাবে। ভুটান নাকি ভারী সুন্দর সুখী দেশ! কিন্তু স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যাবার আগে তার ইচ্ছা আমি আমার দেশভ্রমণের সময় একটু যেন ভুটানে উঁকি দিয়ে আসি। বিদেশীদের ওখানে যাওয়া নাকি একটু মুশকিল, কিন্তু ভারতীয় নাগরিক হিসাবে আমি ইচ্ছা করলেই চট করে ভিসা পেতে পারি। একেবারেই বাজে কারণ। কিন্তু আমি নির্দ্বিধায় দায়িত্ব স্বীকার করে নিলাম। সত্যিই তো। ভারতের একেবারে দোরগোড়ায় এই দেশটি। সুখের দেশ, Shangri-La ইত্যাদি বলে কত নাম। একবার না গেলে চলে?


তুষারমৌলী হিমালয়
আমি ভেবেছিলাম অনেকেই হয়তো ভুটান হয়ে এসেছেন, কিন্তু কাজের বেলায় দেখা গেল আমার চেনা জানা বন্ধু আত্মীয়দের মধ্যে কেউই ওদেশে যাবার চেষ্টা করেননি। আশ্চর্যের ব্যাপার। ভুটানে গিয়েও আমি খুব কম ভারতীয় ট্যুরিস্ট দেখেছি। যাঁদের দেখেছি তারা প্রায় সবাই বাঙালি; তুলনায় এত বাধা সত্ত্বেও (বা তারই জন্য হয়তো) অনেক বেশি বিদেশী ট্যুরিস্টদের ভিড়।

ভুটান একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছোট্ট দেশ, ভারত ও চীনের মধ্যে হিমালয় পাহাড়ের কোলে গুঁজে রাখা। উত্তরে চীন (তিব্বত) ও দক্ষিণে ভারতীয় প্রদেশ--আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও অরুণাচল প্রদেশ। সম্প্রতি সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে বাদানুবাদের পর ভুটান উত্তরের সীমানা বন্ধ করেছে এবং বাণিজ্য, ও সামরিক সুরক্ষার বিষয়ে ভারতের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ভারতীয় সৈনিকরা দেখলাম ভুটানের পাহাড়ে রাস্তা বানাচ্ছে। আর সীমানার দক্ষিণে ভারতীয় রাস্তাগুলি ভেঙেচুরে পড়ে আছে!


পাহাড়ি পথ
ঠিক করেছিলাম গাড়িতে করে যাব ভুটানে। তাহলে বেশ দেশ দেখা যাবে। প্লেনে গেলে তো কিছুই দেখা হয়না। গাড়িতে গেলে একমাত্র রাস্তা কালিম্পং থেকে। প্লেনে প্রথমে বাগডোগরায় নামতে হয়। তারপর গাড়িতে কালিম্পং ও সেখান থেকে সীমানা প্রায় পাঁচ-ছয় ঘন্টার ড্রাইভ। বিদেশী যাত্রীদের একটাই পথ -- প্লেনে 'পারো' শহরে নামা। আমরা ভারতীয় বলে ইচ্ছামতো রাস্তায় চলতে পারি। পাহাড়ি রাস্তা সরু ও এবড়ো খেবড়ো। সবচেয়ে ভালো গাড়ি Toyota Land Cruiser আর Innova--তাইতেই খাবার, জল, গরম জামা-জুতো, মুখরোচক স্ন্যাকস, ম্যাপ ইত্যাদি (না কোনো GPS নেই ওখানে) প্যাক করে নিলাম।


পথের পাশে প্রার্থনা পতাকা
কালিম্পং থেকে সীমান্ত শহর ফুনটশুলিং (Phuntshuling) যাওয়ার রাস্তাটা উত্তরবঙ্গে চা বাগান ও জলদাপাড়া জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যায় শুনেছিলাম। সেটা সত্যিই, কিন্তু রাস্তার অবস্থা এত খারাপ এবং আশে পাশের বাড়ি বাগান সব এত ধুলোমাখা যে নিসর্গ দর্শনের আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়। তারই মধ্যে ১৪ কিমি লম্বা অংশটিকে ভারতের সর্বতম খারাপ রাস্তার পদবী দেওয়া যায়। ঐটুকু রাস্তা পার হতে আমাদের এক ঘন্টা সময় লেগেছিল। তার মধ্যে ঝাঁকুনিতে শরীরের সব হাড়গোড় আলাগা হয়ে গেছিল, নামার পরে গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। আরও উপরি পাওনা--কথা বলতে গিয়ে ঝাঁকুনি খেয়ে ঠোঁট আর জিভ কামড়ে রক্তাক্ত! (পাঠকজন সাবধান! ঐ রাস্তায় গাড়ি চড়ে গেলে সারাটা সময় মুখে কুলুপ এঁটে রাখবেন।)

জলদাপাড়ার গণ্ডার ও হাতিদের কত নাম শুনেছি। এবার পার্কের অবস্থা দেখে কান্না পেল। আমরা গেছিলাম দেওয়ালির সময়। তখনও গেস্টহাউস জনমানবহীন। গাছপালার পাতা একেবারে ধুলায় ধূসর। ঐ অবস্থায় ঐ রাস্তা দিয়ে কেউই পার্কে বেড়াতে আসবেন না। কী দুর্দশা! কারুর উচিত মমতা ব্যানার্জীকে ধরে ঐ রাস্তায় গাড়িতে চড়ানো। তবে হয়তো রাস্তাটার কিছু উন্নতি হতেও পারে।

ফুনটশুলিং ব্যস্ত শহর। গাড়ি, ভিড়, ধুলো, ধোঁয়া সবকিছুই আছে। এখানেই আমাদের ভিসা ইত্যাদি চেক করা হল। ভিসার অফিসেও বেশ ভিড়। বেশিরভাগই ভুটানীরা, ভারতে যাবার ভিসার জন্য। আমরাও তৈরি হয়ে নিলাম। গাড়িতে পেট্রল ভরা হল। আর আমাদের পেট ভরা হল ভুটানী মো মো আর এমা দাতসী দিয়ে।

মোমো উত্তর-পূর্ব ভারতের সবথেকে জনপ্রিয় খাবার। চীনা ডামপলিং-এর মতো ময়দার লেটির ভেতরে মাংস বা মশলাদার সবজির পুর দিয়ে ভাজা অথবা ভাপে সেদ্ধ করা হয়। তারপর ঝাল চাটনির সঙ্গে গরম গরম পরিবেশন। এটা আমারও প্রিয় খাবার। আমি সকাল বিকেল শুধু মোমো খেয়েই খুশি। এমা দাতসিটাও ভুটানী খাবার - চীজ দিয়ে তৈরি, কিন্তু খেতে বেশ ঝাল ও মশলাদার। চীজ ও দুধ দিয়ে আলু বা অন্যান্য সবজির ঝোলের মতো খাবারটা। খুবই সুস্বাদু। ভুটানীরা বেশ লংকা খায়। লংকার আচার খুবই স্বাদের। ভুটানে প্রত্যেকের বাড়ির চালার ওপর পাকা লংকা রোদে শুকোতে দেখেছি। পানীয় হিসাবে ভুটানীরা চা খেতে ভালোবাসে। ভুটানী চায়ে দরাজ হাতে ইয়াকের দুধ ও মাখনের ব্যবহার হয়। চায়ে মাখনের নোনতা স্বাদ আর ইয়াকের দুধের গন্ধ। একটু সইয়ে নিতে পারলে মন্দ লাগে না। শীতের দেশে এই চা বেশ এনার্জি দেয়। ইয়াকের দুধে ফ্যাট খুব বেশি। দুধ জমিয়ে ঘন করে ছোটো ছোটো প্যাকেটে বিক্রি হয়। পাহাড়ি রাস্তার ধারে ধারে দোকানে এগুলো দেখেছি। ড্রাইভাররা এগুলো চিবোতে পছন্দ করে মনে হয়। লম্বা রাস্তায় যেতে এনার্জি দেয়। আমি অবশ্য খেয়ে দেখিনি।


পারো শহর, নদীর ধারে

হাইওয়েটা ফুনটশুলিং থেকে রাজধানী থিম্পু হয়ে পারো পর্যন্ত যায় সোজা। খুব একটা ভিড় নেই রাস্তায় এবং রাস্তাটাও বেশ ভালোভাবে তৈরি। উঁচু পাহাড়ি রাস্তা, এঁকে বেঁকে এ-পাহাড় থেকে ও-পাহাড়ে লাফিয়ে চলেছে। একদিকে খাড়া পাথর, অন্যদিকে গভীর খাদ। সরু রাস্তায় এক সেকেণ্ড অন্যমনস্ক হলেই বিপদ। এক এক জায়গায় দেখি ভয়াবহ ধ্বস। বিরাট বিরাট পাথরের চাঙড় রাস্তা গুঁড়িয়ে নিচের খাদে পড়েছে। নি:শ্বাস বন্ধ করে সাবধানে পার হই। কোনো কোনো জায়গায় রাস্তাটা আবার এক লেন। দু'দিকের ট্র্যাফিক একসঙ্গে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। মাঝপথে দৈত্যকায় লরির মুখোমুখি হলে ভীষণ সাবধানে পার হতে হয়। এজন্যে চাই শক্ত হাত ও ততোধিক শক্ত মন। আমাদের ড্রাইভারদের ধন্যবাদ--ওদের কাছে এসব হয়তো কিছুই নয়--রোজকার রাস্তা। আমাদেরই চোখ বন্ধ করে ইষ্টনাম জপতে হয়।


জাতীয় পোশাক ঘো ও কিরা

চোখ খোলা রাখলে দেখা যায় অপূর্ব পর্বতমালা, গাঢ় সবুজ থেকে দূর দূরান্তে আবছা ধূসর হয়ে আকাশে মিশে গেছে। নিচের উপত্যকায় সেগুন গাছের শ্রেণী। ওপরে উঠে সিডার ও ফার গাছের ভিড় বেশি দেখা যায়। অনেক নিচে খাদের দিকে তাকালে ঝিলমিল রূপালী ফিতের মতো পাহাড়ি নদী চলে এঁকে বেঁকে, কখনো ডানদিকে, কখনো বাঁয়ে। পথে পড়ে ছোটখাট গাঁ বা শহর। মোট মাথায় মজুরদের দেখা যায় হয়তো কোথাও ভাঙা রাস্তা মেরামত করতে চলেছে, দল বেঁধে স্কুলযাত্রী ছেলেমেয়েদের দেখা যায়। সবাই দেশীয় পোষাকে সজ্জিত। পুরুষদের গায়ে 'ঘো' (Gho)--অনেকটা হাঁটু অবধি লম্বা হাউসকোট, বেল্ট বাঁধা ও পায়ে লম্বা মোজা--স্কটদের কিলটের মতই। মেয়েদের পরনে লম্বা পা পর্যন্ত কিরা (Kira) স্কার্ট ও গায়ে পুরো হাতা ব্লাউজ। স্কুলেও এই ভাবেই ইউনিফর্ম তৈরি হয়। মেয়েদের গায়ে থাকে রঙিন শাল। সেটা প্রয়োজনে বাজারের থলি বা বাচ্চাদের পিঠে বাঁধার জন্য ব্যবহৃত হয়।

রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায় লম্বা দড়ি বাঁধা প্রার্থনা-পতাকা: নানা রংয়ের ছোট্ট চৌকো কাপড়ে তাতে প্রার্থনা ছাপা। সেগুলি দড়িতে বেঁধে টাঙিয়ে দেয়। ভক্তের প্রার্থনা পাহাড়ি হাওয়ায় উড়ে যায় ভগবানের দিকে। কোনো কোনো জায়গায় সোজা বাঁশ পুঁতে তাতে লম্বা পতাকা বাঁধা দেখা যায়। একদল পতাকাধারী বাঁশ বেশ একটা ছোট্ট বাগান তৈরি করে। সারা দেশে, সমস্ত উল্লেখযোগ্য জায়গায়, সব মন্দিরে, সমাধিস্থলে, কারণে, অকারণে এই রঙিন পতাকা সারা দেশে একটা উৎসবের আমেজ এনে দেয়। পতাকায় লেখাটা ভুটানী ভাষায় লেখাটা অনেকটা তিব্বতী ভাষার মতই, কয়েকটা অক্ষর আমার চোখে বাংলা লেখার মতো দেখায় যেন।

থিম্পু পৌঁছতে আমাদের লাগল প্রায় পাঁচ ঘন্টা। পারো শহর আরও দু-তিন ঘন্টার রাস্তা। আমরা থিম্পুতেই ঘাঁটি করব ঠিক করলাম। সেখান থেকেই পারো ও আশেপাশের দ্রষ্টব্য জায়গাগুলি দেখে নেব। পারো ও থিম্পু দুই শহরই ছোট্ট নদীর পাড়ে উপত্যকায়, চারদিকে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা প্রায় ৭৩০০ ফুট। হাঁটাচলা করতেই আমার হাঁফ ধরে যাচ্ছিল। পাহাড়ে চড়তে হলে তো আরও মুশকিল।

দোকানপাতি ও রেস্তরাঁগুলিও বেশ পরিষ্কার। চীনে তৈরি জিনিস খুবই কম। বেশির ভাগই ভুটানে বা ভারতে তৈরি। সব বাড়িঘর (এমনকি রাজার প্রাসাদ থেকে দু-তারা হোটেলও) দু-তিনতলার বেশি উঁচু নয়। আকাশচুম্বী অফিস বা ফ্ল্যাটের দেখা পাবেন না। সব বাড়ি ভুটানী ধাঁচে কাঠে তৈরি, ওপরে সুন্দর কারুকার্য দরজা ও জানলার ধারে। কোনো কোনো দোকানের দেয়ালে আমি পুরুষ লিঙ্গের ছবি আঁকা দেখেছি। তাই নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করেন। সেগুলি অবশ্য পর্নগ্রাফি নয়। এগুলি সৌভাগ্যের চিহ্ন। যাতে দুষ্ট লোকের নজর না লাগে।


থিম্পুর পাহাড়ে বুদ্ধমূর্তি
থিম্পুর একদিকে উঁচু পাহাড়ের ওপর একটি বিরাট উজ্জ্বল পেতলে মোড়া বুদ্ধমূর্তি। যেন বুদ্ধ প্রসন্ন মুখে তাঁর প্রিয় শহরটির দিকে চেয়ে আছেন। শহরের সব কোন থেকেই এই মূর্তি দেখা যায়। এর চারপাশে এখন চাতাল বানানো হচ্ছে। মূর্তিটি ভারি সুন্দর, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। থিম্পুর আরেকটা দ্রষ্টব্য মেমোরিয়াল চর্টেন (chorten) বা মন্দির। সারা ভুটানে অনেক চর্টেন ছড়ানো আছে। এগুলি কারুর স্মৃতিসৌধ বটে আর পূজার মন্দিরও। সব গুলিতেই লম্বা সারি দেওয়া প্রার্থনা লেখা ড্রাম বা চাকা, নিচে কাঠের হাতল। ভক্তরা ঘুরে ঘুরে প্রার্থনা করেন এবং হাতল ধরে চাকাগুলি ঘুরিয়ে দেন। চাকার গায়ে হাত দিয়ে ঘোরানো মানা।


থিম্পুর চর্টেন

থিম্পুর চর্টেনটি ১৯৭৪ সালে তৃতীয় রাজার স্মৃতিতে বানানো। কেন যে ঐ রাজার জন্য তা আমি জানি না। একেবারে শহরের মধ্যে বলে এখানে ট্যুরিস্টের বেশ ভিড়। আমি ছোট্ট ছোট্ট চর্টেন দেখেছি ঠিক রাস্তার চৌমাথায় স্থাপন করা। যাত্রার শুরুতে ড্রাইভার গাড়িতে চড়েই ওগুলো প্রদক্ষিণ করতে পারেন। সঙ্গে যাত্রা শুভর প্রার্থনা।


টাকিন
থিম্পু থেকে দুমাইল দূরে পাহাড়ের ওপর একটা ছোট্ট চিড়িয়াখানা। সেটাই ভুটানের ন্যাশনাল জু। কয়েকটা বাঁদর, ইয়াক, ও হরিণ ছাড়া শুধু একটাই দ্রষ্টব্য প্রাণী। খুব দুর্লভ জন্তু, নাম টাকিন (Takin)। এটাই ভুটানের জাতীয় জন্তু ও সবাই একে ভগবানেরই রূপ ভেবে সম্মান করে। টাকিন দেখতে বাছুরের আকার, কিন্তু মাথায় ছাগলের মতো শিং ও দাড়িওয়ালা। হালকা ক্রীম রংয়ের লম্বা লোম, বৈজ্ঞানিক মতে এটা ভেড়ার জাতের প্রাণী। এরকম কয়েকটি তিব্বতে ও চীনেও দেখা গেছে। ভুটানী রূপকথায় বলে আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে এক বিখ্যাত লামা ড্রকপা কুনলি ভুটানে এসেছিলেন। তাঁর যাদুশক্তির খুব খ্যাতি শুনে রাজা চাইলেন একটি যাদু দেখতে। লামা প্রথমে চাইলেন একটি গরু ও একটি ছাগল। তারপর তিনি দুটোকেই কেটে রান্না করে খেলেন। তারপর দুটোরই হাড়গুলো জুড়ে একটা তৃতীয় প্রাণীর রূপ দিলেন। এবং সবশেষে মন্ত্রবলে সেটায় প্রাণ স্থাপন করলেন। সেই-ই হল টাকিন। মন্ত্রপূত বলে ভুটানে কেউ টাকিন মারে না।


প্রার্থনা চাকার পাশে বৃদ্ধা
পারো হচ্ছে ভুটানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর। কারণ সারা দেশের একটি মাত্র এয়ারপোর্ট এই পারোতেই। একটাই রানওয়ে, শহরের ঠিক মাঝখানে তৈরি। দিনে বোধহয় ডজনখানেক প্লেন ওঠানামা করে। প্রত্যেকের জানা কোন সময় কোন প্লেন আসে বা যায়। পারোতেই অভারতীয় ট্যুরিস্টদের নামতে হয়। শুনেছি তাদের ভিসা জোগাড় করতে অনেক সময় ও খরচ লাগে। ঠিক জানিনা কিন্তু শুনেছি এসব ছাড়াও প্রতি ট্যুরিস্টকে মাথাপিছু দৈনিক ২৫০ ডলার দিতে হয়। এইভাবেই ভুটান সরকার বিদেশী ট্যুরিস্টদের সংখ্যা অনেক কম করেছেন, এতে দেশীয় লোকদের মনে বিদেশী ছোঁয়াচ অল্প করে সইয়ে দেওয়া যায়। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ভুটানে টেলিভিশনের চল ছিল না। ভুটানীরা এইমাত্র বাইরের পৃথিবীর খবর পাচ্ছে। তাই সরকার এর ওপর একটু কন্ট্রোল রাখতে চান। এই জন্যই ভুটান এখনও অনেকটা অপরিবর্তিত আছে ও নেপালের মতো গাদা গাদা বিদেশীদের দেখা যায় না। এখন অবশ্য ভুটানে টিভি, ইন্টারনেট দুই-ই সচল।


রিমপুন জং: সাজানো জানালা
ভুটানে অনেকগুলি ঐতিহাসিক জং (Dzong) দেখা যায়। বেশিরভাগই গত চার-পাঁচশ বছরে তৈরি। এগুলি একদিকে প্রতিরক্ষার জন্য দুর্গ, অন্যদিকে বাজার, স্কুল, মন্দির, ধর্মশালা ইত্যাদি ভাবেও ব্যবহার হয়। কোনো কোনোটা রাষ্ট্রীয় কাজেও লাগানো হয়েছে। পারোতে তা জং (Ta Dzong)টি রাষ্ট্রীয় মিউজিয়ামে পরিবর্তিত হয়েছে। তার কাছেই রিমপুন (Rimpun) জংটি ভুটানের প্রধান লামার তৈরি, প্রায় ১৬৪৬ সালে। এটি এদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও সুরক্ষিত দুর্গ। বাইরে জলের নালা, তার ওপর কাঠের পুল দিয়ে ভিতরে ঢোকার দরজা। বিরাট দুর্গটিতে আছে সাধু সন্তদের থাকা খাওয়ার জায়গা। আছে প্রার্থনা মন্দির ও সারিবদ্ধ প্রার্থনা চাকা। প্রত্যেকটি দেয়ালে সুন্দর ছবি আঁকা বুদ্ধের কাহিনী বা পঞ্চতন্ত্র। কাঠের ছাদ ও দরজা, জানালার ফ্রেমগুলি সুন্দর ভুটানী স্টাইলে খোদাই ও রং করা। ধার্মিক অনুষ্ঠান এখনও হয় তবে ধর্মশালার বদলে সবাই এখন শহরের আধুনিক হোটেলেই থাকেন।


'বাঘের বাসা' বা 'তাকসং মনাস্টেরি'
পারো শহরের বাইরে কয়েক মাইল দূরে আছে বিখ্যাত 'বাঘের বাসা' বা 'তাকসং মনাস্টেরি' (Taktsong)। এটা খুব খাড়া ও উঁচু পাহাড়ের খাঁজে গোঁজা। নিচের জমি থেকে প্রায় ৯০০ ফুট সোজা খাড়াই। আমি তো ওঠার চেষ্টাও করিনি। নিচ থেকেই ছবি তুলেছি। এর ছবি সব ভুটানী ট্যুরিস্ট বইয়ে ছাপা আছে। অনেকেই ভুটান বলতে 'বাঘের বাসা'ই জানেন। কথায় আছে অষ্টম শতাব্দীতে গুরু রিমপোচে এখানে এক ব্যাঘ্রিনীর পিঠে চড়ে উড়ে এসেছিলেন। এখানেই মন্দির বানিয়ে তিনি তিনবছর তপস্যা করেন। এখানেই প্রথম ভুটানে বুদ্ধ ধর্মের পালন শুরু হয়। তাই জায়গাটা ঐতিহাসিক ও ধার্মিক ভাবেও খুব বিশিষ্ট। কালো গ্রানাইট খাড়া পাথরের খাঁজে সাদা দেওয়ালের মন্দিরটি দূর থেকেও পরিষ্কার দেখা যায়। আশেপাশে অসম্ভব উচ্চতা থেকেও উড়ছে রঙিন প্রার্থনা পতাকা। মনে তো খুব ইচ্ছে পাহাড়ে চড়বার। দেখলাম অনেকেই যাচ্ছেন। কিন্তু শরীরে বল নেই। তাই ক্ষান্ত হতে হল।


কিইচু মন্দিরে সাজানো দীপমালা
জং, চর্টেন এসব ছাড়াও ভুটানে অনেক মন্দির আছে--বুদ্ধ ও তাঁর নানা অবতারদের পূজার জন্য। পারোর খুব কাছেই আছে একটি মন্দির, নাম কিইচু লাকাং (Kiyichu Lhakhang) বা কিইচু মন্দির। এটা ভুটানের সবথেকে পুরোনো ও বৌদ্ধ ধর্মের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। এরকম সব মন্দির জং ইত্যাদির ইতিহাস রূপকথায় জড়ানো। কোনটা যে সত্যি তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু এই মন্দিরটা সাত শতাব্দীতে একজন তিব্বতী রাজার সময় তৈরি হয়েছিল। মন্দিরটার দুই অংশ। প্রথম মন্দিরের অনুকরণে দ্বিতীয় মন্দিরটি তৈরি হয় ১৯৬৮ সালে, তখনকার বৃদ্ধা রাণীর আদেশে।


দৈবশক্তিপূর্ণ জোড়া কমলালেবুর গাছ
পুরোনো মন্দিরের অন্দরে আছে একজোড়া কমলালেবুর গাছ--সেটায় নাকি সারা বছর ফল হয়। গাছ থেকে লেবু ছেঁড়া মানা। কিন্তু তলায় মাটিতে পড়ে থাকলে ঠাকুরের প্রসাদ হিসেবে যে কেউ কুড়োতে পারেন। বলা বাহুল্য আমি তলায় একটিও লেবু পাইনি। হয়তো ভোরবেলাই সবাই সেগুলি কুড়িয়ে নেয়। গাছে দু-একটা ফল দেখলাম ঠিকই।


রিমপুন জং: ভেতরের দৃশ্য
আমরা অবশ্য ধার্মিক ক্রিয়াকর্ম দেখার কোনো প্ল্যান করিনি, কিন্তু সৌভাগ্যবশত যেদিন কিইচু মন্দিরে গেলাম, সেটা রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন — বুদ্ধের নির্বাণ প্রাপ্তির পর প্রথমে পৃথিবীতে অবতরণের দিন। আমাদের জানাও ছিল না কিন্তু মন্দিরে দেখি সাজ সাজ রব। বিরাট শামিয়ানার নিচে কম্বল পেতে দলে দলে লামা, ভক্ত ও আমজনসাধারণ বসে পড়েছেন। কেউ চোখ বুজে বিড়বিড় করে মালা জপছেন, কেউবা বন্ধু ও আত্মীয়দের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করছেন। কেউ বা ঘন ভুটানী চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। ছেলে-মেয়ে, বাচ্চা, বুড়ো সবাই আছে। সব গোলযোগ ছাপিয়ে গম্ভীর গলায় মন্ত্র উচ্চারণ হচ্ছে মাইকে—শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে দেখি ভুটানের সর্বপ্রধান লামা, মঞ্চে বসে প্রার্থনা গাইছেন। সঙ্গে অন্যান্য লামাদের দল।


রিমপুন জং: দেয়ালে আঁকা ছবি
পূজা ও প্রার্থনা রাত অবধি চলবে। একদিকে মহিলাদের দল ইয়াক ঘি ভর্তি পিলসুজে প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন। সন্ধেবেলা ঠাণ্ডার চোটে আমরা আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে হোটেলে ফিরলাম। পিছনে লামার গম্ভীর সুর প্রার্থনা পতাকার সঙ্গে পাহাড় থেকে পাহাড়ে ধ্বনিত হতে থাকল।

ভুটান একটি ছোট্ট, পরিচ্ছন্ন, সুন্দর পাহাড়ি দেশ। লোকেরা নম্র, বিনীত ও অতিথিবৎসল। সবাই তাদের জাতীয় ধর্ম, সভ্যতা ও পরিবেশ সম্বন্ধে খুব খেয়াল রাখে। বেড়াবার সময় আমার খালি মনে হচ্ছিল যে যদি তিব্বত চীনাদের দখলে না পড়ত হয়তো সে দেশও এইরকম ভুটানের মতোই হত বোধহয়। একটু বেশি ঠাণ্ডা, গাছপালাহীন, কিন্তু আদতে ভুটানের মতোই।


রাজা-রাণী
তাইবলে কি স্বর্গেও ভূত নেই। আছে নিশ্চয়ই। বাইরে থেকে অল্প কদিনে আর কত জানা যায়? এখানে সবাইকে মনে হয় তরুণ রাজা জিগমে নামগিয়েল ওয়াংচুক ও রাণী জেটসান পেমা ওয়াংচুক-র খুব ভক্ত। সব জায়গায় এঁদের যুগল ছবি দেখা যায়। কিন্তু কারুর রাজপরিবার সম্বন্ধে নালিশ থাকলে তাকে এরা সহজে ছেড়ে দেবে না। তাছাড়া রাজার নতুন আইনগুলিও হয়তো সবার মনঃপূত নাও হতে পারে। কিন্তু ডেমোক্রেসির মতো ভোট দিয়ে নেতা বদল হবে না। সারা রাজ্যে ধূমপান কড়া নিষেধ। বিদেশী অতিথিরা নিজের ব্যবহারের জন্য একটুখানি আনতে পারেন শুধু। অ্যালকোহল সম্বন্ধে জানিনা কিন্তু দোকানে বাজারে সহজে দেখা যায় না। হোটেল রেস্তরাঁয় পাওয়া যায় ঠিকই। গাড়ির হর্ন বাজানো মানা, শব্দদূষণের জন্য। নেহাত বিপজ্জনক পাহাড়ি মোড়ে হর্ন বাজানো যেতে পারে। শহরে যানজট কমাতে প্রতি মঙ্গলবার প্রাইভেট গাড়ি চালানো মানা। এটা অবশ্য শুধু শহরের ভেতরেই এবং বাস ট্যাক্সি চড়ে বা পায়ে হেঁটে সবাই স্কুল অফিস করে। কিন্তু আগে থেকে না জানার জন্যে আমাদের শপিং ও রেস্তরাঁ ইত্যাদি যাওয়ায় একটু মুশকিল হয়েছিল বৈকি। মোটামুটি এসব নিয়ম পরিবেশ ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ভালোই। কিন্তু এসব ভুটানের মতো এক ধর্ম, এক ভাষা ছোট্ট দেশেই চলে। ভারত বা আমেরিকার মতো দেশে এরকম নিয়ম চালু করতে গেলে দাঙ্গা বেঁধে যাবে।

এইবার সুখী দেশ সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা যাক। এ-বিষয়ে আমার একটু অতিরিক্ত কৌতূহল আছে। ভুটান কি সত্যিই সুখী দেশ? দেশীয় বা জাতীয় সুখের সংজ্ঞা কী? কীভাবে জানা যায় দেশের লোকেরা কেমন আছে? এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে কিন্তু এর উত্তর পাওয়া সহজ নয়। তবু ভুটান এ-বিষয়ে সাহসী পদক্ষেপ করেছে। কিছু কিছু অন্যান্য দেশও ভুটানের অনুকরণে আগ্রহী। ১৯৭২ সালে ভুটানের চতুর্থ ড্রাগন রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক ঠিক করলেন যে বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী বাস্তব সুখের থেকে আত্মিক সুখের দরকার বেশি। তাই Gross National Product বা GNP-র সঙ্গে আরেকটা মাপক জুড়লেন -- Gross National Happiness (GNH). এটা হোল জাতীয় সুখের মাপকাঠি। সেই অনুযায়ী প্রশ্নের বিরাট লম্বা তালিকা সবাইকে পাঠানো হয়। তাতে আছে অগুনতি বেশ ব্যক্তিগত প্রশ্ন--জাতীয় সুরক্ষা, পরিবেশ রক্ষা, ব্যক্তিগত সুখ, পারিবারিক সুখ, আত্মিক ও ধার্মিক বিষয়ে তৃপ্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর অনেক জটিল ফরমুলা দিয়ে একটা নম্বর বের করা হায়--যেটা হচ্ছে GNH. বলা বাহুল্য অনেকেই এতে বিশ্বাস করেন না। সুখ বা তৃপ্তি এমন একটা ব্যক্তিগত মনোভাব যে একটা নম্বরে সেটা কখনোই মাপা যায় না। তাছাড়া এভাবে তথ্য জমা করে যে কোনো সরকার সেটা দুর্নীতিকর কাজেও লাগাতে পারেন। অন্যদিকে অনেকে মনে করে যে ভাবেই হোক একটা মাপ থাকলে ও বছর বছর একই ভাবে মাপলে সুখের বাড়াকমা সম্বন্ধে একটা আন্দাজ ঠিকই পাওয়া যাবে এবং খাওয়া-পরা ছাড়াও মানুষের তৃপ্তি ও প্রসন্নতার একটা দাম আছে। সেটাও ফেলনা নয়। যাই হোক ২০০৭ সালে একটা আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যায় দেখা যায় ভুটান পৃথিবীর সপ্তম সুখী ও এশিয়ায় সবথেকে প্রথম সুখী দেশ। আর তৃতীয় বিশ্বের কম GDP দেশগুলির মধ্যে ভুটানই সব থেকে সুখী।

কিন্তু সবাই কি একই ভাবে সুখী? আমি দু-একজন বয়স্ক ছাড়া কারুকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ পাইনি। আন্দাজ করেছিলাম রাজার আইন বলে কেউ এর বিরুদ্ধে কিছু বলবে না। তবু চুপ করে কিছু দেখলেও একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ফুন্টশুলিং শহরে ভিসার অফিসে ভুটানী তরুণ তরুণীদের ভিড়। তারা ভারতে এসে নিজেদের ভাগ্য বদলাতে চায়। মন্দিরে, চর্টেনে নোটিশ লাগানো, "জানি, তোমরা অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা জাতীয় পোষাক পরতে চাওনা। তবু তোমাদের প্রতি অনুরোধ, পূজাকর্মের সময় জাতীয় পোষাক পরতেই হবে।" এই দেখে মনে হয় এই নবীন প্রজন্ম বাইরের পৃথিবীর স্বাদ পেয়েছে এবং তারা একটু ডানা ছড়াতে চায়। এরা হয়তো দেশের স্থাণু অবস্থায় বড়োদের মতো আশ্বস্ত ও তৃপ্ত নয়। আশা করি তরুণ রাজা কোনো কঠোরতা ছাড়াই এদের দাবী মেটাবার চেষ্টা করবেন। দেখা যাক্‌।


সুখী মা ও সন্তান



(পরবাস-৫৩, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)