আজকাল আমরা ক্যানসারের খবর সবসময় শুনছি। সারা পৃথিবীতে, সমস্ত দেশে এই রোগের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। ফুসফুস, যকৃত, অন্ত্র, স্তন, জরায়ুর ক্যানসার তো খুবই ব্যাপক। এসব শুনে স্বভাবত:ই মনে প্রশ্ন জাগে এসব কী আধুনিক যুগের প্রভাব না পুরনো যুগেও ছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে তাকাতে হবে পিছন ফিরে অনেক দূরে। ঐতিহাসিক ও প্রাগৈতিহাসিক ছবি, লেখা, স্থাপত্যকলা ইত্যাদি থেকে কিছু তথ্য জানা যায়। অতি পুরাকালীন দেহাবশেষ (মমি ও হাড়গোড়) থেকেও অনেক চিহ্ন পরীক্ষা করা হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে আমি ব্রেস্ট (স্তন) ক্যানসার সম্বন্ধেই লিখছি— কারণ এটা এক অন্যতম ব্যাপক ক্যানসার সারা পৃথিবীতেই।
প্রথমত: পুরাকালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে ক্যানসার বলে কোনো ধারণাই ছিল না। যে কোনো দেহাংশ ফুলে উঠলেই তাকে ক্যানসার টিউমার ইত্যাদি বলা হত। তাই লিখিত বিবরণী থেকে ঠিক অনুমান করা সহজ নয়। অনেক ফোঁড়া, সাধারণ Cyst বা ঘা (wear) ক্যানসার নামে চিহ্নিত। ভারতীয় আয়ুর্বেদে “অর্বুদ” নামটি ক্যানসার জাতীয় রোগের উপসর্গ বলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুই নিশ্চিত চিহ্ন নয়। সে সব যুগে কাটা ছেঁড়া হত না বলে শুধু বাইরের লক্ষণই বিবৃত হয়েছে। দেহের ভেতরে কোনো ক্যানসারের বিবরণ নেই।
“ক্যানসার” নামটি দিয়েছিলেন বিখ্যাত প্রাচীন গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটাস (৪০০-৩৭৮ খৃ. পূ.)। নামটি Karkinos থেকে নেওয়া। গ্রীক ভাষায় এর মানে কাঁকড়া। কাঁকড়ার দাঁড়াগুলি যেমন আঁকড়ে ধরে শিকারকে, সেই রকমই ক্যানসারের থাবা সুস্থ শরীরে ঢুকে ছড়িয়ে পড়ে। Karkinos থেকেই Cancer বা কর্কট রোগ। সে যুগে শুধু বাইরের ক্যানসারের (চামড়া, স্তন, মুখ ইত্যাদি) ইতিহাসই লেখা ছিল। সব থেকে প্রাচীন ক্যানসার বিবরণী আমরা পাই ফারাওদের যুগের মিশরীয় প্যাপাইরাসে লেখা ইতিহাস থেকে। ঐতিহাসিকরা হায়রোগ্লিফিক থেকে অনুবাদ করেছেন এমন অনেক অসুখ বিসুখের মধ্যে আমরা পাই আটটি স্তনরোগের খবর--যা ক্যানসারের উপসর্গের সঙ্গে খুব মেলে। প্রতিরোধ হিসাবে গরম শলাকা দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার উপদেশ আছে। এই-ই ক্যানসারের সবচেয়ে প্রাচীন ইতিহাস।
লেখালেখি ছাড়াও দ্বিতীয় পদ্ধতি হল সোজাসুজি প্রাচীন দেহাবশেষ পরীক্ষা। মিশরে, দক্ষিণ আমেরিকায় চিলে ও পেরুতে এবং অন্যান্য দেশ থেকেও শতশত মমি ও অস্থি পরীক্ষা করা হয়েছে--অনেক রোগের চিহ্ন পাওয়া গেছে কিন্তু ক্যানসারের চিহ্ন খুবই কম। হয়ত পুরনো জমানায় ক্যানসার সত্যিই এত ব্যাপক ছিল না। কিন্তু এ-ও সম্ভব যে (১) মমি ও অস্থিতে শরীরের ভেতরের অংশ এতই শুকনো যে কোনো পরীক্ষা সম্ভব নয়--তাই দেহের ভেতরে ক্যানসার ছিল কিনা জানার উপায় নেই; (২) সে যুগে মানুষের আয়ু ছিল ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত। আমরা জানি যে বেশিরভাগ ক্যানসারই বুড়ো বয়সে হয় (৫০-বছরের উপর)। তাই হয়ত ক্যানসার হবার মতো বয়সই হয়নি সে যুগে; (৩) আধুনিক কালের পরিবেশ দূষণ ও নানা কৃত্রিম রাসায়ানিক পদার্থের ব্যবহারও অনেক ক্যানসার বাড়িয়ে তোলে, সে যুগে এসব জিনিষের চল ছিল না তাই সত্যিই ক্যানসারের হার কম ছিল। সঠিক উত্তর জানতে হলে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
এখানে সেখানে ক্যানসারের বিবরণ আমরা সব দেশের ইতিহাসেই পাই। কিন্তু চীন, ইউনানী, ও আয়ুর্বেদ সম্বন্ধে আমার জ্ঞান নেই বললেই চলে। তাই ঐ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রইলাম। এবার পশ্চিমী চিকিৎসা ইতিহাসে ব্রেস্ট ক্যানসার সম্বন্ধেই কিছু উল্লেখ করি।
ব্রেস্ট ক্যানসার রোগিনীর প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ পাই বিখ্যাত ইতিহাসবিদ্ হেরোডেটাসের লেখায়। রোগিনীও বিখ্যাত--৫২০ খ্রিঃ পূর্বে পারস্য সম্রাজ্ঞী আটোসা ছিলেন প্রবল প্রতাপান্বিতা। তিনি বীর দারিয়ুসের পত্নী, সাইরাস দি গ্রেট-এর কন্যা ও দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাট শের শেস-এর মা ছিলেন। তাঁর স্তনে ছিল একটি বিরাট পূঁজরস ভরা ঘা। সেটার পরিচর্যা ও চিকিৎসার জন্য রাজ্যের সেরা চিকিৎসকরা দৈনিক নানা ওষুধের লেপন করতেন। কিন্তু সেটা কোনো মতেই সেরে উঠল না। অথচ রানিও বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেঁচে রইলেন। হয়তো ঘা-টি ক্যানসার ছিল না, অন্য কোনো benign টিউমার ছিল— তার উত্তর ইতিহাসে নেই।
এরপর পশ্চিমী ইতিহাসে আবির্ভাব হলেন গ্যালেন (130-200 AD)। এই রোমান চিকিৎসক সব অস্বাভাবিক ফুলে-ওঠা ফোঁড়া থেকে ক্যানসার পর্যন্ত— Preturnatural বা অতি অস্বাভাবিক বলে মনে করতেন। তাঁর শিক্ষা প্রথম খৃষ্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিঃ রেনেশাঁসের সময় পর্যন্ত চলেছিল। ইয়োরোপের এই সময়টা ছিল অন্ধকার যুগ--dark ages। কোনো নতুন ভাবনার উদয় হয়নি--শুধু ধার্মিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল গোটা মহাদেশ।
এই সময় নতুন বিজ্ঞান ও ধারণার শিখা জ্বলেছিল মধ্য প্রাচ্যে। মুসলমান বিজ্ঞানী অভিসেনা (ইবন-ই-সেনা) (৯৮০-১০৩৭ খ্রিঃ) এক বিরাট সংকলন লিখেছিলেন--তাতে অনেক রোগের এবং খাদ্যনালীর (esophagus) ক্যানসারের উল্লেখ আছে। এই ক্যানসারও এখনও মধ্য প্রাচ্যে ব্যাপক।
ইউরোপে তখন ধর্মীয় কুসংস্কারের অন্ধযুগ চলছে। তৃতীয় শতাব্দীতে আমরা দেখি সেন্ট আগাথার আবির্ভাব। ধার্মিক পূজারিণী আগাথা ছিলেন অতুল সুন্দরী। রোমান সম্রাট কুইনটিনিয়ান তাঁর প্রেমপার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু আগাথা তাঁকে ফিরিয়ে দেন। ক্রুদ্ধ সম্রাট আগাথার দুই স্তন কেটে ফেলার আদেশ দেন। কিন্তু সেই রাতেই মৃত্যুর আগে ভগবানের দয়ায় দুই স্তনই আবার জোড়া লেগে যায়। এই মিরাকলের জন্যই তাঁকে সেন্ট উপাধি দেওয়া হয়। সেন্ট আগাথা স্তনের সব রোগব্যাধির ত্রাণকর্ত্রী। ছবিতে তিনি দুই স্তন ভগবানকে উৎসর্গ করেছেন।
নতুন হাওয়া এল রেনেশাঁসের সময়। রেনেশাঁসের এক প্রধান শিল্পী রেম ব্রাঁর (১৬০৬-১৬৬৯ খ্রিঃ) একটি ছবিতে আশ্চর্যজনক ভাবে ব্রেস্ট ক্যানসারের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। স্নানরত বাথশিবার পেন্টিংটি বিখ্যাত। কিন্তু আর্টের জন্যই। সম্প্রতি (১৯৬৭) T. C. Greco নামী এক ইটালীয়ান সার্জন ছুটিতে মিউজিয়ামে ঘুরতে ঘুরতে এই ছবিটি দেখেন ও ডাক্তারি নজরে লক্ষ্য করেন যে স্নানরতা মহিলার বাঁ স্তনটিতে ডেলা মতো জায়গা ফোলা। সেই সঙ্গে বাঁ বগলেও কিছু ফোলা অংশ শিল্পী নিখুঁত ভাবে এঁকেছেন। মহিলা তখন রেমব্রাঁর রক্ষিতা ছিলেন, পরে স্ত্রী হয়েছিলেন। মডেলের সময় তাঁর বয়স ছিল ২৯। ব্রেস্ট ক্যানসারের পক্ষে খুবই কম বয়স কিন্তু অসম্ভব নয়। আরও একটি তথ্য যে মহিলা ৯ বছর পরেই মারা যান--বলা হয় রুগ্নতা ও দুর্বলতার জন্য। সে কালে যক্ষ্মা খুবই ব্যাপক ছিল। তা-ও হতে পারে। আবার সমস্ত শরীরে ছড়ানো ক্যানসারও রোগীকে দুর্বল ও রুগ্ন করে দিতে পারে। আসল উত্তর অজানাই রইল।
যুগ যুগ ধরে ক্যানসারের কারণ হিসেবে নানা মত, নানা থিওরির প্রকাশ হয়েছে। ভগবানের রোষ থেকে আয়ুর্বেদের “দোষ” (কফ, পিত্ত, ইত্যাদি) এবং আরও অনেক কিছু। সঠিক কারণ আমরা কিছুটা জানি কিন্তু অনেকটাই এখনও অজানা রয়ে গেছে। ইদানীং ব্রেস্ট ক্যানসার সম্পর্কে জেনেটিক কারণ, হর্মোনের আতিশয্য ইত্যাদি জানা গেছে। অনেকেই আবার ইম্যুনিটি, ডায়েট ইত্যাদিতেও বিশ্বাস করেন।
ব্রেস্ট ক্যানসারের চিকিৎসাও বিজ্ঞান ও বিশ্বাস অনুযায়ী যুগে যুগে বদলেছে। মিশরীয় ফারাওদের সময় গরম শলাকা দিয়ে পোড়ানো হত। লতাপাতার নির্যাস, তুকতাক ইত্যাদি সবদেশেই ছিল। আফিম, ক্যাস্টর অয়েল, সালফার এমনকি বিষাক্ত আর্সেনিকেরও প্রয়োগ হয়েছিল। শিরা কেটে রক্তপাত ও জোঁক দিয়ে রক্ত শুষে নেওয়া--অনেক অসুখেরই জনপ্রিয় চিকিৎসা ছিল।
আধুনিক চিকিৎসা হল সার্জারি। কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত অ্যানাসথেসিয়ার বা অচেতন করার প্রক্রিয়া দরকার। বিনা অ্যানাস্থেসিয়ায় স্তনচ্ছেদ মারাত্মক অপারেশন। অনেক রোগিনী টেবিলেই মারা যেতেন। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ ও প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ডাক্তাররা নানারকম সার্জারিতে হাত পাকান। ঐ সময় অ্যানাসথেসিয়া, ব্লাড ব্যাংক ইত্যাদিরও আবিষ্কার হয়। পরে অ্যান্টিবায়োটিক ও সাধারণ স্বাস্থ্যনীতির (যেমন পরিষ্কার যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ডাক্তারের হাত ধোওয়া ইত্যাদি) চল শুরু হওয়ায় কঠিন অপারেশনও নিরাপদ হয়ে ওঠে। অপারেশনের পরে সংক্রামক রোগের হারও অনেক কমে যায়।
অপারেশন করে ক্যানসার সুদ্ধ স্তনচ্ছেদ শুরু হয় উনিশশ’ শতাব্দীর গোড়ার সময় থেকে। জনস্ হপকিনস্ হাসপাতালের Halsted ছিলেন এইরকম সার্জারির প্রধান হোতা। ১৯৬০-৭০ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রথানুযায়ী এই সার্জারি করা হত। সমস্ত স্তন, নিচের বুকের পেশী, বগলের মাংস সব কেটে ফেলা হত। ক্যানসার নির্মূল হলেও রোগিনীদের সার্জারির পর বড় ব্যথা ও কষ্ট সহ্য করতে হত। অনেকের হাত ফুলে যেত। ১৯৮০-র পর থেকে এই প্রথার 'radical' সার্জারি আর করা হয় না।
রেডিয়েশন আরেকটি ক্যানসার-নাশক চিকিৎসা। এর শুরু হয়েছিল ১৮৯৫ সালে, জার্মানীতে X-ray আবিষ্কারের সঙ্গে। প্রথম প্রথম অনেক বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা রেডিয়েশনের প্রভাবে পড়ে লিউকিমিয়া ও অন্যান্য রোগের শিকার হয়েছেন। এখন চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক নিরাপদ।
ক্যানসার চিকিৎসার তৃতীয় স্তম্ভ হল কিমোথেরাপি। নানা রকমের ক্যানসার চিকিৎসায় কিমোথেরাপি অপরিহার্য। এর-ও আবিষ্কার প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই। Biological weapon হিসাবে বিশ্বযুদ্ধে মাস্টার্ড গ্যাস ব্যবহার করা হয়। কয়েকজন বিজ্ঞানী লক্ষ্য করেন যে ঐ গ্যাসের প্রভাবে রক্তে শ্বেতকণিকার (white cell) সংখ্যা খুব কমে যায়। তক্ষুনি তাঁরা লিউকিমিয়ার রোগীদের ওপর পরীক্ষা শুরু করেন এবং অচিরেই অন্যান্য ক্যানসারেও সুফল দেখা যায়।
ব্রেস্ট ক্যানসারে হর্মোনের প্রভাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৯৬ সালে একজন স্কটিশ ডাক্তার Beatson লক্ষ্য করেন যে কোনো কারণে ওভারি কাটা হলে স্তনের ক্যানসারের বাড় কমে যায় ও অন্যান্য উপসর্গেরও অনেক আরাম পাওয়া যায়। মেয়ো ক্লিনিকে এই নিয়ে গবেষণা চলেছিল। ওভারি ছাড়াও অন্য হর্মোন গ্ল্যান্ডগুলি কেটে ফেললেও সাময়িক উপশম হয়। ১৯৬২ সালে Tamoxifen আবিষ্কার হয়— এটা প্রথম স্ত্রী হর্মোন নিরোধক ওষুধ (anti-estrogen) রোগিনীদের সুস্থ ও জীবিত রাখতে এই ওষুধের জরুরি দরকার। ইদানীং অনেক নতুন ওষুধ বেরিয়েছে যেগুলি Tamoxifen-এর চেয়েও বেশি কার্যকরী এবং তাদের পার্শ্বপ্রভাব (side effect)-ও কম।
স্তন ও অন্যান্য ক্যানসারের চিকিৎসা ও প্রতিরোধের একটি প্রধান ধারণা যে যত তাড়াতাড়ি ক্যানসার ধরা যাবে ততই চিকিৎসার সুফল হবে। (এটা সবক্ষেত্রে সত্য না-ও হতে পারে)। তাড়াতাড়ি ক্যানসার ধরার জন্য অন্যতম টেস্ট--ম্যামোগ্রাফি। যা আজকাল সব মহিলাদের পরিচিত। এই ম্যামোগ্রাফির আবিষ্কার হয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ১৮৯৬ সালে। কিছু জার্মান বিজ্ঞানী কাটা স্তনগুলি X-ray করতে গিয়ে দেখেন যে ক্যানসার গুলোও বেশ দেখা যায়। সেই থেকে শুরু বার্ষিক ম্যামোগ্রাফি--অত্যন্ত ছোট ক্যানসারও ধরা পড়ে X-ray মেশিনে এবং ছোট অবস্থায় থাকার দরুণ ছোট সার্জারিতেই কাজ চলে যায় আর রোগীও সুস্থ দীর্ঘায়ু বেঁচে থাকতে পারেন। ১৯৬০ সালে M. D. Anderson ক্যান্সার হাসপাতালে পাকাপাকিভাবে এর চল শুরু হয়।
ক্যানসার ছোট, বড়, ধনী, দরিদ্র, জাত কুলের ধার ধারে না। অনেক বিখ্যাত, ধনী, প্রভাবশালী মহিলা ক্যানসারের শিকার হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের নিজেদের খ্যাতি ও প্রভাব দিয়ে ব্রেস্ট ক্যানসারের ওপর সরকারী দৃষ্টি পাতে সাহায্য করেছেন ও পয়সা দিয়ে রিসার্চের পথ প্রশস্ত করেছেন। কয়েকজন বিখ্যাত রোগিনীদের নাম হল
—সম্রাজ্ঞী থিরোডোরা--কনস্ট্যানটিনোপলের সম্রাট জাসটিনিয়ানের স্ত্রী; ৫২৭-খ্রিঃ; প্রথম ক্যানসার বর্ণনা
—অস্ট্রিয়ার রানি অ্যান; ১৬৬৩ খ্রিঃ; ইনি ফ্রান্সের রাজা অষ্টাদশ লুই-ইয়ের মা।
—আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের মা মেরী ওয়াশিংটন; ১৭৪৯ খ্রিঃ
—আর এক প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডাম্সের কন্যা অ্যাবিগেল অ্যাডাম্স; শয়নকক্ষে অজ্ঞান না-করেই তাঁর উপর সার্জারি হয়েছিল; ২ বছর পর মারা যান।
—হাওয়াই-এর রানি--কাপিয়ালানি; ১৮৯১ খ্রিঃ
—আমেরিকান লেখক হেনরি জেম্স-এর বোন অ্যালিস জেম্স। ভদ্রমহিলার নাকি ভীষণ অসুখ-বাতিক ছিল। স্পষ্ট ক্যানসার রোগ ধরা পড়তে উনি নাকি খুশিই হয়েছিলেন।
ক্লারা হিটলার। কুখ্যাত ও অতি পরিচিত অ্যাডলফ্ হিটলারের মা। ১৯০৫ সাল। ক্যানসারের ব্যথায় ভীষণ কষ্ট পেতেন ও তাঁর চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন এক ইহুদী ডাক্তার খোলা ঘায়ের ওপর আয়োডিন-এর মলম লাগাতেন। ওষুধের জ্বালায় মহিলা ছটফট করতেন। অ্যাডলফকেও প্রতিদিন মায়ের যন্ত্রণা সইতে হত। হয়ত তখন থেকেই ঐ ইহুদী ডাক্তার (ও সব ইহুদীদের ওপর) বিরূপ মনোভাবের জন্ম হয়েছিল যার নমুনা আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যথেষ্ট পেয়েছি। ক্লারার ক্যানসার না হলে হয়ত ইতিহাসের মোড় অন্যদিকে ঘুরত।
—অভিনেত্রী শার্লি টেম্পল। বেটি ডেভিস, ইনগ্রিড বার্গম্যান, অলিভিয়া নিউটন-জন; ১৯৯২ খ্রিঃ
—প্রেসিডেন্ট পত্নী বেটি ফোর্ড, ন্যানসি রেগান; ১৯৮৭ খ্রিঃ
—প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের মা ভার্জিনিয়া ক্লিনটন (১৯৭৪), সুপ্রীম কোর্ট জজ স্যানড্রা ডে ও'কনর, রন্ধনশিল্পী জুলিয়া চাইল্ড, ফেমিনিষ্ট গ্লোরিয়া স্টাইনেস, আইস স্কেটার পেগি ফ্লেমিং এবং আরও অনেক। কয়েকজন রোগী অন্যদের জীবন সহজ করার চেষ্টায় বিখ্যাত হয়েছেন--টেরিসা লাসের--প্রথম ব্রেস্ট ক্যানসার সাপোর্ট গ্রুপ শুরু করেন। মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং এর ডাক্তাররা তাঁর হেনস্থা করতেন কিন্তু ১৯৫২ সালে আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি থেকে স্বীকৃতি পান।
—রুথ হ্যান্ডলার--বার্বি-ডল নির্মাতা--১৯৭০ সালে ক্যানসার হওয়ার পর Nearly Me নামক সিলিকন ব্রেস্ট prosthesis তৈরি করেন। এখন সার্জারির পর সবাই এইরকম সিলিকন ব্রেস্ট ব্যবহার করেন।
এইভাবেই বিজ্ঞান এগিয়ে চলে। অতীতের সাফল্যের উপর ভর দিয়ে ভবিষ্যতের আবিষ্কারের কাজ শুরু হয়। ব্রেস্ট ক্যানসার চিকিৎসাও অনেক রোগিনীর ব্যথা, যন্ত্রণা, ব্যর্থতা ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আজকের সার্জারি, রেডিয়েশন ও কিমোথেরাপির সুফল লাভ করছে। অতীতের সব রোগিনী ও চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা আমাদের কৃতজ্ঞতার যোগ্য।
গ্রন্থতালিকা
—History of Breast Cancer--A. Mondal
(www.news-medical.net/health/History-Of-Breast-Cancer.aspx)
—History of Pathology--E. R. Long; 1928
—Bathsheba’s Breast--J.S Olsen; 2002
(পরবাস-৬৫, ডিসেম্বর ২০১৬)
অলংকরণঃ সবগুলিই গুগ্ল 'ওপেন অ্যাক্সেস' থেকে নেয়া