আলোলিকা অ্যাপার্টমেন্টসের একতলায় কেয়ার টেকারের ঘরে এখনো একটা বুড়োটে রঙের টিমটিমে আলো জ্বলছে। দোতলার স্বর্ণেন্দু ঘোষ বারান্দার বাতি নেভাতে ভুলে গেছেন। এছাড়া অন্যান্য সব বারান্দার কাপড় শুকোনো দড়ি আর জানালার পর্দা টাঙানো ধাতব লাঠি থেকে ঝুলছে কালচে রাত দেড়টা। ঘুম-বাড়ির রাত পোষাক। ইউনিফর্ম, যা দিনের বেলা থাকে না। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, ভারতবর্ষের মতো ... যা থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে, কিন্তু আছে বলে মনে করতে শেখানো হয়। আছে বলে মনে করতে বেশ লাগে। এই কারণেই অন্ধকার প্রয়োজন। সাম্য, ঐক্য, ইত্যাদি স্বপ্ন নিয়ে চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক দিনমানকে ঘুম পাড়াতে আসে রাত। একটু দূর থেকে দেখলে, অজস্র জনবিচ্ছিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত খাঁচায় ভরপুর এই বহুতল পাড়া, রাত দেড়টায় প্রায় কম্যুন।
অবশ্য কাছ থেকে দেখলে প্রকট হয় কালোর হাজার শেড, সহস্র এক বিবর্ণতা। বস্তুত প্রতিটি শেড বর্ণমালার অন্যান্য রঙের মতোই একা ... বিচ্ছিন্ন, আপাতভাবে পরস্পর মিশে থাকে যদিও। সেইসব বিচ্ছিন্নতায় ফুটে ওঠে অন্ধকারের বহুবর্ণ ছবি। সেইসব ছবির হায়ারোগ্লিফিকে লেখা থাকে রাতের গল্পমালা। যেমন এখন চারতলার তিন নম্বর ব্যালকনির দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি জুম-ইন করলে দেখা যাবে সাত ফুট বাই সাড়ে তিন ফুট জায়গাটা ফাঁকা নয়। বাঁদিকের কোণ ঘেঁষে রেলিঙে ভর দিয়ে অন্ধকারের ফ্রেমে আরেক পোঁচ বেশী রাত্তির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির এক সিল্যুয়েট। প্রশ্ন না করেও ধরে নেওয়া যেতে পারে, ঐ সিল্যুয়েটের ওজন আটান্ন কেজি এবং নাম তনিমা মিত্র, যেহতু ঐ ব্যালকনি এবং সংলগ্ন ঘরগুলো সেই নামেই নথিভুক্ত আছে পুরসভার খাতায়। ধরে নেওয়ারা সচরাচর রাত্রিকালীন দেখার মতোই আবছা, ভ্রান্তি-সম্ভাবনাময়। কিন্তু দেখতে পাওয়ারাও কিছু কম ঠকবাজ নয়, এমনকি দিনের আলোয়। সুতরাং ঐ মানবাকৃতি অন্ধকারটুকুকে স্কাইগ্লোব ইনফোটেকের সিনিয়র পি আর ম্যানেজার ভাবার মধ্যে বিশেষ কোনো মূর্খামি নেই।
দৃশ্যপটে এক বিন্দু লাল আলোর উপস্থিতি লক্ষণীয়, যা আলো হিসেবে অন্য কিছু দেখতে সাহায্য না করলেও ঐ বারান্দার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। আলোটা মাঝে মাঝে বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, আবার ঝিমিয়ে পড়ছে। কাছে গেলে দেখা যাবে আলোটা জ্বলছে তনিমার ঠোঁট থেকে ইঞ্চি দেড়েক দূরে, কিন্তু দূরত্ব বজায় রাখতে পারছে না। জ্বলতে জ্বলতে ক্রমশ এগিয়ে আসছে ঠোঁট লক্ষ করে চুম্বনেচ্ছু জোনাকির মতো। কী আশ্চর্যভাবে সন্নিধি আর মন্তাজ ভেদে বদলে যায় টুকরো ছবির মানে! বদলে যায় অনুভূতি-কল্পনা-উপমা! রাতের বারান্দায় একক তন্বীর দিকে আগুয়ান অগ্নিকণাকে দেখে মনে হল জোনাকি আর চুম্বনের কথা। অথচ ঠিক একইরকম রাতে এখান থেকে মাত্র তিনশ’ মিটার দূরে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে ঠোঁট আর আগুনের নৈকট্য মানেই মুখাগ্নি। সেখানে শুয়ে থাকে যে সব ঠোঁট, চুম্বন থেকে তাদের দূরত্ব অসীম। কিন্তু সোহাগের বেডরুম থেকে বৈদ্যুতিক চুল্লির দূরত্ব কতটুকু? তিনশ’ মিটার? দুশ’ মিটার? একশ’ মিটার? নাকি তাও না?
আগুনকে কাছে নিতে নিতে ... বুক ভরে ধোঁয়া নিতে নিতে তনিমা ভাবছিল দৈনন্দিন শয়নকক্ষ থেকে অন্তিম শয়নকক্ষের দূরত্ব কতটুকু? তবু মানুষ কেবল আজকের ঘুমটুকুর কথা ভেবেই শুতে যায়। কেবল ফুলশয্যাটুকুর কথা ভেবে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। অন্তিম শুয়ে থাকাতেও ফুল থাকে। তবু তা ফুলশয্যা হয়ে উঠতে পারে না, সঙ্গীহীনতায়। পিঁড়ি ঘোরানোর চার জোয়ানের মতোই সেদিনও থাকে মজবুত চারটি কাঁধ। সেদিনও আগুন থাকে, এমনকি ঘৃত-চন্দন। কিন্তু মন্তাজ বদলে যেতেই বদলে যায় সিনেমার গল্প। এই পরিবর্তন, অবশ্যম্ভাবী জেনেও মানুষ দেখতে পায় না আগে থেকে। সবাই তো সের্গেই আইজেনস্টাইন নয়। তারা খুব বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ে টুকরো টুকরো ছবিগুলোর ডিটেল নিয়ে। তাই তাদের যাপিত মুহূর্তমালাকে সাজিয়ে জীবন নির্মাণ করে যে মন্তাজ, তা হয় নিম্নমানের। তার শব্দ, বর্ণ, সঙ্গীত হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ... স্বাধিকারপ্রমত্ত, কিন্তু নিতান্ত ব্যর্থ। তারা একত্র হয়ে বুনতে পারে না কোনো কাহিনী বা মালা। বদলে গেঁথে তোলে দেওয়াল ... অজস্র দেওয়াল নিজের সবদিকে। এইসব দেওয়াল সর্বস্ব অ্যাপার্টমেন্ট হাউস থেকে লোহার দেওয়ালওয়ালা মানুষ পোড়ানো আগুনের দূরত্ব কতটুকু?
ঘন্টা পাঁচেক আগে অনিন্দ্যকে পুড়িয়ে ফেলার জরুরি কাজটা শেষ হয়েছে। তনিমা সেখানে ছিল না, কিন্তু খোঁজ নিয়েছিল। খোঁজ নিতে হয়েছিল, কারণ টিটো সেখানে ছিল। “শেষ হল? জলে নামিস না। না, নদীতে চান করার কোনো প্রয়োজন নেই।” ফোনে ফের বলতে হয়েছিল এসব কথা, যদিও আগে থেকে সাবধান করা ছিল। তনিমা চায়নি টিটো যাক, কিন্তু আটকাতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। টিটো বড় হচ্ছে। মায়ের মাথা ছাড়িয়ে উঠছে ক্রমশ। চোদ্দ হতে চলল। ইদানিং তনিমার সঙ্গেই থাকছিল ছেলে। আগেকার ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেছে। টিটো মাকে ভালবাসে আবার অনেক ছোটবেলার মতো। কিন্তু বাবাকেও ভালবাসে এখনো। সেই ভালবাসা ধীরে ধীরে মরে যেত হয়ত। মায়া কাটানোর জন্যে জোর করেনি তনিমা, কিন্তু মায়ের সাথে থাকতে থাকতে একটু একটু করে সত্যের একটা অন্য ভাষ্য সে জানছিল, শিখছিল। ক্রমশ সেটা আত্মীকৃত হত আর ভেতর থেকে সরিয়ে দিত বাবাকে।
আসলে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা বলে তো কিছু হয় না। এমনকি মহাভারতের আদি সাংবাদিক সঞ্জয়ও তা পারেনি। খবর আসলে স্টোরি। সত্য একধরনের গল্প, যা একান্তভাবেই ভাষ্যের উপর নির্ভরশীল। সেই কারণেই প্রত্যেক রাজার বা রাজগোষ্ঠীর থাকে নিজস্ব সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, মাইনে করা বুদ্ধিজীবী, কবি ও পত্রকার। এই শব্দের বাজারে নৈঃশব্দের স্থান নেই। বিলুপ্তি ভাষ্যহীনের ভবিতব্য। অনিন্দ্য ছিল নীরব মানব। তার সম্ভবত কোনো ভাষ্য ছিল না নিজের তরফে। থাকলেও সে কখনো তা রাখতে পারেনি স্ত্রী বা পুত্রের কাছে। বস্তুত তার ভাষা ছিল কিনা, তা নিয়েই সংশয়। শুধুমাত্র উপস্থিতি আর নৈকট্য অবলম্বন করে সে ছেলের জীবনে খানিকটা টিঁকে ছিল, যখন তনিমা মৃণালের সাথে থাকতে আরম্ভ করল আর বাধ্য হয়ে টিটোকে বাপের সাথে থাকার জন্য ছেড়ে দিল। গত বছরখানেক ধরে সেই স্থানিক সুবিধাও তার হাতছাড়া। মৃণালের পাপড়ি ঝরে গেছে; টিটো ফিরে গেছে মায়ের কাছে। ভাষা আর ভাষ্যহীন অনিন্দ্য সেই ফিরে যাবার দিনেও নির্বাক যুগের চলচ্চিত্রে পড়ে ছিল। শব্দের ব্যবহার রপ্ত করতে পারেনি। এমনকি স্পর্শ, মুখভঙ্গি, চোখ বা শরীরের ভাষা, পোষাক বা তিন দিনের না-কাটা দাড়ির ট্র্যাজিক ব্যঞ্জনা ... কোনোকিছুর ব্যবহারেই তার কোনো দক্ষতা ছিল না। সুতরাং অবধারিতভাবে সে মুছে যেত। তার জন্যে প্রয়োজন ছিল খানিকটা সময়। সেটা সে দিল না। অনিন্দ্য ছিল গণিতের ছাত্র। ভাষাহীন এবং ক্যালকুলেটিভ। সময়ের গণনায় নির্ভুল থেকে শেষ অব্দি মোক্ষম চালটা সে দিল। সম্পূর্ণ মুছে যাবার আগেই মরে গিয়ে অগ্নিশুদ্ধির প্রাকমুহূর্তে সে ছেলের দখল নিল। ম্যাচ শেষ। নিঃশব্দ বাবার মুছে যাওয়া যতটা সহজ এবং স্বাভাবিক, মৃত বাবাকে মুছে দেওয়া ঠিক ততটাই কঠিন।
অনিন্দ্যর মৃত্যুটা তনিমাও মেনে নিতে পারেনি। লোকটা মরে যাওয়ায় অনেক দিক থেকে তার সুবিধেই হল, কিন্তু ঠিক এভাবে সে চায়নি। লোকটা অত্যন্ত কপট। বলা চলে ছিঁচকে। চোরের মতো খেলাটা জিতল আবার। বার বার এইভাবে শঠতার আশ্রয় নিয়ে তনিমাকে ন্যায্য জয় থেকে বঞ্চিত করেছে সে।
বিয়ের পর প্রথম কিছুদিন কথা বলত অনিন্দ্য। পুরুষেরা যেমন পৃথিবীর সব বিষয়ে মতামত দিয়ে স্ত্রীকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে, সেইরকম। কিন্তু যেহেতু অঙ্ক ছাড়া প্রায় কিছুই সে জানত না এবং তনিমা ছিল তুলনায় অনেক বেশী মেধাবী এবং বাগ্মী, তাই সেসব বক্তব্যের প্রত্যুত্তর সাধারণত “তুমি থামো তো” দিয়ে শুরু হয়ে বিদগ্ধ মতামতে শেষ হত। প্রতিদিনই অনিন্দ্য নিজের অজস্র ভুল চিনতে পারত আর শেখার সুযোগ পেত অনেক কিছু। বস্তুত নিজের ঘরেই সে পেয়ে গিয়েছিল একটি অবৈতনিক স্কুল। কিন্তু সে কিছু শিখতে পারছিল বলে মনে হয়নি কখনো। সম্ভবত গণিত ছাড়া আর কোনো বিষয়ে তার মাথা ছিল না। অবশ্য খুব কম পুরুষই বিদূষী স্ত্রীর কাছ থেকে কিছু শিখতে পারে। অহং বড় বালাই। স্ত্রী নামক আয়নায় নিজের মুখটা সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখতে চায় মানুষ। ছবিটা তেমন না হলে যে মেকআপ শিল্পী, ক্যামেরাম্যান আর আলোর ছেলেটার যৌথ ষড়যন্ত্রই তার জন্য দায়ী, সে বিষয়ে কোন বুদ্ধিমান পুরুষের মনে সংশয় থাকতে পারে? বেশিরভাগ স্বামী এইসব পরাজয়ের মুহূর্তে হম্বি-তম্বি শুরু করে, কিন্তু তার জন্য চাই বাচিক দক্ষতা অথবা যথেষ্ট আওয়াজ করার ক্ষমতা। ধ্বনি ও শব্দ প্রয়োগের চূড়ান্ত অদক্ষতা লুকোতে অনিন্দ্য হয়ে গেল নীরব। তনিমার বক্তব্য, প্রশ্ন, উত্তেজনা, চিৎকার, কান্না ... সবকিছুর উত্তরে সে শব্দহীন মুহূর্তমালা প্রয়োগ করতে শুরু করল। এমন ভয়াবহ আর দীর্ঘ নীরবতা কখনো কর্মবাচ্যে হতে পারে না। এই নৈঃশব্দ এক সচেতন, সচেষ্ট প্রয়োগ; এক নিষ্ঠুর উচ্চারণ। তারস্বরের চেয়েও তীব্র আর কর্কশ। তনিমা বলত, “সাইলেন্ট শাউটস”। এই নীরবতার পাঁচিলে বাধা পেয়ে তনিমার কথা বলার ক্ষেত্র ক্রমশ ছোট হয়ে এল। অথচ ভাষাই ছিল তার আশ্রয়, অবলম্বন, অস্ত্র। ছোটবেলা থেকে কথা আঁকড়ে সে বেঁচে থেকেছে। অনিন্দ্য, যাকে সে একেবারে ব্যক্তিগত এক আগ্রহী শ্রোতা হিসেবে চেয়েছিল, ক্রমশ এক নিরবয়ব নৈঃশব্দের মধ্যে হারিয়ে গেল। অথচ আদর্শ শ্রোতা তো নীরবেই শোনে! কিন্তু তার নীরবতার মধ্যে ভাষা থাকে ... আগ্রহী ধৈর্যের ভাষা। মৃদু তার গুঞ্জন। থান ইটের মতো কথার বুকে চেপে বসে না সেই চুপ করে থাকা।
ভাষার জগতের যে বাসিন্দা, তার কাছে শব্দহীনতা অন্ধকারের মতো। যেখানে কথা নেই, সেখানে সে দেখতে পায় না চোখে ... হোঁচট খায় পদে পদে। তনিমা মুখ থুবড়ে পড়ল। নিতান্ত বাঁচার তাগিদে খুঁজতে লাগল বিকল্প শ্রোতা, বিকল্প পানীয় এবং নিকোটিন।
যদিও একসময় অনিন্দ্যর প্রজ্ঞাহীন, প্রায় অর্থহীন বকবকানিতে তার মাথা ধরে যেত, চরমে উঠত বিরক্তি, তবু সেই দৈনন্দিন খেলার মধ্যে নেশা ছিল। সেটা তনিমা টের পেল অনিন্দ্য চুপ করে যাবার পর, যখন বিকল্প নেশার জন্য আকুতি তীব্রতর হল। তখন কর্মজগতে সদ্যজাত তনিমা মিত্রর কেদারাটি আরামের ছিল না। সারাদিন কর্পোরেট চড়াই-উৎরাই, পতনের ভয়, শারীরিক মানসিক ক্লান্তির পর ঐ গৃহযুদ্ধটুকুতে রোজ এক তরফা জেতা ছিল তার অ্যাম্ব্রোসিয়া। ঐ শ্লাঘাটুকু পান করে সে ঘুমোতে যেত। যে একেবারে চুপ থাকে, তাকে তর্কে হারানো যায় না। তনিমার প্রয়োজন ছিল এমন একজনকে, যে কথা বলতে শুরু করবে, তর্ক করতে চাইবে, কিন্তু পেরে উঠবে না। যাকে থামিয়ে দেওয়া যাবে, ভুল প্রমাণ করা যাবে। তারপর শুধরে দেওয়া যাবে সেইসব অনন্ত ভুল। এই বৌদ্ধিক আধিপত্যটুকু তার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই খেলাটুকুর মধ্যে কি ভালবাসা ছিল না? মমতা ছিল না রোজকার সেই সংশোধনের চেষ্টায়? অনিন্দ্য কি পারত না আরেকটু আগ্রহী ছাত্র হয়ে তনিমার সেই একমাত্র খিদেটুকু মেটাতে?
এটুকু ছাড়া আর কী বা চেয়েছিল মেয়েটা? তেমন মেয়ে তনিমা নয়, টিঁকে থাকার জন্য যার স্বামী প্রয়োজন। বরং অনিন্দ্যর বেঁচে থাকার অনেকটা ছিল তনিমা-নির্ভর। তিনবার চাকরি খুইয়েছে সে, কিন্তু ভাতের অভাব হয়নি। সৌজন্যে স্ত্রী। এমনকি বাড়ির লোনের টাকা মেটানোর দায়িত্বে তনিমা। বস্তুত মানুষ, বিশেষত পুরুষ হিসেবে অনিন্দ্য ছিল অপদার্থ। স্কুল-কলেজের পরীক্ষার বাইরে সাফল্য শব্দটার সাথে তার কখনো দেখা হয়নি। সম্ভবত সেই কারণেই তনিমা তাকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করেছিল। সে ছিল পরাজিত পুরুষের রোলে আদর্শ অভিনেতা, যার মুখের কথা, চোখের দৃষ্টি, সবকিছুর গায়ে লেখা আছে “হেরে যাবার জন্যেই এর জন্ম”। এই ভূমিকায় তাকে আসলে চেষ্টা করে অভিনয় করতেই হত না, রোজ হেরে যাওয়া তার পক্ষে ছিল এতটাই স্বাভাবিক। এই পরাজয়টুকু মেনে নেবার মধ্যে কি সত্যি কোনো অপমান ছিল? হেরে যাবার পরেও কি প্রতি রাতে তনিমা তাকে ভালবাসা দেয়নি? তনিমার মতো করে পরাজিত স্বামীকে কে এমন ভালবেসেছে? শুধু সেই হেরো লোকটার জন্য রান্না অব্দি শিখেছিল সে।
তবু অনিন্দ্য পারল না। পুরুষেরা পারে না। তারা সহজে আহত হয় আর রেশম মথের অপরিণত লার্ভার মতো স্বরচিত গুটির মধ্যে শরীরে মনে লুকিয়ে পড়ে। সেই কোকুন ছেড়ে উড্ডীন বেরিয়ে আসার মন্ত্র তারা জানে না। ক্রমশ ব্যক্তিগত বাক্সের ভিতর দমবন্ধ হয়ে ফুরিয়ে যায়। তাদের আশেপাশে যারা থাকে, তাদের উপহার দেয় রেশমের বদলে মৃত আত্মার পূতিগন্ধ। সেই গন্ধে হাঁপিয়ে উঠল তনিমা। শেষে একদিন বলতে বাধ্য হল, “তিন-চার মাসের মধ্যে নিজের একটা বাসা খুঁজে নাও।” অনিন্দ্য সময় নিয়েছিল পাক্কা ছয় মাস। তাও একাধিক বার তাগাদা দিতে হয়েছিল। স্পষ্ট করে বলতে হয়েছিল, “ফ্ল্যাটটা আমার অনিন্দ্য।” তবু সে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। সম্ভবত মানতে পারছিল না। অভিমান সত্ত্বেও তনিমাতে সে অভ্যস্ত ছিল। অভ্যস্ত ছিল টিটোতে, এই বাসায়, মাছের ঝোলে, খড়কুটোতে। এসব ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ তনিমার কাছ থেকে আসতে পারে এবং সেই উচ্চারণ সহাস্য রসিকতা নয়, সেই উপলব্ধির কাছে যেতে তাকে অনেক পাহাড় ডিঙোতে হয়েছিল। শেষে একদিন সে মালপত্র গুছিয়ে নিল। টিটো তখন সাড়ে সাত। মৃণাল মুখুজ্জে তখনো সিঙ্গাপুর ছেড়ে কোলকাতা আসেনি।
শেষ পর্যন্ত অনিন্দ্য যেদিন আলোলিকা অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে গেল, সেই বিকেলটা তনিমা এখন সামনের অন্ধকার ফ্রেমে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বিকেলটাকে শুনতেও পাচ্ছে ঝিঁঝিপোকাহীন শহুরে মাঝরাতের স্তব্ধতায়। স্যান্ডাল উড এয়ার ফ্রেশনার আর স্পার্ক্স ডিও স্প্রের মিশ্র গন্ধটাও আসছে। বসার ঘরের জানালায় গাঢ় ম্যাজেন্টা কালারের ভারি পর্দা। ঘরের হাল্কা গোলাপী দেওয়ালগুলোকেও খানিক বেগুনী লাগছে। সোফার ওপরে এবং পাশে কয়েকটা ব্যাগ; অনিন্দ্যর। ব্যাগের মালিক অকারণে বার বার শোবার ঘর থেকে বসার ঘর যাতায়াত করছে, যেমন সে চিরকাল করে যে কোনো জায়গায় যাবার আগের মুহূর্তগুলোতে। পনেরো মিনিটের মধ্যে তিনবার টয়লেট ভ্রমণ। বাঁ হাতের কব্জিতে সেই কালো ডায়ালের টিসট ঘড়িটা। তনিমাই উপহার দিয়েছিল। বার কয়েক সময় দেখল। পৌনে চারটে, চারটে বাজতে এগারো, চারটে বাজতে নয় ... ইত্যাদি নানারকম সময় দেখাতে থাকে ঘড়িটা, অথবা স্রেফ একটা কালো ডায়াল, কিছু অবান্তর সংখ্যা আর লরেল-হার্ডির মতো অসমান দেহায়তনের দুই সঞ্চরমান কাঁটা। শুধু রোগা লম্বা কাঁটাটির স্থান পরিবর্তন ছাড়া বাকি পৃথিবী একটি কৃষ্ণকায় চাকতি আর তার সংখ্যামালা সমেত অপরিবর্তিত আছে ভেবে হয়ত খানিক আশ্বস্ত বোধ করছিল অনিন্দ্য। সচল সময় তার কাছে কোনো সময়েই মহামূল্য ছিল না। পরিবর্তনের গ্রাস থেকে বাঁচতে চাইত সে। সময় স্থির হলেই তার পক্ষে ভাল হত। কিন্তু তনিমা তাকে একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়ি উপহার দিতে পারেনি। তাই প্রতি মিনিটে একটা কাঁটা একটু একটু করে দক্ষিণাবর্তে চলেছে। অনিন্দ্য হয়ত সেই চলাটার সাথে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাইছে, অথবা সময়ের এগিয়ে যাওয়াকে যথাসম্ভব ছোট ছোট টুকরো করে দেখতে চেষ্টা করছে। এমন সময় ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়াল পুরোনো ধাতব শব্দ করে।
পাশের বাড়িতে হাজার ওয়াট মিউজিক সিস্টেমে ঘোর নাদে ডেথ মেটাল বাজছে অনেকক্ষণ ধরে, যা অনিন্দ্যর শব্দহীন চরিত্র আর তার বাড়ি ছেড়ে যাবার ম্রিয়মাণ দৃশ্যটির সাথে একেবারে বেমানান। শতকরা নব্বইজন পরিচালক এই দৃশ্যে এই আবহসঙ্গীত ব্যবহার করবেন না, তনিমার মনে হয়েছিল। সাহসী দু-দশজন এমন কাউন্টারপয়েন্ট অ্যারেঞ্জমেন্টের কথা ভাববেন আর তনিমার মতো কয়েকজনই মাত্র সেই সংঘাতের রসে আলতো চুমুক দিতে পারবে। কী আশ্চর্য, সেদিন ঐ পরিস্থিতিতেও দৃশ্য আর সঙ্গীত আলাদা ভাবে দেখে-শুনে ঠিক এসব কথা ভাবতে পেরেছিল তনিমা! ছাত্রজীবন থেকে সে এক আদর্শ সিনেফাইল। ওরকম দুরু-দুরু মুহূর্তে পঞ্চেন্দ্রিয়ের মঞ্চে এক বিপুল সম্ভাবনাময় মন্তাজের মধ্যে অনিন্দ্যকে এক সামান্য চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দেখতে তার খুব মজা লাগছিল। এমন এক অভিনেতা, যার অভিনয়ের আবেদন তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। ক্যামেরা-সাউন্ড-আলো-প্রেক্ষাপট-গন্ধ-উত্তাপ ... সবাই মিলে তাকে যেমন ভাবে উপস্থাপন করবে, তেমন ভাবেই সে উপস্থাপিত হবে। বাস্তবের এই মন্তাজ সিনেমার চেয়েও বেশী শক্তিশালী আর অভিনেতা হিসেবে অনিন্দ্য নিতান্তই দুর্বল। এতদিন পর সেই মুহূর্তগুলো ছুঁতে ছুঁতে তনিমার মনে পড়ল, সেদিন অনিন্দ্যকে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটির কাছে এভাবে পরাজিত হতে দেখে বেশ ভাল লেগেছিল তার।
তখন গীটারের সোলো বাজছে। সিম্ব্যালের দুটি বিটের মাঝখানে ট্যাক্সির আওয়াজের প্রথম টুকরোটা শোনা গেল, আর গুলিয়ে গেল সঙ্গীতের টাইম সিগনেচার। এই গুলিয়ে যাওয়া যে আসলে অনিন্দ্যর খেই হারানো সময়বোধের সাথে আবহসঙ্গীতকে কোথাও মিলিয়ে দিল, সেটা তনিমা খেয়াল করেনি। ঘড়্ঘড়্ শব্দের ধাতব ট্যাক্সি ক্রমশ মিশে গেল ধাতু-সঙ্গীতের শরীরে। তারপর আবার অপ্রতিহত সঙ্গীত। সুবল একেকবারে দুটো করে ব্যাগ নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটা ব্যাগ বাঁ কাঁধে আর একটা ডান হাতে নিয়ে অনিন্দ্যও দরজার দিকে পা বাড়াল। যেহেতু সে কাঁচা অভিনেতা, তাই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর পিছন ফিরে স্ত্রী বা ছেলের মুখের দিকে তাকাবার কথা তার মনে হল না। ফ্রিজ করে রাখার মতো একটা অন্তিম লুক পাওয়া না গেলেও দরজা অব্দি যাবার পথেই ক্যামেরা তাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধরেছিল। অনিন্দ্যর মুখের বাঁদিকটা বেশী কোমল, তনিমা অনেকবার খেয়াল করেছে। বাঁদিকের দেওয়ালের কাছে, যেখানে টিটো ছিল, সেখানে ক্যামেরা বসালে অনিন্দ্যর যে ছবি উঠত, তা গরমের ছুটি ফুরোনোর পর হস্টেলে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়া বালকের মতো। ডানদিক থেকে তনিমার মনে হয়েছিল লোকটি একজন অভিজাত কুলি, যে নিজেই ট্রেনে উঠে কোথাও যেতে চায়। পিছন দিকে অনেকটা দূর থেকে লং শটে তাকে দেখলে তীর্থযাত্রী মনে হতেই পারত। অভিযাত্রী ভাবা যেত না, কারণ তার মাথা ছিল ঈষৎ নোয়ানো, কাঁধ ছিল ঝুলে পড়া। বেখাপ্পা বাজনার আবহে, কোনো বিদায় সম্ভাষণ ছাড়াই অনিন্দ্য ফ্রেম আউট করে গেল। পার্শ্বচরিত্রের ক্ষেত্রে যেমন হয়, তার বেরিয়ে যাওয়ায় দৈনন্দিন কোনোকিছুই বিশেষ মোচড় খেল না।
ঋদ্ধ সিনেফাইল হওয়া সত্ত্বেও তনিমার ক্যামেরা সাজানোতে ভুল থেকে গেছিল। টিটোকে সেই সময় বাঁদিকে দাঁড়াতে দেওয়া উচিত হয়নি। তনিমা জানত বাঁদিক থেকে দেখা অনিন্দ্যকে, ডানদিকের অনিন্দ্যর মতো সহজে অবহেলা করা যায় না। তবু সময়কালে টিটোকে সরানোর কথা মনে থাকল না। ভুলটা সে বুঝেছিল অনেকদিন পর, যখন টিটো বাবার কাছে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে বলল, “মা আমাকে ভালবাসে না। বাবাকেও ভালবাসে না। বাবা কত মন খারাপ করে চলে গেছে!”
মৃণালের নিয়মিত আসা-যাওয়া, মায়ের মাঝে মাঝে রাতে বাড়ি না ফেরা টিটোর মনে খারাপ প্রভাব ফেলবে, এই ভয়ে তনিমা তখন ছেলেকে কার্সিয়াঙের নামি বোর্ডিঙে পাঠানোর আয়োজন করছে। সেই সময়ে হঠাৎ এই কথা। “হস্টেল যাব না। বাবার কাছে যাব।” সেই রাতে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গ্রহণমুক্ত পূর্ণিমা চাঁদের মতো পরিষ্কার হল ব্যাপারটা তনিমার কাছে। বাঁদিকের দেওয়াল ঘেঁষে থাকা ঐ অলক্ষিত ক্যামেরাটা! টিটোর চোখ। ওখান থেকে বাবাকে কুলি বা তীর্থযাত্রী মনে হয়নি, মনে হয়েছিল দশম বর্ষীয় বালক। ভরা গ্রীষ্মের ঠা-ঠা দুপুরবেলা বাবার গরমের ছুটি ফুরিয়ে গেল। আর বাড়ি থাকার জো নেই। মা এখন তাকে জোর করে হস্টেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ছেলে হয়ে যাওয়া বাবাকে পাঠিয়ে দিল একদিন, আর তার আড়াই বছর পর পাঠাতে চাইল বাবা হয়ে যাওয়া ছেলেকে। ভুল। ক্যামেরা সাজানোয় ভুল। আর তারই ফলে এই যুদ্ধটুকুও জেতা হল না। তৃতীয় শ্রেণীর অভিনেতা হয়েও স্রেফ দৃশ্যরচনার কারসাজিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ দর্শকের মমতা আর প্রশ্রয় পেয়ে গেল অনিন্দ্য।
শুধু টিটো নয়, নীরবতাকে হাতিয়ার করে দুই পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের এত সমবেদনা আদায় করেছিল অনিন্দ্য, যাকে সামলাতে ভাষা-যুক্তির ঢাল-তলোয়ার হাতেও ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে তনিমাকে। “মিটিয়ে নে না। ভাল তো ছেলেটা।” শুনতে শুনতে বমি আসত তনিমার। এক এক করে সবাইকে বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত সে একদিন সিদ্ধান্ত নিল দোর বন্ধ করে দেবার। আর কারো সাথে কথা নেই এ নিয়ে। কিন্তু টিটোর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করা যায় না, নিজের পাঁজর ভাঙবে। তখনকার মতো বাবার কাছে চলে যেতে দিতে হয়েছিল ছেলেকে। মৃণালের সাথে থাকার জন্য এই নিরিবিলিটুকু প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দুবছর না ঘুরতে সেই পদ্ম ছেড়েছে ভ্রমরী স্রেফ ছেলেকে ফিরে পাবার জন্য। মৃণালকে বিয়ে করার জন্য ততদিনে অনিন্দ্যর কাছে আইনি বিচ্ছেদ চেয়েছে তনিমা। লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। হঠাৎ মনে হল সেট যেভাবে সাজানো আছে, তার মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের দৃশ্যটা শুট করলে একটা বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। টিটো। টিটোর মায়ের পেট কেটে বেরোনো ছেলেটা শুধুমাত্র বাবার হয়ে যাবে। ছেলেকে ফিরে পাবার একান্ত আকুতি ছিল। তার চেয়েও বেশী জরুরি ছিল তাকে ছিনিয়ে নেওয়া বাপের কাছ থেকে। সেই তাগিদের ঝড়ে মৃণাল থেকে উড়ে গিয়ে শান-বাঁধানো পুকুর-পাড়ে আছড়ে পড়ল তনিমা। সেখান থেকে দেখল পদ্মটা কিছুক্ষণ পাপড়ি নাড়িয়ে কষ্ট জানাল খুব। তারপর স্থির হল, যাতে অন্য ভ্রমর এসে বসতে পারে। প্রকৃতির মূল কথা পরাগ মিলন। প্রেম নিমিত্ত মাত্র। ব্যক্তি ফুল আর ব্যক্তি ভোমরার পক্ষে পৃথিবীর ইতিহাস খুব বেশী বড় ... এত বড়, যে স্থান সংকুলান হয় না।
মৃণালকে ফিরিয়ে দেবার পরেও মাস দশেক লেগেছিল টিটোকে ফেরত পেতে। যেন আরো একবার গর্ভধারণ, সেই শিশুটিকে আরেকবার কোলে পাবার জন্য। প্রায় সেরকমই সংগ্রাম। ব্যথা। সহনশীলতা। শেষ পর্যন্ত ফিরে এল ছেলে। চাপা পড়ে যাওয়া বিচ্ছেদের প্রসঙ্গটা আবার তুলতে পারল তনিমা। মৃণালের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সন্দীপকে নিয়েও সংসার পাতার ভাবনা আসেনি মনে। অনিন্দ্য পর্বের আইনি সমাপ্তিতে কোনো প্রাপ্তি নেই সাধারণ অর্থে। তবু তনিমা তাড়া দেখাল। এটা একটা লড়াই। জেতা দরকার। অজস্র শুভানুধ্যায়ীর ক্রমাগত “মিটিয়ে নে না” লড়াইটাকে আরো প্রয়োজনীয় করে তুলেছে।
সেই জয় যখন বিন্দু থেকে ক্রমশ বড় হতে হতে স্ক্রিনের প্রায় আশি শতাংশ জুড়ে দেখা যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়, দৃশ্যটা শেষ হবার আগমুহূর্তে অনিন্দ্য “কাট” বলে স্টুডিয়ো ছেড়ে চলে গেল। “কাট” বলার অনিন্দ্য কে? সে কি পরিচালক? জীবনে যে কোনো দায়িত্ব নেয়নি, সে এভাবে অসময়ে প্যাক আপ করার সিদ্ধান্ত নেয় কী করে? লোকটা মরে যাওয়ায় অনেক সুবিধে হল। তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যে আর কাঠ-খড় পোড়াতে হবে না। শান্তি। তা সত্ত্বেও এভাবে চোট্টামি করে ম্যাচ বাঁচানোর জন্য লোকটাকে ক্ষমা করা যাচ্ছে না।
টিটো বাড়ি ফেরেনি। সে তার জেঠুর বাড়িতে থাকবে রাতে। তনিমা শ্মশানে যায়নি। মেয়েদের যেতে নেই জাতীয় কুসংস্কারের কারণে নয়। যেতে চায়নি এমনিতেই। গেলে হত। অনিন্দ্যকে কাঠের চিতায় পুড়িয়ে, তার জ্বলে ছাই হয়ে যাওয়াটা একটু একটু করে দেখতে পারলে ভাল হত। ঐ সময় লোকটা বাধা দিতে পারত না। এমনকি চুপ করে থেকেও কোনো শ্বাসরোধী নিস্তব্ধতার জন্ম দিতে পারত না, কারণ আগুন শব্দ করত ... কাঠগুলো ফাটত ফটাফট ... মড়ার মাথার খুলিটা ফাটত সশব্দে। সেইসব আওয়াজে, সেই আগুনের গনগনে আলোয়, অগুরুর গন্ধে, দাহের উত্তাপে যে ইন্দ্রিয়-সমন্বয়ী দুর্নিবার মন্তাজ তৈরী হত, তার মধ্যে তনিমার চোখের সামনে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে অপরিবর্তনীয় পরাজয়ে অভিষিক্ত হত অনিন্দ্য। সেই দৃশ্য দেখা হল না। জেতার শেষ সুযোগটাও হাতছাড়া।
এখন সিগারেটটাকেই হিংস্রভাবে টেনে যেন কাগজ আর তামাকে তৈরী অনিন্দ্যকে দাউ দাউ পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করছে তনিমা। তার বুক ভরে ধোঁয়া আসছে, যা আসলে অনিন্দ্যর পোড়া শরীর। মৃত্যুর পরেও বহুদিনের বেডরুমের পাশের বারান্দায় কুণ্ডলি পাকিয়ে অনিন্দ্য প্রবেশ করছে ক্রুদ্ধা স্ত্রীর শরীরে! এমনকি এভাবে মাঝরাতে পুড়িয়েও লোকটাকে হারানো যাচ্ছে না! ফুসফুসের ভেতর অনিন্দ্যকে টের পায় তনিমা। তাকে ঘিরে ধরে কাঠের চিতা পোড়া ধোঁয়া। চোখ জ্বালা করে ওঠে। রাত্রিব্যাপী ধোঁয়ার অন্দরে দাঁড়িয়ে তনিমা টের পায় মৃত লোকটির হাত থেকে রেহাই পাওয়া কখনোই তার উদ্দেশ্য ছিল না। একমাত্র আগ্রহ ছিল তাকে হারিয়ে দেবার। পরাজিত অবস্থাতেই তাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসা যেত। অনিন্দ্য তার সিনেমায় কোনোদিনই পার্শ্বচরিত্র ছিল না।
তারস্বরে বাঁশি বাজিয়ে চলে যায় রাত-প্রহরী। গলির ওপারে পূর্বাশা আবাসন। দুই বাড়ির মাঝখানে ঝুলছে অবলম্বনহীন বিশাল এক অন্ধকারের চাঙড়। সারারাত বাঁশি বাজিয়ে নাইট গার্ডের দল এইসব আঞ্চলিক অন্ধকার পাহারা দেয়। বাঁশিটা দূরবর্তী হতে হতে টুপ করে নিভে যেতেই, হঠাৎ করে অন্ধকারের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল মসিকৃষ্ণ নৈঃশব্দ। এই নিস্তব্ধতা অনিন্দ্যর মতো। এই আকস্মিক শূন্যতার মধ্যে সহসা নিজের চারপাশে অনিন্দ্যকে টের পেল তনিমা। ওপরের ঠোঁটটা ভেজা মনে হল। জিভ দিয়ে আলতো করে সেই জল ছুঁয়ে দেখল নোনতা। নিজের এই দুর্বলতায় ... এই নিতান্ত নিরিবিলি স্টুডিয়োর মধ্যেও একা একা হেরে যাওয়ায় লজ্জিত আর বিরক্ত বোধ করে তনিমা ঘরে গেল হান্ড্রেড পাইপারসের খোঁজে। বোতলটা উপুড় করে বেশ খানিকটা ঢেলে ফেলল গ্লাসে। জল মেশাতে গিয়েও মেশাল না। নাকের কাছে এনে শুঁকে দেখল ঘি-অগুরু-ধোঁয়া-আগুন মেশানো গন্ধ। মুখের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে সেই বিস্ময়কর তরলের দিকে সংশয়ে তাকিয়ে দেখল সেই তরলে ভাসছে একজোড়া ঠোঁট ... অনেকদিন আগের মতো ... পরাজিত আহত পুরুষের নিশ্চেষ্ট অথচ অপ্রতিরোধী ঠোঁট। ধীরে ধীরে গ্লাসটাকে কাছে নিয়ে সেই ভাসমান ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায় তনিমা।
(পরবাস-৬২, মার্চ - এপ্রিল, ২০১৬)