আমেরিকায় দূরপাল্লার মোটরযাত্রা বা 'রোড ট্রিপ' খুবই জনপ্রিয়। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার-এর মাথায় দেশজোড়া বিরাট রাস্তার পরিকল্পনা আসে। ১৯১৯ সালে আইসেনহাওয়ার ও দলবল রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি. থেকে গাড়িতে চড়ে ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার প্ল্যান করেন। একেবারে পূব থেকে পশ্চিম — পুরো দেশটার ভ্রমণ। নেব্রাস্কা, উটা ও নেভাডায় অনেক বিপদআপদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। বেশ কয়েকবার তো প্রায় সব ছেড়ে ঘরে ফেরার অবস্থা হয়েছিল। তারপর তিনমাস পর ক্যালিফোর্নিয়ায় পৌঁছতে পারেন। অনেক কল্পনা-জল্পনার পর ১৯৫৬-সালে হাইওয়ে অ্যাক্ট পাশ হয়। তারপর সারা দেশ জুড়ে মাকড়শার জালের মত হাইওয়ে ও তার শাখাপ্রশাখা তৈরি হয়। এই ইন্টার-স্টেট রাস্তাগুলি এখন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে, প্রতি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে।
পাশে পাশে গড়ে উঠেছে পেট্রল-স্টেশন, হোটেল, মোটেল ও রেস্তরাঁ। নানারকম অখ্যাত, বিখ্যাত দর্শনীয় জায়গা, ঐতিহাসিক শহর, বন্দর সব জায়গায় পৌঁছনো যায় এখন।
এদেশে আসার পর এই বিরাট রাস্তাগুলি সবথেকে প্রথমে আমার নজর কেড়েছিল। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চালিয়েও বিশেষ ক্লান্তি আসে না। ভ্রমণবিলাসীদের এর চেয়ে বেশী আর কি চাই? ষোল বছর বয়সেই এদেশের ছেলেমেয়েরা গাড়ি চালাবার লাইসেন্স পায়। তারপর — অপার স্বাধীনতা। যখন খুশি, যেখানে খুশি যেতে পারে। অনেকেই হাইস্কুল পাস করে কলেজ শুরু করার আগে বন্ধুবান্ধব মিলে একটা রোডট্রিপ করার প্ল্যান করে। কেউ কেউ ক্রসকান্ট্রি — এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তও পাড়ি দেয়। এই হল রোডট্রিপের ট্রাডিশন — বাধাবন্ধনহীন যাত্রা — দূরপাল্লার হাতছানি। সাহিত্যে জ্যাক কেরুয়াক থেকে হলিউডের থেল্মা অ্যান্ড লুইস পর্যন্ত যুগে যুগে লেখক, কবি ও ফিল্ম ডাইরেকটররা রোডট্রিপের রোমান্স নিয়ে কত গল্প, কত গান, কত ছবিই না তৈরি করে গেছেন। যাতায়াত তো আরও অনেক ভাবেই করা যায় — অ্যামট্র্যাক ট্রেনে, গ্রে-হাউন্ড বাসে বা নানা কোম্পানীর প্লেনে করে অনেক কম সময়ে গন্তব্যস্থানে পৌঁছনো যায়। কিন্তু নিজের গাড়িতে চড়ার স্বাধীনতা ও অ্যাডভেঞ্চার আর কোথাও পাবেন না।
অবশ্য রোড ট্রিপ তো আজকাল জলভাত হয়ে গেছে। শুধু আমেরিকাতেই নয়, অন্যান্য দেশেও এইরকম সুশৃঙ্খল রাস্তার সুবিধা আছে। তবে আমেরিকার মত দূরপাল্লার রাস্তা বোধহয় আর কোথাও নেই।
শুধু সুন্দর রাস্তাই নয়, সফল রোডট্রিপের জন্য চাই সুন্দর গাড়ি — আরামদায়ক ও সর্ব সুবিধা সংকলিত — এয়ার কন্ডিশন বা হিটিং, রেডিও, সি.ডি. এমনকি Internet ও TV আছে। নরম গদী, মসৃণ গতি — এ সবই রোডট্রিপকে আরও সুখদায়ক করে তোলে। এইসঙ্গে অবশ্যই যোগ করুন সস্তা পেট্রল বা গ্যাস (গ্যাসোলিন)। এই তিনটির সুবর্ণ যোগ হয়েছে আমেরিকার রোডট্রিপ ট্রাডিশনে।
আমরা প্রবাসীরা যারা এদেশে ষাট বা সত্তর দশকে এসেছি, আমাদের ভারতীয় মধ্যবিত্ত চোখে নিজের গাড়ি কেনা ও নিজে চালিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাওয়াটা ভীষণ উত্তেজক অভিজ্ঞতা। অনেকের মত আমরাও ছুটি পেলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলের ছুটিতে লম্বা সফর কিংবা বাক্স-পেঁটরা নিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে সংসার পাতা, স্বামী-স্ত্রী গাড়ি নিয়ে রোম্যান্টিক বেড়ানো, বা বন্ধু-বান্ধব মিলে হৈ চৈ করা সবই করেছি। বাদামী রং-এর জন্য কখনো পুলিশ বা অন্য বর্ণবিদ্বেষীদের হাতে হেনস্থা হয়নি। সব জায়গাতেই সবার কাছে ভদ্র ব্যবহার ও সাহায্যই পেয়েছি — এটা হয়তো আমারই সৌভাগ্য। অনেকের অন্য অভিজ্ঞতার গল্পও শুনেছি।
অনেক ‘চিকিৎসা’ সত্ত্বেও গাড়িটার অসুখ ক্রমেই বাড়ছিল। একটা সারাই তো আরেকটা কিছু গড়বড় করে। শেষ উপসর্গ ব্যাক করার রিভার্স গীয়ারটা বিগড়ে বসলো। গাড়ি ব্যাক হয় না। খুব ভেবেচিন্তে পার্ক করতে হত যাতে ব্যাক না করেই গাড়ি বের করা যায়। কিন্তু এরকমভাবে আর কতদিন চলে, এদিকে শীতও এসে গেছে — বরফের মধ্যে চালানো আরও ঝামেলা। নতুন একটা গাড়ি কেনার দরকার। কিন্তু ‘অ’ ততদিনে লাল ফিয়াটের প্রেমে পড়ে গেছে। মনে আশা যদি জোড়াতালি দিয়ে আরও কিছুদিন চালানো যায়। আমি সবাইকে ফোন করছি গাড়ি বেচবো — জলের দামে। চেনাশোনা কাউকে বেচতে চাই না কারণ সবাই আমাদের ফিয়াট কাহিনি শুনে ফেলেছে। ডীলাররাও গাড়ির নাম ও মডেল শুনে “না, ধন্যবাদ” বলে দেন। শেষমেশ মরিয়া হয়ে “Goodwill” দাতব্যালয়ে গাড়িটা দানই করে দিলাম। তাও আমি চালিয়ে যেতে পারিনি। ওরাই বাড়ি বয়ে এসে দড়ি বেঁধে গাড়িটা টেনে নিয়ে যায়। তাই নিয়ে আমার স্বামীর কি দু:খ। অতো ঝামেলা সত্ত্বেও জীবনের প্রথম প্রেম সেই লাল ফিয়াটের জন্য তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এখনও।
এরপর গত তিন দশকে আমাদের গ্যারাজে অনেক গাড়ি এসেছে ও গেছে। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি।
অন্যান্য আমেরিকান পরিবারের মতই আমাদের কপালেও ছোট বড়ো অঘটন, দুর্ঘটন ঘটেছে। রাস্তা ভুলে অন্য শহরে পৌঁছে যাওয়া। মাঝপথে গাড়ির চাবি হারানো, পাহাড়ি রাস্তায় মেয়েদের বমি ইত্যাদি তো হয়েইছে। তার মধ্যেই বিস্তর গান, খেলা, পিছনের সীটে দুই বোনের খুনসুটি ও প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর “আর কতদূর?” “আর কতক্ষণ বাকি?” এসব তো সব যাত্রাকাহিনিরই অঙ্গ। পেছনে তাকালে সব দু:স্মৃতিগুলোও সময়ের প্রলেপে মজার অ্যাডভেঞ্চার হয়ে ওঠে। আমার মেয়েরা সেইভাবেই গল্প শোনায় আমার নাতি-নাতনীকে।
গত চার দশকে আমরা আমেরিকার পঞ্চাশটি প্রদেশেই বেড়িয়েছি — কাজের মিটিং-এ, পাখি দেখার ছুতোয়, পারিবারিক সম্মেলনে, আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে, এবং কোনো কারণ ছাড়াই। আলাস্কা, হাওয়াই, পোর্টোরিকোও বাদ যায়নি। এমনকি মেক্সিকো ও কানাডার দু একটি জায়গাতেও ড্রাইভ করেছি। এখনও রোডট্রিপের নাম শুনলেই মন নেচে ওঠে। আসছে মাসে উটা গেলে হয় না? আমার কাছে গাইড বই ও ম্যাপের মত রোমাঞ্চকর বই নেই। যতদিন পারি চালিয়ে যাব। সময় তো প্রায় ফুরিয়েই এল। চরৈবেতি...
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)