ISSN 1563-8685




পাশবিক

ক্টর অনুপমা রয় জেল হাসপাতালে ঢোকার আগে সাবধানে ব্যাগটা গুছিয়ে নেন, মোবাইল থেকে শুরু করে সবরকম দামী জিনিস বার করে লকারে রাখা নিয়ম। অনুপমা ফোনটাকে হাতছাড়া করতে চান না যদিও ফোন চুরি হলে আর রক্ষা নেই। সেই ফোন থেকে তক্ষুনি কারোর নামে সুপারি যাবে নয়তো কোকেন বা হেরোইন লেনদেন হবে কোথাও।

অনুপমা প্রথম প্রথম একটু দমেই গেছিলেন কোথায় কলকাতার মিশন হাসপাতাল আর কোথায় এই আমেরিকান জেলখানা। জীবন কোথায় কোথায় নিয়ে যায় মানুষকে! সৌভিকের সঙ্গে বিয়ে হবার পর এদেশে এসে প্রথম দশ বছর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেছিলেন, তারপরে এই সরকারী চাকরি। ভেবেছিলেন প্র্যাকটিসের উদয়াস্ত খাটনির চেয়ে বাঁধা সময়ের চাকরিই ভালো হবে। জেলখানার কাজটা কাগজে কলমে হালকা হলেও প্রতিটি কেসের সঙ্গে জড়ানো অদ্ভুত সব অন্ধকারের গল্প। অনুপমাকে ওই গল্পগুলো আচ্ছন্ন করে ফেলে, শীতের রাত্তিরে দম আটকানো ধোঁয়াশার মতন জমে থাকে মনের আনাচে কানাচে। গল্প করা, গল্প শোনা অনুপমার রোগ, এই নিয়ে চিরদিন ওঁকে ভুগতে হয়েছে। যখন প্র্যাকটিস করতেন দিনে কুড়িটা করে পেশেন্ট দেখতে হতো, তখনও সবার জীবনের গল্পগুলো জেনে নিতেন উনি। যার ফলে প্রতিদিন বাড়ি ফিরতে যাচ্ছেতাই দেরি হতো, তারপর ক্লান্তি নেমে আসতো শরীর জুড়ে। সৌভিক বিরক্ত হয়ে উঠতেন, ঘরের কাজ সব যেমনকে তেমন পড়ে থাকতো। সেই সময় গল্পগুলো ছিল মেঘ, বৃষ্টি আর রামধনুর মতোই বৈচিত্রময়, নানা রঙে রঙিন। ওরা এমন নেশা ধরিয়েছিল যে কয়েক বছরের জন্য সংসারটাকে প্রায় একপাশেই সরিয়ে রেখেছিলেন অনুপমা। কিন্তু এইভাবে যে চলবে না তাও টের পাচ্ছিলেন ভেতরে ভেতরে। যতই বোঝাপড়া থাকুক সম্পর্কের মধ্যে চাহিদা একটা থেকেই যায়, বিনা তেলে গাড়ি চলে না। অল্পবয়েসে শরীর অনেক কিছু ভুলিয়ে রাখে বয়েস হলে তার জায়গায় দিতে হয় সময়।

এই চাকরিতে গল্পগুলো সংখ্যায় কম কিন্তু ওজনে ভারী। এখানে বাকি ডাক্তারেরা ঘড়ি মিলিয়ে দিনগত পাপক্ষয় করতে আসেন যান, ক্রিমিন্যালদের গল্প নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। ওসব বালাই না থাকলে এ বেশ আরামের চাকরি, মাইনেও মন্দ নয়।

ক্লিনিকে ঢুকেই একটু থমকে গেলেন অনুপমা। হাতকড়া আর শিকল বাঁধা অবস্থায় এক সৌম্যদর্শন টাকওয়ালা বয়স্ক ভদ্রলোক হুইলচেয়ারে বসে একটা বই পড়ার চেষ্টা করছেন। ভদ্রলোকের মুখ কাগজের মতন সাদা, তার ওপরে স্পষ্ট যন্ত্রণার ছাপ, অথচ জোর করে একটা নির্বিকার ভাব বজায় রাখার চেষ্টা আছে। পেটের কাছে একটা চতুষ্কোণ লোহার পাত তার সঙ্গে কব্জি আর গোড়ালি শেকল দিয়ে এমনভাবে আটকানো যে বিশেষ নড়াচড়া করার উপায় নেই। কিন্তু তার মধ্যেই কোনোরকমে বইটা ধরে আছেন উনি। ভদ্রলোককে দেখে কিছুতেই কয়েদী বলে মনে হয় না। পাশের চেয়ারে বসে বিশাল চেহারার এক কাস্টডি অফিসার বিরস বদনে চুইংগাম চিবিয়ে চলেছে।

‘অফিসার, আপনি যদি দয়া করে পেশেন্টের হাতকড়া খুলে দেন। এইভাবে তো আমি ওঁকে পরীক্ষা করতে পারবো না।’ অনুপমা একটু বিরক্তই। জেলের এই ব্যাপারটা উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না।

‘আপনাকে এই ইনমেটের ফাইলটি পড়ে নিতে অনুরোধ করছি, তারপর আপনি যা বলবেন তাই হবে। আপনার সুরক্ষার জন্যেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ অনুপমার ছোটখাটো চেহারাটা দেখে অফিসারটির খুব একটা ভরসা হয়নি বোঝা গেল।

‘আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমাকে ঠিক করে পরীক্ষা করতে দিন। আপনি অনুগ্রহ করে একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান।’

ঘরের মধ্যে এখন শুধু ওরা দুজন। ভদ্রলোক টেবিলের ওপরে আধশোয়া, হাতের বইটা একপাশে রাখা আছে, চোখের দৃষ্টি মহাশূন্যের দিকে। অনুপমা লক্ষ করলেন বইটা বাইবেল আর পেশেন্টের চোখ হেমন্তের ঝরা পাতার মতন হলুদ।

‘মিস্টার পিটারসেন আপনার কি কোথাও যন্ত্রণা হচ্ছে?’

‘ভালোই আছি, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ডক্টর।’ ভদ্রলোকের হাসিটা বিষন্ন অথচ কৌতুকময়। একটু আগের তুলনায় অনেক ভালো।’

আরো দু-একটা প্রশ্ন করে পেশেন্টের ফাইলের মধ্যে ডুব দিলেন অনুপমা। পড়তে পড়তে অজান্তেই ওঁর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, মুখ তুলে খরদৃষ্টিতে একবার পেশেন্টের দিকেও তাকালেন। লোকটির মুখে সেই অদ্ভুত হাসিটা লেগে আছে। উনি যেন ধরেই নিয়েছেন যে সকলের কাছ থেকে শাস্তি আর ঘৃণা ছাড়া ওঁর আর কিছু পাবার নেই।

অ্যারন পিটারসেন একজন সেক্স অফেন্ডার। নিজের নাতনিকে ধর্ষণ করার অপরাধে জেল খাটছেন। পেশায় কেমিস্ট, জেলে আসার আগে একটা রিসার্চ ফার্মে ভালো চাকরিই করতেন। কয়েক মাস আগে ওঁর অগ্ন্যাশয়ে ক্যানসার ধরা পড়েছে। মজার কথাটা এই যে উনি নিজে কাউকে কিছু বলেননি শুধু ওজন কমে অর্ধেক হয়ে গেছিল আর চোখের হলুদ রংটা রাত্তিরবেলাও দেখা যেত। কয়েদীরা সাধারণত: অসুখবিসুখের কথা বাড়িয়ে বলে, তাতে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়, ইনি ঠিক তার উলটো। শেষে একদিন সেলের ভেতরে বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যাবার ফলে ওঁকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। স্ক্যানগুলো আগেই দেখে নিয়েছিলেন; এবার ভদ্রলোকের পেটে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন অনুপমা।

‘কি আশ্চর্য। আপনার কি ব্যথাও হয়নি? এতদিন কাউকে কিছু বলেননি কেন?’

‘কাউকে বিরক্ত করতে চাইনি ডক্টর। তাছাড়া চিকিৎসা করাতেও চাইনি।’

‘তার মানে?’ অনুপমার মনে হলো লোকটা পাগল, ‘এইরকম অসহ্য ব্যথা নিয়ে তিনমাস কাটিয়েছেন, চিকিৎসা করাতে চাননি? কিন্তু কেন?’

‘আমার পরিবারে এইরকম ক্যানসারের ইতিহাস আছে, লক্ষণগুলো আমি কিছুটা জানি। আমি চেয়েছিলাম ক্যানসার হলে সেটা ছড়িয়ে পড়ুক, যাতে সারিয়ে তোলা সম্ভব না হয়।’

অনুপমা পাথর। লোকটার কথাগুলো শান্ত স্বরে বলা, পাগলামির কোনই চিহ্ন নেই। ক্যানসারের রোগীরা ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে, যেখান থেকে পারে আশ্বাস খুঁজে বেড়ায়। এই লোকটা জঘন্য অপরাধী অথচ মৃত্যুভয়ে ভীত নয়। এই দুটো জিনিস ঠিক মিলছে না।

‘ডায়াগনোসিস হয়ে গেছে এখন আমি নিশ্চিন্ত। আমি ইচ্ছাপত্রে সই করে দিতে চাই যে কোনো রকম নিরাময়ী চিকিৎসায় আমার সম্মতি নেই। ব্যথার ওষুধ অবশ্যই খেতে পারি।’ ভদ্রলোক বললেন।

‘কিন্তু কেন? এখনও আমরা কয়েক বছর আপনাকে মোটামুটি সুস্থ রাখতে পারি। চিকিৎসা করালে ব্যথাটাও অনেক কম থাকবে। আপনার বয়েস মাত্র ষাট বছর, শরীরে আর কোনো অসুখ নেই। আপনি এইরকম সুইসাইডাল কেন?’

‘ডাক্তার আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি কেন জেলে আছি?’ ভদ্রলোকের মুখে আবার সেই ব্যথাবিদ্ধ হাসিটা খেলে গেল।

‘জানি, কিন্তু তার সঙ্গে অসুখ চেপে রাখার কি সম্পর্ক বুঝলাম না। এটা কি অনুতাপ? আপনি কি অসুখে কষ্ট পাওয়াটাকে প্রায়শ্চিত্ত বলে মনে করছেন?’ কথাগুলো বলেই খারাপ লাগলো অনুপমার। পেশেন্টকে এইরকম চ্যালেঞ্জ করা ওঁর স্বভাব নয়।

‘না, প্রায়শ্চিত্তে আমি বিশ্বাস করি না।’

‘তাহলে আপনি--’ কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন অনুপমা। ভদ্রলোক কিন্তু ঠিক বুঝে নিয়েছেন।

‘বাইবেল পড়ছিলাম কেন? আসলে প্রায়শ্চিত্তের ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। তাছাড়া বইটা এই ড্রয়ারে ছিল। ডক্টর আপনি কি খ্রীষ্টান?’

‘না।’ কোনরকমে কথাটা বার করলেন অনুপমা। বিস্ময়ে ওঁর গলা শুকিয়ে গেছে।

‘ভালো, ওই একটা দিক থেকে তাহলে আমরা নিশ্চিন্ত। খ্রীষ্টানরা দায়মোচনে বিশ্বাস করে জানেন তো? প্রভু যীশু তাঁর নিজের রক্তস্রোতে সকলের পাপ ধুয়ে দিয়ে গেছেন। শুধু তাঁর শরণ নিয়ে অনুতপ্ত চিত্তে ক্ষমা প্রার্থনা করলেই আপনি রক্ষা পেতে পারেন। কিন্তু যারা শরণাগত বা অনুতপ্ত হতে নারাজ, খ্রীষ্টানরা তাদের খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না।’

‘দেখুন আমি আপনার চিকিৎসা করতে এসেছি, ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে নয়। ক্যানসারে আপনার পিত্তনালি বন্ধ হয়ে গেছে, স্টেন্ট ঢুকিয়ে সেটা আগে চালু করতে হবে। তারপরে কেমোথেরাপি আর রেডিয়েশন। আগে ধরা পড়লে সার্জারি করার একটা সম্ভাবনা ছিল, সেক্ষেত্রে আপনি একেবারে ভালো হয়ে যেতে পারতেন। এখন আপনি যদি চিকিৎসা না করাতে চান সেটা আপনার অভিরুচি। মনস্থির করে আমাকে জানিয়ে দেবেন।’

সারাদিন ধরে দফায় দফায় লোকটার কথা মনে হল আর একটা অকারণ রাগ হতে থাকলো অনুপমার। যে কিছুক্ষণ আগেও শিকলে বাঁধা ছিল সে এমন অনায়াসে ডাক্তারের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে কি করে? লোকটা বিবেকহীন, নিজের নাতনিকে পাশবিক অত্যাচার করে জেল খাটছে এদিকে আবার দার্শনিকের মতন কথাবার্তাও বলে। সবকিছু থেকে ও যেন একটা উদাসীন দূরত্বে বসে আছে, সমাজের দেওয়া শাস্তি, ঘৃণা বা সহানুভূতি যেখানে অবান্তর।

অনুপমা বুঝতে পারলেন অভ্যস্ত চেতনার কোন একটা গহন স্তরে খোঁচা লেগে গেছে, গলগল করে বেরোচ্ছে রাগ আর অস্বস্তি মেশানো কৌতূহল। বিকেল নাগাদ সেটা প্রায় অনুশোচনায় বদলে গেল। হাজার হোক ভদ্রলোকের একটা কঠিন রোগ হয়েছে, এতটা অসহিষ্ণু আর রুক্ষ ব্যবহার ওঁর প্রাপ্য নয়। উনি ঠিক করে ফেললেন যে অ্যারন পিটারসন নামক এই অদ্ভুত রুগীটির সঙ্গে অন্তত: আর একবার সময় নিয়ে বসে কথা বলা দরকার।

*********

‘অনু শুনছো। বেরোনোর সময় মেয়েটার ব্যাগে লাঞ্চবক্সটা ঢুকিয়ে দিয়ো। রোজ ভুলে যায়।’

‘দিয়েছি। তুমি বেরোবার আগে টেবিলের ওপর চিঠিগুলো দেখে নিও একবার।’

‘মা। আজ সন্ধ্যাবেলা আমাকে নাচের ক্লাস থেকে পিক আপ করতে হবে। ঠিক সাড়ে সাতটায়।’

‘মনে আছে। বাই। সাবধানে এসো।’

‘বাই অনু।’

সৌভিক অফিস যাবার পথে মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দেবেন, কফির কাপটা ভর্তি করে নিয়ে অনুপমাও গাড়িতে উঠবেন এবার। লিভিংরুমে এখন কফির গন্ধ আর জানলা দিয়ে উঁকি মারা ফ্যাকাশে রোদ্দুর। কাজের দিনের সকালবেলা, পাড়ার বেশিরভাগ বাড়ি এখন একে একে খালি হয়ে যাবে। বাবা মা যে যার চাকরিতে, বাচ্চারা স্কুলে, সবাই ব্যস্ত থাকবে সারাদিন, সচ্ছলতার দাম চুকোবে ঘন্টা আর মিনিটের বিনিময়ে। সকাল বিকেল হাইওয়ে দিয়ে গাড়ির স্রোত, তাদের ভেতরে হাই তোলা মানুষেরা বসে রেডিওতে একঘেয়ে বকবকানি শুনে চলেছে। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে সবাই ক্লান্ত, কোনরকমে ডিনার সেরে পরের দিনটার অপেক্ষায়। তার মধ্যে হোমটাস্কের তদারকি, দু একটা টেলিফোন, ল্যাপটপে মেসেজ চেক করা আর একটুখানি টিভি দেখা নিয়ে চোখের পলকে ফুরিয়ে যাওয়া অবসর।

অনুপমা আজ ইচ্ছে করেই এক চামচ বেশি চিনি দিলেন কফিটায়। বারান্দায় একটা বার্ড ফিডার আর গোটাকতক উইন্ড চাইম ঝোলানো থাকে, গোটাকতক পাখি সেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে। উনি পাত্রটায় নতুন করে খাবার ভরে দিলেন, এক মিনিট দাঁড়িয়ে শুনলেন ওদের টুংটাং শব্দের সঙ্গে পাখিগুলোর কিচিরমিচির। ফ্যাকাশে রোদ্দুরটা একটু জোর হয়েছে এখন। ভোরবেলার এই কয়েক মিনিটের শান্তি কি দুর্লভ, এর নাগাল পেতে পেতে প্রায় মাঝবয়েস হতে চললো।

গ্যারেজের দরজাটা খুলতে যাবেন এমন সময় কিচেন কাউন্টারের ওপর টেলিফোনটা বেজে উঠলো। প্রথমে ধরবেন না ঠিক করেও শেষ মুহূর্তে দরজা থেকে ফিরে এলেন অনুপমা।

‘হ্যালো--’

‘আমি কি ডক্টর রয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ ওপ্রান্তে একটি নার্ভাস মেয়ের গলা।

‘আমি ডক্টর রয়। কি দরকার বলুন।’

‘আমার নাম ব্রিটানি, আমি আপনার পেশেন্ট অ্যারন পিটারসনের নাতনি।’

‘আপনি আমার ফোন নাম্বার কোথা থেকে পেলেন?’ হঠাৎ বিস্ময়ে আর কিছু মুখ দিয়ে বেরোল না অনুপমার। সঙ্গে সঙ্গেই ওঁর মনে পড়ে গেল যে এটা পুরনো ল্যান্ডলাইন, নম্বরটা ইন্টারনেট সার্চ করলে পাওয়া যাতেও পারে।

‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্য মাপ চাইছি। কিন্তু কয়েক মিনিটের জন্য যদি দেখা করতে রাজি হন তাহলে অনেক কৃতজ্ঞ থাকবো। প্লীজ--’

‘এক মিনিট দাঁড়ান, আমাকে এখন কাজে যেতে হবে। আপনার নম্বরটা দিন, আমি আপনাকে ফোন করবো।’ অনুপমার মনে হলো এই মুহূর্তে আর কথা বাড়ানো ঠিক হবে না।

‘দয়া করে করবেন। আমি জানি অ্যারন মারা যাচ্ছে। ওরা আমার সঙ্গে কিছুতেই ওর দেখা হতে দেবে না। আপনিই শুধু আমাকে সাহায্য করতে পারেন।’ ওদিকের গলার আওয়াজ কান্নায় মিশে গেল প্রায়। সকালবেলার শান্তি এখন ঘাসের মাথায় শিশিরের মতই উবে গেছে, তার বদলে হানা দিয়েছে কালকের অদ্ভুত অস্বস্তি আর মগ্ন চৈতন্যর মধ্যে কিছু ভুলে যাওয়া গোপন অতীতের অনুভব। এক মাথা চিন্তা নিয়ে হাসপাতালে ঢুকেই সোজা কাস্টডি অফিসারকে ফোন করলেন অনুপমা। কেসটার বিষয়ে আগে সব কিছু জেনে নেওয়া দরকার।

রেকর্ড রুমটা বেসমেন্টে, এখানে রোদ্দুরের প্রবেশ নিষেধ, বাতির আলোর রং মৃত মানুষের চামড়ার মতন ফ্যাটফ্যাটে সাদা। সারি দেওয়া ফাইল ক্যাবিনেটগুলোর মাঝে মাঝে কয়েকটা টেবিল চেয়ার পাতা, তারই একটাতে বসে ওঁরা কথা বলছেন।

‘তার মানে ব্রিটানি ওঁর নিজের নাতনি নয়, সৎ মেয়ের মেয়ে, সেই সৎ মেয়েও আবার সিঙ্গল মাদার। বেশ জটিল ব্যাপার।’ অনুপমা বললেন।

‘ঠিক। অ্যারনের স্ত্রীর নাম লরা, ভদ্রমহিলা ওঁর থেকে প্রায় চার বছরের বড়ো। লরার আগের পক্ষের মেয়ের নাম জেনিফার, বিয়ের সময় ওর বয়েস ছিল পনেরো বা ষোলো বছর। জেনিফার কলেজের পড়া শেষ করেনি, একটা ব্যান্ডের সঙ্গে নানা জায়গায় প্রোগ্রাম করে বেরোতো, তারপর আঠেরো বছর বয়েসে প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে। বাবাটির পাত্তা পাওয়া যায়নি। ওর নিজের আস্তানা বলে বিশেষ কিছু ছিলো না, কখনো মার কাছে থাকতো, কখনো ট্যুরে, বাচ্চাটা অ্যারন আর লরার কাছেই মানুষ। এইভাবেই চলেছিল প্রায় তেরো চোদ্দ বছর, তার মধ্যে জেনিফারের পাঁচবার বয়ফ্রেন্ড বদল হয়েছে কিন্তু স্থায়ী ঠিকানা তখনো কিছু হয়নি। বছর দুয়েক আগে লরা আর অ্যারনের মধ্যে হঠাৎ করেই ডিভোর্স হয়ে যায়। অ্যারন বাড়ি ছেড়ে একা একটা ফ্ল্যাটে উঠে যান, সেখান থেকে ব্রিটানির স্কুল হাঁটা পথ। ব্রিটানি নাকি প্রায়ই স্কুল থেকে অ্যারনের ফ্ল্যাটে যেত। ওখান থেকেই একদিন রাতে পুলিশ গিয়ে ওঁকে গ্রেফতার করে। ওদের দুজনকে শোবার ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছিল যখন কারোর গায়েই কোনরকম জামাকাপড় ছিল না। দুজনেরই পেটে অ্যালকোহল ছিল এবং যৌন সংসর্গের অকাট্য প্রমাণ ছড়িয়ে ছিল বিছানায়। তখনও ব্রিটানির বয়েস ষোলো পেরোয়নি কাজেই নাতনির সঙ্গে অত্যাচার এবং নাবালিকা ধর্ষণ, দুটো অভিযোগই ছিল অকাট্য। কিন্তু গল্পটার এখানেই শেষ নয়।’

অফিসারটি দম নিতে থামলেন। এখানে সিগারেট খাবার নিয়ম নেই কিন্তু অনুপমা কোথা থেকে একটা দম আটকানো ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছেন, রীতিমতন অস্বস্তি হচ্ছে ওঁর। চারদিকে লোহার ক্যাবিনেটগুলো থেকে নানা আকারের বিভীষিকার মূর্তিরা বাইরে আসার জন্য দাপাদাপি লাগিয়েছে যেন। এক কাপ কফি পেলে মন্দ হতো না বেশ। অনেকটা চিনি আর দুধ মেশানো কড়া কফি।

‘অ্যারন নিজের সমর্থনে একটাও কথা বলেনি।’ অফিসারটি আবার শুরু করলেন, ‘কিন্তু ব্রিটানি আদালতে দাঁড়িয়ে জবানবন্দি দেয় যে ওর ওপরে এক ফোঁটা জোর করা হয়নি, যা ঘটেছিল পুরোটাই ওর সম্মতিক্রমে। ও বলেছিল যে মা এবং দিদিমাকে ও দুচক্ষে দেখতে পারে না বাড়িতে শুধু অ্যারনই ওর কাছের লোক। সমাজে যে যা বলুক, সম্পর্ক আর বয়েস যাই হোক সামনের এই অভিযুক্ত মানুষটিকেই সে ভালোবাসে। এইরকম পরিস্থিতি নাকি আগেও হয়েছিল, অ্যারনই প্রতিবার ওকে নিরস্ত করেছে। সেদিন ওদের প্রিয় ফুটবল টিমের খেলা ছিল। খেলা শুরু হবার সময় থেকেই অ্যারন বিয়ার খাচ্ছিল, টিম জেতার পর সেটা একটু বাড়াবাড়ির দিকে চলে যায়। নেশার মধ্যে ও লক্ষ করেনি কখন ব্রিটানিও ক্যানের পর ক্যান গলায় ঢালতে শুরু করেছে। তারপর কি ঘটেছে ওদের ঠিক খেয়ালও নেই। হুঁশ আসার পর দেখেছে যে ঘরভর্তি লোকের সামনে ওরা বিছানায় নগ্ন অবস্থায় শুয়ে, সারা ঘরে ওদের পোষাক, খাবারের টুকরো আর বিয়ারের ক্যান ছড়ানো। ওর কথায় অবশ্য হিতে বিপরীত হয়েছিল। ওদের ছোটো শহরে বেশিরভাগ লোক রক্ষণশীল, তারা এই ব্যাপারটা একেবারেই নিতে পারেনি। লরা আর জেনিফার রটিয়ে দেয় যে অ্যারন নাকি ড্রাগ আর অ্যালকোহলের নেশা ধরিয়ে ওকে কব্জায় এনেছিল। সকলের কাছে অ্যারন তখন জলজ্যান্ত শয়তান যা নাকি একটা নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ের মগজ ধোলাই করে তাকে নিজের পাশবিক প্রবৃত্তির শিকার বানিয়েছে। এই সবের মধ্যে অ্যারন পুরোটা সময় এমন নির্বিকার হয়ে ছিল যে জুরি কিংবা বিচারক কেউ ওর মধ্যে কোনরকম অনুতাপের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাননি। যার ফলে এটা ওর প্রথম অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও কোনরকম দয়া পায়নি অ্যারন। ওকে সাইকোপ্যাথিক এবং অতি বিপজ্জনক সেক্স অফেন্ডার দোষী ঘোষণা করে কুড়ি বছরের জেল দেওয়া হয়। ওদিকে সেই এক রাতের কাণ্ড থেকেই ব্রিটানি প্রেগনেন্ট হয়ে পড়লো। নিজেরা গোঁড়া খ্রীষ্টান হওয়া সত্ত্বেও ওর বাড়ির লোক, বন্ধুবান্ধব সবাই গর্ভপাত করানোর জন্য চাপ দিতে থাকে কিন্তু ব্রিটানি কিছুতেই রাজি হয়নি। এখন সে প্রায় একলাই বাচ্চাটাকে বড়ো করেছে, মা-দিদিমার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে অনেকবার জেলে অ্যারনের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল কিন্তু অনুমতি মেলেনি। আইন বলছে যৌন অপরাধীকে কিছুতেই তার ভিকটিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হবে না, বিশেষ করে সে যদি নাবালক বা নাবালিকা হয়।

ধোঁয়ার গন্ধটা এবারে অসহ্য হয়ে উঠেছে। যা শোনার শুনে নিয়েছেন, এইবার ওপরে উঠে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন অনুপমা। ব্রিটানির ফোন নম্বরটা খুঁজে বার করতে হবে। নার্সকে ডেকে বলে দিলেন ভদ্রলোককে আরেকটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে। মাথার ভেতরটা দপদপ করছে, এক্ষুনি এক কাপ কফি না খেলে সত্যিই আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।

***********

‘আমার মনে আছে সেদিন দুপুরবেলা হঠাৎ করেই আকাশ কালো হয়ে উঠেছিল, বাতাস বইছিল শনশন করে। টিভিতে বললো টর্নেডো হতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে সব স্কুল ছুটি। বাইরে এসে দেখি শুকনো পাতাগুলো উলটোপালটা হাওয়ার স্রোতে ইচ্ছেমত এদিক ওদিক উড়ছে। কালো আকাশে মেঘের দল এমন জোরে ছুটে পালাচ্ছে যেন কোন ভয়ঙ্কর দানব তাড়া করেছে ওদের। বাতাসের মধ্যে একটা অমানুষিক শক্তি যেন পাথর চাপা ডিনামাইটের মতন বিস্ফোরণের অপেক্ষায় অস্থির। অ্যারন রাস্তার উলটোদিকে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল, বাতাসে এলোমেলো ওর ব্রাউন রঙের কোর্ট আর মাফলার। এতো লোক গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে কিন্তু ঝড়জলের মধ্যে অ্যারন ছাড়া কেউ নেমে দাঁড়ায়নি। ঠিক সেই সময় কড়কড় করে খুব কাছে একটা বাজ পড়তেই আমি এক দৌড়ে গিয়ে ওর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ও আমাকে বেসবলের মতন খপ করে লুফে নিয়ে, গাড়ির ভেতরে বসিয়ে সীটবেল্ট আটকে দিয়েছিল। ওর শক্ত হাতের কয়েকটা আলতো চাপড় খেয়েই তখন আমি পুরোপুরি আশ্বস্ত। এখন টর্নেডো, সাইক্লোন বা হারিকেন যা খুশি আসতে পারে, আমি জানি অ্যারন ঠিক আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে, স্টোভ জ্বালিয়ে খাবার গরম করে দেবে, ফায়ারপ্লেসের পাশে কম্বলমুড়ি দেওয়া আমার হাতে ঠিক পৌঁছে যাবে প্লেটটা।

'সেদিন কিন্তু ঝড়টা হতে হতেও হয়নি, আমাদের শহরের ওপর দিয়ে পশ্চিমে খোলা সমুদ্রের দিকে উড়ে গেছিল। ঘন্টাখানেকের মধ্যে মেঘ ভেঙে গিয়ে ঝকঝকে রোদ্দুর, তার মধ্যেই আকাশের এককোনায় একটু বৃষ্টি। জলের ফোঁটাগুলো থেকে ঠিক যেন হিরের মতন আলো ছিটকে পড়ছে। তারপর সেই বৃষ্টিটাও থেমে গেল, আকাশের অর্ধেকটা তখন পরিষ্কার নীল। আমি দেখলাম ঠিক বরফে ঢাকা পাহাড়ের মতই বিরাট সাদা একটা মেঘ অন্যদিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, কমলা, হলুদ আর লাল মেশানো অদ্ভুত সুন্দর একটা রং তার সারা গায়ে মাখানো। অ্যারন বললো ভালো করে ওই মেঘের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে। আমি দেখলাম পাহাড়টার মধ্যিখানে বিদ্যুৎ খেলছে, থিরথির করে কাঁপছে তার ঝিলিক দেওয়া আলো, কিন্তু কোনো শব্দ নেই।’

‘বজ্রগর্ভ মেঘ।’ নিজের মনেই কথাটা বলে ফেললেন অনুপমা। ব্রিটানি না বুঝতে পেরে তাকিয়ে রইলো।

‘সরি, বলো তুমি কি বলছিলে।’

‘আমি তখন ক্লাস নাইনে, মা ওইসময় যোহান বলে নতুন একজনের সঙ্গে খুব ডেট করছে, তারপর তো তাকে বিয়েই করলো। লোকটাকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারতাম না। কোনো কাজ বেশিদিন করতে পারতো না, আগের পক্ষের দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে এসে থাকতো। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া মারপিট হতেও দেখেছি। আমার নিজের বাবা সেই যে ছোটবেলা বেপাত্তা হয়েছিল, তার খবর আর পাওয়া যায়নি, তাকে আমার মনেও পড়ে না। আমার অসুখটাও সেই সময় বাড়াবাড়ি হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে অ্যারন আমাকে পড়াতো, আমাকে নিয়ে বাগান করতো, আমাকে সাইকেল চড়তে আর টেনিস খেলতে শিখিয়েছিল, আমার কখন কি খেতে ভালো লাগে তার খেয়াল রাখতো। ওই হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার একমাত্র সাথী, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে একমাত্র নির্ভরযোগ্য মানুষ যে সবসময় আমার জন্য আছে। অসুস্থ আর নিরানন্দ আমাদের এই পুরনো বাড়ি আর আধাখ্যাঁচড়া পরিবার যার ওপর নির্ভর করে চলছে। আস্তে আস্তে এমন দাঁড়ালো যে অ্যারনকে না দেখলে, ওর সাথে কোনো দিনই দেখিনি, প্রথম থেকে বাবার জায়গাতেই ওকে বসিয়েছিলাম। সেই অবস্থানটা যে কখন বদলে গেল আমি নিজেও তার হদিশ পাই না। দিদিমা অসুস্থ, মা নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত, বাড়িতে আমি আর অ্যারন ছিলাম একে অপরের অবলম্বন। সেই থেকে যে এরকম সর্বনাশ হবে যদি জানতাম। অপরাধ করল দুজনে আর সব শাস্তি হলো শুধু একটা লোকের।’

ব্রিটানির চোখে জল ছলছল করছে। অনুপমা দেখলেন বৃষ্টিতে ধোয়া লিলিফুলের মতই তরতাজা একটা মুখ, একরাশ বাদামি চুল শক্ত করে পনিটেল বাঁধা। মেয়েটার সারা শরীরে যৌবনের উচ্ছলতা কিন্তু গাঢ় নীল চোখের তারায় বিষাদের ঢেউ।

‘তোমার মা আর দিদিমার কথা কিছু বলো। অ্যারনের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক কেমন ছিলো?’

‘দিদিমা বাইপোলার মানসিক রোগে ভুগতো, কখনো সাংঘাতিক এনার্জি, কখনও প্রচণ্ড অবসাদ। ওষুধ খেতো না, ডাক্তার দেখাতে চাইতো না, বেশ কয়েকবার সুইসাইড করতে গেছিল। আবার বাতিক উঠলে গুচ্ছের দামী দামী জিনিস কেনা শুরু করতো কিংবা অসম্ভব সব ব্যবসা করার প্ল্যান বানাতো। সেই নিয়ে কিছু বলতে গেলেই তুমুল অশান্তি। মা বাড়ির বাইরে বাইরেই থাকতো, কখনো ছোটখাটো চাকরি করতো, কখনো করতো না। আমার বাবা ছাড়াও আরো অনেকেগুলো বয়ফ্রেন্ড হয়েছিল, শেষ অবধি একটাও টেঁকেনি। বাড়িতে নিয়মিত রোজগার বলতে শুধু অ্যারনের মাইনে। মা একদিকে সৎ-বাবাকে দেখতে পারতো না আবার নানাভাবে ওর কাছ থেকে টাকা আদায় করতেও ছাড়তো না। এ-ব্যাপারে মা আর দিদিমার মধ্যে বেশ একটা আঁতাত ছিল, দুজনে মিলে অ্যারনকে কোণঠাসা করে রাখতো। আমি ওর হয়ে কিছু বলতে গেলে শুরু হতো আরেক অশান্তি। অ্যারনের বিয়ার খাওয়াও ক্রমে ক্রমে বাড়ছিল। সব মিলিয়ে বলতে পারেন একটা বিশৃঙ্খল অসুস্থ পরিবার।’ ব্রিটানি হাসলো।

অনেকক্ষণ হয়ে গেল ওরা দুজনে বসে কথা বলছে। এর মধ্যে লম্বা হয়েছে গাছের ছায়ারা, মলের পার্কিংলটে গাড়ির ভিড়টা বেড়েছে, সিনেমা হলের সামনে লাইন লাগিয়েছে কিছু লোক। দুপুরের নির্জনতায় যে কথাগুলো সহজে বলা যাচ্ছিল, সেগুলোই এখন অস্বস্তিকর লাগছে।

‘তুমি কি এখনও অ্যারনকে--’ কথাটা বলার আগে থেমে গেলেন অনুপমা।

‘ভালবাসি কিনা? নিশ্চয়ই বাসি কিন্তু ওইরকম ভালোবাসা নয়। ওই যে গাড়িটা দেখছেন, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, মেরুন রঙের হন্ডা সিভিক, ওইখানে আমার আসল ভালোবাসার মানুষটি অপেক্ষা করছে। চলুন আলাপ করিয়ে দিই।’

ব্রিটানি ওঁকে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। গাড়ির মধ্যে অপরিচিত এক নওজোয়ান, তার পাশে বছর তিনেকের ফুটফুটে ছেলেটির সঙ্গে খুব মন দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে।

‘আলাপ করিয়ে দিই, এই আমার ফিয়াসেঁ টাইলার, আর এই হচ্ছে আমার ছেলে--অ্যারন জুনিয়র। টাইলার সব কথা জানে, ও আমাদের বিচার করতে বসেনি। অতীতকে অতীতের জায়গায় রেখেই ও বর্তমানকে জড়িয়ে ধরেছে। ও আর আমি মিলে অ্যারনকে বড়ো করে তুলবো। আমি শুধু চাই ওর বাবা ওকে একবার দেখুক, অপরাধ আর শাস্তির মাঝখানে একটুখানি সার্থকতার খোঁজ পাক। ওর জীবনটা যেন শুধু এক অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে না যায়। আমার মুখ থেকে ও একবার শুনে নিক যে সমাজ তার আইন মেনে ওকে অপরাধী করলেও আমি ওকে নি:শর্তে ক্ষমা করেছি।’

অনুপমা হাঁ করে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছেন, টাইলারের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরারও খেয়াল নেই এখন। বিকেলের রোদ্দুরে ওঁর সামনে একজোড়া তরুণ-তরুণী আর তরতাজা একটি শিশু নিয়ে সেই চিরন্তন প্রত্যাশার ছবি। পথ চলতে চলতে মানুষের ইতিহাস এই ছবিটা দেখলেই তার সামনে একটা নতুন স্বপ্নের গাছ পুঁতে দেয়। অথচ এর পিছনেই তাড়া করে ফিরছে সন্দেহ আর বিভ্রান্তি, ঘুরপাক খাচ্ছে নীতি আর ধর্মের বিধান, অপরাধ আর শাস্তির জটিল আবর্ত। পথের ধারে ওঁৎ পেতে রয়েছে রক্তচক্ষু আর মুষ্টিবদ্ধ হাতেরা, দুপাশে খাদের মধ্যে রয়েছে পিচ্ছিল পিপাসাময় অন্ধকার। এই সবকিছুর মাঝখানে একটু আলো পাবার জন্য গাছটার অনন্ত আকুতি।

‘আমি চেষ্টা করবো ব্রিটানি। এইটুকু কথা দিতে পারি। পারবো কিনা জানি না।’ ওদের বিদায় জানিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরলেন অনুপমা। কাল সকালে অ্যারনের সঙ্গে অ্যাপয়ন্টমেন্ট।

*********

‘অপরাধের সংজ্ঞা আর শাস্তির নৈতিকতা নিয়ে সেই মহাভারতের আমল থেকে ঝামেলা চলছে অনু। তুমি কয়েক দিনের মধ্যে তার সমাধান করতে যেয়ো না, শুধু শুধু ল্যাজেগোবরে হবে।’ ল্যাপটপের পর্দা থেকে চোখ না তুলেই মন্তব্যটা ছুঁড়ে দিলেন সৌভিক।

‘ওরকম ক্যাজুয়ালভাবে বোলো না সৌভিক। এই মানুষটা মারা যাচ্ছে, তার আগে সে তার সন্তানকে চোখের দেখা দেখতে চায়। লালফিতের ফাঁসে আটকে তাকে এইটুকু সুখ থেকে বঞ্চিত করা অপরাধ নয়? বিশেষ করে যখন--' অনুপমা অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। এইমাত্র যে টেলিফোন কলটা শেষ হলো তাতে বিশেষ কোনো আশাব্যঞ্জক খবর ছিলো না।

‘বিশেষ করে যখন সেই অবৈধ সন্তানের মা নিজেই দেখা করার জন্য উৎসুক। তুমি বুঝতে পারছো না এই ব্যাপারটা সমাজ কিছুতেই হজম করতে পারবে না। যে যৌন অত্যাচারের শিকার, সে তার অপরাধীকে ঘৃণা করবে, তার মৃত্যু চাইবে এইটাই তো স্বাভাবিক।’

‘কিন্তু ও তো এটাকে অত্যাচার হিসাবে ভাবছে না।’

‘সমাজ ভাবছে, দেশের আইন ভাবছে। তাছাড়া এই যে ব্যতিক্রম, এটাকে কেউ স্বাভাবিক বলে মনে করবে না।’

‘কি ব্যতিক্রম?’

‘একদিক থেকে ঘৃণার অভাব, অন্যদিক থেকে অনুতাপের। ক্রিমিন্যাল জাষ্টিস সিস্টেম এভাবে চলতে পারে না। আলবেয়ার কামুর একটা ছোট্ট উপন্যাস আছে- L’Etranger অর্থাৎ অচেনা বা বহিরাগত। একটা লোকের মা মারা গেছে কিন্তু তার কিছুতেই শোক হচ্ছে না, সে শোকের ভানও করছে না। বাকিদের কাছে সেটা আপত্তিকর। সেই লোকটা ঘটনাক্রমে একটা খুন করে ফেলল। খুন করার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না কিন্তু করার পর তার বিশেষ কোনো অনুশোচনাও দেখা গেলো না। লোকটা তার ব্যক্তিগত সত্ত্বাটির অস্তিত্ব ছাড়া আর কোনো কিছু্কেই সত্য বলে স্বীকার করে না। বিচারকদের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াল সেটাই। সমাজ যে জিনিসের যে প্রতিক্রিয়া আশা করে তার ব্যতিক্রম দেখলেই মারমুখী হয়ে ওঠে।’ সৌভিক চিন্তিতভাবে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি ক্ষমতা জিনিসটাই অবৈধ কিন্তু ক্ষমতাবানরা সেটা জানতে দিতে নারাজ। এই চক্করে পড়ে অনেকের বিপদ হয়েছে, তাই বলছি গা বাঁচিয়ে সরে পড়ো।’

‘আমারও এক একবার মনে হচ্ছে সময় নষ্ট করছি।’ অনুপমা হতাশভাবে বললেন। আচ্ছা তোমার কি মনে হয়? তুমি কখনো পারতে একটা নাতনির বয়েসী মেয়ের সঙ্গে শুতে। নাহয় নিজের নাতনি নয় তাও ছোটবেলা থেকে যাকে বড়ো হতে দেখেছে--’ অনুপমার মুখের ওপর ঘৃণার ভাঁজ পড়লো একটা।

‘আমি পারতাম না। কিন্তু তাতে কিছুই প্রমাণ হয় না অনু। আমি বাংলাদেশের গৃহপালিত পুরুষ, ছোটবেলা থেকেই একদিকে ভণ্ডামি অন্যদিকে রক্ষণশীলতা আমার মজ্জাগত, তার ওপরে আমি ভিতু আর অলস। জীবনের সব নোংরা কার্পেটের তলায় ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে আমার এতগুলো বছর কেটে গেল। কার্পেট নাড়ালে যে কি বেরোবে তা শিবের বাবা মহেশ্বরই জানেন। সুতরাং আমার কথা বাদ দাও। সমাজবিজ্ঞানী হিসাবে তোমাকে এইটুকু বলতে পারি যে আমাদের পাপপুণ্যের ধারণাগুলো সুবিধাজনক কিন্তু ঘোরতর আপেক্ষিক।’

‘অ্যারনকে দেখলে আমার রাগ হয়, আবার ব্রিটানিকে দেখলে মনটা রোদ্দুরে রাখা আইসক্রীমের মতন গলে যায় জানো? অথচ ওদের দুজনে একটাই জিনিস চাইছে। কি উদ্ভট সমস্যা বলো দেখি?’

সৌভিক এবার ল্যাপটপ ছেড়ে অনুপমার সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছেন। ওঁর চশমার কাচের ওপর সকালের রোদ্দুর।

‘কন্ডিশনড রিফ্লেক্স। যদি পারো তবে নীতির আতস কাচটা ফেলে দাও, তার জায়গায় সহমর্মিতার আয়না তুলে ধরো। দেখবে তুমি আর তোমার অভিজ্ঞতার প্রতিফলন, এই নিয়েই বিশ্বসংসার। সেইটা মাথায় রেখে পাপ, পুণ্য, উচিৎ, অনুচিতের বিচার কোরো, তাহলে হয়তো সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাবে।'

‘থ্যাঙ্ক ইউ সৌভিক, ওইটুকুই আমার দরকার ছিল। আইন যাই বলুক আমি অ্যারন আর ব্রিটানির দেখা করিয়ে ছাড়বো।’ কাগজপত্রগুলো ব্যাগে ভরতে ভরতে উঠে দাঁড়ালেন অনুপমা, ‘তার জন্য যদি গভর্নরের কাছে যেতে হয়, তাও যাবো।’

অনেক বোঝাবার পর অ্যারন কিছুটা চিকিৎসা করতে রাজি হয়েছেন। ওঁকে জেল হাসপাতাল থেকে ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে নিয়ে আনা হয়েছে। অনুপমাকে দেখে ওঁর শীর্ণ মুখের ওপর দিয়ে ক্ষীণ হাসির একটা ঢেউ খেলে গেল।

‘ডাক্তার, কোনো খবর পেলেন। কবে আসবে ব্রিটানি?’

‘এখনও ঠিক জানি না অ্যারন। অনুমতি পেতে সময় লাগবে, অন্তত: আরো তিনদিন।’

‘আমি তো ভালোই আছি, তাই না ডাক্তার? তিন দিন টিঁকে যাবো আশা করি।’

‘আগের তুলনায় অবশ্যই ভালো। ব্যথাটা কেমন আছে। মর্ফিন নিতে চাইছেন না দেখলাম।'

‘সহ্যের মধ্যে। মর্ফিন নিলে মাথাটা কেমন যেন ধোঁয়াটে হয়ে আসে, বড্ড খুব ঘুম পায়। আমি যতটা সম্ভব সজাগ থাকতে চাই।’

‘আপনার প্রাক্তন স্ত্রী আর সৎ মেয়ে দেখা করতে চেয়েছেন। আপনি রাজি নন?’

‘ফোনে কথা হয়েছে। দেখা করে নতুন কিছু কথা তো হবার নেই। আমার সম্পর্কে ওদের মনোভাব কিছু বদলায়নি। ওরা আমাকে ক্ষমা করতে চায় কিন্তু ওদের কাছে আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। যার কাছে ক্ষমা চাওয়ার আছে সে এলেই আমার হবে।’

‘তাহলে আপনি স্বীকার করছেন যে ব্রিটানির প্রতি অপরাধ করেছেন?’ অনুপমা বেশ আগ্রহের সঙ্গেই প্রশ্নটা করে ফেললেন।

‘আপনি বুঝি শুধু অপরাধ করলেই ক্ষমা চান ডাক্তার? প্রিয় কাউকে অনিচ্ছায় দু:খ দিয়ে ফেললে ক্ষমা চান না কখনো?’ অ্যারনের গলার স্বরটা অন্যরকম শোনাল।

কি বলবেন ভেবে পেলেন না অনুপমা। লোকটা কি প্রেমিক হিসাবেই ওর নাতনির সঙ্গে দেখা করতে চায় নাকি? ব্রিটানির মা এবং দিদিমা দুজনেই চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে ওরা এই দুজনের নধ্যে কোনোরকম যোগাযোগ হবার বিরুদ্ধে। ওদের ধারণা এতে ব্রিটানির ক্ষতি হবে, কিন্তু মেয়ে এখন সাবালিকা সেও তার ইচ্ছে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ এখন দোটানায়।

ছোট্ট জানলা দিয়ে একচিলতে আকাশ দেখা যাচ্ছে, সেইদিকেই তাকিয়ে আছেন অ্যারন। এক মুহূর্তের উত্তেজনা মুছে গিয়েছে, চোখের মধ্যে আবার সেই অদ্ভুত উদাসীনতা। অনেক দূরে পাইনগাছের মাথায় যে গাংচিল দুটো ঘুরপাক খাচ্ছে, ভদ্রলোকের সব মনোযোগ এখন ওই দিকে।

‘অ্যারন, আপনি এতো একগুঁয়ে কেন। এতে সবাই বিপক্ষে চলে যায়। আপনি ঠিকমতন সহযোগিতা করলে হয়তো জেল থেকে খালাস পেয়েও যেতে পারতেন। গুরুতর রোগ হলে অনেকসময় ক্ষমা পাওয়া যায়। কিন্তু আপনি তো ছাড়া পেলেই ব্রিটানির কাছে গিয়ে হাজির হবেন যেটা আইন কিছুতেই বরদাস্ত করবে না।’ অনুপমা প্রায় ব্যাকুল স্বরে কথা বলছেন এখন।

‘যারা আমাকে বিবেকহীন পশু মনে করে তাদের দয়ার দান আমি কেন নেবো বলতে পারেন? আমার ক্যানসার হয়েছে, বাঁচার সময় সীমিত হয়ে গেছে সেজন্য? আমি মনে করি প্রত্যেকটা জীবন সীমিত, তাই নিয়ে এতো উত্তেজিত হবার কিছু নেই। সমাজের মতে আমি বিপজ্জনক অপরাধী তাই পাঁচজনের মধ্যে স্বাধীনভাবে থাকার অধিকার আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়াটা জরুরী। ভালো কথা। কিন্তু আমি যদি মৃত্যুর মাধ্যমে স্বাধীনতা চাই তাতে সকলের এতো অস্বস্তি কেন? বাকি রইলো ক্ষমা চাইবার প্রশ্ন। মানুষই শুধু তার ভুলের জন্য ক্ষমা চায় তাই যে আমাকে পশু বলে মনে করে না একমাত্র তার কাছেই আমি ক্ষমা চাইতে পারি।’ এতগুলো কথা একসাথে বলে বেশ একটু হাঁপিয়ে গেছেন অ্যারন।

‘কিন্তু আপনার ভুলটা কি হয়েছিল জিজ্ঞাসা করতে পারি?’ অনুপমার গলার মধ্যে বিভ্রান্তি।

‘ডাক্তার আপনি তো ব্রিটানিকে দেখেছেন। কি মনে হয়েছে আপনার?’

‘এক কথায় অসাধারণ মেয়ে। যেমন সুন্দর দেখতে তেমন সুন্দর তার স্বভাব। ছেলে বন্ধুটিও চমৎকার, ওরা দুজনেই বাচ্চাটাকে খুব আদরে রেখেছে। আপনার নামে নাম দিয়েছে ওর। ওর ফিয়াসেঁ টাইলার সব কথা জানে, ওদের মধ্যে কোনরকম ভুল বোঝাবুঝি নেই।’ এক নি:শ্বাসে বলে গেলেন অনুপমা।

‘যেদিন থেকে আপনার কাছে এই খবরটা শুনেছি, আমার মন ঠিক ওই পাখিটার মতন আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। আমার জীবনে ভালো লাগার একটাই উৎস ছিল, তার নাম ব্রিটানি। ও যে ভালো হয়েছে, বিকশিত হয়েছে সবচেয়ে বড়ো কথা সেই রাত্রের ক্ষতগুলো সারিয়ে তুলতে পেরেছে, এই খবরটাই আমার কাছে যথেষ্ট। আমার নামে আমাদের সন্তানের নাম রেখে ও তো কবেই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে, তার সঙ্গে দিয়েছে নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতি। ওকে বাদ দিলে আমাদের জীবনের বাকি অংশটা খুব একটা উজ্জ্বল নয় ডাক্তার, সেটাকে অমূল্য বলে মনে করার কোনই কারণ নেই। সেখানে শুধু একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত, অপাত্রে ভালোবাসা, অবসাদ, অর্থকষ্ট, অশান্তি আর সন্দেহের মিছিল। সব সম্ভাবনার ওখানে অকালমৃত্যু হয়, তাই সেই জীবনের ঘন্টা আর মিনিটগুলো ক্যানসারের কোষের মতোই অপজীবিত, তার কাজ শুধু নষ্ট করা আর নষ্ট হওয়া। ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই শুধু একটা জিনিস ওর হাতে দেবো বলে। ভয় নেই, রোম্যান্টিক কিছু নয় শুধু আমার উইল আর লাইফ ইনসিওরেন্স পলিসি। ওর কলেজে যাওয়ার খরচটা উঠে যাবে। দেখা না হলে আমার উকিল ওর হাতে পৌঁছে দেবে ওগুলো।’

অনেক কথা হয়ে গেছে আজ। ওষুধপত্র ঠিক করে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন অনুপমা। দিনের বাকি ঘন্টা আর মিনিটগুলো অভ্যস্ত এবং একঘেয়ে ছন্দে কেটে যেবে এখন। বিকেলবেলার জন্য অপেক্ষা করে আছেন উনি, যখন কফিশপের সামনে ব্রিটানির সাথে দেখা হবে আবার।

**********

‘আমিও খুব খুশি হয়েছি ব্রিটানি। কাল বারোটার সময় দেখা হচ্ছে তাহলে।’

টেলিফোনটা রেখে শব্দ করে হেসে উঠলেন অনুপমা। গলা ছেড়ে কয়েক লাইন গান উঠলেন অনেক দিন বাদে। পাশের চেয়ারে বই থেকে মুখ তুলে তাকালেন সৌভিক।

‘মনে হচ্ছে ওদের দেখা করার অনুমতি মিলেছে। বাপরে লোক লটারি পেলেও এত খুশি হয় না।’ ‘বাজে বোকো না তো।’ সৌভিকের পেছনে গিয়ে কাঁধের ওপর দুহাত রাখলেন অনুপমা। ‘এ তোমার বইতে পড়া থিয়োরী নয়, সত্যিকারের ভালোবাসার গল্প। এরকমটা যে হতে পারে, আমি না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।’

ওঁর হাত দুটো ধরে নিচের দিকে টেনে আনলেন সৌভিক। অনুপমা এখন সৌভিকের পিছনে, কাঁধের ওপর থুতনি, পিঠের ওপর বুকের নরম চাপ। দুজনেই হাসছেন।

‘মানুষের চিরন্তন রূপকথা, সব খেলায় শেষ অবধি ভালোবাসার টিমকে জেতানো।’ সৌভিক বললেন। আমি খুশি হয়েছি কারণ আমার কাছে এটা তোমার জিত। আইন আর স্টিরিওটাইপের বাইরে গিয়ে তুমি একটা মানবিক সমস্যাকে শুধুমাত্র তোমার বিবেক দিয়ে বিচার করতে পেরেছো সেজন্য আমার অভিনন্দন রইল। তা যুদ্ধে জেতার আনন্দ আমার সঙ্গেও একটু ভাগ করে নিতে পারো।

অনেক রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেল অনুপমার। নানারকম ভুলভাল প্রশ্নরা মাথায় ভেতরে কবাডি খেলছে। আচ্ছা ধরা যাক অ্যারন সেরে উঠলো। তখন ওদের জীবনে একটা নতুন সঙ্কট দেখে দেবে না তো? অ্যারন যদি ওর ছেলের কাছাকাছি থাকতে চায়? টাইলার ছেলেটাকে খুবই শান্ত আর বুঝদার মনে হয় বটে কিন্তু তাহলেও এরকম একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও সামাল দিতে পারবে কি?

এক গ্লাস জল খেয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়ালেন অনুপমা। সৌভিকের মৃদু নাকডাকার শব্দ কানে আসছে। অন্ধকারটা এখানে পাতলা, রাস্তার আলোর সঙ্গে চতুর্দশীর চাঁদের আলো মিলেমিশে বাইরেটা মোটামুটি পরিষ্কার। একটা হাওয়া বইছে গাছের পাতারাও তাই চঞ্চল। ফাঁকা রাস্তায় হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল, পুলিশের গাড়িই হবে।

কিসের অভাবে শুকিয়ে যায় জীবন? শরীরের চাহিদা, মনের চাহিদা, দায়িত্ব, কর্তব্য, অভ্যাস, আইন, নীতিবোধ--এরা সবাই থেকেও নেই হয়ে যায়। ভালোবাসা নামে সেই যে অসম্ভব জিনিসটা এক লহমায় গুবলেট করে দিতে পারে সবকিছু, তাকে তো বোতলে পুরে লেবেল মেরে আলমারিতে তুলে রাখা যায় না। সে হয় পোড়াবে নয়তো আলো দেবে। অনুপমার মনে হলো যাকে আমরা বাস্তবতা বলে সম্মান করি সে আসলে একান্ত উদ্ভট কিছু এলোমেলো ঘটনার এক বিশৃঙ্খল মিছিল। তারই মধ্যে ভালোবাসা যেন ক্ষ্যাপার হাতে পরশপাথর, কখন ছুঁড়ে ফেলে দেবে তার ঠিক নেই। এই আলো অন্ধকারের মধ্যে বসে কে কার বিচার করতে পারে?

বাকি রাতটা আর ঘুম এলো না অনুপমার।

এলিভেটর থেকে বাইরে পা রাখা মাত্রই গোলমালটা কানে এলো। অ্যালার্ম বাজছে তার মানে কেউ একজন মারা যেতে বসেছে এই মুহূর্তে। হাওয়ায় বিপদের গন্ধ পেয়ে উনি প্রায় এক ছুটে অ্যারনের ঘরে পৌঁছে গেলেন। নার্সরা দুদিকে সরে ওঁর জন্য রাস্তা করে দিলো।

প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় অ্যারন বুঝি ঘুমিয়ে আছেন। কাছে গিয়ে অনুপমা বুঝতে পারলেন ওঁর নি:শ্বাস প্রশ্বাস অনিয়মত, মুখের রং হলদেটে সাদা, ঠোঁট আর আঙুলের ওপর নীলচে ছোপ, মনিটরে করাতের দাঁতের মতন হৃদস্পন্দনের এলোমেলো রেখা--এরা সবাই আসন্ন মৃত্যুর সংকেত। এই অবস্থা থেকেও রোগীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব কিন্তু অ্যারনের উইলে পরিষ্কার নিষেধ আছে--কোনো অবস্থাতেই যেন কৃত্রিম উপায়ে তাঁর হৃদপিণ্ড বা শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করা না হয়। কয়েক ঘন্টা পরে ব্রিটানি যখন আসবে, অ্যারন তখন অন্য দুনিয়ায়। ভাগ্যদেবতা ওদের দেখা হওয়া বানচাল করেই দিলেন শেষ পর্যন্ত।

কিন্তু অনুপমা এই মুহূর্তে কারোর মাথা মানতে তৈরি নন। আইন, ওপরওয়ালা, ভাগ্য বা ভগবান কেউ ওঁকে আটকাতে পারবে না। দ্রুত অভ্যস্ত হাতে ডিফিব্রিলেটর তুলে নিয়ে অ্যারনের বুকে শক দিলেন পর পর তিনবার। মনিটরে করাতের দাঁতের মতন অস্বাভাবিক দ্রুত স্পন্দন বদলে সোজা একটা লাইন হয়ে গেল। তারপর ফুটে উঠল ক্ষীণ কিন্তু স্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের রেখা। রোগীর শিরায় কয়েকটা ওষুধ ঢুকিয়ে দিলেন অনুপমা, তারপর মুখ হাঁ করিয়ে গলার মধ্যে চালান করে দিলেন এন্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব। পর পর কয়েকটা নি:শ্বাস পুরে দিলেন অ্যারনের ফুসফুসে। তারপর টিউবটাকে ভেন্টিলেটর যন্ত্রের সঙ্গে লাগিয়ে নিশ্চিন্ত হবার একটা শব্দ করলেন উনি। পুরো সময়টা ঘরের মধ্যে অবিশ্বাস, বিস্ময় আর আশংকা মেশানো একটা কোলাহল চলছিল, অনুপমা মুখ তুলতেই প্রশ্নের তীরগুলো একসাথে বিঁধে গেল সেখানে।

‘একি করলেন?’

‘আপনি পেশেন্টের ইচ্ছা না মেনে এটা করতে পারেন না! এটা বেআইনি।’

‘ডক্টর রয় আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে। এর ফলে আপনার চাকরি যেতে পারে।’

‘এবার কেলেংকারি হলো। পেশেন্টের ফ্যামিলি নির্ঘাৎ মামলা করবে।’

অনুপমা এসব কিচ্ছু শুনছেন না। ওঁর একহাতে ফোন, অন্যহাত দিয়ে ওষুধের আলমারি হাতড়াচ্ছেন এখন।

‘হ্যালো ব্রিটানি। এক্ষুনি হাসপাতালে চলে এসো। মানে এই মুহূর্তে।’

অ্যারন আবার চোখ তুলে তাকিয়েছেন। অনুপমা ওঁর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন।

‘অ্যারন আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন। আমি আপনার উইল অমান্য করেছি। আধ ঘন্টার মধ্যে ব্রিটানি চলে আসবে, তারপর আপনি চাইলে আমি ভেন্টিলেটর বন্ধ করে দেবো। ঠিক আছে?’

‘অ্যারনের মাথা নড়ে উঠলো, আধখোলা চোখে যেন একটা হাসির ঝিলিক। অনুপমা জানেন হাসপাতালের আইন অনুসারে ভেন্টিলেটর বন্ধ করে দেওয়া অতটা সহজ না, অ্যারনের বাড়ির লোকদের খবর দিতে হবে। তারা এমনিতেই অনুপমার ওপর হাড়ে চটে আছে, এ সুযোগ হাতছাড়া করবে না।

ওই তো দরজায় দাঁড়িয়ে ব্রিটানি আর ওর ছেলে! মৃত্যুর গন্ধ মাখানো ধূসর দেওয়ালের ওপরে বেপরোয়া যৌবনের ছবি এঁকে দিয়েছে ওদের নিটোল শরীরের রেখাগুলো। এক দৌড়ে ওদের কাছে পৌঁছে গেলেন অনুপমা। হাত ধরে ওকে সোজা টেনে নিয়ে এলেন অ্যারনের ঘরে।

‘ব্রিটানি ও মারা যাচ্ছে। তোমরা দেখা করে নাও, তারপর আমি ওর ভেন্টিলেটর বন্ধ করে দেবো।’

‘অ্যারন, আমি ব্রিটানি। এই দেখো তোমার ছেলে। আমরা সারা জীবন তোমাকে ভালোবাসবো অ্যারন।’

অ্যারন পিটারসন পুরো চোখ খুলে ওদের দিকে তাকালেন। টিউবের জন্য হাসিটা মুখে দেখা গেল না কিন্তু দুচোখ বেয়ে হাসি উপছে পড়লো সারা ঘরে, ঠাণ্ডা আর নীল আঙুলগুলো মিশে গেল ওদের তাজা হাতের গোলাপী উষ্ণতায়। অনুপমা দেখতে পেলেন অ্যারনের খোলা চোখদুটো খুব আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসছে, ছোটরা যেভাবে ঘুমিয়ে পড়ে। ‘এই মাহেন্দ্রক্ষণ,’ মনে মনে ভাবলেন উনি। আলতো চাপে ভেন্টিলেটর মেশিনটা বন্ধ করে দিয়ে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। অনেক জবাবদিহি, অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে এখন। সেসব তো আছেই, তার আগে সৌভিককে ফোন করে বলতে হবে সব কথা। এত অসহ্য আনন্দের প্রসাদ ভাগ করে না খেলে নষ্ট হয়ে যায় যদি।



(পরবাস-৬৫, ডিসেম্বর ২০১৬)