ISSN 1563-8685




রোড ট্রিপার


খোলা রাস্তার ডাক

মেরিকায় দূরপাল্লার মোটরযাত্রা বা 'রোড ট্রিপ' খুবই জনপ্রিয়। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার-এর মাথায় দেশজোড়া বিরাট রাস্তার পরিকল্পনা আসে। ১৯১৯ সালে আইসেনহাওয়ার ও দলবল রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি. থেকে গাড়িতে চড়ে ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার প্ল্যান করেন। একেবারে পূব থেকে পশ্চিম — পুরো দেশটার ভ্রমণ। নেব্রাস্কা, উটা ও নেভাডায় অনেক বিপদআপদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। বেশ কয়েকবার তো প্রায় সব ছেড়ে ঘরে ফেরার অবস্থা হয়েছিল। তারপর তিনমাস পর ক্যালিফোর্নিয়ায় পৌঁছতে পারেন। অনেক কল্পনা-জল্পনার পর ১৯৫৬-সালে হাইওয়ে অ্যাক্ট পাশ হয়। তারপর সারা দেশ জুড়ে মাকড়শার জালের মত হাইওয়ে ও তার শাখাপ্রশাখা তৈরি হয়। এই ইন্টার-স্টেট রাস্তাগুলি এখন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে, প্রতি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে।


পাশাপাশি জেল, নাপিত, ও মৃতদেহ
সৎকারের দোকান; পশ্চিম নেব্রাস্কা (২০১৫)

পাশে পাশে গড়ে উঠেছে পেট্রল-স্টেশন, হোটেল, মোটেল ও রেস্তরাঁ। নানারকম অখ্যাত, বিখ্যাত দর্শনীয় জায়গা, ঐতিহাসিক শহর, বন্দর সব জায়গায় পৌঁছনো যায় এখন।

এদেশে আসার পর এই বিরাট রাস্তাগুলি সবথেকে প্রথমে আমার নজর কেড়েছিল। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চালিয়েও বিশেষ ক্লান্তি আসে না। ভ্রমণবিলাসীদের এর চেয়ে বেশী আর কি চাই? ষোল বছর বয়সেই এদেশের ছেলেমেয়েরা গাড়ি চালাবার লাইসেন্স পায়। তারপর — অপার স্বাধীনতা। যখন খুশি, যেখানে খুশি যেতে পারে। অনেকেই হাইস্কুল পাস করে কলেজ শুরু করার আগে বন্ধুবান্ধব মিলে একটা রোডট্রিপ করার প্ল্যান করে। কেউ কেউ ক্রসকান্ট্রি — এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তও পাড়ি দেয়। এই হল রোডট্রিপের ট্রাডিশন — বাধাবন্ধনহীন যাত্রা — দূরপাল্লার হাতছানি। সাহিত্যে জ্যাক কেরুয়াক থেকে হলিউডের থেল্‌মা অ্যান্ড লুইস পর্যন্ত যুগে যুগে লেখক, কবি ও ফিল্ম ডাইরেকটররা রোডট্রিপের রোমান্স নিয়ে কত গল্প, কত গান, কত ছবিই না তৈরি করে গেছেন। যাতায়াত তো আরও অনেক ভাবেই করা যায় — অ্যামট্র্যাক ট্রেনে, গ্রে-হাউন্ড বাসে বা নানা কোম্পানীর প্লেনে করে অনেক কম সময়ে গন্তব্যস্থানে পৌঁছনো যায়। কিন্তু নিজের গাড়িতে চড়ার স্বাধীনতা ও অ্যাডভেঞ্চার আর কোথাও পাবেন না।


গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে কলোরাডো নদীতে র‍্যাফটিং (১৯৮৪)

অবশ্য রোড ট্রিপ তো আজকাল জলভাত হয়ে গেছে। শুধু আমেরিকাতেই নয়, অন্যান্য দেশেও এইরকম সুশৃঙ্খল রাস্তার সুবিধা আছে। তবে আমেরিকার মত দূরপাল্লার রাস্তা বোধহয় আর কোথাও নেই।

শুধু সুন্দর রাস্তাই নয়, সফল রোডট্রিপের জন্য চাই সুন্দর গাড়ি — আরামদায়ক ও সর্ব সুবিধা সংকলিত — এয়ার কন্ডিশন বা হিটিং, রেডিও, সি.ডি. এমনকি Internet ও TV আছে। নরম গদী, মসৃণ গতি — এ সবই রোডট্রিপকে আরও সুখদায়ক করে তোলে। এইসঙ্গে অবশ্যই যোগ করুন সস্তা পেট্রল বা গ্যাস (গ্যাসোলিন)। এই তিনটির সুবর্ণ যোগ হয়েছে আমেরিকার রোডট্রিপ ট্রাডিশনে।


কিলাওয়া আগ্নেয়গিরি, হাওয়াই (১৯৮৭)

রোডট্রিপের কয়েকটি অভিশপ্ত প্রভাবও আছে। প্রতি বছর হাজার হাজার যাত্রী পথে দুর্ঘটনায় মারা যান ও ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর জন্য দায়ী অ্যালকোহল ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য। অতিরিক্ত স্পীডে গাড়ি চালানো, লম্বা সফরের ক্লান্তি, রাস্তায় বরফ, ঝড়বৃষ্টি ইত্যাদি। রাস্তায় পরিষ্কার সাবধান চিহ্ন ও গাড়িতে সীটবেল্ট ও এয়ারব্যাগ থাকা সত্ত্বেও এসব ঘটে। আমার কপালেও ঘটেছিল প্রায় তিরিশ বছর আগে। হাসপাতালে ছিলাম মাসখানেক, এখনও তার রেশ রয়ে গেছে। এসব ছাড়াও আছে পরিবেশ-দূষণ, পেট্রলের অপচয় ইত্যাদি। তবুও খোলা রাস্তার আকর্ষণ দুর্বার।


'ওল্ড ফেথফুল'--ইয়েলোস্টোন ন্যশনাল পার্ক (১৯৯২)

আমরা প্রবাসীরা যারা এদেশে ষাট বা সত্তর দশকে এসেছি, আমাদের ভারতীয় মধ্যবিত্ত চোখে নিজের গাড়ি কেনা ও নিজে চালিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাওয়াটা ভীষণ উত্তেজক অভিজ্ঞতা। অনেকের মত আমরাও ছুটি পেলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলের ছুটিতে লম্বা সফর কিংবা বাক্স-পেঁটরা নিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে সংসার পাতা, স্বামী-স্ত্রী গাড়ি নিয়ে রোম্যান্টিক বেড়ানো, বা বন্ধু-বান্ধব মিলে হৈ চৈ করা সবই করেছি। বাদামী রং-এর জন্য কখনো পুলিশ বা অন্য বর্ণবিদ্বেষীদের হাতে হেনস্থা হয়নি। সব জায়গাতেই সবার কাছে ভদ্র ব্যবহার ও সাহায্যই পেয়েছি — এটা হয়তো আমারই সৌভাগ্য। অনেকের অন্য অভিজ্ঞতার গল্পও শুনেছি।


আমাদের প্রিয় লাল ফিয়াট--'ব্যাডল্যান্ড্‌স' (১৯৭৫)
আমি আমেরিকায় আসি ১৯৭৪-সালে। আমার স্বামী ‘অ’ দুদিন পরেই একটি গাড়ি কিনলেন। গাড়ি ছাড়া এদেশে চলাফেরা করা মুশকিল। কিন্তু সেইসময় আমাদের ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স বলতে কিছুই ছিল না। যেটুকু ছিল তাই দিয়ে সস্তায় সেকেন্ডহ্যান্ড (ব্যবহৃত) ছোট্ট গাড়ি পেলাম — লাল টুকটুকে ফিয়াট। সেই সময় গাড়ি সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞানও ছিল না। জানতাম না যে আমাদের গাড়িটি একটি আস্ত লেবু। ইংরেজিতে যাকে বলে lemon (মানে কোনো কাজের নয়)। ‘অ’ তো প্রথম দৃষ্টিতেই গাড়িটির প্রেমে পড়ে গেলেন। প্রথম গাড়ি প্রথম প্রেমের মতই স্পেশ্যাল। গাড়ি কেনার পরেই লাইসেন্স পাওয়া গেল। এতদিন নিজের গাড়িতে বেড়াতে যাবার স্বপ্নই দেখেছি। লাইসেন্স পাওয়া মাত্রই প্রথম রোডট্রিপ ঠিক করলাম। সঙ্গে এলেন এক বন্ধুর মা ও বাবা — এদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁরা তো আর জানতেন না যে এটা আমাদের প্রথম রোডট্রিপ — এক মাস আগেও আমরা গাড়ির ‘গ’-ও জানতাম না। অবশ্য আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহ দুই মিলে অভিজ্ঞতার খামতিটা পুষিয়ে দিয়েছিল। সেবার আমরা ৬১০ মাইল দূরে কলোরাডো প্রদেশে গেছিলাম। আকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় ড্রাইভ করে অতিথিদের রকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্ক ও বিখ্যাত পাইক্‌স পীক চড়েছিলাম। ভগবানের কৃপায় কোনো অঘটন ঘটেনি। গাড়িটাও আমাদের মুখ রেখেছিল।


বাক্সবন্দি শিশুকন্যা (১৯৭৬)
সে-ই আমাদের প্রথম রোডট্রিপ। এরপর আমরা দুজনেই যে ভ্রমণ-নেশার কবলে পড়লাম এখনও তা কাটাতে পারিনি। ওমাহা শহরটা দেশের মধ্যিখানে হওয়ার মস্ত সুবিধা — আমরা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম যেদিক খুশি বেরিয়ে পড়তে পারি। দুই মেয়ে হবার পর দুই মেটারনাল লীভের ছুটি আমি রোড-ট্রিপেই কাটিয়েছি। প্রথমবার, দক্ষিণে নিউ অর্লিয়ন্স, ফ্লোরিডা হয়ে পোর্টোরিকো পর্যন্ত ও দ্বিতীয় কন্যার সময়ে উত্তরে শিকাগো, ডেট্রয়েট হয়ে নায়াগ্রা ফলস ও ভারমন্ট পর্যন্ত চলে গেছিলাম হেমন্তের রঙিন পাতার শোভা দেখতে দেখতে। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে সফর করা বেশ সহজ। বেশিরভাগ সময়েই ওরা ঘুমোয়। তখন তো বাচ্চাদের কার-সীটের চল হয়নি। একটা স্যুটকেসের ডালা খুলে সেটা বিছানা করে নিয়ে গাড়িতে সিটবেল্ট দিয়ে বেঁধে দিতাম। ওরা আরামসে ঘুমোতো। AAA-সংস্থার কল্যাণে আমার সব গাইড বই ও ম্যাপের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছিল — তখন তো আর GPS ছিল না। পশ্চিমে খোলা রাস্তায় স্পীড লিমিটও ছিল না। সোজা, খালি রাস্তায় নব্বুই মাইল বেগে গাড়ি ছোটানোর যে কী আনন্দ — আমার স্বামীকে জিগ্যেস করবেন!


মাউন্ট রাশমোর, সাউথ ডাকোটা (১৯৮৮)


সূর্যমুখীর ক্ষেত, সাউথ ডাকোটা (২০১৬)

লেবু-গাড়ির অম্লরস পেতে আমাদের বেশিদিন লাগল না। তিনদিনের লম্বা ছুটিতে উত্তরে মাউন্ট রাশমোর ও ব্যাডল্যান্ড দেখার প্ল্যান করেছিলাম। মাঝরাস্তায় Wall Drug নামক এক বিশাল দোকানের কাছে এসে গাড়ি অচল হল।


'ইয়ু ওনলি লিভ ওয়ান্‌স'--সে আর বলতে! (১৯৯৮)

কাছাকাছি লোকালয় থাকার দরুণ একটা মেকানিক পেলাম যে ছুটির দিনও কাজ বন্ধ করেনি। তার কাছে গাড়ি জমা দিয়ে হিচ হাইক করে আমরা দর্শনীয় সব কিছু দেখলাম। তখন হিচ হাইক বেশ নিরাপদ ছিল (এখন আর নেই) আর শাড়ি পরে রাস্তায় দাঁড়ালে দু-মিনিটের মধ্যে লিফ্‌ট্‌ পাওয়া যেত। ফেরার পথে গাড়িটা চলছিল বটে কিন্তু নিতান্তই দায়ে পড়ে। একটু ছুতো পেলেই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেত। তারপর ধাক্কা না লাগালে শুরুই হত না। সেই ধাক্কার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। ইঞ্জিন শুরু হয়ে গাড়ি গড়াতে থাকলে চট করে দরজা খুলে, শাড়ি-টাড়ি সামলে লাফিয়ে উঠে পড়া!


ইয়েসোমিটে ন্যাশনাল পার্ক, ক্যালিফোর্নিয়া (২০০৮)

অনেক ‘চিকিৎসা’ সত্ত্বেও গাড়িটার অসুখ ক্রমেই বাড়ছিল। একটা সারাই তো আরেকটা কিছু গড়বড় করে। শেষ উপসর্গ ব্যাক করার রিভার্স গীয়ারটা বিগড়ে বসলো। গাড়ি ব্যাক হয় না। খুব ভেবেচিন্তে পার্ক করতে হত যাতে ব্যাক না করেই গাড়ি বের করা যায়। কিন্তু এরকমভাবে আর কতদিন চলে, এদিকে শীতও এসে গেছে — বরফের মধ্যে চালানো আরও ঝামেলা। নতুন একটা গাড়ি কেনার দরকার। কিন্তু ‘অ’ ততদিনে লাল ফিয়াটের প্রেমে পড়ে গেছে। মনে আশা যদি জোড়াতালি দিয়ে আরও কিছুদিন চালানো যায়। আমি সবাইকে ফোন করছি গাড়ি বেচবো — জলের দামে। চেনাশোনা কাউকে বেচতে চাই না কারণ সবাই আমাদের ফিয়াট কাহিনি শুনে ফেলেছে। ডীলাররাও গাড়ির নাম ও মডেল শুনে “না, ধন্যবাদ” বলে দেন। শেষমেশ মরিয়া হয়ে “Goodwill” দাতব্যালয়ে গাড়িটা দানই করে দিলাম। তাও আমি চালিয়ে যেতে পারিনি। ওরাই বাড়ি বয়ে এসে দড়ি বেঁধে গাড়িটা টেনে নিয়ে যায়। তাই নিয়ে আমার স্বামীর কি দু:খ। অতো ঝামেলা সত্ত্বেও জীবনের প্রথম প্রেম সেই লাল ফিয়াটের জন্য তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এখনও।

এরপর গত তিন দশকে আমাদের গ্যারাজে অনেক গাড়ি এসেছে ও গেছে। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি।


নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক (১৯৮৮)

অন্যান্য আমেরিকান পরিবারের মতই আমাদের কপালেও ছোট বড়ো অঘটন, দুর্ঘটন ঘটেছে। রাস্তা ভুলে অন্য শহরে পৌঁছে যাওয়া। মাঝপথে গাড়ির চাবি হারানো, পাহাড়ি রাস্তায় মেয়েদের বমি ইত্যাদি তো হয়েইছে। তার মধ্যেই বিস্তর গান, খেলা, পিছনের সীটে দুই বোনের খুনসুটি ও প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর “আর কতদূর?” “আর কতক্ষণ বাকি?” এসব তো সব যাত্রাকাহিনিরই অঙ্গ। পেছনে তাকালে সব দু:স্মৃতিগুলোও সময়ের প্রলেপে মজার অ্যাডভেঞ্চার হয়ে ওঠে। আমার মেয়েরা সেইভাবেই গল্প শোনায় আমার নাতি-নাতনীকে।


ভাল্লুক, আলাস্কা (১৯৯৬)

গত চার দশকে আমরা আমেরিকার পঞ্চাশটি প্রদেশেই বেড়িয়েছি — কাজের মিটিং-এ, পাখি দেখার ছুতোয়, পারিবারিক সম্মেলনে, আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে, এবং কোনো কারণ ছাড়াই। আলাস্কা, হাওয়াই, পোর্টোরিকোও বাদ যায়নি। এমনকি মেক্সিকো ও কানাডার দু একটি জায়গাতেও ড্রাইভ করেছি। এখনও রোডট্রিপের নাম শুনলেই মন নেচে ওঠে। আসছে মাসে উটা গেলে হয় না? আমার কাছে গাইড বই ও ম্যাপের মত রোমাঞ্চকর বই নেই। যতদিন পারি চালিয়ে যাব। সময় তো প্রায় ফুরিয়েই এল। চরৈবেতি...





(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)