সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড; প্রধান সম্পাদকঃ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, সম্পাদকঃ অঞ্জলি বসু; প্রকাশনালয়ঃ সাহিত্য সংসদ, কলকাতা-৯; ISBN: 978-81-7955-291-9(set)
চারদশক প্রাচীন এক বাঙলা প্রকাশনা। ভাষাচার্য সুনীতিকুমারের ধ্রুব বিশ্বাস ছিল, ‘এই পুস্তকের উপযুক্ত সমাদর হইবে’। হয়েছেও। এই সময়ের মধ্যে এই মহাগ্রন্থের পাঁচটি সংস্করণ বেরিয়েছে, কলেবর হয়েছে ত্রিগুণ।
এ’হেন এক পুস্তকের ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’, নিদেন ‘গ্রন্থ-পরিচয়ে’রও কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? আম-বাঙালী পাঠকের মনোজগতে এ’গ্রন্থ কি ইতোমধ্যেই এক পাকা স্থান করে নেয়নি?
মনোজগতে পাকা স্থান করে নেওয়া আর গ্রন্থখানির নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা হওয়া দুটি পৃথক বিষয় এবং এ’দুটির মধ্যে বিরোধ নেই কোনো। কিংবদন্তীর ‘অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিক্সনারি’-র প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংস্করণটি বেরোতে আটত্রিশ বৎসর লেগেছিলো (১৮৫৭ থেকে ১৮৯৫ খৃ.)। প্রথম কাজ শুরুর সত্তর বছর পরে বিশ ভল্যুমের দ্বিতীয় সং বেরিয়েছিলো ১৯২৮এ। নিরন্তর পরিমার্জন, সমালোচনা ও ফিরে ফিরে তাকানো ছাড়া এই মানের কোষগ্রন্থ হতে পারে না। বস্তুতঃ, অভিধান বা অভিধানজাতীয় যেকোনো কোষগ্রন্থের জীবনরেখা এইটাইঃ তার স্বতঃচলমানতা। এইটে রুখে গেলেই কোষগ্রন্থটিরও শেষঘণ্টা বেজে গেল। তিনসংখ্যা আগে প্রণম্য হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিংবদন্তীসম মহাভিধানগ্রন্থের আলোচনায় এই আক্ষেপটিই আমরা পড়েছিলাম [গ্র.স.- পরবাস ৬২]।
প্রসঙ্গতঃ, একটি ভাববার বিষয়--কোনো কোষগ্রন্থ বা অভিধানের কি আদৌ কোনো গ্রন্থ-সমালোচনা হতে পারে? অন্যভাবে শুধোলে, কোনো বই পুরোটা না পড়েই কি তার সমালোচনা লেখা যায়? আবার, একটি ৮৮৫+ ৪৮৬ = ১৩৭১ পৃষ্ঠার কোষ, প্রবিষ্টি সংখ্যা যার চারসহস্রাধিক, তার সবকয়টি ভুক্তি পড়ে নিয়ে তবেই কি গ্রন্থটির সমালোচনা লেখা উচিত? নৈলে নয়? দুই সংখ্যা পূর্বে ‘আরবি-ফারসি-অভিধান’-টির ক্ষেত্রে যেটা করা সম্ভব হয়েছিলো, তার পৃষ্ঠাসংখ্যা সওয়া-দুইশ’র বেশি ছিলো না বলে। কিন্তু বর্তমানটির ক্ষেত্রে নামী প্রকাশনা সংস্থাটি বারো বছর পরে (‘৯৮এ’ চতুর্থ, ২০১০-এ পঞ্চম সংস্করণ; ৩য় মুদ্রণ অগাস্ট ২০১৬) অতিজনপ্রিয় এই ‘বাঙালি চরিতাভিধান’ নবকলেবরে বের করলেন মাত্র কয়েকমাস আগে, দুই-খণ্ডে, এবং শিরোনামের বানান পর্যন্ত বদলে দিলেন (‘বাঙ্গালী’ থেকে ‘বাঙালী’ হয়ে ‘বাঙালি’), আর হদ্দ-সমালোচকের কলম (থুড়ি, কি-বোর্ড) নিশপিশ করে উঠবে না? বিশেষতঃ, যেকোনো পুস্তকের পাঠক, তার চেয়েও বেশি, ক্রেতার, এক স্বোপার্জিত অধিকারের কথা যখন এই কলমে আমরা আগেও বলেছি?
শিরোচিত্র ‘প্রথম খণ্ড’-এর দেওয়া থাকলেও আমরা এখানে দুইটি খণ্ডের কথাই বলবো। আর অবধারিত তুলনা চলে আসবে সুসম প্রতিযোগী ‘বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান’ (ঢাকা)-র সঙ্গে।
একজন ‘বাঙালী’ কে? কী তার সংজ্ঞা ও পরিচয়? যেকোনো ধর্মের স্ত্রীপুরুষ যিনি (হয়তো) বঙ্গভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন, (সম্ভবতঃ) যাঁর মাতৃভাষা বাঙলা, এবং বিশেষতঃ, এই ভূমি ও তার মানুষজনের জন্যে যাঁর উল্লেখ্য অবদান আছে শিল্প-সঙ্গীত-সাহিত্য-রাজনীতি-ক্রীড়াহেন নানান ক্ষেত্রে--তিনিই এমন একটি কোষগ্রন্থে ঠাঁই পাবার যোগ্য, তাইতো? হ্যাঁ, এই নীতি মেনেই এ’গ্রন্থে সঠিক স্থান করে নিয়েছেন ডেভিড হেয়ার, হেরাসেম লেবেডেফ, হানা মুলেন, মেরি কার্পেন্টার, সখারাম গণেশ দেউস্কর, ফণীশ্বরনাথ রেণু, শিবকুমার রাই (গোর্খা লিগ) ... বেশ। এই কথাটি মাথায় রেখেই নতুন কেনা কেতাবের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম, এবং এমন এক বই হাতে পেয়ে প্রথমেই যেমনটা হওয়া স্বাভাবিক তেমনই মনে মনে ভাঁজা চরিত্রনাম খুঁজতে লেগেছিলাম। স্যর উইলিয়াম জোন্স—ভারতে পদার্পণকারী শ্রেষ্ঠ ইংরেজ জ্ঞানতাপস! স্যর চার্লস উইলকিন্স—বঙ্গদেশে মুদ্রণশিল্পের জনক। অশোকের শিলালিপির পাঠোদ্ধারকারী পলিম্যাথ জেমস প্রিন্সেপ! চমৎকার! কিন্তু জেমসের গুরু হোরেস হেম্যান উইলসন? হেনরি টমাস কোলব্রুক? হোঁচট খেতে হলো যে! কোন যুক্তিতে এঁরা বাদ? উইলসন না এলে যে ভারতের গৌণধর্মের চর্চা শুরুই হতো না।
প্রথম কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যেই চমৎকার একটি ভুক্তিঃ সিংহল-সন্তান শ্রীমান অনাগরিক ধর্মপাল, যিনি কলিকাতায় ‘মহাবোধি সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৯১ খৃ.)। অতএব খুঁজলাম শ্রীহট্টের শাহ্ জালালের নাম। নেই! বঙ্গদেশে প্রচারকারীগণের মধ্যে শাহ্ জালাল-সাহেবের চেয়ে বড় ধর্মগুরু আর ক’জন আছেন? বাঙলাদেশ সরকার ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরখানি তাঁর নামে নামাঙ্কিত করে ধন্য হয়েছেন, আর কলকাতার মান্য কোষগ্রন্থে তিনি নেই! এটা অবশ্যই নয় যে এই মহাগ্রন্থে মুসলিম ব্যক্তিবর্গ উপেক্ষিত থেকে গেছেন; বরঞ্চ আগের আগের সংস্করণের চেয়ে বর্তমানটি পুষ্টতর এই নিরীখে, কিন্তু কিছু কিছু ব্যক্তিত্বের অনুপস্থিতি বা ছোঁয়া-ছোঁয়া উল্লেখ বিভ্রান্তিকর। যেমন, কাজী নজরুল ইসলামের পূর্বসূরী কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১ খৃ.), যাঁকে ‘অনল-প্রবাহ’ কাব্যের জন্যে বৃটিশ সরকার দুই বৎসর কারারুদ্ধ করে। ইনিও নজরুলের মত মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে যান (তুরস্কসুলতান কর্তৃক ‘গাজী’ উপাধিতে ভূষিত), খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন, পরে চিত্তরঞ্জন ‘স্বরাজ্য দল’ গঠন করলে যোগ দেন তাতে। না, সংসদের এই কোষে এ’সব তথ্য নেই, আছে একটি ভুল তথ্য যে তিনি পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। না, তিনি ডাক্তার ছিলেন না, যদিও তুরস্কে গিয়েছিলেন এক মেডিক্যাল মিশনের সদস্য হয়ে। আরও আশ্চর্য এঁর নামে পৃ. ৭২ ও ৯০-এ দুইটি পৃথক ভুক্তিতে রয়েছে খাপছাড়া ছড়ানো-ছিটোনো তথ্য।
মহাকবি মুন্সি কায়কোবাদের (১৮৫৭-১৯৫১) নামমাত্র উল্লেখও মানা গেল না। আরও কয়েকজন উল্লেখযোগ্য বাঙালী কবি, যেমন, ‘জঙ্গনামা’-কার শাহ্ মুহম্মদ গরীবুল্লাহ্, মরমীকবি রকীব শাহ্ (শীতলাং শাহ্, পাঞ্জু শাহ্, পাগলা কানাই আছেন), বা ‘কবিদের কবি’ আবুল হাসান (১৯৪৭-৭৫)-এর নাম খুঁজে পাইনি।
এ’চর্চা দীর্ঘতর করে লাভ নেই।
১৯৭১এর ‘বাঙলাদেশ মুক্তি আন্দোলন’ ধর্মনির্বিশেষ বঙ্গজাতীয়জীবনের এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কারণ এর আগে ইতিহাসে কখনও কেবল বঙ্গভাষীদের দ্বারা সৃষ্ট কোনো রাষ্ট্র গঠিত হয়নি (হয়তো, প্রাচীনকালের ‘পালসাম্রাজ্য’)। কিন্তু এই পঞ্চম সংস্করণে এসেও কলকাতার ‘সংসদ বাঙালি চরিতাভিধানে’ মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ বাঙালিনায়কগণ উপেক্ষিত থেকেই গেছেন। নৈলে, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ সেনানায়ক ওসমানী বা (পরবর্তীর প্রেসিডেন্ট) জিয়াউর রহমান অনুল্লেখিত থেকে যান? আর, ‘বঙ্গবন্ধু’র নামের সঠিক উচ্চারণ তো পশ্চিমে আজও আমরা সঠিক শিখতে পারলাম না--‘মুজিব-উর-রহমান’ (Responder of Allah’s call)... ‘মুজিবর’ নয়, তাই ‘মুজিবুর’-ই সঠিক উচ্চারণ।
আরেকটি প্রসঙ্গঃ ‘ভাষা আন্দোলন’—বঙ্গভাষাভাষীর এক মহান গর্বের (আবার, বেদনারও) ঘটনা। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ তো আর কেবল ঢাকার বিষয় নয়, রাষ্ট্রসঙ্ঘের স্বীকৃতি পেয়ে আজ তা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’! এ’বইয়ে ভাষাশহীদদের স্থান আছে বটে--আবুল বরকত, রফিকুদ্দিন আহমেদ আছেন; কিন্তু আব্দুস সালাম, আব্দুল জব্বার নেই কেন? মন্ত্রগুরু আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ-সাহেবের ভুক্তিটি পড়ে মন ভরলো।
কোষগ্রন্থ থেকে কত সহজে তথ্য আহরণ করা যাবে সেটি তার সাফল্যের একটি বড়ো নিরিখ। মানছি, বইটি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে নেই (এখনও),তাই ক্রশ-রেফারেন্স সাবেক পদ্ধতিতে হতে বাধ্য। কিন্তু... একটা উদাহরণ দিইঃ ধনঞ্জয় দাসকে চেনেন? কোন্ ধনঞ্জয়? চিনতে পারলেন না তো? ‘কাঠিয়াবাবা’ বললে হয়তো পারতেন। ‘কাঠিয়াবাবা’ কিন্তু ব্যক্তিনাম নয়, নিম্বার্ক-বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের এক পদনাম; সর্বাপেক্ষা পরিচিত নাম ঊনবিংশ শতকের পাঞ্জাব-তনয় স্বামী রামদাস কাঠিয়াবাবাজী (৫৪তম)। শ্রী ধনঞ্জয় দাস (১৯০২-১৯৮৪ খৃ.) ৫৬তম ‘কাঠিয়াবাবা’ হয়েছিলেন--এই পদে দ্বিতীয় বঙ্গসন্তান। প্রথমজন কে? খুঁজে বের করা সহজ এই মহাকলেবর কোষগ্রন্থ থেকে? এঁরা যেহেতু মূলতঃ কোনো বঙ্গীয় গোষ্ঠী নন, কোনো উৎসাহী পাঠক যদি এ’বিষয়ে কিছু জানতে চান, কী করে খুঁজবেন?
অন্যভাবে, ধরা যাক্, যদি ‘কাঠিয়াবাবা’ বলে একটি ভুক্তি থাকতো, যাতে ‘দ্র.’ বলে ধনঞ্জয়ে আসা যেত, সহজতর হতো না খোঁজাটা? ‘জগৎশেঠ’ ভুক্তিটি এইভাবেই রয়েছে। ‘লালাবাবু’-ভুক্তিটিও। বেশ। অনুরূপ আরেকটা উদাহরণ হতে পারে, ধরুন, ‘সন্তোষ ট্রফি’(ফুটবল)-র দাতা/উদ্যোক্তা, শুনেছি, ছিলেন সন্তোষের (অধুনা বাঙলাদেশের টাঙ্গাইলে) কোন্ এক রাজা। কে তিনি? কীভাবে খুঁজবো এই অভিধান থেকে যদি স্যর মন্মথনাথ (রায়)চৌধুরীর নামটি না জানি? বিনীত প্রস্তাব, যদি ‘স’-তে একটি এমন ভুক্তি থাকতোঃ “সন্তোষ (ট্রফি) দ্র. মন্মথ চৌধুরী”, মন্দ হতো কি? শেষ বিচারে, পাঠককে তাঁর লক্ষ্য ভুক্তিটিতে এনে ফেলাই না কোনো অভিধানের প্রধান উদ্দেশ্য? ঠিক এমনই উদাহরণ ইসকন (মায়াপুর)-এর প্রতিষ্ঠাতা ‘স্বামী ভক্তিবেদান্ত প্রভুপাদ’ (অভয়চরণ দে) সম্বন্ধে দেওয়া যায়। দ্বিতীয় খণ্ডে ‘আনন্দমার্গের’ প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্তির (প্রভাতরঞ্জন সরকার) ভুক্তিটি সম্পর্কেও এই একই অনুরোধ থাকবে।
আরেকটি জরুরি বিষয়ঃ ক্যালেন্ডার। গ্রেগরিয় পঞ্জিকায় তো আজ বাঙলা-ভারত তথা বিশ্ব সড়গড় হয়ে উঠেছে। তাই মাঝেমাঝেই এই কোষে হঠাৎ হঠাৎ বাঙলা পঞ্জিকার দিনোল্লেখ খানিকটা বিভ্রান্তিকর বৈকি? চৈতন্যদেবের জন্ম-প্রয়াণ দেওয়া রয়েছে ১৯ ফেব্রু ১৪৮৬ থেকে জুলাই ১৫৩৩, আর তার ঠিক আগেই চিন্তাহরণ স্মৃতিতীর্থের শ্রাবণ ১২৯০ থেকে ১৬.১২.১৩৫৬ব। বিভ্রান্তিকর নয়? প্রথম প্রকাশের ছত্রিশ বৎসর পরে ‘সংশোধিত ও সংযোজিত’ পঞ্চম সংস্করণে (২০১৬-র ৩য় মুদ্রণ) এসেও একটাই সমরূপ পঞ্জিকা অনুসরণ করা হয়নি, এটি মানা গেলো না। আজকাল সহজলভ্য এপ্স (apps) আছে যাতে এই রূপান্তর অতি সহজে সম্ভব।
দ্বিতীয় খণ্ডটি সম্বন্ধে আলাদা করে আর কী বলবো? ৩১ জুলাই ২০১৪ পর্যন্ত যে সব উল্লেখযোগ্য বাঙালী প্রয়াত হয়েছেন তাঁদের নাম সংগৃহীত হয়েছে এই খণ্ডে, যদিও পূর্বে বাদ পড়ে যাওয়া কোনো কোনো ব্যক্তিত্ব, যেমন উইলিয়াম কেরির সহযোগী প্রযুক্তিবিদ্ গোলক কর্মকারের নাম এখানে ঠাঁই পেয়েছে। রেভারেণ্ড জেমস্ লঙ, ভাষাবিদ্ লক্ষ্মণ মজুমদারের নাম দুই খণ্ডেই এসে গেছে (কেন?)। কত কত যে নতুন তথ্য জানতে পেলুম এখানেঃ অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের ব্যবহারজীবি পিতৃদেব উপেন্দ্রচন্দ্র যে নামী শিশুসাহিত্যিকও ছিলেন, জানতাম না। এটাও জানতাম না যে তাঁর পিতা ডাঃ ইন্দুমাধবই হলেন ‘ইকমিক কুকারের’ আবিষ্কর্তা। ভারতের প্রথম বাঙালী অর্থমন্ত্রী ব্যারিষ্টার শচীন চৌধুরীর জন্মস্থান লেখা হয়েছে হুগলী জেলার ‘আরামবাগ’ (পৃ ৩৭০), হবে ‘জনাই’। শ’ ওয়ালেসের ডিরেক্টার সতু চৌধুরী তাঁর পিতা ছিলেন না, ছিলেন ভ্রাতা। পিতা ছিলেন বেনিয়ান প্রবোধচন্দ্র চৌধুরী।
পৃ ৪৫৩-এ রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সুবিনয় রায়ের (১৯২১-২০০৪) পরিচয়ে লেখা হয়েছে যে তিনি নাকি পঙ্কজকুমার মল্লিকের (১৯০৫-৭৮), আজ্ঞে হ্যাঁ, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গীতগুরু ছিলেন, যে তথ্যের পুষ্টি অন্য কোত্থাও পাইনি। প্রথম খণ্ডের পৃ ৩৮১-এ সঠিকই লেখা আছে কিনা যে পঙ্কজকুমার রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখেন দিনু ঠাকুরের কাছে। শারদীয়া পুজোর আগে আগে কেনা কিনা কেতাবজোড়া, তাই সুপ্রীতি ঘোষের নাম বড্ড খুঁজছিলুম। না পেয়ে দুখী। মহালয়ার গানে কেবল ঐ ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’-র জন্যেই ওঁনার একটি ছোট্ট ভুক্তি থাকা উচিত ছিল, নয় কি? সুপ্রভা সরকার আছেন, আছেন জপমালা ঘোষও। বেশ।
সুফিয়া কামালের ভুক্তিটি পড়ে মন ভরলো (পৃ ৪৫২)। বাঙালীর বাণিজ্য-ইতিহাস প্রায় শূন্য। যেটুকু আছে, সে-প্রসঙ্গে ‘পিয়ারলেসের’ রাধাশ্যাম রায়ের নাম ‘চরিতাভিধানে’ নেই বলে আক্ষেপ করেছিলাম ছ’ বছর আগে, ৪৫-সংখ্যায় [গ্র স- ৪৫]। নবতম সংস্করণে এসেও সে-আক্ষেপ থেকে গেলো। নেই সংস্থাটির প্রধান স্থপতি ভূদেবকান্তির নামও (বি কে রায়)। ‘ল্যাণ্ড অব্ ব্যাঙ্কস্ এন্ড ট্যাঙ্কস্’ কুমিল্লার সন্তান নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত আছেন, অবশ্য। এনার ‘কুমিল্লা ব্যাঙ্ক’ পরে ইউবিআইয়ে মিশে যায়।
শেষে মনে হচ্ছে (আচ্ছা, এটা কি খুব অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে না?), যে যুক্তিতে জোন্স বা হ্যালহেড আছেন এই কোষে, শেঠ সুখলাল কারনানি বা দ্বারভাঙার মহারাজা রামেশ্বর সিংহ কেন স্থান পাবেন না এখানে? রমাপ্রসাদ গোয়েঙ্কা (১৯৩০-২০১৩)র নাম তো খুব খুঁজছিলাম দ্বিতীয় খণ্ডে (৪র্থ সং প্রকাশিত ২০১৫তে)।
আমাদের কর্তাভজা (পড়ুন, ইংরেজভজা)-পনা আর অবশিষ্ট নেই বলছেন? আর, অন্য প্রদেশীয়দের প্রতি উন্নাসিকতা? নৈলে, শিল্পী আরনেস্ট হ্যাভেল ‘বাঙালি চরিতাভিধানে’ আছেন (বেশ তো), আর শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লা এখানে ঠাঁই পান না ‘রে রে’ উঠবে, তাই! বাংলার শিল্প-কর্মক্ষেত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বুর্জোয়া ঘনশ্যামের অবদান কম নহে। এনাদের বাদ দিলেও ভূমিকায় তার যুক্তিটা থাকা দরকার।
নতুন নতুন সংস্করণে এক কোষগ্রন্থে নিবদ্ধ তথ্যের নবীকরণ হবে এটাই তো স্বাভাবিক, না? হয়েছে কি? ডিসে ১৯৮৮র দ্বিতীয় সংস্করণে ‘কার্তিক বসু’-ভুক্তিটিতে ছিলো--‘বাংলা এখন পর্যন্ত একবারই রঞ্জি ট্রফি জিতেছে। কার্তিক বসু সেই জয়ী (১৯৩৮-৩৯)দলের সদস্য ছিলেন’। কিন্তু আজ এই ২০১৬তে দাঁড়িয়ে এটি তো আর সঠিক তথ্য নয়, কারণ ইতোমধ্যে ১৯৮৯-৯০তে বাঙলা দ্বিতীয়বার (এখনও পর্যন্ত শেষবার) জিতে ফেলেছে রঞ্জি ট্রফি। কিন্ত দ্বিতীয় থেকে ৩য় ৪র্থ ডিঙিয়ে এই পঞ্চম সংস্করণে এসেও (জুলাই ২০১০, ৩য় মুদ্রণ অগাস্ট ২০১৬) বইটিতে তথ্যটি পুরনোই (অতএব, ভুল) থেকে গেছে।
বর্তমান সংস্করণে ক্রীড়াব্যক্তিত্বগণের গুরুত্ব বেশ বেড়েছে। খুবই আনন্দের কথা। তবু ভূপেন্দ্রনাথ বসুর এতো দীর্ঘ পরিচয়ের মধ্যেও তিনি যে মোহনবাগান ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা-প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এটা পড়তে চেয়েছিলাম। তেনজিং নোরগের উপস্থিতিতে আনন্দিত হই।
একেবারে গ্রন্থশেষে, ঢাকার চরিতাভিধানটিতে কেবলমাত্র প্রবিষ্টির শীর্ষনামগুলি, সংখ্যায় কম নয়, প্রায় দেড়সহস্র, দেওয়া রয়েছে দশপৃষ্ঠাজুড়ে, যেটা তাঁদের তৃতীয় সংস্করণের (২০১১) উদ্ভাবনা। এটি বড্ড কাজের, কারণ কোনো একটি প্রবিষ্টি খুঁজতে, তাই, আর পাতার পর পাতা উল্টে উল্টে যেতে হয়না। ‘সংসদ’-কর্তৃপক্ষ পরের পরে সংস্করণের জন্যে এটি চিন্তার মধ্যে রাখতে পারেন।
বহু মুদ্রণপ্রমাদ এখনও নজরে এসেছে। ‘ব্যবসা’ শব্দটি এতোবার ‘ব্যাবসা’ ছাপা হয়েছে কেন?
পুনঃ- শীর্ষনাম কেন ‘বাঙালী’ থেকে ‘বাঙালি’ হলো সেটা কিন্তু বলেননি কোত্থাও। বর্তমান সংস্করণটি দৃশ্যতঃই কলেবরে দ্বিগুণ হয়ে উঠলেও ঘোষিত ভুক্তি-সংখ্যা চারহাজারই থেকে যায় কী করে?
১৯১১: বাঙালির ঐতিহাসিক ফুটবল যুদ্ধ; কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়; সেতু প্রকাশনী, কলকাতা-৬; প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০১১; ISBN 978-93-80677-04-0
ঊনিশশ’ এগারো নিয়ে আম-বাঙালীর মাতামাতি আর যাবে না।
• আম বাঙালীর?
• শুধু বাঙালীর?
প্রশ্নদুইটির উত্তর খুঁজলেই এক নিবন্ধ বনে যায়।
সুধী পাঠক ধরেছেন ঠিকই, না, আমি ভারতেতিহাসে ১৯১১-র অন্য আরেকটি বড় ঘটনার কথা এখানে বলতে বসিনিঃ ডিসেম্বরে বৃটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লি চলে যাওয়া। আমার লক্ষ্য ২৯শে জুলাইয়ের সেই ঐতিহাসিক ফুটবল বিজয়!
ক্লাসিক সাহিত্যের মত এ এক ইতিহাসের ক্লাসিক ঘটনা, যা বারে বারে পড়লে-জানলে-ফিরে তাকালে নব নব রূপে দেখা দেয়। এককালে মনে হতো এ’ ঘটনা ছিল নগর-কলকাতার উচ্চবর্ণ হিন্দু পুরুষদের আদিখ্যেতামাত্র, ঐ ঐ পরিধির বাইরে যার প্রভাব ছিল নগণ্য। আবার, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনঃবিচারে মনে হয়েছে, এর ব্যাত্যয়টাই বা আর কী হতে পারতো?
এগারো কি একটা স্ফুলিঙ্গ ছিলো?
স্ফুলিঙ্গ তো করে এক শুরুয়াৎ, যার ক্রমপ্রভাবে আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে দিগদিগন্ত, সুদূর বনানী! তাহলে দ্বিতীয়বার শীল্ড জিততে বাগানকে দীর্ঘ ছত্রিশ বচ্ছর অপেক্ষা কেন করতে হয় (১৯৪৭), লীগ প্রথম জিততে আঠাশ বছর (১৯৩৯)? স্বাধীনতার আগে মোহনবাগান ডুরান্ড-রোভার্স জেতেইনি, প্রথম জেতে যথাক্রমে ১৯৫৩ ও ১৯৫৫তে। এরমধ্যে মহমেডান স্পোর্টিং প্রথম আবির্ভাবেই একাদিক্রমে পাঁচবার কলকাতা ফুটবল লীগ জিতে রেকর্ড করেছে (১৯৩৪-৩৮), বাগানের এগারোর পরে তারাই দ্বিতীয় দেশি দল হিসেবে শীল্ড জিতলো ১৯৩৬এ; তারাই কলকাতার প্রথম টিম হিসেবে রোভার্স জেতে ১৯৪০এ, সে বছরই ডুরান্ডও প্রথম জিতে দ্বিমুকুট! ইতোমধ্যে আরেক বর্ণহিন্দুদের ক্লাব ইস্টবেঙ্গল (প্র. ১৯২০) লীগ-শিল্ড জিতে নিয়েছে ১৯৪২ ও ১৯৪৩এ। মোহনবাগানের আগে তারা রোভার্স-ডুরান্ডও জেতে ’৪৯ ও ‘৫১তে। আবার, ভারতীয় ফুটবলে কলকাতার আধিপত্যের যে মিথ প্রচলিত, বা তিন-প্রধানের প্রাধান্যের, সেটা খুঁড়ে দেখলে যে তথ্যটা উঠে আসেঃ প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে পরপর দু’বছর রোভার্স কাপ জেতে ‘ব্যাঙ্গালোর মুসলিমস’ ১৯৩৭ ও ‘৩৮। ইস্টার্ন রেল ১৯২৭এর ডুরান্ডে রানার্স, বাটা স্পোর্টস ক্লাব ১৯৪২এর রোভার্সজয়ী। পঞ্চাশ থেকে চুয়ান্ন একাদিক্রমে পাঁচবার ‘হায়দ্রাবাদ পুলিশ’ রোভার্স জিতেছিলো!
এ’সবও এগারোর স্ফুলিঙ্গেরই প্রভাব নয়? স্ফুলিঙ্গ শুধু আমার অঙ্গনেই আলো জ্বালিয়ে তুলবে, তোমার প্রাঙ্গনে নয়? মহ. স্পোর্টিঙের ‘৩৫এর হিরো জুম্মা খাঁন এসেছিলেন বালুচিস্তানের কোয়েটা থেকে। এগারোর স্ফুলিঙ্গ তাহলে অদ্দূরেও পৌঁচেছিলো? স্কোর দিয়ে, ফাইনাল রেজাল্ট দিয়ে কী প্রমাণ হয়? সাধে কি আর কার্ডাস-সাহেব স্কোরবোর্ডকে গর্দভ বলেছিলেন? শেষ টেস্টে চাট্টি রান করলে ব্রাডম্যানের টেস্ট গড় শত হয়, হলো না দ্বিতীয় বলে গোল্লা করে বোল্ড হতে। তাতে কী এলো গেলো? ক্রিকেটও পেছোয়নি, ব্রাডম্যানও না। ভারতীয় ফুটবলের আদি ‘সিংহপুরুষ’ গোষ্ঠ পালের দীর্ঘ পঁচিশ বছরের মোহনবাগানী জীবনে ক্লাব কোনো উল্লেখযোগ্য ট্রফি পায়নি। তাতে কী? তাতে কী তাঁর ভারতীয় ফুটবলকে পঞ্চাশ বছর এগিয়ে দেওয়া থেমে থেকেছিল?
গল্প করতে করতে অনেক দূর সরে এলুম।
১৯১১ নিয়ে আজ বাঙলা বই পত্রপত্রিকা কম উপলব্ধ নয় বাজারে (চলচ্চিত্রও হয়েছে চমৎকার একখানা), সেমিনালটি যদিও প্রেসি-জে.এন.ইউ-ছাত্র শ্রীসৌমেন মিত্র-মশায়ের (পরে কলকাতার পুলিশ কমিশনার), যেটির রিভিউ আমরা ৪২-সংখ্যায় পড়েছি। উপক্রমণিকায় তাঁরই স্তব করে বর্তমান গ্রন্থকার অধ্যাপক শ্রীকৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচমন। আর তারপর গ্রন্থ এগিয়েছে শিব-বিজয়-হাবুল-অভিলাষের গতিতেঃ কী এক এক অধ্যায়!!
• ‘দাস বিদ্রোহঃ ঐতিহাসিক শিল্ড বিজয়’,
• ‘স্বাধীনতার বর্ণপরিচয়’,
• ‘বাঙালির পাল্টা মার’ বা
• ‘অমর একাদশের অমর কীর্তি’! চমৎকার লেগেছে শেষ অধ্যায়টিঃ
• ‘শিল্ড বিজয়ের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক তাৎপর্য’ যেখানে ম্যাডন ফিল্ম কোম্পানির কর্ণধার রুস্তমজী দোডিয়ালা দ্বারা সেদিনের ইতিহাসের ফিল্ম তোলা (বা,না-তোলা) ধোঁয়াশার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সত্যি, ‘ঠিক যেন এক গল্প হতো তবে...’ যদি সে-ফিল্ম সত্যি সত্যি তোলা হয়ে থাকতো আর আজ কোনো মায়ামন্ত্রবলে হঠাৎ তা আবিষ্কৃত হতো কোনো ধূলিধুসরিত দেরাজ থেকে!
চতুর্থ পরিশিষ্টে ‘অমর একাদশের’ সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়া হয়েছে বেশ দু’এক দু’এক কথায়, ইঁটভাঁটার শ্রমিক গোলকিপার হীরে মুখুজ্জে দিয়ে যার শুরু (কিংবদন্তী হয়ে গিয়েছিলো ‘ভয় নেই, হীরে আছে গোলে’ বচন!)। লক্ষণীয়, ঘটি-দলের অন্তত পাঁচজন সৈনিক ‘বাঙাল’ ছিলেনঃ রাজেন সেন, কানু রায় আর ফাইনালের নায়ক অভিলাষ ঘোষ। এমনকি শিব-বিজয়ও তো আদতে ফরিদপুরের। সেখানে প্রেসিডেন্সি-স্কটিশের ছাত্র ছিলেন কানু রায়, অভিলাষ, রাজেন সেন। একমাত্র বুটপায়ে খেলোয়াড় রেভারেন্ড সুধীর চ্যাটার্জি তো ছিলেন অতি উচ্চশিক্ষিতঃ ইংরাজি ও ইতিহাসের অধ্যাপক হন পরে। সুধীর চ্যাটার্জী ধর্মবিশ্বাসে ক্রিশ্চান ছিলেন (উল্লেখ নেই কেন?)। বর্ণহিন্দু আর সকলেই, রাইটব্যাক (আদতে ইউপির ব্রাহ্মণ) ভুতি সুকুল (‘শুক্ল’থেকে। উল্লেখ নেই) সমেত। সেখানে রাজেন সেনের মত ‘স্বদেশী’ যেমন ছিলেন, তেমনি কানু রায়ের মত পুলিশকর্মী (পরে ‘রায়বাহাদুর’), নীলে ভটচাজ ব্যাঙ্ককর্মী। এগারো নিয়ে ছুট-কাহানী (anecdote) বাজারে কম তো প্রচলিত নেই, এই বইতে তার আরও কয়েকটি থাকলে বেশ হতো। একটি তো এই যে কলকাতা কর্পোরেশন কর্মী হাবুল সরকার ছুটি-না-নিয়ে শীল্ড খেলে এসে ভয়ে ভয়ে জয়েন করছেন পরের দিন...চাকুরি চলে যাবে না তো? বস্ ম্যাকডস সাহেব এক সোনার চেন উপহার দিয়ে তাঁকে বরণ করে নিলেন! ইংরেজরা আদতে স্পোর্টিং জাত ছিলো বটে।
না, এটি কোনো আকরগ্রন্থ নয়, নয় কোনো নতুন তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাগ্রন্থ। কিন্তু দুই মলাটের মধ্যে এগারো-সংক্রান্ত এতো এতো তথ্য নাগালের মধ্যে সহজেই পাওয়াটাও কম কোনো কথা নয়।
শেষে এক মহা আপত্তির কথা বলতেই হয়। এতো উপযোগী এক কেতাবের এতোটা অপ্রযুক্ত প্রচ্ছদ-ফটো বড্ড বেদনা দিলো। শুধু খালি পা দেখালেই চলবে? গুটিয়ে তোলা ফুলপ্যাণ্ট? ঘাসের মাঠ নয়, বালি? সবচেয়ে বড় আপত্তিঃ লেসহীন জাবুলানি বলের ছবি দেখতে হবে এগারোর প্রচ্ছদে? সেকালে আট-প্যানেলের সেলাই করা চামড়ার বল হতো যে, ভেতরে রবারের ব্লাডার! মোহনবাগান সেন্টিনারিতে ভারতীয় ডাক-তার বিভাগ কী অনবদ্য চিত্র করেছিলো একটাকার স্ট্যাম্পটায়! মুদ্রণ প্রমাদ অজস্র। অনামী ‘সেতু’ প্রকাশনীর কাজ মামুলি যদিও লেখকের পরিশ্রম অনন্য। পরিশিষ্ট তিনে সে-সময়ের অনেক সংবাদপত্রের রিপোর্টের উল্লেখ রয়েছেঃ শুধু কলকাতারই নয়, বম্বের টাইমস্ অব্ ইন্ডিয়া, রয়টার, লন্ডনের ডেইলি মেইল, ম্যাঞ্চেস্টারের গার্ডিয়ান থেকে সিঙ্গাপুরের দৈনিক। কাজের। সেসময়ের নানান বৃটিশ প্রেসে ছাপা ব্যঙ্গচিত্র দেখতে পাওয়াটা মজার। জয়ী বাগান-দলের ফোটো তো কিংবদন্তী, কিন্তু হেরো ইস্টইয়র্কশায়ার দলের ফটো আগে দেখিনি। এটাও জানতাম না যে এই দল লক্ষৌএর কাছে ফৈজাবাদে স্টেশনড্ ছিলো, সেখান থেকে কলকাতায় শীল্ড খেলতে এসেছিলো। ‘তথ্যসূত্র’-এর তালিকা ৩৫৯ পর্যন্ত গেছে। কাজে লাগবে। লেখক পেশাদার ঐতিহাসিক, যে-বিষয়ে কলম ধরেছেন তাতে কিছু লিখিত ইতিহাস কিছু মুখর ইতিহাস (oral history) তো মিশে থাকবেই। তাই কথায় কথায় অত ‘মনে হয়’ ‘শোনা যায়’ ‘অনুমান’...লেখার দরকার কী?
উৎসর্গ পত্রটি মন কেড়েছে।
বাংলার প্রবাদ—সুদেষ্ণা বসাক; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশ আগস্ট ২০০৭, তৃতীয় মুদ্রণ এপ্রিল ২০১২; ISBN 81-7756-674-1
এমন সু-গবেষিত গ্রন্থ কম পড়তে পাওয়া যায়,বাঙলায়। শুধু ‘প্রবাদ’ বিষয়েই নয়, আরও আরও নানা বিষয়ে যে যে সব বই হাতে আসে সে-সব ধরেই বললাম। এটা বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে প্রবাদ-প্রবচন-বাগ্ধারা নিয়ে যে সকল কেতাবের নাড়াচাড়া, তা সুশীল দে-মহাশয়ের মহাগ্রন্থ ‘বাংলা প্রবাদ’ হোক্, বা কল্যাণী দত্তের মনোহরা ‘প্রবাদমালা’, বা... ধারে-ভারে-কলেবরে তাদের যেন ছাপিয়ে গেছে এই অনামী লেখিকার বইটি। না, এ’কোনো মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ নয় বটে, কিন্ত দুই মলাটের মধ্যে দুই হাজার+ (? গুনিনি) বাঙলা-প্রবাদ হাতের নাগালে পেয়ে যাওয়া চাড্ডিখানি কতা নয় [এ’প্রসঙ্গে এক না-পাওয়ার দুঃখু শেষে বলবো’খন#]। যে সযত্ন গবেষণা ও পরিশ্রমের ছাপ বইটির সর্বাঙ্গে, শুধু তারই জন্যে মাথায় করে রাখতে হয় একে, তাতে কোন্ দু’-চারটি ভুক্তির সঙ্গে এ’বান্দা সহমত হৈলো কি না-হৈলো @,তাহা উপেক্ষনীয়।
‘প্রবাদ’ কী? ‘প্রবচন’ কাহাকে বলে? এ’দুই শব্দ হামেশাই একসাথে উল্লেখিত হয় বটে, তবে দুইই কি এক? অভিধানে লেখেঃ প্রবাদ--'বহুকাল থেকে প্রচলিত উপদেশমূলক জ্ঞানগর্ভ উক্তি। জনশ্রুতি।' আর ‘প্রবচন’?--‘প্রকৃষ্টরূপে বাচ্য বা বাচনীয়। বহুপ্রচলিত কথা বা বাক্য’। দুটোরই সমার্থে অন্যটা দেওয়া থাকছে। মানে, প্রবাদ বচন মানেই প্রবচন? বাং-টু-ইং অভিধানে দু’টোরই ইঙ্গার্থ proverb দেওয়া আছে, আর ইং-টু-বাং-এ’ proverb-এর বঙ্গার্থ ‘প্রবাদ/প্রবচন’। বুঝলাম। আরেকটি কাছাকাছি বিষয়/শব্দ ‘বাগ্ধারা’ (idiom) বিশিষ্টার্থক শব্দ বা শব্দগুচ্ছ।
বেশ।
আচ্ছা, এটা এট্টু বিচার করে দ্যান দেহি?
[ক]
* ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ বা
* ‘কুঁড়ে গরু অমাবস্যা খোঁজে’
আর
[খ]
* ‘দৈবের লিখন কভু না-যায় খণ্ডন’ [মনসামঙ্গল] বা
* ‘পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে’ [কৃত্তিবাসী রামায়ণ] বা
* ‘অগ্নি ব্যাধি ঋণ, এ’তিন রেখো না চিন্’ [কাশীরাম দাসের মহাভারত]
[ক] ও [খ] এর মধ্যে তফাৎ নাই কোনো?
মনে করি, ‘প্রবাদ’ অনেক বেশি লৌকিক, চালু লোকমুখেমুখে, বাগ্ধারার সঙ্গে প্রায় পার্থক্য নেই তার; আর ‘প্রবচনের’ মধ্যে যেন গভীরতর বিশ্বাস/শিক্ষা/মহাজনকথা মিশে আছে। এটাই ঐ অভিধানে বর্ণিত ‘প্রকৃষ্টরূপে বাচ্য’। না, এই সংজ্ঞাটা কোত্থাও খুঁজে পাইনি (এ’বইয়ের দীর্ঘ উপক্রমণিকা-অধ্যায়েও না), নিজের মনগড়া কথা বললাম ইটি। পাঠক বিচারক।
চারিশতাধিক পৃষ্ঠার বইটির সুমুদ্রিত অঙ্গজুড়ে কী ছেয়ে আছে দেখতে প্রথমে ‘সূচিপত্রে’ যাইঃ সওয়া শ’ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় অধ্যায়টিই দীর্ঘতম—‘বাংলা প্রবাদের বিষয়বৈচিত্র্য’। একুশটি উপ-অধ্যায়ে এখানে ‘দেবদেবী-বিষয়ক’ থেকে ‘কৃষিকর্ম সংক্রান্ত’ থেকে ‘স্থাননাম-বিষয়ক’ থেকে ‘লোকসিদ্ধান্তমূলক’ বিষয়ের প্রবাদের আলোচনা হয়েছে। খেটে কাজ। যদিও সব বিষয়ে যে সহমত হলুম তা বলতে পারি না। যেমন, ‘ঘেঁটেল চেটেল ফড়ে/তিন নিয়ে উলুবেড়ে’ শ্রেণীকৃত হয়েছে ‘স্থাননাম বিষয়ক প্রবাদের’ মধ্যে। বেশ। তাহলে, ‘গুলি খিলি মোতিচুর/এ তিন নিয়ে বিষ্ণুপুর’ বা, ‘গাঁজা তাড়ি প্রবঞ্চনা/তিন নিয়ে সরশুনা’ কেন ‘লোকসাংবাদিকতা-বিষয়ক’ প্রবাদের মধ্যে গেল সেটা বুঝলুম না। তবু এ’সূত্রে বহু বহু প্রবাদ পড়তে পেয়ে গেলুম নিদেন, সেটা কম কথা? প্রবাদের মধ্যে রয়ে গেছে কত ইতিহাস, কত সমাজকথা, কত শৈশবে হারিয়ে যাওয়া জ্যেঠাইমার মুখে শোনা ‘কথা’... (যেমন, শিরোনামেরটি)... বড্ড স্মৃতিমেদুর! ব্লার্বে লিখছেনঃ ‘প্রবাদ যেন মানুষের জীবন-অভিজ্ঞতারই চকিত উদ্ভাস’। যেন?
ষষ্ঠ অধ্যায়টি বেশ! প্রবাদের সঙ্গে ধাঁধা, ছড়া ও গীতি-গীতিকার সম্পর্ক নিয়ে তিনখানি উপ-অধ্যায়ে চমৎকার চমৎকার একমুঠো মন-ভালো-করা প্রবাদ পড়া গেল ছন্দে। অনুপস্থিত কয়েকটি স্মৃতি থেকে বলিঃ ধাঁধা
১. ‘লতাও নয় পাতাও নয় লতিয়ে লতিয়ে যায়/সব্বাঙ্গ থাকতে শুধু চোখদুটিকে খায়’ [ধোঁয়া]
২. ‘বন থেকে বেরোলো ভূতি/ভূতি বলে তোর পাতে মুতি’ [পাতিনেবু]
এ’সব জামাইঠকানো ধাঁধা নিয়ে সেকালের বাসরঘর আলো করে থাকতেন অশীতিপর বালবিধবা ঠান্দিদিরা। শোনা কথা।
একাদশ শতকের চর্যাপদকর্তা ভুসুকু লিখেছিলেন, ‘আপনা মাসে হরিণা বৈরি’ (হরিণ তার নিজমাংসের জন্যেই নিজের শত্রু)। এটাই সম্ভবতঃ বাঙলাসাহিত্যে প্রথম প্রবাদ ব্যবহারের লিখিত উদাহরণ। রয়েছে (পৃ ২১৮) সপ্তম অধ্যায়ে, কবির নামোল্লেখ ব্যতিরেক। এ’অধ্যায়ে ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’ ছাড়াও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, কৃত্তিবাসী ‘রামায়ণ’, কাশীদাসী ‘মহাভারত’ থেকে ‘মনসামঙ্গল’, ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ বা আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্য বা বহরাম খানের ‘লায়লী-মজনু’ কাব্য থেকে দাশরথি রায় হয়ে উইলিয়াম কেরির রচনায় প্রবাদের উল্লেখের কথা বলা হয়েছে। কাজের। কিন্তু একেই টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে আধুনিককালের সমরেশ বসু বা শংকর বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোন্ কোন্ লেখায় কোথায় কোথায় প্রবাদের উল্লেখ এসেছে তার পাঠ অযাচিত, অপ্রয়োজনীয় ও বিরক্তিকর। তাছাড়া, এখানে দেওয়া উদাহরণগুলো কি প্রবাদ? যেমন, ‘আইনের কচকচি’ (শ্যামল গঙ্গো), বা ‘ঊনিশ-বিশ’ (সমরেশ), বা ‘মরণকামড়’ (তপন রায়চৌধুরী) বা ‘গিভ এন্ড টেক’ (সঞ্জীব চট্টো)? আর, বাঙলা সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁর লেখায় প্রবাদ-বাগ্ধারার ছড়াছড়ি, সেই গজেন মিত্তির মশায় অনুপস্থিত।
কেরি-সাহেবের হাতে যেমন বাঙলাগদ্যের শুরুয়াৎ, তেমনি তাঁর দোসর রেভারেণ্ড উইলিয়াম মর্টন-সাহেব দ্বারাই প্রথম Collection of Bengali Proverbs (‘দৃষ্টান্তবাক্যসংগ্রহ’) ছেপে বেরোয় কলিকাতার ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস থেকে, ১৮৩২ খৃ। এটি, এবং সমগোত্রের জেমস্ লং-সাহেব সংগৃহীত ‘প্রবাদমালা’ (১৮৭২) বা দ্বারকানাথ বসু প্রণীত ‘প্রবাদ-পুস্তক’ (১৮৯৩) গ্রন্থের প্রচ্ছদচিত্র দেখতে পাওয়াই সৌভাগ্যের, বেশিরভাগের নামমাত্র শুনিনি আগে, স্বীকারে বাধা নেই।
প্রবাদ-প্রবচন যেহেতু মুখে মুখেই ফিরতো/ফেরে, আঞ্চলিক বৈচিত্র্য/তারতম্য তাই এর আভরণ। কোনো একটি প্রবাদ আমি যে-রূপে জানি, শুনেছি, সেটাই ঠিক, ও’ ভুল বললো—এটা ভাবাই ভুল। প্রসঙ্গতই শিষ্ট-অশিষ্ট শব্দের বাছবিচারের প্রসঙ্গটিও উত্থাপিত হয়ে পড়ে (এটা দুঃখের যে বাঙলাভাষায় আজও ‘অশিষ্ট শব্দকোষ’ রচিত হলো না)। যে শব্দ আমার চৌহদ্দিতে অতি-চল, ওরটায় একহাত জিভকাটা! প্রবাদের আঞ্চলিক বিভিন্নতাও এ’ থেকেই উৎপন্ন। যেমন, ‘হেলে ধরতে পারেনা, কেউটে’ একটা অতি-প্রচলিত প্রবাদ। হুগলীর গ্রামে এটাই শুনেছি ‘এঁ নেই য়োঁ আছে’ বা, আরও কদর্থে, ‘পোঁদে নেই ইন্দি, ভজো রে গোবিন্দি’। উত্তর কলকাত্তাইয়া ভেরিয়েশনে এর আরও একটা কদরূপ (কদর্যরূপ??) অতিপ্রচলিত, লিখতে কলম রুকচে, কারণ মনের চেয়ারটায় ইতোমধ্যে ভিক্টোরিয়ান মোজা পরিয়ে ফেলেছি কিনা। তবু, মাটি থেকে উঠে আসা এ’হেন স্বাভাবিক শব্দের প্রতি মনের আগড়টাকে ভাঙতে না পারলে প্রকৃত প্রবাদের চর্চা হতে পারে না। এই শ্লীল-অশ্লীল বিচারের উন্নাসিকতা ঘোচাতে না পারলে প্রবাদের নৈর্ব্যক্তিক চর্চা কী করে হবে? এই সেদিন কোন্ প্রসঙ্গে ‘বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি’ বলে ফেলে দেখি সম্ভ্রান্তা অধ্যাপিকাগণ খরচোখে তাকাচ্ছেন। ভাগ্যিস, ‘হাগুন্তির লাজ নেই, দেখুন্তির লাজ’-টা বলিনি সেদিন। রাঁড়, মাসিক, হাগা, ছোঁচানো—এ’সব শব্দ-সম্বলিত বহু বহু প্রবাদ শুনে এসেছি আবাল্য। সে-সব কখনও গ্রন্থিত করতে রুচির আগল। কিন্তু, এ’সব হারিয়ে যাবে যে! তাতে ভাষার ক্ষতি। অভিধানকারের তো এ’সব সংকোচ থাকলে চলে না। সদ্ব্রাহ্মণ হরিচরণ শব্দের খোঁজে এমনকি পতিতাপল্লীর আনাচে-কানাচেও ঘোরাঘুরি করতেন। অভিধানকার শুচিবায়ের ঊর্ধে, কিন্তু আলোচ্য সুপুষ্ট গ্রন্থটিতেও অনুপস্থিত এ’সব প্রবাদ।
উপরোক্ত এই আঞ্চলিক বিভিন্নতার কথা মাথায় রেখেও এই পুস্তকে বর্ণিত বেশ কয়েকটি
প্রবাদের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে ভিন্নমত ব্যক্ত করার যাঞা রাখিঃ @
* ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’ (পৃ ১২০)—এটা ‘সংঘশক্তি ও ঐক্য’ গোত্রের প্রবাদ হিসেবে বর্গীকৃত হলো কী কারণে? এখানেই আরেকটি প্রবাদ লেখা হয়েছে, ‘একের বোঝা,দশের লাঠি’--হবে ‘দশের লাঠি, একের বোঝা’।
* ঐ পৃষ্ঠাতেই ‘জুতো মেরে গরু দান’ প্রবাদটি উল্টো লেখা হয়ে গেছে।
* ২৮০-৮১ পৃষ্ঠায় উর্দু ও হিন্দি কিছু প্রবাদ ভাগ করে দেওয়া রয়েছে। উত্তরভারতের উর্দুভাষাই হিন্দোস্তানী ভাষা, অক্ষর তার ফার্সি, আত্মা সংস্কৃতজ হিন্দি। তবু এখানে দেওয়া প্রবাদ ‘নাচ না জানে অঙ্গন টেড়া’ বা, ‘আম কে আম গুঠলিও কী দাম’ হিন্দিরই প্রবাদ, উর্দুর নয়।
* দশম অধ্যায়ে ‘ক্ষেত্রসমীক্ষা’-য় কিছু প্রবাদকে অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করা হয়েছে। পৃ ৩৩৭: ‘উঠলো বাই তো কটক যাই’ বা ‘জাইতও গ্যাল, প্যাটও ভরল না’ কী অর্থে বর্ধমান জেলার প্রবাদ? বর্ধমানে ‘জাত’কে ‘জাইত’ বলবে, ‘পেট’কে ‘প্যাট’?
* আঞ্চলিক বৈচিত্র মেনে নিয়েই বলছি, প্রবাদটি ‘কাঁচায় না নোয়ে বাঁশ, পাকলে করে টাঁশ টাঁশ’। পাকা বাঁশ নোয়াতে চাইলে মচ্ মচ্ বা টাঁশ টাঁশ করে শব্দ হয়, চড় মারার মত ‘ঠাস্ ঠাস্’ নয়। ‘নোয়াইলে’ শব্দটিও এখানে অপ্রযুক্ত, ছন্দহীন। পৃ ২০৮
* পৃ ৪: ‘যদি হয় সুজন, তবে তেঁতুল পাতায় ন জন’ মানে ‘মিলেমিশে কাজ করলে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়’ নয়, এর অর্থ ‘সদ্ভাব বজায় থাকলে জাগতিক কষ্টকে উপেক্ষা করা যায়’।
* পৃ ২৬৪: ‘যেমনি বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল’ মানে ‘একটা সাংঘাতিক জোট বা সমন্বয়’ নহে, ইংরিজিতে tit for tat
* পৃ ২৬৫: ‘দিল্লি কা লাড্ডু...’ প্রবাদে প্রথম ‘ভি’-টা হবে না। কথাটা হলো, ‘যো খায়া বহ্ পস্তায়া, যো নহী খায়া বহ্ ভী পস্তায়া’। এমন এক জাপানি প্রবাদ আছে, ‘ফুজি পর্বতের সামনে এসেও যদি তুমি তাতে না চড়ো তো তুমি হলে দুনিয়ার গাড়োল নাম্বার টু। তাহলে নাম্বার ওয়ানটা কে? না, যে চড়েছে,সে।’
গ্রন্থটির পুষ্ট কলেবরের কারণেই আরও কিছু প্রচলিত প্রবাদের উল্লেখ বাদ পড়ে গেছে বলে আক্ষেপ করি। এমন একটি বইতেও না পেলে এ’ এ’ প্রবাদগুলো আর খুঁজবো কোথায়?
* দে গরুর গা ধুইয়ে
* হরি হে মাধব, চান করবো না গা ধোবো?
* পি পু ফি শু ইত্যাদি ইত্যাদি
# শেষে একটি বর্ণানুক্রমিক সূচি থাকা বিশেষ জরুরি ছিলো, কারণ নৈলে এতো প্রবাদের মাঝে কোনো একটি আছে-কি-নেই খুঁজবো কী করে? ‘বুকে বসে দাড়ি ওপড়ানো’ খুঁজলুম কতো, পেলুম না।
শেষে কিছু ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা এই ধরা থাক্
* পৃ ২০৬: ধাঁধাঃ ‘এরাও মা ঝি, ওরাও মা ঝি....’-র আরেক রূপভেদে শুনেছিঃ ‘এরা বাপ ব্যাটা ওরা বাপ ব্যাটা তালতলা দিয়ে যায়। একটি তাল পড়লে তবে কেমন ভাগে খায়?’ তালের আঁটি তিনটি কিনা। উত্তরঃএখানে দুই প্লাস দুই চারজনের কথা নয় ঠাকুর্দা-বাপ-ছেলে এই তিনপুরুষের কথা বলা হয়েছে।
* পৃ ১৬২: ‘ঘরে নেই ভাত, কোঁচা তিন হাত’ এর অন্য এক রূপ শুনেছিঃ ‘খানেকা ঠিকানা নেই, ন’-বাজের স্নান’
* আরেক চমৎকার প্রবাদ ধরে রেখে ছিলেন বিজন ভটচাজ মশায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমায়ঃ ‘কুঁজোর আবার ইচ্ছে করে চিৎ হয়ে শুতে, গামছার আবার ইচ্ছে করে ধোপাবাড়ি যেতে’। এ’সব লিকে না রাখলে হাইরে যাবে গ, কত্তা। এই বইয়ে নাই।
* (গরীব ঘরে দশ নয় মাত্র আটহাত শাড়ি পরা, তাই) ভাসুরকে দেখে লজ্জায় ঘোমটা টানতে গিয়ে ভাদ্দরবৌয়ের নিতম্ব বেরিয়ে পড়লো—উত্তরবিহারে এই প্রবাদটা খুব চলে। বাঙলাতেও এমন একটা আছে। দেখুন, মনে পড়ছে না। কোত্থাও লেখা নেই কিনা। না, এই পৃথুলা পুস্তকেও না।
* ‘আকাশ-পাতাল ফারাক’ বোঝাতে এই অশিষ্টরুচির প্রবাদটাও চলে, ‘কোথায় হরিদ্বার, আর কোথায় গুহ্যদ্বার’। তেমন একটি রয়েছে পৃ. ৫৩ ‘রাণী ভবানী আর ফুল জেলেনি’। হিন্দিতে বহুপ্রচলিতঃ ‘কঁহা থে রাজা ভোজ ঔর কঁহা ইয়হ্ ভজুয়া তেলি’। লেখিকা হিন্দিসহ তামিল-তেলুগু-গুজরাতী প্রবাদের প্রসঙ্গ পেড়েছেন বলে মনে এলো।
* ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’। ‘ঘোগ’ মানে কী? সংসদ-অভিধান ধামাচাপা অর্থ দিচ্ছেন, ‘বাঘ ও কুকুরের মাঝামাঝি জন্তুবিশেষ’। এ’রকম কোনো জন্তু হয় নাকি?
* ‘অতি বড় সুন্দরী না পায় বর, অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর’। পাইনি।
* পৃ ১৬: ‘খনার বচন, ডাকের বচন, ঘাঘের বচন’ আলোচনা মনোজ্ঞ লেগেছে।
প্রচ্ছদটি বড় মন কাড়লো না। জবড়জং হয়ে গেছে। অধিক দেখনদারি। মত ব্যক্তিগত।
বইটি দশে আট!!!
Gaslight to Neon—Ranita Gupta; Sutradhar Publishers, Kolkata-3; ISBN:
দিনের শেষে নিরিবিলি এক স্রোতস্বিনী-তীরে একা বসে থাকতে ভালো লাগে? না, স্রোত তার খর নয়, না সে তার চলার পথে বড় বড় বাঁক নিয়েছে বেশি। ধীর, শান্ত, শীতল নদী। এমন নদীর এক নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, না? এ’বইটা পড়তে পড়তে এমনই এক অনুভূতি এলো। না এ’কোনো বিখ্যাত মনিষ্যির আত্মজীবনী, না এখানে বড় বড় কোনো কথাবার্তা বলা হয়েছে। কিন্তু মনের তারে... ঐ যে রণন-ঝনন ধ্বনি বেজে উঠলো, সেটাই বেশ, সে অনুরণনটাই থেকে গেল।
ক্লাস নাইনের এক কিশোরী এক শীতসকালে ডোরবেলে এসে খুলে দেখে... দেখে... কে? সামনে স্বয়ং উত্তমকুমার!! হ্যাঁ, বানান ভুল হয়নি, বানানোও নয়। সটান উত্তমকুমার!!! পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি উত্তমের উদিতসূর্য তদ্দিনেই মধ্যগগনের পথে। হ্যাঁ, এমন এমন অনেক ব্যক্তিত্বই আসতেন মেয়েটির পিতৃদেবের নিকট। তিনি যে ভারতে চিত্র-সমালোচনার আদিগুরু নির্মলকুমার ঘোষ, তুষারকান্তির পরেই ছিলেন ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র সর্বেসর্বা! রণিতার এই পেলব আত্মজীবনীতে তাই সেকালের শিল্প-সঙ্গীত-মঞ্চজগতের হোমরা-চোমরারা বারে বারে ঘুরে ফিরে এসেছেনঃ সুচিত্রা সেন থেকে সুপ্রিয়া চৌধুরী থেকে দিলীপকুমার... কে নয়? যদিও লেখার মূলসুর তাতেই আটকে থাকেনি, নৈলে দেখনদারি হয়ে যেতো যে! (জন্মদিনটি এক হলে কী হবে, সত্যজিতের সঙ্গে নির্মল ঘোষের টক্কর তো কিংবদন্তীর ছিল, বেশ পড়তে পাওয়া গেল সেটি এই বইয়ে।)
স্বাধীনতার সময়ে বালিকাটির বয়স সাত। কলকাতার উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম, শিক্ষাদীক্ষা শহরের শ্রেষ্ঠ স্কুলকলেজে। এ’হেনের জীবন যে-পথে চলার ছিল, চলেছে সে-পথেই। সে-পথেই দেখা উত্তরবঙ্গের মামাবাড়ি, কলকাতার দাঙ্গা ও দেশভাগ, প্রেসিডেন্সি কলেজের দিনগুলি, তারপর রেলের উচ্চচাকুরের সঙ্গে বিবাহসূত্রে... এতে অ-গতানুগতিক কিছু নেই। সেটা যেখানে, তা হলো তাঁর চোখের দৃষ্টিতে আর লেখার কলমে, দুটোই বড্ড কম-প্রভাবিত, যেটা লিখনটিকে এক আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। অন্তঃপুরবাসিনীর মৌলিক কলম বড্ড টানে, যে কারণে প্রণম্যা স্মৃতি মিত্র - কল্যাণী দত্ত পড়ে অভিজ্ঞতাভাগ করে নিতে হয়েছিল ‘পরবাস’-পাঠকের সঙ্গে। রণিতার লেখায় অনায়াসে এসেছে সেকালের মেয়েদের ঘরে খেলাধুলোর কথা (পিট্টু খেলা, গাদি খেলা), বাৎসরিক ভয়াবহ টিএবিসি ইঞ্জেকশন, প্রতি প্রাতে ভিস্তিদের পথসম্মার্জন, পুরীর সমুদ্রে গিয়ে ঝিনুক কুড়নো, আবার উদয়শঙ্কর-কাননবালা, নিজের স্কুলছাত্রী বিপ্লবী বীণা দাস--হয়ে এক রেলশহরের ফার্স্ট লেডি হিসেবে ক্লাব আলো করে থাকা। বড় নির্মোহ কথন। যতই উচ্চশিক্ষিত ডক্টরেট হোন্ না কেন, স্বামী-কন্যার মঙ্গলার্থে ঁমায়ের কাছে মানত। শেষবিচারে এই স্নেহময়ীরূপটিই ধরা রয়েছে, অতিমিহি গোবিন্দভোগ চাউলে পরমান্ন-রন্ধন যাঁর পরম ব্যসন! কোথাও কলম-তুলির ছোঁয়ায় বরাকের নৈসর্গিক রূপবর্ণনা মন কাড়ে, আবার তথ্য হিসেবে এটাও জেনে পুলকিত হতে হয় যে স্কুলে তাঁর ক্লাসমেট ছিলেন অভিনেত্রী মালা সিন্হা; ‘চিল্ড্রেন্স লিট্ল থিয়েটার’ যখন তৈরি হলো নাচের দলে স্কুল থেকে প্রথম যে দুই কন্যা ডাক পেলো তারা হলেন এই লেখিকা ও শর্মিলা ঠাকুর!
গল্পটা শুরু হয়েছিল অবিভক্ত উত্তরবঙ্গের এক জেলা শহরে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ পিতামহের ছায়ায়। ঘটনাপ্রবাহ ক্রমে এগিয়েছে শহর কলকাতা থেকে রেলশহর আদ্রা হয়ে লামডিং...। অনেক গল্প শোনা গেলো, অনেক আবার না-ও। রক্ষণশীল গৃহবধূর মত লেখিকা তাঁর কৃতবিদ্য স্বামীর নামোল্লেখ একবারও করেননি বটে কিন্তু ষাট-শুরুর দশকে প্রেসিডেন্সিতে ক্লাসমেটে-মেটে প্রেমবিবাহ কমন তো ছিলো না, আবার অসবর্ণ বিবাহ যে! সেসব গল্প হালকা শুনতে পেলে মন্দ হৈত না। লেখিকার জামাতা কলকাতার পুলিশ কমিশনার ছিলেন, কন্যা নামী লেখিকা, সেসব গল্পও তো কৈ করলেন না? হয়তো রুকে গেছেন রক্ষণশীল শালীনতায়। গ্যাস থেকে নিওন তো হলো, এবার সিএফেলে উত্তীর্ণ হবার আশায় তাই থাকবো আমরা, কোনো সিকুয়েলে। আর এই কেতাবে ঐ যে বিশ-ত্রিশ দশক করতে করতে পঞ্চাশে এসে হঠাৎ দুহাজার সনে লম্ফন—এটা তাল কেটে দিয়ে গেলো যে!
নতুন প্রকাশনী ‘সূত্রধরের’ কাজ মধ্যমানের। এই সাদাকালো ফটোগুলির রিপ্রিন্টই আজকাল ডিজিটাল টাচ-আপে উন্নততর করা যায়। বানান ভুল ধরা পড়বে না, কারণ স্পেল-চেকার আছে। কিন্তু বহুস্থানে ড্যাশ্-হাইফেনের ভুল ব্যবহার চক্ষুপীড়া দেয়। প্রচ্ছদ সাদামাটা।
তাঁর ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিলেন কেতকী কুশারী (ডাইসন)। কেন কেতকীর মত হতে পারলে না--বাপমায়ের কাছে সে গঞ্জনা সইতে হতো রণিতাকে। এদ্দিন পরে এসে রণিতার কলমে পাই কেতকীর সুবাস, কানে আসে মধুর রণন ধ্বনি। রণিতা মানে মধুর ধ্বনির রণন-ঝনন্ নয়?
(পরবাস-৬৫, ডিসেম্বর ২০১৬)