Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে নিবেদিতা দত্তর লেখা



ISSN 1563-8685




আনুর গপ্পো


স্নেহের

      আনু সর্দার,

আমের গল্প তোর ভাল লেগেছে লিখেছিস, আর জানতে চেয়েছিস গামছা কেমন ড্রেস। গামছা ড্রেস নয় রে, দেশি তোয়ালে। কেউ তোর কাছে গেলে পাঠিয়ে দোব তোর জন্য। তুই বোধহয় খেয়াল করিস নি তোর মা এখনো গা মাথা মুছতে গামছা পছন্দ করে। গামছা খুব পাতলা কাপড়ের হয় যাতে করে কাচলে হাওয়ায় মেলে দিলেই শুকিয়ে যায়, ড্রায়ার লাগে না। বেশীরভাগ গামছা লাল সাদা চেক কাটা হয়। আমাদের পশ্চিম বাংলায় বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরের গামছাই বেশী চলে। আসামের গামছা অন্যরকম, খুব বাহার তার। আবার পণ্ডিচেরীর তৈরী গামছা তো আরো অন্য এক ধাঁচের। অনেকগুলো জায়গার নাম বললাম, গুলিয়ে ফেলিস না। আসাম ভারতেরই আর এক রাজ্য, পন্ডিচেরী ইউনিয়ন টেরিটরি আর বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর পশ্চিম বাংলাতেই পড়ে।

তুই শ্রী রামচন্দ্রের গল্প জানতে চেয়েছিস। তোর জন্য শ্রী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর রামায়ণ পাঠিয়ে দোব, বাংলাটা ভাল করে শিখছিস তো? তোর ক্রিকেট-ও ভাল চলছে নিশ্চয়। আদর জেনো।

                                                            —দিম্মা

আনাইরাম,

ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে রামপরসাদ আর হরকিষণের কথা বলি। ওরা দুটি ছোট ছোট গয়লা ছেলে। খুব পুরনো লড়ঝড়ে দুটো বড় সাইকেলে চড়ে আমাদের খড়্গপুরের সামনের বাড়িতে দুধ দিতে আসে। বেশীরভাগ সময়ই শ্রীবাস্তব আন্টির গেট বন্ধ থাকে, তাই ওরা গেট ডিঙিয়ে ঢোকে আর আমি বাগানে জল দিতে দিতে ওদের রকম সকম দেখি।

একদিন আমার চায়ের দুধ ছিল না তাই রামপরসাদের কাছ থেকে এক পো দুধ নিয়েছিলাম (ওরা হিন্দীতে বলে এক পাও)। কি জানি তারপর থেকে ওরা দুজনে পালা করে আমাকে দুধ নেওয়ার জন্য ব্যস্ত করত। রামপরসাদ একদিন অনেক পীড়াপীড়ি করে আধ লিটার দুধ গছিয়ে গেল আর বললে ‘হরকিষন আসতে পারবে না তাই আমাকে পাঠিয়েছে।’ তার আধ ঘণ্টা পরেই হরকিষণ এসে হাজির দুধ নিয়ে, বক্তব্য ‘নাহয় আমাদের দুজনেরই কাছ থেকে এক পাও করে নাও।’ ওকেও বোঝালাম আমার বাড়িতে তো ছোট কেউ নেই যে এত দুধ লাগবে, আর আমার তো প্যাকেটের দুধ একটা হলেই সারা সপ্তাহ চলে যায়। তবে কি জানো আনু ওদের দেখে মনে হয়েছিল রামপরসাদ হয়তো পাকা ব্যবসায়ী হবে, হরকিষণ ভাল মানুষই থেকে যাবে। আমার আশিস জেনো।

                                                            —দিম্মা

আনু,

আজ তোকে আমাদের পাড়ার বুড়ো দাদুর কথা বলি। বারান্দায় বসে আছি, বৃষ্টি তো বেশ জোরেই এক পশলা হয়ে গেল। দাদু কিন্তু এর মধ্যেই বেড়িয়ে ফিরছেন। রোগা-সোগা ছোট্ট মানুষ, শীতে গরমে একই জামা কাপড় পরেন--একটা ঢোলা পাজামা আর মাটি মাটি রঙা একটা হাফ শার্ট। একটু পা টেনে টেনেই হাঁটেন। ওঁর বাড়ির লোকেরা বলে উনি আশি তো পার করেছেন অনেকদিন। দাদু অবশ্য দেখা হলে নিজেই বয়সের কথা তুলে বলেন ‘এই একটু হেঁটে নিই রোজ, সত্তর তো হয়েই গেল, আর কি।’ এতে দোষের কিছু দেখি না। আমরা কেউই তো খুব বুড়ো হতে চাই না, দাদুও বোধহয় চান না এই আর কি। তবে এখনো লাঠি ছাড়াই হাঁটেন আমাদের দাদু।
                                                            —দিম্মা




আনাই,

দাদুকে তোর ভালো লেগেছে জানিয়েছিস, আমারো ঠিক তাই। নিজের মনেই থাকেন, সাতে পাঁচে নেই, বেশ মানুষ।

এবার তাহলে তোকে দর্জি পাখির গল্প বলি। তোর মাসির একটা বই আছে ‘গল্প করে পাখিরা’। নানা রকমের পাখির ছবি দেওয়া বেশ বই। তাতে লেখা আছে টুনটুনি হ’ল দর্জি পাখি। টুনটুনি পাতা জুড়ে বাসা বাঁধে, তাই। কিন্তু আমাদের বাড়ির পিছনে বিরাট যজ্ঞিডুমুর গাছটায় এক লাল টুপি মাথা কাঠঠোকরা যখন কাঠ খোঁটে ঠিক মনে হয় হাটে দর্জি মশাই পাজামা, লুঙ্গি, মশারি সেলাই করছে। পা মেশিন জোরে চালালে যেমন হয়, টরর –র---, আবার সেলাইয়ের কাপড় সরাতে যেটুকু সময় লাগে তা বাদে টরর—র-র—র। আওয়াজটা কিসের প্রথমে বুঝতে পারতাম না। তারপর একদিন শব্দ শুনে ছুট্টে উঠোনে গিয়ে এদিক ওদিক খুঁজতেই দেখি দর্জিবাবুর কাণ্ড! আদর জেনো।

                                                            —দিম্মা




বাবু আনাই দ্য গ্রেট,

কি জানি কেন বিহারের কথা আবার মনে পড়ে গেল। যখন আমরা রাজধানোয়ারে থাকতাম, তখনকার একটা গল্প তোমাকে বলছি। আগেই বলেছি বিহারের বেশীরভাগ বাড়িই ছিল টালি দিয়ে ছাওয়া, যাকে বলা হ’ত খাপড়ার চাল। কিন্তু রাজধানোয়ারের বাড়িটায় একটা ছোট ছাদ ছিল। এই ছাদটা নিয়ে আমাদের বেশ গর্ব ছিল--কেমন হাওড়ায় আমাদের মামারবাড়ির মত ছাদ আমাদেরও আছে। সে ছাদ ছিল ফুটবল খেলার মত। তাহলে হবে কি--আমরা তো আমাদের পুঁচকে (খুব ছোট) ছাদ নিয়ে ভারি খুশি ছিলাম। আর ছাদের সিঁড়িটা ছিল উঠোন বেয়ে।

একবার কি কারণে জানি না, হয়তো গরুর জাবনার জন্যই, অনেক খড় এনে রাখা হয়েছিল ওই ছাদে। আমার মা আগে থেকেই কিছু বুঝে নিয়ে আমাদের খড় নিয়ে খেলা করতে মানা করেছিলো। কিন্তু সে আর কে শুনছে! আমি আর মাসিদিদা খড়ের গাদায় ঝাঁপিয়ে খড়ের আঁটি হাতে গদা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা করেছিলাম। খুব আহ্লাদ হয়েছিল কিন্তু খড় গায়ে লেগে গা চুলকে ছিল ভালই। মা তো জানতো আগেই, তাই মানা করেছিলো, আমরা শুনিনি। ছোটবেলায় এমন সব বারণ না শুনলেও চলে কি বলো?

                                                            —দিম্মা

স্নেহের
       আনাই,

তোকে আজ অনেকদিন পরে মেল করছি। তুই বোধহয় ভাবছিস ‘যাঃ, দিম্মাটা আমায় ভুলেই গেল’। তা তুই এমন ভাবলে খুব কিছু ভুল হবে না। তোর দিম্মাটা একটা ‘ভুল ভুলককড় চাচা’ হয়েছে আজকাল। ভুল ভুলককড় মানে যে সব সময় সব কিছু ভুলে যায়। একটা পুরনো হিন্দি সিরিয়ালে একজন ছিল যে খুব ভুলো মন ছিল, তাকে গ্রামের লোকেরা বলত ‘ভুল ভুলককড় চাচা’। আমি কিন্তু ভুলো হলেও তোমাকে কেমন করে ভুলি। আসলে তুমি মা বাবির সাথে দেশে ফিরলে, আমি কিছুদিন ক্যালিফোর্নিয়ায়, এইসব নিয়ে আমাদের মেলে মেলে গপ্পো-সপ্পোটা কদিন বাদ পড়েছিল এই আর কি।

যাইহোক, এখন যখন তোকে মেল করছি ইউ এস থেকে, ঘড়িতে বাজে প্রায় বেলা দুটো, আর তুই ঘুমিয়ে আছিস ভারতে। ওখানে এখন রাত। ঘুম থেকে উঠে মেল দেখিস। তোর আমার এমনই হয়, তুই আমেরিকায় তো আমি ভারতে, তুই ভারতে তো আমি ক্যালিফোর্নিয়ায়। আর এখন কিছুদিন তো তোরা দেশেই আছিস।

শুনলাম তুমি ক্লাস টু-তে ভর্তি হয়েছ। দেখো তো ছোট থেকে তোমাকে বাংলায় মেল করি বলে তুমি কত বাংলা পড়তে পারো এখনি। কিছুদিনের মধ্যে মনে হয় লিখতেও পারবে। মাম বলছিল প্রথম দিন স্কুলে যেতে তোমার একটু কান্না পেয়েছিল। তা পেতেই পারে। এবার যখন আমেরিকা এলাম একা একা, মনে হচ্ছিল বাড়ি থেকে তৈরী হয়ে বেরোতে বেরোতে, কেন এলাম। এত লম্বা পথ, এত অচেনা সব কিছু। কিন্ত জানো এয়ারপোর্টে পৌঁছেই কত মানুষের সঙ্গে আলাপ হ’ল, কত কথা হ’ল, যেন আমরা সব সময়ই একসঙ্গে ছিলাম, থাকব। তার পর যে যার দিকে চলে গেলাম। তুমিও দেখবে ওখানে স্কুলে যেতে যেতে এমনও মনে হবে হয়তো ‘দূর! শনি রোববার গুলো না এলেই ভাল, কবে যে স্কুলে যাব!’

ভাবছি, তোমাকে কি লিখি যা তোমার ভাল লাগবে। এখানে একত্রিশে অক্টোবর হ্যালোইন উৎসব হয়। হয়তো আমেরিকায় থাকতে এই উৎসব তুমি দেখেছ। আমার কাছে অচেনা, তাই আমার কেমন লাগছে আমেরিকানদের হ্যালোইনের জন্য তৈরী হওয়া তোমাকে জানাই।

আজ তো বিশে অক্টোবর, এর মধ্যে দেখছি হ্যালোইনের জন্য সব দোকানপাটে নানা রকম ভূতের মুখোশ, কংকাল পুতুল, বাদুড় পুতুল ও বিশাল বিশাল কমলা রঙের আসল কুমড়ো বিক্রি হতে শুরু হয়ে গেছে। প্ল্যাস্টিকের কুমড়োও আছে। দেখছি হ্যালোইনের কদিন আগে থাকতেই এখানকার লোকেরা এইসব বাদুড় পুতুল, কংকাল পুতুল, মশারির জালের মত বা তার থেকেও পাতলা কাপড়ের তৈরী মাকড়শার জাল দিয়ে বাড়ির সদর দরজা ও বাগান সাজিয়ে রাখছেন। সকালে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম বেশীরভাগ বাড়ির বারান্দার পটিতে বড় বড় কুমড়ো সাজানো। একজন বললেন এই কুমড়োগুলো সুন্দর ভাবে কেটে চোখ মুখ করে তাতে আলো দেওয়া হয়। যাকে বলে জ্যাকো ল্যার্ন্টান। দোকানে আবার দেখলাম কুমড়ো কাটার ছোট ছোট ছুরি কাঁচির কিট। জানলাম হ্যালোইনের বিশেষ খাবারে কুমড়ো থাকবেই। তৈরী হবে কুমড়ো দিয়ে মিষ্টি পাই। আমরা তো একজনদের বাড়িতে কুমড়ো দিয়ে মাংস রান্না খেলাম। আমি তো কুমড়ো খুবই ভালবাসি, তাই আমার খেতে ভালোই লেগেছে। কিন্তু যারা কুমড়ো দু চক্ষে দেখতে পারেন না তারা কি বলবেন জানি না।

এরপরে হ্যালোইনের দিন অনেককে ভূতের মুখোশ পরে বা খুশীমত সেজে পথে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। আর বেশীরভাগ ছোট ছেলেমেয়েরা তো সেজেছিল পরী বা রাণী।

আনাই, এই হ্যালোইন উৎসবটা আমেরিকার একটি প্রাচীন সংস্কার। কিন্তু এই দেশের নতুন নতুন চিন্তার সঙ্গে ও নিজের সব কিছু নিয়ে দিব্যি কেমন টিকে আছে। আমরা ভারতীয়রা কত নিজের দেশের দোষ দেখি। কথায় কথায় বলি আমরা কত পেছিয়ে আছি। কত সংস্কার শ্যাওলার মত আমাদের জড়িয়ে আছে। কিন্তু আমার মনে হয় সংস্কার যদি কাউকে আঘাত করে দাবিয়ে না রাখে তাহ’লে সার্ফ এক্সেল ডিটারজেন্টের ‘দাগ অচ্ছে হ্যায়’ স্লোগানের মত বলি ‘সংস্কার অচ্ছে হ্যায়’। কারণ সংস্কারই একটা জাতিকে নিজের মত থাকতে শেখায়। কথাগুলো তোমার বুঝতে অসুবিধা হবে এই বয়সে। পরে বড় হয়ে যদি মেলগুলো আবার পড়ো তখন ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। তা ছাড়া সংস্কার না থাকলে সারা পৃথিবীর লোক একই রকম হত আর সবকিছু কি ভীষণ একঘেয়ে লাগত বলোতো?

জানো আনু, তোমাকে মেল করতে বেশ লাগছে। যাদের বাড়িতে আমি উঠেছি তারা দুজনেই বার্কলে ইউনিভার্সিটিতে আছেন। এখন তারা সেখানেই আর আমি তোমাকে লিখছি আমার কথা। এদের এই বাড়িটা বেশ। বিশাল কাচঘেরা বসার ঘরটায় রোদ ঢুকে পড়েছে হৈ হৈ করে। কাচ ঘেঁসে একটা ঝাউ গাছ আর মেপল গাছ সমানে মাথা ঝাঁকিয়ে যেন বলছে ‘কি অত লিখছ গো? আমাদের কথা লিখছ কি?’ কি বলি বলতো এদের? ওদের বরং বলি ‘হ্যাঁগো হ্যাঁ, আনুকে তোমাদের কথা লিখে দিচ্ছি, জানাচ্ছি তোমরা ওকে আদর দিয়েছ’। আশিস জেনো।

                                                            —দিম্মা




আনু বাবা,

আমি গাছ ভালবাসি বলেই বোধহয় যে বাড়িতেই থাকি তার সামনে বা চারপাশে কিছু গাছ থাকে। আমাদের খড়্গপুরের কোয়ার্টারের পশ্চিম পাশে একটা খুব সুন্দর কদম গাছ আছে। অনেক রিকশাওয়ালারা তো বাড়িটাকে কদম বাড়ি বললেই চিনতে পারে। বর্ষা আসার ঠিক আগে আগে (কালো মেঘ যখন আকাশ দখল করতে শুরু করেছে) হঠাৎ খুব মিষ্টি গন্ধ পাই। ছুট্টে বারান্দায় গিয়ে দেখি গাছটা হাল্কা হলুদ রঙের বলের মত ফুলে ভরে গেছে। আর অসংখ্য মৌমাছিদের একটা গুনগুন শব্দ শোনা যাচ্ছে, যেন খুব খুউব আস্তে কোনো মেশিন চলছে। আর সেই সময়ের মনের অবস্থা কেমন করে বোঝাই--ভারতবর্ষের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথের ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’কে এই চাক্ষুষ (নিজের চোখে দেখা) করা যে কি সৌভাগ্য, সে যে দেখেছে সেই জানে। তুমিও যেন কোনোদিন এ শোভা দেখতে পাও সেই প্রার্থনাই করি।

তবে কদম ফুল বেশিদিন থাকে না। ফুটতে না ফুটতেই মাটিটা ফুলের সরু কাঠি কাঠি পাপড়িতে ভরে যায়, পা ফেললে মনে হয় হাল্কা হলুদ ও খয়েরি রঙ মেলানো নরম কার্পেট।

এখনো বার্কলের যে বাড়িতে বসে তোকে মেল করছি তার সামনে দুটো মেপল গাছ ও একটা ঝাউ গাছ আছে সে কথা আগের মেলেই জানিয়েছি। তার মধ্যে একটা মেপল আর ঝাউ তো একেবারে জানলা ঘেঁষে রয়েছে। ভাবতে বেশ লাগে ওরা আমার জন্যই আছে। বাড়িটা গ্যারাজের ওপর, তাই মেপলের মাথা অব্দি দেখতে পাচ্ছি। এখন শীতকাল বলে মেপলের পাতা হলুদ-লাল হয়ে উঠেছে আর গাছের গা ঘেঁষে যে ইলেকট্রিকের তার গেছে তাতে মোটা মোটা কমলা রঙের কাঠবেরালি সদাই কত সার্কাস দেখিয়ে চলেছে। এমনি কিছু পাখি তো থাকেই গাছে, আর নভেম্বর পড়তেই দেখছি হাল্কা নীল ও ছাই মেশানো এক পাখিদের। এ শহরটাও আমাদের আই, আই, টি খড়্গপুর ক্যাম্পাসের মত অসংখ্য বড় গাছ ও ফলের গাছে ভরা। তার ওপর বার্কলের ফুটপাথ তো কত মনোহারী ফুলের গাছে সাজানো। তবে এখানে পাখির ডাক বড় একটা শুনিনি। কিন্তু খড়্গপুরের পাখির ডাক যেন এক সিম্ফনি। নিজেকে যদি একটু সব কিছু থেকে টেনে সরিয়ে আনা যায় তবেই এই অরকেস্ট্রা শোনা যায় রে। আর মনটা হয়ে যায় শীতল এক আনন্দে ভরপূর।

তোর কাছেই শুনেছি মেপল গাছের সিরাপ হয়। যখন তুই প্রিন্সটনে ছিলিস সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে দুধে মেপল সিরাপ দিয়ে খেতে ভালবাসতিস। এবার বার্কলেতে এসে আমিও মেপল সিরাপ দিয়ে প্যানকেক খেলাম। প্যানকেক খেয়ে মনে হ’ল এও এক ধরনের সরু চাকলিই। প্যানকেক যেমন মেপল সিরাপ দিয়ে খাওয়া হয় সরু চাকলিও আমরা অনেক সময় খেজুর গুড় দিয়ে খাই। বিহারে বেসন, আটা গুলে তাতে নুন লংকা পেঁয়াজ দিয়ে সরুচাকলির মত একটা খাবার হয় যাকে বিহারিরা বলেন ছিল্কা। ঝাল ঝাল আচার দিয়ে এই ছিল্কাই আমার হট ফেবারিট!

দ্যাখ আনু গল্পের এই মজা, মেপলের কথা বলতে বলতে বিহারের ছিল্কায় চলে গিয়েছিলাম। তা যা বলছিলাম-–মেপল সিরাপের কথা লিখতে মনে পড়ে গেল আমাদের বাংলার খেজুর গুড়ের কথা। খেজুর গাছের গায়ে দা বা কাটারি (এক রকম বড় ছুরি বলা যেতে পারে) দিয়ে কোপ মেরে তার ঠিক নিচেই একটা হাঁড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয় শীতকালে। খুব ভোরে গ্রামের দিকে এখনোও বোধহয় এই টাটকা খেজুর রস খেতে পাওয়া যায়। খেজুর গুড় বিনা পিঠে পার্বণ ভাবাই যায় না। বার্কলেতে একজন বললেন এই উপায়েই মেপল সিরাপও হয়। তবে গুড়ের বদলে মিছরি করা হয় যাকে বলে মেপল ক্যান্ডি তা বোধহয় তুমি জানোই। আদর জেনো

              —দিম্মা




আনাই,

লিখেছিস ছিল্কার রেসিপিটা এখনিই মামকে লিখে পাঠাতে। তা নাহয় পাঠাবো, তবে মাম তো বড় ব্যস্ত থাকে অফিস নিয়ে তাই ভাবছি ফোনে তোমাদের রান্নামাসিকেই বলে দেব। ইচ্ছে হ’লে তুমিও করে দেখতে পার। দেখবে ছোটমোট রান্না করার মধ্যেও অনেক অ্যাডভেঞ্চার লুকিয়ে আছে। তবে যেটা তোকে আগেই বলে নিই তা হ’ল তুই ঠিকই ধরেছিস সিম্ফনির সহজ মানে হ’ল সুর। এছাড়া অনেক যন্ত্রশিল্পী মিলে নানান সুর যন্ত্রে যখন কোনো সুর বাজান তখন তাঁদের একসাথে বলা হয় অরকেস্ট্রা। আর পিঠে পার্বণ কি তাও জানতে চেয়েছিস। ভারতে সবাই জানেন, কিন্তু এই মেলে তো কেবল তুমি আর আমি তাই আবারও লিখি খেজুর গুড় পিঠে পার্বণে লাগবেই। পৌষ মাসে (ডিসেম্বর-জানুয়ারী) আমাদের ভারতবর্ষের নানান রাজ্যে পৌষ পার্বণ বা পিঠে পার্বণ উৎসবের হাওয়া বয়ে যায়। এই মেলে তোকে আমি বাংলার পিঠে পার্বণের গল্পই বলব। চাষী এ সময় পাকা ধান কেটে ঘরে তোলেন। সেই ধান থেকে নতুন চাল হয়। নতুন চাল, খেজুর গুড়, শীতের সব্জি যেমন কড়াইশুটি, ও ফলের টুকরো দিয়ে নবান্ন হয় আমাদের বাংলায় (নবান্ন নতুন চাল খাওয়ার উৎসব)। আর মা লক্ষ্মী বা যে যার বাড়ির ঠাকুরকে সেই নবান্ন ভোগ দিয়ে পিঠে পুলি বানানোর ধূম পড়ে যায় ঘরে ঘরে। আমার মনে হয় এও এক ধরনের থ্যাংকস গিভিং ফেস্টিভ্যাল। মাঠ যখন সোনার ধানে ভরে ওঠে তখন তো ইচ্ছে করেই নিজের নিজের ঠাকুরকে সেই ফসলের নানা কিছু বানিয়ে উৎসর্গ করতে, প্রণাম জানাতে।

এতো গেল উৎসবের কথা। এবার তোকে বলি কেমন করে পিঠে তৈরী করতে হয়। চাল গুঁড়ি ফুটন্ত জলে দিয়ে ঘুড়ি জোড়ার আঠার মত করে নিতে হয়। তারপর ঠান্ডা হলে তাকে ভাল করে ঠেসে নিয়ে ছোট ছোট বল করে নিতে হবে। তার ভিতর গুড় নারকেলের পুর দিয়ে হয় পিঠে। পিঠে তো অনেক রকমই হয় — সিদ্ধ পিঠে, দুধ পুলি, রাঙা আলু, ভাজা মুগের পিঠে, আড়শে পিঠে, পাটিসাপটা। তবে সবের ভিতরই বেশিরভাগ সময় গুড় নারকেলের পুর থাকে ও তা পাতলা খেজুর গুড় দিয়ে খেতে হয়। আমার বাবা আবার ফুলকপি কড়াইশুঁটির পুর দিয়ে পিঠে খেতে ভালবাসত। পর দিন সকালে বাসি পিঠে ঘি নুন গোল মরিচ দিয়ে ভেজে খাওয়াটা বাবা-ই মাকে শিখিয়েছিল। পিঠে দেখতে হয় ছোট ছোট নৌকো বা টানা টানা চোখের মত বলা যেতে পারে। আমরা যখন ছোট ছিলাম (এই ধর সাত থেকে দশের মধ্যে) সারা দিন হামানদিস্তের দখল নিয়ে ভাই বোনেদের সাথে কাড়াকাড়ি চলত। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে হামানদিস্তে চেয়ে আনার চলও ছিল। চাল গুঁড়নোটা একটা অ্যাডভেঞ্চার মনে হ’ত, পড়াশোনার এত বালাইও ছিল না। ছুটির সময় সারাদিন হুড়েমি আর হৈ হৈ। দিন দশ পনের আগে থাকতে চাল ধুয়ে শুকিয়ে গেলে আমরা ভাই বোনেরা গুঁড়ো করতাম। আজকাল আর কেউ এত কষ্ট করতে পারে না, দোকান থেকেই চাল গুঁড়ি কিনে আনা হয়। সে যাইহোক, তখনকার কালে আমার মা করত খুব ভাল দুধ পুলি আর আমার জ্যাঠাইমা তিল গুঁড়িয়ে গুড় দিয়ে একরকম লেইয়ের মত মিষ্টি বানাতো, নাম দিয়েছিল তিলছেঁই। ভাত-রুটির পাট প্রায় থাকতই না রাতের দিকে, পেট ভরে খালি পিঠে খাওয়া। বাড়ি বাড়ি বাটি ভরে পিঠে পাঠানোও হ’ত আমাদের ছোটোবেলায়।

আজকাল অবশ্য এত পিঠে কেউ বানাতে পারে না। তবে শুনেছি বড় বড় হোটেলে পিঠের ফেস্টিভ্যাল হয়, নানান মেলাতেও পিঠের স্টল দেওয়া হয় এ সময়। তুমি খড়্গপুরে এলে আমি তোমার জন্য পিঠে তো বানাবোই, তবে জানি না তোমার ভাল লাগবে কি না। আদর দিলাম।

                                                            —দিম্মা
পুনঃ- আনু একবার হয়েছে কি এই পিঠের সময়ই আমরা ছিলাম খরসোঁয়াতে। আমার বড়দা একজনদের বাড়িতে পিঠের নেমন্তন্ন পেয়েছিল। বায়না করে আমি আর আমার বোন দাদার সঙ্গ ধরেছিলাম। ছোটো একটা ঝর্না মত নদী পেরিয়ে সেই তাদের বাড়ি। আর গিয়ে কি খেলাম বলতো? — তুই ভাবতেই পারবি না — পিঠে তো ছিলোই, তার সাথে তেল-তেলে ভেড়ার মাংসের ঝোল আর গরম ভাত!

এই পিঠের কথায় মনে এল মাসির শেখা একটা গান ‘পৌষ পরবে টুসু পাতিব/আমরা টুসুর পূজা করিব’—খরসোঁয়াতেই পিঠের সময় এই টুসু পুজোর কথা প্রথম শুনেছিলাম।

                    —দিম্মা

আনু,

‘পৌষ পরবে টুসু পাতিব’ গানটা কেমন তা বুঝতে পারিসনি। সে তো ঠিকই। কেউ গেয়ে না দিলে আর গান কি হলো। এক কাজ করা যেতে পারে। তোর মাম তো ভালোই গায়। ওকে সুবিধামত গানের সুরটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। মাম খুব তাড়াতাড়ি গান তুলতে পারে। তোমাকে সে-ই শোনাতে পারবে। ফোনে অবশ্য মাসিমণিও গানটা গেয়ে দিতে পারে।
                                                            —দিম্মুই





আনাই,
চল আজ তুই আমি দুজনে মনে মনে একটা হাটে বেড়িয়ে আসি। সে আবার কেমন করে ভাবছিস তো! আসলে কোনো জায়গার কথা পড়লে মনে মনে আমরা তো সেই জায়গায় পৌঁছেই যাই, তাই তোর সাথে একটু দুষ্টুমি করলাম।

জানিস আনু বার্কলেতে প্রতি বৃহস্পতিবার হাট বসে। ওখানে বলে ফার্মার্স মার্কেট। হাট বলতে আমরা ভারতবর্ষে যা বুঝি ঠিক তেমন নয় রে, আবার কোথাও যেন মিল পাই। প্রিন্সটনে, যেখানে তুই ছিলিস সেখানে এমন হাট বসত কি?

আমি এই দু মাস বার্কলের ওয়ালনাট স্ট্রীটের যে বাড়িতে আছি ঠিক তার পরের রাস্তাতেই হাট বসে। সাদা সাদা তাঁবুর তলায় হাট শুরু হয় এই দুপুরের দিকে। নানান ফার্ম থেকে চাষীরা আসেন ফল, সব্জি, মাখন, চিজ, মাংস থেকে নানান খাবার, মাশরুম বেচতে। এই হাটে আচার, জেলিও দেখলাম আর সব কিছুই জৈব সারের ফলন। মজাটা এই, এখানে কিছু না কিনলেও ফলের টুকরো কাঠিতে গুঁজে বা প্ল্যাস্টিকের চামচে আচার তুলে খাওয়া যেতেই পারে ইচ্ছে হলে। আমিও প্রথম দিন মন পুরিয়ে খেয়েছি অনেক টুকিটাকি। এইরকম অনেক মানুষের জড়ো হওয়া, বেচাকেনা, বেঁচে থাকার আনন্দটাকে বাড়িয়ে দেয়। বড় হয়ে তুই নাহয় মিলিয়ে নিস। সাদা তাঁবুর সাথে নীল আকাশ, ঝিলমিল রোদ, আর বেশ একটা শীত শীত ভাবে চারিদিকে খুশীর ঢেউ জাগে। খানিকক্ষণের জন্য হলেও মনে হয় আমার সব ঝুট ঝামেলারা দূরে কোথাও বেড়াতে গেছে।

ভারতে চাষী বলতে আমরা তো বুঝি খাটো (ছোটো) ধুতি পরা, মাথায় গামছা বা সাদা পাগড়ি বাঁধা সাদাসিধে মানুষদের। গরমের দেশে এই পোশাকই উপযোগী আর এর থেকে বেশী হয়তো তারা কিনতেও পারেন না। বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু অনেক সময়ই কেউ ওঠা বসা, খাওয়া দাওয়ার আদবকায়দা (নিয়ম) না জানলে তাকে আমরা দুম করে বলে দিই ‘তুই একটা চাষা’। আজকাল অবশ্য আমাদের দেশের চাষীদের পোশাকও পাল্টে যাচ্ছে। হাটে দেখি নানান ধরনের জিন্স প্যান্ট ও রঙিন কত কি লেখা গেঞ্জি বিক্রি হচ্ছে। আমাদের ছোটো মালি পিন্টু বাবু তো রোজ দিন নানান রকম জামাকাপড় পরে কাজে আসে। তবে আজো ভারতে হাট বসে খোলা মাঠে ত্রিপল (এক রকম মোটা কাপড়) বা প্ল্যাস্টিকে ঢাকা বাঁশের চালার তলায়। জিনিসপত্র আসে গরুর গাড়ি, ভ্যান রিকশা বা কখনো কখনো ছোট ছোট লরিতে। সে হাটেও কাঁচের চুড়ি বা বেলুন কিনে, বাদাম ভাজা, গুড় বাদামের পাটালি হাতে বেড়াতে খুব মজা।

আমেরিকান ফার্মাররা দেখছি আর পাঁচজন ওদেশীর মত জিন্সের প্যান্ট, শার্ট, সোয়েটার পরেন। ঠান্ডার দেশ তো! তবে বুকের সামনে থেকে প্রায় হাঁটু অব্দি একটা ছাই রঙের এপ্রন বাঁধা থাকা। তাতে জামাকাপড়ে দাগ লাগে না। কারণ এরা তো ফল সব্জি আচার বিক্রি করেন, আর তা থেকে দাগ লাগতেই পারে। আর আমাদের গ্রামগঞ্জের মানুষদের মত এরা দাগ ছোপ লাগা জামাকাপড় পরেন না মনে হ’ল।

যে রাস্তার ওপর দুধারে হাট বসে, তখনকার মত সেখানে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। পথটা একটা ছোট গাছপালা দেওয়া দ্বীপের মত জায়গা দিয়ে ভাগ করা। সেখানেই কিছু মানুষ চা-কফি খাবার নিয়ে বসে পড়েন। কেউ বা গা মাথা টিপিয়ে নেন। আবার তারই মাঝে দেখেছি এক ছোটোখাটো গায়ক ঢোলা জামা পরা, টুপি মাথায় একটা সেলো বাজিয়ে গান গাইছেন। তাঁর মুখ কেমন যেন একপাশে টেনে বাঁকানো, দোমড়ানো মোচড়ানো। কিন্ত তাতে তাঁর কোনো বালাই নেই। আনন্দ দিয়ে চলেছেন গান গেয়ে। তবে হাটের পর এই রাস্তায় কোনো চিহ্নই থাকে না যা দেখে মনে হয় কিছুক্ষণ আগেও সেখানে কিছু হয়েছিল। এমন আইন করা আছে দেশে যে কোনোরকম জঞ্জালই রাস্তায় পড়ে থাকার জো নেই।

যখনই এই হাটে বেড়াতে এসেছি, ছোটবেলার সেই কবিতাটার কত লাইনই না মনে পড়েছে--‘হাট বসেছে শুক্রবারে’--যেখানে জিনিসপত্র জুটিয়ে এনে/গ্রামের মানুষ বেচে কেনে’। তার সাথে সেলো বাজানো গায়ককে দেখে মনে বেজে উঠেছে অন্ধ কুঞ্জবিহারীর খঞ্জনি বাজিয়ে গান। সব যেন কেমন মিলে মিশে গেছে রে আনাই। মিলটা পেয়েছি আবার যেন পাইনি, ধরি ধরি করেও আবার ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। আদর জেনো।

                                    —দিম্মা




পুনঃ- তুমি চাইলে তোমাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’টা পাঠিয়ে দোব। মার কাছে ‘হাট’ ও ‘অঞ্জনা নদী তীরে’ কবিতাগুলো পড়ো, ভাল লাগবে। ‘সহজ পাঠ-এর সব ভাগগুলোই পড়তে পারো। একজন মহাকবি যখন তোমার মত ছোটদের ভাষা শেখান সেও কত সুন্দর ও অন্যরকম। আর একটা কথা তোমাকে জিগেস করা হয়নি। হাটের গল্প কেমন লাগল যখন জানাবে তখন হ্যালোইনের মেল পড়ে কি মনে হ’ল জানাতে ভুলো না। আজ এইখানে দাঁড়ি টানছি।
                                                            —দিম্মা


(এর পরে)



(পরবাস-৬৩, ৩০ জুন, ২০১৬)