ISSN 1563-8685




জলের তলায় বাগান


মেরিন পার্কের ম্যাপ

জাতীয় উদ্যান (ন্যাশনাল পার্ক) তো দেশে অনেক আছে। করবেট থেকে কাজিরঙ্গা, পেঞ্চ থেকে পেরিয়ার। পশুপ্রাণীতে ভর্তি এই পার্কগুলো দেশের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু আমাদের দেশের তিনদিক ঘিরে যে সাগর, উপসাগর, মহাসাগরের বিস্তৃতি, তার খবর আমরা খুব কমই রাখি। ঐ বীচে বসে সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয় দেখা পর্যন্তই। জলের নীচে যে কত রকম প্রাণীদের বাস--তা নিয়ে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত।

একমাত্র ব্যতিক্রম--গুজরাতের পশ্চিমে কোণে, কচ্ছ বেলাভূমির ধারে একটি ছোট্ট মেরিন ন্যাশনাল পার্ক। নারারা জাতীয় সামুদ্রিক উদ্যান। সারা দেশে মাত্র এই জায়গাটিতে ভাঁটার সময় হাঁটুজলে পায়ে হেঁটে সামুদ্রিক প্রাণীদের দেখা যায়। কোনো স্নরকেল বা স্কুবা ডাইভের যন্ত্রপাতির দরকার নেই। সাঁতার জানা না থাকলেও চলে। শুধু হাঁটতে জানলেই হল। দেখা যায় নানারকম মাছ, অক্টোপাস, কচ্ছপ, নানা রঙের কর‍্যাল রীফ বা প্রবালপুঞ্জ যা অন্য সময় দশ ফুট জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে থাকে।


হাঁটতে জানলেই হলো!

পশ্চিম গুজরাটে কচ্ছের রন দিগন্তবিস্তৃত বেলাভূমির জন্য বিখ্যাত। সেইখানেই সমুদ্রের খাঁড়ির আশে পাশে, ছো্ট ছোট দ্বীপ ও বেলাভূমির ধারে ধারে ভাঁটার সময় জল অনেকদূর সরে যায়। মাছের লোভে নানারকম পাখিরাও ভিড় করে। পাখি ও সামুদ্রিক প্রাণী দেখার ও ছবি তোলার এইটাই প্রশস্ত সময়।

প্রায় পঁচিশ বর্গ কি.মি. নিয়ে এই মেরিন পার্ক। এর মধ্যে অনেকগুলি ছোট ছোট দ্বীপও আছে। আছে বেলাভূমি, প্রবালপুঞ্জ ও সুন্দরীগাছের ঘন বন। দ্বীপগুলি খুবই ছোট ও নামহীন। শুধু সব থেকে বড়টির নাম পিরোটান--সেখানে এক পীরের কবরস্থান আছে। অনেক পায়ে হেঁটে ভাঁটার সময় সেখানে পিকনিক করতে যান। জোয়ারের সময় অবশ্য নৌকার দরকার হয়।


স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছে

কোর‍্যাল রীফের ওপর হাঁটার সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা নারারা। তবে শুধু ভাঁটার সময়েই। প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টায় দুবার জোয়ার আর দুবার ভাঁটা। দুই জোয়ারের মাঝামাঝি ভাঁটার সময়েই হাঁটার সময়। তাই পার্কে যাওয়ার আগে ক্যালেন্ডার দেখে সময় ঠিক করা দরকার।

নারারা বা পিরোটানে যেতে হলে সব থেকে কাছের শহর জামনগর, নারারা থেকে ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা। জামনগরে প্রেসিডেন্ট হোটেলেই সমুদ্রের জোয়ার-ভাঁটার নাড়ীনক্ষত্র জানা যায়। হোটেলের মালিক পার্ক সংরক্ষণে প্রবল উৎসাহী। অফিসের দেয়ালে জোয়ার-ভাঁটার সময় লিস্ট সাঁটা। আমরা সেই হোটেলেই উঠেছিলাম। পার্কে যাব শুনে ভদ্রলোক মহা উৎসাহে সমোসা ও লসসী খাওয়ালেন। তারপরে একঘন্টা ধরে কমপিউটারে পার্কে তোলা ছবিগুলো দেখাতে লাগলেন।


পার্ক অফিস

আমরা যখন গেছিলাম, ভাঁটার সময় ছিল মাঝ-দুপুরে। শীতের সময় হলেও দুপুরে ছায়াবিহীন খটখটে রোদ। তার উপর জলের মধ্যে-- চোখ একেবারে ঝলসে যায়। খুব করে সানস্ক্রীন মেখে মাথায় টুপি, গায়ে ফুলহাতা জামা, পায়ে মোটা সোলের জুতো ও কাঁধে পানীয়জলের বোতল আর ক্যামেরা নিয়ে তৈরি হলাম।


গ্লাস শ্রিম্‌প

জুতো সম্বন্ধে কিছু সাবধানবাণী--খোলা হাওয়াই চটি বা হালকা জুতো পরে যাবেন না। পায়ে বালি কাঁকর ঢুকে যায় আর ভাঁটার স্রোতে পা থেকে খুলে যায়। সব থেকে ভাল লেস বা স্ট্র্যাপ লাগানো টেনিস শু-র মত ভারী জুতো। কর‍্যাল রীফগুলি বেশ শক্ত ও ধারালো।

নারারায় বীচের ধারেই ন্যাশনাল পার্কের অফিস ও টিকিট কাটার ব্যবস্থা। ওখানেই অল্পদামে সরকারি গাইডও পাওয়া যায়। গাইড নিয়ে যাওয়াটা জরুরী কারণ অনেক প্রাণী ছদ্মরূপে রীফের কোণে কানাচে লুকিয়ে থাকে। অভিজ্ঞ গাইড ছাড়া তাদের দেখা পাওয়া অসম্ভব।


সী অনিমোন

প্রতিদিন ভাঁটার সময় রীফের ওপরের অংশ রোদ্দুরে শুকিয়ে যায়। সেগুলো মরা রীফ। তার ওপর দিয়েই হাঁটা যায়। জলের নীচে জীবন্ত কর‍্যাল নরম, মসৃণ ও ভঙ্গুর। সেগুলি সাবধানে এড়িয়ে পা ফেলতে হয়। গোড়ালি-ডুবনো কাকচক্ষু পরিষ্কার জলে আরামসে দু-তিন ঘন্টা ঘুরে বেড়ানো যায়।


মৃত প্রবালের ওপর জীবন্ত প্রবাল

জলের ধারে পৌঁছনোর আগেই বালুভূমির পাশে সুন্দরী গাছের জঙ্গল। তার নীচেই দেখা যায় ছোট্ট ছোট্ট ঝকঝকে সাদা প্রজাপতির মত কাঁকড়া--পোর্সিলিন ক্র্যাব। ওদের কাছে পৌঁছবার আগেই পায়ের শব্দে ওরা বালির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।

জলের ওপরেও দ্রষ্টব্য--দুধ শাদা বক, ইগ্রেট, হেরন, পেন্টেড স্টর্ক, সীগাল, আইবিস, প্লোভার, স্যান্ড পাইপার--কতরকম পাখির ভিড়। সবাই জোয়ারের আগে যথাসাধ্য পেট ভরাতে ব্যস্ত।


পার্কে পাখির ভিড়

গোড়ালি ডুবনো জলে দেখা যায় সুতোর মত সরু ও লম্বা টিউবওয়র্ম--ঠিক বালির মত রং। গাইড দেখিয়ে না দিলে চিনতেই পারতাম না। এক হাত লম্বা প্রাণীগুলি এত তাড়াতাড়ি বালির ভেতর লুকিয়ে পড়ে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।


লম্বা টিউবওয়র্ম--ঠিক বালির মত রং

আরও আছে নানা সাইজের সী কুকুম্বার বা সমুদ্রের শসা। গোলগাল মেটে রঙের প্রাণীগুলি দেখতে ঠিক শসার মতই। আছে স্টারফিশ ও বিট্রল্‌ স্টার--যারা ছুঁলেই ভেঙে যায়।


স্টারফিশ


বিট্রল্‌ স্টার--ছুঁলেই ভেঙে যায়

উজ্জ্বল লাল ও হলুদ রঙের স্পঞ্জ সহজেই চেনা যায়। তাদের গায়ে গায়ে লাগানো কর‍্যালগুলিও কত রকমের--মুন কর‍্যাল, ব্রেন কর‍্যাল ইত্যাদি। আছে ফুটখানেক ব্যাসের সী অনিমোন--একটু ছোঁয়া লাগলেই কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে যায়--যেন লজ্জাবতী লতা।


সী কুকুম্বার বা সমুদ্রের শসা

আরও আছে। পোর্সিলিন কাঁকড়া ছাড়াও আছে বড়সড় নীল কাঁকড়া (ব্লু ক্র্যাব), এবং এক অদ্ভুত জীব--লোমশ কাঁকড়া--wolf crab--দেখতে অনেকটা রোমশ টারানটুলা মাকড়সার মতই। অনেক রকম ছোট মাছ ও চিংড়ি দেখেছি।

 
লোমশ কাঁকড়া ও অক্টোপাস

একটার নাম glass shrimp; কাঁচের মত স্বচ্ছ শরীর, ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব দেখা যায়। সুন্দর ডিজাইন আঁকা nudebrack শরীরে ঢেউ খেলিয়ে চলে। বড় জাতের মত বিষাক্ত নয়।

বড় জীবদের মধ্যে আছে অক্টোপাস। এরা সত্যিই বহুরূপী। মুহূর্তের মধ্যে রং বদলায়। কালো কালির পিচিকিরি ছুটিয়ে পলকের মধ্যে অত বড় শরীরটা কী করে যে ছোট্ট খাঁজের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়, দেখেও বিশ্বাস করা যায় না। আমার মনে হয় সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে এরাই সবথেকে বুদ্ধিমান।


অক্টোপাস

আরও একটু গভীরে--হাঁটু ছোঁয়ানো জলে আরও বড় প্রাণীদের দেখা যায়--রে মাছ, কচ্ছপ, পাফার মাছ ইত্যাদি। কপাল খুব ভালো থাকলে ডলফিনেরও দেখা পাওয়া যায়--আমার কপাল অত ভাল ছিল না কিন্তু একটা পাফার মাছ হাতে ধরার সুযোগ পেয়েছিলাম। এরাই সেই বিষাক্ত জাপানী ফুগু মাছ--যা খুব সাবধানে রান্না করতে হয়। নইলে ভক্ষকের মৃত্যু অনিবার্য। হাতে করে ধরতে কোনো বিষের ভয় নেই। শুধু ধারালো দাঁতগুলোর দিকে নজর রাখতে হয়। একবার কামড়ে ধরলে ছাড়ানো মুশকিল।


এরাই সেই বিষাক্ত জাপানী ফুগু মাছ

এইরকম সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণের চেষ্টা দেখে মনে আশা হয়, কিন্তু পরক্ষণেই দেখি পার্কের পাশেই গুজরাত সরকার “পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি” খুলছেন। ইতিমধ্যেই জমি খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে গেছে। এর প্রভাবে মেরিন পার্কের কী দশা হবে ভেবে ভয় হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো সদুত্তর পেলাম না।


কতরকমের রঙিন স্পঞ্জ





(পরবাস-৭০, ৩১ মার্চ ২০১৮)