চিত্রাদি ফোনে বললেন, আমার নাতির জন্যে একটা অপ্রচলিত, শ্রুতিমধুর নাম পাঠিও। সেই থেকে ছোটো, বড়ো, মাঝারি নানারকমের শব্দ নিয়ে খেলা শুরু হল মাথার ভিতরে। অনেক নাম অথবা শব্দ ভিড় করতে থাকল। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই নীরব শব্দটা মাথায় এল। ভাবলাম, এই নামটি পাঠালে কেমন হয়! কিন্তু এই শব্দটি উচ্চারণ করতেই নীরবের কথা মনে পড়ে গেল। একই পাড়ায় থাকতাম। কিন্তু কখনোই বন্ধুত্ব হয়নি। তবে দেখা হলে টুকটাক কথা হত। কেন জানিনা 'ও' কারো সাথেই তেমন একটা জড়াতে চাইত না। তবু ওকে আমার ভালো লাগত। কিন্তু ঠিকঠিক করে বলা মুশকিল এই ভালোলাগার উৎস কোথায়। নীরব কবিতা ও কবিদের কথা বলত, সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করার কথা বলত, রাজনীতিতে মুক্ত চিন্তার কথা বলত, নীরব ভালোবাসার কথাও বলত। নীরব মুখ তুলে তাকাতে চাইত না। ওকে কেউ কখন কোনো বিষয়ে মুখর হতে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকালে বোঝা যেত ভেতরে ভেতরে একটা গনগনে আগুন লালন করছে। কী যেন একটা বলতে চাইছে। কখনও কখনও নীরবের মুখে শোনা গেছে, 'কোন জীবনই অর্থহীন নয়, শুধু অর্থময় করে নিতে হয়।' ওর চোখ দুটি বড় আত্মবিশ্বাসী ছিল। নীরব কোনো মেয়েকে বিশেষভাবে ভালবাসত কি না সেটা কেউ জানে না। কোনোভাবে ওর জীবনে বিশ্বাস হননের মতো কোনো ঘটনা ঘটেছিল কিনা সেটাও খুব স্পষ্ট নয়। কোনো প্রতারকের মুখোমুখি হলে ঘৃণায়, ক্রোধে ওর শরীরটা রি-রি করে উঠত কি না তা জানা যায়নি। রাস্তায় পড়ে থাকা কোনো 'থ্যাঁতা ইঁদুর' দেখলে অথবা অশ্বত্থ গাছের কোনো অভিশপ্ত শাখার দিকে চোখ পড়লে ওর কিছু মনে হত কি না কেউ জানে না। নীরবের বিশ্বাসের জগতটা কেমন ছিল সবার কাছে তা খুব স্পষ্ট ছিল না। ওর আদৌ বিশেষ কোনো বিশ্বাসের জায়গা ছিল কিনা কেউ জানে না। জীবনের কোনো দুর্বলতমে মুহূর্তে পরমেশ্বরের ভাবনায় নীরব অকারণ আপ্লুত হত কিনা সেটাও জানা যায়নি কখনো।
এরকম অনেক জানা-অজানায় জড়ানো ছিল ওর জীবন। ওর ভেতরটা কিছুতেই অনুমান করা যেত না। তবুও ওর প্রতি অনেকের এক ধরনের ভালোলাগা ছিল, ভালোবাসা ছিল। কিন্তু কেন এই ভালোলাগা, কিসের এই ভালোলাগা অথবা ভালোবাসা অনেকের কাছেই তা পরিষ্কার ছিল না। তবু এই অধরা নীরবকে কখনই দূরের মানুষ মনে হত না। পৃথিবীতে কোনো কোনো মানুষ থাকে যাদের প্রতি এক ধরনের অদৃশ্য আকর্ষণ কাজ করে। এর গতি প্রকৃতি ঠিক ঠিক করে বোঝা যায় না, চেনা যায় না, কোনো বিশেষ সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। নীরবের মধ্যে এমন কিছু বিরল মানবিক উপাদান ছিল যা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির চেয়েও শক্তিশালী। তাই ওর প্রতি সারাক্ষণের একটা সর্বগ্রাসী টান অনুভব করা যেত। বড় কাছের মানুষ মনে হত, নিজের মানুষ মনে হত। মনে হত নীরব জন্মজন্মান্তরের চেনা কেউ।
এরকম অনপেক্ষ একজন মানুষ কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে হঠাৎ করেই একদিন নাই হয়ে গেল, হারিয়ে গেল নিঃশব্দে। সেদিন প্রকৃতিতে কোনো হাহাকার উঠেছিল কি? সেদিন সূর্যোদয় অথবা সূর্যাস্তের মুহূর্তে কোনো কান্নার শব্দ শোনা গিয়েছিল কি? সেদিনের সকাল অথবা সন্ধ্যা প্রতিদিনের সকাল-সন্ধ্যার মতোই কি স্বাভাবিক ছিল, স্বতঃস্ফূর্ত ছিল? এসবের কোনো কিছুই কেউ জানে না। তবে নীরবকে শেষ বারের মতো ট্রাম লাইনের ধার দিয়ে হাঁটতে দেখা গেছে এক শরৎ সন্ধ্যায়। ঠিক সেই একই পথে ৫৪-এর অন্য আরেক শরৎ সন্ধ্যায় কবি জীবনানন্দ দাশ হেঁটে গিয়েছিলেন উড়ন্ত উদাসীনতায়। এরপর নীরবকে আর কখনই দেখা যায় নি। নীরবের কথা কেউ শোনেনি।
সারাটা জীবন ধরে শত শত, লক্ষ লক্ষ ঘটনা ঘটেছে। সেসব কথা স্মৃতির গহীনে তলিয়ে গেছে, ঝরে গেছে, হারিয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে। এতদিন পর কেন শুধু নীরবের কথাই মনে পড়ল, কেন স্মৃতির অতলে ডুবে যাওয়া স্মৃতি আবার জেগে উঠল, কেন বুকের ভেতরটা খালি হয়ে গেল, সেই কবেকার যন্ত্রণাটা আবার কেন চিনচিনিয়ে উঠল? এর কোনো উপযুক্ত উত্তর জানি না। তবে হঠাৎ করে মনে আসা এই নীরব শব্দটি কেবলমাত্র একটি শব্দ অথবা একটি নাম থাকল না আর। ধীরে ধীরে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে উঠল। তার উদ্ভাসিত উপস্থিতি আমাকে আচ্ছন্ন করল, উতলা করল, উদভ্রান্ত করল, সর্বশক্তি দিয়ে যেন জড়িয়ে ধরল। আমার অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল। তারপর ঠিক কি যে হল জানি না। কিন্তু কিছুতেই এই নামটি আর চিত্রাদিকে পাঠাতে পারলাম না।
(পরবাস-৫৩, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)