ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে এসে জানলার ধারে রাখা ইজিচেয়ারটায় চুপ করে বসেছিল দেবব্রত। সকালের হলুদ আলোটা গ্রিল বেয়ে গড়িয়ে নামছে। ধীরস্থির চলন তার। কোথাও ঝড় নেই তুফান নেই। নিশ্চিন্ত নির্বিরোধী চলন তার। রোদের দিকে চেয়ে চেয়ে নিজের ভেতরটাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে দেবব্রত। চোখদুটো বন্ধ করে ডুব দিতে চায় নিজের ভেতর ঘরে। বন্ধ চোখের পাতায় তখন ধূসর বিষাদ গাঢ় আঁচল পাতছে। সঙ সাজা এই সংসারের আঁকাবাঁকা গলিঘুঁজিতে চলতে চলতে কখন যে চলনখানিই বাঁকা হয়ে ওঠে বুঝতে পারে না দেবব্রত।
কে যেন ফিসফিস করে,
—কি চাও তুমি অনুরাধার কাছে?
—কিছু না। আমার এই সামান্য অস্তিত্ব নিয়ে তোমার ভরাট পূর্ণতায় বাসা বেঁধেছি অনু। এভাবে আমাকে ঠেলে দিও না প্লিজ। ভালোবাসার ভিত্তিতেই কি আমাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত নয় অনুরাধা?
—তাই বলে সামাজিক শৃঙ্খলার দায় এড়িয়ে যেতে চাও?
—জানি না, জানি না। কিচ্ছু জানি না। শৃঙ্খল ভাঙবো বলেই তো তোমাকে নিয়ে আমার চলা শুরু হয়েছিল। তবু টের পাইনি কখন কোথায় এতখানি বিষ জমিয়ে তুললে।
ডাইনিং টেবিলে আচ্ছন্নের মত বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় অনুরাধা। দৌড়ে বেডরুমে ঢুকে যায়। মণি তখন গভীর ঘুমের দেশে। সোজা মণির কাছে গিয়ে তাকে সজোরে নাড়া দিতে দিতে চিৎকার করে ওঠে অনুরাধা,
—বল মণি, তুই কার? বল মণি বল...
ঘুমে আচ্ছন্ন মণি অনুরাধার চিৎকারে ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু চোখ খুলে মায়ের উদভ্রান্ত মুখটা চোখের সামনে দেখে হঠাৎ তার কান্না আটকে যায় গলার ভেতর। অবাক চোখ তুলে চেয়ে থাকে সে।
অনুরাধার চিৎকারে দেবব্রতর ঘোর ঘোর ভাবটা আছড়ে খানখান হয়ে যায়। জানলা থেকে দ্রুত উঠে আসে মণির পাশে। তার মাথায় হাত রেখে শান্ত স্বরে বলে—
—কিচ্ছু হয়নি মামণি, তুমি ঘুমোও।
অনুরাধার দিক থেকে ফিরিয়ে তাকে পাশ ফিরে শুইয়ে দেয়। ধীরে ধীরে চুলের ভেতর আঙুল বোলায়। বাবার হাতের স্পর্শে ছোট্ট মণির চোখের পাতা আবার বুঁজে আসে।
বিছানা ছেড়ে উঠে আসে দেবব্রত। দুই বলিষ্ঠ হাতে আচ্ছন্ন অনুরাধাকে সোজা দাঁড় করায় নিজের দিকে। তার দুকাঁধ ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ। অনুরাধা আস্তে আস্তে চোখ তোলে দেবব্রতর দিকে।
অনুরাধার পাগলামী দেবব্রতকেও আক্রমণ করতে চাইছে। অনুরাধাকে স্পর্শ করে নিজেকে স্থির রাখার প্রবল চেষ্টায় অনুরাধার কাঁধে রাখা হাতে ক্রমশ চাপ বাড়ে। প্রবল একটা কাঁপুনি অনুরাধার ঠোঁট ছাড়িয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা শরীরে।
পাখির মত তিরতিরে সেই কাঁপুনিতে দেবব্রতর তীক্ষ্ণ গ্রীবায় ভাঙন ধরে,
—অনু প্লিজ...এমন করে না অনু... তুমি কি বোঝো না মণি আমারও কতটা?
আর পারে না অনুরাধা। অবশ হয়ে আসা শরীরটা ক্রমশ কন্ট্রোলের বাইরে চলে যেতে থাকে। দেবব্রত সজোরে টেনে নেয় তাকে বুকের মধ্যে। নিজের আরক্ত ঠোঁটে আশ্রয় দেয় অনুরাধার নীল হয়ে আসা কম্পিত ঠোঁট।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে অনুরাধার পিঠের ওপর দিয়ে তার চোখ পড়ে বিছানায়। মণির নির্বাক চোখের শূন্য দৃষ্টি। অনুরাধার চেয়ে আট বছরের বড় দেবব্রত আবেগে নিজেকে ভাসিয়েও নৌকো নোঙর করতে দেরি করে না। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে অনুরাধাকে বুকের ওপর থেকে তুলে দুহাতে মৃদু ঝাঁকানি দেয়। অনুরাধা সময় নেয় বেশ কিছুটা। দেবব্রতর থেকে বেশি প্র্যাক্টিক্যাল হলেও আবেগে আক্রান্ত হয় সহসা। তার প্রকাশভঙ্গীও খুব সরল। আর একবার আক্রান্ত হলে তাকে বের করে আনা যে কি কঠিন, তা একমাত্র জানে দেবব্রত।
অনুরাধাকে ছেড়ে দেবব্রত মণিকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু খায়। তারপর একপেগ আদেশের সঙ্গে দুপেগ স্নেহ ঢেলে দেবব্রতর নিজস্ব স্টাইলের ককটেলে অনুরাধাকে বলে—
—যাও অনু, মণিকে তাড়াতাড়ি রেডি করো। আগে মণির স্কুল, তারপর অপারেশান।
বা-আ-আ-পি-ই-ই।
ছোট্ট মুঠিতে চোখ মুছতে মুছতে মণি এসে আছড়ে পড়ল দেবব্রতর কোলের ওপর। কান্নায় ফুলে ফুলে ওঠা মেয়ের পিঠের ওপর আলতো হাত রাখে দেবব্রত,
—কী হয়েছে মামণি?
ছোট্ট হৃদয়ের মস্ত অভিমান ঝরিয়ে দিতে দিতে ফুঁপিয়ে ওঠে মণি, উত্তর দিতে পারে না বেচারি। মেয়েকে শান্ত হতে সময় দেয় দেবব্রত আর আস্তে আস্তে তার পিঠে হাত বোলায়। বেশ খানিকক্ষণ চোখের জল ঝরিয়ে অশান্ত হৃদয় বুঝিবা কিছুটা শান্ত হয়ে আসে। দেবব্রত আবার প্রশ্ন করলে লাল টুকটুকে ঠোঁটে জবাব দেয়,
—মা বকেছে।
—সেকি! কেন কেন? মামণিকে বকেছে কেন? তুমি বুঝি দুষ্টুমি করেছিলে?
বাবার সন্দেহ প্রবণতায় মেয়ের শোক আবার উধলে ওঠে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উত্তর দেয়,
—মোটেই না। আমি শুধু বান্টিকে একটা কিস করেছিলাম, তাইতেই মা...
আবার মেয়ের গলাটা প্রায় বুজে এল দেখে নড়ে ওঠে দেবব্রত—
—ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড। দাঁড়াও, মা কে আমি বকে দিচ্ছি।
—চলো তাহলে।
বাদীপক্ষ জজসাহেবের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বিবাদীপক্ষের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। অসহায় দেবব্রত দেখল যাকে নিয়ে মামলা রুজু করা হয়েছে সেই অকৃতজ্ঞ বান্টি তখন রান্নাঘরের বাইরে একপাশে বসে চুমুকাণ্ড বেমালুম ভুলে গিয়ে পরম নিশ্চিন্তে দুধের বাটিতে চুমুক দিচ্ছে।
রান্নাঘরের দরজায় দুজনে এসে দাঁড়াতেই চোখ ফেরায় অনুরাধা। তার ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দেয়া চোরা হাসি চোখ এড়ায় না দেবব্রতর।
মণির উৎসুক মুখের দিকে গোপনে একবার দেখে নিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব গম্ভীর রেখে গলাখাঁকারি দেয় দেবব্রত—
—এটা কিন্তু তোমার খুব অন্যায় অনু। শুধুমুধু মণিকে বকেছ।
পেটের থেকে গুলিয়ে ওঠা হাসিটাকে ফের পেটের মধ্যে চালান করে দিয়ে ঝংকারে বেজে ওঠে অনুরাধা—
—বকবে না তো কি? র্যাবিজের ভয় নেই? কিছু হলে তো আমাকেই ভুগতে হবে।
নার্সিংহোমের দায়িত্ব সামলে কতটুকু সময়ই বা দিতে পারে মণিকে। আর ভাবতে ভাবতেই গহন মনের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা বিশ্বাসঘাতক ভাবনাটা ঝিলিক দিয়ে গেল— নিজের মেয়ে হলেও কি এমনই করতে দেবব্রত?
ততক্ষণে অস্থির মণি বাপিকে চুপ করে থাকতে দেখে ঠেলা দিয়ে বলে,
—বলো না বাপি, বান্টিকে তো ভ্যাক্সিন দেওয়া আছে, বলো না মাকে।
—আছেই তো। সত্যিই তো, র্যাবিজের ভ্যাক্সিনেশান করা থাকলে আবার ভয় কি?
অনুরাধা ঝেঁঝে ওঠে—
—ভ্যাক্সিনেশান! লাস্ট কোন ডেটে ভ্যাক্সিনেশান করা হয়েছিল তার হিসেব আছে? আমাকে না বুঝিয়ে বরং আদরের মেয়েকে বোঝাও, কুকুর বেড়ালে মুখ দিয়ে আদর করতে নেই।
কথা বলতে বলতেই অনুরাধার মাথাটা টলে গেল। চোখের সামনেটায় গাঢ় অন্ধকার। তখনও একহাতে ধরা আছে সাঁড়াশি আর অন্য হাতটা ছড়িয়ে গেল কিছু আঁকড়ে ধরার আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু সেইটুকু মুহূর্তও ফাঁকি দিতে পারল না দেবব্রতকে। অনুরাধা মাটিতে পড়ার আগেই সে রান্নাঘরের মধ্যে এবং অনুরাধাও দেবব্রতর বাহুবন্ধনে। অনুরাধার পপাতধরণীতল রক্ষা পেলেও তার হাতের সাঁড়াশিটা বিশ্বাসঘাতকতা করে বসল। অব্যর্থ লক্ষ্যে দেবব্রতর কপালে কিছু রক্ত ঝরিয়ে তবে মাটি নিল সাঁড়াশিটি।
অনুরাধাকে দুহাতে তুলে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শোয়ালো দেবব্রত। ফ্যানটা জোরে চালিয়ে দিয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে চোখ মেলল অনুরাধা। আর ধড়ে প্রাণ ফিরল দেবব্রতর। বিছানায় উঠে বসতেই অনুরাধার চোখে পড়ল দেবব্রতর কপালে রক্ত। আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করল,
—একি! তোমার কপালে রক্ত কেন? কী করে এমন হল?
—ওটার কথা এখন থাক। আগে বলো তো, এরকম তোমার আগে কখনও হয়েছে কিনা?
—এই শুরু হল ডাক্তারবাবুর জেরা। আজ্ঞে হয়েছিল।
—কবে?
—ঠিক চার বছর নমাস আগে।
হিসেব শুনে থতমত খেল দেবব্রত। আর উত্তর দিতে দিতেই অনুরাধার ঠোঁটে ফুটল একটা ফাজিল হাসির আভাস। মণিকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,
—মামণি, বাপিকে বলো তো তোমার বয়স কত?
মণি কথা বলবে কি! বান্টি ঘটিত মামলা চলাকালীন মাকে পড়ে যেতে দেখে সে বেচারি তো ভয়েই ঠকঠক করে কাঁপছিল এতক্ষণ। মনে মনে স্থির নিশ্চিত হয়ে ছিল, তার জন্যই মায়ের এমন অসুখ হল। মাকে বিছানায় উঠে বসতে দেখে এই একটু হাঁপ ছেড়েছে বেচারি। তার মধ্যেই মা আবার প্রশ্ন করতে শুরু করল। মণির মুখের চেহারা দেখেই পুরো ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে অনুরাধা। মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল—
—আমার কিচ্ছু হয়নি সোনা মা। তবে তুমি যদি আবার বান্টিকে...
মাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মণি ভয়ে ভয়ে বলে ফেলে
—ককখনো না। বান্টিকে আর কক্খনো কিস করব না।
মেয়ের গালে একটা চুমু দিয়ে দেবব্রতর দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, —দেখো বাবা কেমন ভেবলু হয়ে গেছে। বাবাকে বলে দাও তো তোমার বয়স কত?
—ফোর ইয়ার্স।
এমন সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরে খুব খুশি হয়ে ওঠে মণি। আর তখনই তার নজর পড়ে আদরের টেডি বিয়ারটা এতক্ষণের অনাদরে কেঁদেকুটে গড়াগড়ি দিচ্ছে মেঝেতে। নিচু হয়ে তাকে তুলে নিয়ে মান ভাঙাতে চুমোয় চুমোয় ভরে দিতে দিতে ঘর ছাড়ে মণি।
এতক্ষণে দেবব্রতও হিসেব মেলাতে পারে। আর পারতেই সমস্ত শরীর মন জুড়ে শিহরন বয়ে গেল। অথচ তারই সঙ্গে লেগে রইল কি কোনো কাঁটাও! মনের মধ্যে যেন দুই সতীন মনের বসত, সদাই তাদের লড়াই। এক মন অন্য মনের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করতে পারে না। দেবব্রত আর তার ছায়া কথার পিঠে কথা জোগায়,
—অনুর দ্বিতীয় সন্তান আসছে।
—না, দেবব্রতর প্রথম সন্তান আসছে।
—দুইই কি সমান নয়?
—তুমি কি সমান মনে করতে পারবে দেবব্রত?
অনুরাধা দেবব্রতকে অন্যমনস্ক হতে দেখে ভেতরে ভেতরে একটু কেঁপে ওঠে। কীসের যেন দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের দোলায় দুলতে থাকে মন। নিজের সন্তান এলে মণিকে কি দূরে ঠেলে দেবে দেবব্রত? যদিও কখনো কোনো বাক্যব্যয় করেনি দেবব্রত, তবু কী করে যেন মণিকে নিয়ে তার দোলাচল টের পায় অনুরাধা। খুব গোপন একটা অনুভূতি নড়ে চড়ে বেড়ায় দেবব্রতর মধ্যে, যার স্পর্শ পায় সে। কিন্তু দেবব্রত আজও জানতে পারেনি অনুরাধাও টের পায় তার ছায়ামনের অস্তিত্ব।
কত সময় অনুরাধার নিজেরই মনে হয়েছে নিজেই বলুক দেবব্রতকে,
—খাতায় কলমে মণিকে তুমি নিজের মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিলেও নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছো দেবব্রত। এভাবে কি বাঁচা যায়? আমাদের জন্য কেন তুমি এইভাবে কষ্ট পাবে?
কিন্তু বারবারই সামনে এসে দাঁড়ায় অনুরাধার ছায়া—
—জলঘোলা করে কি লাভ অনুরাধা? এটা তো মানবি, তোর জীবনটা শুরুই হয়েছে জটিলতা দিয়ে। সত্য সরল হলেও জটিল; সত্য স্বচ্ছ হলেও দুর্বোধ্য অনুরাধা।
—তবে কি সব কিছু জেনেও না জানার ভান করে জীবনটা বয়ে বেড়াতে হবে?
—হবে। আর সেটাই জীবন। তুই না মণির মা! নিজের কথাই ভাবছিস স্বার্থপরের মত। তুই কি জানিস না এ জগতে মণির মা ছাড়া আর কেউ নেই।
—জানি।
—ওই নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে সব কিছু কি মেনে নেওয়া যায় না অনুরাধা?
মুখ তুলতেই অনুরাধার চোখে পড়ল বুকের ওপর দুটো হাত আড়াআড়ি রেখে কি যেন ভাবনায় ডুব দিয়েছে দেবব্রত। নড়েচড়ে ওঠে সে। ছায়াকে সরিয়ে একটু তরল হয়—
—কী হল ডাক্তারবাবু? অমন ভ্যাবলা হয়ে গেলে কেন?
কোথায় যেন তলিয়ে গেছিল দেবব্রত। অনুরাধার ডাকে আবার সংবিতে ফেরে। লজ্জিত মুখে বসে পড়ে বিছানায়। দুহাতে অনুরাধার মুখটা তুলে ধরে চুপ করে দেখে কয়েক মুহূর্ত। পিতার গভীর স্নেহ নাকি স্বামীর তীব্র প্রেম নিয়ে সে জড়িয়ে ধরে অনুরাধাকে। তার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে নিজের মনের সব গ্লানি ঝরিয়ে ফেলতে চায়।
এই কি প্রেম? কোথায় কতটুকু টান পড়লে ভালোবাসায় অবিশ্বাস জন্মায়? বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের ভেতর কতটুকু দূরত্ব? সত্যি কি পেরোনো যায় এই দূরত্বটুকু? ছোট্ট এই জীবননদীর বাঁকে বাঁকে কত প্রশ্নের পাহাড় জমা করতে থাকে আর বয়ে চলে কিছু চোরাস্রোত। অস্তিত্বের এই সংকট, যাপনের এই গ্লানি নিয়েও মানুষ আজও চলেছে উজানের পথে।
নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে বিছানা নিতেই অবিনাশের গলা ভেসে ওঠে,
—কেমন আছো মনো?
অনেকদিনের পর আজ যেন মনোরমার মুখে আলোর হাসি ফুটে ওঠে। আলতো আদুরে গলায় আওয়াজ ভাসে,
—তোমার উত্তরাধিকারী আসছে গো।
—বাহ্ বাহ্, এতদিনে তোমার ছেলে তবে বাবা খেতাব পাচ্ছে বলো! অবশ্য মণির কল্যাণে খাতায়কলমে আগেই ও খেতাব জুটে গেছে কপালে।
মণির নামোচ্চারণেই মনোরমার মুখ থেকে আলোর হাসি মুছে যায় সহসা। তিনি ঝেঁঝে ওঠেন,
—হুঁ, মণির বাপ! অন্যের পাপ বহন করতে করতে ছেলেটা আমার নাজেহাল হয়ে গেলো, সেটা তো তোমার চোখে পড়ে না! আজীবন অন্ধ হয়েই সংসার করে গেলে!
—কিছু অন্ধত্ব সংসারের পক্ষে মঙ্গল মনোরমা।
—আমাকে আর মঙ্গল অমঙ্গল শেখাতে এসো না। চোখের সামনে ছেলেটার ভোগান্তি দেখতে দেখতে নিজের ওপরই ঘেন্না ধরে যায় মাঝে মাঝে।
—তুমি সেই চিরটাকাল অবুঝ হয়েই রয়ে গেলে। ছেলে বড় হলে তার কোনটা ভোগ আর কোনটা ভোগান্তি সে হিসেব মাকে নিতে নেই মনো।
মনোরমাকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে অবিনাশও বুঝি নড়ে ওঠেন,
—এত কী ভাবছো মনো?
—ভাবছি, ছেলের কোনো হিসেবই যদি মাকে আর না নিতে হয় তাহলে আর আমার এখানে থাকার দরকারটা কি?
তরল হাসির ঝংকার ওঠে অবিনাশের খসখসে গলায়,
—বিবাগী হবার চেষ্টায় আছো নাকি? সাবধান মনো, আজকাল আর সে বনজঙ্গলও নেই, সে আরামের বিবাগী হওয়াও নেই।
—বিবাগী হতে যাবো কোন দুঃখে? তুমি তো আর আমায় ভিখিরি করে রেখে যাওনি। ভাবছি, আজকাল অনেক বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে, সেখানেই চলে যাবো।
—তা মন্দ ভাবোনি রমা। তাতে তোমার ছেলে বউও একটু হাত পা মেলে সংসার করার সুযোগ পাবে।
অবিনাশের কথা শুনে আবার বুঝি অভিমান ঘনিয়ে আসে মনোরমার চোখে,
—কেন! আমি কি হাত পা বেঁধে রেখেছি নাকি, যে আমি না গেলে হাত পা মেলার সুযোগ পাচ্ছে না।
—না না, বেঁধে রাখবে কেন? নিজের বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকের কথাগুলো একটু ভাবো তো দেখি। মা বাবা দু-একদিনের জন্য অন্যত্র গেলেই আমরা দুজনেই কেমন আরামের নিঃশ্বাস ফেলতাম!
পুরোনো কথা মনে হতেই মনোরমার বিষণ্ণ মুখটা আবার আলো আলো হয়ে ওঠে।
—সেই সেবার মনে আছে, বাবা মা তিন হপ্তার জন্য কেদারবদ্রি তীর্থে গেলেন। আর যাবার আগে থেকেই আমরা কেমন সারা রাত ধরে প্ল্যান করতে মেতে উঠতাম!
—মনে নেই আবার! পুরো তিন হপ্তার করণীয় প্ল্যান হাতের মুঠোয়। কেমন রসিয়ে রসিয়ে সেই দিনকটা চেটেপুটে উপভোগ করেছিলাম মনে আছে?
—হুঁ, তারপর...
—তারপর? হা হা হা
হাসির জলতরঙ্গ বাজছে যেন ঘরের মধ্যে। এমন প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারতো মানুষটা। আর সেবার, সেবার যখন মা বাবা তীর্থ সেরে এলেন, ছেলে একেবারে কেঁচো। বাবা যতো জিজ্ঞেস করেন,
—কি হয়েছে দেবু বল, বৌমার এমন শরীর খারাপ হলো কী করে, কেন এত বমি করছে বাচ্চা মেয়েটা?
ছেলে ততই ভয়ে কাঁটা হতে থাকে। আর মায়ের ঠোঁটের কোণে ততই মিটিমিটি হাসি জড়ো হতে থাকে। আমার মুখে চোখে ভালো করে জলের ঝাপটা দিতে দিতে ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞেস করেন,
—কমাস বন্ধ হয়েছে বৌমা?
আমি উত্তর দেবো কি! লজ্জায় লাল হয়ে মায়ের হাত ছাড়িয়ে এক ছুটে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে যাই। আমার পেছন পেছন মায়ের ছেলেও হাজির। আর তাকে দেখেই লজ্জায় তখন আবেগের বেগ মেশে। ঘুরতে থাকা মাথাটা একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে সেই বুকেই মাথা রাখে।
জীবন্ত খেলনা পেয়ে মণি আর তার টেডিবিয়ারের খোঁজ রাখে না। সারাদিন নতুন খেলনা নিয়েই সময় কাটে। কী সুন্দর চোখ দুটো। যখনই খোলা থাকে মণির দিকে চেয়ে হাসে। খোলা ঠোঁটে খিল খিল হাসি। বন্ধ যখন ঠোঁটের কোণ দিয়ে লালা গড়িয়ে নামে। মা একটা রুমাল দিয়ে রাখে মণির হাতে। মণি সেটা দিয়ে আস্তে করে মুছে দেয় ঠোঁট থেকে গড়ানো লালা। এখন তো বসতেও পারে। অবশ্য প্যারাম্বুলেটারে। মাথাটা হেলে থাকে সিটের গায়ে। মণি প্যারাম্বুলেটার ঠেলেঠেলে গোটা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। আর অজস্র কথা বলে। তার স্কুলের কথা। তার খেলার কথা। তার নতুন বন্ধুর কথা। সে অবাক হয়ে শোনে। কেবলই শোনে। কোনো কথা বলে না। মণি যে এত প্রশ্ন করে তার একটাও জবাব নেই।
মার কাছে তাই কেবলই মণির অভি্যোগ।
—মা, ভাই কেন কথা বলে না?
মণির অভিযোগের কী জবাব দেবে অনুরাধা? মনোরমা অনেক আদর করে নাম রাখলেন সব্যসাচী। এ বাড়ির প্রথম উত্তরাধিকারী। ঠাকুমার আদরের দুলাল। এমন যে কর্মনিষ্ঠ দেবব্রত সেও কেমন ঘরমুখো হয়ে উঠল। যেন নার্সিংহোমে যেতে না হলেই বাঁচে। সমস্ত অবসরটুকু ঢেলে দেয় নতুন অতিথির আদরযত্নে। মণিকে হরেক সাবধানবাণী। নোংরা হাতে ভাইকে ছুঁয়ো না, দেখো ভাই যেন গড়িয়ে না যায়। অনুরাধা মনে মনে হাসে। পোড়ামন হিসেবও কষে সকলের অজান্তে — মণিকেও কি দেবব্রত এমন করে সামলে রাখত? আজও মনে পড়ে মণির সামনে বসে দেবব্রত কেমন উদাস হয়ে যেত। তার টানাপোড়েন আঁচ করতে পারত অনুরাধা। সে বুঝতে পারত দেবব্রত তার দ্বিধাদ্বন্ধগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে আপ্রাণ। কিন্তু মনোরমার তীক্ষ্ণ ঠোঁটে মাঝে মাঝেই ঝরতো বিষ। ফলে আগুন জ্বলে উঠত সংসারে। আজ নতুন অতিথি সমাগমে সেসব স্তিমিত। সকলেই মেতে আছে ছেলেটাকে নিয়ে। আনন্দের হাট বসেছে সংসারে। কিন্তু কমাস পেরোতে না পেরোতেই ধাক্কা লাগল আনন্দহাটে। এবং সেটা এল দেবব্রতর হাত ধরেই।
সেদিন দেবব্রতর বাড়ি ফেরার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেল। মনোরমা ক্রমাগত ঘরবার করছেন। অনুরাধা বোঝাবার চেষ্টা করে,
—মা আপনি একটু স্থির হোন। নিজের নাসিংহোম ছেড়ে রোজই তো আর তাড়াতাড়ি ফেরা যায় না। নিশ্চয়ই কিছু কাজে আটকে গেছে।
—না বউমা, যে ছেলে সন্ধে না হতে হতেই ছেলের টানে ফিরে আসে সে আজ এত দেরি করছে কেন? আমার মন কু গাইছে।
—মায়ের মন অমন করেই থাকে, আপনি অত উতলা হবেন না। আপনার ছেলের ফোন সুইচড্ অফ। আমি পিএকে ফোন করেছিলাম। বলল, স্যার নিজের রুমে কি যেন সব ফাইল নিয়ে ব্যস্ত।
তখন প্রায় রাত এগারটা। মণি বাপি বাপি করে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ল। সব্য তো সেই নটা থেকেই ঘুমিয়ে কাদা। জেগে আছে শুধু মনোরমা আর অনুরাধা। ডাইনিং টেবিলে তাদের খাবারগুলো ক্রমশ ঠাণ্ডা হচ্ছে। দুটো চেয়ার মুখোমুখি। নির্বাক। অনুরাধা ভেতরে ভেতরে উতলা হয়ে উঠছে। কি এমন ফাইল যা নিয়ে এত রাত। অবশেষে কলিং বেল বেজে উঠল। ক্লান্ত ধীর পায়ে একটা ফাইল নিয়ে দেবব্রত এসে পৌঁছল। কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। মনোরমা চেয়ার থেকে উঠে কি একটা যেন বলতে গিয়েও ছেলের রকম দেখে নিজেকে সামলে নিলেন। অনুরাধা দেবব্রতর পিছন পিছন বেডরুমে গিয়ে ঢুকলো।
ফাইলটা ক্যাবিনেটে ঢুকিয়ে রেখে দেবব্রত গিয়ে দাঁড়াল জানলাটার কাছে। কপালে দুঃশ্চিন্তার ছায়া। অনুরাধা কোনো কথা না বলে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল এগিয়ে দিল দেবব্রতর হাতে। এক নিঃশ্বাসে জলটুকু শেষ করেই ঘুরে দাঁড়াল দেবব্রত।
—অনুরাধা...
দেবব্রতর মুখে হাত চাপা দিয়ে মিষ্টি করে হাসল অনুরাধা।
—এখন থাক তোমার ফাইল বৃত্তান্ত। অনুরাধা পালিয়ে যাচ্ছে না। মা অপেক্ষা করে আছেন। আগে চানটা সেরে এসো।
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে এত অসহায় লাগছে কেন? অনুরাধা ফাইল সম্পর্কে এখনও হাসছে। তার কি কোনো ধারণা আছে কি আছে সেই ফাইলে? কী করে কী করে বলব তাকে?
দেবব্রত বাথরুমে ঠুকতেই অনুরাধা ফাইলটা বের করে দেখতে বসল। পেসেন্টের নামটা দেখে চমকে উঠল। অসুখের নামটাও আছে। তবে সেটা তার আওতার বাইরে। সারা ফাইল জুড়ে বিভিন্ন টেস্ট রিপোর্ট। অনুরাধা শুধু এটুকু বুঝলো অসুখটা বেশ শক্তপোক্ত। তবু সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।
বাথরুমের দরজায় টোকা পড়ল,
—একটু শিগগির শিগগির মশাই। এত রাতে অত স্নান করলে অসুখ ডাক্তারকেও ছেড়ে কথা কইবে না।
ডাইনিং টেবিলের পাট চুকল প্রায় নিঃশব্দে। দেবব্রত খেতে বসলেও রাতের অজুহাত দিয়ে প্রায় কিছুই না খেয়ে উঠে গেল। মনোরমাও তথৈবচ। অনুরাধা টেবিল গুছিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখল দেবব্রত জানলার কাছে চেয়ারটায় নিজেকে ঢেলে দিয়েছে। বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। অনুরাধা নিঃশব্দে তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়াল। শুধু এই হাতটুকুর জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল দেবব্রত। হাতদুটো ধরে হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। চমকে উঠল অনুরাধা। এই প্রথম সে কাঁদতে দেখল দেবব্রতকে। তবে কি খুব শক্ত অসুখ? সারানোর বাইরে? অনুরাধার বুকের ভেতর পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে। তবু নিজেকে সামলে মাটিতে বসে মাথা রাখল দেবব্রতর কোলের ওপর। তাকে সামলে নিতে কিছুটা সময় দিয়ে আস্তে আস্তে তার হাতে হাত রাখল।
—অসুখ কি কারো হয় না? তুমি এত ভেঙে পড়ছ কেন?
—এ অসুখের কোনো ওষুধ হয় না অনু।
—কি অসুখ?
—ডাউন সিনড্রোম।
—ফাইলে দেখলাম নামটা। কিন্তু বুঝলাম না।
—জেনেটিক ডিসঅরডার।
—তাতে কী হবে?
—ফিজিক্যাল আর মেন্টাল ডিসএবিলিটি। আমাদের ছেলে আর নরম্যাল হবে না অনু।
আর একবার ধরে এল দেবব্রতর গলা। অনুরাধার চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে এল। নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? যখনই একটু সুখের মুখ দেখেছে তখনই ছোবল দিয়েছে সে। আর কতদূর? দেবব্রতর কোলের ওপর মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ল অনুরাধা। কে কাকে সান্তনা দেয়? দুটো প্রাণ নিঃশব্দে গলছে।
সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না অনুরাধা। ওপাশ ফিরে দেবব্রত। সেই কি ঘুমোতে পারল? তবু দেবব্রতর অবস্থা অনুরাধাকে কিছুটা স্টেবল করে দিল। সকালে উঠে দেবব্রতকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে মাকে কিছু না বলতে ইশারা করল। ছেলে বউকে গম্ভীর দেখে মনোরমাও কোনো কথা পাড়লেন না এই মুহূর্তে। কিন্তু দেবব্রত বেরিয়ে যেতেই অনুরাধাকে ধরে বসলেন মনোরমা,
—কি ব্যাপার বউমা, নার্সিংহোমে কোনো ঝামেলা টামেলা হয়েছে নাকি? দেবু তো কিছুই বলল না। তুমিও এমন চুপ করে থাকলে আমি যাই কোথায়?
মাকে ঠিক কতটা বলবে সেটাই এতক্ষণ মনে মনে হিসেব কষছিল অনুরাধা। যাকে একমাত্র উত্তরাধিকারী ভেবে বসে আছেন, তার সম্পর্কে এমন একটা সংবাদ কতটা নিতে পারবেন সেটাই ভাবছিল কফির মগের দিকে চোখ রেখে।
মনোরমা আবার অস্থির হলেন,
—মায়েদের চিন্তা তো এখন তুমিও বোঝো বউমা, এমন চুপ করে থেকো না।
—মা আপনার নাতির একটা অসুখ ধরা পড়েছে।
—অসুখ?
—হ্যাঁ।
—এই ফুটফুটে ছেলেটার অসুখ? কি অসুখ বউমা? নাম কি? আমাকে সব খুলে বলো।
—নাম শুনে আপনি চিনতে পারবেন না। একরকম জিনের রোগ। শারীরিক আর মানসিক বৃদ্ধি নরম্যাল হবে না।
—কী বলছো বৌমা? আমাদের বংশে কারো তো এ রোগ শুনিনি কখনও।
—এটা জিনের রোগ হলেও বংশগত নয়। এর কোনো ওষুধও নেই।
মনোরমা কেঁদে উঠলেন না। অনুরাধার দিকে কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে চোখটা নামিয়ে নিলেন। অসমাপ্ত চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ধীরে ধীরে যেন নিজেকে টেনে টেনে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
অবেলায় বিছানায় আশ্রয় নিলেন মনোরমা। বালিশে মাথা রেখে চুপচাপ চেয়ে রইলেন জানলাটার দিকে। খরদুপুরেও বাইরেটা অন্ধকার দেখলেন মনোরমা। মানুষ কি নিজের চোখের আলো দিয়ে বাইরের আলো অন্ধকার দেখে? অন্ধকার থেকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল একটা অবয়ব। অবিনাশ। আজ আর জানলায় দাঁড়িয়ে নেই, মনোরমার মাথার কাছে। খুব ধীর স্বরে বললেন,
—এমন গুমরে থেকো না, একটু কাঁদো রমা একটু কাঁদো।
—কান্না যে আজ আসছে না গো, ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে।
—মণির মাকে দোষারোপ করতে পারছো না বলেই কি।
অবিনাশকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ঝেঁঝেঁ উঠলেন মনোরমা,
—কারো দোষ নয়, সব দোষ আমার আমার। এতদিন পর ঘর আলো করে আমার নাতি হল তাও...
বলতে বলতে এতক্ষণ পর কেঁদে উঠলেন মনোরমা। বালিশে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নিজেও জানতে পারেননি। ঘুম ভাঙল একটা খিলখিল হাসির শব্দে। আস্তে করে চোখ খুলে দেখলেন, সব্যর পেরাম্বুলেটার তার বিছানার পাশে। খাটের ধারে ঝুলে থাকা তাঁর আঙুল নিয়ে নিজের মনে খেলছে আর হাসছে। মণি পেরাম্বুলেটারের পেছনে। মনোরমাকে চোখ খুলতে দেখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার দুচোখে,
—ভাই তোমাকে লাঞ্চের জন্য ডাকতে এসেছে।
কথা কটা বলেই পেরাম্বুলেটার ঘুরে ভাই এর একেবারে মুখোমুখি এসে মাটিতে বসল। তারপর দুজনে কপালে কপাল ঠেকিয়ে খিলখিল হাসি। বিজয়ের হাসি। যেন দুজনে মিলে শলা করেছিল মনোরমাকে চমকে দেবার। প্ল্যানমাফিক পুরোটা সমাধা করতে পেরে আনন্দে আত্মহারা।
মনোরমার সবকিছু যেন ঘুলিয়ে যাচ্ছে। মণি কেন বলল না, মা তোমাকে খেতে ডাকছে? মণি এত বড় হয়ে গেল কবে? মণি কি আমার মন পড়তে পারে? সব, সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মনোরমার। আঁচল দিয়ে চোখটা আর একবার মুছে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা রাখতেই মাথাটা কেমন দুলে উঠল। খাটের বাজু ধরার চেষ্টায় হাতটা বাড়ালেন কিন্তু পারলেন না। দুচোখে অন্ধকার নেমে এলো।
ভাইবোনে হাসির জোয়ারে ভাসলেও মণি আড়চোখে আম্মির চমকানো উপভোগ করছিল। আম্মিকে বিছানা ছাড়তে দেখে সেও উঠে দাঁড়িয়েছিল পেরাম্বুলেটার ধরে। হঠাৎ দেখল আম্মি মেঝেতে দাঁড়িয়ে টলছে। ভয়ে সে চিৎকার করে উঠল। ছুট্টে এসে আম্মিকে ঠ্যালা দিতে দিতে বলতে লাগল।
—কী হয়েছে আম্মি, ও আম্মি।
মণির ধাক্কাটা বাঁচিয়ে দিল মনোরমাকে। মাটিতে না পড়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লেন তিনি। মণির চিৎকার শুনে অনুরাধাও ছুটে এসেছেন ততক্ষণে। কোনোরকমে মনোরমাকে বিছানায় শুইয়ে ফ্যানটা ফুলস্পিড করে দিল। জলের জাগ থেকে একটু জল নিয়ে ছিটিয়ে দিল মনোরমার চোখেমুখে। তবু নিস্পন্দ পড়ে রইলেন মনোরমা। রান্নাঘরে ছুটলো অনুরাধা। মোবাইলটা ওখানেই পড়ে আছে।
দেবব্রত যতক্ষণে বাড়ি এসে পৌঁছল ততক্ষণে উঠে বসেছেন মনোরমা। ফোনে দেবব্রতকে অবস্থা বুঝিয়ে বলতে সে যে ওষুধ বলেছিল তাতেই কাজ হয়েছে। ডাক্তারের বাড়ি। অনেক ওষুধই মজুত থাকে বাড়িতে। অনুরাধারও খুঁজে পেতে দেরি হয়নি।
নিজের ঘরে না গিয়ে সরাসরি মায়ের ঘরেই হাজির হলো দেবব্রত। মণি তখনো আম্মির ঘরে। বিছানায় বসে বসে পা দোলাচ্ছে। অন্যমনস্ক হাতে আম্মির শাড়ির আঁচলটা নিয়ে পেরাম্বুলেটারের রডটাতে জড়াচ্ছে। সব্য কখন ঘুমিয়ে গেছে।
মনোরমা পিঠে বালিশ রেখে চোখ বুজে আধশোয়া। চেয়ারটা টেনে মায়ের বিছানার পাশে এসে বসল দেবব্রত। মণিকে বলল,
—ভাই তো ঘুমিয়ে পড়েছে মণি। তুমি বরং মায়ের কাছে ভাইকে নিয়ে যাও।
মণির এখন এঘর ছেড়ে যাবার একটুও ইচ্ছে ছিল না। আম্মির পড়ে যাবার মত এমন একটা মস্ত ঘটনার একমাত্র সাক্ষী সে। তাই ঘটনাটা বাপিকে সবিস্তারে বলার বাসনা। কিন্তু বাপি এমন গম্ভীর কেন?
মণিকে চলে যেতে দেখে মায়ের কপালে হাত রাখল দেবব্রত। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিলেন মনোরমা। ছেলের হাতের স্পর্শে চোখ খুলে তাকালেন। আধশোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আপত্তি করল দেবব্রত। বরং মাকে ধরে সে পুরোপুরি শুইয়ে দিল। পরীক্ষার সরঞ্জাম টেবিলে আগেই হাজির রেখেছিল অনুরাধা। সুতরাং সময় নষ্ট না করে স্টেথো আর প্রেসার মাপার যন্ত্র নিয়ে লেগে পড়ল সে ডাক্তারিতে। কিছুক্ষণ পর তার গম্ভীর মুখ আরো গম্ভীর হয়ে উঠল। ততক্ষণে অনুরাধা দেবব্রতর চা নিয়ে হাজির। শুকনোমুখে জিজ্ঞেস করল,
—কেমন দেখলে?
—প্রেসারটা এখনো বেশ হাই।
—এই তো সেদিন তুমি চেক করলে, বললে নরম্যাল। আজ এত হাই!
মনোরমা তখনো চোখ বন্ধ করে আচ্ছন্নের মত শুয়ে আছেন। দেবব্রত মুখে কিছু না বলে অনুরাধার মুখের দিকে চেয়ে রইল চুপচাপ। অনুরাধা যেটা আঁচ করছিল এতক্ষণ, সেটা কনফার্ম করে দিল দেবব্রতর এই চাহনি।
রাত তখন গভীর। চোখের পাতা বন্ধ থাকলেও ঘুম নামেনি দেবব্রতর চোখে। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে আসে খোলা জানলা্টার কাছে। চাঁদের একফালি এসে পড়েছে আরাম কেদারায়। সেখানেই নিজেকে এলিয়ে দিল দেবব্রত। সারাদিন সে কেবলই চেষ্টা করে চলেছে নিজেকে আর একটু স্বাভাবিক করার। ডাক্তারের সমস্ত যুক্তিগুলো মনে মনে আওড়েছে কতবার। তবু কোথায় যেন ঠিক জোর পাচ্ছে না। কি যেন এক পাথরের ভার বুকের ওপর চেপে বসে আছে।
ঠিক তখনই একফালি চাঁদের গায়ে হাসির আওয়াজ ওঠে —
—কী ভাবছ দেবব্রত?
—আমিই কি দায়ী নই?
—কেন নিজেকে দায়ী করছো?
—আমি কি জানতাম না আমার পঁইত্রিশ বছর বয়স আর প্রথম সন্তানের রিস্ক ফ্যাক্টার?
—জানতে কিন্তু মানতে পারোনি। কারণ মণি,
—মণি!
—হ্যাঁ। তুমি আজও ওকে তোমার ভাবতে পারোনা। তাই ঝুঁকি নিয়েও আপন ঔরসে...
—চুপ করো চুপ করো প্লিজ, আমি আর শুনতে পারছি না...
পাশ ফিরতে গিয়ে শূন্য বিছানায় হাত পড়ে যায় অনুরাধার। ঘুম ভেঙে উঠে বসে বিছানায়। জানলার কাছে আরামকেদারায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে দেবব্রত। একফালি চাঁদের আলো খেলা করছে কপালে। ঠোঁট দুটো নড়ছে। কি যেন বিড়বিড় করছে সে। অনুরাধা থমকে যায়। নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ায়। আলতো হাত রাখে দেবব্রতর কপালে। চোখ মেলে তাকায় সে।
বুকের ভেতর তোলপাড় হলেও খুব স্বাভাবিক গলায় অনুরাধা জিজ্ঞেস করে,
—তুমি কি কাল নাসিংহোমে যাবে?
দেবব্রত মাথার পিছন থেকে হাত দুটো নামিয়ে এলিয়ে দেয় হাতলের ওপর। অনুরাধার মুখের দিকে ঘোলাটে চোখে চেয়ে বলে,
—আমি খুব ক্লান্ত অনুরাধা.
কিছু বলে না অনুরাধা। দেবব্রতর চুলের ভেতর তার আলতো আঙুল বিলি কা্টে। দুটো মানুষকে ঘন হয়ে আসতে দেখে একফালি চাঁদ সরে সরে যায়। পাশের চেয়ারে অনুরাধা বসলে তার কাঁধে মাথা রাখে দেবব্রত। একটু আশ্রয় একটু শুশ্রূষা চাইছে ক্লান্ত একটা মানুষ। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে কত কথা পারাপার করে প্রাণ থেকে প্রাণে।
তখন সকাল অনেকটা গড়িয়ে গেছে। দেবব্রতর ঘুম ভাঙল একটা আদুরে গলার বকুনিতে। চোখ খুলতেই মণির মুখোমুখি। বারান্দায় প্যারাম্বুলেটারের সামনে বসে তর্জনী তুলে বকছে,
—এটা ইন্ডেক্স ফিঙ্গার, ধরো আঙুলটা ধরো। আহ্, মুখ বন্ধ রাখতে বলেছি না। আবার লালপোষটা ভেজালে।কী যে করি আমি...
মায়ের অনুকরণে বকতে বকতে আর একটা লালপোষ বের করে প্যারাম্বুলেটারের নিচ থেকে। ভেজাটা পালটে দেয় যত্ন করে। আর ঠিক তখনি চোখাচুখি হয়ে যায় দেবব্রতর সঙ্গে। বাপির ঘুম ভেঙেছে দেখে একছুটে কাছে পৌঁছে যায়। দেবব্রত দুহাত বাড়িয়ে দেয় মণি্র দিকে। কিন্তু বিছানার কাছে এসেও মণি আবার ফিরে যায় বারান্দায়। প্যারাম্বুলেটারটা আস্তে আস্তে সরিয়ে নিয়ে আসে বিছানার কাছে। তারপর ধরা দেয় দেবব্রতর বাড়ানো হাতে। অশান্ত বুকের ওপর মণিকে জড়িয়ে ধরে দেবব্রত। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিতে থাকে তার মুখ। জমা কষ্টটা গলে গলে যায় নরম কোমল স্পর্শে।
আর ঠিক তখনি সরু কান্নাটা বেজে ওঠে পাশ থেকে। এক ঝটকায় উঠে বসে মণি। লাফিয়ে খাট থেকে নেমে ভাইয়ের গালদুটো ধরে আদুরে গলায় বলে ওঠে,
—কাঁদে না সোনা কাঁদে না প্লিজ, এই তো আমি।
কান্না বন্ধ হয়না দেখে প্রথমে একটু অসহায় বোধ করে মণি। কিন্তু ডিসিশান নিতেও দেরি হয় না বিশেষ। দেবব্রতর দিকে চেয়ে মণি আদেশ করে।
—বাপি, ভাইকে একটু তুলে দাও তো বিছানায়।
প্যারাম্বুলেটারের বেল্ট খুলে আস্তে আস্তে ছেলেকে বিছানায় নিজের কোলে নিয়ে বসে দেবব্রত। আর মণি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে সারাদিন ভাই কখন হাসে, কখন কাঁদে তারই ফিরিস্তি দিতে থাকে বাপিকে। তার আঙুল নাড়ার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কান্না ভুলে আবার খিলখিল হেসে ওঠে ছেলেটা। দুটো তাজা শিশুপ্রাণের মাঝে বসে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে থাকে দেবব্রত।
—তোর ওই আঙুলটা দিয়ে আমার অন্ধকারটা মুছে দে মণি... তোর ওই আলোটা আমাকে একটু দিবি মণি... আমি বড় ক্লান্ত মামণি...
অনুরাধা চুপচাপ বিছানার কাছে পৌঁছে দেবব্রতর কপালে হাত রাখে। গা টা একটু ছ্যাঁকছ্যাঁক করছে। চোখ খুলে অনুরাধাকে দেখে একটু যেন লজ্জাই পায় দেবব্রত। অনুরাধা ছেলেকে কোলে তুলে নিতেই সে বালিশে মাথা দিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে।
ছেলেকে প্যারাম্বুলেটারে বসিয়ে দিতে দিতে অনুরাধার আদেশ জারি হয়ে যায়,
—আজ আর নার্সিংহোমে যাবার নাম কোরো না ডাক্তারবাবু। শুধু ঘুম।
মা ভাইকে বসিয়ে দিতেই মণি বেল্ট লাগিয়ে দেয় ছোট্ট অথচ পাকা হাতে। তারপর মায়ের আদেশটাই আর একবার নিজের আদুরে গলায় ঝালাতে থাকে।
—বাপি, কথাটা কানে গেল? আজ আর নার্সিংহোম নয়, শুধু ঘুম। বিছানা থেকে যদি একবার নামো, দেখো আমি কি করি...
মেয়ের শাসন শুনে হেসে ফেলে অনুরাধা —
—আর বকতে হবে না, এবার যাও দেখি। ব্রেকফাস্ট শেষ করে তৈরি হও। স্কুলে যেতে হবে তো নাকি!
ঠাকুরের বেদিটা মুছতে মুছতে হাত থেমে যায় মনোরমার। পিঠের ওপর কার যেন দৃষ্টি তাঁকে আনমনা করে তোলে। মুখ ফিরিয়ে দেখেন ঠাকুরঘরের এককোণে ঝুলে থাকা ফটো থেকে নেমে এসেছেন অবিনাশ।
—বউমার বারণ সত্ত্বেও সিঁড়ি ভাঙলে এই শরীরে?
—আমার কি আর তোমার মতো সুখী শরীর যে একটুতেই টসকাবে? মরণ হলে বাঁচি।
—আহা, মরণকে ওভাবে ডাকতে নেই। তোমার এখন ভরা সংসার, মরবে কেন?
—নাতির মুখের দিকে চাইতে পারিনা গো। কী সেই পাপ যার প্রায়শ্চিত্ত করতে এতখানি শাস্তি দিল আমার গোপাল...
মনোরমার গলার কাছে কী যেন আটকে আসে। কথা বলতে পারেন না আর। চোখ উপচে জল পড়ে ঠাকুরের বেদিতে।
—এভাবে ভেঙে পোড়ো না মনো। নিজেকে শক্ত করো। পাপ বলে কিছু নেই মনো। নিজের ভেতরে ডুব দিয়ে দেখো মনের সুতোর ভুল বুননে জট পড়ে গেছে কখন জানতে পারোনি। এবার ধীরে সুস্থে জট ছাড়িয়ে দেখো জীবন কত সুন্দর।
নিচে থেকে অনুরাধার গলা ভেসে আসে,
—মা, আপনি কি আবার ঠাকুরঘরে উঠেছেন? এত করে বারণ করলাম, তবু সেই...
অনুরাধার গজগজানি মনোরমার কান অবধি পৌঁছয় না। নিঃশব্দে চোখের জল গড়িয়ে যাচ্ছে ঠাকুরের বেদিতে। কে যেন ডুবুরি নামিয়েছে তাঁর মনের গভীরে। বিভোর মনোরমা জানতে পারলেন না কখন মণি এসে দাঁড়িয়েছে ঠাকুরঘরের দরজায়।
আর দরজায় দাঁড়ানো মণির অবস্থা তথৈবচ। মায়ের নির্দেশে সে এসেছে দেখতে আম্মির পুজো শেষ হলো কিনা। কিন্তু এ কি! পুজো কোথায়? ঠাকুরের বেদিতে মাথা রেখে আম্মি কাঁদছে অঝোর ধারায়। জলের রেখা বেদি উপচে নিচে গড়িয়ে যাচ্ছে সমানে। সে কখনো আম্মিকে কাঁদতে দেখেনি। অবাক হয়ে চেয়ে রইল কিচ্ছুক্ষণ। কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কি আর মণির কম্ম! সে পা টিপে টিপে ঢুকে পড়ল ঠাকুরঘরে। আম্মির পাশে বসে তার ছোট্ট হাতটা খুব আলতো করে রাখল আম্মির পিঠের ওপর।
মুখ তুলে চাইলেন মনোরমা। ঘোরের মধ্যে দেখলেন যেন বেদি থেকে নেমে এসেছেন তাঁর গোপাল। অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন মণির দিকে। তারপর দুহাত বাড়িয়ে মণিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন আবার।
বুকের মধ্যে নরম স্পর্শে উত্তাল হৃদয় কিছুটা শান্ত হলে মণির কপালে একটা চুমো এঁকে পাশে বসালেন। ঠাকুরের বেদিটা আবার মুছতে মুছতে ভাবতে লাগলেন, এ কীসের কান্না? নিজেই নিজের কাছে অবাক হয়ে যাচ্ছেন যেন মনোরমা।
এদিকে মণি পড়েছে বিপাকে। তাকে আম্মি কোলে নিয়েছেন এমন ঘটনা তার স্মৃতিতে নেই। তার ওপর কান্নাকাটি চুমোচুমি! সে বেচারি কী যে করবে আর কী যে বলবে কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারে না। এদিকে সব্বাই বলে মণি নাকি কথার জাহাজ।
ফুল দিয়ে গোপালকে সাজাতে সাজাতে মনোরমা প্রশ্ন করেন মণিকে,
—আমি যখন থাকবো না তখন ভাইকে দেখবে কে?
—কেন, আমি দেখব।
—তুমি তো স্কুলে যাবে, কলেজে যাবে, চাকরি করবে, ভাই তখন কার কাছে থাকবে তাই ভাবছি।
—এটা তো ভাবা হয়েই গেছে। আমি আর মা একটা প্ল্যান করেছি ভাইকে নিয়ে।
—প্ল্যান!
শব্দটা শুনে নড়ে উঠলেন মনোরমা। নাতির কোনোকিছুই নরম্যাল পথে হবার নয়, এ কথাটা আবার নতুন করে মনে পড়ল।
এদিকে প্ল্যানের কথাটা আম্মিকে বেশ রসিয়ে বলার জন্য ছটফট করছে মণি। কিন্তু আম্মিকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে মুখ খুলতে ভরসা পায় না বেচারি। তার পুতুলের খেলাঘরের ছোট ছোট প্লেটের মতো কাঁসারের প্লেটে আম্মি বাতাসা দিচ্ছে গোপালকে। দেখতে দেখতে তার মনে হঠাৎ প্রশ্ন ওঠে,
—গোপালও কি আমার পুতুলের মতো চোখ দিয়ে খায়?
পুতুলের জন্মদিনে মা ছোট্ট ছোট্ট নারকেল নাড়ু গড়ে দেয়। সেগুলো পুতুলের প্লেটে দিলে সেও তো দৃষ্টি দিয়েই খায়। পুতুল যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তাকে বিছানায় শুইয়ে সে নিজে ওই নাড়ুদুটো খেত। এখন অবশ্য নাড়ু খাবার পার্টনার জুটেছে। নিজে একটা নেয় আর অন্যটা দেয় ভাইকে। আর নাড়ু হাতে পেয়ে ভাই কেমন হেসে ওঠে ভাবতে গিয়েই আনন্দে খিলখিল হেসে ওঠে মণি।
মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করছিলেন মনোরমা। মণির হাসির গমকে চমকে ওঠলেন। তারপর ঠাকুরের প্রসাদ দিলেন মণির হাতে।
বাতাসা মুখে দিয়েই মণির হঠাৎ মনে পড়ে যায় আম্মির কথাটা,
—তুমি কেন বললে থাকবে না? কোথায় যাবে?
—বুড়ো হচ্ছি তো, একদিন আকাশের তারা হয়ে যেতে হবে।
—তাহলে গোপালের পুজো করবে কে?
—কেন, তুমি করবে।
—করতেই পারি। পুতুলের সঙ্গে গোপালের বেশ মিল আছে।
মণির সরল উত্তরে মনোরমা ধাক্কা খেলেন অন্তঃস্থলে। মেয়েটার মুখ দিয়ে গোপালই কি শুনিয়ে দিতে চাইছে মনোরমাকে? যে মেয়েটাকে দুচোক্ষে দেখতে পারতেন না আজ সেই দাঁড়িয়েছে তাঁর পরিত্রাতার ভূমিকায়!
নিজেকে আরো একটু গুছিয়ে নিয়ে মণিকে প্রশ্ন করলেন,
—ভাইকে নিয়ে তোমার প্ল্যানের কথাটা বললে না তো!
—ভাই তো এবার স্কুলে যাবে, কিন্তু আমাদের স্কুলে পড়তে পারবে না। তাই ওকে মা সূর্যোদয়ে ভর্তি করবে বলেছে।
মণির স্কুলে না হয়ে সূর্যোদয়ে কেন একথাটার গভীর মর্মোদ্ধার করেও প্রশ্নে ভাসলেন মনোরমা,
—কেন তোমার স্কুলে নয় কেন?
—বারে! ওখানে যে ওকে নিয়ে সব্বাই হাসবে, মজা করবে। যেমন ওই ঘোষবাড়ির মন্টাই এসে করে।
—মন্টাই বড় ডেঁপো মেয়ে।
—জানো আম্মি, ও এলেই আমার এমন রাগ ধরে যে মনে হয় এক ঘুঁষিতে ওর নাকটা ফাটিয়ে দিই। শুধু সঙ্গে ওর মা থাকেন বলে পারিনা।
— সূর্যোদয়ে ভর্তি হলে ভাইয়ের ভালো লাগবে?
—লাগবেই তো! মা বলেছে, ওখানে ওর অনেক বন্ধু হবে। সব্বাই ওকে খুব ভালোবাসবে।
মণির ভালোবাসার পাঠ শুনতে শুনতে আনমনা মনোরমা আরেকবার নিজের মধ্যে ডুব দেন। কী যেন হাতড়ে ফেরেন। ভালোবাসাই কি?
নিচে থেকে অনুরাধার উচ্চকণ্ঠ ভেসে আসে,
—মণিইইই... স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আম্মিকে নিয়ে নিচে এসো।
দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এল অনুরাধা। ছেলেমেয়ে দুটোও কত বড় হয়ে গেল। সেই ছোট্ট ছটফটে মণি আজ গম্ভীর অথচ যৌবনে ছলছল ষোড়শী। আর সব্যও মণির তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠছে তরতর করে। সূর্যোদয়ে ভর্তি হয়েছে সব্য। তাঁরা মেন্টালি চ্যালেঞ্জড বাচ্চা এবং তাদের মা-বাবা নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া করেছেন বটে, কিন্তু সব্যর মতো কেস জীবনে দেখেন নি। বাবা-মা তার আছেন বটে, কিন্তু তার দিদি মণিই যেন তার গার্জেন।
পেরেন্ট টিচার্স মিটিং-এ বাবামায়ের সঙ্গে মণিও হাজির। ঠিক কোন জায়গায় সব্যর প্রবলেম হচ্ছে এটা সে মন দিয়ে শোনে। সেটা অক্ষর পরিচয়ে হোক, কোনো গেম-এ হোক বা হাতের কোনো কাজ। শিক্ষকেরা হার মেনে গেলেও মণি হার মানতে শেখেনি কখনো। রাতদিন লেগে থেকে ঠিক শিখিয়ে ফেলে সব্যকে। আর সব্যটাও তেমনি। দিদির কথা বেদবাক্য। দিদি বকুক মারুক তবু শিখতে চেষ্টা করে আপ্রাণ। না পারলে কেঁদে ভাসায়। প্রথম প্রথম মণি এই কান্নার রহস্য বুঝতে পারত না। অনুরাধা ছুটে এলে মণির অপরাধী মুখ নজরে পড়ত। তাকেই তখন বোঝাতে বসতে হত, অপরাধ মণির নয়, এটা ভাইয়ের অপারগতার কান্না। এই গেমটা ওর পক্ষে কঠিন হচ্ছে, নাইবা শিখল! এভাবেই একটু একটু করে সময়ের চাকায় বেড়ে উঠছে দুটোতে।
সব্য যখন পিয়ানোয় সুর তোলে সূর্যোদয়ের শিক্ষকেরাও অবাক চোখে চেয়ে থাকেন। এই পিয়ানো রহস্যের পিছনেও মণির কারসাজি। তখন কত ছোট। নিজের গানের মাস্টারকে একদিন ধরে বসলো সব্যকেও গান শেখাতে হবে। ভদ্রলোক পড়লেন বিপাকে। শুরু হল সব্যকে হারমোনিয়ামের রিড চেনানো। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে মণি পড়ে রইল সব্য আর হারমোনিয়াম নিয়ে। নিজের গান প্র্যাকটিশ শিকেয় তুলে ভাইকে সারেগামা শেখাতে তুমুল উৎসাহ। ক্রমে শিখিয়েও ফেলল। এবার গান বাজানোর আবদার। মণি গাইবে আর সব্য বাজাবে। কিন্তু চাইলেই সব কিছু পাবে জীবনটা তো এমন নয়। মণিকে মানতে হল সব্যর অন্তরায়। মাস্টার বললেন হারমোনিয়াম সব্যর পক্ষে শক্ত হবে, ওকে পিয়ানো বাজানো শেখানো হোক, যেখানে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সেট করা যাবে। ফলত সুর মেলাতে তার সুবিধে হবে। সেই শুরু হল সব্যর পিয়ানো। সময় লাগলেও ছেলেটা শিখে ফেলল। হয়ত মণির মত পারে না। তবু সে যখন সূর্যোদয়ের ফাংসানে বসে বাজায়, সকলেরই গর্বে বুক ভরে যায়। স্টেজ থেকে নেমে সে সোজা যাবে দিদির কাছে। আলতো হেসে জিজ্ঞেস করবে,
—একদম!
বড়ো সেন্টেন্স বলতে পারে না বটে, কিন্তু তার একটা দুটো শব্দেই মণি বুঝে যায় সব কিছু। সব্য বুঝি হাঁ করলেই মণি বুঝতে পারে সে কি বলতে চায়! অনুরাধা অনেকদিন হল পুরোনো অফিসে ইস্তফা দিয়ে সূর্যোদয়ে শিক্ষকতার কাজ নিয়েছে। অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সব্যর বড় হয়ে ওঠাটা যেন সে নিজের চোখে পরখ করতে চায়। অথচ তাদের পেরেন্টস্রা বুঝতেও পারেন না অনুরাধা এই ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে কারোর মা।
মণি কি আর শুধু সব্যর গার্জেন? সে এখন আম্মিকেও শাসন করে পদে পদে। হার্ট অ্যাটাক হবার পর থেকেই ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন মনোরমা। গোপালও নেমে এসেছে মনোরমার ঘরে। প্রথমদিকে দেবব্রত দিনে রাতে দুটো আয়ার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু দেখা গেল রাতের আয়া এমন নাক ডাকিয়ে ঘুমোয় যে রাতবিরেতে দরকার পড়লে তাকে জাগাতেই মনোরমার অবস্থা কাহিল। আয়া পালটেও যখন কাজ হল না তখন মণি এসে দাঁড়াল অনুরাধার রান্নাঘরে,
—মা, আমার খাটটা নিচে নামিয়ে দাও।
সব্যর রাতের খাবার রেডি করছিল অনুরাধা, অন্যমনস্ক স্বরে জবাব দিল,
—কেন? নিচে না নামলে ঘুম হচ্ছে না বুঝি?
এইবার মণির গম্ভীর গলা শুনতে পাওয়া গেল,
—আমার ঘুমের থেকে আম্মির ঘুমটা বেশি জরুরি।
মেয়ের স্বরে নিজের মধ্যে ফিরে এল অনুরাধা,
—রাতে আম্মি কিন্তু কয়েকবার ওঠে, সামলাতে পারবি তো?
—না পারার কিছু নেই।
রায় দিয়ে মণি চলে গেল নিজের কাজে। অনুরাধা মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলেন চুপচাপ। নিজেই নিজের কাছে বিস্মিত যেন। মেয়েটা এত বড় হয়ে গেল কবে?
তো মনোরমার ঘরেই মণির খাট পাততে হল অনুরাধা্কে। যে মনোরমা মণিকে দুচোখের বিষ দেখতেন, সেই মণিই এখন তাঁর চোখের মণি। গোপালের বেদি ফুল দিয়ে সাজাবে কে? মণি। ঠিকসময়ে তাঁর ওষুধ দেবে কে? মণি। সব্যর স্কুলের ফিরিস্তি দেবে কে? মণি। রাতবিরেতে বাথরুম যাবার দরকার হলে লাঠিটা এগিয়ে দেবে কে? মণি...
অনুরাধার রান্নাঘর এবং ডাইনিং টেবিল দোতলায়। মনোরমার ঘরে তাঁর খাবার জন্য ছোট টেবিল পেতেছিল অনুরাধা। কিন্তু একা ঘরে বসে কবেই খেয়েছেন মনোরমা? মুখ বুজে গলাদ্ধকরণ করতে তাঁর একেবারেই ভালো লাগে না। তাই বেশিরভাগ দিনই খাবার খাওয়া হত না ঠিকমত।
সেদিন রাতে ডাইনিং টেবিলে দেবব্রতকে মায়ের খাওয়া নিয়ে নালিশ করছিল অনুরাধা। কথাটা কানে যেতেই রুখে দাঁড়াল মণি,
—আচ্ছা মা, তুমি আমাদের সবাইকে একসঙ্গে খেতে দাও কেন?
—বাহ্, খাওয়াটা তো একসঙ্গেই ভালো লাগে।
—আর আম্মির?
অনুরাধারা চুপ করে গেল। এ মেয়ের সঙ্গে সেও যেন পেরে ওঠে না আজকাল। পরের দিনই মনোরমার খাওয়ার ছোট টেবিল পালটে বড় করতে হল। সব্যকে নিয়ে মণি এখন আম্মির সঙ্গেই খায়। প্রথমদিকে মনোরমা দু একবার ক্ষীণ আপত্তি করলেও মণি কথাটা কানে তুলল না। হাসি গল্পে মাতিয়ে রাখল আম্মির ডাইনিং টেবিল।
এই মণিকে পেয়ে অবিনাশকে হারিয়েছেন মনোরমা। সে প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। ছেলেমেয়ে দুটোর তারুণ্যে যেন বা ভুলেই যান নিজের একাকিত্ব। আবার নতুন করে জড়িয়ে পড়ছেন সংসার মায়ায়।
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)