ISSN 1563-8685




বাংলা গান : অদীন ভুবন 'অসম্পূর্ণ চেনার বেদনা'


বাংলা গান : অদীন ভুবন; সম্পাদনা : সুধীর চক্রবর্তী; প্রথম প্রকাশ : আগস্ট ২০১১, কারিগর - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ২৯২ ; ISBN : 978-81-920613-0-6

বাংলা গানের ঋদ্ধ ঐতিহ্য প্রায় হাজার বছর ধরে চর্যাপদের কাল থেকে প্রবাহিত বলে বলা হয়। সেই যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা গান অন্যান্য ভারতীয় গানের থেকে একটু স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পেরেছে। এই স্বাতন্ত্র্য, অনায়াসে বলা যায়, নিহিত আছে তার বাণীমুখিতায়। যে কোনো ধরনের বাংলা গান এই স্বভাব-বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। বাংলা গানের সেই সমৃদ্ধ রূপটি এই সংকলন পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছে। এই সংকলনের উপস্থাপনা কোথায় কতদূর সফল আর কোথায় বা ব্যর্থ সে বিচার না করে নির্দ্বিধায় বলা যায় বাংলা গানের এই দুঃসময়ে এমন একটি সংকলনের প্রয়োজন ছিল। বাংলা গানের আদর্শ ও ঐতিহ্য তুলে ধরার প্রয়োজন থেকেই এমন একটি সংকলনের প্রকাশ। বাংলার সাম্প্রতিক গানে বাঙালিত্ব আমরা কতটা হারাতে বসেছি তার মূল্যায়নে এই সংকলন আমাদের সাহায্য করবে। আবার এই সংকলনের বিষয়বস্তুর মধ্যে না গিয়েও বলা যায় যে বাণীমুখী বাংলা গানে সুর তাল লয় ছন্দের যে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে তার অন্তত আংশিক পরিচয়ও পাওয়া যাবে।

সংকলনের সুযোগ্য সম্পাদক সুধীর চক্রবর্তী তাঁর আত্মপক্ষে আমাদের যে-সব তথ্য জানিয়েছেন সেগুলি এইরকম। সংকলিত লেখাগুলি প্রায় সবই 'ধ্রুবপদ' থেকে গৃহীত, কোনোটি বা হুবহু, কোনোটি পরিমার্জিত রূপে। বর্তমান সংকলনটিতে আঠারোটি লেখা চতুষ্পর্বে বিভক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। প্রবীণ লেখকদের তুলনায় নবীন লেখকদের লেখায় তত্ত্ব কম তথ্য বেশি। এ বিষয়ে যথাস্থানে আলোচনা করা হয়েছে। সংকলনে প্রকাশিত আঠারোটি নিবন্ধের মধ্যে চারটি কি পাঁচটি নিবন্ধ কোনো বিশেষ গীতিকার ও সুরকারের কৃতি বিষয়ে। এই তালিকায় স্বভাবতই আগে আছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গান নিয়ে রচনা আছে অন্তত তিনটি, বিবেকানন্দ বিষয়ে একটি, নজরুল বিষয়ে একটি রসগ্রাহী আলোচনা ও একটি তথ্যবহুল স্মৃতিচারণা আছে। রবীন্দ্রোত্তর রচয়িতা নিয়েও কয়েকটি নিবন্ধ আছে। 'ধ্রুবপদ'-এর যারা নিয়মিত পাঠক ছিলেন তাঁদের কাছে এই সংকলনের অধিকাংশ লেখাই পূর্বপঠিত।

আলোচ্য সংকলনের সব লেখাগুলির মধ্যে অধিকাংশ লেখা কয়েকটি শ্রেণীতে বিভাজনযোগ্য। মূল তিনটি শ্রেণী হল - তত্ত্বমূলক, তথ্যমূলক ও স্মৃতিচারণাধর্মী। অবশ্য তত্ত্বমূলক লেখায় তথ্য নেই এমন নয় আবার স্মৃতিচারণাও তথ্যের সন্নিবেশে ভরপুর। তবু অনেক তথ্য আমাদের উৎসাহ বাড়ায়, কৌতূহল উদ্রিক্ত করে। আবার অনেক লেখায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে তথ্য দেওয়া হয়েছে, অথচ কোনো সূত্র নির্দেশ করা হয় নি। এতে পাঠকের চাহিদা অপূর্ণ থাকে। আর প্রসঙ্গটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও তা কেবল কল্পকাহিনীর স্তরেই থেকে যায়।

রচনাগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখের দাবি রাখে রমাকান্ত চক্রবর্তীর 'বাংলা গান : ১৭৫৭-১৯০০'। এই নিবন্ধটি সংকলনের অন্যতম সম্পদ। অবশ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা গানের পরিচয় তেমন করে এ নিবন্ধে পাওয়া যায় না। লেখক জানিয়েছেন "অষ্টাদশ শতকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সুরধারা বঙ্গে আসে।" কিন্তু এই সুরধারা বাংলা গানে কিভাবে প্রযুক্ত হল তার কোনো হদিশ এ নিবন্ধে পাওয়া যায় না। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের জানান যে সেযুগে অসংখ্য কবি গান লিখেছিলেন এবং মার্গসংগীতের রাগরাগিনী ও তাল সেগুলিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু "পেশাদার ঐতিহাসিকগণ পুরাতন বাংলা গানের ঐতিহাসিক মূল্য অনুভব করেন নি।" সেই কারণেই অষ্টাদশ শতকের বাংলা গান বিষয়ে কিছুই সংরক্ষিত হয় নি বলে নিবন্ধকারের আশংকা। তাঁর লেখায় তাই প্রথম উল্লেখ দেখি ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রাধামোহন সেনদাসের বাংলাগানের সংকলন 'সংগীততরঙ্গ'-এর। বহু পুরাতন লুপ্ত গানের পুনরুদ্ধার প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ঐকান্তিক ও কষ্টসাধ্য প্রয়াসের কথা নিবন্ধে শ্রদ্ধায় উল্লেখ করেন রমাকান্ত। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে সংকলনের মাধ্যমেই পুরাতন গান সংরক্ষণের প্রয়াস আমরা দেখতে পাই। রমাকান্ত চক্রবর্তী সেইসময়কার গীতসংকলনের একটি দীর্ঘ তালিকা এই নিবন্ধে সংকলিত করেছেন। সেই সময়কার সব রকমের বাংলা গান, গান-বিষয়ক গ্রন্থ ও রচয়িতাদের পরিচয়ে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর নিবন্ধটি। নিবন্ধের শেষে সংযোজিত তাঁর কীর্তন কবিগান কথকতা ও যাত্রাশিল্পীদের সুদীর্ঘ তালিকা আমাদের বিস্ময় উদ্রেক করে। লেখকের পরিশ্রমী সতর্ক তথ্যনিষ্ঠা সকল গবেষকের কাছেই শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে বলে মনে হয়।

"'বন্দে মাতরম্‌'-এর সুর : উৎস ও বৈচিত্র্য" শীর্ষক নিবন্ধটি এই সংকলনের আর একটি সেরা রচনা। লেখক অনন্তকুমার চক্রবর্তীর প্রয়াণে এক বিদগ্ধ নির্মোহ সংগীতসাহিত্যবিশারদকে আমরা হারালাম। তাঁর এই ঋদ্ধ নিবন্ধে 'বন্দে মাতরম্‌' গানের আদ্যন্ত পরিচয় তিনি রেখে গেলেন। এই গানের রচনাকাল, জাতীয় সংগীত হিসেবে গানটি গৃহীত হবার প্রেক্ষাপট এবং বিভিন্ন কণ্ঠে এই গানের গায়ন ও বাদনের সারণিবদ্ধ দীর্ঘ ইতিহাস, বিভিন্ন সুরদাতাদের সুর দেবার দৃষ্টিভঙ্গি ও তাঁদের ব্যবহৃত রাগতাল ব্যবহারের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন - এই সব তথ্যের এক সম্পূর্ণাঙ্গ ও শ্রমসাধ্য প্রতিবেদন এই নিবন্ধের মূল উপজীব্য। এই সংবাদ আমাদের হ্লাদিত করে যে যদুভট্টের মতো কিংবদন্তি সংগীতগায়ক এই গানের প্রথম সুরকার। আবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাগ্যকে ধিক্কার জানাই (কারণ নিজেদের বঞ্চিত মনে করি) এই দুঃসংবাদে যে সুরটি সংরক্ষিত হয় নি। যদুভট্টের মতো বরিষ্ঠ ধ্রুপদাচার্য কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেমন সুরযোজনা করেছিলেন, তাতে কোন রাগ ব্যবহৃত হয়েছিল বা কোন তালকে এই গানের উপযুক্ত মনে করেছিলেন—এই সব তথ্যের বিলুপ্তি চির-চিরদিনের মতো বাংলা গানের উত্তরসূরী সব প্রজন্মের কাছেই এক দুর্বহ দুর্ভাগ্য। 'বন্দে মাতরম্‌' গানটির দ্বিতীয় সুরকার এবং প্রথম প্রকাশ্য গায়ক রবীন্দ্রনাথ। জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে উদ্বোধন সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন। তবে এই কংগ্রেস অধিবেশনের সঠিক তারিখ নিয়ে যে মতভেদ সে বিষয়ে নিবন্ধকার সুযুক্তিসহকারে আলোচনা করেছেন। এই নিবন্ধের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি নিবন্ধশেষে প্রাপ্ত দুটি তথ্যঋদ্ধ তালিকা। এই তালিকায় লেখক তাঁর জ্ঞাত ও শ্রুত বিভিন্ন রেকর্ড ও ক্যাসেটের একটি সারণি দিয়েছেন। গান শোনার ও সংগ্রহের, পাঠবিষয়ে তাঁর পাঠের বিস্তৃত পরিধির পরিচয় এইখানেই।

বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্মমহাসভায় হিন্দুধর্মের গৌরবগাথা গেয়ে ধর্মীয় পুনরুজ্জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ বলে গণ্য হন, এবং তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ ছিলেন। এই দুটি পরিচয় ছাড়াও আরো বহুবিধ পরিচয়ে তিনি আমাদের সামনে আসছেন তাঁর সার্ধশতবার্ষিকী নানা স্মরণে। কিন্তু তিনি যে একজন সংগীতভাবুক গায়ক ছিলেন, গানের রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন - এই সমুল্লেখযোগ্য পরিচয় আমাদের সামনে তত গুরুত্ব দিয়ে উপস্থিত করা হয় না। সর্বানন্দ চৌধুরীর "স্বামী বিবেকানন্দের সংগীতচেতনা : বাংলা গীতসংকলনের আদিপর্ব" নিবন্ধে বিবেকানন্দের এই পরিচয় আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। এই নিবন্ধে সর্বানন্দ চৌধুরী বিবেকানন্দের সংগীতশিক্ষা, তাঁর গায়ন ও সংগীতরচনা এবং সংগীতচিন্তার বিষয়ে একটি সম্যক ধারণা উপস্থিত করেছেন। যদিও তাঁর লেখা মূলত বিবেকানন্দ সংকলিত 'সংগীতকল্পতরু' গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করেই। তাঁর নিবন্ধের শেষে বিবেকানন্দরচিত ছ'টি গানের একটি তালিকা সংযোজন করেছেন। কিন্তু ছ'টি গানই কি বিবেকানন্দ রচিত গানের সম্পূর্ণ তালিকা? এ বিষয়ে লেখক বিশেষ আলোকপাত করেন নি। হয়তো তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবৎকালে স্বল্প গানই বিবেকানন্দ রচনা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে ও সংগ্রহে ছিল সে-যুগের ভক্তিগানের এক অমিত ভাণ্ডার। অন্যরকমের ধর্মবোধের প্রবক্তা বিবেকানন্দ যে তৎকালীন সময়ের এক দীক্ষিত গায়ক ও গীততত্ত্ববিদ ছিলেন সেই পরিচয়ও তো আমাদের কাছে শ্লাঘনীয়। সর্বানন্দ চৌধুরী সেই পরিচয়টি আমাদের কাছে উদ্ঘাটিত করেছেন।

আলোচ্য সংকলনে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে দুটি রচনা প্রকাশিত হয়েছে। 'সাধক নজরুল' শিরোনামে দিলীপকুমার রায়ের পুনর্মুদ্রিত লেখাটিতে স্মৃতিচারণার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের ব্যাক্তিত্ব বিষয়ে মুগ্ধতার পরিচয় যতটা পাই নজরুলের সংগীতকৃতি বিষয়ে তন্নিষ্ঠ আলোচনা তত পাওয়া যায় না। আলোচনাটিতে "মজলিশি সভাসদ, হাসিগল্পে আনন্দদাতা, গায়ক, আবৃত্তিকার, সুরকার, গুণীর গুণগ্রাহী, উদার, সরল" নজরুলের পরিচয় দিয়েছেন দিলীপকুমার। নজরুলের অনেক গান তিনি পছন্দ করতেন এবং গাইতেন। পছন্দ করতেন, কারণ নজরুলও দ্বিজেন্দ্রলাল ও অতুলপ্রসাদের মতো তাঁর গানে সুরবিহারের স্বাধীনতা সানন্দেই দিলীপকুমারকে দিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু ও নজরুলের সঙ্গে দিলীপকুমারের প্রগাঢ় সম্পর্কের কথা এই নিবন্ধে বলা হয়েছে। নজরুলের কবিতার বিদ্রোহী সুর দিলীপকুমারকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর নিবন্ধের অনেকখানি জুড়ে কবি নজরুলের বিদ্রোহী ভাববস্তুর মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর দেশপ্রেমের উদ্দীপনামূলক ও ভক্তিরসাশ্রিত গানের দীর্ঘ উদ্ধৃতিও তাঁর নিবন্ধে আছে। যে গানগুলি দিলীপকুমার গাইতেন বলে তালিকা দিয়েছেন তার মধ্যে গজলভঙ্গিম কিছু গানও আছে। বাংলা গীতিরীতিতে গজলের আঙ্গিক প্রবর্তনই তো নজরুলের বিশিষ্ট অবদান। সে বিষয়ে দিলীপকুমার আলাদা করে কিছু বলেন নি। তাঁর নিবন্ধের শেষে বলেছেন "কাজির সম্বন্ধে আরও কত কথাই বলার ছিল। কিন্তু একটি নিবন্ধে অত ভার সইবে না। তাই তার ছন্দের কলি, সুরের বৈশিষ্ট্য, আনন্দের নানা রং-রূপ, উপলব্ধির হাতছানি অনুসরণ করে ভক্তির অনন্যতন্ত্র-গতি আরও কত কী বলা হল বা নাই হল আরও কত গুণী দরদী রসিক আছেন তারা বলবেন কাজির এ সব কীর্তির কথা"।

নজরুল-বিষয়ক দ্বিতীয় স্মৃতিচারণাটির লেখক প্রয়াত সুরকার নিতাই ঘটক। তিনি নজরুলের সংগীত সহকারীও ছিলেন। তাঁর লেখায় নজরুলের আরও কয়েকটি দিক উদ্ঘাটিত হয়েছে। গান লেখা সুর দেওয়া আর গাওয়া - এই তিনটি পরিচয় নজরুল সম্পর্কে সর্বজাত। কিন্তু চলন্ত ট্রেনে বসে রবীন্দ্রগানের প্যারডি রচনার কথা বোধহয় অনেকেই জানে না। প্যারডি গানটি উল্লেখও করেছেন নিতাই ঘটক। সংস্কৃতির যেসব ক্ষেত্রে নজরুল সমধিক পরিচিত নন বর্তমান প্রজন্মের কাছে, নিতাই ঘটক তার লেখায় তারই কিছু নিদর্শন উপস্থিত করেছেন। নজরুল সিনেমা গান গেয়েছেন, সংগীত পরিচালনা করেছেন, এমন কি একটি সিনেমায় নারদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নারদের যে প্রচলিত মূর্তি আমাদের কল্পনায় আছে তাকে ধূলিসাৎ করে নজরুল যুবকের বেশে নারদচরিত্রে অবতীর্ণ হন। তিনি 'সাপুড়ে' ছবির নাট্যকার, গীতরচয়িতা সুরকার এবং নিশ্চয়ই সংগীতপরিচালক। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাস অবলম্বনে নজরুল যে ছবি তৈরি করেন তাতে তিনটি রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহৃত হয়। বিশ্বভারতীর পর্যবেক্ষকরা গান তিনটিকে অনুমোদন দেন না। নজরুল তখন ফিল্মটির কপি, প্রোজেকশন মেশিন এবং তার সহকারী মানু গাঙ্গুলিকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে যান। রবীন্দ্রনাথ সব বৃত্তান্ত শোনার পরে গানগুলি না শুনে এবং ছবিটি না দেখেই অনুমতিপত্রে সই দেন। নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বলেন, "কী কাণ্ড বলো তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন আক্কেলে তোমার দোষ ধরে? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে। আমার গানের মর্যাদা কি বেশি দিতে পারবে?" লেখক কোনো তথ্যসূত্র না দিয়েই এই ঘটনাটির বিবরণ দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে নানা প্রশ্ন পাঠককে তাড়িত করে। কবে নাগাদ গোরা ছবিটি নির্মিত হয়েছিল? ছবিটি কি সাধারণের দেখার জন্যে প্রদর্শিত হয়েছিল? কোন তিনটি গান তাতে ব্যবহৃত হয়েছিল? নজরুল কবে নাগাদ শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন? এটিই কি তাঁর প্রথম শান্তিনিকেতন যাওয়া? এই সব নানা প্রশ্ন ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে পাঠকের কৌতূহল জাগায়। তার চেয়েও বড় কথা রবীন্দ্রনাথ গানগুলি না শুনেই গানগুলির জন্যে অনুমোদন দিয়ে দিলেন - এই তথ্যটি প্রণিধানযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান সম্পর্কে খুবই স্পর্শকাতর ছিলেন। দিলীপকুমারকে পর্যন্ত সুরবিহারসহযোগে তাঁর গান গাইবার অনুমতি দেন নি। এদিক থেকে নজরুলকে সৌভাগ্যবান বলতে হবে।

আলোচ্য সংকলনে রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ক তিনটি নিবন্ধ আছে। 'রবীন্দ্রসংগীতের গায়নস্বৈরতা : জিজ্ঞাসুর প্রশ্ন', 'রাগিনীর মরীচিকা' এবং 'রবীন্দ্রসংগীতের শক্তি'। এই তিনটির লেখক যথাক্রমে সদ্যপ্রয়াত রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ সুভাষ চৌধুরী, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এই তিনটি নিবন্ধেরই সাধারণ বিষয় রবীন্দ্রসংগীত হলেও লেখকরা নিজ নিজ উপলব্ধির আলোয় রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রসংগীতের আলোচনা আজ বহুধাবিস্তৃত এবং এইসব আলোচনার সিংহভাগ রবীন্দ্রসংগীতের কাব্যিক উৎকর্ষ, তার ভাববস্তুর গভীরতা ও বহুবিস্তার, লিরিকের অর্থগৌরব, অর্থাৎ সরলীকৃত এক কথায় বলতে গেলে, রবীন্দ্রসংগীতের বাণীর দিক নানাভাবে বিশ্লেষিত হয়। উল্লিখিত দ্বিতীয় লেখাটির বিষয় সেই বাণী ও তার অর্থগৌরব। সুখ্যাত সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলাদেশের বিশেষ প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রসংগীতের সমাজতত্ত্ব ব্যাখ্যা করে আমাদের জানিয়ে দেন যে রবীন্দ্রনাথের গান যেহেতু ব্যক্তির কাছেই মূলত আবেদনশীল, তাই বাংলাদেশের নির্মীয়মাণ সচেতন সমাজে রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা সমাজকে প্রত্যয়শীল করে তুলছে। ব্যক্তির বিকাশ যতই ঘটবে বাইরের আঘাতকে প্রত্যাহত করে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা ততই বাড়বে। তার লেখার শেষ বাক্যদুটি উদ্ধার করি "... শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষমতা অসাধারণ। শক্ত মানুষের সমবেত শক্তি মানববিরোধী অচলায়তন ভাঙার অন্যতম প্রেরণা তো বটেই।"

রবীন্দ্রনাথের গানে গায়নস্বৈরতা একটি পুরাতন সমস্যা, অথচ এ বিষয়ে ক্কচিৎ আলোচনা হয়েছে। রবিবাবুর গান যখন পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীত হয়ে ওঠে নি তখনকার কাল থেকেই এই স্বৈরতার প্রাদুর্ভাব। এখনও সেই স্বৈরতা বহালতবিয়তে বর্তমান। রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট প্রত্যাহৃত হবার পরে এই স্বৈরতা প্রায় মহামারীর রূপ নিয়েছে। কিন্তু সুভাষ চৌধুরীর আলোচ্য বিষয় একটু ভিন্ন ধরনের স্বৈরতা। তিনি এক বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রসংগীতে প্রচল একটি সমস্যাকে উপস্থিত করে কিছু প্রশ্ন রেখেছেন এবং তার উত্তরও দিয়েছেন। তাঁর মূল জিজ্ঞাসা এই যে তালবদ্ধ স্বরলিপি থাকা সত্ত্বেও কেন বিশেষ করে ঢালা বা মুক্তছন্দের গানগুলির গায়নে বিখ্যাত অখ্যাত নির্বিশেষে সব শিল্পীদের ক্ষেত্রেই বিস্ময়কর বিভিন্নতা দেখা দেয়। বিশেষ করে এখন রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা প্রসার ও প্রচার বিপুল এবং অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসংগীত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে পাঠ্যবিষয়। তাই সুরে তালে গায়নে একটি নির্দিষ্ট সর্বজনগ্রাহ্য মান নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ঘটছে তার বিপরীত। বিশেষ করে মুক্ত ছন্দের গানে যাকে ঢালা গানও বলা হয় স্বৈর গায়ন অত্যন্ত প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। সুভাষ চৌধুরী তাঁর নিবন্ধে তিনটি সারণি দিয়ে দেখিয়েছেন তালবদ্ধ স্বরলিপি থাকা সত্ত্বেও কিছু গান মুক্ত ছন্দে গাওয়া হচ্ছে। এর ফলে গানের বাণীর সুসংবদ্ধতা এলিয়ে পড়ছে, অর্থবোধ ধাক্কা খাচ্ছে এবং যত্রতত্র টপ্পার অলংকরণে গানকে অযথা ভারাক্রান্ত করা হচ্ছে। অথচ এই পরিবর্তনের কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে বলেছেন তাঁরা গুরুপরম্পরায় শিখে এইভাবে গেয়ে ঐতিহ্য বজায় রাখছেন। রবীন্দ্রনাথের নিজের গাওয়া গানের সঙ্গেও অনেক কিংবদন্তী শিল্পীর গায়ন মিলছে না। সেক্ষেত্রে ঐতিহ্য কোথায় গেল? সুভাষ চৌধুরী এই সংকটের জন্য স্বরলিপিকারদেরও খানিকটা দায়ী করেছেন। 'বাজাও রে মোহন বাঁশি'- গানটির স্বরলিপি করার ক্ষেত্রে ইন্দিরা দেবী সুর ও ছন্দের, যতির ও লয়ের প্রতি যে প্রাজ্ঞ অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন পরবর্তী স্বরলিপিকাররা সেই ঐতিহ্য ধরে রাখলে মুক্তছন্দের বা ঢালা গানের ক্ষেত্রে এই স্বৈরতা হয়তো খানিকটা ঠেকানো যেত। আলোচ্য সংকলনে এই একটি নিবন্ধেই গানক্রিয়ার ব্যবহারিক দিক নিয়ে এমন বাস্তববোধসম্পন্ন আলোচনা আছে। ভাবতে কষ্ট হয় তাঁর কলমে এক চিন্তা-উদ্রেকী রচনা আর পাব না।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের 'বাংলা গানে পুরুষকণ্ঠ' শীর্ষক নিবন্ধটি বাংলা গানের রচয়িতাদের পুরুষসত্তা নারীর প্রেমকে কেমনভাবে চিত্রিত করে তারই প্রতিবেদন। বাংলা গানের প্রেমসংগীত রচয়িতারা প্রায় সকলেই পুরুষ। পুরুষ তার প্রেমিকাকে যে রূপে দেখতে চায় পুরুষের সেই ইচ্ছাপূরক রূপেই প্রেমের গানে প্রেমিকাদের উপস্থিতি। রবীন্দ্রনাথের 'দীপ নিবে গেছে মম' গানটি সম্পর্কে সনজীদা খাতুনের একটি বিশ্লেষণী উদ্ধৃতি দিয়ে নিবন্ধকার দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথও কিভাবে প্রেমিকাকে চিরপ্রতীক্ষমানা রূপে দেখিয়েছেন। প্রেমানুভূতির দ্বৈধ অবশ্যই আছে। প্রেম নিয়ে নারীর অনুভব তার নিজস্ব। প্রেমিককে নারী কিভাবে নির্মাণ করতে চান পুরুষদের লেখা গানে তার উদ্‌ঘাটন সম্ভব নয়। নারীগীতিকার ছাড়া কেইবা সেই একান্ত নিজস্ব অনুভবকে প্রকাশ করতে পারে। এতাবৎকাল তো নারী পুরুষেরই নির্মাণ। অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় আমাদের জানিয়েছেন "সামাজিক জীবনের নানাক্ষেত্রে মেয়েরা অন্তত নিজের মুখে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে, হোক সে-কথা পুরুষের শেখানো, তবু তোতাপাখির কণ্ঠ তার নিজের। কিন্তু বাংলা গানে এটুকুও ঘটে নি।" এর পরই নিবন্ধকার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন কয়েকজন নারীগীতিকারের কথা বলে। তিনি উল্লেখ করেছেন অনুশ্রী চক্রবর্তী, মৌসুমী ভৌমিক, আলপনা ঘোষ ও মৈত্রেয়ী রায়ের কথা। এঁরা নারীর নিজস্ব ভাষায় ও অনুভবে গান বেঁধেছেন, যে গান কেবল নারীর কলমে ও কণ্ঠে রূপ পেতে পারে। অনির্বাণের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমরাও চাই মেয়েরা তাদের নিজস্ব জগতের কথা, তাঁদের প্রেমের একান্ত উপলব্ধির কথা নিয়ে এগিয়ে আসুন। গানের জগৎ তাতে নিঃসন্দেহে ভিন্ন স্বাদ পাবে আর গানের নতুন দিগন্ত হয়তো খুলে যাবে।

শোভন সোমের নিবন্ধ 'বাংলা রেকর্ডের গান থেকে ফিতের গান' রেকর্ডের প্রবর্তনের ফলে বাংলা গানের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক নবদিগন্তের সূচনা কিভাবে ঘটল তারই আনুপূর্বিক ধারাবিবরণ। রেকর্ডযুগের সূচনার আগে বাংলা গানের পরিসর ছিল একান্তই সীমাবদ্ধ। রুচি ও শালীনতা ছিল প্রায় অনুপস্থিত। নাটক ও নাট্যসংগীতের মধ্যেই ছিল বাংলা গানের ঘোরাফেরা। বৃহত্তর শ্রোতার কাছে উপস্থাপিত হওয়ার শক্তি তার ছিল না। উনিশশো দুইয়ের জুলাই মাসে লণ্ডন থেকে দি গ্রামাফোন এ্যাণ্ড টাইপরাইটার লিমিটেডের প্রতিনিধি জন ওঅট্‌সন্‌ হড্‌ কলকাতায় এসে বাজার সমীক্ষা করে কোম্পানীর একটি শাখা খুলতে চেয়েছিলেন। ওই বছরের অক্টোবরে ফ্রেড গেইস্‌বার্গ কলকাতায় এলেন। তাঁরই উদ্যোগে মিস শশীমুখী ও মিস ফনীবালার গান রেকর্ড করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা গানের ব্যবসায়িক রেকর্ড প্রকাশের ইতিহাস সূচিত হল। এর ফলে গান ঢুকে গেল বাঙালি অন্দরমহলে। রেকর্ডপ্রকাশের ফলে এই উদ্যমের অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক জীবনে এবং সাংগীতিক ক্ষেত্রে যে বিশাল অভিঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল তার একটি সুচিন্তিত সন্দর্ভ শোভন সোম উপস্থিত করেছেন। সংক্ষেপে এই রেকর্ডিং বাংলা গানের ছুঁৎমার্গ দূর করে বেশ্যা-বাইজিদের সমাজ থেকে দূরে থাকা গানকে জলচল করে ব্যাপক সমাজের কাছে প্রসারিত করল। এর ফলেই সংগীতসংরক্ষণের কাজটিও সাধিত হল। তার আগে সব গানই ছিল শ্রুতি ও স্মৃতিবাহিত। কিন্তু রেকর্ডিং ব্যবস্থার হাত ধরে বাংলাগানে একটা standarised documentation এর পথ সুগম হল। আজ আমরা জানি না উনিশ শতকের আগে বাংলা গানের কি রূপ ছিল। নিধুবাবু তাঁর টপ্পা কিভাবে গাইতেন। কিন্তু এখন আমরা জানি লালচাঁদ বড়াল বা গহরজানের গায়নশৈলী কেমন ছিল। নিবন্ধের শেষে রেকর্ড ও ক্যাসেট কোম্পানিগুলির বানিয়াবৃত্তি বাংলাগানের নিয়ন্তা কোন ভূমিকা নিয়েছে সে সম্পর্কে শোভন সোম বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। পরিশেষে শোভন সোমের লেখা থেকে এক টুকরো উদ্ধার করি "সংগীতরংরক্ষণের উপায়ের সঙ্গে সংগীতবিপণনের, শিল্পী নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি জুড়ে না দেখলে ডিস্‌ক্‌ সংগীতের ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব দেখা সম্পূর্ণ হবে না।'

পবিত্র সরকার তাঁর 'আধুনিক বাংলা গানের ভাষা' নিবন্ধে মূলত রবীন্দ্রোত্তর বা তাঁর অনুজ সমসাময়িক গীতিকারদের ভাষা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁদের উপর রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রভাব বা প্রভাবমুক্তিও তাঁর আলোচ্য বিষয়। আধুনিক বাংলা গানের আওতা থেকে তিনি রবীন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ ও নজরুলকে বাইরে রেখেছেন এবং স্বপক্ষে যুক্তিও দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা কবিতা আর আধুনিক বাংলা গান - দুটিই 'আধুনিক' বিশেষণে অভিহিত হলেও বাংলা গানের ক্ষেত্রে আধুনিক বিশেষণকে কেবলমাত্র সাম্প্রতিক এই অভিধায় চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতার সংজ্ঞা কেবল সমসাময়িকতার দ্বারা নির্ধারিত হয় না। আধুনিক বাংলা কবিতার বিশেষ চরিত্র আছে। তার ক্রমবিবর্তিত বিকাশ ও পরিণতি যেমন বহুশাখায়িত হয়ে আজ প্রতিষ্ঠিত, স্বমহিম, বাংলা গানের ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। এই কথা মনে রেখে বলা যায় ভাষার দিক থেকে বাংলাগানের সাবালকত্ব এখনো প্রায় অধরা। পবিত্র সরকার রবীন্দ্রানুজ কয়েকজন গীতিকারের গানের ভাষা নিয়ে সোদাহরণ আলোচনা প্রসঙ্গে দেখিয়েছেন এঁদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনুসারী, অথচ রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা আছে। কেউ কেউ রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত গানও রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল সকলেই একাধারে গীতিকার সুরকার ও গায়ক। আত্মিক প্রেরণাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এঁদের গান রচনার উৎস। অথচ আধুনিক বাংলা গানের গীতিকারদের ক্ষেত্রে একথা বলা চলে না। এঁরা সকলেই বাহ্যিক প্রণোদনা থেকে গান লিখেছেন। সুর দেবার বা গাওয়ার দায়িত্ব অন্যদের। এই বাহ্যিক প্রণোদনা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রেকর্ড ক্যাসেট সিডি বা কোনো সিনেমা। আধুনিক গানের জন্ম এক ত্রিমুখী আয়োজন। আর এর ফলেই আধুনিক বাংলা গান কোনো চারিত্র্য পাচ্ছে না, সমসাময়িক বাস্তবতা থেকেও সে দূরে থাকছে। কিন্তু এই সময়কালে কিছু গীতিকার ও সুরকার ও গায়ক (তাঁরা একই ব্যক্তি) বাংলাগানে এক নতুন নির্মাণের সূচনা করেছেন। পুরোনো শব্দবন্ধ ও ক্রিয়াপদের বর্জনের দ্বারা নতুন ভাষারীতি এনেছেন বাংলা গানে। পবিত্র সরকার তাঁর নিবন্ধের শেষে উল্লেখ করেছেন সুমন চট্টোপাধ্যায়ের কথা। তাঁর গান রচনা সুর যোজনা ও গায়নে বাংলা গায়কিকে সাবালকত্ব দান করেছেন, যার জন্যে বাঙালি শ্রোতার সাগ্রহ অপেক্ষা ছিল। ভাষারীতি, শব্দচয়ন ও ভাববস্তুর নতুনত্বে সুমন চট্টোপাধ্যায় বাংলা গানের নতুনত্বের পথিকৃৎ।

সুমন চট্টোপাধ্যায়ের নিবন্ধ 'আধুনিক বাংলা গান : আকালের সন্ধানে?' পূর্বপ্রকাশিত একটি লেখার পুনর্মুদ্রণ বলে জানিয়েছেন সংকলনের সম্পাদক। পবিত্র সরকারের পূর্বালোচিত নিবন্ধের সঙ্গে বর্তমান নিবন্ধটির বিষয়গত কিছু মিল আছে। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের নিবন্ধটি বাংলা গানে তাঁর চমকপ্রদ আবির্ভাবের প্রস্তুতিপর্বে লেখা। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের লেখাটির মধ্যে সামান্য স্ববিরোধ আছে। তিনি আধুনিক গানকে একদিকে স্বাগত জানাচ্ছেন, আর একদিকে তার নির্মম সমালোচনা করছেন। কিন্তু নিবন্ধটি ঠিক এইটুকুই নয়। তার বাইরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এই নিবন্ধে বিবেচিত হয়েছে যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে এবং নব নব সৃষ্টির দ্বারা বাংলাগানের বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণের উপায় আলোচিত হয়েছে। বাংলা গানকে যতই অবক্ষয়ের গান বলা হোক না কেন, সংস্কৃতিসম্পন্ন শিক্ষিত বাঙালি আধুনিক বাংলা গান সম্পর্কে যত উন্নাসিক হোক না কেন আধুনিক বাংলা গানের ক্ষেত্রে গত পঞ্চাশ বছরে কিছু ভালো কাজ হয়েছে। আর সেই সব কাজের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হয়েই আজ কবীর সুমন তাঁর নতুন সৃষ্টি নিয়ে আমাদের সামনে এসেছেন, বাংলা গানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। বাংলা গানে অবক্ষয়ী আকাশকে তীব্রভাবে আক্রমণ করলেও, বাংলা গানের লিরিকের ভাষাকে বকচ্ছপ বা হাসজারু বলে ব্যঙ্গ করলেও তিনি এই গভীর প্রত্যয় জানিয়েছেন যে ইতিহাস থেমে থাকে না। তাঁর ভাষায় "জীবনের যে কোন প্রাসঙ্গিক ও সৎ উপলব্ধি বা আবেগ-অনুভূতির কথা দিয়ে" বাংলা গান অব্যাহত থাকবে। এই রচনা প্রথম প্রকাশের এক দশকের মধ্যে বাংলা গানের দৈন্যের কালিমা মুছে সুমন চট্টোপাধ্যায় বাংলা গানের ভগীরথ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন।

চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর নিবন্ধের নাম দিয়েছেন 'বাংলা গানের সমস্যা'। এই সমস্যাগুলি তিনি য়ুরোপীয় সংগীতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করেছেন। বাংলাগান মেলডির আধারে গড়ে উঠেছে, হার্মনি বাংলা গানে প্রায় অচলিত। সঙ্গত হিসেবে তবলায় যে পরিষ্কার দ্বৈততার সৃষ্টি হয় সারেঙ্গির বেলায় তা একরৈখিক থেকে যায়। এই সমস্যা একটি কারণেই। ভারতীয় রাগসংগীতে ফর্মই প্রধান, কন্‌টেন্ট (যাকে চঞ্চলকুমার রচনা বলে অভিহিত করেছেন) নেই। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে এই চাহিদা পূরণ হয়েছে। ফর্মের মধ্যে দিয়ে কন্‌টেন্টের আশ্চর্য রূপান্তর ঘটেছে বাংলা গানে। ভারতীয় ঐতিহ্যে সঙ্গত প্রধান অঙ্গ। কিন্তু সঙ্গতের নানা পরিবর্তন যুগে যুগে ঘটেছে। চঞ্চলকুমারের প্রত্যাশা মেলডির নতুন ব্যবহার ও নতুন নতুন সঙ্গতের উদ্ভাবনের দ্বারাই বাংলা গান তার ভবিষ্যৎ রূপটি পাবে। বাংলাগান রূপবন্ধসর্বস্ব—তাঁর এই কথা সর্বত মেনে নেওয়া যায় না।

অশোক মিত্রের নিবন্ধ 'চাঁদ-চামেলি উপাখ্যান' বাংলা গানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরকার সুরসাগর হিমাংশুকুমার দত্তের জীবনকথা নিয়ে রচিত। এই সংকলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা এটি। কারণ হিমাংশুকুমারের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে লেখা খুবই অল্প এবং সেই বিষয় নিয়েই অশোক মিত্র আলোচনা করেছেন। রচনাটিকে ঠিক জীবনীমূলক বলা যায় না, কারণ হিমাংশুকুমারের জীবন সম্পর্কে সঠিক তথ্য সাল-তারিখ ইত্যাদি অমিল। তাঁর সুর রচনার আনুপূর্বিক তালিকাও কিছু পাওয়া যায় না। এই ঘটনা আমাদের বিস্মৃতিপ্রবণ সংরক্ষণবিমুখ বাঙালি চরিত্রের এক লজ্জা। অশোক মিত্র তাঁর নিবন্ধে যেটুকু উল্লেখ করেছেন তার চেয়ে বেশি হয়তো অনুল্লিখিত রেখেছেন। ব্যক্তিগতভাবে এই প্রতিবেদকের মনে হয়েছে যে সব তথ্য সর্বাংশে প্রকাশ করলেও কিছু ক্ষতি ছিল না। কারণ হিমাংশুকুমারের জীবন ও সৃষ্টি বাংলাগানের দেবোপম এক গান্ধর্বের ইতিহাস, বাংলা গানের আলোকপর্বের এক ইতিবৃত্ত। হিমাংশুকুমারের বিকাশে তাঁর সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থান কি ভূমিকা নিয়েছিল তার দিকে আলো ফেলে তাঁর পতন-অভ্যুদয়সংকুল সংগ্রামশীল হয়ে-ওঠার পর্বটি নিপুণ কথকের মতোই আমাদের শুনিয়েছেন অশোক মিত্র। কিন্তু তথ্যের অভাবে অনেকক্ষেত্রে জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে নিবন্ধকারকে এগোতে হয়েছে। তাই হিমাংশুকুমারের জীবন ও সৃষ্টির অনুপুঙ্খ ইতিহাস আমাদের কাছে অধরাই থেকে গেল। কুমিল্লা শহরের সাহিত্যিক সাংগীতিক পরিবেশ ও হিমাংশুকুমারের সাংগীতিক শিক্ষা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন সমাজ-অর্থনীতির প্রেক্ষাপট সুন্দরভাবে উপস্থিত করেন নিবন্ধকার। হিমাংশুকুমারের সংগীতজীবনের বিবর্তন ও বিকাশ ঘটে তাঁর কলকাতাবাস পর্বেই। পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত মার্গসংগীতশিক্ষাকেন্দ্র থেকে তিনি দুবছরের মধ্যেই 'সুরসাগর' উপাধিটি অর্জন করেন, যা অদ্যাবধি তাঁর নামাগ্রে ব্যবহৃত হয়। পাশ্চাত্য সংগীত সন্ধিৎসার টানে 'সরস্বতীমাসি'র বাড়িতে তাঁর দ্বিপ্রাহরিক অনুশীলন শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাগসংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের সুর মিলিয়ে সুর সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৩৩এ সেন্ট পলস কলেজের সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানে শচীনদেব বর্মণ হিমাংশুকুমারের সুর দেওয়া 'নতুন ফাগুনে যবে আজি ধরা চঞ্চল' গানটি পরিবেশন করেন। বলা যায় যে বৃহত্তর শ্রোতৃবর্গের কাছে হিমাংশুকুমারের স্বীকৃতির সেই শুরু। এই গানটির রচয়িতা সাহিত্যিক বিনয় মুখোপাধ্যায়--'যাযাবর' ছদ্মনামে যিনি সুখ্যাত হয়েছিলেন। এর চার বছর পরে ১৯৩৯-এ ইতালীয় র‍্যামেলা গানের দ্বারা প্রাণিত হয়ে তার সুরে রচিত হয় 'তোমারি মুখপানে চাহি'। জনপ্রিয় এই গানটি দ্বিতীয় রূপান্তরে 'তোমারি পথপানে চাহি' রেকর্ড করা হয়। গানের সুরটি বিপুল জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। প্রবল জন-অনুরোধে এই সুরের তৃতীয় সংস্করণ 'বনের কুহুকেকাসনে' স্বামী-স্ত্রী সিনেমায় ব্যবহৃত হয়। এই সব তথ্যে আমাদের সমৃদ্ধ করেন অশোক মিত্র। এই প্রতিবেদক তাঁর বাল্যে ও কৈশোরে সুরসাগরের সুরে শচীনদেব বর্মণের অনেক গান রেকর্ড ও রেডিওতে শুনে মুগ্ধ হতেন। আজ বার্ধক্যে উপনীত হয়েও সেই শোনার স্মৃতি তাঁকে তাড়িত করে আর স্পষ্ট করে বোঝা হয়ে যায় প্রাক্‌রবীন্দ্র বাংলা গানে সুরসাগর নতুন এক দিশার অন্যতম দিশারী।

স্বপন সোমের 'বাংলা হাসির গান ও প্যারডি' এ সংকলনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ। বাংলা গানের এর স্বল্পালোচিত দিগন্তে আলো ফেলে আমাদের অন্ধকার দূর করেছেন। তথ্যের যে বিপুল ও বিস্ময়কর ভাণ্ডার তিনি আমাদের দিয়েছেন তার জন্য পাঠকসমাজ তাঁর কাছে ঋণী থাকবে। হাসির গান ও প্যারডির যে-সব সংজ্ঞা দিয়ে তিনি তাঁর নিবন্ধের মুখপাত করেছেন তা মূল্যবান। তাঁর প্যারডি গানের প্রতিবেদন শুরু করেছেন আজু গোঁসাই-এর কথা দিয়ে। ইনি রামপ্রসাদের সমসাময়িক। রামপ্রসাদের বহু গানের তাঁর কৃত প্যারডি দিয়েই বাংলাগানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এর পরে প্যারডি গানের তালিকায় উল্লিখিত হয় খ্যাত অখ্যাত নামের তালিকা, যে তালিকার শিরোনামে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর অমৃতলাল বসু দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কাজী নজরুল নলিনীকান্ত সরকার সতীশচন্দ্র ঘটক সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কালিদাস রায় সজনীকান্ত শিবরাম চক্রবর্তী পরিমল গোস্বামী—কারো নাম বাদ নেই। গত শতকের অনেক কবি ও বুদ্ধিজীবীই প্যারডি গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের চিত্তাকর্ষক প্যারডি গান ও নানা গল্পসহ উপস্থিত স্বপন সোমের লেখায়। পুরোনো দিনের অনেক বিস্মৃত প্যারডির কথা তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে যাঁদের গানের প্যারডি হয়েছিল তার তালিকাতেও রবীন্দ্রনাথ সর্বোচ্চ। হাসির গান নিয়ে নিবন্ধকারের ব্যাপক অন্বেষণ। উনিশ শতকের গোড়ার দিককার হাসির গানের দীর্ঘ নমুনা তিনি আমাদের বিস্মিত চোখের সামনে উপস্থিত করেছেন। এইসব গানের মধ্যে কোনোটি হয়তো বাল্যকালে শুনেছিলাম, কোনোটি হয়তো শুনি নি। আখড়াই হাফ-আখড়াই কবিগান ও যাত্রাপালা থেকে উদাহৃত গানগুলি ব্যঙ্গ রঙ্গরসময় হাসির গান। উনিশ শতকে নাটকের গানের হাত ধরেই হাসির গান বিশিষ্টতা পায়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের 'বোধেন্দুবিকাশ' নাটকে শুধুই হাসির গান দেখা গেলেও দীনবন্ধু মিত্রের নাটকে বা প্রহসনে হাসির গান সামাজিক রঙ্গব্যঙ্গময় হয়ে ওঠে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথও তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে হাস্যরসের গান রচনা করেছিলেন। গিরিশচন্দ্র অমৃতলাল অমরেন্দ্রনাথের পর এলেন হাসির গানের রাজা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তাঁর হাতেই বাংলা হাসির গান সুরে লয়ে ভাবে এবং পরিবেশনায় এক উচ্চ স্থান অধিকার করেছিল। তাঁর গানের দুর্লভ সরসতা বাংলা হাসির গানের সম্পদ হয়ে আছে আজও। রবীন্দ্রনাথও অনেক হাসির গান লিখেছেন। তাঁর গীতিনাট্য ও নাটকে হাসির গানের ব্যবহার আছে। একটি নাটকে প্যারডি গানেরও নমুনা পাওয়া যায়। তাঁর নাটকের অনেক গানে আপাত হাসির গভীরে কিছু তত্ত্বের আভাস পাওয়া যায়। স্বপন সোম আমাদের জানিয়েছেন, "রবীন্দ্রনাথের হাসির গানে এমন পরিমার্জনা আছে যা যথার্থই উপভোগের বস্তু"। রবীন্দ্রোত্তর গীতিকার সুকুমার রায়, নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, নলিনীকান্ত সরকার, রঞ্জিত রায়, নবদ্বীপ হালদার, তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ রচয়িতার হাসির গানের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন স্বপন সোম। শরৎচন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর নামেই খ্যাত ছিলেন। তাঁর রচিত 'কলিকাতার ভুল' রচনা সুরযোজনা ও পরিবেশনার গুণে অমর হয়ে থাকার যোগ্য। প্রশ্ন জাগে: সাম্প্রতিক কালে কি হাসির গান লেখা হয়? অনেকে বলেন আলাদা করে হাসির গান এখন আর লেখার দরকার নেই। কারণ বেশ কিছু সাম্প্রতিক গান রচনায় সুরে ও উপস্থাপনার তারল্যে প্রায় হাসির গান বলেই মনে হয়। কথাটা অন্তত আংশিক সত্য বহন করে।

শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে একজন প্রজ্ঞাবান তত্ত্ববিদ। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীর অন্তরে প্রবেশ করে সেখানকার উজ্জ্বল মণিরত্ন উদ্ধার করে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেন আর তার দীপ্তিতে আমাদের চোখ ঝলসে যায়। 'রাগিনীর মরীচিকা' শীর্ষক নিবন্ধে তিনি গীতবিতানে পূজা ও প্রেম পর্যায়ের প্রারম্ভে 'গান' এই উপপর্যায়ে সংকলিত গানগুলির আলোচনা করেছেন। এই উপপর্যায়ে পূজার বত্রিশ এবং প্রেম পর্যায়ের সাতাশটি গান নিয়ে আলোচনার মুখপাত করেন নিবন্ধকার। মোট ঊনষাটটি গানের কেন্দ্রবিষয় গান অথবা সুর হলেও রবীন্দ্রনাথ কেবল গান বা সুরের সম্পৃক্তিতে বিচরণ করেন নি। তার অর্থমণ্ডলে আরও ব্যাপকতা এনে শিল্পীর সঙ্গে শিল্পের, কবির সঙ্গে বহির্জগতের, ব্যক্তির সঙ্গে জগতের বহুমাত্রিক সম্পর্কের নানাদিক দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বিচিত্র জটিল গূঢ় গ্রন্থি পরতে পরতে খুলে রবীন্দ্রনাথের গানের অন্তরতম রূপটি আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের অন্তশরীরে যে বহুধাবিস্তৃত নিহিত ব্যঞ্জনা আছে তাকে উদ্‌ঘাটিত করার প্রয়াসে শেষ কথা শেষপর্যন্ত হয়তো না-বলাই থেকে যায়। কারণ দেশকালব্যক্তিভেদে উপলব্ধির নানা স্তরে তা উন্মোচিত হতে থাকবে আর নতুন নতুন দিগন্ত খুলে যাবে রবীন্দ্রগানের। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেধা মনীষা ও বৈদগ্ধ্য এই দুরূহ কাজটি করেছেন। রস ও সুন্দরের স্বারূপ্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই এক বিহ্বল মরীচিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন "হাতের ধরা ধরতে গেলে / ঢেউ দিয়ে তায় দিই যে ঠেলে"।

কমলকুমার মজুমদার মূলত রাগসংগীতের সমঝদার। লোকসংগীতও তাঁর চোখে রাগসংগীতের শাখা। বাংলা গান নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ তাই সবসময়ে বাংলা গানের পক্ষে অনুকূল হয় না। সংগীতের সনাতন যে ধারা বহমান ছিল কালের দাবিতে তা ধাপে ধাপে নেমে এসে "অন্য সময়ের তাগাদায় গান এক বীভৎস রূপ নিয়েছে। ... এই রূপের সুযোগ নিয়ে আধুনিক রবীন্দ্রসংগীত পল্লীগীতি বাজার রেখেছে এবং এই সঙ্গে ফিল্মসংগীত। এতগুলোকে কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়।" সাম্প্রতিক কালে গানের পণ্যায়নের কথা ভেবেই কমলকুমার মজুমদার তাঁর 'প্রসঙ্গ বাংলা গান' নিবন্ধের মুখপাত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে অতুলপ্রসাদ পর্যন্ত রচিত গান সম্পর্কে তাঁর নিরুচ্ছ্বাস অনুমোদন থাকলেও নজরুল ও তাঁর পরবর্তী সংগীতরচয়িতাদের অধিকাংশ সৃষ্টিতে তিনি প্রসাদগুণ দেখতে পান না। বিশেষ করে প্রেমের সুরে ও কথায় কোনো অন্তরঙ্গ যোগাযোগ দেখতে পান না। তরল শব্দবন্ধের অভিঘাতে প্রেমানুভবের গভীরতা অমিল থাকে। তাঁর ভাষায় "গান না টেলিগ্রাম বোঝবার যো নেই"। নতুন ধারার সুরে ও কথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের 'গাঁয়ের বধূ' গানটিকে তাঁর মনে হয় যেন বা 'স্বাধীনতা'র সম্পাদকীয়। সত্যিকারের গভীর ও সূক্ষ্ম বোধসম্পন্ন গীতরচয়িতার জন্য তাঁর অপেক্ষা আছে, থাকবে। কীর্তনের পর রামপ্রসাদের গানে যে সহজ অথচ সমৃদ্ধ বিবর্তন ঘটেছিল তদনুরূপ কিছু বাংলা গানে ঘটেনি। শ্রোতাদের কানও তৈরি হয়নি সেই গভীর ঐশ্বর্যময় গানের যোগ্য উত্তরাধিকারী হওয়ার মতো। এই নৈরাশ্যেই কমলকুমার তাঁর নিবন্ধের ইতি টেনেছেন।

সব জাতের গানের রসজ্ঞ অমিয়নাথ সান্যাল বাংলার সংগীতজগতে এক শ্রদ্ধেয় কিংবদন্তী। তিনি ছিলেন সেই বিরল প্রজাতির শেষ প্রতিনিধি যিনি একাধারে গায়ক ও রসবেত্তা, গানের উপপত্তি ও ক্রিয়াসিদ্ধি উভয়বিধ দিকেই তাঁর অনন্য অধিকার। তিনি দীক্ষিত ও সমুৎসুক শ্রোতা এবং আবেগী অথচ যুক্তিনিষ্ঠ সংগীত-সমালোচক। তাঁর নিবন্ধ 'বাংলা গানের দিগ্‌দর্শনী' সত্যিই বাংলাগানের বহুশাখায়িত দিকগুলি তার জ্ঞানাঞ্জনশলাকার দ্বারা আমাদের চক্ষু উন্মীলিত করে। উনিশ শতকের প্রথমদিকে ব্যঙ্গবিদ্রুপাত্মক রঙ্গরসের গানে মুখরিত বাংলাদেশের কথা বলেই তিনি তার নিবন্ধের কথামুখ শুরু করেন। বিদেশী শাসন ও সংস্কৃতির দ্বারা বাহিত সমাজের নানা অসঙ্গতি ও উচ্ছৃঙ্খলার মুখে দাঁড়িয়েই এই রঙ্গসংগীত তৎকালীন সমাজের প্রতি শাণিত ব্যঙ্গ বিদ্রুপ নিক্ষেপ করতে তৎপর। নিবন্ধকার মনে করেন তৎকালীন রচয়িতাদের সতেজ প্রাণশক্তিই এক্ষেত্রে প্রতিফলিত। সেই সময়কার গীতি রচয়িতাদের পরিচয় দেওয়ার পর অমিয়নাথ মাইকেল মধুসূদনের গান রচনা ও সেই গানে খ্যাতনামা ওস্তাদের সুর দেওয়া সম্পর্কে অনেক অজ্ঞাত ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের জানিয়েছেন। এইসব তথ্য তিনি তাঁর পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছেন। তিনি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলা টপ্পার বিশেষ গঠনরীতি ও চলন, এবং অলংকার প্রয়োগ বাংলাগানের সহগামী। বাংলার নিজস্ব টপখেয়ালভঙ্গিম গানের মধ্যে টপ্পা ও খেয়ালের যে ধরনের মিশ্রণ ঘটেছে, তা বাংলার একেবারে নিজস্ব ঢঙ, যা ভারতের আর কোথাও পাওয়া যায় না। টপ্পা ও খেয়ালের আঙ্গিক মিলিয়ে গাওয়া টপখেয়ালের আদর্শ উদাহরণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন লালচাঁদ বড়ালের রেকর্ডে "মনেরই বাসনা শ্যামা" গানটি। তিনি আরও জানান যে এই ধরনের গানের জন্যেই বাংলায় আড়া মধ্যমান বাংলা-একতাল প্রভৃতি তাল ও ঠেকা বাঙালির সেই যুগের অর্জন। লোকসংগীতে ফিকিরচাঁদের অবদানের কথা বলতে গিয়ে অমিয়নাথের বক্তব্য: "ফিকিরচাঁদ ও রবীন্দ্রনাথ এ দুজনার গানের পার্থক্য মাত্র ভাষার প্রকাশভঙ্গির পার্থক্য।" অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের মিলনের গভীর তত্ত্বকথা যুগে যুগে ভারতীয় কবিতা ও গানের বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে গান যেমন শিল্পমণ্ডিত আলংকারিক ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এমনটি ভারতের আর কোথাও হয়নি। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নানা গীতভাষার সঙ্গে তুলনায় বাংলা কাব্যগীতি যেমন রূপকাশ্রিত তেমনটি ভারতের অন্যত্র ঘটেনি। এইসব আলোচনার শেষে অমিয়নাথ দেখিয়েছেন যে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা গান নতুন রূপ পেতে শুরু করে। ঐতিহ্যকে আশ্রয় করেই ঐতিহ্যকে ভেঙে গড়ে বাংলা গানে নতুন রূপের প্রকাশ এই সময়কাল থেকেই শুরু। এই সময় থেকেই গ্রামীণ গান নাগরিকতার স্পর্শ পেতে শুরু করে। য়ুরোপীয় সুরের আত্তীকরণ, নাটক ও নাট্যগীতির মধ্যে দিয়ে সেই নতুন গানের আবির্ভাব। তার ক্রমবিবর্তনের দ্বারা প্রতিভাবান শিল্পী ও রচয়িতাদের 'আত্মপরীক্ষা ও আত্মপরিচয়' ঘটতে থাকে। এই পরীক্ষামূলক গানের ধারাকে অভিনন্দন জানিয়েই কথা শেষ করেছেন অমিয়নাথ।

সংকলনের শেষ অধ্যায়টি একটি সমৃদ্ধ সাক্ষাৎকার। 'গান নিয়ে ব্যক্তিগত' এই শিরোনামে সম্পাদকের সুচিন্তিত জিজ্ঞাসু প্রশ্নমালার অনন্য উত্তর দিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। শেষবেলাকার এই প্রশ্নোত্তরের পালায় বাংলাগানের নানাদিক যেমন প্রাঞ্জলভাবে ফুটে উঠেছে তাকে বর্তমান প্রতিবেদক ব্যক্তিগত মনে করছেন না। শঙ্খ ঘোষ হয়তো তাঁর নিজের অবলোকন উপস্থিত করেছেন, কিন্তু তা তো আমাদের সর্বজনের বক্তব্য হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রসংস্কৃতিচিন্তার অগ্রপথিক, প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক ও কবি, তত্ত্বজ্ঞানী ও রসবিদ শঙ্খ ঘোষ আমাদের সকলেরই প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন এই সাক্ষাৎকারে। তাঁর জীবনে ও মনের গঠনে বাংলাগানের ভূমিকাপ্রসঙ্গে নানা গান শোনার অভিজ্ঞতার যে দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন তিনি তা এই প্রতিবেদকের অতিবাল্যে শোনা কিছু গানের স্মৃতি জাগালো। রবীন্দ্রনাথের গান বৃহত্তর শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে প্রবেশের অধিকার পাচ্ছে না কেন? এই প্রশ্নের জবাবে আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা তার সুরের কাঠামো এবং প্রধানত তাঁর অনুভূতিজগৎ রবীন্দ্রসংগীতের সর্বত্রগামী হওয়ার পথে বাধা। কবিতা আর গানের ভেদরেখার প্রশ্নে সংক্ষিপ্ত উত্তর, রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি তাঁর পক্ষপাতের কারণ, নজরুলের গানে স্থির কোনো একটা গীতিব্যক্তিত্ব গড়ে না-ওঠা, আধুনিক বাংলা গান নস্ট্যালজিয়া জাগালে পঞ্চাশের দশক থেকে তার বেঁকেচুরে যাওয়া, গণ-আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণসংগীতের ঢিমে হয়ে যাওয়া এবং সবশেষে জীবনমুখী গানের মূল্যায়ন দিয়ে এই সাক্ষাৎকারের শেষ। জীবনমুখী গানের নামকরণ আংশিকভাবে অর্থবহ হলেও এ গানের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লিখিত হয়েছে। এ সীমাবদ্ধতার প্রধান দিক এই যে জীবনমুখী গান যেভাবে রচিত ও পরিবেশিত হয় তাতে মনে হয় এ গান সমষ্টির, ব্যাষ্টির নয়। তাঁর সাক্ষাৎকারের শেষ বাক্যটি আপনাদের শোনাই: "ভিতরের সেই একলা মনটাকে ধরাও তো গানের একটা বড়ো কাজ"।

সম্পাদক তার আত্মপক্ষে জানিয়েছেন, মূল সংকলনে ১০২ জন সংগীতবিদের স্কেচ ছিল। ছবিগুলি সর্বদা উচ্চমানের হয়নি। তাই বর্তমান সংকলনে ৬৮টি স্কেচ মুদ্রিত হয়েছে। বর্তমান প্রতিবেদক এই ৬৮ জনের মধ্যে অনেককেই নানাভাবে দেখেছেন। অনেক ক্ষেত্রে এই স্কেচগুলি সংগীতজ্ঞদের অন্তশায়ী ব্যক্তিত্বকে তেমনভাবে পরিস্ফুট করতে পারে নি বলেই মনে হয়। কয়েকটি বিষয়ে এ সংকলনে কোনো আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হয় নি। সেগুলি থাকলে বাংলাগানের পরিপূর্ণ একটা ছবি পাওয়া যেত। এমন তিনটি বিষয়ের কথা মনে পড়ছে। কীর্তন গান সম্পর্কে রমাকান্ত চক্রবর্তীর নিবন্ধে সামান্য আলোকপাত করা হলেও, কীর্তন গান একটি পৃথক পূর্ণাঙ্গ আলোচনার দাবি রাখতে পারে। দ্বিতীয় বিষয়টি হল রাগপ্রধান বাংলা গান। এটিও বাংলা গানের একটি স্বতন্ত্র ধারা যার সম্পর্কে বিশদ আলোচনা বোধহয় আজও অপেক্ষমান। এ গান কতটা বাংলা গানের চারিত্র্য বজায় রাখছে আর পুরোটাই রাগসংগীত হয়ে উঠছে কিনা এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিপাত বিধেয়। জীবনমুখী গানের ধারার পরেও আজ বাংলাগানে ফিউশন, রিমেক ইত্যাদির প্রবণতা ও শেষত ব্যাণ্ডের গান যা ইতিমধ্যেই বেশ প্রচল—এই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা থাকলে বলা যেত বাংলা গানের সাম্প্রতিকতম দিকটিও সংকলনে স্থান পেয়েছে।



(পরবাস-৫৩, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)