সে এক দুর্বিষহ সময় এসেছিল একদিন – যখন
চারিদিকে শোনা যেত করাল দুর্ভিক্ষের হাহাকার
দেখা যেত শুভদ্র শালীনতার নির্লজ্জ অবক্ষয়
ক্ষুধিত মানুষের কান্নায় ব্যথিত হয়ে উঠত আকাশ
আর স্বার্থপরতার কদর্য ইতিহাস হনন করেছিল
অবিশ্রান্তভাবে মানবিকতার সুকুমার অনুভূতিদের
একজন সুশীল সুজন কবি তখন কি করতে পারেন?
প্রকৃতির লাবণ্যময় প্রতিমার প্রিয় আকর্ষণ
সেদিন ব্যর্থ হয়ে যায় তার কাছে
একটি গোলাপের মোহময় সুগন্ধের থেকেও
ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির সোঁদাগন্ধ মানুষের কাছে
যখন অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হতে থাকে
তখন প্রকৃত কবির কাছে পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদ
ধরা দেয় কৃষকের মেহনতি কাস্তে হিসেবে
সেদিন আর কবিতার উপমান থাকে না চাঁদ
হয়ে ওঠে সংগ্রামের অভ্রান্ত হাতিয়ার...
বিগত শতকের তিরিশের দশকে রবীন্দ্র কাব্যধারার পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অথবা রবীন্দ্রনাথের কাব্য-ভাবনার বিস্তৃত ছত্রছায়ার প্রভাব থেকে মুক্তির সন্ধানে কল্লোলগোষ্ঠির কবিরা এক নব্য-ভাবধারার আন্দোলন শুরু করেন। সেই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে এবং কিছুটা সমর সেন প্রমুখ কবিরা। তাঁরা চিরাচরিত প্রেম এবং প্রকৃতি থেকে সরে এসে কবিতাকে সমসাময়িক সমাজ ও ইতিহাস সচেতনতার সঙ্গে যুক্ত করলেন। তার সার্থক ফসল হল বামপন্থী মতবাদের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থ (প্রকাশ ১৯৪১)। যেখানে মেহনতী মানুষের যাপনচিত্র ছিল মুখ্য বিষয়।
পরবর্তী চল্লিশের দশক সংযুক্ত বাংলার (অন্তত ১৯৪৭ পর্যন্ত) জন্য এক দুঃস্বপ্নের দশক ছিল। ভীষ্ম পিতামহের মতো বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিকে দীর্ঘ প্রতিপালনের পর কবিগুরু প্রয়াত হলেন। দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধে শত্রুপক্ষ একেবারে সদরদরজায় এসে হানা দিয়েছিল। মানুষের কদর্য লালসা আর স্বার্থপর লোভের পরিণতিতে মানুষেরই তৈরি দুর্ভিক্ষে (পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে কুখ্যাত : ১৯৪৩) কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু। এবং সর্বোপরি ১৯৪৬-এ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও স্বাধীনতা পূর্ব দেশ বিভাজনের ফলে উদ্বাস্তু আগমন সম্পর্কিত পরিস্থিতির চাপে মৃত্যু হয়েছিল মানুষের শুভবুদ্ধি ও সুকুমার বোধের। প্রকৃতপক্ষে মানবসভ্যতাই এসে দাঁড়িয়েছিল এক চরম সংকটের মুখে।
কবি দিনেশ দাস এই (৬/৯/১৯১৩-১৩/৩/১৯৮৫) আবর্ত-সংকুল সময়খণ্ডের এক উল্লেখযোগ্য কবি – তাঁর কাব্যচেতনাকে প্রভাবিত করেছিল এই সমস্তকিছুই। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত যাপনের চালচিত্র।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় মাত্র পনেরো বছর বয়সে (১৯২৮) মহাত্মা গান্ধীর লবণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে সাময়িকভাবে লেখাপড়ায় ছেদ ঘটে। একবছর বাদে আবার শিক্ষার জগতে ফিরে এসে ১৯৩০ সালে ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩২তে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বিপ্লবাত্মক স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। ১৯৩৩-এ বি এ ক্লাসে ভর্তি হলেও সেই বিপ্লবী আন্দোলন এবং সাহিত্যচর্চার জন্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেন না। ১৯৩৩-এ দেশ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৫-এ খয়েরবাড়ি চা-বাগানে চাকরির সূত্রে কার্শিয়াং চলে আসেন। সেখানে গান্ধীবাদী মতাদর্শের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পেরে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৩৬-এ বামপন্থী মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে কার্ল মার্কস, ফ্রেড্রিখ এঙ্গেল, রালফ ফক্সের রচনা পাঠ করে এক নতুন ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন। এই চিন্তামানসই তাঁর কবিতাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে আমৃত্যু।
১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো ‘কাস্তে’ কবিতা। এই কবিতাটি আধুনিক বাংলা কবিতার এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় এবং তিনি প্রায় রাতারাতি মেহনতী মানুষের জীবন-যন্ত্রণা প্রকাশের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। ‘কাস্তে’ কবিতায় শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদটাকে তিনি শ্রমজীবী কৃষকের ফসল-কাটার ক্ষুরধার অস্ত্র কাস্তের সঙ্গে তুলনা করেন। যে চাঁদ এতকাল কাব্যজগতে প্রেম ও সৌন্দর্যের লাবণ্যময় প্রতীক ছিল তাকে তিনি খেটে-খাওয়া মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার করে তুললেন। এমন একটি বৈপ্লবিক চিন্তার তিনিই পথিকৃৎ ।
পরবর্তী সময়ে বামপন্থী মতধারার আরেক কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৫/৮/১৯২৬-১৩/৫/১৯৪৭) পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির প্রতীক হিসেবে কল্পনা করে অমরত্ব পেয়েছেন।
দিনেশ দাসের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল: কবিতা; ভুখা মিছিল; কাচের মানুষ; রাম গেছে বনে; কাস্তে প্রভৃতি।
দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’ কবিতাটি একসময়ে যুবাবয়সের তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ঘুরত পথে-ঘাটে, কফি হাউসের চত্বরে। কলকাতার ক্লাইভ স্ট্রিট তাঁর কবিতার কল্যাণে সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে গেছে। আর দীনেশ দাস পরিচিতি লাভ করেন ‘কাস্তে-কবি’ হিসেবে!
(পরবাস-৫৩, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)