ISSN 1563-8685




লাদাখপর্ব


হেমিস গুম্‌বা

২৫ জুন সকাল ৭.১৭- প্রাতর্ভ্রমণ সেরে এখন চা চাপানোর পালা।

সকাল ১০.৫০- প্রাতরাশের আশ নিয়ে সময়যাপন।

সকাল ১১.৫০- নিরাশ হবার মুহুর্তে আশার উজ্জ্বল আলো — প্রাতরাশের আগমন।

দুপুর ১২.৪৫- ভাবছিলাম, হেমিস বুঝি মিস হয়ে গেল। না:, দের হ্যায়, পর আন্ধের নহী। গাড়ি গড়াল হেমিসপানে। আজ থেকে আমাদের সারথী ওয়াংগেল।

দুপুর ২টো- পাহাড়ের কোলে লুকোনো মণি হেমিস গুম্‌বা। বিশ্বের বোধহয় সব থেকে বেশি চর্চিত গুম্‌বা হেমিস (১৩৪৬৪ফু: )।

দুপুর ২.২২ – ধ্যানগম্ভীর হেমিসের মূল উপাসনাকক্ষে সোনালী বুদ্ধ শান্ত সমাহিত স্মিত হাস্যে বসে রয়েছেন। বাকিরা তাঁর অমিত আভায় ম্লান। এই বছরটা হেমিসের মহাউৎসবের বছর, যা ১২ বছর অন্তর আসে — তারই প্রস্তুতি চলছে। এখন যে চত্বরে হাতে গোনা মানুষের আনাগোনা, সেটা মাসখানেক বাদেই ঠাসা ভিড়ে গমগম করবে। হবে সপ্তাহব্যাপী ছাম (নাচ), ঝোলানো হবে তিনতলা সমান থাংকা। মনে মনে সে দৃশ্য কল্পনা করলাম বোধহয় সবাই। কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কী!

দুপুর ২.৪০- হেমিসের মুগ্ধতা মেখে বেরোলাম। এবার ফেরার পথে ঝাঁকিদর্শনের পালা।


থিক্‌সে গুম্‌বা

বেলা ৪টে- থিক্‌সে গুম্‌বা (১১৯৬৪ফু: ) এ-ও বিশাল! যেন থাকে থাকে সাজানো। কত যে ঘর, কত জানালা, চত্বর, গুণে শেষ করা যায় না।

বেলা ৪.৪২- সবাই যে সব দেখল, তা নয়, তবে চায়ের টেবিলে সবাই হাজির।

বেলা ৫.০১- ঠিক সে থিকসে না দেখেই বেরোলাম। কারণ, পিকচার আভি বাকী হ্যায় মেরে দোস্ত।

বেলা ৫.২৫- রাজাদের পুরোনো প্রাসাদ (শ্য প্যালেস ১১৫৩৪ফু: )। ঝাঁকিদর্শনে শান্তি।

বেলা ৬.১২- ছুটি হয়ে যাওয়ায় ‘থ্রী ইডিয়ট্‌স’- এর ‘র‍্যাঞ্চো-স স্কুল’ বাইরে থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। স্কুলের আসল নাম — ‘ড্রুক (বজ্রড্রাগন) পদ্ম(পদ্ম) কারপো(সাদা) স্কুল।

বেলা ৬.২৮- সিন্ধু দর্শন ঘাট। সিন্ধুর করুণ রূপ দেখে করুণা হলো। হাঁটুডোবা দুটো ধারা — ঠিক যেন মনে হচ্ছে উৎসবহীন সময়ে হরিদ্বারের গঙ্গার পঙ্কিল ধারা।

বেলা ৬.৫১- সিন্ধু ত্যাগ করে লেহ তাগ করে ছুট।

সন্ধে ৭.১৮- পেটে ছুঁচোরা বক্সিং লড়ছে।

সন্ধে ৮.০৩- জার্মান বেকারি পরিত্রাতা — পড়তি আলোয় লাঞ্চ!

সন্ধে ৮.১৬- কুলায় ফেরা।

রাত ১১.৪৫- এবার ডিনার। খাদ্যাদি মুহুর্তে সাবাড়।

২৬ জুন দুপুর ১২.১৫- আজ সকাল কেটেছে অলস আলাপনে, পায়চারিতে। আজ কাছাকাছি ঘোরাঘুরি। ধীরেসুস্থে আলসে নিষ্ক্রমণ।

দুপুর ১.১০- গুরু নানকের আলৌকিক কীর্তিস্থান ‘গুরুদ্বারা পাত্থর সাহিব’। শিখদের কিংবদন্তী — নানকজী তপস্যা করছিলেন। একটা দৈত্য এসে তাঁর ধ্যানভঙ্গের উদ্দেশ্যে বিশাল এক পাথর গড়িয়ে দেয় তাঁকে তাক করে। সেই পাথর নানকজীকে স্পর্শ করামাত্র মোমের মতো নরম হয়ে যায়। নানকজীর শরীরের ছাপ চিরস্থায়ী হয়ে যায় সে পাথরে। সেই পাথরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে পাত্থর সাহিব।

দুপুর ২.১১- সেই আশ্চর্য পাথর দর্শনের পর লঙ্গরে সবার সঙ্গে পংক্তিভোজনে উদর পূর্তি।

দুপুর ২.১৮- পরিতৃপ্ত হয়ে আবার সফরে।


জাঁসকার সিন্ধুর সঙ্গম

দুপুর ২.৪৯- ওপর থেকে দেখে শান্তি হয়নি — এখন একেবারে সিন্ধুনদ আর জাঁসকার নদী-র সঙ্গমে। দু-জনের দুই রংয়ের জলধারা কেমন এখানে এসে কোলাকুলি করে মিশে গিয়েছে, তারপর এক দেহ এক মন হয়ে বয়ে গিয়েছে আনন্দে! টুরিস্টরা রবারের ডিঙি চেপে ভেসে বেড়াচ্ছে সেই সঙ্গমে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, ঘোর শীতে এই দুই নদীই জমে গিয়ে তুষারনদী হয়ে পড়ে। জাঁসকারের উজানে যে সব গ্রাম আছে, একমাত্র সেই সময়েই তাদের অধিবাসীরা বাইরের জগতে আসার সুযোগ পায় সেই তুষারনদী ধরে হেঁটে এসে। এই আশ্চর্য পথে হাঁটার অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পেতে বিদেশ থেকে টুরিস্টরা লাদাখে আসে ঘোর শীতে।

বেলা ৩.৪৯- এবার পালা আমাদের সেনাবাহিনীর নির্ভীক বীরত্বের নিদর্শন ‘হল অফ ফ্রেম’। সেনানীদের বীরগাথা, সাহসিকতার নিদর্শন দেখছি মুগ্ধ হয়ে।


শান্তি স্তূপ থেকে

বিকেল ৫.৩৭- শান্তিরক্ষকদের প্রদর্শনী দেখে এবার শান্তিস্তূপের দোরগোড়ায়। বিশ্বশান্তির বাণীবাহক এই স্তূপের ওপর থেকে নিচে বিছিয়ে থাকা লেহ-র রঙীন ছবিটা মুদ্ধ করল। শান্তির খোঁজে আসা মানুষদের গাড়ির ভিড়ের ধাক্কায় চাকা থামল আধ কিলোমিটার আগেই। শেষবেলার রাঙা আলোয় শান্তিস্তূপ যেন আরও শান্ত। গার্গীদি- সন্দীপদা, অর্ণব-কমলেশরা শান্তিতে অবগাহন করতে চড়াই ভাঙছে — আমরা দু-জন এখানে থেকেই শান্তি খুঁজে নিলাম।

বিকেল ৬.৫৬- বাঁকের পর বাঁক — প্যাঁচ খেতে খেতে সেমো গুম্‌বার সামনে এসে থেমে যেতে হলো। গুম্‌বার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাহাড়ের আড়ালে নামার আগে সূয্যিমামা তাকে, আর একটু নিচের লেহপ্রাসাদকে রাঙিয়ে দিচ্ছে। অনেক নিচে লেহ শহরে এখনই বিজলীবাতির ফুলঝুরি।

সন্ধে ৭.২৮- লেহবাজারে খানিক ঘোরাঘুরি সেরে ডেরায় ফেরৎ।

২৭ জুন সকাল ৫.১৫-


খারদুংলা

আজ সবার চোখে খারদুং লা-র স্বপ্ন — পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু গাড়ি চলার উপযোগী গিরিবর্ত্ম — ১৮৩৮০ফুট! তাকে পেরিয়ে আমরা যাব উচ্চ-মরুভূমি নুব্রা-য়।

সকাল ৯.৩৬- গাড়ি গড়াল।

সকাল ১০.০১- ধূ ধূ পাহাড়ে লম্বা লম্বা পাকে ঘুরে ঘুরে পথ পেরোচ্ছি। উচ্চতা বাড়ছে, একটু একটু করে বাড়ছে ঠাণ্ডা।

সকাল ১০.৪৬- সাউথ পুল্লু ক্যাম্প — খারদুংলা-র প্রবেশ তোরণ — ১৫৩০০ফুট।

সকাল ১১.২৩- তুষারশৃঙ্গ এখন হাতের নাগালে। প্রতি বাঁকে বাড়ছে উচ্চতা, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ঠাণ্ডা।

সকাল ১১.৪৫- খারদুংলা। তুষারে বোলডারে মাখামাখি, হাজার হাজার মন্ত্রপূত রঙীন নিশানে রঙীন, শয়ে শয়ে গাড়ি মোটরবাইকে জ্যামজমাট ১৮৩৮০ফুট উঁচু এই গিরিবর্ত্মে এসে টের পেলাম দমে টান পড়ছে। বহুদিনের স্বপ্ন সফল হওয়ার আনন্দে, অক্সিজেনের অভাব সেভাবে টেরই পেলাম না।

সকাল ১১.৪৯- এমন জায়গায় ফটোসেশন না করলে চলে!

দুপুর ১.০৫- বুদ্ধ পার্ক। দেখে তো প্রাইভেট টয়লেট বলে মনে হচ্ছে! হায় তথাগত।

দুপুর ১.১১- নর্থ পুল্লু ক্যাম্প। ১৫৬০০ ফুটে পেট পুজো। হিমালয় টপকে কারাকোরামের দেশে এলাম।

দুপুর ২.৩৩- উত্তরোত্তর উত্তরণে খার্দুং গ্রাম (১৪৭৩০ফুট)।

বেলা ৩.৩৬- বন্যাবিধ্বস্ত খালসার-য়ে সার সার বিধ্বস্ত অর্ধবিধ্বস্ত বাড়ি। আর সেই ধ্বংসের নায়িকা শিয়োক নদী এখন কেমন শান্ত — যদিও গতি কিছু কম নয়।


শিয়োক নদী

বেলা ৩.৩৮- আজব এক পেট্রোল-পাম্প থেকে তেল নেওয়া হলো। শূন্যের মাঝে নীল সবুজ পলিথিন খাটিয়ে মেশিনের কঙ্কাল বসানো, এমন পেট্রোলপাম্প গোটা ভূভারতে নেই।

বেলা ৩.৪২- হঠাৎ নদীর থেকে মুখ ঘুরিয়ে বামপন্থী হলো গাড়ি।

বেলা ৪.০৭- দিসকিট গুম্‌বা আর নবমির্মিত বিশাল বুদ্ধমূর্তি দেখা দিল।


দিসকিট গুম্‌বা

বেলা ৪.১১- ১০৪৮০ ফুট উঁচুতে দুর্গের মতো দিসকিট গুম্‌বা।

বেলা ৪.১৯- বুদ্ধমূর্তির পায়ের তলায়। এখান থেকে দিসকিটকে সবুজ কার্পেট বলে মনে হচ্ছে।

বেলা ৫টা- বুদ্ধদর্শন সেরে সরে পড়ছি।

বেলা ৫.১০- দিসকিট বাজার (১০০০০ফুট)। বেশ জমজমাট।

বেলা ৫.৩৫- হিমালয়ের মরুভূমি হুন্ডার। যতদূর চোখ যায়, নদী পাহাড়ছোঁয়া বালিয়াড়ি। দু-কুঁজো উটের সারি টুরিস্টদের মরুভ্রমণ করাচ্ছে।

বেলা ৫.৪৫- Hotel Ibex-য়ে fix হওয়া গেল। ফলফুলের মেলার মাঝে ছিমছাম আস্তানা।

২৮ জুন সকাল ৬.৩০-


হুন্ডার, আইবেক্স গেস্ট হাউস

সকালের হুন্ডার-য়ের শান্ত সুন্দর রূপ মুগ্ধ করল। হোটেলের উলটোদিকের পাথুরে পাহাড়জোড়া ধ্যানমগ্ন মুনির মতো স্থিতধী। আপেল আখরোট খোবানির গাছগুলো এখনও ঘুমোচ্ছে।

সকাল ৯.২৫- বেরোলাম ভারতের শেষ গ্রাম তুর্তুক-কে টুক করে দেখে আসতে।

সকাল ৯.৩২- জাঁসকার হাইওয়ে ধরে প্রতাপপুর। তেমন একটা প্রতাপশালী বলে মনে হলো না।

সকাল ৯.৪১- হুন্ডরি। হুন্ডার-য়ের বোন নাকি!

সকাল ৯.৫৮- শায়োকের ধারার ধারে স্ফুরু। আমাদের ওয়াংগেলের গ্রাম।

সকাল ১০.৩৬- চাংমার। আবার মারামারি কেন বাপু? দিব্বি তো শান্ত জায়গা।

সকাল ১১.৪৪- গরাড়ি। এখন বাপু গড়াবার সময় নেই — ফেরার সময় ভেবে দেখব।

সকাল ১১.৫৫- সবুজ-মাখা তুর্তুক। দু-দিকের পাহাড় রুক্ষ্ম হলেও তুর্তুকে রং-য়ের ঢল।

ঠিক দুপ্পুরবেলা- তুর্তুক-য়ের Turtuk Holidays হোটেলের রূপে মুগ্ধ আমরা। ফলফুল বাগানের মাঝে বিলাসবহুল তাঁবু। আলস্য এখানে একমাত্র কাজ।

দুপুর ১২.৩২- পাকিস্তান থেকে বয়ে আসা তুর্তুক নালাকে কাঠের পুলে পার করে আদত তর্তুক গ্রামে ঢুকলাম। বালটিস্তানের এই সুন্দর মিষ্টি গ্রামের বাসিন্দারা গ্রামের মতোই মিষ্টি। গার্গীদিকে তো স্কুলফেরৎ বাচ্চা মেয়েরা একরকম কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল।

দুপুর ১.২১- সরু গলি বেয়ে ছোট্ট জলাশয়ে বাচ্চাদের লাফ দেওয়াকে থমকে দিয়ে, একঝাঁক ম্যাগপাইকে চমকে দিয়ে গ্রামের শেষপ্রান্তে সোনালী ফসলে ভরা ক্ষেতের ধারে এসে নিজেরাই থমকে গেলাম। সোনালী ক্ষেত ছাড়িয়ে নানারংয়ের সবুজের নকশা পেরিয়ে পাথুরে পাহাড় মাথা তুলেছে। সেখানে মেঘের ফাঁক দিয়ে পাকিস্তান থেকে উঁকি দিচ্ছে দুনিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ K2। এভারেস্ট আর কাঞ্চনজঙ্ঘা আগে দেখেছি — এবার ত্র্যহস্পর্শ সম্পূর্ণ হলো।


তুরতুক থেকে K2

দুপুর ২.২২- বিহ্বলতা এখনও কাটেনি। আমি, কমলেশ, অর্ণব আর সন্দীপদার চোখে এখনও অবিশ্বাস।

দুপুর ২.৫২- আমদের উৎকন্ঠাকে উৎসবে পরিণত করে কচিকাঁচারা ফিরিয়ে দিল গার্গীদিকে। যদিও তাকে আর সুপর্ণাকে ছাড়তে তারা একরকম নারাজই ছিল।

বেলা ৩.৪৭- একটা রেস্তোরাঁয় উদরপূর্তি সমাপনান্তে তুর্তুক ভ্রমণের অন্ত হলো। এবার ফেরার পালা।

বিকেল ৬.১২- স্কুরুতে চা-বিরতি। গার্গীদি এই সুযোগে স্থানীয় গুম্‌বা দর্শন সেরে এলো।

বিকেল ৬.৩৭- স্কুরু ছাড়ছি। আকাশ থেকে মেঘেরা দল বেঁধে আমাদের প্রস্থান অবলোকন করছে।

বিকেল ৬.৪৪- থোইসে। সিয়াচেনের Air Base। খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি।

বিকেল ৭.১৮- হুন্ডার-য়ের বালিয়াড়ি। ক্লান্ত উটেরা দিনভর ডিউটির শেষে ছুটির অপেক্ষায়।

বিকেল ৭.৩৮- বুঢ়া তার দু-কুঁজের মাঝে সুপর্ণাকে বসিয়ে চক্কর দিতে রাজি হয়েছে।

সন্ধে ৮টা- ঝাঁসির রাণীর মতো মরুবিজয় করে ফিরলেন সুপর্ণারাণী।

প্রায় রাত ৮.৩২- IBEX-য়ের। নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব আরামদায়ক আস্তানায় প্রত্যাবর্তন।

২৯ জুন সকাল ৬.৪৯- হুন্ডার-য়ের, বালটিস্তানের, কারাকোরাসের শেষ সকাল।

সকাল ৯.৪৫- হুন্ডার ছাড়ার আগে বাকিদের দু-কুঁজের মাঝে বসার পালা।


হুন্ডার-এর দুকুঁজো উট

সকাল ১০.৩৬- মরুভ্রমণের ইতি। দশ হাজারি মরুভূমিতে, দুকুঁজো উটের সওয়ার হওয়ার সুযোগ লালমোহনবাবুরও জোটেনি — হুঁ হুঁ বাবা!

দুপুর ১২.৫০- এবার নর্থপুল্লুতে সন্দীপদার হারাধন গগল্‌স্‌ উদ্ধার।

দুপুর ১.৩৬- খার্দুংলা পুনর্বার।

দুপুর ২.২২- সাউথ পুল্লু।

দুপুর ৩.৪৫- লে-র জার্মান বেকারী। উদরপুরণ পর্ব চলছে। আজ বিকেলবেলা ছুট্টি।

৩০ জুন সকাল ৬.৩০- নীলসরোবরের স্বপ্ন নিয়ে ঘুম ভাঙল। আজ প্যাংগংৎসো দর্শন।

সকাল ৮.৪০- প্যাংগং অভিযান শুরু।

সকাল ৯.২৫- কারু। এখান থেকে এবার ৎসো-মোরিরির পথ এড়িয়ে প্যাংগং-য়ের পথে।

সকাল ৯.৫৬- প্রায় ঝড়ের গতিতে আমরা চোগলামসার গুম্‌বা পেরোলাম।

সকাল ১০.০১- শেরতি মোড়। ডাইনে মোচড়। ন্যাড়া পথের অনেক নীচে সবুজ শক্‌তি গ্রাম।

সকাল ১০.৫৫- জিংরাইল। জিংরা ill কেন?

সকাল ১১.১৪- আসছে তৃতীয় উচ্চতম গাড়ি চলার উপযুক্ত গিরিবর্ত্ম চাংলা।

সকাল ১১.২৪- দুরন্ত হাওয়ার সঙ্গী হয়ে ১৭৬৮৮ ফুট উঁচু চাংলা-য়।

সকাল ১১.৪৭- ৎসোলডক। উচ্চারণ করতে গিয়ে জিভ ডকে ওঠার যোগাড়!

সকাল ১১.৫৭- নীল সবুজ মাখামাখি আকথাক লেক। আহা, থাক বাবা শুয়ে।

দুপুর ১২.০৬- পথের ধারে দেখি নোটিস — ১৬১১৩ ফুট। কেন লেখা, কে জানে!

দুপুর ১২.১৪- ১৪৪৮০ফুট। আবার খামোখা বিজ্ঞপ্তি। ভয় দেখাতে চায় নাকি!

দুপুর ১২.২৯- ১৪৭৪০ফুট। আড়াইশোর উন্নতি! টের পেলাম না তো!

দুপুর ১২.৩৫- তাংসে দুরবুক(১৪১৮৯ফু. ) কে দুরুদুরু বুকে পেরোলাম।

দুপুর ১২.৩৮- তাংসে (১৪১০৬ফু. )। ফটাংসে গাড়ি থেমে গেল। চা কিন্তু ফটাংসে এলো না। এলো ধীরেসুস্থে, হেলতে দুলতে।

দুপুর ১২.৫৯- একটার এক মুহুর্ত আগে তাংসে ত্যাগ।

দুপুর ১.০৪- ১৪২১৬ ফুট। ছবি কিন্তু একই। রংবাহারী ন্যাড়া পাহাড়, একমাত্র প্যাংগংচু ঘেঁষে সবুজের জটলা, ফুলের উঁকিঝুঁকি। ওপরে অসহ্য নীল আকাশ।

দুপুর ১.১৭- প্যাংগং-চুকে টপকালাম ১৪৩৫৭ ফুটে।

দুপুর ১.৪৯- প্যাংগং-য়ের প্রথম ঝলক। পাংশুটে পরিবেশে একটুকরো নীলের ঝাঁকিদর্শন।

দুপুর ২.০৯- ঊষর ধূসর পাটকিলে প্রকৃতির মাঝে কে যেন আকাশের নীলটাকে উপুড় করে দিয়েছে — প্যাংগংৎসো। এর মাত্র এক তৃতীয়াংশ ভারতে, বাকিটা তিব্বতে। সেই তৃতীয়াংশই প্রায় ৫৪ কি.মি.!


প্যাংগংৎসো

দুপুর ২.২৯- ১৪৩৯৫ ফুটের প্যাংগং-য়ের হরেক কিসিমের নীলে পা ডুবিয়ে আমরা ৫ ইডিয়ট হতভম্ব। পায়ের তলার নুড়ি, হিমশীতল জল, কিছু টের পাচ্ছি না — কেমন যেন ভোম মেরে গেছি! কমলেশ আর ওয়াংগেল এ দৃশ্য শতেকবার দেখেছে, তবু ওদেরও চোখ চকচক করছে। ন্যাড়া পাহাড়ের মাথায় বসে বরফেরা আমাদের অবস্থা উপভোগ করছে।

দুপুর ২.৫৯- নীল স্বপ্ন চোখে ধরে নীল সরোবরকে নজরে রেখে প্রাণ ভরে উপভোগ করতে করতে লাঞ্চ ভোগ করছি।

বেলা ৪টে- বিদায় ‘সুনীল জলধি’ প্যাংগংৎসো।

বেলা ৫টা- গাড়ি হঠাৎই থেমে গেল। ওয়াংগেলের বাড়ানো আঙুল অনুসরণ করে দেখলাম মোটাসোটা পাটকিলে রংয়ের না বেজি না খরগোস মারমটেরা তাদের নাদুসনুদুস চেহারা আর মোট্টা লেজ নিয়ে এদিক ওদিক, কেউ কেউ ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজছে, লাঞ্চ সেরে কেউ বা পাথরের ওপর আয়েস করে রোদ পোয়াচ্ছে। এই মারমটেরা মনে হয় মানুষ দেখে অভ্যস্ত — দেখামাত্রই ভোঁ দৌড় তো দিচ্ছেই না, উলটে দু-পায়ে দাঁড়িয়ে রীতিমত পোজ দিচ্ছে। অর্ণব তো ওদের সঙ্গে প্রায় হ্যান্ডশেক করে এলো!

বেলা ৫.১৮- ফিরসে তাংসে।

বেলা ৫.২৯- দুরবুক। টুক করে পেরিয়ে এলাম।

বেলা ৬.১৯- ৎসোলডক। মানে কী? কারও আত্মা মানে সোল (Soul) ডকে উঠেছে? কার? ভারি বিভ্রান্তিকর।


চাংলা

বেলা ৬.৪১- জমিয়ে দেওয়া হিমবাতাস চাংলা পার করিয়ে ১৭৫৮৬ ফুটের চাংলা কাফেটেরিয়ায় ঢুকিয়ে ছাড়ল।

বিকেল ৭.১১- চায়ে গা গরম করে হিমেল চাংলা ছেড়ে ভোঁ দৌড় নিৎপানে।

বিকেল ৭.৩৩- জিংরালে নেমে এসে তবে সইতে পারার মতো ঠাণ্ডা পেলাম।

সন্ধ্যা ৭.৪৮- শর্টকাট করতে হুড়মুড়িয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে গাড়ি নামছে শকতিতে। পশ্চিম আকাশে এখন সিঁদুরখেলা চলছে। গাড়ির সামনে দিয়ে জোড়া খরগোশের ভোঁ দৌড়।

রাত ৯.১১- লেহ চলে এলাম। চোখ বুজলেই প্যাংগংয়ের নীল আর মারমটের ফ্যাশন শো।

১ জুলাই সকাল ৮টা-


লেহ বাজার থেকে

আজ পশ্চিমবঙ্গের ‘রূপকার’ ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মদিন। সেই উপলক্ষ্যেই কিনা কে জানে, আজ রেস্ট ডে — আপনা হাথ জগন্নাথ। লে বাজারে ঘোরাঘুরি। ফুটপাথ ধরে অলস পায়চারি। স্তোক কাংড়ি পর্বতমালা, লাদাখ পর্বতমালা আর জাঁসকার পর্বতমালা আমাদের ঘোরাঘুরি স্মিতমুখে দেখতে লাগল। দিনভর আমাদের আলো দিয়ে শেষবেলায় লজ্জায় রাঙা হয়ে স্তোক কাংড়ির আড়ালে ডুব দিল সূয্যিমামা।

২ জুলাই সকাল ৬.৩৭- আজ আলচি দর্শন।

সকাল ১১.৫৮- যাত্রীগণ, রথ প্রস্তুত।

সকাল ১২.১৯- আলচি অভিযান আরম্ভ।

দুপুর ১২.৪১- ফিয়াং গুম্‌বা-র ঝাঁকিদর্শন।

দুপুর ১.০৭- নিম্মু। নিচ্চয়, দিল্লেই নিম্মু।

দুপুর ১.১০- উরগেইন গুম্‌বা। ঝটিতি একঝলক নজর সফর।

দুপুর ১.৪৭- সাসপোল। কিন্তু বুঝলাম না কোথা বা সাস, কোথা বা তার পোল!

দুপুর ১.৫০- বাঁয়ে মোচড় মেরে পুল টপকে আলচি-র পথ ধরল ওয়াংগেল।

দুপুর ২ টো- একাদশ শতকের গুম্‌বা আলচি। ১০৫৫০ ফুট উঁচুতে লুকোনো আশ্চর্য মণি আলচি।

দুপুর ২.১৭- আঁকাবাঁকা অনেকটা পথ। তার ধারে ধারে নানান পসরার সারি। থামতে থামতে পাথুরে পথ ধরে চলা। গুম্‌বা-য় প্রবেশপথের মুখে, পথ হঠাৎ গোঁত খেয়েছে। একটা দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন বৃদ্ধা পরী। বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। হাত ধরে পার করে দিলেন দ্বারের বাধা। মমতার কোনও দেশ নেই।

দুপুর ৩.৪২- একী দেখলাম! মাটি পাথর দিয়ে গড়া এই সুপ্রাচীন গুম্‌বার দেওয়ালের অলঙ্করণ অজন্তার ফ্রেসকোর কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। থাম, কড়ি, বরগা, দরজার কাঠের কারুকার্য হাঁ করে দেখার মতো। গুম্‌বার চারটে কক্ষের ভিতরের বিশাল মাটির মূর্তিগুলো রীতিমতো সম্ভ্রম জাগায়। গুম্‌বার আলো-আঁধারি অদ্ভুত আধিভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।

বেলা ৪.২৮- এখনও মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। এই নির্জনে কী সম্পদ এতকাল ধরে লুকিয়ে রয়েছে!

বিকেল ৭.১৮- আবার জার্মান বেকারি। আবার লেহ।

৩ জুলাই সকাল ৬.১৭- লেহ-র শেষ সকাল। আজ ৎসোমোরিরিতে ঘাঁটি গাড়ার কথা।

দুপুর ১২.৩৯- বিদায় লেহ। ফির মিলেঙ্গে।

দুপুর ১.১৯- কারু। এখান থেকেই ৎসোমোরিরির পথখানা গেছে বেঁকে।

দুপুর ১.৪৪- উপসি। চা-উপোসী গলায় চা ঢালা হচ্ছে।

দুপুর ২.২৪- লিকৎসে এড়িয়ে সিন্ধুর উজানে দৌড়। ১১৩২৪ ফুটের ঊষর পথে সিন্ধুই প্রাণের প্রতিনিধি।

দুপুর ২.৩৯- সিন্ধু লঙ্ঘন। রাণীবাগ-য়ে এক টুকরো সবুজ দেখে দিল বাগ বাগ হয়ে গেল।

দুপুর ২.৪৫- হিম্‌য়া। হিম য়ার আবার নদ পার। এখানে টুরিস্ট লজ তৈরি হচ্ছে। নদের পারে ভবিষ্যতে থাকার ইচ্ছে।

দুপুর ৩.৩৮- কিয়ারি। ১৩৪১৭ ফুটে ফুলের কেয়ারি অবশ্য আশাও করিনি।

দুপুর ৩.৪৪- ইক্‌ক্‌! বিশ্বাস না হলেও এটা একটা গ্রামের নাম।

বেলা ৪.০২- নুরনিস। ঠিক আছে নেব, কিন্তু কেন নেব? ন্যাড়াটে পাহাড় ছাড়া আছেটা কী? সেই পাহাড় বেয়ে পথ চড়ছে।

বেলা ৪.০৫- যাক, পথ এবার সো-জা-যদ্দুর চোখ যায়।

বেলা ৪.০৭- দুম্‌-ধস্‌-ফস্‌-ফস্‌স্‌। টায়ার পাংচার।

বেলা ৪.১২- সব্বোনাশের মাথায় বাড়ি — স্পেয়ারবাবাজীকে লাগানো যাচ্ছে না — স্প্যানারই তো নেই! কী হবে? অন্য গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কবে আসবে সে গাড়ি, আদৌ আসবে কিনা — খোদায় মালুম।

বেলা ৪.২০- এসেছে! এসেছে!! একটা গাড়ি এসেছে।

বেলা ৪.২৩- ভুল, সবই ভুল। স্প্যানারের মাপ মিলছে না নাটের সাথে। আজ বোধহয় হেথায় রাত্রিযাপন। ওয়াংগেলের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।

বেলা ৪.২৭- আবার গাড়ি। আবার আশা।

বেলা ৪.৩১- মিলেছে! মিলেছে! স্প্যানারের মাপ মিলেছে।

বেলা ৪.৩৭- স্থাবর থেকে আবার জঙ্গম।

বেলা ৪.৪৩- কেফার, না কেমার? না বাপু, মারটার মোটেই ভালো জিনিস নয়; এখান থেকে যত ফার্‌ যাওয়া যায়, তত ভালো।


চুমথাং

বেলা ৪.৫০- চুমথাং। হেথায় নাকি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। সে থাক। আগে পেটের আগুন নেবাই।

বেলা ৫.২৯- উদরানল নির্বাপনান্তে স্থানত্যাগ।

বিকেল ৬.০৩- মাহে চেকপোস্ট। ইনারলাইন পারমিট দেখাও হে। এই পান্ডববর্জিত নির্জন ন্যাড়া পাহাড় ঘেরা জায়গায় সেতু পাহারায় ক-জন সেনানী অতন্দ্র পাহারায়। হাজারো সেলাম তাদের।

বিকেল ৬.০৫- সেতু চড়ে নদীয়াকে পার।

বিকেল ৬.২৫- সুমদো। বাংকার ছাড়া কিচ্ছুটি নেই। কোরজোক আর মাত্তর ৪৩ কি.মি.।

বিকেল ৬.৫৬- কিয়াগাৎসো। মিষ্টি হ্রদ।

সন্ধ্যা ৭.৫৭- শেষবেলার আলোয় রাঙা ৎসোমোরিরির দিগন্তবিস্তৃত বিস্তার ১৫০৭৫ ফুটে।

সন্ধ্যা ৮.১২- আর এক দফা পারমিট প্রদর্শনের পর চড়াই চড়ে কোরজোক গ্রাম — ১৫৪০০ ফুট।

সন্ধ্যা ৮.২২- বেশি খোঁজার উপায় ছিল না অবশ্য এই বিধ্বস্ত অবস্থায়। সামনে সাধারণ চেহারার ডলফিন গেস্ট হাউসকে পেয়ে সেখানেই সেঁধিয়ে গেলাম।

রাত ৯.৩৯- একতলার কিচেন কাম ডাইনিং হলে বৌদ্ধ কায়দায় ডিনার। বাইরে এখন তাপমাত্রা উসেইন বোল্টের গতিতে নামছে। ১৯ কি.মি. লম্বা ৭ কি.মি. চওড়া ৎসোমোরিরি কালো চাদরটা গায়ে দিলেও ঘুমোয়নি।


কোরজোক, ৎসোমোরিরি ডলফিন গেস্ট হাউস থেকে

৪ জুলাই ভোর ৫.৩৫- এরই মধ্যে আকাশ আলোয় ভাসছে।

সকাল ৭.০৭- কোরজোককে পায়ে পায়ে দেখে নিলাম। কোরজোক গুম্‌বার এখনও ঘুম ভাঙেনি। আর পিছনের তুষারকিরীটীর মতোই সে ধ্যানগম্ভীর। তবে গ্রাম কোরজোক আড়মোড়া ভাঙছে। আমাদের আসার পথটা বিছিয়ে রয়েছে একটা খয়েরি ফিতের মতো। বাতাসের দাপটে মন্ত্রপূত রঙীন সব নিশান পতপত করে উড়ছে। আর সেই বাতাসই তিরতিরে ঢেউ তুলেছে সুবিশাল ৎসোমোরিরি-র বুকে। হ্রদের ওপারের পাহাড়গুলো তুষারের টুপি পরে কার জন্য যেন উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। হ্রদের পার থেকে খানিকটা তফাতে বিলাসবহুল তাঁবুগুলো এখনও গভীর ঘুমে। জলচর কিছু ব্রাহ্মিণী হাঁস মাচ্ছের খোঁজেই বোধহয় জলে নেমেছে।

সকাল ৭.১৭- সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পূষণদেব তাঁর পূত কিরণস্পর্শ বুলিয়ে দিলেন ৎসোমোরিরি আর কোরজোকের গায়ে। সেই জাদুকাঠির স্পর্শে জেগে উঠল কোরজোক। চালু হয়ে দৈনন্দিন কাজকর্মের চাকা। ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে — হতভাগা পেটের ভেতরের ছুঁচোগুলো নড়াচড়া শরু করেছে।


ৎসোমোরিরি

সকাল ৯.০৪- আজ লাদাখ ছেড়ে হিমাচলে চলে যাব।

সকাল ৯.৫৬- সকালে আলোয় সেজে থাৎসাকারুৎসো বিশাল একখণ্ড পান্নার মতো পড়ে রয়েছে।

সকাল ১০.৩৩- সুমদো। চাংগা রাজ্যে শুরু হলো বালির রাজ্য। যেন কোনও সমুদ্রবেলা ধরে চলেছি। দিগন্তবিস্তৃত বালির মাঝে সরু লম্বা ঘাসের আলপনা হেথা হোথা। তার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বাস্তুর মতো পড়ে থাকা পাথর।

সকাল ১১.৪২- ৎসো-কার এসেও এলো না। বালিতে বসে গেছে গাড়ির চাকা। অ্যাকিসেলেটারে চাপ দিতে আরও বসে গেল। সাড়ে সব্বোনাশ! এই অনন্ত বালির সমুদ্রে অন্য গাড়ির এসে পড়ার সম্ভাবনা, ঘোড়ার ডিম পাড়ার সম্ভাবনার চেয়ে কিঞ্চিৎ আশাব্যঞ্জক।

সকাল ১১.৪৭- চোখের সামনে দেখলাম ওয়াংগেল ওয়ান্ডার। চাকার তলায় গাড়ির রাবার ম্যাট বিছিয়ে প্রায় অলৌকিক কায়দায় বালি থেকে তুলে ফেলল গাড়ি!

দুপুর ১২.১২- অন্তহীন বালিয়াড়ি গিয়ে মিশেছে বিশাল লবণহ্রদে — স্তারৎসাপুক ৎসো আর ৎসোকার। হ্রদের ধারে ধারে নুনের আস্তরণ। অদ্ভুত চরিত্র এই জোস্‌ হ্রদের। এর পশ্চিমাংশ ৎসোকার লবণাক্ত, আবার পূর্ব অংশ স্তারৎসাপুকৎসো-র জল সুপেয়! এই অংশে থুগ্‌গে বসতিতে চাংপাদের বাস।

দুপুর ১২.৩৮- দেবরাং যেন দেবতার আশীর্বাদ। দেখা মিলল লে-মানালি হাইওয়ের। কালো ফিতেটা যেন জীবনরেখা। তবে তার আগেই এই কিয়াংচুথাংয়ে দেখা পেলাম কিয়াং, মানে বন্য গাধার। গাধা হলেও গতি তাদের ঘোড়ার মতোই। গত দু-দিন ধরেই এই চাংথাং অঞ্চলে প্রায়ই দেখা পেয়েছি যাযাবর চাংগা উপজাতির মানুষদের। কুকুর, ভেড়া, পশমিনা ছাগল নিয়ে ওরা ঘুরে বেড়ায়, উপযুক্ত জায়গায় ক-দিনের জন্য তাঁবু অস্থায়ী আস্তানা পাতে। কিয়াংদের জন্য সারা দুনিয়ায় চাংথাং বিখ্যাত হলেও আজই, এই শেষদিনে, তাদের দেখা পেলাম। লাদাখ তার অন্তহীন অমূল্য সম্পদ অকপটে মেলে ধরেছে আমাদের সামনে — যতটা পেরেছি চেটেপুটে নিয়েছি।

দুপুর ১.২৭- পাং। ১৫২০০ ফুটে আজকে ‘Early Lunch’।

দুপুর ২.০৭- লাঞ্চান্তে নিষ্ক্রমণ।

দুপুর ২.২৭- কাংলাজোল — ১৬২৯২ ফুটে বুড়োআংলার ভাই নাকি!

দুপুর ৩.০৩- লাচুংলা — ১৬৬১৫ ফুট। নর্জন নি:শব্দ। পথ এবার নামছে।

দুপুর ৩.১৮- হুইস্কি নালা। দেখে তো নির্মল নীর-ই মনে হলো।

দুপুর ৩.৩০- নাকী লা — ১৫৫৭২ ফুট। নাকী? নাকি....

বেলা ৪.২২- ব্র্যান্ডি ব্রিজ। এ যে গোটা ডিস্টিলারি তুলে এনেছে দেখি।

বেলা ৪.২৮- ডাউন রড ভ্যালি। নামছি তো বটেই — কিন্তু রড টড তো চোখে পড়ল না!

বেলা ৪.৪৩- টুইংটুইং ব্রিজ। টুনটুনির পুল?

বেলা ৪.৫৫- সারচু। সারসার তাঁবুর মেলা। বিদায় লাদাখ। স্বাগত হিমাচল প্রদেশ।

বেলা ৬. ১০- ভরতপুর। চা ভরলাম উদরপুরে।

বেলা ৬.১০- তুষারহীন! জনমানবহীন! এ কেমন লাহুল, স্পিতি আর লাদাখের তেমাথা বড়লাচা লা — ১৬০৫০ফুট।


সুরজতাল

বেলা ৬.৫১- ভাগা নদীর উৎস সুরজতাল।

বিকেল ৭.১৩- জিংজিংবার। বার না হলেও চা-খাবার পাওয়া যায়।

বিকেল ৭.৩৫- পাৎসেও। পাতছে ও? কী পাতছে?

বিকেল ৭.৩৭- ছোট্ট শান্ত দীপকতাল।

সন্ধে ৮.১০- দারচা। ১১০০০ফুটের এই অস্থায়ী তাঁবু-গ্রামে ২০১১-য় রাত কাটিয়েছি। তাই কেমন আত্মীয়বাড়ির সুখে পেলাম লাহুলের এই অস্থায়ী জনপদে।

প্রায় রাত ৮.৩০- জিসপা। আড়েবহরে হোটেলে দিব্যি বেড়েছে!

রাত ৯.১০- কেলং। মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু-র স্মৃতিবিজড়িত কেলং। হোটেল তাশি দেলেকের আরামদায়ক ঘরে পৌঁছে আজকের যাত্রার শুভসমাপ্তি। এ ক-বছরে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে কেলং-য়ের। এখন সে রীতিমতো শহর — বাড়িঘরের জঙ্গল।

৫ জুলাই সকাল ৬টা- নির্মল আকাশে লেডি অব কেলং-য়ের নজরদারিতে কেলং- আড়মোড়া ভাঙছে। আজ মানালির সবুজ অধিত্যকা আমাদের গন্তব্য। লাদাখ-এর ঊষর প্রকৃতি এখন শুধুই স্মৃতি। চারদিকের সবুজ সকালের আলোয় উজ্জ্বল হাসি হাসছে।

সকাল ৮.৩৭- যাত্রা শুরু।

সকাল ৮.৪১- মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু-র আবক্ষমূর্তির সামনে। বিশ্বাসঘাতকায় দেশব্যাপী বিদ্রোহের অকালমৃত্যুর পর মাথার ওপর বিশাল অঙ্কের পুরস্কার থাকা সত্ত্বেও ইংরেজ গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে লাহোর থেকে এখানে এসে ৮ মাসের জন্য আত্মগোপন করেন রাসবিহারী পরবর্তী পরিকল্পনা ছকে নেবার উদ্দেশ্যে।

সকাল ৮.৫৮- বীলিং। সঙ্গী ভাগা নদী। বিলি কাটবার দায় তার।

সকাল ৯.১৩- তান্ডি। ভাগা এখানে চন্দ্রতাল থেকে ছুটে আসা চন্দ্রা-র সঙ্গে মিলিত হয়েছে। জন্ম নিয়েছে চন্দ্রভাগা (চেনাব) নদীর। সেই সুদূর লাদাখের পর এখানেই প্রথম দেখা মেলে পেট্রোল পাম্প-এর। গাড়ি তাই পেট ভরাতে ব্যস্ত।

সকাল ৯.৫৪- গোন্ধলার সবুজকার্পেট চন্দ্রানদীর পারে।

সকাল ১০.২৩- সিস্‌সু। একটুকরো চোখজুড়ানো ছবি।

সকাল ১০.৫০- খোকসার। অনিবার্য চা-বিরতি। সকালের মধুর শীতল বাতাস আর সোনারোদ্দুর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গে। চন্দ্রাকে টপকে চলে এলাম তার ডানতীরে।

সকাল ১১.১১- ১০৩০০ ফুটের খোকসার ছেড়ে ১৩১০০ ফুটের রোহতাং পাসে পৌঁছনোর তাগিদে সামনের চড়াইয়ে চাকা চারটেকে চড়ালো আমাদের গাড়ি।

সকাল ১১.২৯- গ্রামফু। স্পিতির পথ ছুটে চলল চন্দ্রা-র উজানে। আমরা চড়তে থাকলাম তাকে নিচে ফেলে।

দুপ্পুর ১২.১৮- নিস্তব্ধ শ্মশানপুরী রোহতাং পাস। ১৩১০০ ফুটে এখন শূন্যতা। হই হট্টগোলে দোকানপাট ঘোড়া টুরিস্ট সব ভ্যানিশ। এমন দিকশূন্যপুর রোহতাং কখনও দেখব, স্বপ্নেও ভাবিনি। পরিবেশবিদদের নিষেধাজ্ঞা মেনেই এই শূন্যতা। নিচে মাঢ়ীও নির্জন বলেই মনে হচ্ছে।

দুপুর ১২.৫০- মাঢ়ী। ঝাঁপফেলা ক-টা দোকান শুধু।

দুপুর ১.১৩- গুলাবা। হ্যান্ড গ্লাইডিং-য়ের দৌলতে কিছু প্রাণস্পন্দন।

দুপুর ১.৩১- নির্জন রাহালাকে ফেলে কোঠির এক কুঠিতে। পেটের কোটরে মুঠি ভরে কিছু দেওয়ার উদ্দেশ্যে। চারদিকের সবুজ চোখ মনকে অদ্ভুত আরাম দিচ্ছে — সঙ্গে বিপাশা (বিয়াস)-র নৃত্যগীত।

দুপুর ২.৩১- পলচল। পলক ফেলতে পেরিয়ে এলাম।


মানালি, বশিষ্ঠ কুণ্ডের কাছ থেকে

দুপুর ৩.১৫- মানালিকে বিপাশার ওপারে রেখে বশিষ্ঠ কুণ্ডের কাছে ভ্যালি-ভিউ-র বারান্দা থেকে ভ্যালির ভিউ আবলোকন। এতদিনের সঙ্গী ওয়াঙ্গেলকে ছাড়তে বুকের ভিতর চিনচিন।

বিকেল ৫.৫০- বশিষ্ঠ মন্দির দর্শন করলাম। নির্ঘাৎ কিছুটা বাড়তি পুণ্য পকেটে ঢুকল।

৬ জুলাই সকাল ৬টা- আজ সফর শেষের শুরু। শেষবারের মতো দুচোখ ভরে মানালিকে দেখে নিই।

সকাল ১১.৪৭- গাড়ি বিভ্রাটে শুরুর শুরুটাই পিছিয়ে গেল।

দুপুর ১২.১৮- পাতলিখুল। যা ব্বাবা! খোলা পাতাল! না, পাতলা খুলি! গাড়ি ধরল মান্ডির পথ।

দুপুর ১২.২৫- কটরাই। কেউ কেউ বলে কাতরেইন। বৃষ্টি এখানে কি কাত হয়ে পড়ে?

দুপুর ১২.৩৭- রায়সন। ডটাররা কী দোষ করল?

দুপুর ১২.৫৫- ওপারে কুল্লু। মাঝে কুলুকুলু করে বইছে বিয়াস।

দুপুর ১.০৪- ভুন্তর। এই এলাকার এয়ারপোর্ট এখানেই। মণিকরণের পথও এখান দিয়েই।

দুপুর ১.১৬- বজৌরা। গাড়ি দৌড়া।

দুপুর ১.২৩- নাগওয়েইন। নাগও ওয়াইন খায়!

দুপুর ১.৪৪- অওট। খাই খাই স্টপ।

দুপুর ২.১৯- ভরাপেটে আবার দৌড়। দৌড়চ্ছে অবশ্য গাড়িই।

দুপুর ২.২৭- পেরোলাম অওট টানেল। ৩.৫ কি.মি. লম্বা!

দুপুর ২.২৯- থলৌট। আ অব লৌট চলে।

দুপুর ২.৩৩- লারজি। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে লার্জ স্কেলে।

দুপুর ২.৫৪- পন্ডোহ। পণ্ড হবে! কেন?

দুপুর ২.৫৮- জাগরনালা। ঘুমন্ত নালাও আছে নাকি?

দুপুর ৩.১৫- মন্ডী। কী বিক্রি হয় এখানে?

দুপুর ৩.২৭- গুলকর। গুল তৈরি হয় নাকি এখানে?

দুপুর ৩.৩১- বগলা। জয় মা বগলা।

দুপুর ৩.৩৪- লুলাপানি। যাচ্চলে! জল লুলা হয় কি করে?

দুপুর ৩.৩৭- নের চৌক। ঢের গরম।

দুপুর ৩.৫১- কনৌড়। চলছে দৌড়।

দুপুর ৩.৫৬- সুন্দরনগর। কতটা সুন্দর বোঝার আগেই পেরিয়ে এলাম।

বেলা ৪.৫৪- বেরি। কুলের দেশ বুঝি!

বেলা ৫.০১- নদী পার করে সিমলার পথে।

বেলা ৫.০৬- থোরু। এ কি গোবর মাসতুতো ভাই?

বেলা ৫.০৭- মন্দোলি। মন্দ কী!

বেলা ৫.১৪- জুথালা। চিড়িয়াখানার থালা!

বেলা ৫.৩৬- নমহোল। গর্তকে খামোখা পেন্নাম ঠুকতে যাব কেন?

বেলা ৫.৪৯- সিমলাকে এড়াতে ডানহাতি চড়াই পথে চড়া।

বেলা ৫.৫২- ধুন্দন। কুন্দনের বন্ধু? (বাই দ্য ওয়ে, কুন্দনটা কে? )

বিকেল ৬.০৫- পিপুলঘাট। ঘাট তো বুঝলাম, নদী কই?

বিকেল ৬.১৭- বখালগ। বখে যাওয়া গাছের গুঁড়ি!

বিকেল ৬.৩২- পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে!! একটা চা-টা-র দোকান পাওয়া গেছে। পড়ন্ত আলোয় চা-টা খাওয়ার দুরন্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় চলছে।

বিকেল ৬.৫১- অর্কী। অর্ক মানে তো কিরণ। অর্কী কি তবে কিরণী!

বিকেল ৬.৫৪- জাখোলি। ভদ্রকালীর মন্দির। প্রণাম ঠুকে চলি।

বিকেল ৬.৫৭- ঘাঘর। ঘায়ের ঘর?

সন্ধে ৭.০৯- বীরন। মৌমাছির যুদ্ধ!

সন্ধে ৭.২৯- গমঝনু। মনে হয় গম ঝুনঝুন করে বাজানো হয় এখানে।

সন্ধে ৭.৩৯- কক্কড়হাটী। কাঁকরভরা হাট?

সন্ধে ৭.৫০- সুবাথু। সুবা থুথু ফেলছে। কেন?

রাত ৮.১৯- ধরমপুর। খুব পূণ্যবান স্থান তো!

রাত ৮.৪০- জাবলি। সত্যকামের মামাবাড়ি?

রাত ৯.০৯- পরওয়ানু। পরোয়া নেই বললেই হবে? এবার গাড়ি বদলে পৌঁছতে হবে কালকা।

রাত ৯.২৭- কালকা স্টেশন আজহী পঁহুচ গয়ে।

রাত ১০টা- কালকা স্টেশনের এগজিকিউটিভ লাউঞ্জে বসে ট্রেনের জন্য অনন্ত অপেক্ষা। তিনি লেট। আসবেন শেষ রাতে — দুটোয়।


কালকা স্টেশন

৭ জুলাই রাত ০২.৩২- ট্রেন আজ কালকা ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি জমাল। লাদাখ পর্ব সমাপ্ত। এখন সুখস্মৃতির জাবর কাটা।

(শেষ)



(পরবাস-৬৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)



স্কেচ : রাহুল মজুমদার ও ছবি রাজীব চক্রবর্তী