পুনশ্চ পিশাচিনী
১
কী কী হারিয়েছি তার হিসেব করলে তোমাদের রাগ হবে,
কষ্ট হবে, দুঃখ হবে
অবিচলিত থাকো, তার চেয়ে, যা যা হারিয়েছো, ভুলে যাও
আমি হারিয়েছি তোমার করতল, আমার বুকের ওপরে, উষ্ণ
আমি হারিয়েছি এই অনুভব, যে উষ্ণতাও জরুরি
আমি হারিয়েছি যে কোন জরুরি জিনিষের জন্য অভাববোধ
আমি হারিয়েছি তোমাকে, যে তুমি আমার সবকিছু
বুক, তার ওপর করতল
আর তার উষ্ণতা
এবং তার অভাববোধ, সব, সব একসঙ্গে
তুমি, যে আমার প্রতিটি জরুরি অনুভূতির ভেতরে শুয়ে ছিলে, সমস্ত রাত
২
স্মরণ, কী অস্বাভাবিক সব গল্প শোনাস তুই, আর
বিছানার মধ্যে ঢুকে শুয়ে যাস, যেন আমি লেপ সরালেই
তোর মুখ দেখতে পাবো, তারপর ঘুমটুম হবে না সারারাত
আমাদের জন্য তোরা কত চেষ্টা করেছিলি ঠাণ্ডা নোঙরের
কাগজের শেষপাতায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলি সপ্তাহে দুবার
স্মরণ, আমার কিন্তু জানা ছিল, কোনভাবে শেষ হবে গল্পটা আমার
যে গল্প বলিস গিয়ে আজো, ওই নষ্ট ছেলেটাকে
দুর্গাপুরে থাকে যেটা, ব্যাঙ্গালোরে, হায়দ্রাবাদে, হৃদয়ের পোড়া অংশটায়
যে এখনো বৃষ্টি পড়লে, সোঁদা গন্ধে মনে করে, আমাকে, আমাকে
যেমন যেমন ওর মনে পড়ে, যে যে ভাবে ভুলে যেতে চায়
স্মরণ, কী ভাবিস, এ নোটবুকের ছেঁড়া অংশটায়
সেসব গভীর কেচ্ছা টুকে টুকে রাখি, নিয়মিত?
আকাশও পরিষ্কার, হায়দ্রাবাদে মেঘও করে না নাকি, কলকাতার মত?
৩
আমার ছিল বিফলতাবোধ, ও গান
আমার ছিল মৃদু কষ্ট, ম্যাদামৃদু সুখে থাকাগুলো
আমার ছিল ইন্টারস্টেট বাস টার্নিমাস, ছেড়ে যাওয়া
ফেরত আসার জন্য, একাকিত্ব, আঁকাবাঁকা রাস্তা, বাসের ঝাঁকুনি
সময় সময় পেটব্যথা, চিনচিন কাঁপুনি আর পাশে বসা অচেনা পুরুষ
লজেন্স-অফার-করা, কামুক অথচ সহযোগী
আমার ছিল পাহাড় ও তার ওপর পড়ে থাকা মেঘ,
বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ও বাড়ির জন্য মন কেমন
কষ্টেও সুখ, ঝিম ঝিম করা হৃদয়, রক্তও অবশ হয়ে আসা ছিন্ন ফিলিং ...
সেও তো প্রেমের মত, শুধু
তার কোন প্রান্তমুখ নেই... গোলাকার।
৪
তুই পিশাচিনী, তুই রাস্তা চলতে কোথায় পৌঁছস
দুদিকে অন্তিম গান, হাহাকার, শহর-পোড়ানো
কালো, মন্দ ধোঁয়া, তুই মাঝখানে হাঁটিস, অধোমুখ—
তোরও তবে কোনওখানে যাবার রয়েছে? কষ্ট? হ্যাঁ কষ্টও রয়েছে অনেক
গাঢ় ভূত কষ্টগুলি সেসময়ে ঝুলে থাকত অন্তরে বাহিরে
খাটের ছপ্পরে থাকত নরমুণ্ড, কচি কচি অন্ধকার রাত
রাত্রিও ঝোলানো থাকত পাক হয়ে শুয়ে থাকা দীর্ঘ মনখারাপের পাশে,
কোলবালিশের কাছে শুয়ে থাকত ভারি মনস্তাপ
৫
তারপর তুই উঠে যেতিস নতুন একটা ভালবাসায়
একটি লাল, অসন্দিগ্ধ, টকটকে প্রণয়ে
আর সেই হৃদয়ের কথাবার্তা যা মূলত আত্মরতিময়
তখনো দেখিস নি তবে, মানুষ আসলে কী কী রূপ ধরে আসে, কী কী হয়
বৃত্তের শুরুর দিকে সবকিছু নতুন ছিল, পরে ফের, চাকতি চাকতি মিলে গেল যেই
দেখলি বৃত্ত ঠিক সম্পূর্ণ হবার পরে শুরু করবে আবার প্রথম থেকে পড়া
আর হৃদয়, খুলে ধরবে একে একে পুরনো মহড়া।
আসলে কখনো তুই নিজের সে চটচটে রসের থেকে মুক্ত হতে চাসনি তেমন
ঝোপে ঝাপে এখনো জোনাকি ধরবি, কালো পুকুরের ধারে ধারে
কোমরে ব্যথার মত রাত্রি নামে, পিশাচিনী, শুতে যাবি না রে?
চিলতে
ভালো লাগছে না।
দুপুরের দিকে মাথা ঠাণ্ডাভাব কমতে থাকে, টেনশন বাড়তে থাকে।
তিনটে থেকে চারটের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল ও বিরক্ত লাগে।
সারাজীবনে কত ঘন্টা ভালো লাগল না? ভাল না লাগার এই
সময়গুলোকে যোগ দিতে দিতে আমরা পাহাড় বানাই
আমরা আলমারি বানাই, বুকশেলফ বানাই
একজন মানুষের জীবনেই তো জমে যায়
কত শ', কত হাজার, কত লক্ষ ঘন্টার ভাল না লাগা
যেন ফিক্সড ডিপোজিট, যেন হাড়গোড়ের স্তূপ, যেন না ভাঙা পাথরের চাঁই
তাহলে সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ জীবনের
সমস্ত ভালো না লাগা ঘন্টাগুলো যোগ দিলে
কতখানি সময় দাঁড়াবে?
ততখানি সময়ের সমুদ্র পেরিয়ে আমি পাই
তোমার সঙ্গে একটা ফুলকি ঝরা মুহূর্ত
পান্নার টুকরোর মতন উজ্জ্বল, সবুজ।