Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines



পরবাসে তাপস চক্রবর্তীর
লেখা




ISSN 1563-8685




ব্যোমকেশের চলচ্চিত্রায়নে অভিনেতার ভূমিকা

রদিন্দু বন্দোপাধ্যায় ব্যোমকেশের প্রথম গল্প সত্যান্বেষীতে ব্যোমকেশের চেহারার একটা ছবি এঁকেছিলেন। প্রথম দেখাতেই তার মনে হয়েছিল সে শিক্ষিত, মেধাবী, তীক্ষ্ণদৃষ্টি, সংযতবাক, সহৃদয়, মনস্বী, গম্ভীর। বয়েস ২৩/২৪। গায়ের রঙ ফর্সা। বেশ সুশ্রী। সুগঠিত চেহারা। মুখে চোখে বুদ্ধির ছাপ। তার চরিত্রের দিকটা লিখেছিলেন এইভাবে — বাইরে থেকে তাকে দেখে বা তার কথা শুনে একবারও মনে হয় না তার ভেতর অসামান্য কিছু আছে। কিন্তু একবার খোঁচা দিয়ে বা প্রতিবাদ করে যদি উত্তেজিত করা যায় তখন ভেতরের চেহারাটা কচ্ছপের মত বাইরে বেরিয়ে আসে। স্বল্পভাষী কিন্তু একবার ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে যদি চটিয়ে দেয়া যায় তখন ছুরির মত শানিত ঝকমকে বুদ্ধি সংকোচ সংযমের পর্দা ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। চুরুট খায়। ঘরের মধ্যে ঘন ঘন পায়চারী করে। হ্যারিসন রোডের বাড়ীর তিনতলায় থাকে। তিন চারটে ঘরের মধ্যে একটা ঘর ব্যোমকেশের নিজস্ব সেখানে কারুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। ওই ঘরটা একাধারে তার লাইব্রেরী ল্যাবরেটরী মিউজিয়াম আর গ্রীনরুম।

ব্যোমকেশের চেহারার মধ্যে কোথাও শরদিন্দু সঠিক লেখেননি সে কতফুট লম্বা ছিল। যে কখনো অভিনয় জগতে ছিল না বোঝা যায় অথচ গ্রীনরুমে সমস্ত রকম মেকআপের সাজ সরঞ্জাম থাকতো এবং নিজেই নিজের ছদ্মবেশ ধারণ করত ও অজিতকেও ছদ্মবেশ ধরিয়ে দিত। খবরের কাগজ পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়ত। সন্দেহজনক খবর কি বিজ্ঞাপন দাগ দিয়ে রাখতো। বিভিন্ন সময়ে খুনীদের ব্যবহার করা অস্ত্র মিউজিয়ামে রেখে দিত। এটাও জানা যায় দেশপ্রেমিক ছিল। কালো টাকা পুড়িয়ে প্রথম স্বাধীনতা দিবসে সে দেশের কালো টাকার বিরুদ্ধে নিরুচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

বাংলার চলচ্চিত্রে বহুবছর আগে মঞ্জু দে শজারুর কাঁটা ছবি তৈরি করেছিলেন। তারপর বহুবছর ব্যোমকেশ অস্পৃশ্য ছিল প্রযোজকদের কাছে। মাঝখানে স্বপন ঘোষালের মগ্ন মৈনাক এবং সত্যজিতের চিড়িয়াখানা। এখন কয়েকবছর ধরে ব্যোমকেশের বন্যা চলছে। অঞ্জন দত্ত অরিন্দম শীল ও টিভিতে ক্রমাগত ব্যোমকেশের সিরিয়াল চলছে।

এখন বাংলা হিন্দি মিলিয়ে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেছেন দশ জন অভিনেতা। অজয় গাঙ্গুলী, উত্তমকুমার, শুভ্রজিত দত্ত, আবীর চ্যাটার্জী, সুজয় ঘোষ, ধৃতিমান চ্যাটার্জী, যীশু সেনগুপ্ত, গৌরব চক্রবর্তী, রাজিত কাপুর এবং সুশান্ত রাজপুত।

সমস্ত পরিচালকই ব্যোমকেশকে ধুতি পাঞ্জাবী কালো ফ্রেমের চশমায় তার চেহারাটা রেখেছেন। শুধু ধৃতিমান শার্ট প্যান্টে। তিনি একমাত্র বৃদ্ধ ব্যোমকেশ। উত্তমকুমার মাঝবয়সী। বাকি সবাই যুবক ব্যোমকেশ।

উত্তমকুমারই আমাদের চোখে পড়া প্রথম ব্যোমকেশ, কারণ মঞ্জু দের ছবির ব্যোমকেশকে কেউ মনে রাখতে পারেনি। তাই উত্তমকুমারের ব্যোমকেশ আমাদের মননে চিরকালীন ছবি হয়ে থেকে গেছে। চিড়িয়াখানা ছবিতে সত্যজিৎ রায় একেবারে প্রথম দৃশ্যে ব্যোমকেশের হাতে একটি সাপ দেখিয়েছেন। মেরুদণ্ডহীন এই প্রাণীটি শরদিন্দু কোন লেখাতে বলেননি ব্যোমকেশের ছিল। সমাজে যে মেরুদণ্ডহীন মানুষগুলো অপরাধ করে বেড়ায় ব্যোমকেশ যে তাদের নিয়ে চলেন এটাই সত্যজিৎ প্রথম দৃশ্যেই ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমরা একটা কঙ্কালকেও দেখি তার ঘরে। সম্ভবত এনাটমি ব্যাপারটা ব্যোমকেশ ভাল বোঝেন এটা জানাতেই। নিশানাথ সেন (অভিনয়ে সুশীল মজুমদার বিখ্যাত পরিচালক) যখন প্রথম ঘরে আসেন ব্যোমকেশ তার গা থেকে কোটটা খুলে নিতে সাহায্য করেন, অর্থাৎ ব্যোমকেশ ভদ্রতা এবং বিলেতি কায়দায় অভ্যস্ত ছিলেন। সত্যজিৎ এ ছবিতে ব্যোমকেশের নানান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছিলেন যা শরদিন্দু লিখে যাননি। ডাক্তারের গায়ে ধাক্কা লাগিয়ে কাবুলিওয়ালা ব্যোমকেশ তার পকেট থেকে ঘরের চাবি যেভাবে পকেটমারি করেন সে গুণটা শরদিন্দুর লেখায় নেই।

খোঁচা খেয়ে উত্তেজিত হওয়া ব্যোমকেশকে উত্তমকুমারের মধ্যে দেখা যায়নি। ঘুষোঘুষি বা রিভলবার চালাতেও দেখা যায়নি। কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্নের উত্তরে রহস্য ভেদ করার চেষ্টায় উত্তমকুমার আগাগোড়াই অনবদ্য। মৃত্যুর সঠিক সময়টা যখন পুলিশ অফিসারকে বলেন এবং অফিসার অবাক হয়ে যান, সেই সময়ে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে ব্যোমকেশের আত্মবিশ্বাসী জায়গাটা অসাধারণ পর্যায়ে নিয়ে যান উত্তমকুমার। এ ছাড়া জাপানী এবং কাবুলিওয়ালা দুটি ছদ্মবেশেই উত্তমকুমার চমৎকার অভিনয় করেছেন। এ ছবিতে ডাক্তারের ফ্ল্যাটে যেভাবে ব্যোমকেশ চকিতে এ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েটিকে মুখে হাত চাপা দিয়ে ঘরে টেনে নিয়ে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলেন তাতে উত্তমকুমার যথেষ্ট সপ্রতিভ অভিনয় করেছেন। এবং সব রহস্যছবির শেষ দৃশ্য যেখানে রহস্যভেদ করে গোয়েন্দা সেটা বোরিং হয়ে যায়। চিড়িয়াখানাতে উত্তমকুমার সেটা হতে দেননি। ওঁর ডিসেকশন অফ ইনসিডেন্টগুলো এত সাবলীল অথচ ভ্যারিয়েশন নিয়ে বলেছেন যে শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সাসপেন্সটা বজায় রেখেছেন। এ ছবিতে ব্যোমকেশ যে সম্ভাব্য হত্যাকারীদের ছবি দেয়ালে পিন দিয়ে সেঁটে, তারপর একজন একজন করে ছবি সরাতে থাকেন সন্দেহের বাইরে যারা এবং শেষ পর্যন্ত হত্যাকারীর ছবিটাই পড়ে থাকে — এই ধরনটা অঞ্জন দত্ত রেখেছেন সত্যজিৎ ধারাতেই।

উত্তমকুমার হয়তো শরদিন্দুর প্রকৃত ব্যোমকেশ পুরোপুরি হয়ে উঠতে পারেননি কিন্তু অন্যদিকে ব্যোমকেশের মাত্রাটিকে এমন উঁচু পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে ব্যোমকেশ বলতে ঐ উত্তম-মাপকাঠি থেকেই সবাইকে বিচার করতে হয়।

যদি উত্তমকুমার থেকে যীশু সেনগুপ্ত পর্যন্ত ব্যোমকেশের চরিত্রচিত্রণ পাশাপাশি রাখা যায় তো দেখা যাবে উত্তমকুমার করেছেন মধ্যবয়সী ব্যোমকেশ। চরিত্রের তীক্ষ্ণদৃষ্টি, অবলোকন, ধীর স্থির ভাব, সত্য অন্বেষণ করার ধারার প্রশ্নোত্তরগুলো অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই উত্তম-ব্যোমকেশকে কখনো উত্তেজিত হতে দেখিনি কিংবা সংঘাতের সামনে দেখা যায়নি কিংবা রিভলবার বা ঘুষোঘুষি করতে দেখা যায়নি। আদ্যন্ত এক বাঙালি মধ্যবিত্ত সাবলীল ব্যোমকেশ। পক্ষান্তরে আবীর যীশু শুভ্রজিৎ সুশান্ত রাজপুত গৌরব চক্রবর্তীর ব্যোমকেশ একেবারেই যুবক ব্যোমকেশ। মোটা চশমা যতই দেয়া হোক না এঁদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এঁরা মুখে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। এঁদের জেরা করার ধরনের মধ্যেও একটা যৌবনের ছটফটানি রেখে দেয়া হয়েছে। এঁরা প্রত্যেকেই অবশ্য একটা ধীর স্থির ভাব বজায় রেখে গেছেন। এর মধ্যে বরং যীশু সেনগুপ্তর ব্যোমকেশ অনেক ধারালো হয়ে বেরিয়ে এসেছেন যতটা আবীর বা গৌরব পারেননি। যীশু রিভলবার ব্যবহার করেছেন। সাগ্নিককে চড় মেরে যে অ্যাকশনটা করেছেন সেটা সরাসরি শরদিন্দুর ভাষা থেকে উঠে আসা ব্যোমকেশ — একবার চটাইয়া দিয়ে যদি উত্তেজিত করা যায় মুহূর্তে শানিত ছুরির মত ব্যোমকেশ কচ্ছপের মত বাহির হইয়া আসে — যীশু হুবহু এই জায়গাটা অপূর্ব ধরেছেন। হাঁটায় চলায় যীশুর ব্যোমকেশ অনেক সপ্রতিভ অনেক খেলোয়াড়চিত। ধুতি-পাঞ্জাবীতে অনেক দ্রুত অন্যদের চেয়ে। আবীর যেমন মুখের ওপর কড়া ভাষায় জবাব দিতেও অসম্ভব ভদ্রতা বজায় রাখে। গৌরব যেমন অভদ্রতা একেবারেই করে না। যীশু করে এবং দাপটের সঙ্গে করে। অন্যদিকে বয়স্ক ব্যোমকেশ হিসেবে ধৃতিমান ব্যোমকেশের চেহারাতে একজন মনস্ক অভিজ্ঞ চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন। অ্যাকশনধর্মী একেবারেই নয়। খুব সহজ স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে জিজ্ঞাসাবাদ এবং অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে রহস্যের সুরাহা করেন।

ছোটপর্দার ব্যোমকেশ হিসেবে রজিত কাপুর এবং গৌরব চক্রবর্তী যথেষ্ট ভালভাবে চরিত্রটাকে মেলে ধরেছেন। গৌরবের সাংসারিক ব্যোমকেশ একটা নতুন পাওয়া। কিন্তু চেহারায় গৌরব বড্ড ছোট্টখাটো যেটা ব্যোমকেশ ভাবলে ঠিক খাপ খায় না। সীমন্তহীরা গল্পে এক জায়গায় শরদিন্দু লিখছেন — খুলির মধ্যে পঞ্চান্ন আউন্স ব্রেন ম্যাটার আছে। হনু আর চোয়াল উঁচু, মৃদঙ্গ মুখ, বাঁকা নাক, ত্বরিতকর্মা কূটবুদ্ধি একগুঁয়ে। ইনটিউশন খুব বেশি। রিজনিং পাওয়ার মন্দ ডেভলপড নয়। কিন্তু এখনো চরিত্রটাকে ম্যাচিওরড করে তুলতে পারেননি ... বুদ্ধিমান বলা চলে। এই যে ব্যোমকেশ সম্বন্ধে তার ভেতরের চরিত্রটার ছবি আঁকলেন এর সঙ্গে গৌরব চক্রবর্তীকে বা আবীরকে মেলানো মুস্কিল।

চলচ্চিত্রে ব্যোমকেশের চরিত্রচিত্রণে যে অভিনেতারা অভিনয় করে এসেছেন যদি তাঁদের অভিনয়-কালের ক্রমানুসারে সাজাই তাহলে আমি এভাবে বলতে পারি —

যুবক ব্যোমকেশের চরিত্রে প্রথমেই যীশু তারপর আবীর, শুভ্রজিৎ। অজয় গাঙ্গুলী, সুজয় ঘোষ।

মধ্যবয়সী ব্যোমকেশের চরিত্রে একমাত্র উত্তমকুমার।

বৃদ্ধবয়সী ব্যোমকেশ চরিত্রে ধৃতিমান চ্যাটার্জী।

ছোট পর্দায় ব্যোমকেশের চরিত্রে রাজিত কাপুর, গৌরব চক্রবর্তী।

হিন্দিতে সুশান্ত রাজপুত বেশ ভাল।

আর ব্যোমকেশের চরিত্রচিত্রণে যে পরিচালকরা ভালমত খেটে চরিত্রটা দাঁড় করিয়েছেন তাঁদের ক্রমপর্যায়ে রাখবো সত্যজিৎ রায়, অঞ্জন দত্ত, ঋতুপর্ণ সেনগুপ্ত, অরিন্দম শীল। এঁরা কেউই ব্যোমকেশকে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা ধুতি পাঞ্জাবীর বাইরে নিয়ে যাননি। সত্যজিতবাবুর মাপ ব্যবহার করাটা যতটা সিনিক ততটা ব্যোমকেশকে তুলে ধরা নয়। অঞ্জন দত্ত একেবারে শরদিন্দুর ভাষা থেকে যীশুকে তুলে ধরেছেন। অরিন্দম শীল আধুনিক করে তুলেছেন অনেকটাই। আর ব্যোমকেশকে প্রকাশিত করতে অজিতের চরিত্রটাতে অঞ্জন দত্ত অরিন্দম শীল যতটা মনোযোগ দিয়েছেন অন্যরা ততটা নয়। মঞ্জু দে খুব ওপর ওপর গল্পটা বলে গেছিলেন। অজিতের চরিত্রে শাশ্বত অসাধারণ। শৈলেন মুখার্জীও ভাল।

চলচ্চিত্রে ব্যোমকেশের জোয়ার এসেছে। গোয়েন্দা-গল্প প্রযোজকরা তুলতে চাইতেন না কারণ ছবিটা কেউ দুবার দেখবে না, কেননা খুনী কে সেটা তারা প্রথমবার দেখেই জেনে যাবেন, তাই। কিন্তু এখন লোকে দেখছে কারণ চরিত্রগুলো আরও লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে বেরিয়ে আসছে। অঞ্জন দত্ত যেমন টেকনিকে রশোমন-ছায়া ফেলেছেন তার ছবিতে, তেমনি রহস্যের ধারাটা নানান পথে আকর্ষণীয় করে তুলে দেখাচ্ছেন পরিচালকরা। তাই লোকে দুবার দেখছে।

এখন অপেক্ষা নতুন নতুন ব্যোমকেশের গল্পে কত নতুনভাবে, কত গভীরভাবে, আরো নিখুঁত করে ব্যোমকেশকে উপস্থাপিত করতে পারেন পরিচালকেরা।