আমার সম্প্রতি ভুটান যাত্রার পিছনে একটা তুচ্ছ কারণ আছে। ২০১২ সালের আমেরিকার ইলেকশনে যখন ওবামা ও রম্নি একেবারে সমান সমান, আমার এক ডেমোক্র্যাট বন্ধু প্রতিজ্ঞা করে বসল যে রম্নি নির্বাচিত হলে সে দেশ ছেড়ে ভুটানে চলে যাবে। ভুটান নাকি ভারী সুন্দর সুখী দেশ! কিন্তু স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যাবার আগে তার ইচ্ছা আমি আমার দেশভ্রমণের সময় একটু যেন ভুটানে উঁকি দিয়ে আসি। বিদেশীদের ওখানে যাওয়া নাকি একটু মুশকিল, কিন্তু ভারতীয় নাগরিক হিসাবে আমি ইচ্ছা করলেই চট করে ভিসা পেতে পারি। একেবারেই বাজে কারণ। কিন্তু আমি নির্দ্বিধায় দায়িত্ব স্বীকার করে নিলাম। সত্যিই তো। ভারতের একেবারে দোরগোড়ায় এই দেশটি। সুখের দেশ, Shangri-La ইত্যাদি বলে কত নাম। একবার না গেলে চলে?
|
ভুটান একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছোট্ট দেশ, ভারত ও চীনের মধ্যে হিমালয় পাহাড়ের কোলে গুঁজে রাখা। উত্তরে চীন (তিব্বত) ও দক্ষিণে ভারতীয় প্রদেশ--আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও অরুণাচল প্রদেশ। সম্প্রতি সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে বাদানুবাদের পর ভুটান উত্তরের সীমানা বন্ধ করেছে এবং বাণিজ্য, ও সামরিক সুরক্ষার বিষয়ে ভারতের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ভারতীয় সৈনিকরা দেখলাম ভুটানের পাহাড়ে রাস্তা বানাচ্ছে। আর সীমানার দক্ষিণে ভারতীয় রাস্তাগুলি ভেঙেচুরে পড়ে আছে!
|
|
জলদাপাড়ার গণ্ডার ও হাতিদের কত নাম শুনেছি। এবার পার্কের অবস্থা দেখে কান্না পেল। আমরা গেছিলাম দেওয়ালির সময়। তখনও গেস্টহাউস জনমানবহীন। গাছপালার পাতা একেবারে ধুলায় ধূসর। ঐ অবস্থায় ঐ রাস্তা দিয়ে কেউই পার্কে বেড়াতে আসবেন না। কী দুর্দশা! কারুর উচিত মমতা ব্যানার্জীকে ধরে ঐ রাস্তায় গাড়িতে চড়ানো। তবে হয়তো রাস্তাটার কিছু উন্নতি হতেও পারে।
ফুনটশুলিং ব্যস্ত শহর। গাড়ি, ভিড়, ধুলো, ধোঁয়া সবকিছুই আছে। এখানেই আমাদের ভিসা ইত্যাদি চেক করা হল। ভিসার অফিসেও বেশ ভিড়। বেশিরভাগই ভুটানীরা, ভারতে যাবার ভিসার জন্য। আমরাও তৈরি হয়ে নিলাম। গাড়িতে পেট্রল ভরা হল। আর আমাদের পেট ভরা হল ভুটানী মো মো আর এমা দাতসী দিয়ে।
মোমো উত্তর-পূর্ব ভারতের সবথেকে জনপ্রিয় খাবার। চীনা ডামপলিং-এর মতো ময়দার লেটির ভেতরে মাংস বা মশলাদার সবজির পুর দিয়ে ভাজা অথবা ভাপে সেদ্ধ করা হয়। তারপর ঝাল চাটনির সঙ্গে গরম গরম পরিবেশন। এটা আমারও প্রিয় খাবার। আমি সকাল বিকেল শুধু মোমো খেয়েই খুশি। এমা দাতসিটাও ভুটানী খাবার - চীজ দিয়ে তৈরি, কিন্তু খেতে বেশ ঝাল ও মশলাদার। চীজ ও দুধ দিয়ে আলু বা অন্যান্য সবজির ঝোলের মতো খাবারটা। খুবই সুস্বাদু। ভুটানীরা বেশ লংকা খায়। লংকার আচার খুবই স্বাদের। ভুটানে প্রত্যেকের বাড়ির চালার ওপর পাকা লংকা রোদে শুকোতে দেখেছি। পানীয় হিসাবে ভুটানীরা চা খেতে ভালোবাসে। ভুটানী চায়ে দরাজ হাতে ইয়াকের দুধ ও মাখনের ব্যবহার হয়। চায়ে মাখনের নোনতা স্বাদ আর ইয়াকের দুধের গন্ধ। একটু সইয়ে নিতে পারলে মন্দ লাগে না। শীতের দেশে এই চা বেশ এনার্জি দেয়। ইয়াকের দুধে ফ্যাট খুব বেশি। দুধ জমিয়ে ঘন করে ছোটো ছোটো প্যাকেটে বিক্রি হয়। পাহাড়ি রাস্তার ধারে ধারে দোকানে এগুলো দেখেছি। ড্রাইভাররা এগুলো চিবোতে পছন্দ করে মনে হয়। লম্বা রাস্তায় যেতে এনার্জি দেয়। আমি অবশ্য খেয়ে দেখিনি।
|
হাইওয়েটা ফুনটশুলিং থেকে রাজধানী থিম্পু হয়ে পারো পর্যন্ত যায় সোজা। খুব একটা ভিড় নেই রাস্তায় এবং রাস্তাটাও বেশ ভালোভাবে তৈরি। উঁচু পাহাড়ি রাস্তা, এঁকে বেঁকে এ-পাহাড় থেকে ও-পাহাড়ে লাফিয়ে চলেছে। একদিকে খাড়া পাথর, অন্যদিকে গভীর খাদ। সরু রাস্তায় এক সেকেণ্ড অন্যমনস্ক হলেই বিপদ। এক এক জায়গায় দেখি ভয়াবহ ধ্বস। বিরাট বিরাট পাথরের চাঙড় রাস্তা গুঁড়িয়ে নিচের খাদে পড়েছে। নি:শ্বাস বন্ধ করে সাবধানে পার হই। কোনো কোনো জায়গায় রাস্তাটা আবার এক লেন। দু'দিকের ট্র্যাফিক একসঙ্গে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। মাঝপথে দৈত্যকায় লরির মুখোমুখি হলে ভীষণ সাবধানে পার হতে হয়। এজন্যে চাই শক্ত হাত ও ততোধিক শক্ত মন। আমাদের ড্রাইভারদের ধন্যবাদ--ওদের কাছে এসব হয়তো কিছুই নয়--রোজকার রাস্তা। আমাদেরই চোখ বন্ধ করে ইষ্টনাম জপতে হয়।
|
চোখ খোলা রাখলে দেখা যায় অপূর্ব পর্বতমালা, গাঢ় সবুজ থেকে দূর দূরান্তে আবছা ধূসর হয়ে আকাশে মিশে গেছে। নিচের উপত্যকায় সেগুন গাছের শ্রেণী। ওপরে উঠে সিডার ও ফার গাছের ভিড় বেশি দেখা যায়। অনেক নিচে খাদের দিকে তাকালে ঝিলমিল রূপালী ফিতের মতো পাহাড়ি নদী চলে এঁকে বেঁকে, কখনো ডানদিকে, কখনো বাঁয়ে। পথে পড়ে ছোটখাট গাঁ বা শহর। মোট মাথায় মজুরদের দেখা যায় হয়তো কোথাও ভাঙা রাস্তা মেরামত করতে চলেছে, দল বেঁধে স্কুলযাত্রী ছেলেমেয়েদের দেখা যায়। সবাই দেশীয় পোষাকে সজ্জিত। পুরুষদের গায়ে 'ঘো' (Gho)--অনেকটা হাঁটু অবধি লম্বা হাউসকোট, বেল্ট বাঁধা ও পায়ে লম্বা মোজা--স্কটদের কিলটের মতই। মেয়েদের পরনে লম্বা পা পর্যন্ত কিরা (Kira) স্কার্ট ও গায়ে পুরো হাতা ব্লাউজ। স্কুলেও এই ভাবেই ইউনিফর্ম তৈরি হয়। মেয়েদের গায়ে থাকে রঙিন শাল। সেটা প্রয়োজনে বাজারের থলি বা বাচ্চাদের পিঠে বাঁধার জন্য ব্যবহৃত হয়।
রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায় লম্বা দড়ি বাঁধা প্রার্থনা-পতাকা: নানা রংয়ের ছোট্ট চৌকো কাপড়ে তাতে প্রার্থনা ছাপা। সেগুলি দড়িতে বেঁধে টাঙিয়ে দেয়। ভক্তের প্রার্থনা পাহাড়ি হাওয়ায় উড়ে যায় ভগবানের দিকে। কোনো কোনো জায়গায় সোজা বাঁশ পুঁতে তাতে লম্বা পতাকা বাঁধা দেখা যায়। একদল পতাকাধারী বাঁশ বেশ একটা ছোট্ট বাগান তৈরি করে। সারা দেশে, সমস্ত উল্লেখযোগ্য জায়গায়, সব মন্দিরে, সমাধিস্থলে, কারণে, অকারণে এই রঙিন পতাকা সারা দেশে একটা উৎসবের আমেজ এনে দেয়। পতাকায় লেখাটা ভুটানী ভাষায় লেখাটা অনেকটা তিব্বতী ভাষার মতই, কয়েকটা অক্ষর আমার চোখে বাংলা লেখার মতো দেখায় যেন।
থিম্পু পৌঁছতে আমাদের লাগল প্রায় পাঁচ ঘন্টা। পারো শহর আরও দু-তিন ঘন্টার রাস্তা। আমরা থিম্পুতেই ঘাঁটি করব ঠিক করলাম। সেখান থেকেই পারো ও আশেপাশের দ্রষ্টব্য জায়গাগুলি দেখে নেব। পারো ও থিম্পু দুই শহরই ছোট্ট নদীর পাড়ে উপত্যকায়, চারদিকে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা প্রায় ৭৩০০ ফুট। হাঁটাচলা করতেই আমার হাঁফ ধরে যাচ্ছিল। পাহাড়ে চড়তে হলে তো আরও মুশকিল।
দোকানপাতি ও রেস্তরাঁগুলিও বেশ পরিষ্কার। চীনে তৈরি জিনিস খুবই কম। বেশির ভাগই ভুটানে বা ভারতে তৈরি। সব বাড়িঘর (এমনকি রাজার প্রাসাদ থেকে দু-তারা হোটেলও) দু-তিনতলার বেশি উঁচু নয়। আকাশচুম্বী অফিস বা ফ্ল্যাটের দেখা পাবেন না। সব বাড়ি ভুটানী ধাঁচে কাঠে তৈরি, ওপরে সুন্দর কারুকার্য দরজা ও জানলার ধারে। কোনো কোনো দোকানের দেয়ালে আমি পুরুষ লিঙ্গের ছবি আঁকা দেখেছি। তাই নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করেন। সেগুলি অবশ্য পর্নগ্রাফি নয়। এগুলি সৌভাগ্যের চিহ্ন। যাতে দুষ্ট লোকের নজর না লাগে।
|
|
থিম্পুর চর্টেনটি ১৯৭৪ সালে তৃতীয় রাজার স্মৃতিতে বানানো। কেন যে ঐ রাজার জন্য তা আমি জানি না। একেবারে শহরের মধ্যে বলে এখানে ট্যুরিস্টের বেশ ভিড়। আমি ছোট্ট ছোট্ট চর্টেন দেখেছি ঠিক রাস্তার চৌমাথায় স্থাপন করা। যাত্রার শুরুতে ড্রাইভার গাড়িতে চড়েই ওগুলো প্রদক্ষিণ করতে পারেন। সঙ্গে যাত্রা শুভর প্রার্থনা।
|
|
|
|
|
|
|
|
ভুটান একটি ছোট্ট, পরিচ্ছন্ন, সুন্দর পাহাড়ি দেশ। লোকেরা নম্র, বিনীত ও অতিথিবৎসল। সবাই তাদের জাতীয় ধর্ম, সভ্যতা ও পরিবেশ সম্বন্ধে খুব খেয়াল রাখে। বেড়াবার সময় আমার খালি মনে হচ্ছিল যে যদি তিব্বত চীনাদের দখলে না পড়ত হয়তো সে দেশও এইরকম ভুটানের মতোই হত বোধহয়। একটু বেশি ঠাণ্ডা, গাছপালাহীন, কিন্তু আদতে ভুটানের মতোই।
|
এইবার সুখী দেশ সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা যাক। এ-বিষয়ে আমার একটু অতিরিক্ত কৌতূহল আছে। ভুটান কি সত্যিই সুখী দেশ? দেশীয় বা জাতীয় সুখের সংজ্ঞা কী? কীভাবে জানা যায় দেশের লোকেরা কেমন আছে? এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে কিন্তু এর উত্তর পাওয়া সহজ নয়। তবু ভুটান এ-বিষয়ে সাহসী পদক্ষেপ করেছে। কিছু কিছু অন্যান্য দেশও ভুটানের অনুকরণে আগ্রহী। ১৯৭২ সালে ভুটানের চতুর্থ ড্রাগন রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক ঠিক করলেন যে বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী বাস্তব সুখের থেকে আত্মিক সুখের দরকার বেশি। তাই Gross National Product বা GNP-র সঙ্গে আরেকটা মাপক জুড়লেন -- Gross National Happiness (GNH). এটা হোল জাতীয় সুখের মাপকাঠি। সেই অনুযায়ী প্রশ্নের বিরাট লম্বা তালিকা সবাইকে পাঠানো হয়। তাতে আছে অগুনতি বেশ ব্যক্তিগত প্রশ্ন--জাতীয় সুরক্ষা, পরিবেশ রক্ষা, ব্যক্তিগত সুখ, পারিবারিক সুখ, আত্মিক ও ধার্মিক বিষয়ে তৃপ্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর অনেক জটিল ফরমুলা দিয়ে একটা নম্বর বের করা হায়--যেটা হচ্ছে GNH. বলা বাহুল্য অনেকেই এতে বিশ্বাস করেন না। সুখ বা তৃপ্তি এমন একটা ব্যক্তিগত মনোভাব যে একটা নম্বরে সেটা কখনোই মাপা যায় না। তাছাড়া এভাবে তথ্য জমা করে যে কোনো সরকার সেটা দুর্নীতিকর কাজেও লাগাতে পারেন। অন্যদিকে অনেকে মনে করে যে ভাবেই হোক একটা মাপ থাকলে ও বছর বছর একই ভাবে মাপলে সুখের বাড়াকমা সম্বন্ধে একটা আন্দাজ ঠিকই পাওয়া যাবে এবং খাওয়া-পরা ছাড়াও মানুষের তৃপ্তি ও প্রসন্নতার একটা দাম আছে। সেটাও ফেলনা নয়। যাই হোক ২০০৭ সালে একটা আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যায় দেখা যায় ভুটান পৃথিবীর সপ্তম সুখী ও এশিয়ায় সবথেকে প্রথম সুখী দেশ। আর তৃতীয় বিশ্বের কম GDP দেশগুলির মধ্যে ভুটানই সব থেকে সুখী।
কিন্তু সবাই কি একই ভাবে সুখী? আমি দু-একজন বয়স্ক ছাড়া কারুকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ পাইনি। আন্দাজ করেছিলাম রাজার আইন বলে কেউ এর বিরুদ্ধে কিছু বলবে না। তবু চুপ করে কিছু দেখলেও একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ফুন্টশুলিং শহরে ভিসার অফিসে ভুটানী তরুণ তরুণীদের ভিড়। তারা ভারতে এসে নিজেদের ভাগ্য বদলাতে চায়। মন্দিরে, চর্টেনে নোটিশ লাগানো, "জানি, তোমরা অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা জাতীয় পোষাক পরতে চাওনা। তবু তোমাদের প্রতি অনুরোধ, পূজাকর্মের সময় জাতীয় পোষাক পরতেই হবে।" এই দেখে মনে হয় এই নবীন প্রজন্ম বাইরের পৃথিবীর স্বাদ পেয়েছে এবং তারা একটু ডানা ছড়াতে চায়। এরা হয়তো দেশের স্থাণু অবস্থায় বড়োদের মতো আশ্বস্ত ও তৃপ্ত নয়। আশা করি তরুণ রাজা কোনো কঠোরতা ছাড়াই এদের দাবী মেটাবার চেষ্টা করবেন। দেখা যাক্।
|
ভ্রমণকালঃ নভেম্বর, ২০১২
(পরবাস-৫৩, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)