নির্বাচিত অসমীয়া কবিতা
মূল অসমীয়া থেকে অনুবাদ
অমিতাভ

কবি: হোমেন বরগোহাঞি
(১৯৩১)

তিনটি কবিতা




রাত

আমার চেতনার অন্ধ বিশাল নদীর
ঘাটে ঘাটে
ফুল হয়ে ফুটে ওঠা রূপকথার মেয়ে
তোমার সন্ধ্যার সেই বন্ধ্যা বাসনার
নির্মেঘ আকূতি।

রাতের বুকে হায় জাগেনাকি কোনো এক নারীর হৃদয়
স্ফীতোদরা কোনো এক প্রগলভা নারীর
আসংগ কামনাঃ
অনিমেষ স্তব্ধ কার বোবা চাউনিতে
সুদূর আহ্বান

তন্দ্রা আর মরণের।
আমার চৈতন্যের এই অন্ধ বিশাল নদীর
ঘাটে ঘাটে
রাতের নিশান।



স্মৃতি

হঠাৎ নীরব হয় পরিচিত পাখির কান্না,
পাকা ফল ঝরে পড়ে এমন নীরবে যে
জমি যে নিষ্ফলা গাছ টেরও পায়না;
নির্জন হয় সাপের আঁধার জঠরে।

মৌন এই মৃত্যু-লীলা প্রকৃতির প্রাচীন নিয়ম,
কেবল আমিই তার কঠিন উদ্ধত ব্যতিক্রম।
মৃত্যুর অমোঘ হাত আমায় স্পর্শ করে যখন,
ক্রুদ্ধ এক প্রতিবাদ ফেটে পড়ে আমার হৃদয়ে
বারে বারে ফিরে চাই, কী এক রক্তাক্ত হাহাকার
দীর্ণ করে কণ্ঠ আমার অনন্তের হিমেল বাতাস
ভারাতুর করে তোলে; প্রতিধ্বনি বাজে অবিরাম।

কেননা সত্তায় আমার রয়েছে এক স্মৃতি অনির্বাণ
অনাদি অতীত আর অযাপিত দূর ভবিষ্যতের
প্রিয় এক মুখচ্ছবি বুকেতে গভীর স্পর্শ যার
চিরন্তন বিরহের বেদনায় অনন্ত অম্লান।

স্মৃতি নেই প্রকৃতির নিরুতসুক অন্ধ হৃদয়ে;
তাই আমি সৃষ্টি করি প্রকৃতির অতীত প্রতীক
মৃত্যুর তমিস্রা ভাঙা শব্দের উজ্জ্বল দীপশিখা—

প্রকৃতিকে তুচ্ছ করে যাতে আমার অমর বিষাদ
পূর্ণ করে অন্য এক ভুবনের শূন্য অধিকার,
আমি যেথা মৃত্যুহীন, সৃষ্টির শাশ্বত অঙ্গীকার।



ওফেলিয়া

চোখে নিদ্রা নেই, ঈশ্বরেরও, নীল সমুদ্রের
        হৃদয় অস্থির আজ, কে সে আসে চুপি চুপি
আপন আত্মার ভীতি, সে কি প্রেতের ছায়া, প্রীত
        নরক-শান্তিতে, এলসিনোরের উজাগর
অন্তহীন প্রতীক্ষায়? রক্তের মূল্যে কেনা হবে
        প্রতিশ্রুত স্বর্গভূমি, কালের প্রহরী হুঁশিয়ার
শুভবুদ্ধি সৌন্দর্যের দীপশিখা জ্বলুক আবার
        পিতার পবিত্রঋণ শোধ হোক প্রাণ-আহুতিতে।

এখন সময় নেই, ওফেলিয়া, এলসিনোরের
        রক্তবর্ণ অন্ধকার বিশ্বময় পড়ল ছড়িয়ে
জ্যোতি নেই হৃদয়ের বাহিরে ভিতরে, তাই
        এখন প্রার্থনা কর, মগ্ন চৈতন্যের আঁধারে।
আছেকি ঊষসীর উদাত্ত আলোকবাণী কোনো
        পরম সত্তার, যাকে দেখা যায় তিমির রাত্রির,
দীর্ঘ পথ পার হয়ে পাপ-জাত আপন আত্মার
        অথবা, বিকল্পও যা, সে যে মৃত্যু মানবিকতার।

শান্তির আশ্বাস নেই, জীবনের ধ্রুপদী বিশ্বাস
        আত্মার ঐতিহ্য, প্রেম, বিষ-যন্ত্রণায় জরজর,
বুদ্ধির আলোক ব্যর্থ, অর্থহীন কর্মের প্রেরণা—
        সত্য নাকি একমাত্র নিয়তির অমোঘ সংকেত?
প্রশ্ন কর— (দেহের বিলাস বৃথা), হও সন্ন্যাসিনী
        উন্মাদিনী? সেও সুগীত গান প্রাচীন দিনের
প্রেতাকীর্ণ আঁধারে রুদ্ধশ্বাস এলসিনোরের
        জীবন দুঃস্বপ্ন মাত্র; মৃত্যু। সেও নিষ্ফল আশ্বাস।


(পরবাস-৫৩, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)