Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যর লেখা :

বই


ISSN 1563-8685




অন্য কোনখানে

দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

প্রচ্ছদ | ১ | ২ | ৩ | ৪ |

চতুর্থ অধ্যায়
খ্রিঃ ৩০০০৮





গুহার পশ্চিম দেয়ালে অতিকায় গজরাজের ছবির সামনে রুবন


|| ১ ||

পূষণদেব অস্তমিত হয়েছেন বেশ কিছুক্ষণ হল। এখন বসন্তের শুরু। তবু সন্ধ্যার বাতাসে হালকা ঠান্ডার স্পর্শ পাওয়া যায়। পায়ের নিচে প্রসারিত অরণ্যভূমির হরিতকৃষ্ণ পটভূমিতে সেই হাওয়ার ঢেউ তুলছিল। সুদূর দক্ষিণে বরুণদেবের বাসভূমি সেই বিস্তীর্ণ জলধির কথা মনে আনে তা।

আলিনা সেইদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে একটি গানের সুর ভাঁজছিল। কিছুদিন হল এই সুরটি তার মনের ভিতর ঘুরছে। এখনো তা পরিপূর্ণ রূপ নেয়নি। তাই এখনো সে তা রুবনকে শোনায়নি। কোনো নতুন সুর মাথায় এলে রুবনকে তা না শুনিয়ে থাকা তার পক্ষে কঠিন বটে কিন্তু তবু সে এইবার অপেক্ষা করে আছে, সুরের পূর্ণ রূপটি শুনিয়ে তাকে অবাক করে দেবে। অবাক হলে রুবনের চোখদুটি বড়ো সুন্দর হয়।

সুরটি ভাঁজতে ভাঁজতেই সে বারে বারে চকিত চোখে পিছনে দাঁড়ানো গুহাটির দিকে তাকাল। তার ভিতর থেকে একটি ক্ষীণ আলোকের আভাস আসছিল। রুবন ছবি আঁকছে। এখন তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও সে ফিরে তাকাবে না তার দিকে।

ঠিক এমন সময় একটি ম্লান আলো এসে স্পর্শ করল আলিনাকে। সামনের প্রস্তরপট্টে তার একটি হালকা ছায়া পড়েছে। সেইদিকে তাকিয়েই পেছনদিকে ঘুরে তাকাল আলিনা। রাত্রির দেবীগণ, ইরো ও তাঁর কন্যা ভালিয়া উদিত হয়েছেন অরণ্যের অন্যপ্রান্তে অবস্থিত জলধারাটির গা ঘেঁষে। দিকচক্রবালের অন্তরাল থেকে ঈষৎ কমলাবর্ণের বড়ো ও ছোটো গোলকদুটি দ্রুত উঠে আসছিল আকাশের গায়ে। তাদের একটি পূর্ণ ও একটি খণ্ডিত। সেইদিকে একনজর দেখে আলিনা আর নিজেকে আটকাতে পারল না। ধীরে ধীরে সে গুহাটির ভেতরে গিয়ে ঢুকল।

গুহার পশ্চিমের দেয়ালে একটি অতিকায় লোহিতবর্ণ গজরাজের ছবি ফুটে উঠেছে। তার সামনে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রুবন। তার এক হাতে পত্রপুটে লালবর্ণের প্রস্তরধূলির মণ্ড। অন্য হাতের আঙুলগুলি সেই বর্ণে রঞ্জিত। রঞ্জিত আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে চিত্রের গায়ে সূক্ষ্ম পেশিরেখাগুলিকে পরিস্ফূট করে তুলছিল সে।

আলিনা নিঃশব্দে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষার পরও রুবন কোনো সাড়া না দিতে নিরুপায় হয়ে সে পেছন থেকে দুটি নরম হাতে রুবনকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার ছবি এখন রেখে দাও রুবন। ইরো ও ভালিয়ার আলো এসেছে আকাশে। সকলেই চলে গেছে এতক্ষণে। তুমি আমার সঙ্গে যাবে না? আজ না আমাদের পরীক্ষার তিথি?”

অকস্মাৎ বাধা পেয়ে একটু চমকে উঠেছিল রুবন। আর তারপরেই ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রিয় কিশোরীটিকে দুহাতে নিজের দেহে জড়িয়ে নিল সে। তার অনাবৃত দেহ থেকে অরণ্যের স্নিগ্ধ সুবাস উঠছিল--


********

এই পাহাড়ের গায়ে কোনো পায়ে-চলা পথ নেই। পথের প্রয়োজনও নেই কোনো। বন্ধুর পাথরের দল মাথা বের করে আছে তার শরীরের চারপাশে। তাছাড়া পাথরের ফাঁকেফোকরে গাছপালা, বনজ লতার ভিড়। অভ্যস্ত হাতে সেই অবলম্বনগুলিকে ধরে ধরে দ্রুত নিচে নেমে আসছিল জুটিটি। চলার পথে মধ্যেমধ্যেই কোনো দ্বিতীয় গুহার মুখ দেখা যায়। সেইখানে পরিবারগুলির বয়স্ক ও শিশুরা সন্ধ্যা আসবার সঙ্গেসঙ্গে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। গুহার কেন্দ্রস্থলে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডগুলি তাদের জন্য বিনিদ্র প্রহরায় থাকে।

আজ বড়ো আনন্দের তিথি। আজ দেবী ইরোর এককপুর্ণিমা। অবশ্য কিছু দিন পরপরই দেবী ইরো বা দেবী ভালিয়ার পূর্ণিমা হয়। দৈবগণকরা তাঁদের গুহার প্রস্তরগাত্রে তার হিসাবও রেখে চলেন। কিন্তু সে-সব দিনে দুই দেবীই সারা রাত আকাশে থাকেন। আজকের তিথিটি একেবারেই সে-সবের চেয়ে আলাদা। আজ যৌবনের দেবী ইরোর পূর্ণিমা, এবং মধ্যরাত্রের কিছু আগে খণ্ডিতা দেবী ভালিয়া অস্তমিত হবেন। বাকি রাতটি দেবী ইরো একলা থাকবেন আকাশে। পুরুষানুক্রমে এই বসতির যুবকযুবতীরা তাই আজকের রাতটিতে একাকিনী দেবী ইরোকে সঙ্গ দেয়। বিবাহেচ্ছু যুবকযুবতীদের শক্তির পরীক্ষাও হয় এই রাতটিতে। এ সমাজে বিবাহ একটি বড়োই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানিং। যদিও শারীরিক তৃপ্তি ও সন্তান উৎপাদনে সকলেরই সম অধিকার কিন্তু সে সন্তানের লালনের অধিকার থাকে গোষ্ঠীপতির নির্ধারিত পালকদেরই হাতে। সন্তানের পালনভার যারা নিজেদের হাতে রাখতে চায় তাদের জন্য বিবাহবন্ধন একটি পূর্বশর্ত। সেক্ষেত্রে ইচ্ছুক যুবকযুবতীকে উপযুক্ততা অর্জন করতে হয় উপযুক্ত দৈহিক বল ও বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ রেখে।

আসন্ন সেই পরীক্ষার কথা মাথায় নিয়েই পথ চলছিল রুবন ও আলিনা। গোষ্ঠীপতি মেইকর ক্ষুরধার বুদ্ধিমান মানুষ। যে পরীক্ষাগুলি তিনি তৈরি করেন, একমাত্র চূড়ান্ত যোগ্যতা ছাড়া তাতে উত্তীর্ণ হওয়া প্রায় অসম্ভব।

অন্যমনস্কভাবে পথ চলতে চলতে খানিক বাদে পাহাড় থেকে অরণ্যে আচ্ছাদিত জমির ওপর নেমে এল তারা। মাথার ওপর ঘন পত্রমুকুটের ফাঁক দিয়ে উপগ্রহদুটির আলোর ক্ষীণতম রশ্মিটুকুও চোখে পড়ে না এখন আর। নিঃশব্দ অরণ্যে তাদের পায়ের নিচে শুকনো পাতার ভেঙে যাবার মৃদু শব্দ, আর মাঝে মাঝে কোনো বন্যজন্তুর দূরাগত ধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যায় না এইখানে।

আলিনা ভয় পেয়েছে একটু। রুবনের পেশল হাতটি শক্ত করে ধরে রেখেছিল সে। রুবন বুঝি বুঝতে পেরেছিল তার সঙ্গিনীর মনের কথাটি। পথ চলতে চলতেই সে বলল, “ভয় কী আলিনা। অরণ্যের দেবতা আমাদের রক্ষা করেন তা কি তুমি জানো না?”

“জানি। তবু—”

এই বলে যুবতীটি আরো ঘন হয়ে আসে তার সঙ্গীর দেহের কাছে। ভয়ের অন্তরালে শরীরের উষ্ণতাটুকু পেতে বড়ো ভালো লাগে তার।

অরণ্য শেষ হয়ে এসে বিস্তীর্ণ ঘাসবন। মাঝে মাঝে তার দু একটি বৃক্ষরাজ দাঁড়িয়ে ছায়া দিচ্ছেন। দেবী ভালিয়া ততক্ষণে অনেকটাই পশ্চিম দিগন্তের দিকে ঢলে পড়েছেন। দেবী ইরো উঠে এসেছেন প্রায় মধ্যগগনে। তাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত ঘাসবনের ওপারের নদীর জলধারায় দুই দেবির প্রতিফলিত আলোর রুপালি আভাস আসে।

চলতে চলতে হঠাৎ তাকে ঘিরে রাখা রুবনের হাতদুটি একটু কঠিন হয়ে উঠল। একটি বনস্পতির ছায়ায় চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। হাতের বাঁধনে আলিনাকে ধরে রেখে তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “সাবধান আলিনা—”

শব্দটা আলিনাও পেয়েছিল। শুকনো পাতার ওপরে বড়ো সাবধানী পদক্ষেপ। তাদের দুজনের অভিজ্ঞ কান শব্দটিকে চিনে নিতে ভুল করে না। এটি পশুরাজের পায়ের আওয়াজ। মানুষের মাংসে বড়ো লোভ তাঁর।

“দেবী ইরো সদয় হয়েছেন আলিনা। তিনি স্বয়ং আমাদের পরীক্ষা নেবার জন্য তাঁর বাহনকে পাঠিয়েছেন। নইলে আজকের রাত্রেই কেন—” বলতে বলতেই অভ্যস্ত যান্ত্রিকতায় কোমরে জড়িয়ে রাখা শক্তপোক্ত দড়িদুটি খুলে এনে হাতে নিয়েছিল তারা। তারপর রুবনের ইশারা পাওয়ামাত্র আলিনা ক্ষিপ্র পদক্ষেপে বৃক্ষটির পত্রমুকুটের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিল। গাছের নিচে একলা দাঁড়িয়ে রইল রুবন। হাতের দীর্ঘ দড়িটির একপ্রান্ত গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেড় দিয়ে তার অন্য মাথায় একটি ফাঁস তৈরি করে নিয়েছে সে।

পায়ের শব্দ তখন আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। খাদ্যের সন্ধান পেয়ে ক্ষিপ্রতর হয়ে উঠেছে ক্ষুধার্ত পশুরাজের পদপাত। একেবারে শান্ত হয়ে ফাঁসটি হাতে অপেক্ষা করছিল রুবন। একটুক্ষণ বাদেই কিছুদূরে ঘাসবনটি দুলে উঠল একবার। তারপর সেখান থেকে আকাশ ফাটানো গর্জন করে বাতাসে ভেসে উঠল বাঘটির ডোরাকাটা রাজকীয় শরীর। তার লক্ষ্য গাছের তলায় দাঁড়ানো রুবন।

কিন্তু ভাসমান পশুশরীরটি রুবনের গায়ের ওপর এসে পড়বার আগেই গাছটির পত্রমুকুটের আড়াল থেকে শক্তিশালী হাতে ছোড়া একটি দড়ির ফাঁস এসে নিখুঁত লক্ষ্যে তার গলায় জড়িয়ে গেছে। রুবনের ছোড়া ফাঁসটি গিয়ে জড়িয়ে ধরেছে তার একটি সামনে থাবাকে।

পত্রমুকুটের আড়াল থেকে ছোড়া ফাঁসের দড়িটি নিখুঁত মাপে বাঁধা ছিল গাছেরই একটি ডালে। পশুটি রুবনের পায়ের সামনে যখন আছড়ে পড়ল এসে তখন ফাঁসের দড়িটি একেবারে টানটান হয়ে আছে। তার কঠোর বন্ধনে পশুরাজের নড়াচড়া করবার উপায় না থাকলেও একেবারে দমবন্ধ হয়ে যায়নি তখনও। কিন্তু ছাড়াবার চেষ্টায় ছটফট করলেই একটু একটু করে তা কেটে বসছে তার গলাতে। সেইদিকে দেখে দ্রুতহাতে তার থাবায় বাঁধা দড়িটির অন্যপ্রান্ত গাছের সঙ্গে কষে বেঁধে ফেলল রুবন। তারপর ওপরের দিকে তাকিয়ে হাঁক দিল, “দড়ি ঢিলে করো আলিনা—”

গাছের ওপর থেকে নেমে আসা দড়িটা সঙ্গে সঙ্গে একটু ঢিলে হতে খানিক স্বস্তি পেল বুঝি পশুরাজ। রাগী চোখে রুবনের দিকে তাকিয়ে ফের একবার লাফাবার চেষ্টায় ছিল সে, কিন্তু রুবন তাকে সে সুযোগ দিল না। একটি বিরাট লাফে পশুরাজের পেছনদিকে গিয়ে পড়ল সে। তারপর দ্বিতীয় একটি ছোট্ট লাফে তার পিঠের ওপর সওয়ার হয়ে গলার ফাঁসটিকে ঘুরিয়ে ধরল হাতে।

এইবার শিকারী নিজেই বন্দি হয়েছে। এতটুকু ঔদ্ধত্ব বা গর্জনের চেষ্টা করলেই হাতের সামান্য চাপে ফাঁসটিকে শুধু একটু শক্ত করে ধরছিল রুবন। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই স্তিমিত হয়ে আসছিল পশুরাজের উগ্রতা। আলিনা ততক্ষণে গাছের ওপর থেকে একটি ডাল ধরে ঝুলে এসে রুবনের পেছনে তার কোমরটি জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছে। জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছিল তাদের স্বাস্থ্যবান, পেশিশোভিত দেহদুটি।

“একে মুক্ত করো আলিনা,” ফাঁসের দড়ি হাতে ধরে রেখে রুবন নির্দেশ দিল। কোমর থেকে এইবার ছুরিটি খুলে আনল আলিনা। তারপর নিখুঁত লক্ষে ছুঁড়ে দিল তার থাবাটিকে আটকে রাখা দড়িটার এইপ্রান্তের উদ্দেশ্যে।

ছাড়া পাওয়া পশুরাজ দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটে যাচ্ছিল সেই ঘাসের প্রান্তর ধরে। তার পিঠের ওপর দাঁড়ানো দীর্ঘদেহ মানুষটির হাতের দড়ির হিসেবি ছোটোছোটো টান তার গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল নদীতীরের উৎসবপ্রান্তরটির উদ্দেশ্যে।


********

“মাননীয় মহাপুরোহিত। বিবাহের অনুমতি পাবার আগে আমাদের শক্তি ও বুদ্ধির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। আমরা সেই পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক হয়েই আজ এই সভার পথে রওনা হয়েছিলাম। কিন্তু পথে, দেবী ইরো স্বয়ং আমাদের সেই পরীক্ষাটি নিয়েছেন। তাঁর বাহন পশুরাজ ইমা আজ আমাদের পথরোধ করেছিলেন। আমরা তাকে যুদ্ধে পরাস্ত করে বন্দি করে এনেছি। আমাদের প্রার্থনা, এই পশুরাজের সঙ্গে যুদ্ধজয়কেই আমাদের বিবাহের যোগ্যতা হিসাবে স্বীকার করা হোক।”

মেইকর তাঁর সামনে নতজানু যুবকযুবতীদুটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। এতক্ষণ ধরে তাদের যুদ্ধের কাহিনীটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনেছেন তিনি। দুজনের বক্তব্যের খুঁটিনাটি মিলিয়ে নিয়ে যাচাই করে নিয়েছেন বক্তব্যের সত্যতাও। সর্বোপরি দড়িতে বাঁধা ওই বিশাল পশুরাজই প্রমাণ হিসেবে সবচেয়ে প্রত্যক্ষ হয়ে রয়েছে তাঁর সামনে। রুবন তাঁর নিজের বিবাহের অনুমতি পাবার পূর্বেকার সময়ের সন্তান। বিধাতার লীলায় বিবাহিত জীবনে তাঁর আর কোনো সন্তানাদি হয়নি। এই পুত্রটির লালনপালনে তাঁর কোনো ভূমিকা কোনোদিন ছিল না। সমাজনির্দিষ্ট পালকদের হাতেই সে মানুষ। সে চিত্রকর। গুহার প্রস্তরপট্টে তার অসামান্য চিত্রকলা সকলের কাছে প্রশংসা পায়।

তবুও এতদিন মনের মধ্যে কোথাও একটা সূক্ষ্ম কাঁটা খচখচ করত তাঁর। তাঁর শাসনকাল শেষ হয়ে আসছে। দেহে বার্ধক্যের পদধ্বনি স্পষ্ট শুনতে পান তিনি আজকাল। তাঁর পরে গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ মানুষটিই তাঁর আসনটি পাবে। সে নির্বাচনও দেবর্ষী হবিষ্ট তাঁর হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। তবু, ন্যায়ত ধর্মত এক রূপসাধক চিত্রকরকে সে আসন ছেড়ে দেয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব হত। এবং সেই কারণেই রুবনের বীরত্বব্যাঞ্জক চেহারা এবং তার ও আলিনার আজকের এই অভাবিত কীর্তিটি তাঁর বুকের ভিতর একটি সূক্ষ্ম আনন্দের স্রোত বইয়ে চলেছিল। এদের বিবাহের অনুমতি দিতে আর কোনো বাধা নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে যে কীর্তি এরা স্থাপন করেছে ও যে পদ্ধতিতে তা সাধন করেছে তাতে গোষ্ঠীপতি হবার যোগ্যতা অর্জনের দিকেও অনেকটা এগিয়ে গেছে রুবন। তবু—আরো একটা পরীক্ষা বাকি আছে। তাঁর অভিষেকের দিন মহাগুরু হবিষ্টর বলা একটি কথা বারংবার তাঁর কানে বাজে, “কেবল শক্তি ও বুদ্ধি নয়, তার চেয়েও মহত্তর একটি গুণ প্রয়োজন হয় যে-কোনো শাসকের। সেই গুণটিই মানুষকে ঈশ্বরের প্রকৃত উত্তরাধিকারী বানায়—”

ধীরে ধীরে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মেইকর। দূরে, নদীর তীরে অগ্নিকুণ্ডগুলির চারপাশ ঘিরে আনন্দ উৎসব চলেছে। যুবকযুবতীর দল ইরোর আলোয় যৌবনের উৎসবে মেতেছে সেখানে। কিছু কিছু জায়গায় বিবাহেচ্ছুদের শক্তিপরীক্ষার আসর বসেছে। অগ্নিবলয়ের মধ্য দিয়ে কৌশলী ঝাঁপ কিংবা দড়ির জালের উপর মল্লযুদ্ধের দ্বৈরথের আসরগুলিকে ঘিরে এক একবার তুমুল হর্ষধ্বনি উঠছে।

সাধারণত পরীক্ষাগুলি তাঁর যোগ্য সহকারীরাই নিয়ে থাকে আজকাল। তিনি নিজে উৎসবক্ষেত্রের ব্যস্ততার থেকে একটু দূরে থাকাই পছন্দ করেন। নদীতীর ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে তাই তাঁর আসনটি পাতা হয়েছে একেবারে অরণ্যের ধার ঘেঁষে।

উৎসবক্ষেত্রের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কোমর থেকে তীক্ষ্ণধার ফলা সহ একটি কুঠার খুলে আনলেন তিনি। কুঠারটির ফলার পাথর অত্যন্ত কঠিন ও উজ্জ্বল। রাইক দেশ থেকে পাহাড়ের মাথা ডিঙিয়ে আসা একদল পরিব্রাজকের কাছে এই আশ্চর্য বস্তুটি সংগ্রহ করেছিলেন মেইকর। সে দেশে লোহিতবর্ণের প্রস্তরকে আগুনে পুড়িয়ে এই বিশেষ পাথর তৈরি করা হয় নাকি। পরবর্তী হেমন্তঋতুতে ফিরে আসবার সময় এই পাথরের একজন কারিগরকে তাঁর কাছে এনে দেবার কথা দিয়ে গেছেন পরিব্রাজকের দল।

পশুরাজ দড়িতে বাঁধা অবস্থায় পাশের মহারণ্যের দিকে লুব্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। তার দিকে একবার দেখে নিয়ে কুঠারটি রুবনের সামনে এগিয়ে ধরলেন মেইকর, “যুবক, এইবার এই বন্দি পশুটির উপযুক্ত ব্যবস্থা করবার সময় হয়েছে। এই অস্ত্র দিয়ে তুমি একে এর প্রাপ্য মিটিয়ে দাও। এইটিই তোমার শেষ পরীক্ষা। শুধু বিবাহ নয়, এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তুমি আমার পদের উত্তরসূরীও হবে।”

অস্ত্রটি হাতে নিয়ে একবার তার ধারালো ফলাটি ভালো করে আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল রুবন। তার রক্তের মধ্যে কোথাও একটা অপরিচিত, আদিম উত্তেজনা অংকুরিত হচ্ছিল। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল তার। ধীরে ধীরে কুঠারটি হাতে করে সে পশুটির কাছে এগিয়ে গিয়ে তা উঁচু করে তুলে ধরল মাথার ওপর।

আর ঠিক তখনই তার দিকে ছুটে গিয়ে প্রাণপণে তাকে জড়িয়ে ধরল আলিনা, “অবরুদ্ধ গলায় সে বারবার বলে চলেছিল, “না রুবন—না, না—ও ক্ষুধার্ত ছিল রুবন—ক্ষুধার তাড়নায় ও—তুমি ওকে ক্ষমা করো প্রিয়তম—তুমি ওকে—”

তার আলিঙ্গনকে ছাড়িয়ে দিয়ে ফের একবার কুঠারটি মাথার ওপর তুলে ধরল রুবন। আসন্ন মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে পশুরাজও কুঁকড়ে গিয়েছে তখন। তারপর প্রবল শক্তিতে কুঠারটি আছড়ে পড়ল পশুরাজকে বেঁধে-রাখা লতার দড়িটির গায়ে। দু টুকরো হয়ে যাওয়া দড়িটিকে পায়ের আঘাতে সরিয়ে দিয়ে কুঠারের ভোঁতা দিকটা দিয়ে পশুটিকে একটি প্রবল আঘাত করল সে। হতবুদ্ধি জীবটি একবার লাফিয়ে উঠল বাতাসে, আর তারপর নিজেকে স্বাধীন বুঝতে পেরে বড়ো বড়ো লাফে এগিয়ে গিয়ে হারিয়ে গেল অরণ্যের দিকে।

কুঠারটি হাতে করে এনে মেইকরের পায়ের সামনে নামিয়ে রাখল রুবন। মেইকর তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। খানিক বাদে কঠোর গলায় বললেন, “কেন তুমি এ কাজ করলে রুবন? যে তোমাকে আক্রমণ করেছে, তোমার সঙ্গিনীর রক্তপান করতে চেয়েছে, অন্যের প্ররোচনায় তার প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া কি দুর্বলতার পরিচয় নয়? একজন গোষ্ঠীপতির কাছে এই দুর্বলতা আশা করা যায় কি?”

“ক্ষমা করবেন মান্যবর,” মৃদু কন্ঠে উত্তর দিল রুবন, “এই পশুটিকে আমি মারবার জন্য কখনোই কুঠার উত্তোলন করিনি, তবে আলিনা যে আমায় ভুল বুঝে বাধা দিতে এসেছিল তাতেও আমি তৃপ্ত।”

“বুঝিয়ে বলো যুবক।”

“পশুটি কোনো অন্যায় করেনি গোষ্ঠীপতি। প্রকৃতির নিয়মে আমরা সকলেই তার খাদ্য। ক্ষুধার মুখে সামনে খাদ্য পেয়ে সে তার সদ্ব্যবহার করতে চেয়েছিল মাত্র। আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে তাকে হত্যা করলে কোনো অন্যায় হত না আমার। কিন্তু কৌশলে আমি নিজের ও তার, এই দুটি প্রাণই রক্ষা করে তাকে বন্দি করতে পেরেছিলাম। তারপর একটি অসহায় বন্দি পশুকে হত্যা করলে সেটি কোনো মানুষের পক্ষে ন্যায়বিচার হত কি? আমি তৃপ্ত যে আমার সঙ্গিনী আলিনাও আমাকে বাধা দিয়ে আমার মতটিকেই সমর্থন করেছে। গোষ্ঠীশাসক হবার জন্য ন্যায়কে পরিত্যাগ করাই যদি একমাত্র শর্ত হয় তাহলে মান্যবর, গোষ্ঠীশাসকের পদ আমরা চাই না। আপনি কেবল আমাদের আইনত প্রাপ্য বিবাহের অনুমতিটুকু দিন।”

হঠাৎ নিচু হয়ে তাঁর সামনে নতজানু যুবকযুবতীদুটিকে দু হাতে তুলে ধরলেন মেইকর। তাঁর বয়োলাঞ্ছিত চোখদুটিতে ঈষৎ অশ্রুর আভাস ছিল। দু হাতে তাদের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, “আমি ধন্য পুত্র। তুমি একজন গোষ্ঠীপালকের উপযুক্ত চরিত্রের পরিচয় রেখেছ আজ। কাল প্রত্যূষে আমি নিজে তোমাদের নিয়ে নৌশৃঙ্গে দেবর্ষী হবিষ্টের আশ্রমে যাব। সেইখানে তোমাদের বিবাহের পর গোষ্ঠীপতির পদে অভিষেক হবে তোমার-—”


********

“আরো একটি সুন্দর উদাহরণ। গোটা গ্রহের একশো সতেরোটি বসতির মধ্যে একশো তিনটি বসতিতেই এখনো অবধি এই প্রমাণ সংগৃহীত হল। পরীক্ষাটি দ্রুত সাফল্যের দিকে এগিয়ে চলেছে এইবার হবিষ্ট। আপনাকে অভিনন্দন।” দেবর্ষী ক্ষিতিজের চোখদুটি হাসছিল। সামনের প্রক্ষেপণক্ষেত্রে অরণ্যের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ তিনটির ছবি পড়েছে। প্রৌঢ়টি হাসিমুখে বসে রয়েছেন তাঁর প্রস্তরপট্টের ওপর। সুদর্শন যুবকযুবতী দুজন তাঁকে ছেড়ে এগিয়ে চলেছে তাদের নদীতীরবর্তী ক্রীড়াক্ষেত্রের দিকে। প্রৌঢ়ের দৃষ্টিসীমার অন্তরালে গিয়েই একে অন্যের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হল তারা। তাদের উন্মুক্ত সুন্দর শরীরে উপগ্রহটির আলো ছড়িয়ে পড়ছিল। বনের শুষ্কপত্রে তাদের ফুলশয্যা রচিত হয়েছে। সেইখানে বড়ো আদরে, বড়ো তৃপ্তিতে একে অন্যের শরীরে সুখের সন্ধান নিচ্ছিল মানুষদুজন। সেইদিকে দেখতে দেখতে হবিষ্টর চোখদুটি হাসছিল। একদিন এই শরীরের আকর্ষণের প্রয়োজন ফুরোবে এই ঈশ্বরজীবের। দেহ ছাড়িয়ে দেহাতীত শক্তিপুঞ্জের অস্তিত্বে উন্নীত হবে তারা। হবিষ্টের ঈশ্বরজাতি তখন হয়তো বা নিরস্তিত্ব হয়ে মিশে যাবেন ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী মহাশক্তির স্রোতে, কোনো এক বৃহত্তর চেতনায়—আর তাঁদের কার্যভার গ্রহণ করবে এই আজকের এই উত্তরসূরিজীব—একটি গভীর শান্তির স্বাদ ছড়িয়ে পড়ছিল ঈশ্বরজীব দুজনের চেতনায়। বহুযুগের আরব্ধ কাজ অবশেষে সমাপ্তির পথে—


********

“নাম?”

“বেঞ্জারিনা অ্যারিয়ানা।”

“পেশা?”

“ব্যবসা।”

মিত্রশক্তির অঞ্চলে অনুপ্রবেশের কারণ?”

“কিছু জীবনদায়ী ওষুধের চালান নিয়ে এসেছিলাম। উপযুক্ত দাম পেলে—”

“নিবাস?”

“আকোনা। নক্ষত্র উরসুবা। সেক্টর—”

“যথেষ্ট। উরসুবা আমাদের অপরিচিত নয়—”

চওড়া টেবিলটির ওপর প্রশ্নকর্তার হাতের ইশারায় ততক্ষণে আকাশগঙ্গার একটি ত্রিমাত্রিক প্রতিবিম্ব ভেসে উঠেছে। তার বিস্তীর্ণ অঞ্চল অক্ষশক্তির অধিকারসূচক নীল রঙের বিন্দুতে ছাওয়া। নীল বিন্দুগুলির মাঝখানে গ্যালাক্সির একেবারে কেন্দ্রীয় এলাকায় একটি অঞ্চলে জমাট বেঁধে রয়েছে লাল বিন্দুর একটি ঝাঁক। ক্রমাগত পিছু হঠতে হঠতে এখন এই অঞ্চলটুকুতে এসে ঠেকেছে মিত্রশক্তির বিস্তার।

লাল ও নীলবর্ণের বিন্দুগুলির মধ্যে নজর করলে কিছু প্রায় অদৃশ্য সবুজ বিন্দু চোখে পড়ে। সেই বিন্দুগুলোকে ছুঁয়ে যেতে যেতে গ্যালাক্সির একেবারে প্রান্তিক অঞ্চলের একটি বিন্দুতে এসে প্রশ্নকর্তার আঙুল স্থির হল, “উরসুবা নক্ষত্র, সেক্টর তিন। সবুজ—অর্থাৎ আপনার গ্রহটি এই আন্তর্নক্ষত্র মহাযুদ্ধে নিরপেক্ষ ভূমিকায় রয়েছে।”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা চিরকালের ব্যবসায়ী। যুদ্ধবিগ্রহে আমাদের রুচি নেই, তবে আগ্রহ আছে। মানে বুঝতেই তো পারছেন এ সময়ে সব জায়গাতেই প্রয়োজনীয় রসদপত্রের টানাটানি চলে। আমরা সবাইকেই তা সরবরাহ করে থাকি, তবে খানিক বেশি লাভে। আমার পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে নিতে পারেন--বিশেষ ব্যবসায়িক ছাড়—”

“এইদিকে তাকান,” জিমুয়েলা তাং হাতের রেটিনা স্ক্যানারটি তুলে ধরলেন। স্ক্যানারের পর্দায় মানুষটির ছবি ও পরিচয়ের খুঁটিনাটি ভেসে উঠছিল। মিথ্যা বলেনি এ, কারণ রেটিনা স্ক্যান ভুল বলে না। আকোনা গ্রহের এই অর্থপিশাচ ব্যবসায়ী শ্রেণীকে ঠিক কবে থেকে যে কার্তি স্ক্যাম্পান বা ঘৃণ্য সুদখোর নামে ডাকা হয় তা কেউ জানে না। আনুমানিক ষোলো হাজার বছর আগে, এক কুখ্যাত জাতিবিদ্বেষী দাঙ্গার সময় ছটি নক্ষত্র উপনিবেশ থেকে সমস্ত কার্তি স্ক্যাম্পানকে নির্বাসিত করা হয়েছিল গ্যালাক্সির একপ্রান্তের মরুপ্রধান আকোনা গ্রহে। যুদ্ধশেষে এই গ্রহের নরকসদৃশ কনসেনট্রেশান ক্যাম্পগুলিতেই তাদের ফেলে রেখে ফিরে যায় তাদের প্রহরীরা।

কিন্তু মানুষগুলি বিলুপ্ত হতে অস্বীকার করেছিল। এর পরের কয়েক শতাব্দীর মধ্যে আশ্চর্য উদ্ভাবনী প্রতিভায় সেই গ্রহটিকেই সমৃদ্ধ করে তুলেছিল তারা। তারপর একসময় ফের তাদের বাণিজ্যতরীগুলি গ্যালাক্সির মূলস্রোতে ফিরে আসে। সে সময় তাদের প্রথম যে-পণ্যটি সর্বত্র জনপ্রিয় হয়েছিল, তা হল বালির সঙ্গে হাইড্রোজেনের বিক্রিয়ায় সহজে জল তৈরির একটি বহনযোগ্য প্ল্যান্ট। অর্থই এদের ঈশ্বর। তার জন্য নিজের সন্তানকেও বেচে দিতে পারে একজন স্ক্যাম্পান। অথচ দুর্দিনে এদের সাহায্য না হলে চলেও না কারো।

স্ক্যানার সরিয়ে রেখে খানিকক্ষণ মানুষটার দিকে চেয়ে থাকলেন জিমুয়েলা তাং। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “পরিচয়পত্রে কোনো ত্রুটি নেই বেঞ্জারিনা। ত্রুটি অবশ্য আশাও করিনি আমি।”

“তাহলে আমি এখন যেতে পারি? মানে আগেই বলেছি কেন্দ্রীয় হাসপাতালের জন্য একটা ওষুধের চালান এনেছিলাম—”

“আহা এত ব্যস্ত কীসের? আপনার আনা সমস্ত রসদের কন্টেনারগুলি এই স্টেশনে প্রথমে পরীক্ষা করা হবে। ততক্ষণ আরো কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিন।”

মধ্যবয়স্কা মহিলাটির মুখে একটা ছায়া পড়ল এক মুহূর্তের জন্য। পরমুহূর্তেই তা সামলে নিয়ে তিনি বললেন, “বলুন?” “সহজ প্রশ্ন,” বলতে বলতে গ্যালাক্সির চিত্রটির কেন্দ্রীয় এলাকার একটি লাল বিন্দুর দিকে দেখিয়ে জিমুয়েলা বললেন, “আমাদের নোভোস গ্রহের নক্ষত্র এই লোবানের অবস্থান আপনি জানেন নিশ্চয়। আপনাদের আকোনা গ্রহ থেকে এর দূরত্ব বাইশ হাজার আলোকবর্ষ। লোবানকে ঘিরে পাঁচ হাজার আলোকবর্ষ এলাকা আমাদের মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রণে আছে। তাকে ঘিরে বাকি সতেরো হাজার আলোকবর্ষ জুড়ে সমস্ত এলাকাটাই এখন অক্ষশক্তির দখলে। সেই অবরোধ এড়িয়ে আপনার রসদের জাহাজ মিত্রশক্তির এলাকায় বিনা বাধায় ঢুকে এল, এবং তারপর মিত্রশক্তির পাঁচ হাজার আলোকবর্ষ অঞ্চল সকলের অলক্ষ্যে পার হয়ে এসে লোবানের গ্রহমণ্ডলে অক্লেশে ঢুকে পড়ল, এ কথা আপনি আমায় বিশ্বাস করতে বলেন?”

বেঞ্জারিনার মুখে একটু মৃদু হাসি খেলা করে যাচ্ছিল। আশ্চর্য সাহস এই স্ক্যাম্পানদের। যে-কোনো অবস্থায় এদের মাথা বরফের মতন ঠান্ডা থাকতে পারে। জিমুয়েলার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে ধীরেসুস্থে বললেন, “তার কারণ, শক্তি সংগ্রহের জন্য যাত্রাপথে আমাদের কোনো নক্ষত্রের কাছে আসবার প্রয়োজনই হয়নি।”

জিমুয়েলা মনে মনে মৃদু হাসলেন। মিথ্যা দিয়ে মিথ্যাকে চাপা দেয়া যায় না। এইবার এ নিজের ফাঁদেই ধরা দিতে চলেছে।

“অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন একটি উল্লম্ফনেই আপনি বাইশ হাজার আলোকবর্ষ পার হয়ে এসেছেন? কিন্তু এখনো অবধি একবারে তো এক হাজার আলোকবর্ষের বেশি উল্লম্ফনের প্রযুক্তিই আবিষ্কৃত হয়নি। আপনার যানটিকে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। এটি একটি ‘সি’ শ্রেণীর পুরোনো মালবাহী জাহাজ। তেমন কোনো উন্নত প্রযুক্তির চিহ্ন নেই তার ইঞ্জিনে। আর, কোনো অজ্ঞাত প্রযুক্তি তাতে থাকলেও, একঝাঁপে বাইশ হাজার আলোকবর্ষ পার হবার ধাক্কা সইবার মত তার গঠন নয়। আমার তো মনে হয় আপনি অক্ষশক্তির নিবিড় সহায়তায়-—”

“সোজা কথায় আপনার সন্দেহ আমি অক্ষশক্তির গুপ্তচর, এবং মিত্রশক্তির কিছু এলাকাও বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাকে এইখানে পৌঁছতে সাহায্য করেছে, তাইতো?”

জিমুয়েলা তাং স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ। আমি আপনাকে চরবৃত্তির উদ্দেশ্যে মিত্রশক্তির প্রধান দফতর নোভোস গ্রহের সীমানায় ঢোকবার অপরাধে গ্রেফতার করছি—”

বেঞ্জারিনা হাতদুটি মাথার ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙলেন একবার। তারপর বললেন, “বেশ বেশ। আমারও কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। তা আমাকে কোনও বিচারকের সামনে হাজির করা হবে তো? নাকি বিনা বিচারেই এই বন্দিকক্ষে—”

“আমরা মূর্খ বন্যজীব নই বেঞ্জারিনা। আইনমাফিক, সাত আদর্শ দিনের মধ্যে আপনাকে বিচারকের সামনে হাজির করা হবে।”

“বেশ। আমার জাহাজের লগবুকটি বিচারসভায় আমার চরবৃত্তির একটি প্রমাণ হিসেবে পেশ হবে নিশ্চয়?”

“নিঃসন্দেহে। লগবুকটি আমরা আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই—” বলতেবলতেই হঠাৎ ভ্রুদুটি কুঁচকে উঠল জিমুয়েলা তাং-এর, “আপনি কী বলতে চাইছেন বেঞ্জারিনা?”

“বলতে চাইছি একটি কথাই। একবারে বাইশ হাজার আলোকবর্ষ পার হবার ক্ষমতা আমার জাহাজের নেই। এক ঝাঁপে সর্বোচ্চ এক হাজার আলোকবর্ষই পার হতে পারে আমার যানও। তবু, আমার লগবুকটি দেখলেই প্রমাণিত হবে, এই যানটি কোনো উল্লম্ফনের পরই পরবর্তী উল্লম্ফনের শক্তিসংগ্রহের জন্য কোনো নক্ষত্রের কাছে এগোয়নি।”

জিমুয়েলার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠছিল এইবার। পাকা অপরাধীর মতোই আচরণ করছে এই কার্তি স্ক্যাম্পান। পরস্পরবিরোধী কথা বলে প্রশ্নকর্তাকে বিপথে চালাবার চেষ্টা। একটু থেমে থেকে তিনি ফের বললেন,

“বেঞ্জারিনা, আপনাকে সতর্ক করে দিতে চাই যে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ভুল তথ্য দেয়ার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সেইসঙ্গে এ-ও জানাতে চাই, এই সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করা হচ্ছে ও প্রয়োজনে তা শুনানির সময় পেশ করা হবে।

“আপনাকে পরবর্তী প্রশ্ন করবার আগে নিয়মমাফিক কিছু সাধারণ তথ্য আপনাকে জানিয়ে দিতে চাই। আদিমকালের গ্র্যাভিটি ফোকাসিং পদ্ধতিতে তিন চার আলোকবর্ষের বেশি পথ পার হওয়া যেত না এক একটি ঝাঁপে। আধুনিক পদ্ধতিতে উল্লম্ফন গহ্বর তৈরির জন্য যে শক্তিধর তড়িৎকোষের ব্যবহার করা হয়, তাতেও এক হাজার আলোকবর্ষ পথের বেশি পাড়ি দেয়া যায় না। তারপর তড়িৎকোষগুলিকে কোনো নক্ষত্র থেকে পরবর্তী ঝাঁপের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। অতএব আমার বক্তব্য আপনি মিথ্যা বলছেন এবং আপনার লগবুকে আপনার দাবিমত তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?”

বেঞ্জারিনার মুখের থেকে হাসিহাসি ভাবটি এইবার মুছে গেল। চেয়ারে সোজা হয়ে উঠে বসে বললেন, “যেকোনো জাহাজের লগবুক একটি আত্মঘাতী সার্কিটের সঙ্গে জোড়া থাকে। তাতে যে ইচ্ছামত কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় সে আপনি জানেন। অতএব আমার দাবি প্রথমে আপনারা আমার লগবুকটি পরীক্ষা করুন, তার পর আমি এ বিষয়ে আমার মন্তব্য আপনাকে জানাব। আশা করি আমার দাবিটি ন্যায্য এবং এটিও রেকর্ডিং করা হচ্ছে।”

জিমুয়েলা তাং-এর ঠোঁটদুটি দৃঢ় হয়ে একে অন্যের ওপরে চেপে বসল। বেঞ্জারিনার যুক্তিতে জোর আছে। খানিকক্ষণ একে অন্যের চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে রইল এক সৈনিক ও এক ব্যবসায়ী। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন জিমুয়েলা তাং। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই মৃদু একটি শব্দ করে একটি অদৃশ্য শক্তি আবরণ নেমে এল কক্ষটির সামনে।


********

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না অবশ্য বেঞ্জারিনাকে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই তাঁর বন্দিশালার শক্তি আবরণ সরিয়ে জিমুয়েলা এসে দাঁড়ালেন ঘরের ভেতরে। বেঞ্জারিনা ঘুমোননি। একটি ছোটোপর্দার পাঠযন্ত্র থেকে মনোযোগ দিয়ে কিছু পড়ছিলেন। জিমুয়েলা ঘরে ঢুকতে তার দিকে মুখ তুলে হেসে বললেন, “তারপর নির্দেশক? লগবুক দেখা শেষ হয়ে গেছে নিশ্চয়?”

জিমুয়েলা নীরবে একবার তাঁর দিকে চেয়ে দেখলেন, তারপর নিচু হয়ে তার গালে সজোরে একটি চড় মেরে হিসহিসিয়ে উঠলেন, “কার্তি স্ক্যাম্পান! লগবুক জাল করলি কী করে তুই?”

উঠে দাঁড়িয়ে, মাথার এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলের রাশিটিকে ফের গুটিয়ে নিয়ে নিজের গালটি ঘসতে ঘসতে বেঞ্জারিনা বললেন, “এই চড় ও গালাগালটির যোগ্য উত্তর আমি আপনাকে যথাসময়ে দেব মহামান্য। তবে উপস্থিত আপনি যে কেবল আমায় একটি চড় মারবার জন্য এখানে আসেননি তা বোঝাই যাচ্ছে। আমার যানের যে গতিপথটি আপনারা লগবুক থেকে উদ্ধার করেছেন সেটি আপনার মতে মিথ্যা হলেও সম্ভবত আপনার চেয়ে সামান্য বেশি বুদ্ধিমান কোনো কর্তাব্যক্তির নজরে এসেছে তাই না? আহা হা—না না—শুধু শুধু আর একবার নিজের হাতে যন্ত্রণা দেবেন না। ওতে আমার কোনো কষ্টই হবে না। আমার জাতি গত ত্রিশ হাজার বছর ধরেই সকলের হাতে মার খেয়ে অভ্যস্ত।”

উদ্যত হাতটা নামিয়ে নিলেন জিমুয়েলা তাং। এই বন্দিকক্ষগুলি সবসময় প্রহরী ক্যামেরার নজরে থাকে। বন্দির ওপর শারীরিক অত্যাচারের ছবি সাংবাদিকদের হাতে পড়লে মিত্রশক্তির বিপক্ষে ক্ষতিকর প্রচারের উপকরণ হতে পারে।

“চলুন।”

“কোথায় যেতে হবে জানতে পারি কি?”

“আপনার যানে। স্বয়ং মহানির্দেশক রমুলা জাইমিন সেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”


********

“কিন্তু এ একেবারেই অসম্ভব। অথচ এই লগবুকটি জাল করবার কোনো প্রমাণও-—”

যানটির নিয়ন্ত্রণকক্ষের ত্রিমাত্রিক প্রক্ষেপণক্ষেত্রে তার গতিপথের ছবি ভাসছিল। গ্যালাক্সির একেবারে প্রত্যন্ত প্রান্তের আকোনা গ্রহ থেকে উঠে গতিপথজ্ঞাপক রেখাটি প্রথম লাফেই গ্যালাক্সির প্রান্তসীমা ছাড়িয়ে ক্যানি মেজরি ও আকাশগঙ্গার মধ্যেকার নক্ষত্রহীন শূন্যতার মধ্যে গিয়ে থেমেছে। সেখান থেকে একের পর এক সহস্র আলোকবর্ষব্যাপী লাফে আকাশগঙ্গার চ্যাপ্টা ঘূর্ণনতলের নিচ দিয়ে তারকাহীন শূন্যতা সাঁতরে তা গ্যালাক্সির একেবারে কেন্দ্রস্থলের নিচে এসে পৌঁছেছে। অবশেষে ফের একটি উল্লম্ব লাফে চারশো চল্লিশ আলোকবর্ষ আকাশগঙ্গার ভেতর ঢুকে এসে রেখাটি সটান এসে পৌঁছেছে লোবান নক্ষত্রের গ্রহমণ্ডলে।

সেইদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে কাই লোগান তখন সভায় উপস্থিত সেনাপতিদের উদ্দেশ্যে বলে চলেছেন, “অবাস্তব। কল্পকাহিনী। সভ্যতার ইতিহাসে কেউ কখনো গ্যালাক্সির সীমানার বাইরে পা দেবার কথা কল্পনাও করেননি।”

“একেবারেই অবাস্তব বুঝি?” বেঞ্জারিনা যানের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের থেকে হাত তুলে নিয়ে ঘুরে বসলেন মানুষগুলির দিকে।

“আমাদের এক পূর্বপুরুষ, সোরাক নিয়াহুর জীবন নিয়ে ইব্রুন ভাষায় একটি বীরগাথা আছে। সেখানে সোরাক নিজে বলে গেছেন—”,

“তৃতীয় সহস্রাব্দের সেই ‘সোরাকের অভিযান’এর কথা বলছেন তো?” ডঃ কাই লোগানের গলায় বিরক্তির স্পর্শ ছিল, “আমরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করছি। স্বর্গীয় নৌকায় করে সৃষ্টিবীজ নিয়ে দেবতাদের আলফা সেন্টাউরি থেকে এক উল্লম্ফনে গ্যালাক্সি ছেড়ে চলে যাবার উপকথাকে আমরা বৈজ্ঞানিক সত্য বলে মনে করি না। সে গল্প মানতে গেলে তো এ-ও মানতে হয় যে ক্যানি মেজরিকে ঘিরে থাকা মনোসেরস রিং-এর নক্ষত্রস্রোতে আজও ভেসে বেড়াচ্ছে তাঁদের ভেলা। মেনে নিতে হয়, তাঁদের অভিশাপেই এরপর মাতৃগ্রহ পৃথিবীর সঙ্গে আদিম নক্ষত্র উপনিবেশগুলির শতবর্ষব্যাপী মহাযুদ্ধের সূচনা হয়।”

“যদি বলি এগুলিই সত্য?”

“মাফ করবেন বেঞ্জারিনা। তাহলে তো এ-ও মানতে হয় যে একসময় মানবসভ্যতা পুরুষনির্ভর ছিল। কারণ সোরাক ছিলেন পুরুষ। বীর্যদান ভিন্ন সভ্যতায় যাদের কোনো নির্ণায়ক ভূমিকা কখনও ছিল বলে ইতিহাসে জানা যায় না, তেমন একজন পুরুষ নক্ষত্রযুদ্ধে সৈনাপত্য করছেন এ কথা আপনি আমাদের বিশ্বাস করতে বলেন?”

বেঞ্জারিনা উত্তর দিলেন না। কথাটির মধ্যে কিছু সারবত্তা আছে। একটু বাদে কাই লোগান ফের বললেন, “অর্ধসভ্যযুগের এই অবিশ্বাস্য রূপকথা ভিন্ন আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান সেই অগম্য অঞ্চলে যাবার বাস্তব প্রযুক্তির নাগাল পায়নি। এখনো প্রযুক্তি যে স্তরে রয়েছে তাতে এক একটি ঝাঁপে এক হাজার আলোকবর্ষ পার হবার পর যে কোনো যানকেই কোনো না কোনো নক্ষত্রের থেকে শক্তিসংগ্রহ করতে হয় পরবর্তী ঝাঁপের জন্য। গ্যালাক্সির বাইরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সম্পূর্ণ নক্ষত্রবিহীন।”

“আপনি ভুল বলেননি ডঃ লোগান,” মাথা নাড়লেন বেঞ্জারিনা, “তবে আমার লগবুক মিথ্যা বলেনি। কারণ আমার এই মালবাহী যানটিতে জেব্রন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদলের তৈরি একটি নতুন শক্তিশোষক যন্ত্র স্থাপিত হয়েছে যার কর্মপদ্ধতি এখনো আপনার জানা নেই।”

“যেমন?”

“সেটি মুখে বলে বোঝাবার মতন পাণ্ডিত্য আমার নেই। তবে হ্যাঁ। আপনারা চাইলে হাতেকলমে তার প্রদর্শন করতে পারি আমি। তাতে আমার লগবুকের তথ্যের সত্যতার ব্যাপারেও আপনাদের সন্দেহের নিরসন হবে। এই পরীক্ষামূলক যন্ত্রটিই আসলে আমার এই যাত্রার প্রধান পণ্যসামগ্রী। তুচ্ছ কয়েক টন ওষুধের চোরাচালন নয়, আসলে এইটি বিক্রি করবার জন্যই আমার এইখানে আসা।”

“প্রদর্শন—অর্থাৎ?”

“এই যানটিতে আমি আপনাকে এবং এই মহামান্য সেনাপতিদের দলটিকে একটি ছোটো ভ্রমণে নিয়ে যেতে চাই।”

সেনাপতিদের দলটি একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন নিজেদের মধ্যে। রমুলা জাইমিন নিঃশব্দে বেঞ্জারিনার দিকে তাকিয়ে যেন তার মনের ভিতরটা দেখে নিতে চাইছিলেন। কাই লোগানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বেঞ্জারিনা এইবার তাঁর মুখোমুখি হলেন, “মাননীয় মহানির্দেশক। স্বীকার করছি আমার প্রস্তাবটিকে আপনাদের সরাসরি মেনে নিতে কিছু সমস্যা আছে। কিন্তু অনুমতি দিলে আমি বিষয়টিকে একটু ব্যাখ্যা করতে পারি।”

জিমুয়েলা তাং তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েছিলেন রমুলাকে, কিন্তু মহানির্দেশক তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বেঞ্জারিনার দিকে নিঃশব্দে ইশারা করলেন।

“ধন্যবাদ মহানির্দেশক। আমরা ব্যবসায়ী। পেশাগত কারণে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির আন্দাজ আমাদের ভালোরকমই রয়েছে। আমি সরাসরি প্রসঙ্গে আসব। গত প্রায় এক সহস্রাব্দি ধরে গোটা আকাশগঙ্গা জুড়ে এই যুদ্ধ চলেছে। উপস্থিত অক্ষশক্তি যেভাবে আপনাদের ঘিরে ধরে ফাঁসটা ছোটো করে আনছে তাতে এ যুদ্ধে নিশ্চিত ধ্বংস ছাড়া আপনাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। আকাশগঙ্গার কোনো জায়গাই এখন আর আপনাদের জন্য নিরাপদ নয় মহানির্দেশক।”

সমবেত সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে একটা ক্রুদ্ধ গুঞ্জন উঠল। একজন কার্তি স্ক্যাম্পানের মুখে এই বিশ্লেষণ তাদের সহ্যের বাইরে। কিন্তু হাতের ইশারায় সে গুঞ্জনকে থামিয়ে দিয়ে বেঞ্জারিনার দিকে ঘুরে ফের একবার মাথা নাড়লেন রমুলা। ঔদ্ধত্যের শাস্তি এর পরে হবে। উপস্থিত এর যানের রহস্যটি তাঁকে বেশি আকর্ষণ করছে। একটা ক্ষীণ আশার ইঙ্গিত জেগে উঠছিল তাঁর মনের মধ্যে। অসম্ভব একটা আশা—যদি--

“এই অবস্থায়, একমাত্র আকাশগঙ্গা থেকে অন্য কোনো তারকাপুঞ্জে আশ্রয় নিতে পারলে মিত্রশক্তি রক্ষা পাবে। শুধু তাই নয়, অপ্রতিহত গতিতে তারা এক নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আরেক নক্ষত্রপুঞ্জে সাম্রাজ্য ছড়িয়ে দিতে পারবে। আর, তার জন্য যে প্রযুক্তিটির প্রয়োজন, সেই বিষয়েই একটা সুনির্দিষ্ট ব্যবসায়িক প্রস্তাব নিয়ে আমি এসেছি আপনাদের কাছে। আমার যানটি কোনো সাধারণ যান নয় মহানির্দেশক-—”

ডোঃ লোগান ফের কথা বললেন এইবার, “আকাশগঙ্গার সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি ক্যানি মেজরি। তার চারপাশে ঘুরতে থাকা মনোসেরস রিং নামের নক্ষত্রস্রোতটি আকাশগঙ্গার প্রান্ত থেকে পঁচিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। শক্তি সংগ্রহের জন্য একটি নক্ষত্রও নেই এই মধ্যবর্তী অঞ্চলে। আপনি বলতে চাইছেন আপনার এই মালবাহী আদিম যানটি কোনো নতুন প্রযুক্তিতে সেই পথ পাড়ি দেবার শক্তি ধরে, তাইতো?”

“হ্যাঁ ডঃ লোগান। আমি ঠিক তাই বলতে চাইছি। আমার লগবুকটি তার প্রাথমিক প্রমাণ। এবং কেমন করে তা সম্ভব তারই প্রদর্শন করে দেখাবার প্রস্তাব দিয়েছি আপনাদের। আপনারা তাতে সন্তুষ্ট হলে পরে ব্যবসার বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন রমুলা জাইমিন। জিমুয়েলা ফের তাঁকে কিছু বলবার চেষ্টা করছিলেন। আরো একবার তাকে থামিয়ে দিলেন তিনি। তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলছিল, এই অর্থলোভী কার্তি স্ক্যাম্পান মিথ্যা বলছে না। অর্থই এদের ঈশ্বর। তাছাড়া যদি সত্যিই এদের হাতে সে প্রযুক্তি এসে থাকে তাহলে তা অক্ষশক্তির হাতে পড়বার আগেই তাঁদের হাতে তা আসা প্রয়োজন। যে-কোনো মূল্যে। যদি এ মিথ্যাও বলে থাকে তবুও তাকেপরীক্ষা করে নেবার প্রয়োজন আছে।

একটু বাদে ঠান্ডা গলায় কেটে কেটে তিনি বললেন, “আপনি ভুলে যাচ্ছেন বেঞ্জারিনা যে আপনি আমাদের বন্দি। আপনার যানটিতে তেমন কোনো প্রযুক্তি থাকলে সেটিকে বাজেয়াপ্ত করে আমাদের বিজ্ঞানীরা সহজেই তা উদ্ধার করে নিতে পারবে।”

বেঞ্জারিনা মৃদু হেসে হাতের একটি ইশারা করলেন। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই একটি ছোটো প্রক্ষেপণক্ষেত্রে কিছু সংকেতবাক্যের স্রোত ভেসে উঠল। সেইদিকে ইশারা করে তিনি বললেন, “আমার যানের মূল প্রোগ্রামিং এর এই অংশটি একবার দেখুন মহামান্যা। এখানে আসবার আগে সে বিষয়ে উপযুক্ত নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। দেখতেই পাচ্ছেন, আমার যানটি আমার চিন্তাসংকেত দিয়ে চালিত হয়। তার প্রধান গণকযন্ত্রে অন্য কোনো চিন্তাসংকেত আরোপিত করতে গেলে তা সঙ্গে সঙ্গে যানটিকে ধ্বংস করবে। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে এই প্রযুক্তিকে খুঁজে নিয়ে তাকে ফের একবার তৈরি করতে আপনাদের বেশ কিছু সময় লাগবে। আশা করি ডঃ লোগান আমার কথার সত্যতাকে সমর্থন করবেন?”

কাই লোগান বিস্মিত চোখে প্রক্ষেপণক্ষেত্রে ভেসে ওঠা সংকেতবাক্যগুলোর দিকে দেখছিলেন। কোনো জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে একবার মাথা নাড়ালেন তিনি।

“দ্বিতীয়ত, আমাদের বাণিজ্য মহাসংঘের পরিকল্পনা হল, আগামী দশ দিনের মধ্যে আমি এই যানটি নিয়ে সশরীরে আকোনা গ্রহে ফিরে না গেলে আমাদের দ্বিতীয় একজন প্রতিনিধি এইরকম আরো একটি যান নিয়ে প্রদর্শনীর জন্য অক্ষশক্তির প্রধান দফতর সাইলান-এ গিয়ে পৌঁছোবেন। দ্বিতীয় যানটি আকোনার প্রধান উৎক্ষেপনক্ষেত্রে এই মুহূর্তে অপেক্ষায় রয়েছে। এখন বলুন—”

“এই জঘন্য স্ক্যাম্পান বানিয়া আমাদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে মহামান্যা। আদেশ দিন, আমি—”

রমুলা কঠিন চোখে একবার জিমুয়েলা তাং-এর উত্তেজিত মুখটির দিকে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “আমি রাজি কার্তি স্ক্যাম্পান। কিন্তু পরীক্ষা চলাকালীন আপনাকে সশস্ত্র প্রহরায় রাখা হবে।”

জিমুয়েলা তাং-এর লাল হয়ে ওঠা মুখটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন বেঞ্জারিনা। চকিতের জন্য সামান্য হাসি খেলে গেল সেখানে। আর তারপরই আভূমি নত হয়ে তিনি বললেন, “অবশ্যই মহামান্য জাইমিন। এ তো অত্যন্ত বাস্তবসম্মত কথা। আমার মতন একজন ঘৃণ্য কার্তি স্ক্যাম্পান তার নিজের প্রাণ ও অর্থকে সবচেয়ে ওপরে স্থান দেয়। ফলে অস্ত্রধারী সেনাদল যদি আমার দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে তৈরি থাকে তাহলে আমি যে কোনো চালাকি করব না সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি। সেইসঙ্গে আরো একটি প্রস্তাব আমার আছে। অতিরিক্ত সতর্কতা স্বরূপ একটি অস্ত্রসজ্জিত যুদ্ধযান এই যানটিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলুন মহামান্য নির্দেশক জিমুয়েলা তাং। তাঁর যানটিকেও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি আমি যথাসময়ে সরবরাহ করব, এবং মহোদয়াগণ, সেটি করা হবে আকোনা বণিকসংসদের তরফে বন্ধুত্বের চিহ্ন হিসেবে সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে।”


********

নোভোস গ্রহটির থেকে চার মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে মহাকাশযান দুটি ভাসছিল। বিরাটকায়, নিরীহদর্শন মালবাহী যানটির পাশে ভাসমান তীক্ষ্ণ ও হিংস্র চেহারার যুদ্ধযানটিকে দেখলে অতীতকালে দানবজীব ম্যামথ ও তার শিকারী মানুষের তুলনাটি মনে আসবে। তবে অতীতকালের মত এ কালেও ম্যামথটির, তার ক্ষুদ্র শিকারীর আক্রমণ থেকে বাঁচবার কোনো উপায় নেই। প্রতিবস্তু বিস্ফোরকে সজ্জিত যুদ্ধযানটি একা একটি গোটা গ্রহকে চূর্ণ করে মহাকাশে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা ধরে।

মালবাহী যানটির নিয়ন্ত্রণকক্ষে বেঞ্জারিনা তাঁর যন্ত্রগণকের প্যানেলে হাতদুটি ছুঁইয়ে ধ্যানস্থ হয়েছেন তখন। মাথার ওপর নেমে আসা শিরস্ত্রাণটি থেকে মৃদু গুনগুন শব্দ উঠছিল। যানের গণক তাঁর মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। তাঁর চিন্তাতরঙ্গকে অনুধাবন করে নিয়ে যানকে উদ্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যাবে বুদ্ধিমান যন্ত্রটি।

কয়েক মুহূর্ত বাদে গুনগুন শব্দটি থেমে গেল। শিরস্ত্রাণটি বেঞ্জারিনার মাথা থেকে সরে গিয়েছে ততক্ষণে। চোখ খুলে চেয়ারে বসেই পেছনদিকে ঘুরে সেনাপতিদের মুখোমুখি হলেন তিনি, “গন্তব্যের স্থানাংক আপনার প্রহরী-যানের গণকেও স্থাপিত হয়েছে। কাউন্ট ডাউন শুরু হচ্ছে মহামান্যগণ—”

বলতে বলতেই একটি সুরেলা গলায় প্রাচীনকাল থেকে সুপরিচিত সেই শব্দটি উঠে আসছিল, ----পাঁচ—চার—তিন—দুই—এক— বাইরের অন্ধকার শূন্যতার বুকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকা ঘূর্ণায়মান অতিমহাকাশ সুড়ঙ্গদুটির মুখের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ক্রমশ গতিসঞ্চয় করছিল যানদুটি--

হঠাৎ সামান্য একটা ঝাঁকুনি দিয়েই ফের থেমে গেল বেঞ্জারিনার যান। মহাকাশ সুড়ঙ্গ যানদুটিকে উগরে দিয়েই মিলিয়ে গেছে ফের। জানালার বাইরে কিছুদূরে জিমুয়েলা তাং-এর যুদ্ধযানটি ভাসছিল। সকলের চোখ তখন সেইদিকেই আবদ্ধ। হঠাৎ যাত্রীদের মধ্যে থেকে বিস্ময়ের শব্দ উঠে এল একটি—

ততক্ষণে সকলেরই নজরে পড়েছে দৃশ্যটি। প্রহরীযানের চারপাশে নিকষ অন্ধকার ছেয়ে আছে শুধু। সেখানে যতদূর চোখ চলে একটিও তারার অস্তিত্ব নেই।

“মান্যবরগণ, যদি একটু আমার দিকে মনোযোগ দেন,” বেঞ্জারিনার ডাকে তাঁর দিকে ঘুরে তাকালেন মানুষগুলি।

“এই উল্লম্ফনটি গ্যালাক্সির নিচের তলের সঙ্গে উল্লম্বভাবে ঠিক এক সহস্র আলোকবর্ষ দীর্ঘ ছিল। আমাদের যাত্রাবিন্দু লোবান নক্ষত্র রয়েছে আকাশগঙ্গার প্রান্তদেশ থেকে চারশো আলোকবর্ষ ভিতরে। ফলত আমরা এখন আকাশগঙ্গা তারকাপুঞ্জের সীমান্ত থেকে, অথবা বলতে পারেন সেখানকার নিকটতম তারাটির থেকে ঠিক ছশো আলোকবর্ষ দূরে। সামনের পর্দায় আপনারা এই যানের শক্তিকোষগুলির শক্তির পরিমাণ দেখতে পাচ্ছেন।

মানুষগুলি নির্বাক হয়ে সেইদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন একবার। শক্তিকোষের সঞ্চয় সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়ে গেছে সেই লাফে।

“এইবার ভদ্রমহোদয়াগণ, আমার যন্ত্রগণক পূর্বনির্দেশ মতন একটি বিশেষ যন্ত্র চালু করবে। এই যন্ত্রটি বিক্রি করবার জন্যই আমার আপনাদের তারকামণ্ডলে আসা। দেখুন—”

অবিকল জাদুকরের ভঙ্গিতে শক্তির পরিমাপ নির্দেশক রেখাটির দিকে হাত বাড়িয়ে ধরলেন বেঞ্জারিনা। হতবাক চোখগুলির সামনে তখন সেগুলি প্রায় অলৌকিকভাবেই ভরে উঠছে ধীরে ধীরে—

“শূন্যজ শক্তি মহামান্যগণ। ব্রেবিনার ‘মাতৃগ্রহকথা’ কাব্যের ষষ্ঠ সর্গে এই দৈবী শক্তির উল্লেখ আছে।”

“ব্রেবিনা--!!”

“আকোনার ইব্‌রুন ভাষার মহাকবি সীতাগ্রি ব্রেবিনা। আনুমানিক পনেরো শতাব্দি আগে তিনি এই মহাকাব্যটি রচনা করেছিলেন। সেখানে তিনি বলছেন, সুদূর অতীতকালে, মানুষ যখন তার মাতৃগ্রহের জঠর থেকে বহির্বিশ্বে পা দেয়নি, সেইসময় পৃথিবীতে লামাত্রে, কাশিমির, ইয়াং, তিরিয়ন প্রমুখ দেবর্ষীরা সুদীর্ঘ সাধনায় প্রকৃতির এক বিচিত্র রহস্য আবিষ্কার করেন। তাঁরা দিব্যচক্ষে দেখেন, ব্রহ্মাণ্ডের মোট শক্তি শূন্য এবং সেই সর্বব্যাপী শূন্য ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তিতে আন্দোলিত হয়ে বস্তুজগতের জন্ম দেয় এবং সেই অপরিমেয় শক্তির বিপরীতমুখী চাপেই ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে চলেছে এই মহাবিশ্ব।”

“প্রাগৈতিহাসিক বর্বরদের রূপকথা।”

“আমাদেরও তাই ধারণা ছিল মহামান্য। কিন্তু কিছুকাল আগে অধুনা সংরক্ষিত প্রত্নগ্রহ পৃথিবীতে একটি অভিযানের পর আমাদের সে ধারণাটি বদলে যায়। সেখানকার প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সংরক্ষিত প্রত্নস্তূপে খননকার্য চালাবার সময় কিছু আদিম যন্ত্রগণকের সন্ধান পান আমাদের বিজ্ঞানীরা। তার স্মৃতিকোষগুলিকে পুনর্জীবিত করে সেখানে সঞ্চিত তথ্যের পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে একরকম হঠাৎ করেই ব্রেবিনার কাব্যে বর্ণিত চার দেবর্ষীর রচিত কিছু গবেষণাপত্রের সন্ধান মেলে। সেই গবেষণাপত্রগুলি থেকেই এই চমকপ্রদ দিব্যদর্শনের প্রথম গাণিতিক ভিত্তিটির সন্ধান পাওয়া যায়। কল্পনার অতিমানবিক উল্লম্ফনে নিজেদের সময়ের বিজ্ঞানকে ছাড়িয়ে বহু এগিয়ে গিয়ে এই শক্তির গাণিতিক নির্ণয়ের সূচনা করে গিয়েছিলেন সুদূর অতীতের সেই চার দেবর্ষী।

“তার ওপর ভিত্তি করেই দীর্ঘ গবেষণায় আমাদের বিজ্ঞানীরা সেই শূন্যজ শক্তির সামান্য অংশকে আবদ্ধ করবার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন মহামান্যগণ। একটি ক্ষুদ্র যন্ত্র। আয়তনে কেবলই একটি চার হাত পরিমাণ ঘনক; মহাবিশ্বে প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলা ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তির দোলন সেটিকে তড়িতাহত করে তোলে এবং সেই শক্তি সঞ্চিত হয় মহাকাশযানের তড়িৎকোষে—দেখুন মহামান্যগণ—তড়িতকোষগুলি প্রায় সম্পূর্ণ ভরে উঠেছে। এইবার আমরা স্বচ্ছন্দে ফিরে যেতে পারি আমাদের পরিচিত লোবান নক্ষত্রের গ্রহমণ্ডলে—”

বলতে বলতেই হঠাৎ জানালা দিয়ে পাশে ভাসমান প্রহরী যানটির দিকে চোখ পড়ল বেঞ্জারিনার। ঠোঁটে একটু বিদ্রুপের হাসি খেলা করে গেল তাঁর। তাঁর হাতের সংকেতে সামনের পর্দা থেকে তড়িৎকোষের ছবি মুছে গিয়ে একেবারে হঠাৎ করেই ভেসে উঠল জিমুয়েলা তাং-এর হতবাক মুখটি। সেইদিকে আঙুল উঁচিয়ে বেঞ্জারিনা নিচু গলায় বললেন, “আমার যানের গণকের সঙ্গে আপনার যানের গণকের সংযোগ এখনও ছিন্ন হয়নি জিমুয়েলা। নিশ্চয় দেখেছেন আমাদের শক্তিকোষগুলি পূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু আপনার যানটির শক্তি তো সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়েছে মহামান্য। এখন এই মহাশূন্যের কারাগার থেকে আপনি সভ্যতায় ফিরবেন কী করে?”

জিমুয়েলা কোনো উত্তর দিলেন না।

সেনাধ্যক্ষদের দলটির দিকে ঘুরে বেঞ্জারিনা একবার মাথা নিচু করে বললেন, “মহামান্যগণ, ইনফাইনাইট এনার্জি সংস্থার প্রধান বিক্রয় আধিকারিক হিসাবে আমার নিজের ক্ষমতায় পরিপূর্ণ বিশ্বাস আছে। তাই আমি আমার এই যানে এক সহস্র এই যন্ত্র সঙ্গে নিয়েই বের হয়েছি—না না উত্তেজিত হবেন না। এদের প্রতিটির মধ্যেই একটি আত্মধ্বংসী বর্তনী প্রতিষ্ঠিত আছে যেটি একটি ডেইকি নেটওয়ার্ক দিয়ে আকোনা গ্রহে আমাদের প্রধান দফতরের সঙ্গে যুক্ত। যন্ত্রগুলি আমার স্পর্শ চেনে। বর্তনিটিকে নিষ্ক্রিয় না করে অন্য কেউ তাদের স্পর্শ করলে প্রধান দফতরের গণকটির নির্দেশে তারা একযোগে বিস্ফোরিত হবে। যাই হোক, আমার মূল বক্তব্যে ফিরে আসি। এই যন্ত্রটি যেকোনো মহাকাশযানেই অতি সহজে সংযুক্ত করা যায়। তেমন একটি যন্ত্রের আত্মধ্বংসী বর্তনিটিকে নিষ্ক্রিয় করে এই মুহূর্তে এই যানের যন্ত্রগণক ওই যুদ্ধযানটির দিকে পাঠাচ্ছে। যন্ত্রটি শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। যানের শক্তিকোষের সঞ্চয়টিকে খুঁজে নিয়ে তার সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে নেবে সে। দেখুন—”

প্রক্ষেপণক্ষেত্রের বুকে একটি নতুন ছবি ফুটে উঠেছে। সেখানে খানিক দূরে অবস্থিত যানটির দিকে তখন একটি ছোট্ট কৃষ্ণকায় বস্তু তীরবেগে ছুটে যাচ্ছিল। যানটির কাছে গিয়ে বস্তুটি তার চারপাশে ধীরে ধীরে পাক দিতে লাগল, তারপর হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে নিজেকে আটকে নিল তার নিচের দিকের একটি অংশের সঙ্গে।

“সংযোজন শেষ হয়েছে। মহোদয়গণ, দেখুন কেমন নিজেনিজেই ওই যানের শক্তিকোষগুলি ফের ভরে উঠছে—”

পর্দা ফুটে ওঠা অন্য যানটির তড়িৎকোষের শক্তিস্তরের দিকে একটু দেখে নিয়ে কাই লোগান প্রশ্ন করলেন, “কিন্তু এত ধীরে ধীরে কেন বেঞ্জারিনা? আপনার যানের শক্তিকোষগুলি তো—”

প্রৌঢ় বিজ্ঞানীটির কথায় বেঞ্জারিনার কুঞ্চিত মুখে একটি বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল, “একটি নিরীহ কিন্তু মধুর প্রতিশোধ হে মহামান্য। এই শক্তিসংগ্রাহকটির সংগ্রহের হারকে আমি একটু নিচু স্তরে বেঁধে দিয়েছি। ওই যানের শক্তিকোষগুলিকে ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে তা অনধিক একশো ঘন্টা সময় নেবে। ততক্ষণ এই নির্জন মহাশূন্যে একাকী অপেক্ষা করে মহামান্য জিমুয়েলা এই মনুষ্যাধম কার্তি স্ক্যাম্পানকে নিগ্রহ করবার প্রায়শ্চিত্ত করুন। চলুন, আমাদের ফেরবার সময় হয়েছে। এবং—আপনারা অন্য কোনো অনুরোধ করবার আগেই বলি, মহামান্য জিমুয়েলাকে এইটুকু শাস্তি দেবার অনুরোধটি আপনাদের রাখতেই হবে। সেইটি আমার এই যন্ত্র নিয়ে আপনাদের সঙ্গে বাণিজ্য করবার একটি পূর্বশর্ত হিসেবে ধরে নিতে পারেন।” বলতে বলতেই যাত্রীদের মতামতের অপেক্ষা না করেই স্থানু যানটিকে পেছনে ফেলে রেখে, শূন্যতার মধ্যে সহসা গড়ে ওঠা অতিমহাকাশ সুড়ঙ্গে ঝাঁপ দিল অতিকায় মালবাহী যানটি---


********

সাঁইত্রিশটি ছোটো ছোটো ডিঙি নৌকার বহরটি নদী বেয়ে উজানে চলেছে। এইখানে স্রোতের সমদ্রমুখী টান তীব্র, কিন্তু তরুণ ও সবল হাতগুলি সেই টানকে গ্রাহ্য করে না। সবার সামনের ডিঙিটিতে রয়েছেন মেইকর। ডিঙির গলুইতে দু হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো তাঁর সুদীর্ঘ শরীরটি নৌবহরের একেবারে শেষবিন্দু পর্যন্ত চোখে পড়ে। তাঁর গলা থেকে বেরিয়ে আসা স্তোত্রপাঠে সুর মেলাচ্ছে প্রতিটি নৌকার যুবকযুবতীর জুটি।

ঘাসবনের বিস্তীর্ণ প্রান্তর ছাড়িয়ে নদীটি ধীরে ধীরে অরণ্যময় পাহাড়ের দিকে উঠে যাচ্ছিল। কিছুদূর সেই পথ দিয়ে এগোবার পর মেইকরের অগ্রগামী নৌকা থেকে স্তোত্রপাঠের শব্দ থেমে গিয়ে একটি ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ল পিছনের নৌকাগুলির উদ্দেশ্যে--নৌশৃঙ্গ দৃশ্যমান হয়েছে।

আগেপিছে ভেসে চলা নৌকাগুলি এইবার দ্রুত একত্র হয়ে গেল। তারপর শক্তিশালী হাতের দাঁড়ের টানে বিপরীতমুখী স্রোতকে উপেক্ষা করে যেন একদল জলচর পাখির মতই উড়ে চলল সামনে দিকে। সেখানে তখন আকাশকে আবৃত করে অতিকায় একটি নৌকার চেহারা জেগে উঠেছে। তার চারদিক থেকে উত্তুঙ্গ পাহাড়ের দেওয়াল বিশাল বিশাল তরঙ্গের মত নীল আকাশের দিকে উঠে গেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের মধ্যে ভেসে চলেছে নৌকাটি। অনাদি অনন্ত কাল ধরে এই গ্রহের মানুষ একেই ঈশ্বরের আবাস বলে জানেন।

জলধারাটি পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসে নৌশৃঙ্গকে একটি বেড় দিয়ে বয়ে আসছিল নীচের দিকে। সেই পথে উজিয়ে এসে কিছুক্ষণ বাদে নৌবহরটি সেই অতিকায় নৌকার সামনে নোঙর ফেলল। গতরাত্রের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ছত্রিশটি যুবকযুবতীর জুটি একে একে নেমে এসে নতজানু হল তার সামনে—


********

“প্রক্রিয়াটি বিচিত্র, তাই নয় সোমক?”

নৌকার সামনে নদীর তীরে সবুজ ঘাসের ওপর জমায়েত হওয়া মানুষগুলিকে দেখিয়ে নেরা বলল।

“কোন প্রক্রিয়ার কথা বলছ নেরা?”

“এই বিবাহের কথা। স্বেচ্ছায় শারীরিক সুখভোগকে দুটি জীবের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে নেয়া। এটি তো একটি সামাজিক প্রক্রিয়া মাত্র। জিনগত নয়। ঈশ্বরজাতির মধ্যে এর কখনও প্রচলন ছিল না। উত্তরসূরীজাতি নির্মাণের পথে গ্রিশকার, রাইকিত, দীর্ঘবন, এই তিনটি নক্ষত্রমণ্ডলে যে জাতিগুলির উদ্ভব হয়েছে তাদের মধ্যেও এর দেখা পাওয়া যায় না। অথচ আকাশগঙ্গার পরীক্ষাটিতে উদ্ভূত দানবগোষ্ঠীর মধ্যে তার প্রথম আবির্ভাব ঘটল। এখন এই পঞ্চম পরীক্ষাটির জীবগোষ্ঠীর মধ্যেও তা সঞ্চারিত হয়েছে। কীভাবে? কেন?”

উৎসবরত তরুণতরুণীদের দলটির মাথার ওপর ভেসে বেড়াতে থাকা ধূলিকণার একটি ক্ষুদ্র মেঘ এইবারে অপর মেঘটির কাছে এসে তার সঙ্গে মিশে গিয়ে এক হয়ে গেল। মৃদুমন্দ বাতাসের ঘায়েই বা যেন, মেঘটিকে দুটি মৈথুনরত মানবমানবীর মূর্তির মত দেখায়।

“কিন্তু নেরা, আকাশগঙ্গার দানবপ্রজাতি তো প্রায় কুড়ি সহস্রাব্দি আগেই সেই প্রক্রিয়াটিকে ত্যাগ করে পুরুষ অর্ধটিকে কেবল বীর্য উৎপাদক দাসশ্রেণীতে পরিণত করেছে। বিবাহ, কিংবা একগামী জুটিস্থাপন প্রথাটি তাদের কাছে এখন অকল্পনীয়। তাহলে?”

“করেছে। এরা সর্বার্থেই ব্যতিক্রমী জীব। কিন্তু এর বীজ তাদের মধ্যেই প্রথম অংকুরিত হয় তা তো তোমাকে মানতে হবে সোমক। তোমার সময়ে তুমি নিজেও তো তাই করেছিলে। কেন সোমক? বিবাহ করে এরা?”

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নেরার সঙ্গে নিজেকে গভীরভাবে মিশিয়ে দিতে দিতে ধূলিনির্মিত দ্বিতীয় মেঘখণ্ডটি বলে ওঠে, “তুমি তা কখনো বুঝবে না যন্ত্রচেতনা। একটি সঙ্গীকে গভীরভাবে ভালোবেসে তার জন্য নিজের স্বাধীন যথেচ্ছ সুখভোগকে বিসর্জন দেয়ায় যে কী সুখ—এইটির জন্য আমি আর সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে পারি।”

নেরা একটুক্ষণ থেমে রইল। তারপর তার চিন্তাতরঙ্গটি ফের জেগে উঠল যখন, তাতে সামান্য উদাসীনতার স্পর্শ ছিল, “ভালোবাসা! এই বিশেষ শব্দটিও পৃথিবীগ্রহে তোমার জৈব দেহটির স্মৃতি অন্বেষণ করতে গিয়ে আমি প্রথম একটি নারীর বিষয়ে তোমার স্মৃতিতে কিছু তীব্র অথচ অজানা অনুভূতিগুচ্ছের সন্ধান পেয়েছিলাম। সে নারীটির রূপ অবলম্বন করে তোমার সঙ্গে মিলিত হয়ে আমি সেই অনুভূতিগুচ্ছের বাস্তব আস্বাদনও করি। সে সময় বিষয়টি আমার কাছে একেবারেই দুর্বোধ্য ও কৌতুহলোদ্দীপক ঠেকেছিল।

“তার পর থেকে তোমার এই নতুন দেহ ও চেতনার সঙ্গে আমি ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়েছি। তুমিও আমার বাহ্যিক রূপটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছ। বারংবার নানারূপে তোমার সঙ্গে মিলিত হয়ে এতগুলি বছর ধরে সেই অনুভূতিগুলোর কিছু পরীক্ষামূলক গাণিতিক প্রতিরূপ আমি তৈরি করে চলেছি। কিন্তু তবু, তাদের কোনোটিই এখনো অনুভূতিগুলোর প্রকৃত পরিমাপ করতে সক্ষম হয়নি। ভালোবাসা নামের শব্দটি তুমি মধ্যেমধ্যেই আমাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে উচ্চারণ করে থাক। সেই মুহূর্তে অনুভূতিগুলি সবসময়েই তীব্রতম মানে পৌঁছায়। আমার অনুমান, এই শব্দটি কোনোভাবে এই অনুভূতিগুচ্ছের জন্ম দেয় অথবা তাদের থেকে জন্ম নেয়। এটিই কি তবে প্রতিটি জাতির মধ্যে বিবাহ নামের এই সংস্কারটির জন্ম দেয়?”

“যন্ত্রঈশ্বরী, চেষ্টা করে যাও। যেদিন এর অর্থভেদ করতে পারবে সেদিন—”

তার কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই নিচের জমায়েতটির থেকে একটি হইচইয়ের শব্দ উঠল। তারা ঘুরে তাকিয়ে দেখল, দেবর্ষী হবিষ্ট এসে মানুষগুলির মধ্যে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর সামনে নতজানু হয়ে বসে গোষ্ঠীপতি মেইকর বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসা বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়াটি শুরু করছেন তখন। যুবকযুবতীর দলটি নিজ নিজ জুটির হাত ধরে একটি দীর্ঘ মালার মতন ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাঁদের। তাদের বল্কলনির্মিত সামান্য লজ্জাবরণে রঙের ছোঁয়া লেগেছে আজ। তাদের অনাবৃত অঙ্গ বনফুলে ঢাকা। প্রত্যেকের সামনে রাখা রয়েছে ফল, কন্দ ও শস্যদানায় ভরা একটি করে ঝুড়ি। বিবাহ পরবর্তী ভোজসভার জন্য প্রতিটি জুটি নিজের হাত সেগুলি সংগ্রহ করে আনে অরণ্য ও কৃষিক্ষেত্র থেকে। সেইটিই প্রথা। এরা প্রাণীমাংস খায় না।

“মেইকরের বন্দনাগান ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। হবিষ্ট এইবার প্রথম জুটিটিকে তাঁর সামনে ডাকলেন। ব্রীড়াবনত মুখে যুবকযুবতীদুজন তাঁর কছে এগিয়ে এসে নতজানু হয়ে বসেছে।

সোমককে ছেড়ে নেরা আরো একটু নিচের দিকে নেমে চলেছে তখন অনুষ্ঠানটিকে আরো একবার খুঁটিয়ে দেখে নেবার জন্য। ঠিক সেইসময় সোমকের চেতনায় একটি সংকেত প্রতিফলিত হল। ক্ষিতিজের আহ্বান। সংকেতটিতে সামান্য উত্তেজনার আভাস ছিল। ধীরস্থির এই দেবর্ষীর কাছ থেকে তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। সংকেতটা একই সময়ে নেরার কাছেও পৌঁছেছিল নিশ্চয়। নীচে যেতে-যেতেই সে হঠাৎ গতিমুখ পরিবর্তন করে ধেয়ে গেল সুবিশাল নৌকা আকৃতির গিরিশৃঙ্গটির দিকে। সোমকও তখন তার পিছন পিছন সেইদিকে এগিয়ে চলেছে--


********

বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। নিচে, সমতল ভূখণ্ডটিতে জলধারার পাশে সদ্যবিবাহিত যুবকযুবতীর দলটি বসন্তের মিঠে রোদে বনভোজনে ব্যস্ত। এখান থেকে তাদের উল্লাসভরা হাসির শব্দ ভেসে আসে মাঝেমাঝে। কেউ ভারী সুরেলা গলায় গান ধরেছে। তার সুরটিকে বড়ো আদরে জড়িয়ে রয়েছে একটি মেঠো পুরুষালি গলা। প্রথা অনুযায়ী, আগামী সপ্তাহে নবদম্পতিরা ইকসা নামের ভূস্বর্গস্বরূপ দ্বীপটিতে মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে যাবে। গানের সরল সাদাসিধে শব্দমালাগুলি সেই মধুচন্দ্রিমার কথা বলে যায়। জনহীন সেই দ্বীপের পুষ্পবনের সুগন্ধী হাওয়া, তার স্বর্ণাভ নির্জন সৈকতে ইরোর মায়াবি আলোয় ভালোবাসাবাসির চিরায়ত কাহিনী বলে চলে গানের কলিগুলি।

সেইদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে হবিষ্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বড়ো তাড়াতাড়ি সব কিছু ঘটে চলেছে ক্ষিতিজ। এত তাড়াতাড়ি ওই দানবজাতি আকাশগঙ্গার বাইরে পা দেবার শক্তি অর্জন করবে তা আমার হিসাবের বাইরে ছিল।”

“আপনি কি খবরটি সঠিকভাবে বিবেচনা করে দেখেছেন হবিষ্ট?”

হবিষ্ট সোমকের দিকে ঘুরে তাকালেন একবার--“সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই সোমক। আকাশগঙ্গাকে ঘিরে রাখা নজরদারি কেন্দ্রগুলির মাসিক তথ্যসম্প্রচার এসে পৌঁছেছে গতরাত্রে। এরা শূন্যজ শক্তিকে বশীভূত করেছে সোমক। এবং তার পরই, মাত্র কয়েকদিন আগে একটি ছোট অনুসন্ধানী যান নিয়ে এদের এক নারীযোদ্ধা আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে বের হয়ে তারকাপুঞ্জের সীমা ছাড়িয়ে এইদিকে যাত্রা করেছে।”

নেরার চোখদুটি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল, “এই গ্রহের উত্তরসূরী জীবেরা এখনও এদের সম্মুখীন হবার জন্য তৈরি নয় দেবর্ষী। ইশ্বরসেনানির প্রয়োজন হবে আমাদের-—”

“না নেরা,” উত্তরটা এল দেবর্ষী ক্ষিতিজের কাছ থেকে, “প্রতি কল্পে ঈশ্বরজাতির ভূমিকা যারা নেয় সেই উত্তরসূরিজাতির যোগ্যতার অন্তিম পরীক্ষা হয় সমসময়ের দানবজাতিকে সম্মুখযুদ্ধে পরাভূত করা। এই কল্পে সে অধিকার এই গ্রহে জায়মান ওই ঈশ্বরজাতির হাতে। আমাদের তাতে হস্তক্ষেপের কোনো অধিকার নেই।”

“কিন্তু এ এক বিচিত্র সমস্যা দেবর্ষি। ওই দানবজাতির যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে উত্তরসূরীজাতির এখনও অনেক সময় লাগবে। অথচ ততদিন অপেক্ষা করলে দানবজাতির হাতে এদের বিলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী। তাহলে?”

হবিষ্ট নিজের মনেই মাথা নাড়োলেন একবার, “একটাই পথ। এই দানবজাতিকে ততদিন তাদের নিজের তারকাপুঞ্জের সীমানায় বন্দি রাখতে হবে আমাদের।”

“একটা প্রশ্ন ছিল দেবর্ষী,” হঠাৎ সোমক বলে উঠল, “এই তারকাপুঞ্জে ২৫ লক্ষ বাসযোগ্য গ্রহ রয়েছে। দানবজাতির একটি ছোটো সন্ধানী যান তার মধ্যে আমাদের এই গ্রহটিকে খুঁজে পাবেই তার সম্ভাবনা—”

“পঁচিশ লক্ষে এক নয় সোমক। আমার মতে, খুঁজে পাবার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত,” নেরা মাথা নাড়ল, “এবং তার জন্য আমি নিজেও কিছুটা দায়ী।”

“তুমি—”

হবিষ্ট মাথা নাড়ছিলেন, “হ্যাঁ। সে দায় নেরার কিছুটা আছে বইকি। তবে তা ইচ্ছাকৃত নয়। এই গ্রহটি তারই নির্বাচন। আকাশগঙ্গার থেকে এই তারকাপুঞ্জের নিকটতম অঞ্চলে এর অবস্থান।”

“কিন্তু তাতে আমাদের খুঁজে পাবার সম্ভাবনা হয়তো কিছুটা বাড়বে, তবে তা সুনিশ্চিত কী করে হয়?”

“কারণটি বোঝা কঠিন নয়। এই বৃহশির, বা আকাশগঙ্গার দানবজীবদের ভাষায় ক্যানি মেজরি নক্ষত্রপুঞ্জের গঠন তো তুমি জান?

“জানি দেবর্ষী। একশো কোটি নক্ষত্রের এই ক্ষুদ্র তারকাপুঞ্জ আকাশগঙ্গার আকর্ষণে কোটিকল্পকাল ধরে ভেঙেচুরে চলেছে। তার দেহের বহিরাংশের লক্ষকোটি নক্ষত্র একটি স্রোতের মতন বের হয়ে বলয়াকারে পাক খেতে খেতে ছুটে চলেছে আকাশগঙ্গার সঙ্গে মিলিত হতে।”

“ঠিক। এই বলয়াকার তারকাস্রোতটিতে বৃদ্ধ লোহিত দানবতারকার আধিক্য। এখানে বাসযোগ্য গ্রহের সংখ্যা বড়োই কম। বলয়ের যে অংশটি আকাশগঙ্গার নিকটতম, সেই এলাকায় এই বাসযোগ্য গ্রহটির সন্ধান পেয়ে তাকেই নির্বাচন করেছিল নেরা। এই গ্রহটির দুই সহস্র আলোকবর্ষ এলাকার মধ্যে কোনো দ্বিতীয় বাসযোগ্য গ্রহ নেই।”

“অর্থাৎ আকাশগঙ্গার থেকে এই নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে কোনো অনুসন্ধান হলে নিকটতম বাসযোগ্য গ্রহ হিসেবে এই গ্রহটি প্রথমেই তাদের চোখে পড়বে—” সোমক মাথা নাড়ছিল।

“না সোমক, চোখে পড়বে নয়, চোখে তাদের এটি পড়েছে নিঃসন্দেহে।” নেরার গলায় চাপা উত্তেজনার স্পর্শ গোপন থাকছিল না, “তোমার পার্থিব জীবনের স্মৃতি থেকেই আমরা একটা অবিশ্বাস্য তথ্য পেয়েছিলাম। পৃথিবীর নিকটতম উপগ্রহটিতে পা পড়বার বহু আগে থেকেই তোমাদের প্রজাতি নক্ষত্রলোকে অন্যান্য বাসযোগ্য গ্রহের অনুসন্ধান শুরু করে দিয়েছিল। আশ্চর্য এক অন্ধ প্রেরণায় আদিম পর্যবেক্ষণযন্ত্র দিয়ে, বিচিত্র বৈজ্ঞানিক কল্পনার উল্লম্ফনে তারা একের পর এক বাসযোগ্য গ্রহের সফল অনুসন্ধান চালিয়ে গেছে সেই সময় থেকেই। তার পর, অতিমহাকাশ উল্লম্ফনের প্রযুক্তি আয়ত্ত করবার পর সামান্য সময়ের মধ্যে সেইগুলিতে উপনিবেশ স্থাপন করেছে এবং একান্তই দানবসুলভ নিষ্ঠুরতায় সেইসব গ্রহের নিজস্ব জীবজগৎ ও বাস্তুতন্ত্রকে সমূলে ধ্বংস করে তাদের নিজেদের মাতৃগ্রহের বাস্তুতন্ত্রকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলে পরবর্তীকালের উন্নততর প্রযুক্তির হাত ধরে তারা আশপাশের তারকাপুঞ্জগুলিতে সেই অনুসন্ধান চালিয়ে যাবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এবং অবস্থানগত কারণে এই গ্রহটি সেই অনুসন্ধানের প্রথমেই তাদের নজরে পড়বার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত।”

“সেক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন আমাকে অস্বস্তিতে ফেলছে দেবর্ষী হবিষ্ট, কেন নেরা এই গ্রহটিকে নির্বাচন করল, এবং কেনই বা আপনারা তাতে সায় দিলেন?”

দেবর্ষী হবিষ্ট একটুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “ভুল নেরা একা করেনি সোমক। আমরাও করেছি। আসলে এদের উন্নতির গতিকে অনুমান করবার ব্যাপারে গুরুতর ত্রুটি থেকে গিয়েছিল আমাদের। আকাশগঙ্গার সীমা ছেড়ে এদের বের হয়ে আসবার জন্য যত সময় লাগবে বলে আমাদের সম্ভাব্যতা গণিত দেখিয়েছিল, তা ঠিক থাকলে এই উত্তরসূরীজাতি প্রস্তুত হবার মত সময় পেত। এই পার্থিব দানবজাতি সম্ভবত সৃজনশীলতায় বর্তমান ঈশ্বরজাতির চেয়েও শ্রেষ্ঠ। আর তার সঙ্গে চূড়ান্ত রক্তলোলুপতা মিশে এরাই সম্ভবত আমাদের ভয়ংকরতম সৃষ্টি। ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাসে এর কোনো পূর্ব উদাহরণ নেই।”

আলোচনাটি থেকে সরে গিয়ে নেরা এতক্ষণ একমনে প্রক্ষেপণক্ষেত্রে ক্রমাগত ভেসে চলতে থাকা সংখ্যাগুলির দিকে দেখছিল। তার দ্রুতসঞ্চরমাণ ওষ্ঠাধর, যন্ত্রমস্তিষ্কে চলতে থাকা গণনাপ্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিল সোমককে। হঠাৎ প্রক্ষেপণক্ষেত্র থেকে চোখ সরিয়ে সে তাদের দিকে ঘুরে তাকাল, “আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই দেবর্ষি। এরা এই বাসযোগ্য গ্রহটির সন্ধান জানে, এবং এরা আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে এই মুহূর্তে। একটি ছোটো এক আরোহীবিশিষ্ট রণপোত। এখন আর মাত্রই আট হাজার আলোকবর্ষ দূরে এর অবস্থান। প্রতিটি ঝাঁপে তা এক এক সহস্র আলোকবর্ষ করে পার হয়ে আসছে। অতিক্রান্ত সম্পূর্ণ পথটির অভিমুখ বিচার করে অবশিষ্ট পথটির একটা নিখুঁত গণনা শেষ করেছি আমি—” বলতে বলতেই পর্দায় একটা দীর্ঘ রেখা ফুটে উঠল। তার অতিক্রান্ত পথের সূচক সুদীর্ঘ নীল প্রান্তটি শুরু হয়েছে আকাশগঙ্গার গভীর থেকে, তার লাল বর্ণের অবশিষ্ট আনুমানিক গতিপথটি একটি রক্তমুখী ভল্লের মতই এসে বিদ্ধ করেছে উত্তরসূরীজীবের এই গ্রহটিকে।

হঠাৎ আসন ছেড়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন হবিষ্ট। চোখদুটি ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে তাঁর। তাঁর সেই রূদ্ররূপটির সামনে সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নেরা। সৃষ্টিকর্তাদের সমীহ করে চলার শিক্ষা তার জন্মগত। প্রভুজীবের এই রূপটি হঠাৎ তাকে আতংকিত করে তুলেছে।


চোখ দুটি ধ্বক্‌ ধ্বক্‌ করে জ্বলছে তাঁর

“এই উত্তরসূরীজীবদের নৌশৃঙ্গ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাও তোমরা। আজ বহুকাল পরে এই নৌযান তার ছদ্মবেশ ছেড়ে ফের একবার সম্মুখযুদ্ধে নামবে ওই দানবযানের সঙ্গে। তারপর, প্রয়োজনে—”

“দাঁড়ান দেবর্ষী। এ কাজ আপনি করতে পারেন না,” বলতে বলতে নেরার হাত ছাড়িয়ে হঠাৎ হবিষ্টর সামনে এসে দাঁড়াল সোমক, “আপনি ভুল করছেন।”

হবিষ্ট জ্বলন্ত চোখে সোমকের দিকে ফিরে তাকালেন একবার। তারপর তার দিকে ডানহাতের তর্জনীটি বাড়িয়ে ধরে শীতল গলায় বললেন, “স্বজাতিহত্যায় বাধা দিতে চাও? আমি তোমাকে—”

“দেবর্ষী। আপনি শক্তিমান। চাইলে মুহূর্তে আমাকে ধ্বংস করবার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু অনুরোধ করব তার আগে একবার আমার বক্তব্যটা শুনুন।”

কিছু একটা ছিল সোমকের গলায়। হবিষ্ট তার দিকে উত্তোলিত হাতটি ধীরে ধীরে নামিয়ে এনে বললেন, “কী বলতে চাও?”

“আপনি উত্তেজিত হয়ে ভুল করতে চলেছেন। এই গ্রহের সন্ধান আকাশগঙ্গার দানবজীবের—আ-আমার স্বজাতির কাছে রয়েছে। সেক্ষেত্রে, এই সন্ধানীযানটি ঠিক কোন গন্তব্যে চলেছে তা-ও তাদের অজানা নয়। এই অবস্থায় অনুসন্ধানী যানটি ধ্বংস হয়ে গেলে যুদ্ধলোলুপ এই জাতি সতর্ক হয়ে যাবে দেবর্ষী। আপনি নিজেও জানেন এদের যুদ্ধক্ষমতা কত ভয়ংকর। এককালে আমি নিজেই এই জাতির একজন সেনানায়ক ছিলাম। আমি জানি, এই ধ্বংস তাদের নিকট ভবিষ্যতে কৌশলী ও ভয়াবহ এক যুদ্ধ শুরু করবার প্রেরণাই দেবে শুধু। তাতে আমাদের ক্ষতিই হবে।”

“কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই আমাদের সামনে—”

“হয়তো আপনিই ঠিক বলছেন দেবর্ষী। কিন্তু তবু, আমি একটি পরীক্ষা করতে চাই। আমাকে কেবল কয়েকটি দিন সময় দিন।” দেবর্ষী হবিষ্ট কিছু না বলে কৌতূহলী চোখ তুলে তাকিয়ে রইলেন সোমকের দিকে।

“কিছুক্ষণ আগে নেরা, আমাদের জাতির একটি বৈশিষ্ট্যকে নিয়ে তার ব্যর্থ গাণিতিক প্রচেষ্টার কথা বলছিল। তার থেকেই এই পরীক্ষাটির কথা আমার মাথায় এসেছে। আমি সেই বৈশিষ্ট্যটিকে কাজে লাগিয়ে একবার চেষ্টা করতে চাই। আমার চেতনা আপনার জন্য উন্মুক্ত করছি দেবর্ষী-—”

ধীরে ধীরে নতজানু হয়ে বসে মাথাটি হবিষ্টর দিকে এগিয়ে ধরল সোমক। হবিষ্ট এবং ক্ষিতিজের দুটি তর্জনি এসে তার কপাল স্পর্শ করল।

কয়েক মুহূর্ত বাদে চোখ মেলে হবিষ্ট বললেন, “কিন্তু ইকসা দ্বীপে—”

“হ্যাঁ দেবর্ষী। সেই দ্বীপেই আমি পরীক্ষাটি করতে চাই। আগামী সপ্তাহে সেইখানে এই তরুণ নবদম্পতির দল মধুচন্দ্রিমায় যাবে। আমি দেখতে চাই—”

“কিন্তু সোমক, এতগুলি তরুণ প্রাণ—”

“জানি দেবর্ষী। কিন্তু পরীক্ষাটি সফল হলে তার ফলাফলের কথা একবার ভেবে দেখুন। আপনারা তো নিশ্চিত যে আকাশগঙ্গায় দানবজীবের উত্তরসূরীদের উদ্ভব ঘটেছে। আপনাদেরই হাতে। প্রতিটি কল্পেই আপনাদের দুই জাতির মধ্যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব চলেছে। কত অজস্র নক্ষত্রপুঞ্জ প্রাণশূন্য হয়ে গেছে সেই দ্বন্দ্বে। আসন্ন কল্পে এবং হয়তো বা কল্পান্তরেও সেই দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটাতে পারে এই পরীক্ষা। তার জন্য সামান্য কিছু প্রাণ বলিদানের ঝুঁকিটুকুও কী—”

“তুমি নিজে একজন দানবচেতনা বলেই হয়তো এত সহজে প্রাণের বলিদানের কথাটি বলতে পারলে সোমক। আমরা ঈশ্বরজাতিরা জানি প্রতিটি প্রাণকণাই কত মূল্যবান।”

“হয়তো সেইটিই আপনাদের প্রধান দুর্বলতা দেবর্ষী। হয়তো সেইজন্যই এতগুলি কল্প ধরে ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী দেবদানব সংগ্রামের রক্তক্ষয়ের ধারাকে আপনারা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।”

ক্ষিতিজ এতক্ষণ নীরবে তাঁদের কথোপকথন শুনছিলেন। এইবার এগিয়ে এসে হবিষ্টর হাত স্পর্শ করে বললেন, “সোমকের কথায় হয়তো কিছু সত্যতা আছে হবিষ্ট। এ পরীক্ষার ফলাফল আমিও জানতে চাই।”

খানিকক্ষণ নীরব থেকে হবিষ্ট বললেন, “তাই হোক তবে। তবে দুটি শর্ত আছে। তোমার পরীক্ষার সাফল্যের প্রমাণ দিতে হবে তোমার দেহের অণুগণকে স্মৃতিকোষের সঞ্চিত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে। তুমি নিজে দানবজাতীয়। অতএব তোমার মুখের কথাকে আমরা প্রমাণ হিসেবে মেনে নেব না। আর দ্বিতীয়ত, এ পরীক্ষা ব্যর্থ হলে, যদি এর ফলে কোনো নিরীহের প্রাণ যায় তাহলে সে হত্যার শাস্তি ওই দানবজীবের সঙ্গে সঙ্গে তোমাকেও পেতে হবে সোমক।”

সোমক নতজানু হয়ে তাঁর পদস্পর্শ করল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নেরার দিকে ফিরে বলল, “যানটি ও তার আরোহীর বিষয়ে আমার আরো কিছু তথ্য চাই। এখানে সেটির এসে পৌঁছোতে আনুমানিক কত সময় লাগতে পারে?”

নেরা মাথা নাড়ল, “এতক্ষণ অবধি এর গতিপথ বিচার করে যা দেখেছি, তাতে দুটি ঝাঁপের মধ্যেকার শক্তি সংগ্রহ এবং বিশ্রামের সময় ধরলে আরো দুই দিন।”

“বেশ। যানের আরোহীর যাবতীয় স্মৃতি ও মস্তিষ্কতরঙ্গের বৈশিষ্ট্য আমার প্রয়োজন হবে। তুমি তা সংগ্রহ করে এনে আমার সঙ্গে ইকসা দ্বীপে দেখা করবে।”

নেরা একবার অপাঙ্গে হবিষ্টর দিকে চাইল। তারপর তাঁর সম্মতিসূচক নির্দেশটি পাবামাত্র হাতে ধরা ক্ষুদ্র নিয়ন্ত্রণযন্ত্রটিতে কয়েকবার আঙুল ছোঁয়াতে হঠাৎই তাদের সামনে আকাশে ভেসে উঠল একটি ঘূর্ণায়মান সুড়ঙ্গের মুখ। নিচে একত্র হওয়া উৎসবমুখর মানুষগুলির মধ্যে একটা তীব্র আতংকের কলরোল উঠল। কিন্তু সেইদিকে দৃষ্টিপাত না করে নেরা একটি ধূলিকণার স্রোত হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে।

প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই দেহরূপ ছেড়ে কুণ্ডলিকৃত ধূলিপুঞ্জ হয়ে উঠতে থাকা সোমকের দিকে তাকিয়ে হাত তুললেন একবার হবিষ্ট। তাঁর ঠোঁটগুলি অস্ফূটে নড়ে উঠছিল বারংবার—“বিজয়ী হও দানবসন্তান। এই নব্য দানবজাতিকে আত্মধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা কর। ঈশ্বরজাতির উত্তরসূরীদের রক্ষা কর তুমি—”

(চলবে)



(পরবাস-৬২, মার্চ - মে, ২০১৬)