“Institutionalized rejection of difference is an absolute necessity in a profit economy which needs outsiders as surplus people.”--Audre Lorde
“For years we were called niggers to indicate we had no value or worth and that anything could be done to us. Then the word ‘nigger’ became politically incorrect. So they began calling us criminals. When you say a person is a criminal it means that what happens to them does not matter. It means he or she is a nigger. It means they deserve what they get.”--Melvin Ray, a prisoner of Alabama Prison, 2014
বারাক ওবামার নির্বাচনকে ‘পোস্ট রেসিয়াল’ (post racial) বলে যাঁরা ধরে নিয়েছিলেন তাঁরা আজ নিশ্চয়ই বিস্মিত আমেরিকার 'ফার্গুসন', 'বাল্টিমোর'-এর দিকে তাকিয়ে। শহরগুলির রাস্তা 'কালো' মানুষের বিক্ষোভে উত্তাল কেন আজও? আর যাঁরা ‘ইতিহাসের অন্তিম ঘনিয়েছে’[১] বলে দাবী করেছিলেন, যাঁরা ভেবেছিলেন ইতিহাস অপ্রাসঙ্গিক তাঁরাই বা কী ভাবছেন আজ আমেরিকার এই গণ-আন্দোলনের দিকে তাকিয়ে জানতে ইচ্ছে করছে। স্বীকার করতেই হবে নাকি এবার যে ‘রেস' (race) আর 'রেসিজম’ (racism) একান্তই ঐতিহাসিক? 'রেস' 'মিথ' হলেও 'রেসিজম' নেহাতই বাস্তব? সেই কবে ১৯৫০ সালে UNESCO-র পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হয়: 'রেস'(race)-এর পার্থক্যের ধারণাটি একটি 'মিথ' (myth) যার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। জীববিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক ‘প্যানেল’ (panel)-এর গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তি এই ঘোষণা। অথচ, একবিংশ শতাব্দীতেও 'রেস' আমেরিকার সমাজ-জীবনের কেন্দ্রে বসে! পুলিশের গুলিতে নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুর ঘটনার যে তালিকা হাতে আসছে সেখানে দেখা যাচ্ছে ‘কালো’ মানুষের সংখ্যা ‘সাদা’ মানুষের দ্বিগুণ[২]। দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে 'Black Lives Matter'-এর মত গণ-উত্থান, ষাটের দশকের সিভিল রাইটস-এরই অসমাপ্ত লড়াই আজকের চেহারায়। বিস্ময়ে তাকিয়ে সবাই--আজও বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে কেমন করে ‘রেস’ নির্ধারিত করে দেয় তার আয়ু কত হবে, শিক্ষার কতটুকু সুযোগ সে পাবে, অসুস্থ হলে চিকিত্সার সুযোগ পাবে কিনা ইত্যাদি! এমন কী রাষ্ট্রের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার মত ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুও প্রয়োগ করতে পারবে কিনা (felon-এর কোনও ভোট দেওয়ার অধিকার নেই)। এক কথায়, সামাজিক সম্পদের কতটুকু তার নাগালে। আমেরিকান গণতন্ত্র তার এই গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে—ইতিহাসের সেই আয়রনি বড় স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়েছে মিশেল আলেক্সাণ্ডার (Michell Alexander)-এর বিখ্যাত রচনায়[৩]:
“Jarvious Cotton cannot vote. Like his father, grandfather, great-grandfather, and great-greatgrandfather, he has been denied the right to participate in our electoral democracy. Cotton's family tree tells the story of several generations of black men who were born in the United States but who were denied the most basic freedom that democracy promises—the freedom to vote for those who will make the rules and laws that govern one's life. Cotton's great-greatgrandfather could not vote as a slave. His great-grandfather was beaten to death by the Ku Klux Klan for attempting to vote. His grandfather was prevented from voting by Klan intimidation. His father was barred from voting by poll taxes and literacy tests. Today, Jarvious Cotton cannot vote because he, like many black men in the United States, has been labeled a felon and is currently on parole.”
আসলে, জাত-পাত, 'রেস' এক আশ্চর্য অনড় ধারণা, যা জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে থাকে সমাজের বুকে। কেবল ওপরের সংস্কার বা আইন দিয়ে যা দূর করা যায় না। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ এ-কথা নিশ্চয়ই বুঝবেন। মানব-মুক্তির লড়াই এক-পা-এক পা করে এগোনোর চেষ্টা করে, আর সঙ্গে সঙ্গে ‘জাত্যাভিমান’/'রেসিজম'-এর প্রকাশভঙ্গিও বদলাতে শুরু করে প্রায় তালে তালে। তার চেহারা, ভাষা যায় বদলে। আর তাই অতীতে যে রাস্তায়, বা উপায়ে লড়াই চলেছিল তা আর আজকের পরিস্থিতিতে তেমন কাজে লাগে না। নতুন স্ট্র্যাটেজি বা পন্থা, নতুন ভাষা আবিষ্কার করতে হয়। যেমন, আমেরিকার ক্ষেত্রে অতীতের সাদা-কালোর প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব আজ উদারনৈতিক অর্থনীতি বা neoliberalism-এর পর্দার আড়ালে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে। নয়া উদারনীতিতে সমাজের কোনও ভূমিকা নেই। গোটা সমাজ একটা খোলা বাজার। সবকিছুর মূল্য নির্ধারিত কেবল আর্থিক লাভ-ক্ষতির নিরিখে। জনমানসে ধনতন্ত্র আর গণতন্ত্র সমার্থক হয়ে যায়। মূলস্রোত সমাজের দাবী ‘সিভিল রাইটস’ বিল ‘পাস’ হয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই তো ‘রেসিজম’ মুছে দেওয়া গেছে, তাই এবার সবাই colorblind হয়ে গেলেই সব সমস্যার শেষ (Angela Davis)। এই আদর্শে/ধারণায় পুষ্ট রাষ্ট্রনীতিতে সমাজের কোনও দায় নেই, তাই দরিদ্রতম মানুষের জন্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থাগুলি একে একে বন্ধ হয়ে যায়। আর দাবী করা হয় গরীব মানুষের দুরবস্থার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী, তারা কর্মবিমুখ। কেবল আমেরিকাতেই নয় পৃথিবীর সব দেশেই সুবিধাভোগী মানুষের এই ধারণা। সরকার বা সমাজের কাছে কিছু প্রত্যাশা কোর না। আর্থিক-সামাজিক সফলতার জন্য চাই 'ব্যক্তিগত দায়বোধ', কিছু মানুষের/গোষ্ঠীর 'কর্মবিমুখতা'-ই তাদের সমস্যার মূল—এইসবই আজকের ‘রেসিজম’-এর ভাষা।
'ফার্গুসন,' 'বাল্টিমোর'--তাই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বহু পুরোনো ইতিহাস, আর সেই ইতিহাসেই আজও আমাদের বাস। কেবল আজকে তাকে নতুন প্রেক্ষিতে চিনে নিতে হবে। ইতিহাসের সঙ্গে এই নিরন্তর বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়েই সামাজিক আন্দোলন এগোতে পারে, নইলে থমকে দাঁড়ায় (Angela Davis)। আমেরিকার কথাই ধরা যাক। সিভিল রাইটস পরবর্তী যুগে সাদা-কালোর পার্থক্য আইনগত ভাবে মুছে দেওয়া গেছে মাত্র, সমাজের গোটা কাঠামো খুব বেশি বদলায়নি। 'রেসিজম' তার অদৃশ্য হাতে আজও জড়িয়ে ধরে রেখেছে গোটা সমাজটাকে। জেলগুলি উপছে পড়ছে ‘কালো’ মানুষের ভিড়ে, অল্পবয়সী আফ্রো-আমেরিকান পুরুষের বিশাল সংখ্যা আজ জেলগুলিতে বন্দী। ইদানিং মেয়েদের সংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই মা, তাঁদের শিশু সন্তানদের foster care কিংবা সরকার চালিত অনাথ আশ্রমের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিবারগুলি ছারখার হয়ে যাচ্ছে, ঠিক যেমনটি ঘটেছিল দাসপ্রথার যুগে। পৃথিবীর মাত্র ৫% মানুষের বাস যুক্তরাষ্ট্রে, আর সারা বিশ্বের বন্দীদের ২৫% বাস করছেন এই দেশেরই জেলগুলিতে (২.৩ মিলিয়ন)। যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার ১২%-১৩% আফ্রো-আমেরিকান। কিন্তু জেলে বন্দী মানুষের ৪০%-ই আফ্রো-আমেরিকান (US Dept. Of Justice, 2009)। অর্থাত্ এত সংখ্যক মানুষ এ দেশের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অক্ষম।
অনেকের মতেই পুরোনো ‘slavery’-র আজকের চেহারা এ দেশের ‘জেল প্রতিষ্ঠান’ বা 'প্রিজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স' (Prison industrial complex)। মিলিটারির মতই প্রিজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স করপোরেট নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, যার একমাত্র লক্ষ্য আর্থিক মুনাফা এবং সমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ। গোটা প্রক্রিয়াটা চলছে অপরাধ দমনের অজুহাতে। ঘরে বাইরে করপোরেট আমেরিকা সামলে বেড়াচ্ছে তার শত্রু। বাইরে ইরাক, আফগানিস্তান আর নিজের মাটিতে সমাজের দরিদ্রতম (অধিকাংশ আফ্রো-আমেরিকান) মানুষের প্রতিবাদ মিছিল। নিরস্ত্র সেই মানুষের ক্ষোভ সামলাতে আধুনিক রণসজ্জায় সজ্জিত বিশাল সৈন্য মোতায়েন করা হচ্ছে। ফার্গুসন, বাল্টিমোর-এর মত শহরের জনপথগুলিও আজ ইরাক, আফগানিস্তানের মতই যুদ্ধক্ষেত্র। গণতন্ত্র-ধনতন্ত্রের আলগা বাঁধন আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। একসময় দাসপ্রথার মধ্যে দিয়ে যে মানুষের শ্রমে গড়ে উঠেছিল আমেরিকার ধনতন্ত্র তারাই গৃহযুদ্ধের অবসানে উদ্বৃত্ত শ্রম হিসেবে দাঁড়িয়েছিল, আজও তাই। এদেশের রাষ্ট্রনীতিতে এই উদ্বৃত্ত শ্রমিকের স্থায়ী ঠিকানা কয়েদখানা।
আফ্রো-আমেরিকান পুরুষ মানেই যে আদতে একজন দুর্বৃত্ত অপরাধী, এটা একটা সনাতন ছবি (archetypical image) হিসেবে আমাদের জন-মানসে গেঁথে গেল কেমন করে, কিংবা জেল-ব্যবস্থা আফ্রো-আমেরিকান জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল কেমন করে বুঝতে গেলে একটু গোড়ার পর্বে ফিরে যেতে হবে। কারাগার এবং প্রাচীন দাসপ্রথার নিবিড় সম্পর্কের প্রসঙ্গ আফ্রো-আমেরিকান সমস্যার যে-কোনো আলোচনায় ইদানিং বারবার উঠে আসছে। ১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির মধ্যে দিয়ে, ‘উত্তরের’ শিল্পায়নকে ঘিরে নতুন অর্থনীতি ইত্যাদির চাপে দক্ষিণের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাচীন সিংহদ্বার ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাসপ্রথার আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটলেও প্রকৃত মুক্তি তখনও অনেক দূর। Emancipation Proclamation ঘোষিত হল সংবিধানের যে ১৩ নম্বর সংশোধনীর (Thirteenth Amendment)-এর মধ্যে দিয়ে আদতে সে ছিল সীমিত মুক্তি, দাসত্ব-কে ধরে রাখার সংবিধান-গত ‘অধিকারের’ সুযোগ থেকে গিয়েছিল ছোট্ট লিখিত সুত্রে: দাসত্বকে ধরে রাখা হয়েছিল অপরাধীর জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে (“Slavery was abolished...'except as a punishment for crime.'" )। এই সূত্রটুকু ধরেই দাসপ্রথা গোপনে সংরক্ষিত হয়েছিল সেদিন। অর্থাত্ আফ্রো-আমেরিকান মানুষের শ্রমের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ণ থেকে গেল। গণ-আন্দোলনের চাপে সরাসরি দাসপ্রথা ফিরিয়ে আনা তখন প্রায় অসম্ভব; তাই প্রচলিত হল 'the convict lease program'--এই অজুহাতে বড় বড় কর্পোরেশনগুলির কাছে বন্দী-শ্রম বিকোতে লাগলো রাষ্ট্র। সদ্যমুক্ত মানুষের পুনর্বাসন হিসেবে 'পুনর্গঠন প্রক্রিয়া' (Reconstruction)-এর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা টিঁকেছিল মাত্র বছর পাঁচেক। সমাজের সুবিধাভোগী মানুষ তাদের এত দিনের অভ্যাস সহজে ছেড়ে দিতে নারাজ, তাই ভাগচাষ (share cropping), Jim Crow[৪]-এর মধ্যে দিয়ে মূলস্রোত সমাজ ধরে রাখল ‘উঁচুনীচু’-র ব্যবস্থাকে। সমাজের সমস্ত সম্পদ সাদা মানুষের জন্য, আর উচ্ছিষ্টটুকু রইল পড়ে সদ্যমুক্ত আফ্রো-আমেরিকান গোষ্ঠীর জন্য। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী উদ্বৃত্ত শ্রমকে জেলে পাঠানোর মধ্যে দিয়েই মূলস্রোত সমাজ, রাষ্ট্র খুঁজেছিল তার সামাজিক, অর্থনৈতিক সমাধান।
আজও মূল প্রক্রিয়ার বিশেষ তারতম্য ঘটেনি। গত কয়েক দশক ধরে জেল সংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে এ দেশের শ্রমিকের জীবন/ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আশীর দশকের বুশ-রেগন জমানা থেকে, অর্থাত্ অর্থনৈতিক উদারনীতির একেবারে গোড়ায় শ্রমিক সংগঠনগুলির ওপর রাষ্ট্রের কড়াকড়ি শুরু হল। শ্রমনীতি ইত্যাদিকে উড়িয়ে দিয়ে, ব্যবসাক্ষেত্রে সমস্ত প্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে করপোরেটগুলি লুটেপুটে নিতে শুরু করল সমাজটাকে। অবাধ লাভের জন্য সমস্ত বড় বড় শিল্পগুলি সরে যেতে লাগলো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলিতে, যেখানে মানুষের শ্রমের দাম নগণ্য। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আফ্রো-আমেরিকান শ্রমিক। এই বিপন্ন শ্রমিকদের ক্ষোভ, রোষ ইত্যাদি মোকাবিলার মোক্ষম উপায় হয়ে দাঁড়াল আবার সেই কয়েদখানা। একজন আমেরিকান শ্রমিক যিনি একসময় যে কাজের জন্য ঘণ্টা-প্রতি আট ডলার রোজগার করতেন সেই কাজ থাইল্যাণ্ডে সরে গেল, কারণ একই শ্রমের মজুরি সেখানে ঘণ্টা-প্রতি দু ডলার। অসহায়, মরিয়া বেকার শ্রমিক মাদক কিংবা অন্য কোনও বেআইনি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লে তাকে ঠেলে দেওয়া হল জেলে। জেলের ভেতরে বন্দী অবস্থায় তার শ্রমের মূল্য দাঁড়াল ঘণ্টা-প্রতি মাত্র ২২ সেন্ট। ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে বন্দী-শ্রম সোনার খনি (Evans, L. )। শ্রমিকের প্রতি কোনও দায় নেই, সংগঠন-ভুক্ত নয় বলে শ্রমিকদের দিক থেকে কোনও দাবিদাওয়া নেই। নিশ্চিন্ত, অবাধ শোষণ। জেল প্রতিষ্ঠান যেন এক ম্যাজিসিয়নের ভূমিকা পালন করতে শুরু করল: বেকারত্ব, আশ্রয়হীনতা, মাদকে নেশা, অশিক্ষা—এই সব দারিদ্র্যজাত সমস্যাকে অনায়াসে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলে। আবার, খাঁচার মধ্যে বন্দী এই অসংখ্য মানুষ—তাদের কোনও রকমে টিঁকিয়ে রাখার জন্যও তো চাই কিছু ‘পরিষেবা’—এই সুযোগে জেলগুলিই হয়ে দাঁড়াল বিশাল লাভজনক ব্যবসা। বলাই বাহুল্য, গোটা অপরাধ দমনের জন্য আইনী ব্যবস্থা (penal system)-ও গড়ে উঠতে লাগলো তারই সঙ্গে তাল মিলিয়ে করপোরেট মালিকদের চাহিদা মিটিয়ে—এমন সব আইনের প্রচলন হতে লাগলো যার প্রয়োগে জেল ভর্তি রাখার জন্য 'অপরাধী'-র অভাব না ঘটে। একটি বিশেষ সমীক্ষার তথ্য অনুয়ায়ী এক একজন বন্দীর জন্য বছরে করপোরেট লাভ $৩0,000 থেকে $৪0,000( Chris Hedges)। আশির দশক থেকে জেলখানাগুলিতে করপোরেট বিনিয়োগ শুরু হয়। কয়েদখানাগুলি Correction Corporation of America (CCA) এবং GEO-দুটি বিরাট বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের বিশাল মুনাফার উত্স ($৭0 বিলিয়ন) হয়ে দাঁড়ায়। আটচল্লিশটি রাজ্যের কাছে এই করপোরেট মালিকেরা প্রস্তাব করে যে জেলগুলি পরিচালনার যাবতীয় খরচ এবং দায়িত্ব এই প্রাইভেট সংস্থাগুলি বহন করবে। তবে কিছু শর্তে--জেল প্রতি অন্তত: ১০০০টি 'শয্যা'রাখতে হবে, এবং তার ৯0% পূর্ণ থাকা চাই। বলাই বাহুল্য, এই শর্ত পূরণ করার জন্য চাই 'অপরাধীর' নিরবচ্ছিন্ন স্রোত। অর্থাত্, এমন আইনী ব্যবস্থা চাই যা এই স্রোতকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে। বিভিন্ন রাজ্যগুলি তাদের অর্থাভাবের সুরাহা হিসেবে কয়েদখানাগুলির দায়িত্ব এই করপোরেটগুলির ওপর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। Federal Bureau of Prison-এর সমীক্ষা অনুয়ায়ী জেলগুলি ভরে রয়েছে মূলত সামান্য ‘ড্রাগ চার্জ’-এ জড়িত দরিদ্রতম মানুষ, ভয়ানক হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত অপরাধীর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে নগণ্য । গণতন্ত্রের দাবী আইনের চোখে সকলেই সমান—'উঁচু-নীচুর' নাকি কোনও পার্থক্য নেই। অথচ, একই অপরাধে, আফ্রো-আমেরিকান নাগরিককে অনেক বেশি শাস্তি ভোগ করতে হয় সাদা নাগরিকের তুলনায়। তথাকথিত 'ড্রাগ-ওয়ার'-এর কথাই ধরা যাক। বাজারে সাধারণত: দুই প্রকারের কোকেন বিক্রি হয়—পাউডার কোকেন আর ক্র্যাক কোকেন। মাত্র ৫ গ্রাম ক্র্যাক কোকেন-এর জন্য ৫ বছরের কারাবাস। আর পাউডার কোকেন-এর ক্ষেত্রে সেই একই শাস্তি হয় অন্তত: ৫00 গ্রাম পাওয়া গেলে। এই পার্থক্যের কারণ ক্র্যাক কোকেন সস্তা বলে আফ্রো-আমেরিকান অঞ্চলে এর প্রচলন বেশি। এই প্রসঙ্গে, অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালের একটি বিশেষ আইনী উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন-এর ১৯৯৪ সালের 'অপরাধ আইন' (Violent Crime Control and Law Enforcement Act of 1994)। ইনি সেই ক্লিন্টন নিজেকে যিনি আফ্রো-আমেরিকান সমাজ-সংস্কৃতি-প্রেমী হিসেবে দাবী করে থাকেন। এই আইনের ফলে কম করে মাত্র কয়েক বছরে এক মিলিয়ন, অর্থাৎ দশ লক্ষ মানুষকে জেলে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল (Hedges)। এমন কী মৃত্যুদণ্ডের পরিধি বিস্তৃত হয়েছিল মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের ক্ষেত্রেও। অথচ নানা সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে কড়া পুলিসি এবং শাস্তির ব্যবস্থা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কখনোই তেমন কার্যকরী হয়নি। আর একটি বিশেষ সমীক্ষায় দেখা গেছে নিউ ইয়র্ক স্টেট-এ ৭0% বন্দী মাত্র আটটি বিশেষ অঞ্চলের বাসিন্দা—যে অঞ্চলগুলি তলিয়ে রয়েছে চূড়ান্ত দারিদ্রে।
সামান্য আশার কথা এই যে আজ প্রেসিডেন্ট ক্লিটনকে তাঁর দূরদৃষ্টির অভাব প্রকাশ্যে স্বীকার করতে হচ্ছে। এমন কী ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট পদে অন্যতম প্রতিযোগী তাঁর স্ত্রী হিলারি ক্লিটন-এর কাছে আবেদন এই যে নির্বাচিত হলে তিনি যেন তাঁর স্বামীর সেদিনের ভুল শুধরে নেন। শ্রীমতী ক্লিন্টন-এর মুখেও ইদানিং 'mass incarceration'-এর বিরুদ্ধে লড়াই-এর প্রতিশ্রুতির কথা শোনা যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে এ সবই ঘটছে 'ফার্গুসন’, ‘বাল্টিমোর’-এর আন্দোলনের প্রেক্ষিতে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যখন আসন্ন।
অর্থনৈতিক ‘উদারনীতি’-র প্রসারে আমেরিকার মাটি থেকে উৎপাদন-শিল্পগুলি (manufacturing unit) সরে গেছে/যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বে, আর তার জায়গায় শহরে, গ্রামেগঞ্জে গড়ে উঠছে প্রকাণ্ড বন্দী-আবাস যেগুলো সেই সব অঞ্চলের বাসিন্দাদের রুজি-রোজগারের মূল উত্স (অনেকসময় একমাত্র)। বাড়িগুলি নির্মাণ, তার রক্ষণাবেক্ষন, ভেতরের সুরক্ষা নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন নতুন টেকনোলজি ইত্যাদিকে ঘিরে ব্যবসা জমে উঠছে। 'আমেরিকান এক্সপ্রেস' 'জেনারাল ইলেকট্রিক'-এর মত কোম্পানি টেনেসি আর ওকলাহোমা রাজ্যের কয়েদখানা গড়ার কাজে অর্থ নিয়োগ করছে। এমন কী বড়ো বড়ো টেলিফোন কোম্পানিগুলিও মুনাফা লুটছে, বন্দীদের ক্ষেত্রে ‘ফোন কল’-এর দাম বাড়িয়ে[৫]। কোন কোনও জেলের মধ্যে কেমিকাল তৈরির কারিখানা, রিসাইক্লিং কারখানা, গাড়ি সারাবার দোকান ইত্যাদিও আছে। বন্দীশ্রমে তৈরি হচ্ছে গাড়ির লাইসেন্স প্লেট। ম্যাকডোনাল্ড-এর মত কোম্পানি যাবতীয় কাঁচা মাংস সংক্রান্ত কাজের জন্য বন্দী-শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। এদিকে বন্দীদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিষয়টির ব্যাপারে জেল কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত অবহেলার খবর সাংবাদিকরা প্রায়ই জানাচ্ছেন। পুষ্টিকর খাদ্য তো দূরের কথা অপরিষ্কার পানীয় জলের থেকে কিডনির অসুখ, এমন কী ক্যান্সারের মত কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। ইদানিং সরকারের অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাতে টুথপেস্ট ইত্যাদির মত সামান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যও বন্দীদের কিনতে হচ্ছে জেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। নানা অজুহাতে জরিমানার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছে বন্দীদের পরিবারগুলি। এর ওপর আছে শারীরিক-মানসিক নিগ্রহ। আর তাই, প্রিজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স-এর মত বিশাল ‘করপোরেট’ (প্রায় $৫০০ বিলিয়ন)-এর বিরুদ্ধে একটাই অস্ত্র বন্দী-শ্রমিকদের সামনে খোলা: ধর্মঘট, অর্থাত্ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসহযোগ। গত ২০১৪তে আলাবামার একটি জেল থেকে শুরু হয়েছে এই অসহযোগ আন্দোলন। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য রাজ্যের জেলগুলিতেও। ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যারিজোনা, ইলিনয়, ওহাইও, টেক্সাস ইত্যাদিতেও এই প্রতিবাদ সংগঠনের কাজ এগিয়ে চলেছে। এক সাংবাদিক সাক্ষাতকারে আলাবামা-র 'ফ্রি আলাবামা মুভমেন্ট'-এর নেতারা জানিয়েছেন যে রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে ফল পাওয়ার আশা তাঁরা করেন না, কারণ সকলেই জানেন এই রাষ্ট্রচালকরা, এমন কী রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি নিজে আফ্রো-আমেরিকান, তিনিও পুরোপুরি করপোরেট আমেরিকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (Chris Hedges)। আন্দোলনকারীরা আজ আর কোনও সংস্কারের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাসী নন, তাঁরা ডাক দিয়েছেন এই অচলায়তনগুলি একেবারে ভেঙে ফেলার। বন্দীদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন এঞ্জেলা ডেভিস (Angela Davis), কর্নেল ওয়েস্ট (Cornel West)-এর মতো বেশকিছু বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী।
এই লাগামছাড়া লোভের রাজত্বে শিশুদেরও রেহাই নেই। গরীব অঞ্চলের স্কুলগুলিতে শিক্ষকের চেয়ে পুলিশের আনাগোনা বেশি। অর্থের অভাবে ধুঁকছে স্কুলগুলি। সামান্যতম অজুহাতে পাঁচ বছরের শিশুকেও হাতকড়া পরিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে। কোনও কোনও স্কুল কর্তৃপক্ষ পুলিশি ব্যবস্থার উপর ছেড়ে দিয়েছেন স্কুলচালনা। সশস্ত্র পুলিশ যেকোনো শিশুকে হেনস্থা করতে, এমন কী গ্রেপ্তার করতে পারে বিনা বাধায়। বার্মিংহাম (আলাবামা)-র মত কিছু কিছু জায়গার হাইস্কুলগুলিতে স্থায়ীভাবে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। 'The school-to-prison pipeline'--শব্দবন্ধটি তাই কোনও অত্যুক্তি নয়, প্রত্যেকদিনের বাস্তব।
আন্তর্জাতিক করপোরেটগুলির কাছে কেবল আমেরিকাই নয়, গোটা পৃথিবীটাই তো আজ এক অবিচ্ছিন্ন বাজার। প্রাকৃতিক সম্পদ যত খুশি লুটেপুটে নাও। সাধারণ মানুষ 'consumer' মাত্র। আর্থিক মুনাফাই শেষ কথা। এই চূড়ান্ত ভোগের স্রোতে যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াবে তার বিনাশ একান্ত কাম্য। আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি এ-হেন দর্শনের ফল কী দাঁড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ তছনছ হয়ে যাচ্ছে, সীমিত কিছু গোষ্ঠীর প্রাচুর্য বৃদ্ধি পেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চরম দারিদ্র্য। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে আদিবাসী এবং প্রান্তিক মানুষ তাদের জমি হারাচ্ছে। দিশেহারা মানুষ নানা ‘বেআইনী’ কাজে লিপ্ত হয়ে জেলে যাচ্ছে। তাই মনে হয়, আমেরিকার প্রিজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স আসলে বিশ্ব-জোড়া (আমেরিকা, স্পেন, গ্রীস থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ) এক বিশাল ফাঁদের সামান্য অংশ মাত্র। আর, বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে যে 'রক্তকরবী'-পালা আজ চলেছে আমরা সবাই সেখানে ‘৬৯-ঙ’ কিংবা ‘৪৭-ফ’।*
[১] http://www.social-sciences-and-humanities.com/PDF/The-End-of-History-and-the-Last-Man-.pdf
[২] http://www.theguardian.com/us-news/2015/jun/01/black-americans-killed-by-police-analysis
[৩] Michelle Alexander: “New Jim crow: Mass Incarceration in the Age of Colorblindness”, The New Press
[৪] Share Cropping: সাধারণ অর্থে “ভাগচাষ”, অর্থাত্ যখন জমির মালিক চাষীকে জমির কিছু অংশ চাষের জন্য ধার দেয়/দিত উত্পাদিত ফসলের একাংশের পরিবর্তে। সাধারণত: এই ব্যবস্থায় চাষীকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়/হতো উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই রোজগারের অন্য কোনও উপায় না থাকায় চাষীকে এই জমির কাজে বাঁধা পড়ে থাকতে হয়/হতো। আমেরিকার দক্ষিণে ‘গৃহযুদ্ধের” পরবর্তী অধ্যায়ে তুলো, ধান, তামাক ইত্যাদির plantation-গুলোর মালিক এই “ভাগচাষ”-এর মধ্যে দিয়ে সদ্য-মুক্ত আফ্রো-আমেরিকান মানুষের শ্রমের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। জমি ছাড়াও চাষের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, সার, এমন কী চাষে-পরিবারগুলির জন্য খাবার-দাবারও ধারে সরবরাহ করতো। ফসল তোলার সময় দেখা যেত বিশাল “ঋণ” চাষীর ঘাড়ে চেপে বসেছে, যে ‘ঋণ’ সারা বছরের শ্রম দিয়েও মেটানো সম্ভব নয়। এর উপর আইনী ব্যবস্থা এমন ছিল যাতে চাষী প্রয়োজনে তার ফসলের ভাগটুকু না বিক্রি করতে পারে।
The Jim Crow laws: “গৃহযুদ্ধের” পরবর্তী কালে “দাসপ্রথার” আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির পর “পুনর্গঠন” প্রক্রিয়ার ফলে সদ্যোমুক্ত আফ্রো-আমেরিকান মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ঠেকানোর জন্য মূলস্রোত সমাজের উদ্যোগে মূলত: “দক্ষিণে” প্রচলিত হয় Jim Crow আইন, এক ধরনের casteism—‘সাদা’’-‘কালো’ সমাজের মাঝে একটা ‘আইনী’ ‘দেয়াল’। সমস্ত ‘public’ জায়গায় ‘সাদা’-‘কালো’-র আলাদা ব্যবস্থা—এইভাবে “separate but equl’ স্লোগানের অজুহাতে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সম্পদের সুযোগ থেকে আফ্রো-আমেরিকান সমাজকে বঞ্চিত করার ‘আইনগত’ ব্যবস্থা’। এই নিয়ম সব থেকে স্পষ্ট ছিল শিক্ষা এবং আবাসন ব্যবস্থায়। ষাটের দশকের ‘সিভিল রাইটস’-এর মধ্যে দিয়ে আইনগত ভাবে এই ‘দ্বি-জাতিপ্রথা’-র অবসান ঘটে।
[৫] http://www.bastardarchive.org/books/Goldberg_and_Evans-Prison_Industrial_Complex-150dpi-read.pdf
মূলত: যে সব বই এবং সাংবাদিক আলেখ্য এই রচনাটি লিখতে সাহায্য করেছে:
১. Alexander, Michell. New Jim Crow: Mass Incarceration in the Age of Colorblindness; New Press, 2010
২. Davis, Angela Y. The Meaning of Freedom: And Other Difficult Dialogues; City Lights, 2012
৩. Evans, Linda and Goldberg, Eve. The Prison Industrial Complex and the Global Economy; Kersepledeb Pub., 1998
৪. Hedges, Chris. The Business of Mass Incarceration; truthdig.com, posted on July 28, 2013
৫. Hedges, Chris. America’s Slave Empire; truthdig.com, posted on June 21, 2015
(পরবাস-৬০, অগস্ট ২০১৫)