Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে কাকলি মজুমদারের
লেখা


ISSN 1563-8685




তিন বন্ধু পরিবারের সামার ট্রিপ


ইয়োহো ন্যাশনাল পার্কে - পাহাড়, জঙ্গল আর সবুজাভ-নীল লেক

ভারতবর্ষ থেকে হাজার মাইল দূরে কানাডার বিখ্যাত ইয়োহো ন্যাশনাল পার্কে (Yoho National Park) বন্ধুদের সাথে ঘুরতে এসে রামগিরির সেই প্রাচীন যক্ষকে খুঁজে পেলাম। কত যুগ আগে পড়েছি। এখনও সে ভিতরে রয়ে গেছে?

আমি এক আহ্লাদী মেঘ আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি গায়ে মেখে নীলগিরি শৃঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আজ আমার অনুভবে মহাকবি কালিদাসের সেই চিরন্তন মহাকাব্য ধীরে ধীরে ছেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন ইয়োহো ন্যাশনালপার্কের এই পাহাড়, মেঘে ঢাকা সবুজ বনানী মহাকবির সেই রামগিরি পর্বত। ঠিক এইখানেই মেঘ-পাহাড় মিলেমিশে সেই প্রেম-বিরহের মহাকাব্য সৃষ্টি হয়েছিল। নির্বাসিত বিরহী যক্ষ এইস্থানে দাঁড়িয়ে মেঘদূতকে প্রিয়ার কাছে তাঁর প্রেমবার্তা পৌঁছে দেবার জন্য অনুনয় করেছিলেন। আজ কি আষাঢ়ের প্রথম দিবস? মেঘ ইয়োহো নদীর উপর দিয়ে ভালোবাসার গভীর আকুতি বয়ে নিয়ে উড়ে চলেছে। যুগ যুগ ধরে মেঘদূতের অমর যাত্রা চলেছে দেশ-কালের গণ্ডি ভেঙে। আমি মেঘে-জলে ভিজতে ভিজতে ভালোলাগায়-ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে গেলাম। সেই সঙ্গে আমার জীবনের প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গেও ভালোবাসায় সম্পৃক্ত হয়ে রই!

আহা ভ্রমণের শুরুতে এ কী আনন্দ! আমরা তিন বন্ধুপরিবার মিলে ক্যালগেরি শহর থেকে প্রায় ২১০ কিলোমিটার ড্রাইভ করে ইয়োহোতে এসেছি। গ্রীষ্মে হাইওয়ের দুপাশে সবুজের কত না বাহার দেখলাম। ভোরের নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে একান্ত আলস্যে সবুজ মাঠ শুয়ে ছিল। তার গায়ে মেঘের ধূসর ওড়না জড়ানো। আরও দূরে নীল পাহাড় আর গাঢ় সবুজ বনের আভাস। তখন কি জানতাম যে এবারের ভ্রমণে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা হবে?

বেশ ক’দিন ধরে তিন বন্ধু — পলা, সোনালি আর আমি মিলে এই ট্রিপের সব প্ল্যান করেছি। আগের দিন রান্না করে, সকালে গরম লাঞ্চ ক্যাসারোলে প্যাক করে নেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যে পলা পাক্কা রন্ধনপটিয়সী। তার খাওয়াদাওয়া কখনও সংক্ষেপে হয় না। তাই বেড়াতে যাবার আগে প্রতিবার আমার সঙ্গে তার এক অসম লড়াই। আমি বলতে থাকি “আরে ঘুরতে চলেছিস, না খেতে? তাহলে বাড়িতে বসে পার্টি করলেই তো হয়।” পলা এসব কথায় বিশেষ পাত্তা দেয় না। সে তার বরের কথাই শোনে না, আর আমি তো নগণ্য। তাই প্রতিবারই আমাদের ট্রিপে খাবারের লটবহর চলে। পলা বলে “তুই কিছু সিম্পল বানালেই চলবে।” অথবা, “তোর রান্না করতে না-হলেই তো হল? খেতে কি অসুবিধে?” সোনালি খেতে খুব ভালোবাসে। আমি বেশ জানি যে এ-ব্যাপারে সে মনেপ্রাণে পলাকে সমর্থন করে। বেড়াতে এসে চব্বিচোষ্য লেহ্য পেহ--এ না হলে বাঙালি! আমি নির্ভেজাল ভ্রমণপিয়াসী। দেখাটা মুখ্য। মুগ্ধ আর বিস্মিত হওয়ার জন্যই তো ভ্রমণ। গতানুগতিক জীবনের বাইরে এসে কল্পনার ডানা মেলে দেওয়ার জন্যই দূরে যাওয়া। আমাদের বরেরা কেউ খেতে, কেউ ড্রাইভ করতে, কেউ দেখতে ভালোবাসে। তারাই ম্যাপ দেখে, যাত্রাপথ নির্ধারণ করে, থাকার জায়গা বুক করে। আমাদের ছেলে মেয়েরা বেশিরভাগই টিন-এজার। কেউ ইউনিভার্সিটি গেছে বা যাবে যাবে করছে। সব কিছুতে তাদের আপাত ঔদাসীন্য থাকলেও, ওরা ঘুরতে ভালোবাসে। এই সব নানা বৈচিত্রের মিলেমিশে আমাদের দলটি যেন এক মহামিলনের সমষ্টি।

আমার মেঘদূতে ভেজা পরিপূর্ণ মন। মিঠি মিঠি ভালোলাগা নিয়ে ভাবি যে এই কাহিনীর মুখ্যচরিত্র ইয়োহো ন্যাশনাল পার্ক। ইয়োহোর জন্মকথায় এদেশের রেলওয়ের (Canadian Pacific Railway) ইতিহাস জড়িয়ে আছে। ১৮৮৬ সালে রকি মাউন্টের মধ্যে ১,৩১০ স্কোয়ার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই ন্যাশনাল পার্ক তৈরি হয়েছিল। এই পার্কে পাহাড়, ঘন জঙ্গল, জলপ্রপাত, নদী, সবুজাভ-নীল লেক আর অজস্র হাইকিং ট্রেইল। এখানে সর্বদা মেঘ-রোদ্দুর-জল আলোর লুকোচুরি খেলা। পার্কস কানাডা (Parks Canada) হাইকিং ট্রেইলগুলো অসাধারণ নিষ্ঠায় নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করে। এই অঞ্চলের আদিম শ্বাসরুদ্ধকরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনের গভীরে সম্ভ্রম জাগায়। তাই আদিবাসীরা এর নাম দিয়েছিল “ইয়োহো” অর্থাৎ বিস্ময়। ১৮৮১-তে কানাডার পুব থেকে পশ্চিমে রেলওয়েকে নিয়ে যাবার জোর প্রস্তুতি শুরু হয়। সে একটা ঐতিহাসিক সময়। দীর্ঘ দিন ধরে আলাদা থাকা কানাডার প্রভিন্সগুলো একে একে যুক্ত হয়ে এক নতুন কনফেডারেশান গড়ে উঠেছে। সংযুক্ত দেশটি পুব-পশ্চিমে দীর্ঘ ৯,৩০৬ কিলোমিটার জমিনকে রেলপথে যুক্ত করবার স্বপ্ন দেখছে। কানাডার পশ্চিমে প্রকৃতি ভয়ানক দুর্গম। খাড়া পাহাড়ের মধ্য দিয়ে রেলপথ তৈরি করা খুবই কঠিন ছিল। রেলওয়ে কোম্পানি সুইজারল্যান্ড, জার্মানী থেকে বিখ্যাত আল্পসের গাইডদের দিয়ে এই পাহাড়ি ভূখণ্ডের ম্যাপ বানাচ্ছিল। সেই খবর পেয়ে ভ্রমণ পিয়াসী পর্যটকরাও অভিযানের নেশায় আসতে শুরু করলেন। ১৮৯১ সালে, আল্পস বিশেষজ্ঞ হেবেল (Hebel) প্রথম এই বিশাল ব্যাপ্ত অঞ্চলের পুরো ম্যাপ তৈরি করেছিলেন। পুব থেকে পশ্চিমে রেলপথ চালু করতে এক দশকের বেশি সময় লেগে গিয়েছিলো। ১৯০১ সালে সুইস অভিযাত্রী এডওয়ার্ড উইম্পার (Edward Whimper) রেলওয়ে কম্পানিকে তাঁর রিপোর্টে এখানকার বিপুল ট্যুরিজম এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে দুর্গম পাহাড় কেটে রাস্তা, হোটেল ইত্যাদি চালু হল। নব্বুই-এর দশকে রাস্তাঘাটের অত্যাধুনিক পরিকাঠামো তৈরি হবার পর গাড়িতে করে ভ্রমণ অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। গাড়িতে নিজের ইচ্ছেমতন জিনিসপত্তর নিয়ে যাওয়া আসা করা যায়, তাই রোড ট্রিপেই আমাদের গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ। রেল এই অঞ্চলে মূলত মালগাড়ির কাজ করে। পথে দেখলাম রাস্তার পাশাপাশি সারি সারি রঙিন পতাকার মতন মালবাহী কামরা নিয়ে রেল চলছে, নস্টালজিক হুইসিল দিতে দিতে। সেই শব্দের সাথে আমার শৈশবের বাবা মা ভাই ঠাকুমার সাথে ট্রেনে চেপে বেড়াতে যাবার স্মৃতি মিশে আছে।


টাকাকোয়া — এক প্রবল শক্তিশালী জলপ্রপাত

ইয়োহোতে আমাদের প্রথম গন্তব্য টাকাকোয়া ফল্‌স (Takakkowa Falls)। কানাডার দ্বিতীয় উচ্চতম এই জলপ্রপাত প্রায় ২৫৪-মিটার উঁচু পাহাড় থেকে সশব্দে লাফিয়ে নিচে আছড়ে পড়ছে। আমরা দল বেঁধে ইয়োহো নদী পেরিয়ে জলপ্রপাত দেখতে গেলাম। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দোরগোড়ায় যেন আচমকা দড়াম করে ধাক্কা খেলাম। চোখের সামনে যেন নিউক্লিয়ার বোম্বিং দেখছি। ঘন সাদা ধোঁয়ার মতন সশব্দে পাহাড়ের নিচে নামছে। ইনি দৃশ্যমান হবার আগেই দূর থেকে গুরুগুরু সহস্র মেঘ ডাকবার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। এবার সামনে থেকে তাঁকে দেখতে গিয়ে জলের ছিটেয় ভিজে গেলাম। আওয়াজ এতো জোরে যে পাশের লোকের সাথে চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে। টাকাকোয়ার পাশ দিয়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে অল্পবয়েসি ছেলেমেয়ের দল উপরে উঠছে। নিচ থেকে ওদের সারি সারি পিঁপড়ের মতন দেখাচ্ছে। এই বয়সে আমি তো টিপিকাল “বুকিশ ছাত্রী” ছিলাম। স্কুলে যোগব্যায়াম আর পাড়ায় বুড়ি বসন্তের বেশি কিছু খেলাধুলা করিনি। কলেজে গিয়ে তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজকাল একটু দুঃখ হয় বইকি। আহা, সেই সময়টা যদি আবার ফিরে পেতাম!


ইয়োহো নদীর পাশে উৎসাহী মানুষের জটলা

ইয়োহো নদী আর টাকাকোয়া জলপ্রপাত, দুই জলস্রোত নিচে নেমে এক জায়গায় এসে মিশেছে। পাহাড়ি নদী ইয়োহোরও দেমাক কম নয়। যেমন দুধ-সাদা গায়ের রঙ, তেমন তেজি ঘোড়ার মতন স্বচ্ছন্দ-চঞ্চল। যাঃ, একপশলা বৃষ্টি নামল। নানা দেশের টুরিস্টরা দিব্যি ভিজছে। আমার ভারি ভালো লাগছিলো। ভেজা ভেজা দুপুর। সামনে এক প্রবল শক্তিশালী জলপ্রপাত আর মাথার মধ্যে মেঘদূতের মৃদু আভাস। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পলা পড়িমরি করে ছুট লাগালো গাড়ির দিকে। “একটু দাঁড়িয়ে যা। পাহাড়ি বৃষ্টি এখুনি থেমে যাবে।” আমার কথা শেষ হবার আগেই পলা হাওয়া। ততক্ষণে সোনালি আর তার বর সুশান্ত পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেছে। সুশান্ত কলেজ জীবনে মাউন্টিনিয়ারিং ট্রেনিং নিয়েছে। একসময় নিয়মিত হিমালয়ে ট্রেকিং-এ যেত। সোনালিও খেলাধুলা করেছে। তাই ওরা দুজনেই বেশ ফিট আছে। দেখতে দেখতে সুশান্ত ওই ছেলেমেয়েগুলোর মতন উপরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সোনালি হাঁপিয়ে মাঝপথে পাথরের উপর বসে গেছে। ও নামতে পারবে তো? সুশান্ত ওকে ঠিক নামিয়ে আনবে।

বৃষ্টি শেষে, আকাশে হাসিমুখ সাদা-হালকা মেঘ উড়ে চলেছে। পলা কিছুক্ষণ গাড়িতে থেকে বোধহয় “বোর” হয়ে ফিরে এসেছে। ও মেঘ দেখছে। আমি বললাম “উত্তরবঙ্গে ডুয়ার্সে এই রকম জলভরা মেঘ দেখেছি। সেই কোন ছেলেবেলায়।” পলা গতবছর দেশে গিয়ে জলদাপাড়া ঘুরে এসেছে। ও মাথা নাড়ল। হঠাৎ দেখি দূর থেকে পলার মেয়ে সীমন্তি হন্তদন্ত হয়ে এদিকে আসছে। ওর চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ “মাম্মি মাম্মি, শুভমদাদা জলে পড়ে গেছে।” বলেই সে নিচে নদীর দিকে ছুট দেয়। শুভম সোনালি-সুশান্তর ছেলে। সীমন্তির পিছনে আমরাও রুদ্ধশ্বাসে ছুটি। একটু আগেই দেখে এসেছি যে ছেলেপুলেরা নদীর ধারে জটলা করছিল। ছুটতে ছুটতে আমাদের বড়োদের পথ থেকে ডেকে নিই। ভীষণ বুক ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। জানি না গিয়ে কি দেখব? সোনালি-সুশান্তকে ডেকে কোন লাভ নেই। কান ফাটিয়ে চিৎকার করলেও ওরা শুনতে পাবে না।


ইয়োহো নদীর তীব্র খরস্রোতা রূপ

নদীর ধারে ছেলেমেয়েরা জলের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে তীব্রস্রোতা পাহাড়ি নদী। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। নদীর মাঝামাঝি এক বিশাল পাথর ধরে শুভম এক অদ্ভুত দক্ষতায় ঝুলছে। পাথরটা নিশ্চয় খুব পিছল হবে। ওর চারপাশ দিয়ে তীব্র জলস্রোত বইছে। মুহূর্তের অসাবধানতায় ও বোধহয় জলে পড়ে গিয়েছিল। কোন রকমে পাথর ধরে ভেসে যাওয়া থেকে বেঁচে গেছে। বাকি ছেলেমেয়েরা কি করবে বুঝতে পারছে না। শুধু ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সীমন্তি অস্থির হয়ে লাফাচ্ছে। শুভম খুব ভালো সাঁতার জানে। কিন্তু এইরকম ভয়ংকর স্রোতে পড়লে যে-কেউ এক মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। হিমবাহ থেকে নামা নদীর জল হিমঠান্ডা। জলে পড়লে হাইপো-থারমিয়ায় মানুষ মারা যেতে পারে। পার্কস কানাডার কর্মীরা কোথায়? এখন কি করি?---

কাউকে কিছু করবার সুযোগ না দিয়েই শুভম কাছের একটা পাথরে উঠে এলো। বোধহয় অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে সাহস জুগিয়েছে। এই বিপদে কিভাবে যে ছোট ছেলেটি মাথা ঠান্ডা রেখেছে — একটুও উপস্থিত বুদ্ধি হারায়নি! বড়দেরই মাথা গুবলেট বা নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যেতে পারতো। পরপর পাথরের উপর দিয়ে বড় ছোট লাফ দিয়ে শুভম তীরে উঠে এল। একটু এদিক ওদিক হলে সোজা জলস্রোতে ভসে যেতো। উপরওয়ালার অসীম কৃপা। তিনি বোধহয় ওকে রক্ষা করলেন। আমরা এবার শ্বাস নিলাম। ছেলেপুলেরা ওকে গভীর আনন্দে জড়িয়ে ধরলো। শুভমের মুখ দেখে তার ভিতরে কি হচ্ছে বোঝা গেলো না। ভয় পেয়েছে বলেই মনে হোল। পাবারই কথা। কিন্তু তার প্রথম কথা “I almost lost my new iphone. It’s wet.” পলা কান্না রুখতে রুখতে বললো “চুলোয় যাক ফোন। বেঁচে যে গেছিস এই বড়।”

আমরা সবাই মিলে ওকে গ্রেফতার করে নদী থেকে দূরে কারপার্কে নিয়ে গেলাম। ওর বাবা-মা এলে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুভম ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে এল। সুশান্ত সোনালির মুখ খুব স্বাভাবিক। এতো বড় একটা বিপদের পরেও। আমি কিন্তু বেশ নাড়া খেয়েছি। ভিতরে ভিতরে কাঁপুনি হচ্ছে। মাথা থেকে মেঘদূত কাব্যভাব উধাও। ভাবলাম যে ওরা শুভমকে জলেপড়া অবস্থায় দেখেনি বলে এতো স্থির আছে। হয়তো ঘটনার গভীরতা ওদের মধ্যে প্রবেশ করেনি। আমি সোনালিকে “শুভমকে বকিস না” বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। এদেশে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা সব কিছুর উর্ধে। কাউকেই যেচে উপদেশ দেওয়া চলবে না।


হাইকিং ট্রেইল—কিছুটা পাটাতনের বাকিটা অসমতল নুড়ি বিছানো

সোনালি ততক্ষণে লাঞ্চের আয়োজনে লেগে গেছে। খেয়েদেয়ে আমরা পরিকল্পনা মাফিক হাইকিং-এ গেলাম। “বেড়াতে এসে একটু রিল্যাক্স করি” বলে কেউ কেউ থেকে গেল। দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের মধ্য দিয়ে নুড়ি-বিছানো পথ চলে গেছে গভীর ঘন পাইনবনে। ধীরে ধীরে টাকাকোয়ার শব্দ দূর থেকে আরো দূরে মিলিয়ে গেলো। শুনতে পাচ্ছি, ইয়োহো নদী পাশে পাশে চলেছেন। তিনি কখনও দৃশ্যমান কখনও অদৃশ্য। কখনও তন্বী, কখনও গর্ভবতী স্ফীতকায়া। পাইন বন থেকে গাছেদের গা’ধোয়া এক ধুনো-ধুনো পবিত্র মৃদু সুগন্ধ ভেসে আসছে। প্রকৃতি বৃষ্টির জলে স্নান করে স্নিগ্ধ পবিত্র হয়ে যেন কোন পূজার অপেক্ষায় রয়েছে। বিশ্বচরাচরব্যাপী এমন এক নিটোল শান্তিতে একটু আগের ঘটনায় মনের ভিতরে জমা ভয়ংকর অস্থিরতা থিতিয়ে এলো।

চিরটা কাল আমি হাইকিং-এর তাল তুলি। নুড়িপথে চলতে চলতে, পলা বেশ অধৈর্য — “আর কত দূর যাব?” ভাবখানা এমন “নেচে নেচে কোন জাহান্নমে নিয়ে চলেছিস? সবেতেই তোর বাড়াবাড়ি।” আমি উত্তর দেবার আগেই কেউ বোধহয় দুই দেবদূতকে আমাদের উদ্দেশ্যে পাঠালেন। পথের বাঁক ফুরাতেই একেবারে মুখোমুখি দৃশ্যমান। গ্রীষ্মের তাতে পুড়ে তামাটে দুই সুপুরুষ কেনেডিয়ান যুবক। তারা হাইকিং সেরে ফিরছে। পলা হাঁকপাঁক করে ওঠে "ওদিকে কি আছে?” এদেশের হাইকাররা খুবই সুপরিকল্পিত। এদের ব্যাকপ্যাকে হয়তো শুকনো স্যান্ডুইচ আর ফ্রুটজুস, কিন্তু হাইকিং-এর বিশদ ম্যাপও আছে। আবার কেনেডিয়ানরা খুবই প্রকৃতিপ্রেমিক। এদেশের অসাধারণ রূপসী ভূখণ্ডে কেমন যেন একটা নেশা আছে। ওরা আমাদের জানালো যে আরও ১৮ কিলোমিটার দূরে একটা tea house আছে। সেই রেলওয়ের রমরমা সময়ে টুরিস্টদের জন্য তৈরি হয়েছিল। এখন সেখানে হাইকাররা বিশ্রাম নিতে যায়। এরা আরও অনেক দূরের কোন একটা পাস থেকে আসছে। বেশি দূরে যেতে যদি না চাই, তাহলে অন্তত আমরা যেন কাছের জলপ্রপাতগুলো দেখে যাই।

আমারা টুকটাক কথা বলছি। একটু আধটু হাসাহাসিও হচ্ছে। চারিদিক এতো গভীর শান্ত যে আমাদের কলকলানি ক্রমশ মৃদু ফিসফাসে রূপান্তরিত। এই ট্রেইলের বৈশিষ্ট্য হল যে দুপাশের পাহাড় থেকে ক্রমাগত ছোট বড় নানা জলপ্রপাত নেমে আসে। এমনটা আর কোথাও দেখিনি। ছোট জলপ্রপাতগুলোর নাম নেই। ছেলে দুটোর কথামতন দেখি পার্কস কানাডার একটা সাইন বোর্ড এলো — Angel’s Stairs Falls. ভারি কাব্যময় নাম। কি অপূর্ব সৃষ্টি — সত্যিই যেন পাহাড় কেটে উপরের স্বর্গ থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে এই জলপ্রপাত নেমে এসেছে। এরপর দুএকটা ছুটকো-ছাটকার পর, আর একটা বিস্ময় — Point Lace Falls। কেউ যেন ২৪ ঘন্টা ধরে পাহাড়ের বুকে কুরুশে লেস বুনে চলেছে। লেস ক্রমাগত ডানা মেলছে। বদলে যাচ্ছে তার গড়ন। তার উপরে শেষ বিকেলের সূর্য বসাচ্ছে হিরা-চুনি-পান্নার কাজ। বসে বসে আমরা সেই অপূর্ব শিল্পকর্ম দেখতে থাকলাম। টাকাকোয়া থেকে সিঁড়ি, মাঝে নাম-না-জানা আরো কত্ত জলপ্রপাত, আর সিঁড়ি থেকে লেস। যুগ যুগ ধরে বরফে বৃষ্টিতে জলে ভিজে ভিজে পাহাড় কেটে কেটে এই সব অসামান্য সম্পদ তৈরি হয়েছে। প্রকৃতি যে তার গভীরে কত কী লুকিয়ে রেখেছে!

ধীরে ধীরে বেলা শেষ হয়ে আসছে। পাহাড়ে হঠাৎ করে সন্ধে নেমে আসবার আগেই ফিরতে হবে। রাতে হাইকিং-এর কোন প্রস্তুতি নেই। এখনও ফিরবার পথে ৪ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। বরেরা খুব তাড়া লাগায়। আমরা পাইনের বিশুদ্ধ পবিত্রতা গায়ে মেখে ফিরে আসি। কার-পার্কে পৌঁছে, পলা ওর জাবদা প্রাগৈতিহাসিক দেখতে একটা ফ্লাস্ক থেকে সক্কলকে মসালা চা দেয়। আঃ এতো হাঁটাহাঁটির পর ঈষৎ উষ্ণ চায়ের কোন জবাব নেই। এই জন্যই পলা আমাদের সকলের প্রিয়। এবার পাত্তাড়ি গুটিয়ে রাত্তিরের গন্তব্য গোল্ডেন। ওখানে আমাদের হোটেল বুক করা আছে।

*

গাড়িতে উঠতে যাব, সোনালি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। “শুভম কি ভেসে যাচ্ছিল? ঠিক করে বলতো।”

আমি একটু চমকে তাকাই। ওর দু-চোখে মাতৃত্বের প্রগাঢ় কান্না। এক ঝলক তাকিয়ে বলি, “ভাবিস না। ও এক্কেবারে ঠিক আছে।”

আমার ভিতরের লেগে থাকা ছোট্ট খচখচানিটা এবারে মিলিয়ে যায়। সোনালি আর আমি দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে সন্তানস্নেহে এক হয়ে যাই।


টাকাকোয়া ছাড়িয়ে পথ চলে গেছে দূরে




(পরবাস-৬৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)