ড. সলিম আলি
ভারতের পক্ষীবিদ্দের মধ্যে সলিম আলির নাম সবার চেয়ে ওপরে। তিনিই এদেশে পাখিদের সম্বন্ধে
বিজ্ঞানসম্মতভাবে গবেষণা, নামকরণ ও সংরক্ষণের কাজ প্রথম শুরু করেন। ভারতে তাঁর নামে অনেক বিজ্ঞান বিভাগ ও গোষ্ঠী আছে। দুটি সংরক্ষিত পার্কে তাঁর নাম যুক্ত। একটি গোয়ায়, পাঞ্জিমে এবং দ্বিতীয়টি কেরালার, পাহাড়ি অঞ্চলে।
কেরালা প্রদেশটি প্রাকৃতিক সংরক্ষণ, আবহাওয়া দূষণ, ইত্যাদি সম্বন্ধে খুবই প্রগতিশীল। কোচি শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি পুরোপুরি সোলার পাওয়ারে (সৌরশক্তি) চালিত। ভারতে একমাত্র উদাহরণ এইটিই। এছাড়াও প্রদেশটি বেশ সচ্ছল, রাস্তাঘাট পরিষ্কার ও সুগম। ভিখারি-টিখারির বালাই নেই। অনেকেই দুবাই ও অন্যান্য পেট্রলধনী দেশে চাকরি করে দেশে টাকা এনেছেন। এখন তো ওখানে বাংলাদেশিদের ভিড়। সবাই মধ্যপ্রাচ্যে টাকার খোঁজে ছুটছে।
ভারতের সব প্রদেশগুলির মধ্যে কেরালাই আমার প্রিয়। বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক মিল। খাবারের মধ্যে ভাত ও মাছের প্রাধান্য, চারিদিকে সরস, সবুজ জলাজঙ্গল, কলা ও নারকোল গাছের ছড়াছড়ি। ঠিক বাংলার গাঁয়ের দৃশ্য। তাছাড়া কম্যুনিজমপ্রীতি তো আছেই।
বেশিরভাগ ভ্রমণার্থীরা কেরালায় আসেন সমুদ্রতীর উপভোগ করতে — কোভলম্ তো সদ্যবিবাহিতদের প্রিয় হনিমুনের জায়গা। ইদানীং দ্বিতীয় আকর্ষণ হয়েছে হাউস বোটে নদী, নালা, খাল, বিল ('ব্যাকওয়াটার') ভ্রমণ। কেরালার পশ্চিমতটে এরকম খাল, বিল প্রচুর। তীরে তীরে বেশ সুন্দর বাড়ীঘর। ছোট ছোট গাঁ, চারিদিকে সবুজ বনানী। আশির দশক থেকে ব্যাকওয়াটার ভ্রমণ খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নৌকাগুলিও সুন্দর, শোবার ঘর, কিচেন, বাথরুম সবকিছু আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন। খাবারও খুব মুখরোচক। এটা উত্তরে কাশ্মীরে হাউসবোটে লেক-ভ্রমণের মতই। কিন্তু কাশ্মীরে যুদ্ধ হাঙ্গামায় ট্যুরিস্টের সংখ্যা কমে যাওয়ায় দক্ষিণে কেরালায় এর জনপ্রিয়তা বেড়ে উঠেছে। হয়তো সব হাউসবোট কোম্পানি দক্ষিণেই চলে এসেছে।
পশ্চিমঘাট পর্বতমালা যাবার পথে
সমুদ্র ও ব্যাকওয়াটার ছাড়াও কেরালায় আছে দর্শনীয় পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ও তার কোলে অসংখ্য নদী, জঙ্গলে জলপ্রপাত, সুন্দর ছবির মত গ্রাম, কফি ও চা বাগানের চিকন সবুজ কার্পেট। এতসব সত্ত্বেও পাহাড়ের দিকে ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ কম। একমাত্র ব্যতিক্রম আমার মতো পক্ষীপ্রেমীরা। সারা ভারতে একমাত্র কেরালাতেই পক্ষীপ্রেমী ও পক্ষীসংরক্ষণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বেশ কাকতলীয় ভাবেই কোচিতে একদল পক্ষীপ্রেমীদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল। মহা আনন্দে আর সব প্ল্যান বাতিল করে ওঁদের সঙ্গে পুরো একটা দিন কোচির কাছেই জলাজঙ্গলে (কদমকুডদী অঞ্চল) ঘুরে বেড়ালাম। ওঁরা বছর শেষে মরশুমি পাখিদের সংখ্যা গণনা করছিলেন। আমিও জুটে গেলাম ও অনেক নতুন পাখির দর্শন পেলাম।
বক (Egret)
ডিসেম্বর মাসে পরিযায়ী পাখিতে কেরালার জলাজঙ্গল ভরপুর। ব্যাকওয়াটারের জলের ধারে দুধসাদা বক, সারস, বুনো হাঁসের দল, মাছ ধরায় ব্যস্ত মাছরাঙা ও পানকৌড়ি, নীল আকাশে ব্রহ্মিণী চিল, গাছের ডগায় ও ঝোপঝাড়ে বুলবুলি, গাঙশালিক, ছাতার ও ফিঙে, আরও কত পাখির ওড়াওড়ি আর ডাকাডাকি। একটা জলাভূমির পাখি ক্রেক (Baillon’s Crake) আমি আগে কখনো দেখিনি।
মাছরাঙা
বুলবুলি
ছোট্ট মেটে রঙের পাখি, জলের ধারে লম্বা ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। বাইরে আসতে দারণ অনিচ্ছা। তার ফোটো তুলবার জন্য ঘন্টাখানেক ধৈর্য ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। (পাখি দেখা অনেক সময়েই অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা) অবশেষে শ্রীযুক্ত ক্রেক দয়া করে এক-পলক দর্শন দিয়েই আবার অদৃশ্য হলেন। আমরাও সবাই ধন্য হলাম।
ক্রেক
পুবদিকে পশ্চিমঘাট পাহাড় কেরালা ও তামিলনাড়ু প্রদেশের সীমান্তে। এখানে সব থেকে বড় নদীর নাম পেরিয়ার।
পেরিয়ার নদীবেশ গুরুগম্ভীর, বিরাট নদী। শীতের সময়েও বেশ জল। বর্ষায় আকছার নৌকাডুবি হয়। পেরিয়ারের সাতটি শাখা--পাহাড়ে এখানে ওখানে বেশ দর্শনীয় জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে।
ভূতখানকেতু ব্রিজ
পেরিয়ার নদীকে পোষ মানাতে সম্প্রতি একটা বাঁধ তৈরি হয়েছে। জায়গাটার নাম ভূতখানকেতু। ‘ভূত’ অর্থ ‘দৈত্য’ মালয়ালী ভাষায়। পুরাকালে দৈত্যেরা নাকি রাতের অন্ধকারে নদীতে বাঁধ দিয়ে পাশের এক শিবমন্দির ডোবাবার পরিকল্পনা করেছিল। তার জন্য বিরাট বিরাট পাথরের চাঁইও জোগাড় করেছিল। কিন্তু ভগবান শিব আগে থেকেই জানতে পেরে রাত থাকতেই মুরগির শব্দ করে সূর্যোদয় ঘোষণা করেন ও দিনের আলোয় দৈত্যরা কাজ অসমাপ্ত রেখে পালিয়ে যায়। কাছাকাছি একটা ছোট্ট শিবমন্দিরও চোখে পড়লো।
শিবমন্দির
পেরিয়ার নদীর তীরে আমাদের পাখি দেখার লজটির নাম ‘হর্নবিল লজ’। পাহাড়ের কোলে মুন্নার শহরের কাছে, থাটেকাড (Thattekad) জেলার অন্তর্গত। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। পথে পড়ে অনেকগুলো চা-বাগান। আমি কখনো চায়ের ফুল বা ফল দেখিনি। তাই ছবি দিলাম। এছাড়াও আছে বিরাট বিরাট রাবার গাছের বাগান ও ইদানীং বাজারপ্রিয় পাম গাছের চাষ — যা থেকে তেল তৈরি হয়। এসবই খুব লাভজনক। পাম থেকে দিশী মদও তৈরি করে। কেরালা ড্রাই স্টেট। মদের কেনেবেচা নিষেধ। কিন্তু গ্রাম জঙ্গলে এই দিশী মদের কারবার বেশ চলছে দেখলাম। খেতেও মন্দ নয়। কোনো পচাগন্ধ নেই। অনেকটা রাম-এর মতই স্বাদ।
হর্নবিল লজ
হর্নবিল লজটা একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। আশেপাশে কোনো শহর বা গাঁ নেই। একপাশে পেরিয়ার নদী, ওপারে খাড়া উঠে গেছে পশ্চিমঘাট পাহাড়। নদীর কূলে কূলে ও ক্যাম্পের চারপাশে নানারকম পাখির কূজন। এদের দেখতেই পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে দর্শকরা এখানে আসেন। লজে বিদেশী পক্ষিপ্রেমীদের সংখ্যাই বেশি দেখলাম। ক্যাম্পে খাওয়ারদাওয়ার ব্যবস্থা বেশ ভালোই। সকাল বিকেল গাইডের সঙ্গে পাখির খোঁজে ঘোরাঘুরি। এছাড়াও আছে অনেকগুলো সাইকেল। যে কোনো একটায় চেপে যতদূর ইচ্ছা ঘুরে বেড়ানো যায়। নদীর জন্য আছে অনেকগুলো কায়াক বা ছোটো নৌকা। কিন্তু পেরিয়ারের মত নদীতে একা একা চালাবার সাহস হল না।
Bittern
আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল সলিম আলি (থাটেকাড) বার্ড স্যাংচুয়ারী। আমাদের লজ থেকে মাইল খানেক দূরত্বে। গোড়া থেকেই আমি সলিম আলির ভক্ত। তাঁর লেখা “Birds of India” ভারতীয় পাখি সম্বন্ধে প্রথম বই আর ঐ বই দিয়েই আমার পাখিবিদ্যায় হাতেখড়ি। এখন তো অগুনতি বই ও আন্তর্স্থল (ওয়েবসাইট) দেখা যায়। কুড়ি বছর আগেও ঐ একটাই বই ছিল সারা ভারতে।
সলিম আলি সারাজীবন পাখি সংরক্ষণের কাজ করে গেছেন। বিশ্ববিখ্যাত কেওলাদেও (বা ভরতপুর) বার্ড স্যাংচুয়ারী তাঁরই চেষ্টায় তৈরি। এজন্য তাঁকে পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ উপাধিও দেওয়া হয়েছে। আমার খুব ইচ্ছা ছিল তাঁর প্রিয় জায়গা থাটেকাডের পাখি দেখার জন্য। আমার কাছে সলিম আলি বার্ড স্যাংচুয়ারী একরকম তীর্থই।
কিন্তু জায়গাটার অবস্থা ও ব্যবস্থা একটু হতাশাজনক। প্রথমত: এর খোঁজ পাওয়াই মুশকিল — বেশিরভাগ স্থানীয় লোকেরা এর নাম জানে না ও উলটোপালটা নির্দেশ দেয়। এমনকি কোচিতে আমার মালয়ালী বন্ধুরাও বললেন ‘ওখানে পাখি নেই’ বা ‘ওটা তো বন্ধ হয়ে গেছে’ ইত্যাদি। ইন্টারনেটেও বেশি বর্ণনা নেই। অনেক সময় সলিম আলি ও থাটেকাড নাম দুটোই গুলিয়ে যায়। তা-ও হয়তো ভুল ধারণার আরেক কারণ। আমার ধারণা ছিল সবাই এর নাম জানবে কিন্তু আসলে তা একেবারেই নয়।
Salim Ali Bird Trail
আরেকটা জিনিষ দেখে খুব মনখারাপ হল। স্যাংচুয়ারী পার্কের সামনেই সাইনবোর্ডে লেখা ‘সলিম আলি বার্ড স্যাংচুয়ারী ট্রেল’। কিন্তু ট্রেল (Trail) বানান ভুল করে ট্রায়াল (Trial) বানিয়ে দিয়েছে। যেন পাখিদের পরীক্ষা বা বিচার হচ্ছে। কিছু কিছু বিদেশী পর্যটকরা একটু হাসাহাসিও করলেন। আমার খুব খারাপ লাগলো। পারলে একটা ব্রাশ ও পেন্ট নিয়ে আমি নিজেই বানানটা শুধরে নিতাম। পরে অবশ্য আমি আমার কোচিতে পাওয়া নতুন বন্ধুদের এ বিষয়ে জানিয়েছি। আশা করি কাজ হয়েছে বা হবে।
ধনেশ পাখি
এসব সত্ত্বেও ট্রেলটা কিন্তু ভারী সুন্দর। একটা জলাশয়ের পাশ দিয়ে গেছে। দুধারে বাঁশ, সেগুন ও অন্যান্য নাম-না-জানা গাছপালায় ঢাকা। প্রধান রাস্তায় একটু বেশি ভিড় আর পিকনিকরত ছেলেমেয়েদের হল্লা। কিন্তু একটু দূরে গেলেই নিঝুম শান্তি--শুধু পাখির ডাক ও পাতাঝরার শব্দ। একটু ধৈর্য ধরে বসলেই হরেক রকম পাখির দেখা পাওয়া যায়। প্রথমেই চোখে পড়ল সলিম আলির প্রিয় আমাদের লজের পাখি--হর্নবিল বা ধনেশ পাখি। তার বিরাট চঞ্চু ও ওড়ার সময় পাখায় হুশহুশ শব্দ বিশেষ লক্ষণীয়। তাছাড়াও দেখলাম লাল ঠোঁট (Red whiskered) বুলবুল, সবুজ পায়রা, সোনালী বুক ওয়ার্বলার, দু’তিন রকমের প্রিনিয়া, ডলার বার্ড, সোনালী পিঠ কাঠঠোকরা, বিরাট লম্বা লেজ-ঝোলা ফিঙে (Racket Tailed), ভোঁতা-মুখ Frogmouth, নিশাচর পাখি যা ভারতে একমাত্র এখানেই দেখা যায়। এছাড়াও আছে ফিঙে, পাহাড়ি শালিক, ছাতার, ম্যাগপাই, রবিন আরও কত রকম পাখি। সলিম আলির নিজের মতেই কেরালার থাটেকাড অঞ্চল পক্ষীপ্রাচুর্যে ভারত বিখ্যাত। এইসব জায়গাগুলি সংরক্ষিত রাখার জন্য তাঁকে আমাদের সবার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
ফ্রুট ব্যাটস
যাত্রা সময়কাল—ভ্রমণকাল- ডিসেম্বর ২০১৬