“সত্যম শিবম সুন্দরম” — কার কণ্ঠস্বর? ও কার কণ্ঠস্বর?
ওই নিঝুম নিথর নিস্তব্ধতায় ও কার গলা শোনা যায়?
ওই গভীর জঙ্গলে? বট অশ্বত্থের ঘন বনে?
কেউ তো সেখানে নেই! কোনো জনমানুষের চিহ্নমাত্রও নেই!
সামনে কেবল একটা বিশাল বটগাছ — তার অজস্র ঝুরি — একটা জং-ধরা প্রকাণ্ড ত্রিশূল আর একটা ভাঙাচোরা পাখির খাঁচা সেই ঝুরির মধ্যে কি অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে আছে — যেন পরম মমতায় শিকড়বাকড়গুলো আঁকড়ে রয়েছে ওই দুটিকে — আর ওখানেই — ওর কাছে গিয়েই কান পাতলে যেন শোনা যাচ্ছে — “সত্যম শিবম সুন্দরম” — দেখা যাচ্ছে স্থির হয়ে থাকা একটি কাহিনী — একটি অসার কাহিনী —
বহুকাল আগের কথা। বাংলাদেশেরই এক ছায়াসবুজ অখ্যাত গ্রাম। সেখানে বাস করতো অল্প কিছু মানুষ।
জয়রাম ভটচাজ তাদের মধ্যে একজন। পাটের দড়ির মতো পাকানো চেহারা। লম্বা ফরসা আর মাথায় এক ঝাঁকড়া চুল। খাড়া নাক তোবড়ানো গাল। কিন্ত চোখদুটো যেন অদ্ভুতভাবে ঝকঝক করছে। যজমানি আর টোলের ছাত্র পড়ানো ছিলো তার জীবিকা। অতি সাধারণ মানুষ হয়েও জয়রাম ভটচাজ ছিলেন তাঁর আশেপাশের মানুষদের থেকে কিছুটা অন্যরকম। পুরুতগিরি থেকে ছাত্র পড়ানো সবকিছুতেই ছিলো তাঁর অসম্ভব রকমের নিষ্ঠা ও সততা। এই ব্যাপারে সামান্যতম আপোষও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। এই ভাবে জীবনযাপন করতে গিয়ে আশেপাশের কারো সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠলো না। এমনকী নিজের পরিবার সন্তানদের সঙ্গেও না। কিন্তু এই নিয়ে কোনও আক্ষেপ ছিলো না তাঁর। নিজের মতো একলা চলতেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।
অবশ্য একেবারে একলা নয়। দুটি ছিলো তাঁর সর্বক্ষণের সাথী। এক, তাঁর ইষ্টদেবতা মহাদেব। আরেক, তাঁর মদনমোহন। সারাদিনে অন্তত দুবার মহাদেবের ধ্যান করতেন। সর্বদা একটা প্রকাণ্ড ত্রিশূল হাতে নিয়ে ঘুরতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিলো তাঁর ইষ্টদেবতা মহাদেব বিরাজ করছেন ওই ত্রিশূলে। কোনো দুঃখ দুর্দশা কিংবা সমস্যা এলে ওই ত্রিশূলটাকে শক্ত করে ধরে বলতেন — “সত্যম শিবম সুন্দরম — শিবশম্ভু তুমিই মুক্তির পথ দেখাও।" এই কথাগুলি উচ্চারণ করে তিনি যেন নিজের মধ্যে আশ্চর্য শক্তি পেতেন। অন্তত তাই ছিলো তাঁর বিশ্বাস। অতি গভীর বিশ্বাস।
আত্মীয় প্রতিবেশীরাও জানতো এই ব্যাপারটা। তাই জয়রামের ফ্যাসফ্যাসে গলায় ওই “সত্যম শিবম” শুনলেই তারা বলতো — “এই রে — বুড়ো আবার কোনো বিপদে পড়েছে।”
জয়রামের সত্যিকারের আপনজন বলতে ছিলো একমাত্র মদনমোহন। সন্তানের চেয়ে বেশি স্নেহের। স্ত্রীর চেয়েও বেশি ভরসার। প্রিয় বন্ধুর চেয়েও বেশি আন্তরিক — এই মদনমোহন। একটা টিয়াপাখি। যজমানি আর টুলো পণ্ডিতির ফাঁকে জীবনে যতটুকু পড়ে থাকতো তার পুরোটাই কাটতো ওই পাখিটাকে নিয়ে। নিজে হাতে তাকে সময়মতো খাবার দেয়া — ঠিক সময়ে চান করানো — রোদে বসানো আর তার ফাঁকে তার সঙ্গে অনর্গল বকবক করা তাঁর রোজকার কাজ।
আর কী সেই বকবকানির বিষয়বস্তু — সকালসন্ধে রোদহাওয়াবৃষ্টির থেকে শুরু রামায়ণ মহাভারতের গল্প — এমনকি রামপ্রসাদী গানের তত্ত্বকথা পর্যন্ত তিনি সমানে বলে যেতেন পাখিটির সঙ্গে। আর পাখিটাও মাঝে মাঝেই নানা রকমের সুর করে আওয়াজ করতো। তাতে জয়রাম কী খুশিই না হতেন — “ঠিক বলেছো মদনমোহন — কী বুদ্ধিমান ছেলে তুমি তাই ভাবি।” পাড়াপড়শি আর আত্মীয়স্বজনের কাছে ব্যাপারটা ছিলো অতি হাস্যকর। কেউ কেউ অবশ্য বলতো — “বেচারা আর কি করবে — বউ-ছেলেপুলেরা তো খোঁজও করে না — এই পাখিটাই তো ওর সংসারের একমাত্র বন্ধন।”
এইভাবে সুখেদুঃখে নিজের মনে দিন কাটতো জয়রামের। যখন তিনি খুশি থাকতেন — শান্তিতে থাকতেন — তখন গলা ছেড়ে গান গাইতেন — “আমি অভয়পদ সার করেছি, ভয়ে হেলবো না দুলবো না গো” — আর বলতেন — “মদনমোহন তুমিও গাও দেখি —”
কিন্তু মাঝেমাঝেই অশান্তি এসে জুটতো। কখনো যজমানের ছোটোবড়ো কথা — কিংবা টোলের ছেলেপুলেদের চরম অসভ্যতা মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। জয়রাম তখন ওই ত্রিশূলটা শক্ত করে ধরে বলে উঠতেন — “সত্যম শিবম সুন্দরম।” তারপর সেটিকে সামনে খাড়াই করে রেখে চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসতেন তিনি।
কখনো-সখনো জয়রাম খাঁচাসমেত পাখিটাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়তেন। তখনো অবশ্য তাঁর সঙ্গে থাকতো ওই ত্রিশূলটা। কারণ জয়রামের স্থির বিশ্বাস ছিলো যে ওই ত্রিশূলটা তাঁকে সবরকম বিপদ আপদের থেকে রক্ষা করবে। আর মদনমোহন তো তার সবচেয়ে আপনজন। তাই খাঁচা খোলা রইলো কী রইলো না তাতে কিছুই আসতো যেতো না। পাখিটাও মাঝে মধ্যে খাঁচা থেকে বেরিয়ে উড়ে বসতো জয়রামের কাঁধে । জয়রাম হই হই করে বলে উঠতেন — “কী গো মদনবাবু —একটু নদীর ধারে ঘুরতে যাবেন নাকি?”
একহাতে খাঁচা আর অন্য হাতে ত্রিশূল নিয়ে জয়রাম যখন বাইরে বেরোতেন, তখন মনে হোত যে এক হাতে মোহ আর অন্য হাতে মুক্তির নিশান নিয়ে এক পাগলা চলেছে নিরুদ্দেশে।
সেটা ছিলো একটা সত্যিই খুসির দিন। প্রায় পাঁচদিন ধরে একটানা দিন নেই রাত নেই বৃষ্টির পরে সেদিন সকালে আশ্চর্য হলুদ আলোয় সূর্যের মুখ দেখা গেলো। চারিদিকে যেন একটা মিষ্টি গন্ধভরা বাতাস বইতে লাগলো। নাম না-জানা পাখিরা সমানে ডাকতে থাকলো। জয়রামের ঘুম ভেঙে গেলো। চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে জয়রাম বললেন — “আজকের দিনটা বড়ো সুন্দর। চলো মদনমোহন — একটু বেড়িয়ে আসি।” পাখিটাও যেন তক্ষুণি সায় দিয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডেকে উঠলো।
স্নান করে মহাদেবের পুজো সেরে জয়রাম বেরিয়ে পড়লেন। একহাতে খাঁচায় মদনমোহন। অন্যহাতে সেই ত্রিশূল। আর কাঁধে একটা ঝোলা। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে উনি বলে উঠলেন — “জয় শিবশম্ভু — সবই তোমার খেলা। সত্যম শিবম সুন্দরম।” পাশ থেকে এক পড়শি দেখতে পেয়ে বললো — “মাথাটা পুরোটাই গেছে।” জয়রাম বেরিয়ে পড়লেন। গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীর ধারের যেখানটায় গাছের সারি সবচেয়ে ঘন হয়ে আছে সেটির এক কোনায় ছিলো একটা পাথরের ঢিবি। এই জায়গাটা ছিলো জয়রামের অতি প্রিয়। জয়রাম এসে বসলেন সেই ছায়াঘেরা জায়গাটায়। টিয়াপাখিটাও একটু বাদেই এসে বসলো তার কাঁধে। তিনি গুনগুন করে গাইতে লাগলেন তাঁর প্রিয় রামপ্রসাদী। তার মদনমোহনও যেন সঙ্গে সঙ্গে তারিফ করে শিস দিয়ে উঠলো।
তারপরেই পাখিটা উড়ে গিয়ে বসলো সামনের গাছের ডালটায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকলো এদিক সেদিক। জয়রাম তখন চোখ বুজে নিজের সুরে নিজেই মত্ত। একটু বাদে চোখ খুলে দেখলেন তাঁর মদনমোহন বসে আছে বেশ দূরের একটি উঁচু ডালে। “আর উঁচুতে যেও না মদন। নেমে এসো। এবার বাড়ি যাবো।” এই বলে জয়রাম শূন্যে খাঁচাটা নাড়তে থাকলেন। এটা একটা জয়রামের অতি-ব্যবহৃত পদ্ধতি। সাধারণত দু একবার এইভাবে ডাকার পরেই পাখিটা উড়ে নেমে আসতো জয়রামের কাঁধে। তারপর নিজে থেকেই ঢুকে পড়তো তার খাঁচাটায়। কিন্তু এইবার তার আর কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। জয়রাম একটু অবাক হলেন। তারপর দৌড়ে এগিয়ে গেলেন ওই গাছটির নীচে। খাঁচাটি দুলিয়ে বলতে থাকলেন — “নেমে এসো। নেমে এসো মদনমোহন। এবার বাড়ি যেতে হবে।” তখুনি পাখিটা উড়ে এসে বসলো অনেকটা নীচু একটা ডালে। জয়রাম উৎসাহিত হয়ে বলতে থাকলেন — “এই তো আমার মানিকসোনা — আমার মদনরাজা — কি সুন্দর চলে এসেছে।” পাখিটা তখনই উড়ে গিয়ে জয়রামের গায়ে একটা পাখার ঝাপটা দিয়ে সাঁ করে উড়ে গিয়ে বসলো আরো উঁচু একটা গাছের মাথায়। জয়রাম হতভম্ব হয়ে গেলেন পাখিটার এই আচরণে। জয়রাম গলা তুলে বললেন — “কি হোলো মদন? কি হোলো?” পাখিটা ওই গাছের মাথা থেকেই চ্যাঁ চ্যাঁ করে আওয়াজ করতে থাকলো। জয়রাম এবার একটু রেগে গিয়েই বললেন — “তামাসা হচ্ছে? তামাসা হচ্ছে আমার সঙ্গে?” পাখিটাও যেন তীক্ষ্ণ স্বরে জয়রামকে ব্যঙ্গ করে ডেকে উঠলো তখুনি। জয়রাম রাগে আগুন হয়ে বললেন “বটে এত আস্পদ্দা?” তখনই জয়রাম দেখতে পেলেন মাথার উপর এক ঝাঁক টিয়া উড়ে যাচ্ছে। আর তাঁর মদনমোহন মিশে গেলো ওই ঝাঁকের সাথেই।
জয়রাম মাথা নীচু করে নিলেন। তারপর ত্রিশূলটাকে শক্ত করে ধরে তার ফলাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলেন — “সত্যম শিবম সুন্দরম।” তারপর চোখ বন্ধ করে তাঁর ইষ্টদেবতার স্মরণ করতে থাকলেন।
পাখিটা কিন্তু উড়ে গেলো না। বরং একটু বাদেই এসে বসলো জয়রামের সামনে। তাই জয়রাম চোখ খুলেই দেখতে পেলেন তাঁর এই আপনজনকে। জয়রাম আবার চোখ বন্ধ করে ত্রিশূলটাতে মাথা ঠেকিয়ে বললেন — “শিবশম্ভু—সবই তোমার কৃপা।” ততক্ষণে তাঁর মদনমোহন আবার উড়ে গেছে একটু দূরের পাতার ঝোপে। জয়রাম পা টিপে টিপে খাঁচা হাতে হাজির হলেন সেই ঝোপটার সামনে। পাখিটা যেন টের পেয়েই তক্ষুণি উড়ে গেল আরো একটু উঁচু ডালে। জয়রাম খাঁচাটা নিয়ে সেই গাছের সামনে গিয়ে প্রায় কেঁদেই ফেললেন — “কী দোষ করেছি রে আমি তোর কাছে যে তুই আমায় এত কষ্ট দিচ্ছিস?” পাখিটা নানা রকম আওয়াজ করে এ ডাল থেকে ও ডালে উড়ে বেড়াতে লাগলো। আর জয়রাম তার পিছু পিছু কখনো অনুনয় করে, কখনো চিৎকার করে, কখনো আদর করে কতো কী বলে দৌড়োতে থাকলেন। কিন্তু বেলা বাড়তে থাকলো। সূর্য মাথার উপর ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকলো। হঠাৎ জয়রামের চোখে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেলো। কাটা গাছের মতো হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলেন তিনি। ওই পাথরের ঢিবিটার পাশেই।
জয়রামের যখন জ্ঞান ফিরলো তখন রোদ পড়ে এসেছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে হু হু করে। কতরকমের পাখি ডাকছে গাছের ছায়ায় ছায়ায়। জয়রাম পড়ে ছিলেন জড়ভরতের মতো। পাখির ডাকে হঠাৎ সম্বিৎ ফিরলো তাঁর। খাঁচাটাকে নিয়ে কোনোক্রমে উঠে দাঁড়ালেন। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। তবুও জয়রাম এক হাতে খাঁচা অন্য হাতে ত্রিশূলে ভর দিয়ে টলতে টলতে এগোতে লাগলেন ওই ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে। এদিক ওদিক থেকে কত রকমের পাখির ডাক শোনা গেলো কিন্তু তাঁর মদনমোহনের অতি পরিচিত স্বরটি কখনই শোনা গেলো না।
ঘন পাতার ফাঁকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামলো। বিরাট আকাশের নিচে নিথর অন্ধকারে জয়রাম বসে রইলেন পাথরের মূর্তির মতো। বাড়ি ফেরার কথা মনেই হোলো না তাঁর। সারাদিন দু ফোঁটা জলও জোটেনি অথচ খিদে-তেষ্টার কোনো বোধই ছিলো না জয়রামের। বসে বসে ভাবছিলেন মদনমোহনকে নিয়ে সমস্ত পুরোনো কথাগুলো। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছিলো তাঁর।
আসলে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না তাঁর মদনমোহনের এভাবে চলে যাওয়াটা। অন্ধকার ক্রমশ গভীর হতে থাকলো। জয়রাম ভাবলেন — এতো অন্ধকার তো মদনমোহন দ্যাখেনি কখনো — তাই আরেকটু রাত বাড়লেই ও ঠিক নেমে আসবে নিশ্চয়ই। এই ভেবে খাঁচাটা খুলে সামনের একটা গাছের নিচে রেখে এলেন জয়রাম। তাঁর মনে হোলো হয়তো কোনো কারণে তাঁর সামনে আসতে চাইছে না সে। তাই একটু আড়াল থেকে অপেক্ষা করাই ভালো। অতএব খাঁচাটিকে একটু দূরে রেখে একটা অশথ গাছের নিচে এসে বসলেন জয়রাম।
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছিল। হু হু করে বাতাস বইছিলো। জয়রাম বসেছিলেন পাথরের মূর্তির মতো। ওই নিকষ কালো অন্ধকারে জয়রামের মনে পড়ছিলো সব পুরোনো কথা — তাঁর বাড়ির কথা — সংসারের কথা — টোলের ছাত্রদের কথা — যজমানদের কথা —আর সেই শিবমন্দিরের কথা — যেখানে রোজ ভোরবেলায় মহাদেবের ধ্যান করে তিনি তাঁর দিন শুরু করতেন। জয়রামের মনে হতে লাগলো — এত বছর ধরে এইভাবে জীবন কাটিয়ে নিজের অজ্ঞাতে বড়ো কোনো পাপ করে ফেলেননি তো? কোনো গর্হিত অন্যায় আচরণ কারো সঙ্গে? সেই ছোটোবেলা থেকে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনাগুলো তিনি আবার চুলচেরা বিচার করতে বসলেন। কোথাও যদি কিছু গলদ ঘটে থাকে। কিন্তু এতো ভেবেও জয়রাম কোনো কিছুর কূলকিনারা করতে পারলেন না। এতে তাঁর মনটা আরো ছটফট করতে লাগলো। ত্রিশূলটাকে শক্ত করে ধরে মহাদেবকে আরো গভীরভাবে স্মরণ করে শান্ত হবার চেষ্টা করতে লাগলেন। এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে। চারিদিকের গহন অন্ধকার ক্লান্ত অবসন্ন জয়রামের গাঢ় ঘুমের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো।
ঠং করে কিছু ঠোকার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো জয়রামের। জয়রাম ধড়মড় করে উঠে বসলেন। পাশে পড়ে থাকা ত্রিশূলটাকে কুড়িয়ে নিলেন শক্ত হাতে। তাকিয়ে দেখলেন রাতের অন্ধকার সামান্য ফিকে হয়েছে। অতি সন্তর্পণে তিনি এগিয়ে গেলেন খাঁচাটির দিকে। বুঝতে পারলেন যে খাঁচাটি ফাঁকাই আছে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জয়রাম আকাশের দিকে তাকালেন। ক্ষয়াটে চাঁদের পাশ দিয়ে হু হু করে ভেসে যাচ্ছে কত বিচিত্র আকৃতির মেঘের দল। নিজের অজান্তেই তিনি পৌঁছে গেলেন ওই শূন্য খাঁচাটির দিকে। তারপর যেন পরম মমতায় খাঁচাটিকে তুলে নিলেন বাঁ হাতে। আর ডান হাতে শক্ত করে ধরলেন ত্রিশূলটা। হু হু করে দু চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো জয়রামের। জয়রাম চোখ বন্ধ করলেন। সেই অন্ধকারেও দাউ দাউ আগুনের জ্বালা দু চোখে। জয়রামের শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠলো। ত্রিশূলটা আকাশের দিকে তুলে ধরা গলায় বলে উঠলেন — “সত্যম শিবম সুন্দরম।”
তখনই জয়রাম শুনতে পেলেন ঝন ঝন করে কিছু পড়ার আওয়াজ। তাকিয়ে দেখলেন দূরে দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে। জয়রাম দেখছিলেন শুনছিলেন সবই কিন্তু কিছুই যেন তাঁর বোধবুদ্ধিতে আসছিলো না। হু হু করে বাতাস বইছিলো। জয়রামের উস্কোখুস্কো চুলোগুলো বাতাসে উড়ছিলো। পরনের কাপড় জমিতে লুটোচ্ছিলো। সেই অবস্থায় একহাতে খাঁচা আর অন্য হাতে ত্রিশূল উঁচিয়ে — “কোথায় পালাবি? কোথায় পালাবি?” বলে টলতে টলতে ওই লোকগুলোর দিকে এগোতে লাগলেন।
আর এই কথার পরেই লোক দুটো যেন ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠে দৌড় লাগালো ওই গভীর জঙ্গলের অন্ধকারে। কিন্তু জয়রামের যেন কোনো হুঁশ নেই কোনোদিকেই। তিনি ওই ভাবেই এগোতে এগোতে একটা কিছুতে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন মাটিতে। তাঁর হাতের ত্রিশূল আর খাঁচা ছিটকে পড়লো দু ধারে। জয়রাম দেখলেন সামনে পড়ে রয়েছে একটা শাবল। আর তাঁর পায়ের কাছে বিরাট একটা গাঁইতি। পাশেই একটা মাটি খোঁড়ার গর্ত। জয়রাম উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আবার পড়ে গেলেন। আর তখনই দেখতে পেলেন তাঁর সামনে পড়ে আছে চকচকে চাকতির মতো কয়েকটি জিনিষ। শেষ রাতের অন্ধকারেও তার কি জৌলুষ। জয়রাম কাছে গিয়ে হাতে নিয়ে দেখলেন সেটিকে। সোনার মোহর! চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে! উলটে নিয়ে দেখলেন মোহরের ও পিঠটা। ও পিঠের কোনায় যেন লেগে রয়েছে একটু রক্তের ছিটে!
জয়রামের শরীরে যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। বাঁ হাতের মুঠিতে মোহরটাকে নিয়ে আর ডান হাতে ত্রিশূলটাকে শক্ত করে ধরে উপরের বিশাল কালো আকাশের দিকে মুখ করে বলে উঠলেন — “সত্যম শিবম সুন্দরম”।
—“সত্যম শিবম সুন্দরম
—শিবশম্ভু তোমার কি অদ্ভুত লীলা
—নয়তো আজ আমার এ অবস্থা হয় কি করে?
—আর সে রাতেই বা অমন ঘটনা ঘটলো কি করে?”
বিরাট বিস্তীর্ণ কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন জয়রাম। আবার এক নিস্তব্ধ রাত। ঘন জঙ্গল। মাথার উপরে শুধু বিশাল আকাশ। আর এই বিপুল নির্জনতা। মাটির উপর ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটাকে এলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কতো কথাই না ভাবছিলেন জয়রাম। তাঁর সর্বক্ষণের সাথী সেই ত্রিশূলটা আর খাঁচাটা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন সামনের প্রকাণ্ড বটগাছটার শিকড়ে। আর নিজের মনে ইষ্টদেবতা মহাদেবকে বলে যাচ্ছিলেন জয়রাম —
—“তুমিই তো সব জানো মহাদেব — তুমিই তো সব করেছো — আমার দু হাত ভরিয়ে দিলে আশ্চর্য ভাবে — যখন আমি একেবারে নিঃস্ব — বাঁচার ইচ্ছেটাও নেই —
—“কেন? না — একটা পাখি —নিতান্ত একটা পোষা টিয়াপাখি — উড়ে গেছে খাঁচার দরজা খোলা পেয়ে — সেটাই তো স্বাভাবিক — অথচ সেই ঘটনায় আমার সমস্ত পৃথিবীটা যেন হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেলো —
—“এটা ঠিক যে সংসার থেকেও তো কিছুই ছিলো না আমার — স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের কেউ তো খোঁজ নিতো না কখনো — আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কাউকে কাছে পাইনি কোনোদিন —
—“সংসারের মায়া বলো — বন্ধন বলো — সবই ওই পাখিটাই ছিলো — সেও যখন চলে গেলো তখন মনে হোল সব শূন্য হয়ে গেলো আমার —
—“যেন কেমন একটা ক্ষ্যাপার মতো হয়ে গেলাম তখন — সেই শেষরাতে যখন দেখলাম খাঁচায় মদনমোহন ফেরেনি — ওই শূন্য খাঁচা আর ত্রিশূলটা নিয়ে তোমায় ডেকেছিলাম — সত্যম শিবম সুন্দরম —
—“ওরা কি ভেবেছিলো বলো তো আমায় ওই ভাবে দেখে? ভূত? প্রেত? পিশাচ? নয়তো দু দুটো ডাকাত ওই ভাবে তাদের লুঠের জিনিষ ফেলে ওই ভাবে পালালো? কিংবা সবই হয়তো তোমার খেলা —
—“আমি জয়রাম ভটচায — টোলের ছাত্র পড়িয়ে আর যজমানি করে কোনক্রমে দিন কাটালাম — চিরকাল খুদকুঁড়ো খেয়ে আর ছেঁড়া ধুতি পরে রইলাম — এই গাঁয়ের বাইরে কোনোদিন পা ফেললাম না — কিন্তু তা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ ছিলো না--সাধ্যমতো নিষ্ঠা দিয়ে কাজ করতাম সবসময় — সৎ ভাবে —পরিশ্রম করে সংসার প্রতিপালন করতে চেষ্টা করতাম — আর এর বিনিময়ে কেবল রাশি রাশি অপমান আর হেনস্থা — এছাড়া কিছুই পাই নি জীবনে কোনোদিন —
—“ওই মোহরের ঘড়াকে তাই ভাবলাম তোমারই দান — দু হাতে তুলে নিলাম — শুরু হোল আমার নতুন জীবন —
—“বেরিয়ে পড়লাম যে দিকে দু চোখ যায় —আর তখনই দেখলাম পৃথিবীতে কতো কিছু আছে যার কিছুই জানতাম না —
—"দূর থেকে দেখতাম বাজারে কত রকমের মিষ্টি পাওয়া যায় — কতো রকমের ফল — হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার সাহস হয়নি কোনো দিন — মুড়ি বাতাসা খেয়ে দিন কাটে যার সে কিনবে ফল মিষ্টি? তাই বাজারে গেলাম — একটা মোহরের বদলে যা পেলাম তা দিয়ে আগে পেট পুরে খেলাম — খুব পাপ করলাম নাকি মহাদেব?
—"কোথাও কোনো দেশ দেখা তো দুরের কথা — এই গ্রামের বাইরেই যাইনি কোনোদিন — তাই মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে হোত নিজের জন্মভিটেটা দেখবার। খুব ছোটোবেলার আবছা আবছা স্মৃতি — বাবার মুখে কত কী গল্প শুনতাম — আর নিজের মনেই সেসব জায়গার ছবি আঁকতাম। যাওয়ার পয়সা পাবো কোথায়? তাই খুঁজে খুঁজে হাজির হয়েছিলাম সেখানে। এতে কি কোনো অন্যায় হোল ঠাকুর?
—“তারপর যা যা হোল সেসব তো তুমিই করালে — তোমার ইচ্ছায় ঘুরে বেড়ালাম কতো জায়গায় — কতো লোকের সঙ্গে আলাপ হোল — কতো রকমের অভিজ্ঞতা — এত সুখ আছে পৃথিবীতে — এত আনন্দ আছে — কিছুই জানতাম না — টাকা দিয়ে সবই কেনা যায় — আর আমার কাছে তখন অনেক টাকা — খরচও করলাম দু হাতে — হু হু করে কেটে গেল অনেকগুলো দিন — অনেক অনেক দোষ করে ফেললাম তাই না মহাদেব?
—“আমার জীবন তখন তো ছুটছিলো যেন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে — তাই আছড়েও পড়লো কদিন বাদেই। একদিন ভোররাতে শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো — চোখের উপর যেন ঘন কালো পর্দা এসে পড়লো — তারপর যে কী হোলো কিছুই মনে পড়ে না — যখন জ্ঞান এলো বুঝলাম একটু একটু করে — বড়োসড়ো অসুখের ধাক্কায় পড়েছি। বয়স তো হয়েই ছিলো — হয়তো চলেই যেতে হোত আমায় — যদি না কয়েকজন পাশে এসে দাঁড়াতো। কতো চিকিৎসা হোলো — কতো খরচ হোলো — শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম বলে — আরো কটা দিন এই পৃথিবীর মায়ায়। বড়ো ভুল করে ফেললাম ঠাকুর —
—“এতগুলো মোহর — সব খরচ করে ফেললাম — কত সহজে। তাই আবার আগের জীবন — আবার আধপেটা খাওয়া — আবার থাকার ঠাঁই নেই। তাও বাড়ি ফেরার কথা ভাবিওনি কখনো — কিন্তু নিজের জন্মভিটেতে ফিরে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো —
—“ইচ্ছে ছিলো সেখানে তোমার একটা ছোটো মন্দির বানাবো — আমার মনের মতো একটা শিবমন্দির — তার পাশে এক টুকরো জমি কিনে ছোটো একটা ঘর বানিয়ে থাকবো — তাই এতো কষ্টের মধ্যেও একটা মোহর রেখে দিয়েছিলাম আলাদা করে — যাতে শেষ জীবনটা কাটাতে পারি ওইভাবে — তোমার পাশটিতে — তোমার ত্রিশূলটাকে সাথে নিয়ে — আর কী বা ছিলো আমার এছাড়া —
—“আর ওই ভাঙা খাঁচাটা। ওটাও সঙ্গের সাথী আমার। আমার সব মায়া মমতা মোহ তো জড়ো হয়েছিলো ওই খাঁচাটার মধ্যেই — ওটাকে বয়ে বেড়াই সারাক্ষণ — যাতে কখনো না ভুলি ওই চরম কষ্টের রাতটার কথা — তুমি তো সবই জানো মহাদেব —
—“তাহলে বলে দাও না কোথায় গেলো এত কষ্ট করে রাখা মোহরটা — কোথায় হারালাম — একবারটির জন্যে ফিরিয়ে দাও না— যা দিয়ে আবার নতুন করে ......”
নিজের মনেই কথাগুলো বলছিলেন জয়রাম — তাঁর ওই ত্রিশূল আর খাঁচাটা বটের ঝুরিতে ঝুলিয়ে রেখে — ঘন ঘাসের জমির উপর শুয়ে — মাথার উপরের বিরাট আকাশের দিকে তাকিয়ে। সেই আকাশের কোনায় অনেকটা ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের পাশ দিয়ে হু হু করে বয়ে যাচ্ছিলো ঘন মেঘের দল — মাঝে মাঝেই বিদ্যুতের রেখা নিঃশব্দে চিরে দিচ্ছিলো সেই নিকষ কালো আস্তরণ।
তখনই হঠাৎ একটা গোঙানির আওয়াজে চমকে উঠলেন জয়রাম। সমস্ত ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেলো এক নিমেষে। উনি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন। কিন্তু কিছুই চোখে পড়লো না। জয়রাম মনের ভুল ভেবে চোখ বন্ধ করলেন। একটু বাদেই ফের শুনতে পেলেন সেই আওয়াজ। জয়রাম উঠে পড়লেন। মনে হোলো আওয়াজটা আসছে তাঁর পিছন দিক থেকে। এক পা এক পা করে এগোতে থাকলেন সেই দিকে। আর তখনই চোখে পড়লো সেই দৃশ্যটা।
একটা বৃদ্ধ লোক প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছের নীচে পড়ে আছে। মুখটা হাঁ করা — চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে — বুকপেট যেন ওঠা নামা করছে হাপরের মতো। অর্থাৎ মৃত্যু যেন ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে আছে তার মুখের সামনে। জয়রাম তার সামনে এসে দাড়ালেন।
আবছা আলোয় চোখে পড়লো লোকটি তার ডান হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে কিছু একটা। জয়রাম হাঁটু মুড়ে লোকটির পাশে বসলেন। দেখতে পেলেন লোকটি একটা ছোটো পুঁটলির মতো কিছু একটা ধরে রেখেছে তার হাতের মুঠোয়। জয়রাম পুঁটলিটা নিয়ে দেখতে গেলেন। হাড় জিরজিরে আঙুল কটায় যেন জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে ধরে আছে ওই পুঁটলিটা।
জয়রাম কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসে রইলেন ওই মরতে চলা লোকটির সামনে। তারপর একটা হ্যাঁচকা টানে লোকটির হাত থেকে নিয়ে নিলেন পুঁটলিটা। এবার খুব সাবধানে পুঁটলিটা খুললেন জয়রাম। চাঁদের আবছা আলোয় দেখতে পেলেন ওই পুঁটলির মধ্যে রয়েছে কয়েকটি মোহর। জয়রাম পুঁটলির ভিতর হাত ঢুকিয়ে মোহরগুলো বার করে নিলেন। তারপর সেগুলো শক্ত করে মুঠোয় নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ওই মৃতপ্রায় মানুষটির পাশ থেকে।
ঠিক তখনই একটা প্রকাণ্ড কালো মেঘে ঢেকে গেলো আকাশের আধক্ষয়া চাঁদটা। ঘন অন্ধকার যেন হঠাৎ গ্রাস করে নিলো চারিদিক। জয়রাম পা ফেললেন ওই অন্ধকারের ভিতরে। আরও অন্ধকারের দিকে। যেখানে তাঁর কোনো ছায়াই পড়বে না তাঁকে অনুসরণ করার জন্য।
এবার কিন্তু জয়রামের সেই “সত্যম শিবম সুন্দরম” আওয়াজটা আর শোনা গেলো না। তার বদলে ঝোড়ো হাওয়ার বিকট শন শন শব্দে কেঁপে উঠলো চারিদিক।
সেই শিকড়ে বাঁধা ত্রিশূল আর খাঁচাটা সেই গহন অন্ধকারে শুধু দুলতে থাকলো আর দুলতে থাকলো ...
এরপর বহুকাল কেটে গেছে — ওই ত্রিশূল আর খাঁচাটা এখন আশ্চর্য ভাবে স্থির হয়ে আছে — ওই বটগাছটিতেই — তার অজস্র ঝুরির ভিতর — নিঃশব্দে নিমগ্ন একটি অসার কাহিনীর আকারে।
(গল্পটির প্রথম অংশটি প্রেমচন্দের 'আত্মারাম' গল্পের দ্বারা প্রাণিত)
(পরবাস-৬৩, ৩০ জুন, ২০১৬)