Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে
উদয় চট্টোপাধ্যায়ের

আরো লেখা :


ISSN 1563-8685




একে চন্দ্র দুয়ে পক্ষ

মার পাঁচ বছরের নাতনি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল: 'আমরা দশে দিক বলি কেন?' দিক তো চারটে—পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর আর দক্ষিণ। খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। পূর্বদিকে সূর্য ওঠে, পশ্চিমে অস্ত যায়। শীতে উত্তুরে হাওয়া বয়, গ্রীষ্মে দখিনা। ভারতের ভৌগোলিক সীমানা জানতে বাচ্চাদের পড়তে হয় উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পূর্বে মায়ানমার ও চীন, আর পশ্চিমে আরব সাগর ও পাকিস্তান। বাকি দিকগুলো লুকালো কোথায়? নাতনিকে বলি: 'আছে, আছে। সেগুলো হল ঈশান, অগ্নি, নৈঋ'ত, বায়ু, ঊর্ধ্ব আর অধঃ।' সে বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। অজ্ঞতা কি শুধু তার একার? বড়োরাই কি সবাই বলতে পারবে কোন্‌টা ঈশান, কোন্‌টা নৈঋ'ত? 'গুপ্তধন' গল্পে রবীন্দ্রনাথ গুপ্তধনের নির্দেশ জানাতে ছড়ায় লিখেছিলেন - 'ঈশানকোণে ঈশানী, / কহে দিলাম নিশানী'। ঈশান শিবের নাম, সেই অনুষঙ্গে দুর্গা হলেন ঈশানী। 'বর্ষশেষে'র সেই অবিস্মরণীয় প্রারম্ভিক পংক্তি 'ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে / বাধাবন্ধহারা'—শুধু লাইনটা নয়, তার কল্যাণে মনে গাঁথা হয়ে আছে ঈশান মানে উত্তর-পূর্ব কোণ। তেমনই কিশোর বয়সে হাতে এসেছিল বিমল ঘোষের রোমানিয়া ইউগোস্লাভিয়া ভ্রমণবৃত্তান্ত 'ইউরোপের অগ্নিকোণে', যার সুবাদে অগ্নিকোণ যে দক্ষিণ-পূর্ব কোণ সেটা এখনও ভুলিনি। অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণদেরও সেটা ভুলে গেলে চলে না। অগ্নিকোণের অধিদেবতা হলেন অগ্নি, যজ্ঞকর্মের অগ্নিকুণ্ডের স্থাপনা করতে হয় যজ্ঞক্ষেত্রের অগ্নিকোণে। নৈঋ'ত হল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ, যেদিকে আমাদের কেরল মালাবার উপকূল। অবশিষ্ট বায়ু তাহলে অবশ্যই উত্তর-পশ্চিম কোণ। অবিভক্ত ভারতে হাওড়া থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পেশোয়ার পর্যন্ত বায়ু বেগে বায়ুকোণের দিকে ছুটত বলেই কি ট্রেনটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'তুফান মেল'? বাকি রইল ঊর্ধ্ব আর অধঃ। মাথার উপরে আকাশের চাঁদোয়া, আর পায়ের নীচে পৃথিবীর ভূমি যা খুঁড়তে খুঁড়তে রসাতল পাতাল পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। মানুষের চিত্তবৃত্তিকে ঊর্ধ্বগামী করাতে হয়, অনবধানে হয় অধঃপতন—রসাতল গমন। উপরনীচ নির্দেশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন ভারতবর্ষের প্রাচীন দার্শনিকেরা।

এক থেকে দশ শিশুরা এখনও শেখে একে চন্দ্র দুয়ে পক্ষ আবৃত্তি করে। 'আবৃত্তিঃ সর্বশাস্ত্রাণাং বোধাদপি গরীয়সী'—বুঝতে না-পারলেও মুখস্থ করো। ছন্দোবদ্ধ ছড়ার মতো একে চন্দ্র দুয়ে পক্ষ থেকে দশে দিক আওড়াতে আওড়াতে দশ পর্যন্ত সংখ্যা অধিগত হয়ে যায় অনায়াসে, না-ই বা বোধগম্য হল চার বেদ পঞ্চবাণের তাৎপর্য। সেটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে হবে। তিন বছরের আগেই আমার নাতনির 'দশে দিক' শেখা হয়ে গেছে, দশ দিক নিয়ে প্রশ্নটা এল তার পাঁচ বছরে। এখন ছয় ঋতু বুঝবে, সাত সমুদ্রকে কল্পনা করে নেবে রূপকথার আদলে—কিন্তু পঞ্চবাণ নৈব নৈব চ। It is never too early to learn শেখার কোনো নিম্নতম বয়স নেই, কিন্তু বোঝার জন্যে তা নয়। বিদ্যালাভ থেকে শিক্ষালাভ, তা' থেকে প্রজ্ঞা—এটা পর্ব পরিক্রমা, পর্যায়ান্তর।

শিশুকে 'একে চন্দ্র' বোঝানো যায় অনায়াসে—আকাশের চাঁদ দেখিয়ে। সূর্যকে দেখিয়েও শেখানো বা বোঝানো যেত। তবে চাঁদ হল শিশুর আদরের চাঁদামামা—যাকে কপালে টিপ দেবার জন্যে ডাকা হয়, যাকে ভাত বেড়ে দেওয়া যায় শিশুর ভাত খাবার থালাটির পাশে। আদরের জনকে দিয়েই একের পরিচিতি হোক, ক্রমে তাকে বিস্তৃত হতে হবে ভূমার উপলব্ধি পর্যন্ত। সূর্যের বদলে চন্দ্রকে বেছে নেবার অন্য ব্যাখ্যারও অবতারণা করা যেতে পারে। দিনের আকাশে সূর্য একাই একাধিপতি। রাত্রের আকাশে অগণিত তারার মাঝখানে চাঁদ অনন্য। সাতাশ নক্ষত্র ভার্যার একপতি হিসাবে আর যে চন্দ্রদেবের ক্ষয় রোগের কারণে স্বর্গের দেবতাদের দীপ্তি ম্লান হতে বসেছিল তাঁর মহিমা কি কিছু কম শ্লাঘনীয়?

দুয়ে পক্ষ। কী কী পক্ষ? শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষ। অমাবস্যার পর থেকে দিনে দিনে শশীকলার বৃদ্ধি, শেষে 'ওগো পঞ্চদশী, তুমি পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে'। এটাই শুক্লপক্ষ। পূর্ণিমার পরের প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত কৃষ্ণপক্ষ। শুক্লা একাদশীর নিশিতে নিদ্রাহারা শশীকে একলা বসে স্বপ্নপারাবারের খেয়া চালাতে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আবার, গাঙুরের জলে ভেলা-বাওয়া বেহুলার চোখ দিয়ে কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্নায় সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট সমন্বিত বাংলার অপরূপ রূপ দেখেছিলেন জীবনানন্দ। কোন্‌ পক্ষ গরীয়ান, কোন্‌ পক্ষ লঘীয়ান? দুই-ই তুল্য। পাখির দুই ডানার মতো। দুয়ে পক্ষ পাখির দুই পক্ষও তো হতে পারত! কিংবা আজকের রাজনীতির প্রেক্ষিতে স্বপক্ষ আর বিপক্ষ—আমরা ওরা। সমকালীন এক খ্যাতিমান ভাষাতাত্ত্বিক উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ, প্রথম পুরুষের স্থানে আমি পক্ষ, তুমি পক্ষ, সে পক্ষ লেখার প্রস্তাব রেখেছিলেন। 'দুয়ে পক্ষ'র পক্ষ এদের থেকে দুটিকে বেছে নিয়ে কোনো পক্ষপাতিত্ব করবে না নিশ্চয়।

'তিনে নেত্র' উচ্চারণ করে একটু থামতে হয়। নিজের দুই নেত্র বন্ধ করে তৃতীয় নেত্রের হদিশ খুঁজতে হয়। দার্শনিকরা বলেন এই তৃতীয় নেত্র জ্ঞাননেত্র, যা দিয়ে দেখার অতীত কিছু দেখা যায়। যা দেখে শিল্পী করেন শিল্প সৃষ্টি, জ্ঞানী লাভ করেন পরমার্থ। ত্রিনেত্র হলেন মহাদেব আর দুর্গা। তাঁদের তৃতীয় নয়ন থেকে বর্ষিত হয় কখনও রোষাগ্নি, কখনও করুণা আর দাক্ষিণ্য।

চারে বেদ কিংবা চারে চতুর্বেদ। এর অর্থ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। বেদের অর্থ জ্ঞান। পুরুষানুক্রমে লব্ধ জ্ঞানরাশিকে সূত্র ও সংগতি অনুসারে চার ভাগে বিভক্ত করে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন সৃষ্টি করলেন চতুর্বেদ—ঋক্‌, সাম, যজুঃ ও অথর্ব, পৃথিবীর আদিমতম চারটি গ্রন্থ। মহিমান্বিত হলেন বেদব্যাস নামে। 'ব্যাদে সব আছে' বলে বিদ্রূপ করেছিলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা সেইসব অত্যুৎসাহীদের যারা বিশ্বাস করতেন ও প্রচার করতেন যে বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক কোনো আবিষ্কারই নতুন নয়, সবই বেদে উল্লিখিত আছে। বেদে সব নেই, কিন্তু বেদে আছে মানবিক কর্মকাণ্ডকে সংহত করার নির্দেশনা, বিশ্বরহস্য উন্মোচনের প্রথম প্রচেষ্টা আর আত্মোপলব্ধির প্রয়াস। বেদের অঙ্গ হিসাবে উদ্ভূত হয়েছে উপনিষদ ও বেদান্ত, যেখানে মানবপ্রজ্ঞা আরোহণ করেছে চরমতম শিখরে।

পাঁচে পঞ্চবাণ। এ পঞ্চবাণের অর্থ বা মর্মগ্রহণ শিশুসাধ্য নয়। পঞ্চবাণ বা পঞ্চশর হলেন মদনদেব, কামের অধিষ্ঠাতা দেবতা। তাঁর আয়ুধ পুষ্পধনু এবং পাঁচটি বাণ—সম্মোহন, উন্মাদন, শোষণ, তাপন ও স্তম্ভন। পর্যায়ক্রমে এগুলির প্রয়োগ জীবকুলের চিত্তে ও দেহে কী প্রভাব ফেলে এদের নামেই তার প্রকাশ। সৃষ্টিরক্ষায় মদনদেব ও তাঁর পঞ্চবাণের ভূমিকা অপরিহার্য। অসুরনিধন কল্পে কুমার কার্তিকেয়র জন্ম সম্ভাবনায় দেবতাকুলকে উদ্যোগী হতে হয়েছিল মদনদেবকে পাঠিয়ে মহাদেবের ধ্যান ভঙ্গ করতে। তার পরিণাম সর্বজনবিদিত। একাধারে ক্রুদ্ধ মহাদেবের রোষানলে মদনভস্ম আর ধ্যানভঙ্গ মহাদেবের অনুরাগে কুমারসম্ভব। 'পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ এ কী সন্ন্যাসী,/ বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে!'। মদনের ভস্ম বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল বলেই সৃষ্টিতরঙ্গ আজও অব্যাহত। শুধু জৈবিক সৃষ্টি নয়, মানবিক প্রেমভিত্তিক অজস্র সাহিত্যসৃষ্টিও। বৈষ্ণব মহাজন কবি কৃষ্ণপ্রেমে অধীরা রাধার মনোভাব প্রকাশ করেছেন: 'পাঁচবাণ আব লাখবাণ হোয় / মলয়-পবন বহু মন্দা' (বিদ্যাপতি)।' রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদাকেও আহ্বান জানাতে হয়েছে মদনদেবকে তাঁর অভিলষিত অর্জুনের সঙ্গে মিলনাকাঙ্ক্ষায়: 'যে পুষ্পে গাঁথ পুষ্পধনু / তারি ফুলে ফুলে, হে অতনু'। পাশ্চাত্য পুরাকাহিনিতে মদনদেবের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন কিউপিড (Cupid)। তাঁরও অস্ত্র পুষ্পধনু, তবে তাঁর তূণে কতগুলি বাণ তা' বলা হয়নি। তীরবিদ্ধ শিকার তাঁকে প্রশ্ন করতেই পারে 'তোমার তূণে আছে আরো কি বাণ'। মদনদেব যুবা, তাঁর পত্নী রতি। কিউপিড কিন্তু অপাপবিদ্ধ বালক। বালকবীরের বেশে বিশ্বজয় করার রাবীন্দ্রিক কল্পনা কিউপিডে মূর্ত, মদনদেবে নয়।

ছয়ে ঋতু—গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। ষড়ঋতুর আবর্তে নিয়ন্ত্রিত আমাদের জীবনযাত্রা। শিশু তাই স্বাভাবিকভাবেই পরিচিত হয়ে ওঠে ঋতুগুলির সাথে। পাশ্চাত্যে চার ঋতু—বর্ষা আর শরৎ সেখানে অনুপস্থিত। গ্রীষ্মের পরেই সেখানে আসে একটানা ঝিরঝিরে বৃষ্টি নিয়ে মেঘলা বিষন্ন হেমন্ত। মেঘ আছে, মেঘের আড়ম্বর নেই। বৃষ্টি আছে, শ্রাবণের ধারা নেই—যার অভিঘাতে গেয়ে ওঠা যায় 'শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে / তোমার ওই সুরটি আমার মুখের পরে বুকের পরে'। আমাদের বর্ষা শুধু যে অন্ন জুগিয়ে চলেছে তা' নয়, তার ঘনঘটায় অভিভূত হয়েছে কবিচিত্ত—কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ। বর্ষার পর শরৎ আসে তার অমল মহিমা নিয়ে—তার সোনা রোদ্দুর, শিউলি ফুল আর ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু, মাঠে মাঠে ধান আর 'পারে না বহিতে নদী জলভার'। স্বল্পস্থায়ী হেমন্ত ফসলে ভর্তি মাঠের উপরে সন্ধ্যাবেলায় কুয়াশার আস্তরণ টেনে মনে এঁকে যায় এক স্থায়ী চিত্রপট। পাশ্চাত্য দেশের হেমন্তের মতো গাছের পাতায় রঙের হোলিখেলা চলে না। তবু কবির নজর এড়ায় না 'দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ'।

সাতে সমুদ্র বললেই শিশুর কল্পনায় ভেসে ওঠে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারের তেপান্তরের মাঠের কথা। সমুদ্র তার চাক্ষুষ দেখা না-থাকলেও কল্পনা করে নিতে অসুবিধা হয় না সমুদ্র এক অনন্ত বিস্তৃতি জলরাশি। আর একটু বড়ো হয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে সে জানতে পারে পাঁচ মহাসাগরের কথা—অতলান্তিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, উত্তর মহাসাগর আর দক্ষিণ মহাসাগর। মানচিত্র উলটে দেখতে পায় ছোটবড়ো আরও অনেক সাগর উপসাগরের নাম। কিন্তু সাত সমুদ্র সে খুঁজে পায় না। পাবে কোথা থেকে? এই সাতসমুদ্র পুরাণে বর্ণিত সাত সমুদ্র—লবণ, ইক্ষুরস, সুরা, ঘৃত, দধি, ক্ষীর ও স্বাদূদক বা মিষ্টিজলের সমুদ্র। এদের ভৌগোলিক দর্শনপ্রাপ্তি সম্ভব নয়। মিষ্টি জলের হ্রদ থাকলেও সব সমুদ্রই নোনাজলের। পুরাণে এইসব দেবদুর্লভ সমুদ্রে উপনীত হবার বা সেগুলো ভোগের অধিকার নির্দিষ্ট আছে বিশেষ বিশেষ পুণ্যকর্মের অধিকারীর জন্যে।

আটে অষ্ট বসু। এঁদের কথা শিশুরা কেন, অধিকাংশ বড়োরাও জানে না। বঙ্গদেশে অনেক স্বনামধন্য বসু জন্মেছেন—মালাধর বসু থেকে শুরু করে রাজনারায়ণ বসু, জগদীশ চন্দ্র বসু, সুভাষ চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু হয়ে মায় জ্যোতি বসু পর্যন্ত। এঁরা কেউই অষ্টবসুর মধ্যে পড়েন না। কালীপ্রসন্ন সিংহের অনূদিত মহাভারতে পাচ্ছি 'পৃথু ইত্যাদি আট বসু', তাদের মধ্যে আর একটিমাত্র নাম—দ্যু বসু। এঁরা সকলেই দেবতা। 'সংসদ্‌ বাঙ্গালা অভিধান' জানাচ্ছে, এই অষ্টবসু দক্ষ প্রজাপতির কন্যা বসুর আট পুত্র। তাদের নাম—ভব, ধ্রুব, সোম, বিষ্ণু, অনল, অনিল, প্রত্যুষ, প্রভাস (মতান্তরে, প্রভব)। মহাভারতের আখ্যানমতে পৃথু প্রমুখ অষ্টবসু বশিষ্ঠ মুনির সর্ব সুলক্ষণা গাভী নন্দিনীকে অপহরণ করেছিলেন দ্যু বসুর পত্নীর অভিলাষ পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে। এই পাপের জন্য বশিষ্ঠ তাঁদের মনুষ্য হয়ে জন্মানোর অভিশাপ দিয়েছিলেন। তাঁদের অনুনয়ে বশিষ্ঠ সাতজনের দণ্ড লাঘব করে জন্মের অব্যবহিত পরেই স্বর্গে ফিরে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন, শুধু যার জন্যে এই বিপত্তি সেই দ্যু বসুর শাস্তি ধার্য হল যাবজ্জীবন মনুষ্যলোকে কালযাপন। তাঁদের অনুরোধে সুরধুনী গঙ্গা সম্মত হয়েছিলেন নরলোকে এসে তাঁদের গর্ভে ধারণ করতে। শান্তনু-পত্নী হয়ে গঙ্গা সাত সদ্যোজাত পুত্রকে এক এক করে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। শান্তনুর বাধায় গঙ্গা অষ্টম পুত্রকে ভাসিয়ে দিতে পারেন নি, কিন্তু শান্তনুকে ত্যাগ করে স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এই অষ্টম পুত্রই দ্যু বসু—মানবজন্মে যিনি দেবব্রত, পরবর্তীকালে ভীষ্ম।

নয়ে নবগ্রহ। সূর্যের বা অন্য কোনো নক্ষত্রের চারপাশে পরিক্রমণকারী মহাজাগতিক বস্তুরা হল গ্রহ। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান মতে সূর্যের গ্রহরা হল—বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন আর প্লুটো। যদিও অতি সম্প্রতি আকার ও ওজনের ভিত্তিতে নির্ধারিত গ্রহের সংজ্ঞায় প্লুটো গ্রহত্ব হারাতে বসেছে। প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে 'নয়ে নবগ্রহের' ন'টি গ্রহ হল—সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু আর কেতু। বুঝতে অসুবিধা হয় না খালি চোখে দৃশ্যমান সাতটি উজ্জ্বল আকাশদীপ গ্রহ বলে চিহ্নিত হয়েছে, শুধু রাহু কেতু কল্পনানির্ভর। কিন্তু সেই কল্পনারও একটা ভিত্তি আছে। সারা বছরে একাধিকবার গ্রহণ লাগে সূর্যে আর চন্দ্রে। এক কালো ছায়া এসে গ্রাস করে তাদের, কখনও আংশিকভাবে, কখনও সম্পূর্ণভাবে। কী এই কালো ছায়া? তার সূত্র মিলবে সমুদ্রমন্থনের কাহিনিতে। স্বর্গচ্যুতা লক্ষ্মীকে পাতাল থেকে উদ্ধার করার জন্যে সমুদ্রমন্থনের প্রয়োজন হয়েছিল, আর সে-জন্যে দেবতাদের নিতে হয়েছিল অসুরদের সহায়তা। সমুদ্রমন্থনে উঠেছিল অমৃতভাণ্ড, যে অমৃত পান করলে অমর হওয়া যায়। তাই তার দাবিদার সুর অসুর দু-দলই। অনাচারী প্রবল দৈত্যদের অমরত্ব থেকে বঞ্চিত করতে দেবতারা সাহায্যপ্রার্থী হলেন বিষ্ণুর। বিষ্ণু মোহিনীরূপ ধারণ করে অমৃত বন্টন করতে এলেন। কমণ্ডলুর মাঝখানে প্রাচীর দিয়ে একদিকে অমৃত অন্যদিকে দুধ রেখে দুই পঙ্‌ক্তিতে উপবিষ্ট দেব ও অসুরদের মধ্যে অমৃত ও দুধ বন্টন করলেন মোহিনীরূপী বিষ্ণু। রাহু নামের এক চতুর অসুর অমৃতবন্টনে এইরকম বৈষম্যের অনুমান করে ছদ্মবেশে এসে বসেছিল দেবতাদের পঙ্‌ক্তিতে। অমৃতপাত্রে চুমুক দেবার মুহূর্তে সেটা চোখে পড়ে সূর্য আর চন্দ্রের। বিষ্ণুকে সে-সংবাদ দিতেই বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে তার মস্তক ছিন্ন করলেন। অমৃতপানের প্রভাবে মুণ্ড আর ধড় অমর হয়ে আকাশে আবর্তিত হতে লাগল—মুণ্ড রাহু নামেই, আর তার ধড় কেতু। সূর্য আর চন্দ্র তাকে চিহ্নিত করেছিল এই বিদ্বেষে রাহু তাদের পিছনে ধাওয়া করে সর্বদা, আর সুযোগ পেলেই তাদের কামড়ে ধরে বা গিলে ফেলে। কিন্তু তার কাটা মুণ্ড থেকে বেরিয়ে গিয়ে অচিরেই মুক্তি পায় সূর্য আর চন্দ্র।

রাহুর ছিন্ন ধড় কেতু এই নিয়ে মতানৈক্য আছে। অমৃত তো রাহুর গলার নীচে নামেনি, তাহলে তার ধড় অমরত্ব পায় কী ভাবে? তাছাড়া রাহুর গোত্র জৈমিনি, কেতুর গোত্র পৈতিনশ। তাই এই দুই অংশ এক দেহধারীর হতে পারে না। 'ছায়াগ্রহ' বলেও কেতুর উল্লেখ পাওয়া যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে সূর্য ও চন্দ্রের মহাকাশ পরিক্রমণের কক্ষপথ দুটি যে উত্তর দক্ষিণ বিন্দুতে পরস্পরকে অতিক্রম করে যায় সেই দুটি বিন্দুই হল রাহু আর কেতু।

এই হল একে চন্দ্র থেকে দশে দিকের ইতিবৃত্ত; যাদের মধ্যে বিধৃত রয়েছে বহু তথ্য, কাহিনি আর কল্পনা।


গ্রন্থ সহায়তা:

১)সংসদ বাঙ্গালা অভিধান—সাহিত্য সংসদ, কলকাতা (২০০৩)
২) মহাভারত ১ম খণ্ড, কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত, সাক্ষরতা প্রকাশন, কলকাতা
৩) উইকিপিডিয়া ('কেতু' বিষয়ে)



(পরবাস-৫৯, এপ্রিল ২০১৫)