১) অভিযান
উটের জীবনগাথা লিখে রাখে বালির কলম।
নিঝুম সরাইখানা, আধোঘুমে ক্লান্ত মুসাফির।
নর্তকীরা ফিরে গেছে, বালিচাপা বিবশ বসনা
মৃত অঙ্গারের মতো। খাপখোলা ছুরি বাঁকা চাঁদ,
আগুনে মাটির পাত্র, শিকে গাঁথা পশুর হৃদয়।
অনন্ত ক্ষুধার ভার নিয়ে গেল তপ্ত ক্যারাভান।
খেজুর গাছের গান মনে রাখে তাঁবুর গালিচা।
যতদিন জাদু ছিল, উড়েছিল মনের খেয়ালে।
বালিতে বিছানা পেতে, খেজুরের স্নিগ্ধ আঙিনায়,
শুয়ে ছিল কতদিন। ভোরবেলা আজানের সুরে।
কোমল রেখাব দিয়ে ধুয়েছিল চোখের কাজল।
তখনই প্রদীপ হাতে ফিরে গেল নক্ষত্র প্রবীণ।
ঘুমভাঙা মিনারেট, বিপণিতে মহা কোলাহল।
কার্পেট, তৈজসপত্র, ঝাড়বাতি, আলো অন্ধকার,
ঘুলঘুলি, কালো চোখ, আলখাল্লা, গোপন খঞ্জর।
সহসা গলির বাঁকে হানা দেয় বুড়ো আলাদিন।
রাজ্য হারিয়েছে কবে, হারিয়েছে আশ্চর্য প্রদীপ।
বোঝা নিয়ে সিন্দবাদ হেঁটে গেল বিরস বদনে।
অপরাহ্ণে সূর্যস্নান, মেঘেরাও বিরল অতিথি।
আকাশে গভীর নীল, ক্যাকটাসে অচেনা সবুজ,
বালিয়াড়ি ওঠে নামে, আদিগন্ত হলুদের স্রোতে
ভাসে দগ্ধ মরীচিকা। বেদুইন অতি নির্বিকার,
কোনো পথ যেথা নেই দিশাহারা বালির সাগরে
উটের লাগাম হাতে চলে গেল অনামী ডেরায়।
ছায়া দীর্ঘতর হয়, সূর্য ঢলে বালির পাহাড়ে,
বালির ওপরে ছবি, বালির ওপরে রক্তরাগ।
খেজুরতলায় একা আমি আর মাটির প্রদীপ
নিস্তব্ধতা হিরণ্ময়, সাঁঝবাতি জানে কথকতা,
সেই চেনা অগ্নিকুণ্ড, কালো ওড়নায় সেই নারী,
আমার হৃদয় নিয়ে জ্বেলে দিল জাতিস্মর শিখা।
২) বিপর্যয়
সব ধুনি নিভে যায়, অঙ্গার বিষণ্ণ উদাসীন।
বাতাসে গায়ত্রীছন্দ, পুবের আকাশে আলপনা।
তাণ্ডব মিলিয়ে যায়, শান্তি ওড়ে রূপালি ডানায়।
পদচিহ্ন মুছে দিয়ে ছন্নছাড়া বালির প্রাসাদ,
ঢেউ আসে শস্যক্ষেতে হাওয়া। শোভন মৃত্যুর ছন্দে,
বালিয়াড়ি জ্বলে ওঠে অন্তিম ক্ষমায়। আমি আছি
ভোরের শ্মশানে একা। সারারাত নিভন্ত আগুনে
মহাক্ষুধা জেগেছিল। আজ ভোরে প্রেতেরা উধাও।
আধপোড়া অভিমান, আধোঘুমে বঞ্চনার স্মৃতি,
সব অভিশাপ নিয়ে দেহ ভাসে কলার ভেলায়।
তোমাকে বন্দনা করি হে উন্মাদ, ওহে অর্থহীন,
ক্ষ্যাপার পরশমণি, ভোরবেলা সোনালি কঙ্কণ।
কি অনন্ত অপচয় এনেছিল রোদে ভরা দিন!
কথারা স্থবির প্রেত, ফিরে গেছে ব্যর্থ কুয়াশায়।
৩) দহন
তোমাকে দিয়েছি পাপ, আমাকে দিয়েছো পদধ্বনি,
প্রতিটি কথার ঋণ চুকে গেছে বোবা যন্ত্রণায়।
ছলনা করেছো জানি, মুগ্ধতায় ভিজিয়েছো হাত,
খেলেছো নিষ্ঠুর খেলা সেই হাতে পুতুলখেলায়।
দিন গেলে কাদাপায়ে হেঁটে গেছো সুরের আঙিনা।
অনেক ঝরেছে রক্ত, অকিঞ্চন প্রতিটি নিমেষ,
উদাস অক্ষরগুলি ধুয়ে গেছে রতি বেদনায়,
অনন্তের অভিসারে যোনি, বক্ষ, ঊরু, ওষ্ঠাধর,
গোধূলির ছিন্ন মেঘ, মেঠো ফুল হরিৎ প্রান্তর,
এ সবই নিয়েছো তুমি, বিনিময়ে দিয়েছো স্তব্ধতা।
তবুও গান্ধার আমি, উঠোনে জ্বালাই সাঁঝবাতি,
কোমল ঋষভ হয়ে ভেসে যাই ভোরের আকাশে,
তীব্র মধ্যমের নেশা, টলোমলো দ্বিতীয় প্রহর,
আমারই সুরের মেঘ এখনো ভেজায় পোড়ামাটি।
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)