(১)
এবারে গঙ্গারাম ট্রান্সফার হয়ে এসেছে রায়পুর জেলার রাজিম ব্রাঞ্চে। মহানদীর তীরে এই প্রাচীন রাজিম নগরী, আর এখানে একটি লক্ষ্মণমন্দির আছে।
বছর দুই আগে বিলাসপুর জেলায় থাকতেই ও এই রাজিম নগরীর কথা ও মাহাত্ম্য শুনেছিল।
সেটা বোধহয় ছিল ফাগুন মাসের শেষ। ঝরাপাতার দিন, পলাশের বনে আগুন লেগেছে। শিলাবৃষ্টি হয়নি, তাই আমের মুকুল ঝরে যায়নি। আর সকাল সন্ধে যখন তখন ন্যাড়া ডালগুলোতে বসে কোকিল ডাকতে থাকে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক আদিম বুনো গন্ধ। প্রকৃতি ঋতুমতী হয়েছে।
গাঁয়ের লোকজন-ছেলেছোকরাদের হাতে কোন কাজ নেই। তাই অলস দুপুরে বা গুলাবী জাড়া (গোলাপী শীত) পরা বিকেলে গাঁয়ের অলি গলিতে বাজছে নাগাড়া। গোটা চারেক হাফপ্যান্ট পরা ছোঁড়া বসে দুটো কাঠি দিয়ে কালোমাটির শরীরে চামড়াছাওয়া নাগাড়া পিটছে আর "ফাগ"' গাইছে। এ চলবে টানা দু'সপ্তাহ ধরে, সেই হোলি বা দোলের দিন পর্য্যন্ত। ফাগ গানের মধ্যে এই গানটা মনে হয় বেশি জনপ্রিয়।
"তহুঁ যাবে, মহু যাবো রাজিম কে মেলা,
রাজিম কে মেলা রে ভাই, রাজিম কে মেলা রে ভাই।''
(তুই যাবি রে, আমিও যাব--রাজিমের সেই মেলাতে)।
(২)
আজকে গঙ্গারাম যাবে রাজিমের মেলায়। চারদিন আগে মকরসংক্রান্তি থেকেই মেলা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ব্যাংক ছেড়ে বেরোনোয় বড্ড চাপ। দু'জন স্টাফ ছুটিতে। এই সময় রোজ হেড অফিস থেকে কৃষি লোনের আদায় আর রবি ফসলের লোন বিতরণ নিয়ে হুড়কো আসতেই থাকে।
আহা! তার কি ভাষা! একেবারে "সচিত্র প্রেমপত্র''।
যার সারমর্ম হচ্ছে যে এই কৃষিপ্রধান রাজ্য ছত্তিশগড়কে লোকোক্তিতে ‘ধান কী কটোরা' (ধানের ভাণ্ডার) বলা হইয়া থাকে। কাজেই এই ক্ষেত্রের কৃষকদের সময়মত কৃষিজনিত উৎপাদক ঋণ দেয়া সমস্ত ব্যাংক সমাজের (বিশেষত: গ্রামীণ ব্যাংকের) পরমকর্তব্য। এই ব্যাপারে কোন লাপরবাহী বরদাস্ত করা হইবে না। বর্তমান সীজনে লক্ষ্যমাত্রার হইতে কম ঋণ বিতরণ হইলে সম্বন্ধিত ব্যাংক ম্যানেজার ব্যক্তিগত রূপে উত্তরদায়ী হইবেন। শালা! কেন ‘ব্যক্তিগত’ রূপে? কেন 'সমষ্টিগত' রূপে নয়?
ফলশ্রুতি এই গোবরগণেশ ম্যানেজার গঙ্গারাম রোববারের আগে আর মেলার দিকে পা বাড়াতে সাহস করেনি। আজ রোববার, আজ যাবে। অবশ্যি ঘটনাচক্রে একদিন ব্যাংকের ডিউটি করতে করতেই ওর এক ঝলক মেলা দেখা হয়ে গেছে।
হয়েছে কি, শুক্কুরবার ডিফল্টারের লিস্ট দেখতে দেখতে ওর হঠাৎ মটকা গরম হয়ে গেছল। মাঝামাঝি জায়গায় একটি নামে চোখ পড়েছে, ঘনশ্যাম যাদব।
উনি সরকারি স্কুলের মাস্টার, কিন্তু ক্ষেতিবাড়িও আছে। তাই তিন একর জমিতে খরিফ ধান বোনার জন্যে ওনাকে একর প্রতি দশহাজারের হিসেবে তিরিশহাজার লোন দেয়া হয়েছিল। এবার তাগাদায় তিনবার ওনার বাড়ি যাওয়া হয়েছিল, তাতে ফল হয়েছিল কিছু শুকনো কথা, — এই দেখুন, আগামী সপ্তাহেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শেষকালে ফক্কিকারি, মানির দেখা নাই রে নাই!
তা এবার শুক্কুরের বারবেলায় বার খেয়ে গঙ্গারাম ঠিক করলো আজ এই গুরুজি বা ম্যাথসের টিচার ঘনশ্যাম যাদবের থেকে কিছু আদায় করেই আনবে। ব্যাংকের চাপরাশি জীবনলালকে সঙ্গে নিয়ে ও বেরিয়ে পড়লো গুরুজির খোঁজে। উনি বাড়িতে নেই, স্কুলে নেই, গেলেন কোথা?
— এই তোর বাপ কোথায়?
— তালাও গয়ে।
এই ছোট্ট দুটি শব্দের অনেক মানে। ওই বাক্যটির প্রথম পাঠ হল — বাবার পেট গড়বড়, এখন অবেলায় গেছে পুকুর পানে, সব সেরে সাফসুতরো হয়ে ফিরবে।
খানিকক্ষণ পরে গিয়ে দেখা গেল— এই তো ছিল, পঞ্চায়েত অফিসের দিকে গেছে। তা পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে দেখা গেল সেখান থেকে ক্ষেত গেছে। এই ভাবে বার-আটেক নাকানি চোবানি খাবার পর জানা গেল উনি মেলার দিকে গেছেন।
মেলা যাবার পথে রাস্তার দুধারে বিক্রি হচ্ছে মুড়ি-মুড়কি, চিনির পুতুল, ক্যালেন্ডার আর্ট। গঙ্গারাম ক্যালেন্ডার আর্টের নায়িকাদের বোকা-বোকা হাসি, বুকের দুই পর্বতের মাঝখানে খাই, উপত্যকা এইসব মগ্ন হয়ে দেখছিল।
চটকা ভাঙল চাপরাশি জীবনলালের চাপা চিৎকারে।
— সাহেব! ওই দেখুন! মেলার মেইন গেটের বাইরে শুঁড়িখানায় গুরুজি আছেন। আমি গিয়ে দেখে এসেচি, আপনি শিগ্গির চলুন।
ঢুকে দেখা গেল আধো-অন্ধকার। আধময়লা কাঠের বেঞ্চি-টেবিল। তাতে দাগধরা প্লাস্টিকের বড় জাগ, তাতে জল আর ছোট ছোট কাচ বা প্লাস্টিকের গেলাসে ছোটবেলায় কৃমির ওষুধ হিসেবে খাওয়ানো চুনের জলের মত দেখতে কিছু পানীয়। গুরুজি এবং তাঁর জনাকয়েক বন্ধু মিলে তর্ক জুড়েছেন যে এবছর দারুতে জল মেশানো হচ্ছে; নইলে কি করে এতটা খেয়েও কোন নেশা হচ্চে-টচ্চে না!
গঙ্গারামকে দেখে গুরুজির মুখে একগাল হাসি।
— আসুন, স্যার! আপনারো চলে নাকি? অ্যাই, নিয়ে আয় একবোতল হিরণছাপ, আর দুটো গ্লাস। ম্যানেজার সায়েব নিজে এসেছেন, খেয়ে রায় দেবেন কতটা জল মেশানো হয়েছে।
গঙ্গারাম হাতের ইশারায় বারণ করে জিগ্যেস করে, “গুরুজি, আমি আপনার বাকি টাকার জন্যে এসেছি। কিন্তু, আপনি এখানে? আপনার ওপর ভবিষ্যতের ভার। আপনি এভাবে দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
— দেখুন স্যার! আমাকে সরকার পয়সা দেয় পাঁচঘন্টা পড়াতে। তাই সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা অব্দি আমি দেশকে একদম সঠিক পথে নিয়ে যাই, কিন্তু একটার পর? তখন আমি নিজেই জানিনে যে আমি কোথায় যাই, তো আমি দেশকে আর কি পথ দেখাব?
ওরকম আউট অফ সিলেবাস জবাব শুনে গঙ্গারাম আবার ভ্যাবা গঙ্গারাম। ফলে ও শুধু মেলার বাইরে থেকে পাঁপড় ও তেলেভাজার দোকান, নাগরদোলা, বোম্বাই ড্যান্স পার্টির তাঁবু এবং "ট্যুরিং টকিজ'-এর বিজ্ঞাপন দেখেই ফিরে এল। গিন্নি গেছে একসপ্তাহের জন্যে মাইকা, মানে বাপের বাড়ি। কাজেই রোববারের দুপুরে খেয়েদেয়ে দিব্যি মেলায় একা-একা ঘোরা যাবে।
এল রোববার। ব্যাংকের চাপরাশি জীবনলাল ডিমের ঝোল, আলুকপি আর ভাত রেঁধে বলল— দু'বেলার মত করা রইল, ওবেলা গরম করে নেবেন। আমি আসব সোমবার সকালে,— ভাবীজি পৌঁছনোর আগেই।
খেয়েদেয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় তিনটে বাজল। গঙ্গারাম পরেছে প্যান্টের সঙ্গে কাজ করা খাদির পাঞ্জাবী, এদিকের লোকজনের ভাষায় ‘কুর্তা'। পনের মিনিট হাঁটলে মহানদীর পুল, সেটা পেরিয়ে ডানদিকের ঢালে নামতেই অনেকটা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশাল মেলা। আজ ছুটির দিন হওয়ায় এখন থেকেই লোকজনের ঢল নেমেছে। সাইকেল আর বাইক রাখার স্ট্যান্ড পেরোতেই কেউ সলজ্জ ভাবে স্যালুট মারল। একটি কিশোর।
— সাহেব, বাবা আপনাকে ডাকছে।
গিয়ে দেখা গেল পান চিবিয়ে দাঁত বের করে হাসছে ব্যাংকের চাপরাশি জীবনলাল।
— ছেলের নামে সাইকেল স্ট্যান্ডের ঠিকে নিইচি, আপনাদের আশীর্বাদে হাতে দু'পয়সা আসছে। রোজ ব্যাংক বন্ধ হলে এখানে এসে একটু হাত লাগাই, হিসেবপত্তর দেখি। অ্যাই, যা দু'কাপ ইস্পেশাল চা নিয়ে আয়।
গঙ্গারাম নিরস্ত করে এগিয়ে যায়। দুপাশে দোকানের সারি। ভাজিয়া, লাড্ডু, বুড়ির চুল, রংচঙে মিঠাই, ছানার জিলিপি ও মুগডালের বড়া বা মুঙ্গোড়া। অনেকেই গঙ্গারামের ব্যাংকের খাতক। নমস্কার-চমৎকারের পালা সেরে ও এগিয়ে যায়। সামনে ট্যুরিং টকিজ বা ভ্রাম্যমাণ সিনেমা হল।
একটি বড় তাঁবু। অনেকটা জায়গা ঘিরে মাটিতে খুঁটি পুঁতে বানানো, সার্কাসের তাঁবুর চেয়ে একটু ছোট। প্লাইউডের ওপর কাপড় লাগিয়ে তার ওপর রং দিয়ে বড় বড় করে লেখা ‘মা মহামায়া ট্যুরিং টকিজ', প্রোপাইটার রবিকুমার ট্যান্ডন। আর পাশে বড় করে টাঙানো দুটো সিনেমার বিজ্ঞাপন— ‘ভগবান সমায়ে সংসার মেঁ' আর ‘তড়িপার' (এলাকাছাড়া)।
সম্ভবত একটি শো শেষ হয়েছে। পিলপিল করে লোক বেরোচ্ছে, স্থানীয় ভাষায় বলা যায়--ভেড়িয়া দশান বা ভেড়ার চাল। একটি অল্পবয়েসী বউ ভীড়ের ঠেলায় মুখ থুবড়ে পড়ছিল, ওকে তুলতে গিয়ে ওর পতিদেবের কনুই লেগেছে পাশের কারো চোখে। ব্যস, প্রথমে গালাগালি — রোঘা! বের্রা! তোর আঁখি লা ফুট গয়ে কা! (রোগেভোগা পাজি বদমাস্! তোর চোখ গলেছে নাকি)। শীগ্গিরই স্বর চড়ে মুদারা ছাড়িয়ে তারসপ্তকে শুরু হল — তেকর দাঈ (তোর মা) ইত্যাদি। এরপর হাতাহাতি। গঙ্গারাম ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে একপাশে সরে দাঁড়ায়, শারীরিক হিংসায় ওর অনীহা।
ইতিমধ্যে ম্যনেজার-কাম-প্রোপ্রাইটার বছর চল্লিশের রবিকুমার এসে গেছে, সঙ্গে দুটো ষণ্ডামার্কা গেটম্যান। এসেই ওরা হাত-পা চালিয়ে এইসব ‘লফরা’ থামিয়ে দিল। তারপর গঙ্গারামকে দেখতে পেয়ে একটু লাজুক মুখ করে এসে বলল — করনা পড়তা হ্যায়, সাহাব! ইস ধান্ধে মেঁ যো করো ও কম হ্যাঁয়। ইন লোগ সব জানোয়ার হ্যাঁয়। দো-চার লাথ-মুক্কা জমা দেনে সে তব মানতা হ্যাঁয়। (এই ব্যবসায় আপনি যাই করুন কোনটাই যথেষ্ট নয়। এখানকার লোকজন হল জানোয়ার। গোটা কয় লাথি-ঘুঁষি লাগান, দেখবেন সব ঠিক।)
আসুন স্যার, একটি সিনেমা দেখে যান। গঙ্গারাম পকেটে হাত দিতেই ম্যানেজার জিভ কাটে।
আপনার ব্যাংকে টকিজের টিকিট বিক্রির পয়সা জমা করতে খাতা খুলেছি, একটি সিনেমা দেখতে এসেছেন, তাও আজ প্রথমবার, পয়সা নিলে ধম্মে সইবে?
ও গঙ্গারামকে প্রায় হাত ধরে গাইডেড ট্যুরের মত করে নিয়ে যাচ্ছিল, তক্ষুণি ওর পথ আটকে দাঁড়াল একটু আগে স্ত্রীকে বাঁচাতে ঝামেলা বা লফরায় পড়া স্বামীটি। ওর হাতের ইশারায় বউটি ঢিপ করে প্রণাম করতেই গঙ্গারাম অপ্রস্তুত। উত্তেজিত স্বামীটি হাত জোড় করে তড়বড় করে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু ও বেশ তোতলা।
ম্যানেজার হেসে বলল— ও হল হকলারাম ছিপিয়া। উত্তেজিত হলে বেশি হকলায়। শান্ত হয়ে যা, তোর কথা আমি বুঝিয়ে বলছি। ও বলছে আপনি যে লোন দিয়েছেন তার আদ্দেক ও দোকানে লাগিয়েছে আর আদ্দেক গেছে নতুন বৌয়ের 'গওনা'য়। (গওনা হল--বালিকা বধূ রজ:স্বলা হইলে তাহার পিতৃগৃহ হইতে প্রথম স্বামী সন্দর্শনে যাত্রার আচার-অনুষ্ঠান।)
কিন্তু আগামী মাস থেকে কিস্তি পটানো শুরু করবে। আজ নতুন বৌটিকে ওর অনুরোধে মেলা দেখাতে এনেছে, ও ভিন গাঁয়ের মেয়ে, আগে কখনো এমন মেলা দেখেনি, সাহেব যেন রাগ না করেন, ইত্যাদি। কি রে, ঠিক বল্লাম তো?
হকলারাম সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
প্রোপ্রাইটার ওকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে প্রায় প্রথম সারির পাশে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসিয়ে দেয়, নিজেও একটু বসে। শো শুরু হচ্ছে, মাঝে মাঝে বিড়ি-নেভাও জাতীয় চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
আলো নিভলো। কিন্তু, একি? বেশ খানিকক্ষণ হয়ে গেছে, না দেখাচ্ছে সার্টিফিকেট, না নায়ক-নায়িকার নামধাম। এদিকে ফাইট, রেপ, গান-নাচ নিয়ে তুলকালাম। অন্ধকারে বেজে উঠছে সিঁই-সিঁই করে সিটি। গঙ্গারাম অস্বস্তিতে। এটা কি ফিলিম? ম্যানেজার ব্যাখ্যা করে — এটা ‘তড়িপার' ফিলিমের দ্বিতীয় ভাগ। প্রথম ভাগ দেখানো হয়ে গেছে। আজ্ঞে না, ওটা শো ভাঙার নয়, ইন্টার্ভ্যালে ছোট বাইরে যাবার ভীড় ছিল। তাতে কি আছে স্যার? আপনি সেকন্ড হাফটা আগে দেখছেন। শেষ হলে পনের মিনিট পর আবার নতুন ব্যাচের জন্যে শুরু হবে। তখন প্রথম ভাগটা দেখে নেবেন। হরে দরে একই হোলো, ল্যাজা-মুড়ো জুড়ে গেল।
গঙ্গারাম দ্বিতীয় ভাগটুকু দেখে বেরিয়ে আসে। দমবন্ধ গুমোট, বিড়ির ধোঁয়া আর গাঁজাখুরি গল্পে মাথা ধরে গেছে।
এবার সামনে এয়ার গান দিয়ে বেলুন ফাটানোর খেলা। পাঁচটাকা দিয়ে দশবার ট্রাই মারলো, একটা বেলুন ফাটলো। পরের স্টলে কপাল ভালো ছিল। রিং ছুঁড়ে একটি বৃত্তের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোন জিনিসের ওপর রিংয়ের মত পরাতে পারলে সেটা তোমার। গঙ্গারাম জিতে নিল একটি বোরোলীন, একটা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি আর একটা গায়েমাখা সাবান।
বেশ খুশিমনে জেতা জিনিসগুলো নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখছে এমন সময় পেছন থেকে কানে এল-- অল্ দ্যাট গ্লিটার্স ইজ নট গোল্ড, জানেন বোধহয়। ওই নকল সাবান ব্যবহার করলে চর্মরোগ হবে। আর কসমেটিকস-এর প্যাকেটগুলো চোখের সামনে এনে ভাল করে দেখুন!
ইংরেজির টিচার শ্যামসুন্দর তিওয়ারিজী।
বিমূঢ় গঙ্গারাম দেখে হুবহু একইরকম প্যাকেটে বোরোলীনের জায়গায় লেখা আছে কোরোলীন, আর ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি হয়েছে কেয়ার-অ্যান্ড-লাভলি; অক্ষরগুলো পর্যন্ত একইরকম।
কেন জানি না ওর মেলাওয়ালা দোকানদারের প্রতি কোন রাগ হয় না। বরং রাগটা হয় জেতার আনন্দ চুপসে দেয়ার জন্যে তিওয়ারি স্যারের ওপর। ধন্যবাদ জানিয়ে ও এগিয়ে চলে ‘বম্বে ড্যান্স পার্টি’র স্টলের দিকে। ভেতরে ঢুকে দেখে খালি স্টেজে স্পট পড়েছে, শুরু হল বলে। আলো নেভে, ব্যাকগ্রাউন্ডে ক্যাসেটে বেজে ওঠে — মার দিয়া জায়ে, কি ছোড় দিয়া যায়ে? বোল্ তেরে সাথ ক্যা সলুক কিয়া জায়ে!
তেহাইয়ের সঙ্গে ঠুমকা লাগিয়ে নাচছে একটি রোগা পটকা লম্বা মত মেয়ে। উচ্ছসিত দর্শককুল। এবার আইটেম নাম্বার টু। চুড়িদার-কুর্তার সঙ্গে হাফ জ্যাকেট পরা একটি ছেলে দিলীপকুমারের অতিরঞ্জিত অনুকরণে গাইছে- শালা ম্যায় তো সাহাব বন গয়া।
গঙ্গারাম অন্যমনস্ক, ওর কানে বাজছে ধরতাইটা।
— আগ লাগে হামারি ঝোপড়িয়া মেঁ, হম গাহে মলহার। ও বেরিয়ে হাঁটতে থাকে। সামনে চায়ের দোকান আর পুলিশ চৌকি। একটু গলা ভেজাবে নাকি? কিন্তু পুলিশ চৌকির সামনে এত ভীড় কেন?
(৩)
একটি টেবিল, কাঠের চেয়ার, একটি ব্যাটারি-সেট হাত-মাইক বা চোঙা; পেছনে চাটাইয়ের বেড়া, মাথার ওপরে তেরপলের ছাউনি — এই নিয়ে মেলার অস্থায়ী পুলিশ চৌকি। ফোর্স বলতে গোটা দুই সেপাই আর একজন হাবিলদার। কিন্তু ভীড় কিসের?
জিগ্যেস করায় কেউ বলল — তামাশা হো গইস্, এক বাঈ লা লেকর এক আদমী অউ পুলিসমন খিঁচাতানি করথে। আদমী ঘলাউ হাকলা হবে, এ কাকর সঙ্গোয়ারি কউন জানে!
(ভারি তামাশা! একটি মেয়েছেলেকে নিয়ে পুলিশ আর একজন ব্যাটাছেলের মধ্যে টানাটানি চলছে। ব্যাটা আবার তোতলা! মেয়েটা যে কার ঘরের বউ কে জানে?)
বকের মত গলা বাড়িয়ে গঙ্গারাম লফরাটা বোঝার চেষ্টা করে। দুটো পুলিশ মিলে একটা গেঁয়ো লোককে থাপ্পড় মারছে আর বলছে —ভাগতা হ্যায় কি নেহি? অন্দর করওয়া দুঁ ক্যা?
আর লোকটা উত্তেজিত তোতলামিতে কি যেন বলতে চাইছে বোঝা যাচ্ছে না। ওদিকে গোঁফের ফাঁকে মুচকি হাসি এক হাবিলদার একটি মেয়ের ডানা ধরে রয়েছে আর পাবলিককে বলছে — ফুটো শালে লোগ! খড়ে খড়ে তামাশা দেখ রহে হো ক্যা?
এক আউরত খো গয়া হ্যায়, হমলোগ উসীকে আদমীকে তলাশ মে লগে হ্যায়।
অল্পবয়সী মেয়েটি পরিত্রাহি কাঁদছে — কয়েকটি কথা অল্পস্বল্প ভেসে আসছে, — ছোড় দে হমলা, সাহাব! হমন গাঁও যাবো, কভি ন মেলে মা আবো।
— দাঁড়া, দাঁড়া! বাড়ি যাবি, সে তো আমরা সবাই যাবো। আমাদেরও বাড়ি ঘর আছে। এত ভয় পাচ্ছিস কেন? ঠিক করে খোঁজ খবর না নিয়ে তোকে যার তার হাতে তো ছেড়ে দিতে পারি না!
গঙ্গারামের মাথায় হঠাৎ টিউবলাইট জ্বলে ওঠে। ও এগিয়ে গিয়ে গোঁফওলাকে বলে ক্যা বাত হ্যায় হাবলদার সাহাব? লফরা কাহে কি?
— আপ কৌন হ্যায়? ও আচ্ছা, ব্যাংকওয়ালে সাহাব! দেখিয়ে না, ইয়ে লড়কি মেলে মেঁ খো গয়ী থী। মতলব ফালতু ঘুম রহী থী, হমারে আদমী পাকড়কে লায়ে। তখন ও বলে কি স্বামীর সাথে মেলায় এসেছিল, ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে। তা গাঁয়ের নাম, স্বামীর নাম কিছুই ঠিক করে বলতে পারছে না।
বিকেলের দিকে এই একটা তোতলা হারামজাদাকে দেখে বলছে যে ওই নাকি ওর স্বামী। আমাদের সন্দেহ সবটাই বানানো। ধান্ধেওয়ালী লড়কী। আজকাল গাঁয়ের থেকে রাজিম মেলায় খুব অল্পবয়সী খাপসুরত লড়কিলোগ আসছে। এখন অ্যারেস্ট হওয়ার ভয়ে উল্টোপাল্টা লোককে স্বামী বানিয়ে কেটে পড়বার মতলব। কিন্তু দুধনাথ হাবিলদারকে চেনে না। আমি উড়ন্ত পাখির লেজে ক'টা লোম বলে দিতে পারি। আমার চোখকে ফাঁকি দেবে?
গঙ্গারাম এখন আর ভ্যাবাগঙ্গারাম নয়। মৃদু হেসে হাবিলদারকে বলে — এদের ছেড়ে দিন। আমি এদের দুজনকেই ভালোভাবে চিনি। এরা হল বরপালী গাঁ নিবাসী হকলারাম আর ওর নয়ী নবেলী দুলহন, মাত্র গওনা হয়েছে, প্রথমবার মেলাতে এসেছে। আমার ব্যাংকে ওদের ছবি আর রেশন কার্ড আছে। কোন চিন্তা করবেন না।
এবার হাবিলদারের তো-তো করার পালা।
আমাদের কোন ভুল নেই, ওর স্বামী তখন থেকে তোতলাচ্ছে, ঠিক করে বলতে পারছে না। আমি কি করবো! ঠিক আছে আপনি যখন বলছেন ওদের চেনেন, ছেড়ে দিচ্ছি।
— কোন টিপছাপ?
— না, না! কেস বানাইনি তো!
এবার মেয়েটি ছুটে গিয়ে হকলারামের বুকে মাথা লুকিয়ে হু-হু করে কেঁদে ফেলে।
পুলিশগুলো অন্যদিকে তাকায়। একজন সিপাহী ব্যাজার মুখে লাঠি নিয়ে ভীড়ের দিকে তেড়ে যায়।
গঙ্গারাম ওদের একটি চা-ভাজিয়ার দোকানে নিয়ে গিয়ে তিন প্লেটের অর্ডার দ্যায়।
ওরা লজ্জা পায়, বলে শিগ্গির গাঁয়ে ফিরে যেতে চায়। ভাজিয়া খেতে খেতে গঙ্গারাম আড়চোখে দেখে নতুন স্বামীর কোন কথায় মেয়েটির ব্রীড়াবনত মুখ। ওদিকে বম্বে ডান্সের তাঁবু থেকে গান ভেসে আসছে — “সজনী তু কাহে আয়া নগরী হমার, ধরেগা বিদেশি বাবু বাহিয়া তোহার”।
গঙ্গারাম বলে— “আজ তো ভীড়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে আর পুলিশের চক্করে পড়ে তোমাদের মেলা দেখা হয় নি। কাল আসবে কি?”
মেয়েটি উত্তেজিত গলায় বলে — নহী সাহাব, অউ কবভো মেলে মা নহী আবো। ইঁহা জানবর রহতে সব, জানবর। ও শালে মুচ্ছল মোলা কহত রইসে — আজ রাত মা মোর ঘর খালি হ্যায়, রুক জা! মোর আদমী মোলা ঢুঁড়ত ঢুঁড়ত ওহাঁ পৌঁছ গঈস। কহিস এ মোর বাঈ হবে, ছোড় দে সাহাব। তো ওলা ধাক্কা মারকে গালি দেকে ভগাওত রঈস্।মর যাবো, পর ইঁহা নহী আবো।
— না, না! তঁয় গলত গোঠিয়াথস্ সওয়ারি!
(না, না! তুই ভুল বলছিস বৌ!)
টেবিলে ঘুঁষি মেরে চায়ের কাপ উল্টে দাঁড়িয়ে পড়েছে হকলারাম, এখন ও একটুও তোতলাচ্ছে না। স্পষ্ট গলায় বলে — হমন কাল আবো, পরশু আবো, রোজ আবো। পর অকেলা নহী, বিনুদাদা, সমারিন ভৌজি, সেবারাম অউ পাঁচজনলা সঙ্গ ধরকে আবো। এহীমন চোর-চোট্টা লালচী হমার কা উখাড় সকী?
(আমরা কাল, পরশু রোজ এখানে আসবো। কিন্তু একা নয়, গাঁ থেকে অনেকে মিলে একজোট হয়ে আসবো। এই চোর-লোভী গুলো আমাদের কি ছিঁড়বে?)
গঙ্গারাম আবার ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে যায়।
(পরবাস-৬৩, ৩০ জুন, ২০১৬)