Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে চম্পক সৌরভের
লেখা


ISSN 1563-8685




ছদ্মনাম

নিল মিত্র একজন জনপ্রিয় সাহিত্যিক। তিনি ছোটদের, বিশেষ করে কিশোরদের জন্য রহস্য-রোমাঞ্চ, ভূতের গল্প ও রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প লেখেন। প্রতি বছর পুজোর সময় এবং বইমেলায় তাঁর বই প্রকাশিত হয়। তিনমাসের মধ্যেই একটা সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। সেই জন্যই প্রকাশকদের কাছেও অনিলবাবুর বই ছাপার চাহিদা আছে।

অনিলবাবু ইদানিং খেয়াল করছেন, তাঁর বই-এর সংস্করণ কাটতে এক বছর লেগে যাচ্ছে। প্রকাশকরাও আর নতুন বইয়ের জন্যে তাগাদা দিচ্ছে না। অবশ্য তিনি বই প্রকাশের জন্যে দিলে তা ফিরিয়েও দিচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে অনিল বাবুর বইগুলো এখন ধারে কাটছে না, ভারে কাটছে। তাই তিনি তাঁর আগের লেখা আর হালের লেখা কয়েকটা বই পড়ে দেখলেন। তিনি নিজেই বুঝলেন, কাহিনিগুলো প্রায় সবই এক ধরনের হয়ে গেছে। পাঠকদের কাছে তাই চাহিদা কমে গেছে, শুধু তাঁর নামের জোরে বিক্রী হচ্ছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য তিনি তাঁর দুই প্রকাশকের সাথে কথা বললেন। তাঁরাও বললেন, পাঠকরা আগের বই-এর থেকে নতুন বইয়ে কোনো পার্থক্য পাচ্ছে না। নতুন বই পড়লে মনে হচ্ছে পুরানো বই-ই পড়ছে। প্রকাশকরা বললেন, ‘অনিলবাবু, আপনি কিছু নতুন ধরনের গল্প লিখুন, তাহলে বইয়ের কাটতি আবার আগের মতই হবে। আপনার তো বাজারে নাম আছে।’

অনিলবাবুর মনে প্রকাশকদের কথাগুলো ঘোরাফেরা করছিল। ভাবলেন, নতুন ধরনের গল্প লেখার চেষ্টা করতে হবে। অনিলবাবু লেখা ছাড়া আর কিছু করেন না। তাই লেখার জন্যে তাঁর অনেক সময়। তিনি একা মানুষ। বাড়ির কাজকর্ম সবকিছু করার জন্য একজন লোক আছে। তাই, বাড়ির কাজের ঝামেলা তাঁকে পোয়াতে হয় না, লেখালেখি করার অনেক সময়। প্রতিদিন কাগজ কলম নিয়ে বসছেন, কিন্তু কোনো প্লট আর মাথায় গজাচ্ছে না, লেখাও এগোচ্ছে না। মাঝে মধ্যেই চোখ বন্ধ করে ভাবেন—‘আমার লেখার ক্ষমতা কি ফুরিয়ে গেল? আমার লেখার ভাবনা কি হারিয়ে গেল? আর কি আমি নতুন ধরনের গল্প লিখতে পারবো না?’ রোজই কাগজ-কলম নিয়ে বসেন, কিন্তু লেখা আর হয় না। ক্রমে ক্রমে হতাশা অনিলবাবুকে গ্রাস করল। তাঁর আর লিখতে ইচ্ছা করে না। বাইরে বেড়াতে যান না, বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটান, এমনকি খবরের কাগজও পড়েন না, টিভিও দেখেন না। শুয়ে শুয়ে ভাবেন, ‘আমি কি সত্যিই ফুরিয়ে গেছি?’ রোজ রাতে শুতে যাবার আগে ভাবেন, আজ রাতে স্বপ্নে নিশ্চয় নতুন দারুণ গল্পের প্লট পাবো। কিন্তু ইদানিং স্বপ্নও দেখেন না।

এবারই প্রথম পুজোয় অনিলবাবুর লেখা কোনো বই প্রকাশিত হল না। সুনীল গুহ অনিলবাবুর প্রথম প্রকাশক এবং এখনও বই প্রকাশ করেন। সুনীলবাবুর মনে হল এবার তো অনিলবাবুর কোনো বই বেরোলো না, আর গত ছয়মাস ধরে অনিলবাবুকে দেখা যায়নি। এমনকি আগের বেরনো বইগুলোর কোনো হিসাবনিকেষ করতেও আসেন না। অনিলবাবুর কি শরীর খারাপ? বইমেলা তো আর কদিন পরেই, এখন থেকে যদি পাণ্ডুলিপি না পাওয়া যায়, তবে বইমেলায় বই প্রকাশ হবে কি করে? সুনীলবাবু ভাবলেন, একবার অনিলবাবুকে ফোনে তাগাদা দেবেন। কিন্তু অনিলবাবুর বাড়িতে বেশ কয়েকবার ফোন করেও অনিলবাবুকে পাওয়া গেল না। মানে, তাঁর ফোন কেউ ধরল না। সুনীলবাবু খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন; অনিলবাবুর কি হল?

পরের দিন বিকেলে সুনীলবাবু অনিলবাবুর বাড়িতে গেলেন দেখা করতে। বেল্‌ বাজাতে কাজের লোক দরজা খুলে দিল। সুনীলবাবু বললেন, ‘অনিলবাবু বাড়িতে আছেন?’

‘হ্যাঁ আছেন।’ লোকটি সুনীলবাবুকে চিনত, বেশ কয়েকবার এবাড়িতে দেখেছে। বলল, ‘আসুন, বসুন; বাবু শুয়ে আছে, আমি বাবুকে ডেকে দিচ্ছি।’ সুনীলবাবু বললেন, ‘না-না বাবুকে ঘুম থেকে তুলতে হবে না।’ লোকটি বলল, ‘না, উনি ঘুমাচ্ছেন না। উনি এখন রোজই এমনই শুয়ে থাকেন। কোথাও বেরোন না। রোজই ডাকাডাকি করে উঠিয়ে স্নান করাতে হয় এবং অনেক বলে খাওয়াতে হয়। আপনি এসেছেন জানলে হয়ত উনি উঠে আসবেন, তাহলে ভালোই হবে।’

কিছুক্ষণ পরে অনিলবাবু এলেন। সুনীলবাবু এ কোন অনিলবাবুকে দেখলেন! যে অনিলবাবু সবসময়ই ফিটফাট থাকেন, ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরেন, নিখুঁতভাবে দাড়ি-গোঁফ কামানো, চকচকে মুখ, হাসি-হাসি চেহারা, আজ সেই অনিলবাবুর আধময়লা জামা-কাপড়, বেশ কয়েকদিনের না-কামানো দাড়ি-গোঁফ, অবিন্যস্ত চুল, ক্লান্ত চোখের কোণে কালি-পড়া মুখ, সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত চেহারা।

সুনীলবাবু বললেন, ‘আপনি অসুস্থ?’ উত্তরে অনিলবাবু বললেন, ‘না। তবে, এখন আর কিছুই ভালো লাগে না। লিখতে চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। কোনো কিছুতেই উৎসাহ পাই না। মাথায় গল্পের প্লটই আসে না, মনে হয়, আমি আর কোনোদিনই গল্প লিখতে পারবো না। আমি বোধ হয় ফুরিয়ে গেছি।’

সুনীলবাবু বললেন, ‘না-না আপনি ফুরিয়ে যাবেন কেন? মনে হয়, এই পরিবেশটা আপনার ভাল লাগছে না। আমার মতে, কোনো একটা সুন্দর শান্ত পরিবেশে গেলে আপনার মনটা ভালো হয়ে যাবে, আনন্দে ভরে যাবে। আর আপনার লেখাও খুলে যাবে।’

অনিলবাবু হেসে বললেন, ‘কোথায় পাবো ওরকম একটা শান্ত সুন্দর ভালো লাগার পরিবেশ?’

সুনীলবাবু বললেন, ‘আমার এক আত্মীয়র গ্রামের বাড়িটা নদীর ধারে ছোটো-খাটো জঙ্গলের পাশে শান্ত-নির্জন পরিবেশে। এখনও পর্যন্ত ঐখানে শহরের দূষিত আবহাওয়া ঢোকেনি। বাড়িটা বেশ নির্জনে। আশেপাশে কোন বসতি নেই। আপনি কয়েকদিন ঐখানে থেকেই দেখুন না? না ভালো লাগলে চলে আসবেন। আমাদের আত্মীয়রা ঐ বাড়িতে থাকে না, কোলকাতায় থাকে। দেখাশোনার জন্য একজন লোক আছে, সেই আপনাকে রান্না-বান্না করে দেবে। আপনার কোনো অসুবিধে হবে না।’

কয়েকদিন পরে সুনীলবাবু এসে বললেন, ‘বাড়ির মালিকের চিঠি নিয়ে এসেছি। আমিও আপনার সাথে যাব, আপনাকে ওখানে রেখে আসবো। আগামী কালই আমরা বেরবো। আপনি তৈরি থাকবেন। আমি গাড়ি নিয়ে কাল সকাল আটটায় চলে আসবো।’

পরের দিন আটটার সময় সুনীলবাবুর সঙ্গে অনিলবাবু যাত্রা শুরু করলেন। কোলকাতা ছেড়ে বর্ধমান পেরনোর পরে অনিলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমরা যাচ্ছি কোথায়?’ উত্তরে সুনীলবাবু বললেন, ‘জায়গাটার নাম জামগ্রাম। বর্ধমান জেলার শেষে ঝাড়খণ্ড বর্ডারে অজয়নদীর ধারে ছোট-খাটো শাল জঙ্গলের ধারে। পৌঁছতে আমাদের বিকেল হয়ে যাবে। আমরা রানিগঞ্জে দুপুরের খাবার খেয়ে নেবো। আর সঙ্গে কয়েকদিনের রেশনপত্র ও সব্জি তরকারি আছে, অসুবিধা হবে না। বাকি জিনিস ওখানে পাওয়া যাবে। চা-কফি, যেগুলো ওখানে পাওয়া যাবে না সেগুলো নিয়ে নিয়েছি।’

পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। ওঁদের গাড়ি পাঁচিলে ঘেরা একটা কম্পাউন্ড-এর গেটে হর্ন দিতে লাগল। খানিকক্ষণ পরে একজন প্রায় বৃদ্ধ ব্যক্তি ধীরে-ধীরে এসে গেট খুলে দিলেন। গাড়িটা ভিতরে ঢুকতেই সুনীলবাবু লোকটিকে ডেকে বললেন, ‘আমরা কোলকাতা থেকে আসছি, এই তোমার বাবুর চিঠি। আমরা এখানে কয়েকদিন থাকব।’ লোকটি বলল, ‘আমি তো আউট হাউসে থাকি, আপনারা বাংলোর ভেতরের বাবুর ঘরের চাবিটা এনেছেন তো? ওটা বাবু বন্ধ করেই যান। বাকি বাড়িটা আমিই দেখাশোনা করি।’ সুনীলবাবু চাবি দিয়ে অনিলবাবুকে দেখিয়ে বললেন, ‘উনি এখানে কিছুদিন থাকবেন। তোমাকে ওর জন্য রান্না-বান্না; চা-জলখাবার সব কিছু করে দিতে হবে। তুমি পারবে তো?’ তারপরেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কি?’

লোকটি বলল, ‘আমার নাম ভীম মণ্ডল। মোটামুটি রান্না-বান্না করে দিতে পারবো।’

শীতকাল--তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়ে গেল। পাঁচিলে ঘেরা জায়গাটা অনেকটা বড়। তার মাঝখানে বাংলবাড়িটা। চারিদিকে বাগানঘেরা পাঁচিলের ধারে ধারে অনেক বড় বড় গাছ। সেইজন্যে সন্ধে হতে না-হতেই জায়গা বেশ অন্ধকার হয়ে গেল। এখানে বিদ্যুৎ নেই, হ্যারিকেনের আলোতেই সব কাজ হয়। সুনীলবাবু বললেন, ‘রাতে এখানে বোধহয় লেখা-পড়া করা যাবে না হ্যারিকেনের আলোয়। তবে দিনের আলোতে কোন অসুবিধে হবে না।’ তারপরেই বললেন, ‘এর ধারেকাছে ১০-১৫ কি.মি-র মধ্যে মোবাইল ফোনের কোনো টাওয়ার নেই তাই ফোন কাজ করবে না। রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে ওঁরা একটু গল্প করলেন। অনিলবাবুর জায়গাটা সম্বন্ধে কৌতূহল রইল, ‘মনে হচ্ছে জায়গাটা ভালোই লাগবে। এরকম জায়গাতে কোনোদিন থাকিনি।’

পরের দিন বেশ সকালে অনিলবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি সুনীলবাবুকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, ‘চলুন চারপাশটাটা ঘুরে দেখি। দরজা খুলে ঘর থেকে বেরোতেই দেখলেন ভীম মণ্ডল চায়ের কাপ আর কেটলি নিয়ে ওদের দিকে আসছেন। ‘আপনার উঠে পড়েছেন, চা রেডি, বারান্দায় টেবিলে চায়ের কাপ আর কেটলি দিয়ে দিচ্ছি।’ চা খেতে-খেতে সূর্যোদয় দেখে অনিলবাবু বেশ উচ্ছ্বসিত। সুনীলবাবু বললেন, ‘তাহলে মনে হচ্ছে জায়গাটা আপনার ভালোই লাগবে। সূর্যোদয় কেন, বাড়ি থেকে সূর্যাস্তও দেখতে পাবেন। শুধু সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত কেন, এছাড়া নদী-জঙ্গল সবই দেখতে ভালো লাগবে। সত্যি জায়গাটা খুব সুন্দর। আমি কিন্তু একটু পরেই কোলকাতার জন্যে বেরবো। আর কোনো যোগাযোগ করা যাবে না। আমি একমাস পরে আসবো আপনার খবর নিতে।’


সুনীলবাবু চলে যাবার পর এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। অনিলবাবুর জায়গাটা ভালো লেগে গেছে। সকাল-বিকাল উনি চারিদিকে ঘুরে বেড়ান। ভীম মণ্ডলের রান্নাও বেশ ভালো। দূরের সাঁওতাল গ্রাম থেকে ভীম মণ্ডল ডিম-মুরগী কিনে আনে। খাওয়া-দাওয়া মোটামুটি ভালই হয়। ভীম মণ্ডল বাগানে সব্জীও ফলায়। চার-পাঁচ কি.মি. দূরে কোলিয়ারি বাজারে বাকি প্রয়োজনীয় জিনিসও পাওয়া যায়, তাই সেরকম কোনো অসুবিধা হয় না। জঙ্গলের পাশে নদীর ধারে বসে সূর্য ডুবতে দেখতে ভালই লাগে। ধীরে ধীরে তাঁর মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কয়েকদিন পর হঠাৎই লেখার খাতা ও কলম নিয়ে লেখার চেষ্টা করেন। অনেকক্ষণ বসে থেকে আঁকিবুঁকি কাটলেও ঠিক লেখার মত কোনো প্লট মাথায় এলো না। ভাবলেন, ঠিক আছে পরে চেষ্টা করা যাবে।

একদিন একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক অনিলবাবুকে দেখে নমস্কার করে বলল, ‘আপনি ঐ বাংলো বাড়িটাতে এসেছেন? কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি আপনি বারান্দায় বসে কিছু লেখালেখি করেন। আপনি নিশ্চয় লেখক? অনিলবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি লিখি। এখানে এসে আমি লিখতে চেষ্টা করছি; ঠিক লিখতে পারছি না। মনে কোনো লেখার ভাবনাই আসছে না।’

যুবকটি বলল, ‘বছর পাঁচেক আগে আপনার মত একজন লেখক ঐ বাড়িতে এসেছিলেন। তিনিও অনেক লেখালেখি করতেন ঐ বারান্দায় বসে। তারপর একদিন আমাকে ডেকে বললেন, লেখার খাতাগুলো যে ঘরে উনি থাকেন, সে ঘরের টেবিল-এর ড্রয়ারে রেখে গেছেন। তিনি কয়েকদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছেন। কিন্তু, তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি।’

কথায়-কথায় ভীম বলল, ‘পাঁচ বছর আগে আপনার মত এক বাবু এসেছিলেন, কি সব লেখালেখি করতেন। তারপর একদিন তাঁর সব জিনিসপত্র রেখে বাবু চলে গেলেন আর ফিরে আসেননি।’ এই কথা শুনেই অনিলবাবুর সেই যুবকটির বলা লেখার খাতার কথা মনে পড়ল। তিনি টেবিলের ড্রয়ারগুলো দেখতে দেখতে নিচের ড্রয়ারে বেশ কয়েকটা খাতা দেখলেন, সঙ্গে একটা ডায়রি। উনি কৌতূহলবশত ডায়রিটাই হাতে নিয়ে দেখতে লাগলেন। ডায়রি ২০০০ সালের। ১ জানুয়ারির পাতাতেই শুধু লেখা আছে, বাকিটা সব ফাঁকা। ১লা জানুয়ারির পাতায় লেখা আছে—‘আজকেও আর একটা লেখা ফেরত এল। আমি প্রায় একশোটা গল্প-কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পাঠিয়েছি এবং প্রত্যেকটাই ফেরত এসেছে। আমার লেখা কি এতই খারাপ? কিন্তু বন্ধু-বান্ধব এমন কি মাস্টারমশাইরাও আমার লেখার প্রশংসা করতেন। স্কুল কলেজের ম্যাগাজিনে আমার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হত। এবং সকলে ভালও বলত। কিন্তু কোনো পত্রিকার সম্পাদকই আমার লেখা মনোনীত করেন না। আমার জীবনের একটা ইচ্ছা ছিল, কোনো পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হোক, অনেক পাঠক পড়ুক। ভালো বলতে হবে বলছি না। তবু কোনো পত্রিকায় নিজের লেখা ছাপা দেখতে এবং পড়তে পারলে মনের ইচ্ছাটা পূর্ণ হবে। কিন্তু সে ইচ্ছা আর পূর্ণ হবে না। আমি আর কোনোদিনই লিখবো না। তবুও লেখার খাতাগুলো এই ডায়রির সাথে রেখে গেলাম। যিনি এই খাতাগুলো পাবেন, তাঁকে আমি এই লেখাগুলো পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি। মনের একটা অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে চলে যাচ্ছি। কিন্তু মনে হচ্ছে একবারও ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখতে পেলাম না।’

অনিলবাবু ডায়রি বন্ধ করে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন। ডায়রিটা উল্টে-পাল্টে দেখলেন; লেখকের কোন নাম খুঁজে পেলেন না। নিজের মনেই বললেন, ‘আমিও তো এখন লিখতে পারছি না, জানি না আর কোনোদিন লিখতে পারবো কিনা।’ অনিলবাবু অদেখা সেই লেখকের মনের বেদনাটা মর্মে-মর্মে বুঝলেন। মনটা তাঁর দু:খে হাহাকার করে উঠল।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরে তিনি খাতাগুলো পড়তে শুরু করলেন। খাতার সব কটা গল্প যখন পড়ে শেষ করলেন, তখন সন্ধে নেমে গেছে। ভীম এসে বলল, ‘বাবু অন্ধকার হয়ে গেল। এই নিন, আপনার চা নিয়ে এসেছি।’

চা খেতে-খেতে অনিলবাবু খাতায় লেখা গল্পগুলোর কথা ভাবতে লাগলেন। প্রত্যেকটা গল্পের লেখার প্লট, বাঁধুনি ও ভাষা তাঁর তো খুব উচ্চশ্রেণীরই লাগল। তবুও এইসব লেখা পত্রিকায় ছাপা হল না কেন? রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পরে বিছানায় শুয়েও ঐ লেখার কথা ভাবতে লাগলেন। ঘুম আসছে না। এত ভালো লেখাও কোনো সম্পাদকের কেন পছন্দ হল না? কেন তাঁরা লেখাগুলো ছাপলেন না?

হঠাৎ তাঁর মনে আলোর এক ঝলকানি এল; ভাবলেন, এই গল্পগুলোই যদি আমি ব্যবহার করি, তাহলে কেমন হয়? লেখকের নাম তো কোথাও লেখা নেই। সকালবেলা চা-খেয়ে খাতাটা আবার পড়তে শুরু করলেন। শেষ খাতার অনেক পাতা সাদা ছিল। শেষ পাতায় দেখলেন লেখা আছে, ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখতে না পাওয়ার অতৃপ্তি নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি।’

                                           পরান মণ্ডল

অনিলবাবু শেষ লেখার পাতাটা বারবার পড়লেন, মনে মনে বললেন, ‘অবাক কাণ্ড! কালকে তো খাতাটা উল্টে-পাল্টে অনেকবার দেখলাম, এই পাতাটাতো দেখতে পাইনি!’ ঠিক করলেন, এক কাজে দু-কাজ করতে হবে।

দিন সাতেক পরে সুনীলবাবু এলেন। অনিলবাবুকে দেখে বললেন, ‘আরে আপনাকে তো উজ্জ্বল ঝকঝকে লাগছে। মনে হচ্ছে বেশ কিছু লেখা ইতিমধ্যে বেরিয়েছে আপনার কলম থেকে।’

অনিলবাবু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ কিছু একটা হয়েছে।’ দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পরে তিনি সুনীলবাবুকে লেখার খাতাগুলো দিলেন।

পরদিন সকালবেলা সুনীলবাবু অভিভূত হয়ে বললেন, ‘আপনার এত ভালো লেখা আমি আগে পড়িনি। প্রথম খাতার সাতটা গল্প নিয়ে একটা বই করে আগামী বইমেলায় বার করব। আপনি বইটার নাম ঠিক করে দিন এক্ষুণি।

অনিলবাবু বললেন, ‘বইটার নাম হবে ‘পরানের শেষ ইচ্ছা।’ — আর লেখকের নাম পরা্ন মণ্ডল।’

সুনীলবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি কি আর অনিল মিত্র নামে লিখবেন না?’ অনিলবাবু বললেন, ‘না। আমি এবার থেকে পরান মণ্ডল নামেই লিখব।’

সুনীলবাবু বললেন, ‘এটাই কি হবে আপনার ছদ্মনাম?’

অনিলবাবু চুপ করে রইলেন। আশা করছেন, পরান মণ্ডলের আত্মা এবার শান্তি পাবে।



(পরবাস-৬১, ডিসেম্বর ২০১৫)