প্রথম কালবৈশাখী। বৃষ্টি এল। সোঁদা গন্ধে চলকে যাচ্ছে প্রাণ। আর তার সঙ্গে আরো কীসের যেন একটা গন্ধ উঠছে। ভালোবাসার কি কোনো গন্ধ হয়? অনুরাধা কিন্তু ভালোবাসার গন্ধ পায়। আর সেই পাওয়াকে অশেষ করে সে বাঁচতে চায়।
আবার বাঁচবে বলেই তো দেবব্রতর হাতে হাত রেখেছিল অনুরাধা। আর কী বা করতে পারত সে? শুধু তো নিজের জীবনই নয়। আরো একটা ছোট্ট প্রাণ ছিল তারই মুখাপেক্ষী। প্রতি মুহূর্তে তার কানে বাজত প্রশ্নটা—
—আমাকে তুই আনবি তো মা?
বারবার মনের কোন গহিন থেকে উঠে আসতে চাইছিল এই ডাকটা। তীব্র সে আহ্বান। কেমন করে উপেক্ষা করবে সে? সে তো পলাশের মত নির্দ্ধিধায় বলতে পারে না,
—ওকে না আনলেই কি নয় রাধা? জানো তো আমাদের সমাজ এখনও এসব মেনে নেবার জন্য প্রস্তুত নয়!
—কি বলছ পলাশ? সমাজের ভয়ে একটা ফুলের মত প্রাণ নষ্ট করব?
—কেন বুঝতে চাইছ না রাধা, আমারও বাড়ি আছে, আত্নীয়স্বজন আছে। নমাস পরে কী জবাব দেব বলতে পারো?
—জবাব তো তোমার অজানা নয় পলাশ।
—সেটা তো প্রমাণ করা যাবে না রাধা।
—এটা একবিংশ শতাব্দী পলাশ। কোনো প্রমাণের দায় তোমার নেই। চলি।
সেদিন এক ঝটকায় নিজেকে ফিরিয়ে এনেছিল অনুরাধা। কানে বাজছিল পলাশের কাতর আহ্বান—
—শোনো রাধা, এভাবে চলে যেও ...
না, আর ফিরে তাকায়নি অনুরাধা। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সন্তান তার। তাকে সে আনবেই।
পদ্মপাতায় সূর্যকে ঠিকরে দেয় ভালোবাসা, প্রতিটি ক্ষণে প্রতিটি মুহূর্তে। অথচ টলমল করে অবহেলায় অবমাননায়। তবুও বাঁচার প্রবল তৃষ্ণায় চিৎকার করে ওঠে অনুরাধা—
—বাঁচতে চাই—ই—ই......
প্রতিদিন একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল তার গর্ভের আধার। আর সে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল একটা হাত, যে তার কাঁধ স্পর্শ করে থাকবে। হাত ছোঁয়ানো দূরত্বে থাকা পুরু ঠোঁটে বলিষ্ঠ উচ্চারণ উঠে আসবে—
—ভয় নেই রাধা, আমি আছি তোমার পাশে।
শুধু এইটুকু। এই আশ্বাস এই নির্ভরতার খোঁজে দিশেহারা হয়ে গেছিল অনুরাধা। মা নেই বাবা নেই। মামা মামী হস্টেলে রেখে মানুষ করেছেন। চাকরি পাবার পর সে স্বাধীন। সর্বতোভাবেই স্বাধীন। অথচ সেই মুহূর্তগুলোয় সে একটা পরুষবাহুর অধীনতা কামনা করেছিল। তাকে বুকের মধ্যে পিষে ফেলতে ফেলতে যে বলবে —
—তোমার সবটুকু নিয়েই তুমি আমার অনুরাধা।
ভোরবেলা স্নান সেরে সরু পাড়ের সাদা শাড়ি পরলেন মনোরমা। আজ ভোরবেলায় একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেল। সেই থেকে মনটা ভার ভার হয়ে আছে। ভিজে চুলটা পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে ঠাকুরঘরে ঢুকতেই হেসে উঠলেন অবিনাশ রায় —
—কেমন আছো রমা?
—জানি না যাও।
—মন খারাপ?
প্রথম ঝঙ্কারে সমস্ত অভিমান ঝরে পড়তেই ঠাকুরঘরের এককোণে ঝুলে থাকা ফটোর দিকে চোখ রাখলেন মনোরমা। চিকচিক করে উঠল চোখের কোণটা—
—আমাকে ফেলে একা একা চলে গেলে। কার কাছে রেখে গেলে তোমার রমাকে?
—কেন রমা, তোমার ছেলে, তোমার বউমা আর ওই ফুলের মত মিষ্টি মণি তোমাকে তো ঘিরে আছে।
—দেবু আমারই ছিল গো, বড্ড কাছের। কিন্তু এখনও কি সে আমার আছে? বলো?
—ছেলে বড় হলে শেয়ার করতে হয় রমা।
—কার সঙ্গে শেয়ার করতে বলো তুমি? ওই ঢঙি মেয়েটার সঙ্গে? চাকরি করে বলে যেন মাথা কিনে রেখেছে।
—কিন্তু আমি তো দেখি মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতি আর সাদাসিধে।
—তা তো তুমি দেখবেই! কেমন বুদ্ধি করে বসার ঘর থেকে তোমার ফটোটা সরিয়ে ঠাকুরঘরে করে দিল। কেমন বুদ্ধি করে তোমার জন্মদিনে মৃত্যুদিনে একটা করে মালা ঝুলিয়ে দেয় তোমার গলায়। ভালো তো তোমার লাগবেই।
—নিজের দিক থেকে একটু চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকাও রমা। জীবন জটিল তবু জীবনই সত্য।
মনোরমা হাঁপিয়ে ওঠেন। প্রতিদিন অসহ্য বেঁচে থাকা।
—নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য বাঁচো রমা।
—চিরটাকাল এই একটাই মন্ত্র আউড়ে গেলে তুমি।
নিচে থেকে অনুরাধার গলা ভেসে আসে—
—মা আপনার হল?
ঘোর ভেঙে যায় মনোরমার। ঠাকুরঘর থেকেই সাড়া দেন—
—আসছি।
নিচে নামতেই অনুরাধা স্বভাবসিদ্ধ নরম স্বরে বলে,
—মা, আপনার ছেলেকে ব্রেকফাস্টটা রেডি করে দেবেন? আমি তাহলে মণিকে দুধটা খাইয়ে আসি।
—তুমি যাও, আমি দেখছি এদিকটা।
অতদূরে যেও না অনুরাধা...অ...নু...রা...ধা...। নৌকোয় অনুরাধা আর পলাশ কোথায় যাচ্ছে? গোপন ঘনিষ্ঠতার ঘ্রাণ উঠছে......অ...নু...রা...ধা...
ঘুম ভেঙে যায় দেবব্রতর। দেখে অনুরাধা নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। একটা হাতমণির বুকের ওপর আলতো পড়ে আছে। দেবব্রতর বুকের গভীর থেকে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস। পায়ের কাছে জানলা দিয়ে কখন যেন একটুকরো চাঁদ ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে। ঘরের কোণে ঝুলে থাকা অন্ধকার তাকে জায়গা দেয়নি বসতে। মণির কোমল মুখে ছিল বুঝি সরল আহ্বান। তাই তার কাজল ধ্যাবড়ানো অন্ধকার চোখের কোলে পা গুটিয়ে বসেছে চাঁদ। জোছনপরির একমুঠো স্বপ্নে রাঙিয়ে দিয়েছে ফুলের মত মুখটা। মাঝে মাঝে পাতলা ঠোঁটে টুকরো হাসি। ঠাকুমা বলতেন ছোটরা দেয়ালা করে ঈশ্বরের সঙ্গে।
দেবব্রত বিড়বিড় করে ওঠে —
—আমি কি একটু ছুঁয়ে দেবো তোর চোখের পাতা? আমাকে একটু ছুঁতে দিবি ওই চাঁদটা?
চাঁদের গায়ে হাসির আওয়াজ ওঠে —
—এ ফুল তো তোমার নয় দেবব্রত। তুমি তো ওকে ঘৃণা করো
ডুকরে ওঠে দেবব্রত —
—না...না...না...
—তবে?
—ভালোবাসি
—মিথ্যেকথা
—চাঁদের সঙ্গে কেউ মিথ্যে কথা বলে?
একটু একটু করে চাঁদ সরে সরে যায়। এ আলো হারিয়ে ফেলতে চায় না দেবব্রত। সে নিজেকে দেখতে চায় এই আলোতেই। সে বিছানা থেকে আস্তে আস্তে নেমে পড়ে। জানলার গ্রিলে মুখ রেখে চেয়ে থাকে দূরে —
—আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে।
—কোথায় ফিরতে চাও দেবব্রত?
—নিজের কাছে।
—নিজেকে হারালে কোথায়?
—কোথায় কোথায় কোথায়...
অনুরাধা পাশ ফেরে। মণির বুকের ওপর থেকে তার হাতটা সরে যেতেই কেঁদে ওঠে মণি।
ট্যাক্সি...ই...ই
দাঁড়ালো না ট্যাক্সিটা। তাপসীর পাশ দিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে চলে গেল। খুব অস্থির লাগছে। কী যে হবে অনুর! কলকাতা শহরে সময়ে একটা ট্যাক্সি পাওয়া যে কত কঠিন, তা যেন আজকের মত আর কোনোদিন টের পায়নি তাপসী। উত্তেজনায় বেশ খানিকটা রাস্তার ওপরেই এসে পড়েছিল সে এবং প্রবল জোরে ব্রেক কষল লাল এস্টিমটা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ছিটকে পড়ল সে। গাড়ির দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে নেমে এলেন ভদ্রলোক। মুখে একরাশ অপরাধবোধ নিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তাপসীর দিকে —
—আই আম সো সরি। কোথায় লাগল আপনার?
—উঃ, মনে হচ্ছে হাতটাই ভেঙেছে।
—চলুন আপনাকে আগে নার্সিংহোমে নিয়ে যাই।
—কিন্তু কিন্তু...
—কোনো দ্বিধা করবেন নাপ্লিজ। আসুন আমার সঙ্গে।
—কিন্তু ডাক্তারের কাছে আমার চেয়ে অনুর পৌঁছনোটা বেশি দরকারী।
—অনু কে?
—আমার বন্ধু। ওরই জন্য ট্যাক্সি খুঁজছিলাম। কিন্তু...
ইতিমধ্যে গাড়ি ঘিরে ভিড় জমে উঠেছে। এক একজন দর্শকের কাছ থেকে এক একরকম উপদেশ ছুটে আসছে —
—দিদি ক্ষতিপূরণ দাবী করুন।
—গাড়িবান লোকেরা পথচারীদের যেন দেখতেই পায় না।
—লোকটাকে পুলিশে দেওয়া উচিত।
জনতার মন্তব্যে কান না দিয়ে তাপসীর দিকে চেয়ে ভদ্রলোকটি খুব অনায়াসে বললেন,
—যদি আমার দ্বারা আপনাদের কোনো সাহায্য হয়—
বলেই ভদ্রলোক তাপসীর দিকে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালেন। কয়েকটা মুহূর্ত তাপসী চোখ রাখল ভদ্রলোকটির মুখে। সাধারণের ভিড়ে খুঁজে পাবার মত শারীরিক কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। খুব সাধারণ নাক মুখ অথচ চোখের দৃষ্টিতে গভীর মননের ছাপ। দ্বিধা কাটিয়ে তাপসী বলল—
—চলুন তাহলে। দেরি না করে আপনার গাড়িটা ঘুরিয়ে নিন।
হাতটার চিনচিনে যন্ত্রণা উপেক্ষা করে তাপসী পোঁছে গেল গলির মোড়ের লেডিস হস্টেলে। সঙ্গে অচেনা ভদ্রলোকটি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতেই শোনা যাচ্ছে একটা কাতর যন্ত্রণার শব্দ। ঘরে ঢুকেই দৃষ্টি আটকে গেল। সিঙ্গল বেডের বিছানায় ছটফট করছে মেয়েটি। শিশুর জন্মমুহূর্তে মায়ের সাদর কাতরতা।
কয়েকটা মুহূর্ত থমকালেন ভদ্রলোক। তারপর দ্রুত সিদ্ধান্ত। তাপসীর থেকে হস্টেলের ঠিকানা চেয়ে নিয়ে মোবাইলে কাকে যেন আদেশ করলেন এখুনি এম্বুলেন্স নিয়ে চলে আসতে। তাপসী কিছু বোঝার আগেই তিনি বললেন—
—এঁকে তো এখন গাড়িতে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই আমাদের নার্সিংহোমের এম্বুলেন্সকে আসতে বললাম। তাছাড়া আপনার হাতটাও দেখানো দরকার।
—আপনি কি ডাক্তার?
উত্তেজিত কপালের ঘামের সঙ্গেই সলজ্জ হাসির রেখা দেখা গেল ভদ্রলোকটির ঠোঁটে—
—লোকে সেইরকমই বলে বটে!
বৃষ্টিধোয়া ভোরের আলো নামছে নার্সিংহোমের গা বেয়ে। অনুরাধার বাঁদিকে ছোট্টবেডে আলোর কণা। ছোট মুঠি ভরে আকাশ মেখেছে বৃষ্টিকন্যা। ঘুমপরিদের দেশে এক পা রাখা এতোল বেতোল আলোর কণা। ও মা, তুই জাগবি কবে? ঘুমঘোরে তোর বৃষ্টিবাদল আদল ফেরত সকালবেলা।
খুব ধীরে চোখ মেলতেই অনুরাধার চোখ মিলে যায় এক অচেনা মানুষের চোখে,
—এখন কেমন লাগছে অনুরাধা?
কিন্তু উত্তর দেবার মত শক্তিটুকুও জোগাড় করে উঠতে পারে না ক্লান্ত অনুরাধা।নিজের অবস্থানটুকুও আবছা লাগে মাথার ভেতর। চুপ করে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর কিযেন মনে পড়ে যায় তার। খুব আলতো উচ্চারিত হয় কিছু অস্পষ্ট শব্দ—
—আমার সন্তান?
—পাশ ফিরে দেখুন আপনার লালপরি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
অনুরাধা পাশ ফেরে। স্বর্গছেঁড়া এক টুকরো হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ক্লান্ত চোখের কোল।
আরামের নিশ্বাস ফেলে ফিরে যান ডাক্তার দেবব্রত রায়।
ভিজিটিং আওয়ার্সে অনুরাধার পাশে ছোট টুলে এসে বসে তাপসী—
—এবারে কী করবি কিছু ভেবেছিস অনু?
তখনও মাথার ভেতর ঘোর ঘোর ভাবটা কাটেনি। এ প্রশ্নের উত্তর যে জানা নেই অনুরাধার। কী করবে সে এবার? কোথায় যাবে আলোর কণাকে নিয়ে? ভেবে পায় না সে। তাই এড়িয়ে যেতে চায় এই মুহূর্তে —
—তোর হাতের ব্যান্ডেজ কতদিনের রে?
—থ্রি উইক্স।
কথা বলতে বলতেই তাপসী দেখে আবার ঘুমের ঘোর নামছে অনুরাধার চোখে। ডাক্তার বলছিলেন, অনুরাধার রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হয়েছে খুব। দুর্বলতা গ্রাস করেছে শরীরমন। ওকে আর ডিস্টার্ব না করে উঠে পড়ে সে।
অনেকক্ষণ হল ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতেও একটা অচেনা দৃষ্টির স্পর্শ পায় অনুরাধা। অমসৃণ শরীরপথ বেয়ে পায়ে পায়ে। গর্ভের আঙিনা ছুঁয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে বিন্দু বিন্দু জলকণা মিশে যায় নোনাজলে। ঝিনুকের গভীরে দানা বাঁধে তরল মুক্তোরা। জমানো রক্তস্রোত নদী হয়ে হয়ে মিশে যায় সাগরের বুকে।
সঙ্গমের এপারে একটা নৌকো। অনুরাধা আর পলাশ। ভীষণ দুলছে নৌকোটা। পলাশের বুকের কাছে একটা রক্তরং পলাশ। অহঙ্কারী দৃষ্টি নিয়ে কৌতুকে মেতেছে। কী ভয়ঙ্কর মাতালের মত হাসছে ফুলগুলো! নৌকোটা আরো দুলে উঠছে। দুলতে দুলতে কাত হয়ে গেল একদিকে। আর অবলম্বনহীন অনুরাধা নদীর গভীর জলে পড়ে যেতে যেতে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় ভীষণ জোরে চিৎকার করে ওঠে —
—প...লা...শ...
কপালে ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে স্বপ্ন ভেঙে যায় অনুরাধার। ঘোর ঘোর চোখে তাকায় সে—
—আমাকে ছেড়ে যেও না পলাশ...আমি...আমি...
অনুরাধার পাশের টুলে বসে তার কপালে হাত রেখে টেম্পারেচার দেখার চেষ্টা করছিলেন ডাক্তার। আর তাঁরই বাঁ হাতটা স্বপ্নের ঘোরে আঁকড়ে ধরেছে অনুরাধা।
ডাক্তার কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে ডান হাত দিয়ে অনুরাধার হাতটা ছাড়িয়ে দিতে দিতে মৃদু উচ্চারণ করেন—
—আমি আছি, আপনি ঘুমোন।
অনুরাধা আবার তলিয়ে যায় ঘুমে। টুলে বসেই ডাক্তার বহুবার দেখা রিপোর্টগুলো দেখতে থাকেন আবার। অনেক রাতে ধীরে ধীরে ঘোর কেটে আসে অনুরাধার। ঘোরের মধ্যে দেখা সেই মানুষটিকে এখনও বসে থাকতে দেখে মুখে রক্ত ঘনায়। ঠোঁট দুটো নড়ে ওঠে—
—আপনি?
—ডাক্তার দেবব্রত রায়।
চুপ করে কি যেন ভাবে অনুরাধা। ক্লান্ত মাথার ভেতর জটিল স্পন্দন। জটগুলো ছাড়াতে পারেনা যেন। পাশ ফিরে একবার দেখে আলোর কণাকে। তারপর খুব মৃদু উচ্চারিত হয়—
—আমার মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেট...
সহসা কথা যোগায় না ডাক্তারের মুখে। নিচু চোখে চুপকথারা বাসা বাঁধে। কি যেন ভাবেন দেবব্রত। তারপর খুব সহজ ভঙ্গিতে অনুরাধার হাতটাকে আশ্রয় দেন নিজের হাতে। আলতো একটু চাপ দিয়ে বলেন—
—এখন কোনো চিন্তা নয়। শুধু ঘুম। ওকে?
অনুরাধার প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি ডাক্তার। তবু কেন যেন নির্ভরতার হাসি ফোটে অনুরাধার ক্লান্ত চোখে।
বিভোর ডাক্তারের অজান্তেই রোজকার মত ভোর নামে কলকাতার বুকে। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ভোর হয়ে আসা শহর, রাস্তার নৈঃশব্দ্য ডাক্তারের রাতজাগা চোখে নির্জন কুয়াশা নামায়। সারারাত ঘুমন্ত অচেনা মেয়েটির অসংবদ্ধ প্রলাপ কি যেন মায়া ছড়িয়েছে ডাক্তারের বুকের ভেতর। এমন অবেলায় ডাক আসে কেন? কি আছে ওই ডাকে?
অস্থির ডাক্তার জানলা থেকে ফিরে চোখের সামনে অনুরাধার ফাইলটা খুলে চুপ করে বসে থাকেন। উস্কোখুস্কো চুলের ভেতর অন্যমনস্ক আঙুলগুলো কি যেন খেলায় মেতেছে। রাতে বাড়িও ফেরা হয়নি। অবশ্য একজন ডাক্তারের এইরকম পরিস্থিতি কিছু অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এমন অকারণে! যেটা অস্থির করছে তাকে, তা হল, অনুরাধার সচেতনে ফেরার জন্য কেন ডাক্তার দেবব্রত রায়কেই সারারাত অপেক্ষা করতে হয়? এই কাজের জন্য নার্সিংহোমের নির্দিষ্ট জুনিয়ার ডাক্তার আছে। কিন্তু তাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি দেবব্রত। কিন্তু কেন? একটা ব্যাখ্যা খুঁজছেন তিনি। সকালের রাউন্ড শুরু হবার আগেই নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন হয়ত।
মাত্র দুটো রাতের ব্যবধান। হিসেব কষে চলা জীবনটা হঠাৎ টলমল করে উঠল। সিঁড়িভাঙা অঙ্কগুলো ঘুলিয়ে যাচ্ছে। অনুরাধার বন্ধ চোখের পাতায় ও কীসের রহস্য? মৌন মুখর। আঁচ লেগে গেল কি কর্তব্যনিষ্ঠ ডাক্তারের মনে? দুদুটো রাত কেটে গেছে ওই মুখের দিকে চেয়ে। ছকে বাঁধা জীবনটা ওলোটপালোট হয়ে গেছে। বাঁধভাঙা নদীর প্রচণ্ড স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ডাক্তারের সমস্ত দায় দায়িত্ব কর্তব্যের বোঝা। একটা প্রবল ঝড়ের সংকেত টের পাওয়া যাচ্ছে বুকের ভেতর। কে যেন অচেনা ডাক পাঠিয়েছে গভীর স্বরে। রোগ আর রোগীর সঙ্গে বসবাস করতে করতে কখন যে পঁয়ত্রিশটা ভোর ডেকে ডেকে ক্লান্ত পায়ে ফিরে গেছে দেখা হয়ে ওঠেনি। আধো আলো আধো অন্ধকার আজ কি সেই ডাক দিয়ে গেল? এই অবেলায়?
—আসতে পারি?
ডাক্তার দেবব্রত রায়ের রুমের দরজায় তাপসী। অনুরাধার ফাইলে নাকি নিজের মনের কোন অজানা গুহার ভেতর হারিয়ে গেছিলেন দেবব্রত। তাপসীর ডাকে সংবিতে ফেরেন ডাক্তার। ফাইল থেকে চোখ তুললেন। তাপসীকে দেখে মৃদু হাসি ফুটল ঠোঁটে—
—আসতে আজ্ঞা হোক ম্যাডাম।
—অনুরাধাকে কবে ডিসচার্জ করছেন?
—আগে আপনার হাতটা সারুক।
একটু থমকে যায় তাপসী। কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র। তারপরই হো হো করে হেসে ওঠে। মনে পড়ে যায় মুজতবা আলি—
—চিঠি লিখছ না কেন?
—পায়ে ব্যথা!
হাসি থামিয়ে হঠাৎ ডাক্তার প্রশ্ন করলেন—
—পলাশ কে?
চমকে ওঠে তাপসী। ডাক্তারের চোখে চোখ রাখে কয়েক মুহূর্ত। তারপর চোখ নামিয়ে উত্তর দেয়—
—অনুরাধার মেয়ে যার পিতৃপরিচয় বহন করছে।
—বুঝলাম। কিন্তু তাকে তো একদিনও দেখলাম না!
এবার চুপ করে যেতে হয় মুখর তাপসীকে। হাসিমাখা চোখের কোণে টলটল করে ওঠে নোনাজল। তাকে সামলে নিতে একটু সময় দিয়ে ডাক্তার বললেন—
—সম্ভবত পিতৃপরিচয় স্বীকার করার চান্সও আর নেই?
—হুঁ।
—ভাবছিলাম আপনার বান্ধবী যদি মত দেন তো তাঁর মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেটে বাবার নামের জায়গায় দেবব্রত রায়ের নামটা...
প্রবল উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তাপসী। অকূল দরিয়ায় ভাঙা খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মত ডাক্তারের হাত দুটো ধরে ফেলে তাপসী—
—ডাক্তার... আপনি...
কিন্তু গলার কাছে কি যেন আটকে আসে। কথা শেষ করতে পারে না সে। দুচোখ জলে ভরে যায়। সেই প্রাইমারি থেকে স্কুলে একসঙ্গে পড়েছে তারা। তাপসী আর অনুরাধা। একজনকে ছেড়ে অন্যজনকে ভাবাই যেত না। বন্ধুরা বলত লেজুড়। মা—বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত অনুরাধা দুর্গাপুজোর ছুটির সময় তাপসীদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেত তার সঙ্গে। তখন তাদের দেখে মনে হত যেন তারা একই মায়ের গর্ভের ধন। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ক্রমে চাকরি, হস্টেল। একই ঘরের বাসিন্দা হয়েও কেমন করে যেন বন্ধনটা আলগা হয়ে পড়ছিল। কখন কোন ফাঁকে দুই সখির নিবিড় ব্যূহ ভেদ করে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটল, টের পাওয়া গেল না। কিন্তু যখন পেল, তখন জল গড়িয়ে গেছে অনেকটা দূর। অনুরাধা আর পলাশ তখন অনেক গভীরে। রূপসী অনুরাধা প্রেমের গহিন রূপে আর রসে মোহময়ী হয়ে উঠছে। তাপসীর মনের কোণে জমা পড়ছে অভিমান। কোনো ভাষা নেই সে অভিমানের। তবু তার ভার জানান দেয় নিঃশব্দ উপস্থিতি। বেশ কটা বছর পার হতে হতে শান্ত ধীর স্বভাব অনুরাধা কেমন যেন আরো বেশি চুপচাপ হতে শুরু করল। তাপসীর প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার ছল খোঁজে। ক্রমে অনুরাধার চোখের কোলে কালি, পা ভারি হয়ে উঠতে উঠতে ধরা পড়ে গেল অনুরাধা। অথচ সেই পলাশ কেমন করে অস্বীকার করল সমস্ত দায়?
টেবিল ছেড়ে জানলার কাছে উঠে আসেন দেবব্রত। আলো হয়ে ওঠা আকাশের দিকে চেয়ে যেন স্বগতোক্তি করেন—
—আপনার বান্ধবী এখনও জানতেই পারেননি কখন তিনি খুলে দিয়েছেন আমার বন্ধঘরের দরজাটা। আমার বোঝা-না-বোঝা পেরিয়ে...
কোথায় যেন তলিয়ে গেছিল তাপসী। ডাক্তারের কথায় সংবিতে ফেরে। তাকিয়ে দেখে জানলা থেকে এক টুকরো রোদ পড়েছে ডাক্তারের মুখের একপাশে। অন্যমনস্ক তাপসীর স্বর শোনা গেল খুব আবছা ভাবে—
—আপনি...
জানলা থেকে ফিরে দাঁড়িয়ে তাপসীকে থামিয়ে দিলেন ডাক্তার—
—একটু দাঁড়ান। আমরা কিন্তু অনেকদূর স্বপ্ন দেখে ফেলছি খোদ মালিকের বিনা অনুমতিতে। আপনার বান্ধবীর পছন্দ হবে কেন এই বুড়ো ডাক্তারকে?
—আপনি বুড়ো?
—তা আপনাদের চেয়ে বছর আট দশেকের বড়তো বটেই।
চোখে জল নিয়েও হেসে ফেলে তাপসী।
দুপুরের চড়া রোদের একফালি ঘরের জানলা গলে মনোরমার বিছানায় লুটোপুটি। জানলার বাইরে কাঠচাঁপা গাছের ছায়া ঘরের মধ্যে তৈরি করছে আলোছায়ার সরণি। বালিশের একদিকে একটু হেলানো মাথা। সাদা কালোয় মেশা খোলা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে বালিশের গায়ে। যেন বা কিছু মায়া আর মমতার দীর্ঘ বন্ধন, মাথার তেলের সঙ্গে, মনোরমার দেহনিঃসৃত বহদিনের বহুস্মৃতির সঙ্গে। বন্ধ চোখ। চোখের পাতায় তিরতিরে কাঁপন। বাঁহাতটা বুকের কাছে এলানো। ডানহাতের মুঠিতে আজকের আনন্দবাজার।
সারাদিন সংসারের নানা টুকিটাকি কাজ সারতে সারতেই ঘড়ির কাঁটা একটার ঘর ছুঁইছুঁই। দুপুরের ভাত পেটে পড়তে না পড়তেই পেনসেন চাওয়া শরীরটায় বিছানার আকুতি। তবু রোজই বিছানা নেওয়ার আগে খবরের কাগজটা নিতে ভোলেন না মনোরমা। যদিও ওই নেওয়াটাই সার। রোজই আ ন দন্ত ন য়ে দ য়ে পড়তে পড়তেই চোখের পাতা দুটো নেমে আসে চোখের কোলে। মাথাটা টলে যায় বালিশের প্রান্তে।
ঘুমের মধ্যে হঠাৎ খাড়া হয়ে বিছানায় বসলেন মনোরমা—
—কলিং বেল বাজল কি? এই অসময়ে কে এল? নাকি ভুল শুনলাম?
আরো একবার কলিং বেল শোনার অপেক্ষায় বিছানায় বসে রইলেন মনোরমা। জানলায় বসা রোদের দিকে তাকাতেই চোখাচুখি হয়ে গেল। অবিনাশ রায়। মাথার সামনেটায় ইন্দ্রলুপ্তির আভাস। পুরু ঠোঁট। হাই পাওয়ারের চশমা ভেদ করে দেখা যায় দুচোখের গভীর দৃষ্টি,
—এতদিনেও ছেলের বিয়ে দিতে পারলে না রমা? দরজা খোলার একটা লোক অন্ততঃ থাকত।
রোদের ঝাঁঝ মাথার মধ্যে একটা অস্পষ্ট ঘোর নামাচ্ছে। কাঠচাঁপার মৃদু গন্ধ একা হয়ে যাওয়া মানুষটার ভেতর অভিমানের ঢেউ তুলছে,
—দরজা খোলার জন্য দরোয়ান রাখলেই হয়, ছেলের বউ আনার কি প্রয়োজন? আমাকেও বুঝি ওই জন্যই এনেছিলে?
—আহ্ রমা, বুড়ো হয়ে তোমার শরীরটার মতই রসিকতা বোধের পাতাগুলোও ঝরে যাচ্ছে।
—যাক গে। সে পাতা তো আর তোমায় কুড়োতে হচ্ছে না। তুমি নাকে সর্ষের তেল দিয়ে আরামে ঘুমোয়।
—কিন্তু মনো, স্বর্গে যে সরষের তেল বাড়ন্ত গো। তেলের বালা...ই নেই। সর্বত্র গাওয়া ঘিয়ের গা ঘষাঘষি।
—এখন তো আর আমার শাসনের ভয় নেই। যত পারো খাও, হার্টের তেরটা বাজাও।
—স্বর্গে যে কেউ হার্টের তোয়াক্কা করে না রমা।
মৃদু হাসির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গেই মনোরমা শুনতে পেলেন হালকা হাতে বাজানো কলিংবেলের শব্দ। ফাঁকা জানলাটা আর একবার দেখে নিয়ে শরীরটা ঘুরিয়ে বিছানা থেকে নামতে যেতেই টের পেলেন ঘাড়ের ব্যথাটা।
— তখন ধড়মড়িয়ে উঠতে গিয়েই কি ঘাড়ে লেগে গেল? এই হয়েছে বুড়ো বয়সের জ্বালা। চলতে ফিরতে জানান দেওয়া চাই বয়সটা তোর বসে নেই।
দরজা খুলতেই বিব্রত হল দেবব্রত। মায়ের বেশ আলুথালু। খোলা চুল এলিয়ে আছে পিঠে। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। মাকে সবসময়ই ফিটফাট দেখতেই অভ্যস্ত সে। এরকমভাবে সে কবে মাকে দেখেছে মনে করতে পারল না। নাকি দেখার সময়ই তার কমে গেছে? সকালবেলা তাড়াহুড়োর মধ্যে সে যখন ব্রেকফাস্ট করে, তখনও মা চান টান সেরে পাটভাঙা শাড়িতে ফিটফাট। সেই যে সকালে বেরিয়ে যেতে হয় নার্সিং হোমে, তারপর ফিরতে ফিরতে পাড়া ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু জেগে থাকেন মা। সারাদিনের কর্মক্লান্ত শরীর নিয়ে খাবার টেবিলে। মায়ের সঙ্গে দুচারটে কথাবার্তা হয়। কিন্তু মায়ের দিকে সেভাবে তাকানো হয়না বিশেষ। আজ এই অসময়ে বাড়ি ফিরেছে বলেই মায়ের অসর্তক রূপ সে দেখতে পেল। নাকি সে আজ মায়ের কাছে আসবে বলেই তাকালো তাঁর দিকে?
—ইস্, তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম!
মনোরমাও কম অবাক হননি। যে ছেলে পাড়া ঘুমোলে বাড়ি ফেরে সে আজ দুপুরবেলায় কেন? তবে কি কোনো অঘটন ঘটল?
বয়সের দোষ। ঘটনা ঘটার আগেই অঘটন ঘটার সম্ভাবনায় অস্থির হয়ে ওঠা। ছেলের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন মনোরমা। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ থাকলেও চোখে সতর্কতার সঙ্গে একটা লাজুক হাসির আভাস যেন।
—তাতে কি? এইসময় আমি রোজই উঠে পড়ি। আজকে একটু গভীর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
দরজা বন্ধ করে শাড়ির আঁচলটা গুছিয়ে নিয়ে তৎপর হন মনোরমা,
—তুই জামাকাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে আয়, আমি চা বসাই।
দোতলায় নিজের ঘরে এসেই দেবব্রত টের পেল ক্লান্ত শরীরটা শাওয়ারের তলায় একটা লম্বা ধারাস্নানের জন্য মুখিয়ে আছে।
দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সে গলা তুলল,
—একটু অপেক্ষা করো মা, আমি একেবারে চান সেরে আসছি।
ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে টেনে বাথরুমে শাওয়ারের তলায় দাঁড় করাল দেবব্রত। ঠাণ্ডাজলের ধারা শরীর ছুঁতেই একটা শিহরন বয়ে গেল সারা শরীর বেয়ে। অনুরাধার বন্ধ চোখের পাতায় তিরতিরে কাঁপনটা তার শরীরমনে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ধীরে ধীরে।
শাওয়ারের তলায় অন্যমনস্ক দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জলীয়বোধে শরীরটা কুঁকড়ে যেতেই দেবব্রতর খেয়াল হল, সে অনেকক্ষণ বাথরুমে। তাড়াতাড়ি পাজামা আর হলুদ টিশার্ট গায়ে চড়িয়ে নিচে নেমে এল। চায়ের সরঞ্জাম সাজানো টেবিলে, অথচ মনোরমা নেই।
—মা, আমার হয়ে গেছে, তুমি কোথায়?
—বোস আসছি। কটা পিঁয়াজি ভেজে নিয়ে আসছি।
ছেলের সামনে একটা ছোট প্লেটে পিঁয়াজি রেখে বসলেন মনোরমা।
—তুমি খাবে না?
—নাহ্, বেলায় ভাত খেলে এইসময় আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে না।
—কতদিন পর পিঁয়াজি ভাজলে তুমি।
—কী করি বল? ডাক্তার ছেলের ভাজাভুজিতে বিরাগ দেখে করতেই সাহস পাই না। তাছাড়া রোজই তো রাত দুপুরে বাড়ি ফিরিস। এসব খাবার সময় কোথায়?
টিপট থেকে চা ঢালতে ঢালতে ছেলের মুখের দিকে সোজা তাকালেন মনোরমা। কিছু যেন একটা বলতে চায় দেবু, অথচ শুরু করতে পারছে না। কী কথা? এখনও ছেলের দিকে তাকালে সবটুকু ধরাপড়ে মায়ের চোখে। ছেলেকে একটু উসকে দেবার জন্য মুখ খুললেন মনোরমা, —দেবু, যেটা বলবি ভাবছিস বলে ফেল, ছটফটানিটা কমবে।
চমকে মায়ের দিকে তাকায় দেবব্রত। এখনও ছেলেবেলার মত মা আমাকে পড়তে পারে? অবাক হয় সে। একটুক্ষণ চুপ করে নিজেকে খানিক গুছিয়ে নিয়ে সরাসরি শুরু করে সে,
—জানো মা, ভাবছি বিয়েটা এবার সেরেই ফেলি।
চলকে গেল চা। ঠোঁট থেকে চায়ের কাপটা আলতো নামিয়ে রেখে মনোরমা বললেন,
—বাব্বা, এতদিনে ছেলের আমার সুমতি হল? তা মেয়ে কি ঠিক করে ফেলেছিস?
—হ্যাঁ, মানে আমার দিক থেকে ঠিক করেছি। কিন্তু সে মেয়ে এখনও জানে না।
—সেটা কিরকম? বিয়েটা তো করবি দুজনে, নাকি একলা একলা?
মৃদু হাসির হিল্লোল উঠল। মনোরমা বোধহয় চাইছেন আবহাওয়াটা হালকা রাখতে। যাতে ছেলে সবটা তাঁকে বলতে পারে। এবং মনোরমাকে চমকে দিয়ে দেবব্রত বলে ওঠে,
—না, ঠিক দুজনেও না। বলতে পারো তিনজনে।
মনোরমার হাতে ধরা কাপটা হাতেই থেকে গেল। তিনি খানিক অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন ছেলের মুখের দিকে। এদিক ওদিক হাতড়েও তিনজনের কোনো কূলকিনারা করতে পারলেন না। গলাটা একটু পরিস্কার করে দেবব্রত প্রায় সবটাই খুলে বলল মাকে। তারপর যোগ করল,
—তোমার মত না থাকলে আমি আর অনুরাধাকে এপ্রোচ করব না।
কী বলবেন মনোরমা? তার মতের অপেক্ষা করছে ছেলে! এটা বিশ্বাস করতেও ভয় পাচ্ছেন তিনি। আর সেই ভয়ার্ত দৃষ্টি লুকোতে কাপের হাতলে লেগে থাকা দাগগুলোয় হাত রাখেন মনোরমা। বছর তিনেকও হয়নি মানুষটার হাতে হাতে ঘুরতো এই কাপ। দিনের মধ্যে পঁচিশবার চা। এই দাগগুলো কি একদিন মুছে যাবে? নাকি বছরের পর বছর বয়ে চলবে পুরোনো মালিকের ছাপ? এতগুলো বছর ছেলের বিয়ে নিয়ে কম চেষ্টাচরিত্র করেননি। কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারেননি। বিয়ের বয়স তো কারো বসে থাকে না। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়েছে। ৩৫ পেরিয়ে গেল। আজ যখন সে নিজে চাইছে তখন তিনি বাধা দেবেন কোন প্রাণে? তবু কেন মন সায় দেয় না? নিজেকে হাতড়ে ফেরেন মনোরমা। প্রচলিত রীতির কুমারী নয় বলেই কি ভয় পাচ্ছেন? নাকি অন্য ঔরসের সন্তানকে মেনে নিতে পারছেন না? দ্বিধাদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলেন।
রাতে বিছানায় শরীরটা ফেলা মাত্রই অবিনাশ এসে উপস্থিত,
—কী ভাবছো মনো?
সকলের সামনে রমা, একান্তে মনো। আজও কেন এত স্পষ্ট করে মনে পড়ে তোমায়? চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে শুয়েছিলেন মনোরমা। নিজের চাওয়া আর বিবেকের সঙ্গে কী যেন বোঝাপড়া চলে নিঃশব্দে,
—আমার এমন ডাক্তার ছেলের জন্য কত মেয়ে হা-পিত্যেশ করে বসে আছে। আর ছেলের কিনা অবৈধ সন্তান সমেত মেয়ে পছন্দ হল!
—বৈধতার প্রশ্নে শিশুটির অবস্থান কোথায় বলতে পারো?
—কিন্তু আমিও তো ছেলের মা। কেন এই অহেতুক টানাপোড়েন মেনে নেব?
—অবৈধতায় শিশুটির তো কোনো হাত নেই রমা। ছেলের পছন্দ করা মেয়েকে যদি মেনে নিতে পারো তবে তার ফুলের মত শিশুটিকে মেনে নিতে অসুবিধে কোথায়? ভাবো শিশুটি ওই মেয়ের, আর কারো নয়।
মনোরমা আর ভাবতে পারেন না। এতদিন পর ছেলে বিয়ে করায় মত দিয়েছে। এখন না করলে হয়ত আর কোনোদিন বিয়েই করবে না।
—না, নাইবা করলে মনো।
আবার ঝঙ্কার ওঠে—।
—তোমার আর কি? চোখের সামনে নিজের ছেলের ভোগান্তি তো আর দেখতে হবে না।
—ছেলে ভুগবে এটা আগে থেকেই ভেবে নিচ্ছো কেন মনো? হয়ত দেখবে ওই ছোট্ট শিশুটিই সমস্ত ভোগাভুগির নিরাময় করছে।
ভিজিটিং আওয়ারে তাপসী এসে দেখল অনুরাধা ফিড করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর মেয়েটা মায়ের কোলের কাছে নিশ্চিন্তে শুয়ে খেলা করে যাচ্ছে। তাপসী টুল টেনে বসতেই চোখ মেলল অনুরাধা,
—কখন এলি?
—এই তো। আজকে শরীরটা কেমন লাগছে?
—খুব দুর্বল লাগছে রে। দাঁড়াতে গেলেই পা-দুটো কাঁপছে।
—শোন, ডাক্তার বলছেন তোকে কিছুদিন থাকতে হবে এখানে।
—রোগটা কি?
—এনিমিয়া। আমাদের দেশের মেয়েদের কমন রোগ। তোর ব্লাড রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন, হিমোগ্লোবিন লেভেল ৭ এ নেমে গেছে। ওটা ১২ তে উঠে নরম্যাল নাহলে ছাড়া যাবে না বলছেন।
—কিন্তু এখানে অতদিন থাকা।
—তুই ও নিয়ে ভাবিস না অনু। তোর শরীরের যা হাল করেছিস, এখন বাড়ি গিয়ে বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারবি? এখানে ওটা নার্সরা সামাল দিচ্ছে। ভালোই তো। তোরও রেস্ট হল, মেয়েটাও ভালো রইল। তুই কিছুদিন রেস্ট নে। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।
তাপসীর দীর্ঘ ভাষণের পর অনুরাধার টুকরো প্রশ্ন,
—তারপর?
মুখর তাপসী মূক হয়ে আসে। তারপর? কি কঠিন প্রশ্ন করেছে অনুরাধা। কোথায় আছে এর উত্তর? সালোয়ারের গোলাপী ওড়নাটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে তাপসী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
হোস্টেলের একলা বিছানায় শুয়ে ছটপট করে তাপসী। পাশের বেডটা এখনও খালি। কবে কখন আর একজন এসে দখল নেবে, মুছে যাবে অনুরাধার যাপনের গন্ধটুকু। হোস্টেলসুপার কিছুতেই রাজি নন ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেলে মেয়ে সমেত অনুরাধাকে রাখতে। মামা মামী তো প্রেগন্যান্ট অনুরাধাকেই রাখতে রাজি হননি। আর অনুরাধা যা মেয়ে, সে কি আবার যেতে রাজি হবে মামার কাছে? তাহলে? কোথায়? বাড়ি ভাড়া? নাহ্, তাও সম্ভব নয়। কোন বাড়িওলা রাজি হবে কন্যাসমেত অবিবাহিত মেয়েকে বাড়িভাড়া দিতে? অভিভাবক ছাড়া মেয়ে বাড়িভাড়া চায় কেন? যে মেয়ের বিয়েই হয়নি তার সন্তান জন্মায় কেন? এতগুলো কেনর উত্তর কোথায়? নারী স্বাধীনতা? হুঁ, নারী স্বাধীনতা এখনও সোনার পাথরবাটি।
ভাবতে ভাবতে মাথাটা গরম হয়ে ওঠে। কেন অনুরাধা এখনও সেই বিশ্বাসঘাতক পলাশকে মনে রাখবে? কেন সে নতুনভাবে জীবন শুরু করবে না? ডাক্তার দেবব্রতর মত মানুষ কটা হয়? তিনি যখন নিজে চাইছেন তখন অনুরাধা না বলবে কেন? নাহ্। কিছুতেই না। মনস্থির করে ফেলে তাপসী। ভিজিটিং আওয়ারে অনুরাধার সামনে বসে সোজা তাকায় তার চোখের দিকে,
—তুই কি আর বিয়ে করবি না বলে পণ করেছিস?
খুব অবাক হয় অনুরাধা। এই মুহূর্তে এইরকম একটা প্রশ্নের জন্য সেও বুঝি তৈরি ছিলনা। বিষণ্ণ হাসি বাজল নিজেরই অজান্তে।
—জীবনের সবকিছু হাসি দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া যায় না অনু।
—কিন্তু তোর প্রশ্নের উত্তরটা যে আমার জানা নেই তপু।
—জানা না থাকলে এবার তো জানার চেষ্টা কর। আমাকে এড়িয়ে গেলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে?
—এত রেগে যাচ্ছিস কেন তপু? তোর কি মনে হয় আমাকে বিয়ে করার জন্য গণ্ডায় গণ্ডায় মানুষ অপেক্ষা করে আছে?
—যদি সত্যিই কেউ চায়, তুই করবি?
—আগে তো কেউ চাক, তারপর না হয় ভেবে দেখবোখন।
একটা গভীর নিশ্চিন্ত শ্বাস তাপসীর বুক আলোড়িত করে বেরিয়ে আসে। মুখে হাসি নিয়ে সে অনুরাধার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। খুব মৃদু উচ্চারণ করে—
—অনু, মানুষে অবিশ্বাস নিয়ে তো মানুষ বাঁচে না। একবার ঠকেছিস বলেই সংসারের সব মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলিস না। নাহয় আরো একবার বিশ্বাস করলি। সংসারে কিছু মানুষ এখনও মানুষ রে।
তাপসীর হাতের ওপর দু ফোঁটা বৃষ্টি ঝরে।
অনুরাধার ফাইলে চোখ বোলাচ্ছেন ডাক্তার দেবব্রত রায়। হিমোগ্লোবিন লেভেল ১০। নাহ্, এর বেশি আর উঠছে না। গড়পড়তা ভারতীয় মেয়েদের এটাই স্ট্যান্ডার্ড বলে মেনে নিয়েছি সবাই। আর চেষ্টা করাই বৃথা। অনুরাধাকে নিজের রুমে ডেকে পাঠান ডাক্তার।
—এখন কেমন লাগছে অনুরাধা?
—বেশ ভালোই তো।
—তবে এবারে আপনার ছুটি মঞ্জুর করা যায়। কিন্তু তার আগে যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলতে চাই।
—বলুন।
—এখানে এভাবে নয়। আপনি যদি আমার ডিউটি আওয়ারের পর একবার আমার সঙ্গে বাইরে বেরোতে রাজি হন তাহলে সুবিধে হয়।
অনুরাধা দ্বিধান্বিত। ডাক্তার বুঝতে পারে তার সংকোচ। রোগীর বাইরে জীবনে কখনও মেয়েদের সঙ্গে ওঠাবোসা করেনি সে। কীভাবে কথা বলতে হয় শেখেনি কখনও। এভাবে তার সঙ্গে বাইরে বেরোবার কথা বলাটা ঠিক হল কিনা ঠাহর করতে পারে না। অনুরাধার মুখে আলোছায়ার খেলা দেখে।
অনুরাধা কি বলবে ভেবে পায় না। এতদিন ধরে নার্সিহোমে থাকতে থাকতে ডাক্তারের আচরণ তাকে বিশ্বাসের দিকেই টানছে। মানুষকে অবিশ্বাস করতে কখনও শেখেনি সে। পলাশ তাকে যতই টানুক অবিশ্বাসের দিকে, তার চেতনা, তার বোধ তাকে সর্বদা ঠেলে দেয় বিশ্বাসের দিকেই।
খানিকটা সময় নিয়ে সে বলে—
—কিন্তু ছোট মেয়ে নিয়ে ...
অনুরাধা কি অজুহাত খুঁজছে তাকে এড়িয়ে যাবার? ডাক্তার আশানিরাশায় দোল খান। ধীরে ধীরে বলেন,
—মেয়েকে আপনি কমলা নার্সের কাছে স্বচ্ছন্দে রেখে যেতে পারেন। ঘন্টাখানেক সে সামলাতে পারবে বলেই মনে হয়।
তখনও সন্ধে হয়নি। পশ্চিমে ঢল খাওয়া সূর্য রক্তিমের গাঢ় নেশায় তির্যক কটাক্ষ হানছে। কি যেন এক স্বপ্নের মিড় মনের কোণে খেলা করে। অনুরাধা ছুঁতে চায়। কিন্তু পারে না। গাড়ির খোলা জানলায় অবাধ্য হয়ে ওঠা বাতাস তার খোলা চুল নিয়ে খেলায় মেতেছে। গোধূলির মায়া তখনও মুখর। পাখপাখালির নীড়ফেরা তান থমকে যাচ্ছে বুকের ভেতর। একটা অবুঝ কান্না উঠে আসতে চাইছে মনের গহিন থেকে।
আউট্রাম ঘাটের কাছে থেমে গেল গাড়িটা। দেবব্রত গাড়ির দরজা খুলে ডাকল-- —আসুন
খুব ধীরে নেমে এল অনুরাধা। গঙ্গার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অনেকদিনের পর নদীর হাওয়া বুক ভরে গ্রহণ করল সে। চুপচাপ তাকে লক্ষ্য করছে দেবব্রত। হয়তবা নিজেকে তৈরি করছে মুখোমুখি হবার।
অনুরাধা কিছুটা উচ্ছল হয়ে পড়ে,
—এতদিন পর বাইরে বেরিয়ে কি যে ভালো লাগছে।
—অনুরাধা একটা কথা বলার ছিল।
চুপ করে তার দিকে তাকায় অনুরাধা। কিন্তু কথা আটকে যায় দেবব্রতর। কীভাবে বলবে কিছুই অনুমান করতে পারে না। কিছুক্ষণ পর গঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে সে সরাসরি বলে ওঠে,
—আসলে কীভাবে প্রোপোজ করতে হয় সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই, মানে...
উচ্ছল অনুরাধা স্থির হয়ে আসে। তার মনে পড়ে নার্সিংহোমে তার ঘুমন্ত চোখে কারো দৃষ্টির স্পর্শ অনুভব করত সে। বেশ কয়েকবারই আবিষ্কার করেছে সে দৃষ্টি ডাক্তারেরই। নদীর দিকে মুখ ফেরানো ডাক্তারের দিকে তাকায় অনুরাধা। আর ঠিক সেই মূহূর্তে মনে পড়ে যায় একদিন, ঠিক এমনি একটা দিনে পলাশ তাকে নিয়ে নৌকোয় উঠেছিল। আমূল কেঁপে ওঠে অনুরাধা। আবার, আবার সে কি ভুল করবে? নাকি আরো একবার বিশ্বাস করবে? গর্ভের ভার বহন করতে করতেই সে হাতড়ে বেড়িয়েছিল একটা কাঁধ, যেখানে সে নিশ্চিন্তে মাথা রাখতে পারে। কিন্তু সে কি এই ডাক্তার? কতটুকু চেনে সে তাকে?
নদীর জলের ভেতর অনুরাধার ছায়া কথা বলে ওঠে,
—পলাশকে তুই কতদিন জানতিস অনুরাধা?
—অনেকদিন।
—সেই অনেকগুলো দিনের অবসর কি তোকে পলাশকে চিনে নিতে দিয়েছিল? চুপ করে কেন অনুরাধা? সময়ের হিসেব দিয়ে মানুষ চেনা যায় না অনুরাধা। মুহূর্তের ঘাত প্রতিঘাত দিয়ে মেপে নিতে হয়।
নদীর জলের দিকে স্থির চেয়ে থাকা অনুরাধাকে দেখে দেবব্রত। নার্সিংহোমের সবচেয়ে কড়া ডাক্তার হিসেবে পরিচিত দেবব্রতর মনটাও কেমন যেন মেদুর হয়ে আসে।
আলতো স্বরে উচ্চারণ করে,
—আপনার যেকোনো মতই শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নেব অনুরাধা। কোনো প্রশ্ন রাখব না।
—না মানে, আমি তো ঠিক একা নই ডাক্তার।
—অনুরাধা, আমি আসলে বলতে চাইছিলাম আপনার মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেটে যদি দেবব্রত রায়ের নাম লেখানো যায়, তাহলে...
—করুণা?
শব্দটা তিরের মত বেঁধে ডাক্তারের বুকের গহিনে। কিছু শব্দবন্ধ খুললেই ঝড়ের পূর্বাভাস, ভাঙচুর। নোনাজল নদীখাত বেয়ে গভীরে আরো গভীরে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায় দেবব্রতর। ঠিক, ঠিক এই প্রশ্নটাই রাতের পর রাত তার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই সে মেনে নিতে পারেনি তার প্রথম ভালোবাসা করুণার হাত ধরে এসেছে।
অনুরাধার বাঁহাতটা আলতো করে নিজের মুঠিতে তুলে নেয় ডাক্তার,
—না অনুরাধা।হঠাৎ কোনো আবেগ থেকে একথা বলিনি আপনাকে। তাপসীর কাছে সমস্ত কিছু শুনেছি। এব্যাপারটা নিয়েও অনেক ভেবেছি। কিন্তু কিছুতেই করুণা বলে মেনে নিতে পারিনি।
—আজকে মণির স্কুলে পেরেন্টটিচার’স মিটিং আছে। তুমি যাচ্ছো তো?
ব্রেকফাস্ট টেবিলে অরেঞ্জ জুসটা দেবব্রতকে এগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করে অনুরাধা। খবরের কাগজের পাতায় মগ্ন দেবব্রত মুখ তোলে—
—অনু, প্লিজ, আজকে তুমি একলাই যাও। মিসেস পাকড়াশির আজ গলব্লাডার অপারেশান আছে। ডঃ অরিন্দম ঘোষ আমাদের কাউকে এসিস্ট্যান্ট চেয়েছেন।
—কেন, সুদেষ্ণাকে বলো এটেন্ড করতে।
—সুদেষ্ণা কোথায়? সে তো ছেলের পরীক্ষা বলে ছুটি নিয়ে বসে আছে।
—ডঃ সুদেষ্ণা ছেলের জন্য ছুটি নিতে পারেন, কিন্তু ডঃ দেবব্রত মেয়ের স্কুলের জন্য একটু সময় দিতে পারে না, আশ্চর্য!
—ছেলেমানুষি কোরো না অনুরাধা। নার্সিংহোমটা যখন আমার, তখন তার দায়দায়িত্বগুলো আমাকেই নিতে হবে তো! ডঃ সুদেষ্ণা এখানে চাকরি করেন মাত্র। তাঁর জমানো ছুটি তিনি যখন খুশি নিতে পারেন। আমার কিছু করার আছে কি?
—তোমার কাজটাই কাজ, আমার অফিসটা কিছু নয়? সব সময় মণির জন্য আমাকেই ছুটি নিতে হবে কেন বলতে পারো দেবব্রত?
—সব মায়েরাই করে অনু, এতে তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন?
—পেরেন্টটিচার’স মিটিংটা বাবা মা দুজনকে নিয়েই। কেবল বার্থ সার্টিফিকেটে নাম লেখালেই বাবা হওয়া যায় না দেবব্রত।
দেবব্রতর ফর্সা মুখে রক্ত ঘনায়। অনুরাধার চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল তাকিয়ে থাকে সে। তারপর আস্তে আস্তে উঠে যায় ডাইনিং টেবিল ছেড়ে।
ঝোঁকের মাথায় কথাগুলো বলে ফেলেই কেঁপে ওঠে অনুরাধা। বুঝতে পারে দেবব্রতর সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গাটাতেই আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে। সকালের তরতাজা মানুষটার ক্লান্ত চলনের দিকে চুপচাপ চেয়ে থাকে সে।
সংসারের সমস্ত দাবিদাওয়া মিটিয়ে কতটুকু শিশিরকণাই বা জমতে পারে। তবু মানুষ সেটুকুও শুষে নেয় কথার বিষাক্ত ছোবলে।
দোতলায় ঠাকুরঘরের পুজো সেরে নিচে নামছিলেন মনোরমা। সিঁড়ির ধাপগুলো সতর্ক মনোযোগ দিয়ে নামতে নামতে অনুরাধার শেষ কথাগুলো তাঁর কান এড়ালো না। ডাইনিং টেবিলে দেবব্রতর প্লেটের দিকে চেয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মনোরমা,
—দিলে তো ছেলেটার খাওয়াটা বারোটা বাজিয়ে? বলিহারি তোমার আক্কেল বউমা। সারাদিনে খাওয়াদাওয়া ঠিকমত হয় কিনা তার নেই ঠিক, সকালের জলখাবারটা পর্যন্ত ঠিক করে খেতে দিলেনা?
যে কথাগুলো অনুরাধার নিজের মনের ভেতরই ঘুরপাক খেতে খেতে বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছিল, সেগুলো অন্যের মুখ থেকে শুনেই মনটা কেন যে আরো বিষিয়ে উঠল কে জানে। মুখে ছোবল দিল কালকূট। বিষের তীব্রতায় আরো ঘুলিয়ে উঠল হাওয়া,
—উচিত কথা বড্ড বেশি বাজে, তাই না মা!
—আমার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, আমাকে আর উচিত অনুচিত শেখাতে এসো না বউমা। কার না কার বাচ্চা কোলে করে ঘরে তুলল যে মানুষটা তাকেই আবার হেনস্থা করছ। ছি বউমা। বিদ্যেবুদ্ধি কি শুধু পরীক্ষা পাশের জন্য? চাকরি করছ বলে যেন ধরাকে সরা জ্ঞান করছ।
চেয়ারের সঙ্গে যেন গেঁথে যায় অনুরাধা। বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশব্দ হাহাকার ওঠে,
— মণি তুই কার?
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)