(পরশুরামের লেখা বিখ্যাত ছোটোগল্পের ছায়া অবলম্বনে আধুনিক পথনাটিকা)
পাত্রপাত্রী
আনন্দ
সূত্রধর ১
সূত্রধর ২
সূত্রধর ৩
সূত্রধর ৪
পলা
(গাড়ির ব্রেকের আওয়াজ এবং মহিলাকণ্ঠে 'শিট' শব্দটি শোনা যাবে। স্টেজে ঢুকবে আনন্দ, সূত্রধর ১ ও ২)
সূত্রধর ১: আনন্দ তোর নাকি মোটর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কোথায় কোথায় লেগেছে বল দেখি?
আনন্দ: কোথাও তো লাগে নি। মানে ধাক্কাটা আস্তেই লেগেছিল।
সূত্রধর ২: আস্তেই হোক আর জোরেই হোক একটা মোটর অ্যাক্সিডেন্ট বলে কথা। পুলিশ তোকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো না?
আনন্দ: পুলিশ তো আসেই নি। জ্যাম রাস্তা, সবাই অফিস ফেরৎ, আশেপাশের গাড়ি থেকে লোকে গালাগাল দিচ্ছে। আমরা কার্বে গিয়ে নিজেদের নাম ঠিকানা ইনসিওরেন্স টুকে নিলাম, তারপার যে যার রাস্তায়। সত্যি বলছি এটা বিশেষ কোনো ব্যাপার না।
সূত্রধর ১: ব্যাপার না মানে? লোকটা তোর পেছনে ধাক্কা মারল আর তুই ওকে ছেড়ে দিলি?
আনন্দ: মানে ইয়ে লোক নয়, অল্পবয়েসী, মহিলা, খুব করে মাপ চাইছিল।
সূত্রধর ২: ব্যস মহিলা দেখেই পটপট করে ল্যাজ নড়ে উঠলো। এইজন্য বলি, খোদার খাসির মতো থাকিস না, একটা বিয়ে কর। চল এখন ডাক্তার দেখাতে যাবি। তারপর ইনসিওরেন্সে ফোন করতে হবে, একটা ল'ইয়ারের সাথেও কথা বলতে হবে।
আনন্দ: মানে আমার তো কোথাও ব্যথা নেই, গাড়িটাও দিব্যি চলছে, বাম্পারটা একটু মেরামত করিয়ে নিলেই হবে। এসব ঝামেলা না করলে হয়না।
সূত্রধর ১: না হয়না। আনন্দ, তুই সেই যদুবংশের লাজুক ছেলেটিই থেকে গেলি। দিস ইজ আমেরিকা, এখানে ব্যথা হবার আগেই চিকিৎসা করতে হয়। এইরকম রিয়ার এণ্ডিং থেকে কত লোক জন্মের মতো নুলো-খোঁড়া হয়ে হুইলচেয়ারে বসে আছে জানিস?
আনন্দ: অ্যাঁ! নুলো-খোঁড়া হয়ে!
সূত্রধর ২: ওর নাম হুইপল্যাশ। স্পাইন্যাল কর্ডে শর্ট সার্কিট হয়ে যায়।
সূত্রধর ১: হ্যাঁ চালাকি নয়, আমাদের অফিসেই দুজন আছে। এখন অবশ্য তারা কেউ কাজ করে না। ডিসএবলড কিনা, রোজ বেশ স্কুটার হাঁকিয়ে ম্যাকডোনাল্ডে এসে বসে থাকে, পয়সাকড়িও ভালো পায়। তোর ডিসএবিলিটি ইনসিওরেন্স করা আছে তো?
আনন্দ: আমি তো ঠিক জানিনা।
সূত্রধর ২: পইপই করে বলেছিলাম, কাজে জয়েন করার আগে কি সই করছিস দেখে নে। যাকগে এটা রিয়ার এণ্ডিং, ওই মহিলার দোষ, দে দেখি ওর কার্ডটা। ড্রাঙ্ক ছিল কিনা জানিস।
আনন্দ: না মানে ড্রাঙ্ক বলে তো মনে হলনা। দেখ সত্যি বলছি আমার তেমন কিছু হয়নি।
সূত্রধর ১: আরে এতো আচ্ছা গবেট। দেখছি হয়েছে তাও বলবে কিছু হয়নি।
(কথা বলতে বলতে সবাই বেরিয়ে যায়। সূত্রধর ৩ ও ৪ মঞ্চে একটি টেবিল, ল্যাপটপ, কয়েকটি পোস্টার বোর্ড ইত্যাদি নিয়ে আসে। সূত্রধর ৪ ডাক্তারের বেশে ঢোকে এবং সোজা কম্পিউটারে গিয়ে বসে পড়ে। আনন্দ একটু নার্ভাসভাবে চেয়ারে বসে আছে)
সূত্রধর ৪: আমি ডঃ প্যাটেল, ইন্টারনিস্ট। ব্যথাটার নম্বর বলুন, এক থেকে দশের মধ্যে।
আনন্দ: আজ্ঞে ব্যথার নম্বর তো জানিনা।
সূত্রধর ৪: এক মানে ব্যথা প্রায় নেই, দশ মানে অসহ্য ব্যথা। কাগজে লেখা আছে পড়েননি?
আনন্দ: মানে ঘাড়ের কাছটা ওই এক হবে। কাল রাত্তিরে ঘুমটা ঠিক হয়নি।
সূত্রধর ৪: (দৃষ্টি কম্পিউটারের দিকে) ঘাড়ে ব্যথা, ঘুম হয়নি। ঠিক আছে এম. আর. আই. করাতে হবে। কখন হাতে পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে, সকালে না সন্ধ্যায়।
আনন্দ: আজ্ঞে ঝিঁ ঝিঁ তো ধরে না। আচ্ছা আমাকে একটু পরীক্ষা করে দেখুন না কি হয়েছে।
সূত্রধর ৪: (বিরক্ত হয়ে) আরে মশাই ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে কমপিউটারে আপনার প্রোফাইল ঢোকাতে হবে, তারপর কি কি টেস্ট দরকার সেগুলো প্রিন্ট করতে হবে, হেলথ মেইন্টেন্যান্সের জন্য যা যা করা দরকার সেগুলো স্কেজুল করতে হবে। জিভ দেখি? (বলতে বলতে দায়সারা গোছের পরীক্ষা করে নেয়) যা ভেবেছিলাম তাই। ঘাড়ের নার্ভগুলোতে জট পাকিয়ে গেছে।
আনন্দ: (আঁতকে উঠে) তার মানে। এরপর কি হতে পারে?
সূত্রধর ৪: সেটা জানতেই তো এই পনেরোটা ব্লাড টেস্ট, ঘাড়ের এম. আর. আই. আর নিউরোলজি কনসালট করা হবে। যদি নার্ভে গণ্ডগোল কিংবা মাথায় টিউমার জাতীয় কিছু না থাকে তবে অর্থোপেডিক্স আর ফিজিক্যাল থেরাপিতে পাঠাবো। ধন্যবাদ।
(সূত্রধর ৪ ল্যাপটপ নিয়ে বেরিয়ে যায়। সূত্রধর ৩ ঢোকে, হাতে একটা মস্ত সিরিঞ্জ। আনন্দর হাতা গুটিয়ে রক্ত নিতে থাকে, আনন্দ ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তারপর দুজনেই বেরিয়ে যায়। অন্যদিক থেকে সূত্রধর ১ ও ২ ঢোকে)
সূত্রধর ১: বলেছিলাম না? দুদিনের মধ্যেই আনন্দের সব সিম্পটমগুলো দেখা যাচ্ছে।
সূত্রধর ২: এম. আর. আই. মেশিনের মধ্যে নাকি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল। চারদিকটা বন্ধ কিনা। তারপর ওরা ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে তবে এম. আর. আই. করেছে। সেই থেকে ভীষণ দুর্বল। (আনন্দ ঢোকে।)
আনন্দ: তোরা এসে গেছিস? আচ্ছা আমার তো এখনো হাতে পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরছে না, মাথাও ঘুরছে না শুধু সারাদিন ঘুম পাচ্ছে আর বুকের মধ্যে মাঝে মাঝে একটা ধড়ফড়ানি। তোরা রিপোর্টগুলো পেয়েছিস।
সূত্রধর ১: হ্যাঁ ব্লাড রিপোর্ট সব ঠিক আছে। কাল নিউরোলজিস্ট দেখবেন।
আনন্দ: আচ্ছা এম. আর. আই.-টা তো প্যাটেলই দেখে দিতে পারে, আবার নিউরোলজিস্ট কেন?
সূত্রধর ২: উনি বললেন, ওই যে তোর ঘুম ঘুম পাচ্ছে ওটা নাকি ভালো লক্ষণ নয়। ডক্টর অরোরা, নিউরোলজির প্রফেসর তোকে ভালো করে দেখবেন। এর মধ্যে আমি একজন লইয়ার ঠিক করেছি, তার কাছেও যেতে হবে।
(সবাই বেরিয়ে যায় - ডাক্তারের পোষাকে সূত্রধর ৩ ঢুকে চেয়ারে বসে। নার্ভাসভাবে আনন্দ ঢুকছে)
সূত্রধর ৩: আরে সর্বনাশ আপনি হেঁটে হেঁটে ঢুকছেন। হুইলচেয়ার কোথায় গেল?
আনন্দ: আমি তো দিব্য হাঁটতে পারছি।
সূত্রধর ৩: এখন পারছেন। একটু বাদে যদি পড়ে যান, আমাকে আবার কুড়ি পাতা রিপোর্ট লিখতে হবে। যাকগে বসুন। সকালবেলা বমি পায়।
আনন্দ: না তো, বমি কেন পাবে?
সূত্রধর ৩: পাবে পাবে, এখনো অল্প বলে বুঝতে পারছেন না। কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে।
আনন্দ: না, মানে ভোঁ ভোঁ তো করেনা।
সূত্রধর ৩: করে করে, চারদিকে যা আওয়াজ, ঠিক করে শুনতে পান না। আচ্ছা আপনার এর আগে কখনো লাম্বার পাংচার হয়েছে।
আনন্দ: না মানে গাড়ির পেছনে ধাক্কা লেগেছে, কোনোরকম পাংচার তো হয়নি।
সূত্রধর ৩: টায়ার পাংচার নয়, লাম্বার পাংচার। মেরুদণ্ডে ফুটো করে রস বার করা হয়েছে কি?
আনন্দ: কেন আমাকে ওইসব করতে হবে কেন? এম. আর. আই.তে কি খারাপ কিছু পাওয়া গেছে?
সূত্রধর ৩: নাঃ এক্কেবারে পরিষ্কার। তবে কিনা আপনার ব্লাড টেস্টে কয়েকটা গোলমাল আছে, মৃগী বা মালটিপল স্কেরোসিস হলেও হতে পারে।
আনন্দ: কি বললেন। আমার সিরোসিস হয়েছে।
সূত্রধর ৩: সিরোসিস নয় স্কেরোসিস। নার্ভগুলো শুকিয়ে যায়, হাতে পায়ে সাড় থাকে না। তারপর ইউরিন বন্ধ হয়ে যায়। এই যে, এই কাগজগুলো দেখে নিন তাহলেই বুঝবেন। আর এইখানে সই করুন।
আনন্দ: কিন্তু আমার তো বেশ ভালোই ইউরিন হচ্ছে।
সূত্রধর ৩: আজ হচ্ছে বলেই কাল যে হবে তার গ্যারান্টি কোথায়? দেখুন, ইইজি আর লাম্বার পাংচার না করে ঠিক বলা যাবে না যে আপনার কি কি নিউরোলজিক্যাল অসুখ ছিল বা ভবিষ্যতে কি কি হতে পারে। না না আপনি ভর্তি হয়ে যান। আগে আমরা প্রমাণ করবো যে আপনার মৃগী কিংবা মালটিপল স্কেরোসিস নেই, তারপরেই না আপনাকে অর্থোপেডিক্সের কাছে পাঠানো হবে।
(লাম্বার পাংচারের যন্ত্রপাতি নিয়ে সূত্রধর ৪ ঢোকে, দুজনে মিলে আনন্দকে জাপটে ধরে পিঠে সূঁচ ফোটায়, মাথায় তার আটকে দেয়। আনন্দ একটা চেয়ারে বসে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। সূত্রধর ৩, ৪ বেরিয়ে যায়, সূত্রধর ১, ২ ঢোকে।)
সূত্রধর ১: (আনন্দের পিঠ চাপড়ে) কেমন আছিস?
আনন্দ: (লাফিয়ে ওঠে) করিস না, পিঠে ভীষণ ব্যথা, মাথা ধরেছে, ভালো লাগছে না। আমি বাড়ি যাবো।
সূত্রধর ২: ঘাবড়াস না আমরা তো আছি। আরে এটা তো অন্ততঃ জানা গেল যে তোর মৃগী কিংবা মালটিপল স্কেরোসিস নেই। এই দ্যাখ ল'ইয়ারের কাগজপত্র সব নিয়ে এসেছি। যেখানে যেখানে কাগজ সাঁটা আছে সই করে দে দেখি।
আনন্দ: আমি কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইনা।
সূত্রধর ১: আরে বলা তো যায়না, তোর চিকিৎসা কদিন চলবে, চাকরি করতে পারবি কিনা, আরো কি কি ক্ষতি হতে পারে। সব ওদের ইনসিওরেন্স কভার করবে।
আনন্দ: প্লীজ তোরা আমাকে একটু রেহাই দে। এই দ্যাখ লিস্ট করা আছে, আমার কি কি অসুখ থাকতে পারে। এগুলো একটা একটা করে গুগুল করছি আর সবকিছু আরো গুলিয়ে যাচ্ছে। কিসব ভয়ানক অসুখ আর তার বিদঘুটে সব চিকিৎসা, পড়লে বুকের রক্ত শুকিয়ে যায়।
সূত্রধর ২: আমি বলি কি শোন। ডক্টর স্বামীনাথনের নাম শুনেছিস। দীপক চোপড়ার ছাত্র, অলটারনেটিভ মেডিসিনের গুরু, হোমিওপ্যাথি, নেচারোপ্যাথি, ইয়োগা, আকুপাংচার, কিরোপ্রাক্টিক সবকিছুই নাকি গুলে খেয়েছে। সাহেবরা দলে দলে 'ডঃ সোয়ামি'র ক্লিনিকে যায়। ওঁকে একবার কনসালট করে দেখা যাক?
আনন্দ: আর কতো কনসালট করাবো? যত ডাক্তার দেখাচ্ছি, আমার রোগের লিস্ট তত লম্বা হচ্ছে।
(সূত্রধর ১, ২ বেরিয়ে যায়। সোয়ামির বেশে সূত্রধর ৪ ও তাঁর সহকারী হিসাবে সূত্রধর ৩ ঢোকে।)
সূত্রধর ৪: কটা কেমো হয়েছে?
আনন্দ: মানে? কেমো হয়েছে মানে?
সূত্রধর ৪: ক্যান্সারের রুগীরা যখন কেমোথেরাপি নিতে নিতে আধমরা হয়ে যায় তখনই আমার কাছে আসে কিনা। আপনার কোথায় ক্যানসার হয়েছে।
আনন্দ: ক্যানসার? আমার কেন ক্যানসার হতে যাবে?
সূত্রধর ৪: তাহলে কি হয়েছে? গেঁটে বাত, অ্যালজাইমার না কোলাইটিস? নাকি যৌবনেই বৃদ্ধ হয়েছেন? মোটকথা ওই বিষ খাওয়ানো ডাক্তারের দল জবাব না দিলে কেউ তো আমার কাছে আসেনা। আসুন দেখি কেমিক্যাল ওষুধ খেয়ে খেয়ে কতটা ক্ষতি হয়েছে, কতখানি ডিটক্সিকেশন দরকার।
আনন্দ: আজ্ঞে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, পিঠে একটু ব্যথা, তাও ঐ ছুঁচ ফোটানোর জায়গাটায়। কিন্তু খিদে নেই, ঘুম নেই, সবসময় দুর্বল লাগে।
সূত্রধর ৪: ব্যস ব্যস আর বলতে হবেনা। অ্যাক্সিডেন্টের ফলে আপনার মেরুদণ্ডের অ্যালাইনমেন্ট নষ্ট হয়ে গেছে। এইবার ওটাকে রিঅ্যালাইন করে তারপর লাগাতার ইয়োগা আর অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট থেরাপি করতে হবে। শরীর থেকে সব বিষ বার করে, ইং-ইয়াং ব্যালানসিং করে একেবারে নতুন মানুষ বানিয়ে দেবো। খরচ মাত্র হাজার পাঁচেক ডলার। শুয়ে পড়ুন শুয়ে পড়ুন।
(সূত্রধর ৩ আনন্দকে বিছানায় বসিয়ে দেয়, তারপর পিঠের ওপর নানারকম দলাইমলাই চালাতে থাকে। আনন্দ ব্যথায় চিৎকার করে পালায়। ডাক্তাররা তার পিছনে পিছনে ছোটে। সূত্রধর ১ ও ২ ঢোকে। আনন্দ অন্যদিক থেকে ছুটে এসে ওদের ধরবে।)
আনন্দ: ওরে তোরা আমাকে বাঁচা। আমি মেরুদণ্ড সোজা করতে চাইনা। আমার পাঁচ হাজার ডলার নেই।
সূত্রধর ১: বোস, বোস ব্যস্ত হোস না, আরে টাকা তো ইনসিওরেন্স কোম্পানি দেবে।
আনন্দ: ছাই দেবে। এই দ্যাখ চিঠি। আমার ইনসিওরেন্স বাতিল করা হয়েছে। এরা বলছে ওবামাকেয়ার না কি যেন একটা ওয়েবসাইট আছে সেখানে গিয়ে নতুন ইনসিওরেন্স করতে হবে। এদিকে অলরেডি পঞ্চাশ হাজার ডলারের মেডিক্যাল বিল এসে গেছে, আরো আসবে।
সূত্রধর ২: আরে সর্বনাশ। ওই ওয়েবসাইট তো মায়ের ভোগে। প্রেসিডেন্ট শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়ে বসেছেন। তুই কি করবি এখন? কালকেই তো অর্থোপেডিক্স সার্জারি হবার কথা।
আনন্দ: আমি দেশে ফিরে যেতে চাই। পিসীমা গো তোমার হাতের চুন-হলুদ দিলেই কবে আমার ব্যথা সেরে যেত।
সূত্রধর ১: দূর পাগলা কোথায় দুনিয়ার এক নম্বর হেলথ কেয়ার সিস্টেম আর কোথায় চুন হলুদ। ভালো করে শোন তোকে পয়সাকড়ির পরোয়া করতে হবে না। তুই শুধু এই কাগজপত্রে সই করে দে, তারপর ল'ইয়ার ওদের ইনসিওরেন্সের সঙ্গে বুঝবে। শালা তোকে রিয়ার এণ্ড করে বসিয়ে দিয়েছে এবার হুড়কো কাকে বলে দেখবে।
আনন্দ: (সই করতে করতে) নিজে তো মারা যাবোই, আরেকটা মানুষকে ফাঁসিয়ে গেলাম। কি দেশেই এসেছি। (কাগজগুলো বাড়িয়ে দেয়) এই নাও যা খুশি করো, আমি আর একবার দেখবো তারপর সোজা ঘরের ছেলে ঘরে ফেরত। মরতেই যদি হয় তবে বিদেশ বিভূঁইয়ে মরি কেন।
সূত্রধর ২: ব্যাস নিশ্চিন্ত। এবার চল অর্থোপেডিক্স দেখাতে হবে।
(সবাই বেরিয়ে যায়। একদিক দিয়ে সার্জনের পোষাকে সূত্রধর ৩ ঢোকে। সারা গায়ে নানারকম যন্ত্রপাতি ঝুলছে। আনন্দ ঢুকছে।)
সূত্রধর ৩: এই যে রোগী। একে অপারেটিং রুমে নিয়ে যাও।
আনন্দ: আমি বাড়ি যাব। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর রাস্তাটা শুধু দেখিয়ে দাও।
(সূত্রধর ৪ ঢুকে আনন্দকে পাকড়াও করে। আনন্দ পালাচ্ছে, পিছনে পিছনে সূত্রধর ৩ ও ৪, অন্যদিক থেকে পলা ঢোকে, আনন্দর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়।)
আনন্দ: উঃ বাবাগো। (হাঁপাচ্ছে)
পলা: মাপ করবেন, আপনাকে দেখতে পাইনি। এত ব্যস্ত হয়ে ছুটছেন কেন? সামওয়ান ইন লেবার?
আনন্দ: মানে? লেবার মানে?
পলা: মানে আপনি তো বার্থিং সেন্টারে এসে গেছে। লেবার অ্যাণ্ড ডেলিভারি ওয়ার্ড। তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম আপনার স্ত্রী বা গার্লফ্রেণ্ড কি লেবারে আছেন? আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।
আনন্দ: আমি সার্জারি করাবো না?
পলা: কি বলছেন? কে আপনার সার্জারি করতে চাইছে।
আনন্দ: ওই যে অর্থোপেডিক্স সার্জন। বলছে আমার পিঠের হাড় নাকি নরম হয়ে গেছে, সিমেন্ট দিয়ে শক্ত করতে হবে।
পলা: শান্ত হোন। কেউ আপনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সার্জারি করবে না। আচ্ছা আপনাকে কেমন চেনা লাগছে, আমরা কোথাও মিট করেছি কি? আমার নাম ডক্টর পলা মিত্র, গাইনিকোলজিস্ট।
আনন্দ: সর্বনাশ। আপনিই না আমার গাড়ির পিছনে ধাক্কা মেরেছিলেন।
পলা: ও মাই গড। আপনিই সেই লোক। মিথ্যে অসুখের ভান করে আমাকে স্যু করেছেন, আপনার ওই স্টুপিড ল'ইয়ার সারাদিন আমার পিছনে লেগে আছে। কি চান আপনি? সারা জীবন কাজ না করে বসে বসে খাবেন। কিচ্ছু হয়নি আপনার। আপনাদের মতো লোকজনের জন্যেই আমাদের হেলথ কেয়ার সিস্টেমটা গোল্লায় যাচ্ছে। যাকগে আপনার সঙ্গে কথাও বলতে চাই না। ওই দিকে অর্থোপেডিক্স ডিপার্টমেন্ট, আপনি যান, ধন্যবাদ।
আনন্দ: কি? কি বললেন? আমার কিচ্ছু হয়নি?
পলা: হয়নিই তো। দিব্যি দৌড়চ্ছেন, লাফাচ্ছেন, চেঁচামেচি করছেন।
আনন্দ: আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক (পলাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে) উঃ গত দু সপ্তাহে এই একটা ডাক্তার বললো যে আমি ভালো আছি। আপনি প্লীজ একটু আমার কথাগুলো শুনুন, এভাবে চললে আমি শিগগিরই মারা যাব।
পলা: কি করছেন। ছাড়ুন নাহলে পুলিশ ডাকবো।
আনন্দ: (প্রায় কেঁদে ফেলে) - না শুনুন প্লীজ। আমি কারুর নামে মামলা করতে চাই না, কারো সাথে আমার ঝগড়া নেই। আমি শুধু সুস্থভাবে বাঁচতে চাই। সবাই মিলে আমার এই দশা করেছে। আমাকে দয়া করে বলুন যে আমার ঠিক কি হয়েছে - কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার, স্পনডাইলোসিস, মালটিপল স্কেরোসিস, এপিলেপসি, ব্রেইন টিউমার। আর আমি কদিন বাঁচবো।
পলা: (একটু আশ্চর্য হয়ে) দাঁড়ান দাঁড়ান রাস্তার মাঝখানে কান্নাকাটি করবেন না। আপনি কি আগে থেকে অসুস্থ ছিলেন? যেটুকু ধাক্কা লেগেছে তাতে তো কিছুই হবার কথা নয়। নাঃ আপনি নির্ঘাৎ কোনো মতলবে আমাকে ফাঁসাতে এসেছেন।
আনন্দ: আমার কোনো অসুখ ছিল না আর আমি কাউকে ফাঁসাতেও চাইনি। আমি শুধু চাই যে কেউ একজন আমার কথাগুলো শুনুক, কমপিউটারের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মানুষটার দিকেও তাকিয়ে দেখুক। তারপর আপনাদের ওই শক্ত শক্ত ল্যাটিন শব্দগুলো একটু সহজ করে বুঝিয়ে দিক। আমাকে একটু ভরসা দিক। আমি শুধু একটা নাম্বার আর একটা বিলিং ইউনিট নই, আসলে একটা জলজ্যান্ত মানুষ। আমি আর এই চিকিৎসার চাপ নিতে পারছি না।
(সূত্রধরেরা ঢুকে লাইন করে দাঁড়ায়)
সূত্রধর ৩: আপনি নিতে না পারলেও আমরা ছাড়তে পারছি না।
সূত্রধর ৪: আপনি বিনা ডায়াগনসিসে, বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে আপনার বাড়ির লোক মামলা করতে পারে।
সূত্রধর ৩: কাজেই আপনার প্রতিটি কথা রেকর্ড করে রাখা হবে।
সূত্রধর ৪: আপনি যদি বাঁচেন তবে আমাদের মহান চিকিৎসা শাস্ত্রের সব নিয়মকানুন মেনে বাঁচবেন।
সকলে একসাথে: আর যদি মারা যেতেই হয় তো সব রকম বিধিসম্মত চিকিৎসা করিয়ে তারপর নিশ্চিন্তে মারা যাবেন।
পলা: এই, আপনারা কি শুরু করেছেন কি? বেরোন এক্ষুনি। (সূত্রধরেরা মার্চ করে বেরিয়ে যায়) লোকটাকে একটু রেহাই দিন। (আনন্দকে) চলুন আমার অফিসে গিয়ে কথা বলি। আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে ঠিকই আছেন, শুধু শুধু এতো অ্যাংশাস হলে চলবে কেন? আমি কিন্তু ওই অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে একটা কথাও বলছি না।
আনন্দ: বিশ্বাস করুন আমার বন্ধুরা কিসব কাগজে সই করিয়ে আপনার পিছনে লেগেছে। এদিকে আমার ইনসিওরেন্স বাতিল হয়ে গেছে, নতুন ইনসিওরেন্স নিতে পারছি না, পঞ্চাশ হাজার ডলার ডাক্তারি বিল মাথার ওপর ঝুলছে। আপনি বলছেন আমার কিছু হয়নি কিন্তু আপনার ওই কমপিউটারে দেখুন আমার মেডিক্যাল রেকর্ড পাঁচশো চুয়ান্ন পাতা।
পলা: আসুন আমার অফিসে, কি হয়েছে প্রথম থেকে সবকিছু খুলে বলুন। মনে হচ্ছে ওষুধ নয় আপনার কিছু গাইডেন্স আর রিঅ্যাসিওরেন্স দরকার। ইস খুব ভয় পেয়ে গেছেন দেখছি।
আনন্দ: আমার তাহলে ভালো হবার আশা আছে বলছেন।
পলা: অসুখের কথা থাক, আপনার কথা একটু আগে শুনি। কবে দেশ থেকে এসেছেন, একলা না বিবাহিত, কোথায় থাকেন, কোথায় চাকরি করেন, কি খেতে ভালোবাসেন, এইসব আগে বলুন দেখি।
আনন্দ: বলবো? আপনার সময় আছে।
পলা: (ঘড়ি দেখে) নেই, তবে সময় করে নেবো। হাজার হোক আমার জন্যই তো আপনার এই দশা। (হাসে)
(দুজনে চেয়ার টেবিল টেনে বসে। প্রথমে কথাবার্তা, তারপর হাসি, দুজনকে আস্তে আস্তে বেশ ঘনিষ্ঠ দেখায়)
পলা: তাই বলুন। আপনার অসুখটা তার মানে মাথায়।
আনন্দ: যা বলেছেন। কদিন কি ভয়ে ভয়েই না কাটিয়েছি। আজ বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাবো।
পলা: কাল আসবেন কিন্তু। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। খুব ভালো থেরাপিস্ট আপনাকে হেল্প করতে পারবে।
আনন্দ: কোনো থেরাপিস্টের দরকার নেই। আপনি যে বললেন আমার কিছু হয়নি, তাতেই আমি অনেকটা ভালো বোধ করছি। কাল নাহয় ঠিক এই সময় আপনার সঙ্গে গল্প করতে আসব। আরেকটা কথা বলি। আপনাকে দেখলেই বোঝা যায় যে আপনি খুব ভালো ডাক্তার। মানে আপনার সাথে কথা বললে মনটা ভালো লাগে আর মনটাই তো সব। আচ্ছা গুড নাইট।
(আনন্দ বেরিয়ে যায়। পলা ওর দিকে তাকিয়ে মাথা হতাশভাবে নাড়ায়। তারপর ফোনটা তুলে নেয়। ওর কথা বলার মধ্যেই আস্তে আস্তে আলো নিভে যাবে)
পলা: হ্যালো আমি পলা বলছি। হ্যাঁ ঠিক বলেছ, এই ছেলেটার গাড়িতেই ধাক্কা মেরেছিলাম। কি বলছো? ওকে ভুলিয়েভালিয়ে একটা সাইকিয়্যাট্রিস্ট দেখাতে হবে। ডায়াগনোসিস অ্যাংসাইটি আর ডিপ্রেশন। অসাবধানে ব্রেক কষেছিল সেটাই প্রমাণ হবে তাইনা? ঠিক আছে, আমি রেফার করে দেব। তুমি তাহলে আমাদের ল'ইয়ারকে একটা ফোন করে দাও। কি বলছো? না না ঠিক আসবে, খুব ভয় পেয়ে গেছে তো। অনেকদিন ধরে চিকিৎসা করাচ্ছে বেচারা।
( অন্য নাটিকা বজ্রকীট)
(পরবাস-৫৭, জুলাই ২০১৪)