ভূতের ছানার হাতদুটো কিছুতেই আর লম্বা হচ্ছে না।
বাবা-ভূত আর মা-ভূতের তাই এই নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। ভূত হয়ে বাচ্চা যদি হাতদুটোকে যেমন খুশি বড় করতে না পারে — এই যেমন ধরো মাটিতে দাঁড়িয়ে নারকেল গাছ থেকে গোটা দশেক নারকেল পেড়ে আনা — তা হলে বড় হয়ে বাচ্চার হবে কি? কে তাকে ভূত বলে মানবে?
যত বড় হচ্ছে, ভূতের ছানা নিজেও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বড় হাত না থাকলে কত অসুবিধে। নারকেল না পাড়তে পারা-টারা তো আছেই, তবে সবচেয়ে বেশি অসুবিধে হলো মুণ্ডু-বাস্কেটবল খেলার সময়। মুণ্ডু-বাস্কেটবল খেলার নিয়ম খুব সোজা। নিজের মুণ্ডুটাকে দেহ থেকে খুলে ড্রপ দিতে দিতে ছুঁড়ে অন্যপক্ষের বাস্কেটে ঢোকাতে পারলেই পয়েন্ট। কিন্তু আর সকলের মত ভূতের ছানা কিছুতেই বাস্কেট করতে পারে না। অন্য ভূতের ছানারা নিজেদের হাতগুলোকে লম্বা করে ওর মাথাটা লুফে ফেলে। তারপর সবাই মিলে চেঁচাতে থাকে, “দেবো না! দেবো না!” আর দেয়-ও না! রোজ তাই ভূতের ছানাকে নিজের মুণ্ডু বন্ধুদের জিম্মায় রেখে কবন্ধ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। আর কে না জানে কবন্ধেরা জাতে ছোটো? ওর মা-বাবাও তাই এ’সব দেখে ওর উপরেই ভয়ানক রেগে যায়।
আজকেও যখন এরকম হলো তখন ওর বাবা গম্ভীর গলায় ওর মা কে বললেন, “না! অনেক হয়েছে! আমার মনে হয় এবারে ওকে বদ্যি-ভূতের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।”
বদ্যি-ভূত এক ব্রহ্মদৈত্য। বৈদ্যবাটিতে শ্মশানের পাশে একটা বড় বেলগাছে তাঁর বাসা।
বাবা-ভূতের মুখে সব শুনে আর ভূতের ছানার দুটো হাত-ই খুব ভালো করে টিপে টিপে দেখে বদ্যি-ভূত গম্ভীর হলেন। বললেন, “হুঁ! সমস্যা প্রবল বটে। তবে চিন্তা কোরো না, আমাদের আয়ুর্বেদে — বেদ তো — ওতে সব রোগের নিরাময়ের নির্দেশিকা আছে! ওকে রোজ দু-বেলা জিরাফাদ্য ঘৃত খাওয়াও, হামানদিস্তায় জিরে আর জিরাফ বেটে যা তৈরি হয়! দেখো, জিরাফ যেন খাঁটি হয়, যেন জেব্রার ভেজাল মেশানো না হয়!”
বাবা-ভূত কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, “খাঁটি জিরাফ পাবো কোথায় যে বাটবো?”
— কেন? আফ্রিকায়?
— আফ্রিকা থেকে আনবো কি করে? আমার হাত লম্বা বটে, কিন্তু অতটা লম্বা তো করতে পারবো না!
— হাত আমার-ও অত লম্বা নয়! তবু, চাও যদি তো জিরাফাদ্য ঘৃত আমি আনিয়ে দিতে পারি, আমার বন্ধু জুলু-ভূতের মাধ্যমে। এক শিশিতে এক ছটাক, দাম এক হাজার টাকা। চাও? তবে কাল মাঝরাতে এস।
টাকা দিয়ে পরের দিন মাঝরাতে ওষুধ নিয়ে এলো বাবা-ভূত। কিন্তু কি বাজে বদ্যি-ভূতের ওষুধ! এক ডোজ ওষুধ খাবার পর-ই ভূতের ছানার হাতদুটো নয়, গলাটা লম্বা হয়ে গেলো জিরাফের মতন!
বাবা-ভূত লোকজন জুটিয়ে বদ্যি-ভূতকে ঠ্যাঙাতে গেলো। কিন্তু গিয়ে দেখলো বেলগাছ ফাঁকা, কোথাও কেউ নেই!
ভোর রাতে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে পাশের শেওড়া গাছের শাঁকচুন্নি পিসি বিরক্ত হয়ে খ্যানখ্যানে গলায় বললেন, “পাখি উড়ে গেছে রে, বোকার দল! বদ্যিভূতের ছেলে ওর বাবাকে আমেরিকায় নিয়ে গেছে। সবার ছেলেরাই নিয়ে যায়, খালি আমার ছেলেটাই একটা অপদার্থ, কোনো কাজের নয়!”
বাবা-ভূত আর মা-ভূত এই ঘটনার পর খুব মুষড়ে পড়লো। ওদের দুঃখ দেখে কাকা-ভূত পরামর্শ দিলো যে কলকাতা শহরে কিছুদিন হলো খুব নামকরা এক আমেরিকান ডাক্তার ভূত — ডক্টর পোল্টারজিস্ট — বেড়াতে এসেছেন। তাঁকে দেখালে কেমন হয়?
বাবা-ভূত আর মা-ভূত তো হাতে যেন সদ্য জল থেকে তোলা ইলিশ মাছ পেলো। তক্ষুনি, তক্ষুনি কলকাতা যাবার সব ব্যবস্থা করে ফেলা হলো।
ছানা-ভূতকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে খুব করে নেড়েচেড়ে দেখলেন ডক্টর পোল্টারজিস্ট। ওর মুণ্ডু খুলে লুফে দেখলেন, হাতে পায়ে চাঁটি মারলেন। পেটের কাছে নাক নিয়ে গিয়ে কি সব যেন শুঁকলেন-ও। তারপর গাঁক-গাঁক করে আমেরিকান অ্যাকসেন্ট-এর ইংরেজিতে বললেন, “এটা কোনো সমস্যাই নয়! কাল মাঝরাতে ওকে ভুষুণ্ডির মাঠে নিয়ে এস! তবে আমার ফি কিন্তু টাকা নয়, ডলারে দিতে হবে। এক হাজার ডলার।”
এই কিছুদিন আগে আমেরিকায় শুঁটকিমাছ চালান দিয়ে ঠিক এক হাজার ডলার-ই রোজগার করেছিলো বাবা-ভূত। জমানো সেই এক হাজার ডলার নিয়ে পরের দিন মাঝরাতে ভুষুণ্ডির মাঠে এলো বাবা-ভূত আর ছানা-ভূত। এসে দেখে ডক্টর পোল্টারজিস্ট চারটে গোদা পালোয়ান ভূতকে নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে। ওদের দেখে হেসে বললেন, “এরা আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট!” তারপর তাদের দিকে চেয়ে বললেন, “নে, ট্রিটমেন্ট নাম্বার ১৭, চটপট শুরু কর!”
বলামাত্র ভূতের ছানাকে চ্যাংদোলা করে ফেললো চার পালোয়ান ভূত। দুজন ধরলো ওর দুটো হাত আর বাকি দুজন ওর দুটো পা। তারপর চললো তাদের মধ্যে টাগ-অফ-ওয়ার কম্পিটিশন, ভূতের ছানা যেন সেই লড়াইয়ের দড়ি!
কি টান, কি টান! ভূতের ছানা যন্ত্রণায় চেঁচাতে লাগলো: আঁ-আঁ-আঁ-আঁ-আঁ, কিন্তু কে সেই চার পালোয়ানকে থামাবে?
টানের চোটে ভূতের ছানার দেহ বাড়ছে তো বাড়ছেই, বাড়ছে তো বাড়ছেই, বাড়ছে তো বাড়ছেই …
কিন্তু একটাই শুধু মুশকিল হয়ে গেলো। কি জানো?
যে দুজন পালোয়ান-ভূত ভূতের ছানার হাত ধরেছিলো তারা ছিলো কলকাতার ভূত। আর পায়ের দিকটা ধরেছিলো দুজন আমেরিকান ভূত। কলকাতার ভূত কি কখনো আমেরিকান ভূতের সাথে গায়ের জোরে পারে?
সেজন্যেই ভূতের ছানার হাতদুটো লম্বা না হয়ে লম্বা হয়ে গেলো ওর পা দুটো!
পালোয়ানগুলো অবশ্য তাড়াতাড়ি-ই থেমেছিলো, কিন্তু সেই অল্প সময়ের মধ্যেই যা হবার হয়ে গেছে!
কিন্তু তাতে ক্ষতিটা আর কি হলো বলো? এ তো দেশি বদ্যি-ভূতের হাতের কাজ নয়, খোদ আমেরিকান ডাক্তার ভূতের হাতের কাজ! আমেরিকান ডাক্তারকে তো আর ধরে ঠ্যাঙানো যায় না বাঙালি ডাক্তারের মতন! ঠ্যাঙালে কে না জানে যে ট্রুম্যান সাহেবের ভূত এসে দেশে অ্যাটম বোমা ফেলে যাবে।
বাবা-ভূত আর মা-ভূত তাই খুব খুশি। সারা পাড়া জাঁক করে তাঁরা এখন ভুতুড়ে ভাষায় সকলকে বলে বেড়ান, “আঁমাদেঁর ছেঁলেঁ সবাঁর চেঁয়ে লম্বা!”
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)