ISSN 1563-8685




বিজয়া

।। এক ।।

রাণীর কথা

মি প্রীতিলতা বলছি। রাণী বলেই ডাকে সবাই। পরিচয়? জগৎবন্ধু ওয়াদ্দেদারের বড় মেয়ে, নন্দনকানন অপর্ণাচরণ হাইস্কুলের হেড-দিদিমণি। অন্ততঃ তিন মাস আগেও আমার সেটুকু পরিচয়ই সকলকে দিয়ে রেখেছিলাম। এখন আমি ফেরারী। গত পাঁচই জুলাই সংবাদপত্রে ঘটা করে আমায় চট্টগ্রামের পলাতকা উপাধি দেওয়া হয়েছে।

অথচ আমি কিন্তু পালাতে চাইনি। আমি পালাচ্ছি না। নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি আজ ঠিকই। কোথা থেকে বলি? তেরোই জুনের রাত? না কি আরও আগে, কলেজবেলার সেই অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতার কথা?


অমিতা দাশ। ছদ্মনাম ঠিক করেও দেওয়া হয়েছিল উপরমহল থেকে। বেথুন কলেজে স্বনামে ভর্তি হলেও, আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের রক্ষীদের কাছে আমি ছিলাম কনডেমড্ সেলের রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের একমাত্র মাসতুতো বোন অমিতা। চল্লিশবারের বেশী এই পরিচয়ে সাক্ষাৎ করেছি তাঁর সাথে।

পাশের সেলে ছিলেন নসুদা, দীনেশ গুপ্ত। প্রথম কয়েকটি সাক্ষাতের পর নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হলেই রহস্য করে হেসে বলতেন, “কেমন আছ অমিতা? মাসিমার যত্ন নিচ্ছ তো?”

চট্টলজননীর সুযোগ্য সন্তান রামকৃষ্ণদাকে তারিণী মুখার্জী হত্যার মামলায় খুইয়েছিল সংগঠন। তাই কলকাতায় স্নাতকস্তরের পড়াশোনার জন্য আগত আমার উপর আদেশ হল, দেখা করো।

কী আশ্চর্য মানুষটিই না ছিলেন! দুর্দান্ত বিপ্লবী, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী, এদিকে রসিকতায় জুড়ি মেলা ভার। আমার ভিতরে যা কিছু ছিল, তাতে প্রথম দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি একাই। আমার প্রথম প্রকৃত অনু্প্রেরণা, পথের দিশা। আশীর্বাদ করেছিলেন আপন দাদার মত; “বাড়ি ফিরে পূর্ণেন্দু, অপূর্বর সঙ্গে যোগাযোগ করো। কাজের সন্ধান ওরাই দেবে। সফল হও, সার্থক হও।”

কী অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে দিন কেটে যেত। কেটে যাচ্ছিল। আঘাত এল আচম্বিতেই। ছদ্মপরিচয়ে প্রবেশ করতে বাধা পেলাম জেলের সামনে।

—দেখা হবে না।

—কেন?

—উনি আর নেই। আজ ভোর চারটেয় ফাঁসি হয়ে গেছে।

না, মরদেহের কোন সুব্যবস্থাও করেনি সদাশয় সরকার। তারা বুঝে গেছে, এই ছেলেদের মৃতদেহ থেকেও জন্ম নিতে পারে নতুন আগুনের ফুলকি। সেলের নকল চাবি তৈরী করে দাদাকে মুক্ত করার স্বপ্ন আমার সত্যি হল না।

মরিয়া হয়ে উঠলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শংসাপত্র অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হয়েছিল, কালক্ষেপ না করে ফিরে এলাম চট্টগ্রামে। সঙ্গে কলকাতার দপ্তর থেকে কয়েকটা তাজা বোমা।

রামকৃষ্ণদার কথামত সাক্ষাৎ করলাম পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সঙ্গে। তাঁর যোগাযোগেই অবশেষে মাস্টারদা সম্মত হলেন আমার সক্রিয় দলভুক্তিকরণে। নির্মল সেনেরও কিছু ভূমিকা ছিল বুঝি এ সিদ্ধান্তে। ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে তখন তাঁরা আত্মগোপন করে আছেন। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ভোলা, রামকৃষ্ণদার সহচর সেই হাস্যরসিক অপূর্ব সেন। সারা পথ গুনগুন করে গান গেয়ে চললে, “হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মত নাচে রে!” পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত এতটুকু বুঝতে দিলে না, কী ধুম জ্বরকে সঙ্গে নিয়ে সে এতটা পথ হেঁটে এসেছে।

সাবিত্রীদেবীর বাড়িতে থাকতাম তাঁর পুত্রবধূ ও পৌত্রীর সঙ্গে। বিপ্লবীরা তাঁকে মা বলতেন, আর বাড়িটিকে বলতেন “স্যানাটোরিয়াম্” — নিরাপদ আশ্রয়! দীর্ঘকাল পর নির্মলদার সাক্ষাৎ পেয়ে এক জন্মের কথা বলে নিয়েছিলাম যেন সেদিন। আজ বড় স্পষ্ট মনে পড়ে সে-সব।

—নির্মলদা, আমার বড় মরতে ইচ্ছে করে।

—দূর পাগল! তুই কীসের জন্য মরবি?

উঠে গিয়ে ভোলার জন্য সাগু রান্না করে লেবু চিনি মিশিয়ে নিয়ে এলাম। তাই খেতে খেতেও বাড়ির কথা তুলে ঠাট্টাতামাশা শুরু করল সে। আনন্দ-নির্ঝর অপূর্ব! ভালো না বেসে পারা যায় না।

সাধারণতঃ নির্মলদার পাতে খাওয়া সারতাম। সেদিন নির্মলদা কিছু খাবে না বলায় ভারি বিপদে পড়লাম। মাস্টারদার সঙ্গে বসে খেতে হবে! ছুটে গিয়ে তাকে খাওয়ার জন্য সাধ্যিসাধনা শুরু করি।

নির্মলদা তো হেসেই অস্থির। “ডাকাত মেয়ে, এবার কেমন জব্দ?”


সেদিন তেরোই জুন। দোতলার ঘরে রাত্রে মাস্টারদার পায়ের কাছে বসে তাঁর কথা শুনছি, ভোলা শুয়ে পড়েছে, নির্মলদা অভ্যাসমত দরজায় ঠেস দিয়ে বন্দুক পরিষ্কার করতে বসেছেন। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে মাস্টারদাকে হাত দেখিয়ে চুপ করালেন। ভোলা ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। মাস্টারদা বুঝতে পেরে ছোট মেয়েটিকে ডেকে বলেন, দরজা ফাঁক করে দেখতে।

—পুলিশ! মেয়েটি ফিসফিসিয়ে বলে উঠল।

ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন— নীচে যাও।

প্রতিবাদ করতে যাই, মাস্টারদা হাতে রিভলভার তুলে নিয়ে দরজার পিছনে এসে দাঁড়ান। নির্মলদাও মুখ ফিরিয়ে নেন, ভোলা এগিয়ে এসে তাঁর হাত থেকে একটা পিস্তল তুলে নেয়।

যাও! কঠিন গলায় ধমকে ওঠেন আবার।

অমান্য করতে সাহস হয় না, মই বেয়ে নেমে আসি। প্রথম গুলির শব্দটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির মেয়েরা আমাকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়। গুলির আওয়াজ। সামনে একটা দেহ পতনের শব্দ। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নির্মলদার বুলেটে ভবলীলা সাঙ্গ করল। রাইফেল আর লুইস গানের বিরুদ্ধে তিনটি পিস্তল ও রিভলভারের অসমযুদ্ধ চলে কিছুক্ষণ।

নির্মলদার গলা পাওয়া যায় —এদিক দিয়ে আসুন!

ভোলা অন্যদিক থেকে বলে, এদিকটাও ফাঁকা আছে।

নির্মলদা বলেন, আপনি আমার পিছনে আসবেন। আমায় আগে যেতে দিন। যদি সামনে কেউ—

কথাটা শেষ হয় না, আরো কয়েকটি গুলির শব্দ না ফুরোতেই নির্মলদার আর্তনাদ শোনা যায়। ছোট মেয়েটিকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি মই বেয়ে উঠতে যাই, পিছন থেকে তার মা এসে আমাকে আঁকড়ে ধরে।

নির্মলদার ব্যথা-কাতর গলা ভেসে আসে, “রাণী? রাণী!”

মাস্টারদা ভোলার পিছু পিছু নেমে আসেন। আমাকে আর ধরে রাখা যায় না। মাস্টারদার পায়ে পড়ে বলি, আমায় সঙ্গে নিয়ে চলুন! ফেলে যাবেন না!

মাস্টারদা মুহূর্তকাল চিন্তা করেন। পাশে দাঁড়িয়ে নির্বিকার সৈনিক অপূর্ব, ট্রিগারে আঙুল রেখে। নির্মলদার ডাক কখন স্তব্ধ হয়ে গেছে।

পিছনের বনের রাস্তা ধরে ছুটতে থাকি আমরা, যথাসাধ্য নিঃসাড়ে। হঠাৎ এক জায়গায় শুকনো পাতার উপর পা পড়ে যায় অপূর্বর। একটি অব্যর্থ শব্দভেদী বুলেট তৎক্ষণাৎ তার বক্ষভেদ করে।

ভোলা! চাপা চিৎকার বেরিয়ে আসে আমার গলা থেকে। মাস্টারদা এক হ্যাঁচকায় আমাকে মাটিতে শুইয়ে না দিলে পর পর ছুটে আসা মৃত্যুবাণের একটিও লক্ষ্যভ্রষ্ট হত না। অপূর্বর সঙ্গে রামকৃষ্ণদার কথা অনুযায়ী জন্মের মত পরিচয় হয়ে গেল।

বর্ষার রাতে বনজঙ্গল আর নালাডোবার মধ্য দিয়ে কী করে বুকে হেঁটে চার মাইল পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠপুরায় অশ্বিনী কবিরাজের বাড়ি অবধি পৌঁছোলাম, সে কথা স্পষ্ট মনে পড়ে না। কেবল মাস্টারদাকে নির্বোধের মত অনুসরণ করে চলেছিলাম, ভোলা আর নির্মলদার পিছুডাক উপেক্ষা করে।

চারু দত্ত ও মহেন্দ্র-সহ দলের কিছু ছেলে সেখানে উপস্থিত ছিল। আমাদের অবস্থা দেখে শিউরে উঠল। মাস্টারদাকে সেদিন প্রথম ও শেষবার কাঁদতে দেখেছিলাম। রুদ্ধস্বরে তিনি বললেন, “আমার ডান হাতখানা ভেঙে গেল। নির্মলকে আজ যে বড় দরকার...”

সারারাত ছটফট করে মরলাম। ভোলার হাসিমুখ, কৌতুক, বারে বারে চোখে ভাসছিল। আর চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পাচ্ছিলাম নির্মলদার সেই কাতর স্বর, “রাণী, রাণী...” শুধুঅভিজ্ঞ নেতা নয়, বন্ধুর মত ব্যবহারে দলের ছেলেদের প্রাণ, স্বভাবলাজুক, নিঃস্বার্থ সংগ্রামী নির্মলদার সেই শেষ ডাকে আমি সাড়া দিতে পারলাম না।

পাগলের মতো হয়ে উঠেছিলাম। মাস্টারদার কাছে ভিক্ষা করতে থাকি, কাজ দিন, কাজ দিন! কীসের দ্বিধা আপনার!

মাস্টারদা মাথায় হাত রেখে সস্নেহে বলেন, দ্বিধা নয়, চিন্তা। তোর জন্য। পরিকল্পনা!


প্রস্তুতি শুরু হল। ফুটুদা, তারকেশ্বর দস্তিদার সমুদ্রসৈকতে নিয়ে গিয়ে গোপনে ট্রেনিং দিতেন সবরকম বন্দুক ব্যবহার এবং বোমা ছোঁড়ার। লাঠিখেলা দীপালী সংঘেই শিখেছিলাম। বাকি আয়ত্ত করতে সমস্যা হল না।

পাহাড়তলীর ইউরোপীয়ান ক্লাব। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দিনই তাতে আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল। ঘটনাচক্রে দিনটা ছিল গুড ফ্রাইডে। ক্লাব বন্ধ। জনপদে ইংরেজদের ভোগবিলাসের এই প্রাণকেন্দ্র আজ আবার জেগে উঠেছে। মধ্যরাতের মদ্যপ উল্লাসে তারা ডুবিয়ে দিতে চায় দুই বছর আগেকার চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের স্মৃতি।

মাস্টারদা বললেন, এই কাজে নারীবাহিনীর সহায়তা চাই। কল্পনা, রাণী, তোমাদের এ দায়িত্ব দিলাম।

আমার আবাল্যসহচরী কল্পনা দত্ত পুরুষের ছদ্মবেশে গিয়েছিল জায়গাটা দেখে আসতে। গাড়িচালকের সন্দেহ হয় কণ্ঠস্বরে, পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে। মাস্টারদা সিদ্ধান্ত নিলেন, আর বিলম্ব নয়। অ্যাকশন যা করবার, এখনই। অভিযানের দায়িত্ব কেবল আমার স্কন্ধে ন্যস্ত করলেন। তারিখ ঠিক করা হল, চব্বিশে সেপ্টেম্বর। আজ।

আমার মনের শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেছে গতকাল মাস্টারদার হঠাৎ আবির্ভাবে। রাতে বসে মা-কে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি লিখলাম। সব কথা উজাড় করে দিয়ে।

মাস্টারদা নিজের হাতে আমাকে সাজিয়ে দিলেন; যুদ্ধসাজের ছদ্মবেশে।

যুদ্ধ জিতে ফিরে আয়— বললেন তিনি।

আমি জবাব দিলাম, সফল যেন হই, আশীর্বাদ করুন। তবে আমি যাই জন্মের মতন।

এই বলে প্রণাম করতে যাই। মাস্টারদা বাধা দিয়ে বলেন, না। কার্যসিদ্ধি করে ফিরে আসা চাই। এটা আমার আদেশ, মনে রেখো।

কী অপরিসীম ঔদ্ধত্য ভর করল আমায়। বললাম, নেতৃত্বই যখন দিলেন, তখন তা ব্যবহারের স্বাধীনতা দেবেন না?

মাস্টারদা অকস্মাৎ রূঢ়কণ্ঠে বললেন, ছেলেমানুষি কোরো না রাণী। যা বলছি, শোনো। সেন্টিমেন্টের প্রশ্ন না এটা।

এতবড় দায়িত্ব নিয়ে সেন্টিমেন্টাল হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, এটাই বা ভাবলেন কেমন করে!

তোমাকে তো এই একটা কাজের দায়িত্বই দেওয়া হয়নি শুধু! পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আর কাউকে খোয়াবার বিলাসিতা এখন আমাদের সাজে না।

নিজের বুকপকেটে হাত দিয়ে বললাম, ধরা তো আমি দেব না!

মাস্টারদা মৌন হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে বললেন, “আর কোনোদিন তোর দাদা তোকে সাজিয়ে দেবে না।”

গুরুতুল্য, পিতৃতুল্য মানুষটি হঠাৎ যেন শিশুর মত একইসঙ্গে অবুঝ আর অসহায় হয়ে গেছেন। অনুমতি না পেয়ে প্রণাম নয়, হাসিমুখে সামরিক অভিবাদন জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।

গৃহস্বামী জয়দ্রথবাবুর হাতে চিঠিখানা দিয়ে বললাম, মায়ের কাছে পৌঁছে দেবেন।

শান্তি, কালী, প্রফুল্ল, বীরেশ্বর বাইরে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে। অভিযানের আগ্রহের চাঞ্চল্যলক্ষণ স্পষ্ট।

ফল্-ইন্!

অভীষ্টের দিকে এগিয়ে চললাম। অদ্ভুত একটা আনন্দে বিভোর হয়ে। এই কয় মাস ক্রমাগত যে শব্দ আমাকে পাগল করে তুলেছে, তা আবার এখন শুনতে পাচ্ছি। এখন আরও স্পষ্ট। মৃত্যুপথযাত্রী নির্মলদা ডাকছেন, “রাণী, রাণী!”

শুধু এখন আমার মনে আর কোন খেদ নেই। ওই আহ্বানে সাড়া দিতেই যে চলেছি আজ!

আমার কথাটি ফুরোতে চলল। তবে নিয়তির অতর্কিত আঘাতে নয়। নিজের প্রাপ্তির অংশ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিয়ে আমার জীবনে তৃপ্তির পূর্ণচ্ছেদ আজ স্বেচ্ছায় টানব স্বয়ং।  


।। দুই ।।

মহেন্দ্র চৌধুরীর কথা


টেগরা কালও স্বপ্নে এসেছিল।

“সোনাভাই! আমি চললাম সোনাভাই! তোমরা যেন থেমো না!”

সোনাভাই, জেনারেল লোকনাথ বল প্রত্যুত্তরে ভলি-ফায়ারের আদেশ দিয়েছিলেন চিৎকার করে। অনুজ টেগরা সে আদেশ পালন করার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।

তেরো বছরের কিশোর ভাইটির মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের পুরো বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লোকনাথদা। বিনোদদা তখন অকেজো ডান হাতের জন্য পায়ে করে বন্দুক ভেঙে বাঁ হাতে কার্তুজ ভরে গুলি চালাচ্ছেন। নির্মলদা আগুন-গরম মাস্কেটের নল চেপে ধরেছেন দুই হাতে। সোনাদার আরেক ভাইয়ের রক্তে সেই রাইফেলের কলকব্জা লুব্রিকেট করছেন বনবিহারী দত্ত। সোনাদা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন “ফায়ার আনটিল দ্য মেশিনগান ইজ কমপ্লীটলি সাইলেন্সড্!”

জালালাবাদ, তেইশে এপ্রিল উনিশশো ত্রিশ।

নির্মলদা আহত মাস্টারদার ভার নিয়ে হাঁটছিলেন। একটু আগেই তাঁদের বড় প্রিয় সহকর্মী অম্বিকাদা, মতিদা ও অর্ধেন্দুদাকে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে এসেছেন। হ্যাঁ, তাঁরা তখনও জীবিত। কেবল উঠে আসার ক্ষমতা ছিল না।

যুদ্বজয়ীর ক্লান্ত মিছিলে সেদিন আমিও ছিলাম। অজস্র মৃত-অর্ধমৃত সহযোদ্ধাকে পিছনে ফেলে আসা দুরূহ পদযাত্রায়, অবিচল অধিনায়ক লোকনাথ বলের পিছু পিছু, তাঁরই দেওয়া পথনির্দেশে। অসংখ্য প্রিয় বন্ধু এবং দুই ভাইয়ের মৃত্যু সোনাদার বাইরের চেহারায় কোন ছাপ ফেলেনি। এক দুরন্ত বিস্ময়ে সেদিন তাঁর থেকে শিখে নিয়েছিলাম নতুন মহামন্ত্র।

সৈনিকের কর্তব্য!

কে জানত তার চরম পরীক্ষা আমার সামনে দুই বছর পর এভাবে উপস্থিত হবে?


প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। আমাদের আদরের রাণীদিদি। ধলঘাটে নির্মলদা আর ভোলা পুলিশের গুলিতে চলে যাওয়ার পর থেকে মাস্টারদার সঙ্গে সেও ফেরার হয়ে গেল।

অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দিন থেকে দুবার তুচ্ছ কারণে পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ প্রচেষ্টা বাধা পেয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে কল্পনা গিয়েছিল প্রস্তুতির জন্য; পুরুষের ছদ্মবেশ ধরা পড়ে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছে। যদিও সঙ্গত কারণের অভাবে পুলিশ তাকে এখনো গুরুতর অপরাধে ফাঁসাতে পারেনি, তবু দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অযথা কালহরণ না করে, রাণীদিদির নেতৃত্বে চব্বিশে সেপ্টেম্বর ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।


—পুজো করব। সব এইখানে সার দিয়ে রাখ।

রাণীদির পুজোআচ্চায় ভারি নিষ্ঠা। নল ছোট করে কাটা রাইফেলগুলো সার বেঁধে রেখে, রক্তজবার মালা দিয়ে অস্ত্রপূজায় বসল আগের রাত্রে। সিঁদুরের টিপ দিল আমাদের কপালে।

“এখন একবার মাস্টারদার পায়ের ধুলো পেলেই ষোলোকলা পূর্ণ হত” কিছুটা অভিমানভ’রে কথাগুলো যেন নিজেকেই শুনিয়ে খাতাপত্র নিয়ে বসে গেল রাণীদি। ইস্কুলের খাতা নয়, চিঠি আর ডায়েরী নিত্য লেখার অভ্যেস ছিল তার।

আমরা রাতের খাওয়া একে একে সেরে নিচ্ছি, আচমকা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ভিতরের দরজাগুলোয় চটপট শিকল তুলে দিয়ে এঁটোহাতেই দরজা খোলে বীরু। পিছনে অন্ধকারে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। সশস্ত্র।

—আদাব, বাবুজি।

কান এঁটো করা হাসি হেসে সামনে এসে দাঁড়ায় কালোপানা বেঁটেখাটো, রোগা, দাড়িওলা এক মুসলমান মাঝি।

—কাকে চাই? একটু হলেও যেন আশ্বস্ত হয়ে প্রশ্ন করে সতর্ক বীরেশ্বর।

মাঝির পিছন থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে দলের এক খুদে সদস্য ঈশান।

— বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি, ও মহীন্-দা?

মাস্টারদা! মাস্টারদা এসেছেন! মুহূর্তে আনন্দতরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে আমাদের কাট্টলীর আস্তানার প্রতিটা কোণায়। রাণীদি ছুটে আসে। পায়ের ধুলো নিয়ে বলে, উঃ মাস্টারদা আপনি কি অন্তর্যামী?

মাস্টারদা হাসতে হাসতে বললেন, অনন্ত এই এক জ্বালা ধরিয়েছে আমায়। সব মিশনের আগে একটিবার নিজে চোখে না দেখা হলে শান্তিতে থাকতে দিত না।


নিশিকান্তকাকার হাতে বানানো শেষ কয়েকটি বাছাই স্ট্রাইকার দেওয়া বোমা সঙ্গে এনেছিল তাঁর ভাইপো কালীকিঙ্কর। জালালাবাদে দুর্ধর্ষ লড়াইয়ে অভিজ্ঞ সে-ও। এই অভিযানের দ্বিতীয় দলের পথনির্দেশের গুরুদায়িত্ব তারই উপরে, ক্লাবের এক বাবুর্চিকে হাত করে গোপন প্রবেশাধিকার সে কিছুটা পাকা করে ফেলেছে। তারকেশ্বর দস্তিদার আমাদের প্রত্যেককে আলাদা করে ডেকে বুঝিয়ে দিলেন প্রতিটি পদক্ষেপ।

পরদিন সন্ধ্যায় মুসলমান গাড়োয়ানের ছদ্মবেশে সাজলাম আমি আর সুশীল। মাস্টারদা-সহ সব গুরুজনকে প্রণাম করে বেরোলাম। রাণীদির ঘরে তখনও দরজা বন্ধ। মহানন্দে যখন ক্লাবের পথে এগিয়ে চলেছি, কল্পনাও করিনি আজকের অভিযানের সবচেয়ে বড় অভিঘাত সৃষ্টি হবে আক্রান্তের উপরে নয়, আক্রমণকারীর উপরে।

ক্লাবে তখন উত্তুঙ্গ উন্মাদনা শুরু হয়েছে। রাত গড়ানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাতলামির মাত্রা চড়ে গেছে, শুরু হয়েছে বিজিতের রাজ্যে শোষকের বিলাসিতার উদ্‌যাপন— নগ্ন-উল্লাস নৃত্য! জালালাবাদের আতঙ্ক কি এর মধ্যেই মুছে গেল?

অশিক্ষিত গরীব দুটি মুসলিম ছেলে কখন মেমসাহেবদের নাচ দেখতে “Dogs and natives are not allowed” শর্তাবলী-লেখা ক্লাবে ঢুকে পড়েছে, সেটা নিয়ে হুলূস্থূল করে মেজাজ নষ্ট করা তুরীয় অবস্থায় থাকা সাহেবদের কারোরই অভিপ্রেত ছিল না। আমরা অভিনয় বজায় রাখি, নির্দেশের অপেক্ষায়।

কোণের বিলিয়ার্ড-রুমের দরজা দিয়ে হঠাৎ ভিতরে আসরের মাঝখানে ঢুকে আসে এক পাগড়িধারী শিখ। আমরা শক্ত করে পোশাকের নীচে অস্ত্র খামচে ধরি। পাঞ্জাবী পুরুষটির পাশে এসে দাঁড়ায় ফতুয়া আর ধুতি পরা কয়েকটি সাধারণ ছেলে, অসাধারণ বলতে শুধু তাদের হাতে উদ্যত মাস্কেট।

কেউ কিছু বোঝার আগেই শিখের নারীকণ্ঠে চিৎকার শোনা যায় —“চার্জ!”

কালীকিঙ্কর নৃত্যরত সাহেব-মেমদের মাথার উপর আলো তাক করে বোমা ছুঁড়ে মারে।

পরের কয়েক মিনিট শুধু মাস্কেটের গর্জন আর বিস্ফোরণ। আশ্চর্য নিরাপদ অবস্থায় একের পর এক জখম করে চলে শান্তিদা আর পান্না। পিছন থেকে আমার গায়ে একটা কাচের গ্লাস এসে ভাঙে। পিছন ঘুরে পর-পর দুটো বন্দুকের শব্দ পাই। দেখি, দ্বিতীয় গ্লাসটি নিক্ষেপ করার আগেই অধিনায়িকার এক গুলিতে ভূমিশয্যা নিয়েছেন প্রতিআক্রমণকারী সাহেব বাহাদুর। আর দ্বিতীয় গুলিটা...

রাণীদির বাঁ হাত থেকে রক্তপাত হচ্ছে। প্রফুল্ল ছুটে আসে। নিজের কার্তুজ ভরা বন্দুক তার হাতে গুঁজে দেয়। আরো মিনিটখানেক বন্দুকের গর্জনের পর সশস্ত্র সাহেবদের প্রত্যুত্তর নিশ্চুপ হয়ে যায়।

রাণীদি উঠে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে নির্দেশ দেয়, “ফল্ ব্যাক্‌! ফল্ ব্যাক্ নাউ!”

হাত ছুঁয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়াই শুধু নয়, তার বুকের কাছ থেকে পোশাক রক্তে লাল হয়ে উঠেছে। সম্ভবতঃ স্প্লিন্টার।

পান্না, প্রফুল্ল, বীরেশ্বর, শান্তিদা দুই দিকে ছিটকে বেরিয়ে যায়। টলতে টলতে সামনের দরজা দিয়ে ছুটে বেরোয় প্রীতিলতাদি, পিছু পিছু আমি আর কালী।

রিট্রিট! কাকে যেন উদ্দেশ্য করে আদেশ দেয় সে। পুলিশের হুইসল শোনা যায়। দূরের মাঠে অন্ধকার চিরে জোরালো টর্চের আলো দেখা যায়।

—এ কী? তোমার খুব চোট লেগেছে প্রীতিদি?

গাছতলায় বসে পড়া দলনেত্রীর দিকে ছুটে যায় কালীকিঙ্কর।

রিট্রিট! আবারও গর্জে ওঠে রাণীদি।

—না, আমরা তোমায় বয়ে নিয়ে যেতে পারব, চলো।

কালীর কথার সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃৎস্পন্দন থমকে যায়। রাণীদির জখম বাঁ হাতের মুঠোয় ধরে রাখা জিনিসটা চিনতে পারায়।

মিশন লীডারের মুখ কোমল হয়ে আসে। জড়ানো গলায় বলে— আমার আর ফেরা হবে না, ভাই!

কালী বিহ্বল হয়ে রাণীদির হাত চেপে ধরে।

— কেন করলে? কেন করলে?

হুইসলের শব্দ ও টর্চের আলো প্রায় কাছে এসে পড়েছে।

— মহীন্ — বন্দে মাতরম্!

সৈনিকের শিক্ষা! অন্তিম নির্দেশ মাথায় করে কালীকে হিঁচড়ে টেনে সরিয়ে নিয়ে যাই বনের দিকে। সম্বিত ফিরে পায় অভিজ্ঞ যোদ্ধা কালীকিঙ্করও। অন্ধকার বন ভেদ করে ছুটতে থাকি জয়দ্রথ-গৃহ অভিমুখে। পটাশিয়াম সায়ানাইডের ছলে মৃত্যু-অমৃত পানরতা রাণীদিদিকে ফেলে রেখেই।


মাস্টারদা বিছানায় বসে আছেন। ধ্যানগম্ভীর ভঙ্গি। ছুটে এসে মেঝের উপর আছড়ে পড়ে কালী ডুকরে উঠল, “মাস্টারদা, দিদি—”

মাস্টারদা নিথর বসেই থাকেন। একইভাবে। একটুও আশ্চর্য না হয়ে। উত্তর দেন না।

ধীরে ধীরে চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা জল কেবল গড়িয়ে পড়ে তাঁর। স্পষ্ট দেখতে পাই, ঘরের ওই মৃদু আলোতেও।

দ্বিতীয়বার। 

।। তিন।।

কল্পনা দত্তের কথা


ককোপে পাঁঠাবলি দিতে পারিস? জিজ্ঞেস করেছিল অপর্ণা।

ঠোঁট উল্টে আমি বলেছিলাম, খুব পারি, এক্‌খুনি পারি।

অকারণে প্রাণীহত্যা করতে পারব না, সাফ জানিয়ে দেয় প্রীতি।

ইস্কুলের বারান্দায় বসে থাকা আমরা ক’জন সমস্বরে হেসে উঠি। তা হলে তুই অহিংসা করবি? হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে আরেক সহপাঠী।

প্রীতি গম্ভীরভাবে বলে, মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার! মায়ের পুজোয় বলি দেব তো ছাগল কেন, লালমুখো সাহেবই উচ্ছুগ্যু করি!

প্রীতিলতা আমার প্রিয়সখী, সেই টিফিনের খাওয়া ফেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে যাওয়ার দিন থেকেই। বয়সে একটু বড় বলে সবসময় আমাকে সামলে রাখতে চাইত, আর বিরক্তির সীমা থাকত না আমার। বিপদের মুখে সে ছিল অবিচল, আর যত কঠিন পরিস্থিতিতেই পড়ুক, নিজের জন্য কাউকে এতটুকু ভুগতে দেওয়ার মেয়েই ছিল না সে।

প্রীতির বাবা ছিলেন মিউনিসিপ্যাল অফিসের সামান্য কেরানি। স্বল্প বেতন ও সামর্থ্যে ছয়টি সন্তানকে মানুষ করার গুরুদায়িত্ব তাঁর কাঁধ থেকে বড় মেয়েই নিজে তুলে নিয়েছিল। ঈশ্বরনিষ্ঠা আর ভালবাসায় পরিপূর্ণ তাদের ছোট্ট ঘরটির কথা শুনে বিলিতি শিক্ষায় মোড়া বাড়ির মেয়ে আমার সংকোচ ও মুগ্ধতা একইসঙ্গে সীমা ছাড়িয়ে যেত।

ম্যাট্রিকের পর প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদের বৃত্তি অল্পের জন্য হারিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় প্রীতিলতা। ছেলেবেলায় স্কুলের গার্ল গাইড হওয়ার সময় থেকেই শরীরচর্চায় তার উৎসাহ, ঢাকায় গিয়ে লীলাদির দীপালী সংঘের কাজে পুরোমাত্রায় আত্মনিয়োগ করে। লাঠিখেলা, তলোয়ারচালনায় নিজেও পারদর্শী হয়ে ওঠে, অপরকেও শেখায়। লম্বা ছুটির সময় আমরা দেখা করতাম চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের সঙ্গে। এরই মধ্যে আই.এ. পরীক্ষায় প্রথম হয়ে সে দর্শনশাস্ত্র নিয়ে পড়তে চলে এল কলকাতায়। হস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্টকে নিজের মিষ্টি স্বভাবে অল্পদিনের মধ্যেই অভিভূত করেছিল, ছদ্মনামে, ছদ্মবেশে তার দলীয় কার্যকলাপের কথা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর ফেরার এবং ভুলবশতঃ তারিণী মুখার্জী হত্যার পর ধৃত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা নিজের মুখেই বলত আমাকে, প্রচণ্ড উৎসাহে।

দায়িত্বজ্ঞান আর জেদ দুটোতেই তার তুলনা আমাদের দলে দ্বিতীয়টি ছিল না। সংসার চালাত নিজেই, অসাধারণ পড়াশোনার জোরে প্রধানশিক্ষিকার চাকরি পাওয়ার পর। দলে একদিন পাঁচশত টাকার জরুরি দরকার, মাস্টারদা সমস্ত জড়ো করে গুনে-গেঁথে বললেন— চারশো বাহান্ন।

আলোচনা চলতে থাকে, কোন ফাঁকে প্রীতি উঠে গিয়ে সারা মাসের রসদ পঞ্চাশটি টাকা নিয়ে এসেছে কেউ লক্ষ করেননি। মাস্টারদা-সহ সকলেই সে টাকা নিতে অস্বীকৃত হলেন।

প্রীতিও ছাড়বার পাত্রী না। বললে- বাবা সংসার চালানোর টাকা আমার হাতেই দেন। নিজে খরচ করলেও কিছু ক্ষতি ছিল না, ও আমি তাঁকে বুঝিয়ে বলব।

নেতারা ফের আপত্তি করেন। প্রীতি এবার সত্যিই কেঁদে ফেলে। “আমরা গরীব বলে দেশসেবার অধিকারও দেবেন না? এই রইল সব, আমি চললাম।”

কোনো কাজে, কোনো পরিস্থিতিতে কখনো তাকে পিছপা হতে দেখিনি। কোনোদিন কারোর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি, দলের সব ছোটোখাটো সমস্যার সমাধান করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, দলনেতাদের আদরের বোন সে ছিল এক আলোর মত উজ্জ্বল উপস্থিতি।

ধলঘাটে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন-হত্যার সময় উপস্থিত ছিল প্রীতি। কেবল ক্যামেরন-হত্যা নয়, দলের অনন্য সম্পদ অপূর্ব সেন এবং মাস্টারদার প্রধান সহায় নির্মলদাকে খুইয়ে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মুখ থেকে সেদিন সে ফিরে এসেছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সর্বাধিনায়কের সঙ্গে। এর পরেই অ্যাকশনের জন্য একেবারে যেন পাগলপারা হয়ে উঠল সে।

দিবারাত্র মাস্টারদার কাছে অনুনয় করত, “কাজ দিন, এবার আমাকে কাজ দিন!”

প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্য উদগ্রীব আমিও সেই আবেদনে যোগ দিতাম। এরই মধ্যে পুলিশ তাকে আমাদের বাড়িতে খুঁজে গেছে। কেমন করে চোখে ধুলো দিয়ে সেখান থেকে সে পালিয়েছিল, তা আমি আজও জানতে পারিনি। ফুটুদা আমাদের পিস্তল চালানোর ট্রেনিং দেওয়া শুরু করলেন। অবশেষে পাহাড়তলির ক্লাব আক্রমণের অনুমতি মিলল। পুরুষের বেশে দেখে আসতে গেলাম পরিস্থিতি। দুর্ভাগ্য আমার! গাড়িচালকের সন্দেহ হওয়ায় ধরা পড়ে গেলাম।


জেলগেট দিয়ে ঢুকে ফিমেল ওয়ার্ডের দিকে এগোচ্ছি, পথরোধ করে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধা। সর্বাঙ্গে টিউমর, অসুস্থ শরীর। কিছুটা চমকে উঠে পিছিয়ে গেলাম।

—স্বদেশী? তুমি স্বদেশী?

কোনোক্রমে “হ্যাঁ” বলে জমাদারনির পিছু পিছু এগিয়ে চললাম। বৃদ্ধা সঙ্গ ছাড়েন না। পাশে পাশে আসেন আর বলেন, “তুমি যেন মুখ খুলো না। অনেক ভয় দেখাবে, অনেক লোভ দেখাবে, মুখ যেন খুলো না মেয়ে, কাউকে কিছু বোলো না...”

ছড়া কেটে পুলিশকে শাপ-শাপান্ত করতে করতে আরো কিছুদূর সঙ্গে আসেন। নিজের সেলে ঢুকেই ওয়ার্ডেসকে প্রশ্ন করি, কে উনি?

উত্তরের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। বললে, “ওর নাম সাবিত্রী দেবী। মাস তিনেক ধরে পুলিশের অত্যেচার, ছেলে অসুস্থ, মাথার আর ঠিক নেই বোধহয়।“

সাবিত্রী দেবী! ধলঘাটের সাবিত্রী দেবী, “স্যানাটোরিয়াম”এর গৃহকর্ত্রী, বিপ্লবীদের মা!

পরবর্তী এক সপ্তাহ এঁর সঙ্গেই কেটে যায় আমার। জেলের আধিকারিকদের মোটেই মান্য করতেন না, রোজ পুজোপাঠ করে পুলিশের মৃত্যুকামনা করতেন, গর্বের সঙ্গে নিজের বিপ্লবী ছেলেদের গল্প করতেন। না, নিজের জেলবন্দী অসুস্থ ছেলেকে দেখতে না পাওয়ার কথায় নয়, নির্মল সেনের কথা, কন্যাসমা প্রীতিলতার কথা বলতে গেলেই চোখ দিয়ে জল গড়াত অঝোরে।

বিব্রত পুলিশ তখনও আমার পুরুষবেশে ঘুরে বেড়ানোর ব্যাখ্যা করতে পারেনি, আইনের ফাঁকে আমি কোনোভাবেই দোষী সাব্যস্ত হলাম না। হঠাৎ পঁচিশে সেপ্টেম্বর সকালে পুলিশের ডিআইবিকে আসতে দেখা যায়। আমার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন — কী ভাগ্যি তোমাকে সময়ে উদ্ধার করেছিলাম!

আমি হতভম্ব হয়ে প্রত্যুত্তর দিতে ভুলে যাই। খানিক পরে আরেকজন অফিসার এসে বলেন, তোমাকে সেই সময়ে অ্যারেস্ট না করলে কী দুর্ঘটনাটাই না হত!

এবার আমি রুখে উঠি। সোজা ডিআইবির কাছে গিয়ে দাবি করি, বলতে কী চান আপনারা? কী ঘটেছে?

ইনস্পেক্টর গভীর দুঃখের ভাব দেখিয়ে বলেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মৃতদেহ ইউরোপীয়ান ক্লাবের কাছে কাল রাতে পাওয়া গেছে। যেমন বেশে তুমি সেজেছিলে, সেই একই পোশাকে সেও পড়েছিল। সময়ে তোমাকে গ্রেফতার করেছিলাম, না হলে আজ তোমারও একই অবস্থা হতে পারত!

আমি আর কিছু শুনতে পারছিলাম না। প্রীতি! প্রীতি আত্মহত্যা করেছে!

দুরন্ত অনুশোচনায় আমি বিহ্বল হয়ে পড়ি। ইচ্ছাকৃত সুইসাইড! আমি থাকলে কোনোমতেই এ হতে দিতাম না। এ আমারই ব্যর্থতা!

ইনস্পেক্টর গভীর সমবেদনার সুরে বলে যেতে থাকেন, পকেট থেকে একতাড়া কাগজ পাওয়া গেল। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস বলে সেই ফাঁসীর আসামীটির ছবি, দলের প্যামফ্লেট, সুইসাইড নোট...

শেষ কথাটায় চমক ভাঙে। প্রশ্ন করি, সুইসাইড নোট? কীসের সুইসাইড নোট?

ইনস্পেক্টর একটা আধভেজা কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে গভীর উৎসাহে অপেক্ষা করতে থাকেন। আমি পড়তে থাকি।

“আমি বিধিপূর্বক ঘোষণা করিতেছি, যে প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া, অত্যাচারের স্বার্থসাধনে নিয়োজিত সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসনের উচ্ছেদ সাধন করিয়া আমার মাতৃভূমি ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করিতে ইচ্ছুক, আমি সেই ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখার একজন সদস্য।

এই বিখ্যাত “চট্টগ্রাম শাখা” দেশের যুবকদের দেশপ্রেমের নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছে। স্মরণীয় ১৯৩০-এর ১৮ই এপ্রিল এবং উহার পরবর্তী পবিত্র জালালাবাদ ও পরে কালারপুল, ফেণী, ঢাকা, কুমিল্লা, চন্দননগর ও ধলঘাটের বীরোচিত কার্যসমূহই ভারতীয় মুক্তিকামী বিদ্রোহীদের মনে এক নূতন প্রেরণা জাগাইয়া তুলিয়াছে।

আমি এইরূপ গৌরবমণ্ডিত একটি সঙ্ঘের সদস্যা হইতে পারিয়া নিজেকে সৌভাগ্যবতী অনুভব করিতেছি।

আমরা দেশের মুক্তির জন্য এই সশস্ত্র যুদ্ধ করিতেছি। অদ্যকার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অংশ।

বৃটিশ জোরপুর্বক আমাদের স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইয়াছে। ভারতের কোটি কোটি নরনারীর রক্তশোষণ করিয়া তাহারা দেশে নিদারুণ দুর্দশার সৃষ্টি করিয়াছে। তাহারাই আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংসের এবং সকল অধঃপতনের একমাত্র কারণ। সুতরাং তাহারাই আমাদের একমাত্র অন্তরায়। যদিও মানুষের জীবন সংহার করা অন্যায়, তবু বাধ্য হইয়া বড় বড় সরকারী কর্মচারীর ও ইংরেজদের জীবন সংহার করিতে আমরা অস্ত্রধারণ করিয়াছি। মুক্তিপথের যে কোনো বাধা বা অন্তরায় যে কোনো উপায়ে দূর করার জন্য আমরা সংগ্রাম করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

আমাদের দলের মহামান্য ও পূজনীয় নেতা মাস্টারদা অদ্যকার এই সশস্ত্র অভিযানে যোগ দিবার জন্য যখন আমাকে ডাক দিলেন, তখন আমি নিজেকে যথেষ্ট সৌভাগ্যবতী মনে করিয়াছিলাম। মনে হইল, এতদিনে আমার বহু প্রত্যাশিত অভীষ্ট সিদ্ধ হইল এবং সম্পূর্ণ দায়িত্ব লইয়া আমি এই কর্তব্যভার গ্রহণ করিলাম। এই উন্নত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্ব যখন আমার মত একটি মেয়েকে এই গুরুভার অর্পণ করেন, তখন এতগুলি কর্মঠ ও যোগ্যতর ভাইয়েরা বর্তমান থাকিতে অভিযানে নেতৃত্বের ব্যাপার একজন ভগিনীর উপর কেন ন্যস্ত হইবে, এই বলিয়া আমি আপত্তি জানাইলাম এবং একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে ঐ কাজে যাইতে চাহিলাম।

কিন্তু আমি পরে পূজ্য নেতার আদেশ শিরোধার্য করিয়া লইলাম।

আমি মনে করি যে, আমি দেশবাসীর নিকট আমার কাজের কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য। দুর্ভাগ্যবশতঃ এখনও হয়ত আমার প্রিয় দেশবাসীর মধ্যে এমনও অনেকে আছেন, যাঁহারা বলিবেন যে —ভারতীয় নারীত্বের ঊর্ধ্বতন আদর্শে লালিত একটি নারী কি করিয়া নরহত্যার মত এই ভীষণ হিংস্র কাজে লিপ্ত হইল।

দেশের মুক্তি-সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না? ইতিহাসে অনেক উদাহরণ আছে, রাজপুত রমণীরা অসীম সাহসের সহিত রণাঙ্গনে যুদ্ধ করিতেন এবং স্বদেশের স্বাধীনতা ও নারীত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য তাহারা শত্রুর প্রাণ-সংহার করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করিতেন না। ইতিহাসের পৃষ্ঠা এইরূপ কত নারীর বীরত্বগাথায় পূর্ণ। তবে কেন আমরা, আজিকার ভারতীয় নারীরা বিদেশীর দাসত্বশৃঙ্খল হইতে নিজের দেশকে পুনরুদ্ধার করিবার জন্য এই মহান যুদ্ধে যোগদান করিব না? যদি বোনেরা ভাইদের সঙ্গে কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে পারে, তবে সশস্ত্র বিদ্রোহে যোগদানে তাহাদের বাধা কি? সশস্ত্র বিদ্রোহে অন্য দেশের বহু নারী যোগদান করিয়াছে, তবে কেন ভারতীয় নারীরা বিপ্লবের এই পন্থাকে অন্যায় বলিয়া মনে করিবে?

নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়াছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন — এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।”

প্রীতি নিজের পুরো নাম স্বাক্ষর করেছে।

ইনস্পেক্টর আগ্রহের সঙ্গে বলেন, তোমার সঙ্গে কাদের যাওয়ার কথা ছিল? তাদের নাম-পরিচয় বলতে পারবে? বলা তো যায় না, কিছু গুরুতর আহত দেহ পাওয়া গেছে, শনাক্ত করতেও তো...

ডিআইবিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে এসে নিজের সেলের দিকে হাঁটা দিলাম।

।। চার ।।

প্রতিভাময়ী দেবীর কথা


রাণীর চিঠিখানা ঈশান দিয়ে গেল। হাতে দিয়ে একদণ্ড অপেক্ষা করল না, প্রণাম করেই ছুটে পালাল।

পুজোর দিন আজ। দুর্গাপঞ্চমী তিথি। আজ আর আমার ব্যস্ততা নেই, ফেরারী মেয়ের পিছনে ভাতের থালা নিয়ে ছুটে যাওয়ার দায় নেই, দুরন্ত সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা নেই, পুলিশের ভয় নেই। রাণীশূন্য রাজ্য আপন খেয়ালে চলেছে, কোথাও কোন বাঁধন নেই।

পুলিশ এসে সেদিন ঘরময় তাণ্ডব করে গেছে অকারণেই। হয়তো অকারণে নয়, হারিয়ে ফেলার ক্ষোভে-আতঙ্কে। ঝাঁসীর রাণীর গল্প শুনতে চাওয়া আমার চট্টগ্রামের রাণী তাদের ফাঁকি দিয়ে, বিদ্রূপ করে চলে গেছে। রাণীর তোরঙ্গ ভাঙতে বাধা দেওয়ার জন্য মধুকে মাটিতে ফেলে মারের চোটে অজ্ঞান করে দিয়েছে ওরা।

আজ সবকিছু শান্ত হয়ে গেছে। রয়েছে শুধু বহুদূর থেকে আসা রাণীর চিঠি।

“মা, আমায় তুমি ক্ষমা করো—তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে গেলাম। তোমাকে এতটুকু ব্যথা দিতেও তো চিরদিন আমার বুকে বেজেছে। তোমাকে দুঃখ দেওয়া আমার ইচ্ছা নয়। আমি স্বদেশ-জননীর চোখের জল মোছাবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি। তুমি আমায় আশীর্বাদ কর, নইলে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে না। একটিবার তোমায় দেখে যেতে পারলাম না! সেজন্য আমার হৃদয়কে ভুল বুঝোনা তুমি।

মাগো, তুমি অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য — স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না?

কী করবে মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী যে বিদেশীর অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অপমানিতা! তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?

না, আর পারছি না। ক্ষমা চাওয়া ভিন্ন আর আমার উপায় নেই। আমি তোমাকে দুদিন ধরে সমানে কাঁদিয়েছি। তোমার ক্রন্দন আমাকে এতটুকু টলাতে পারেনি।

কি আশ্চর্য মা! তোমার রাণী এত নিষ্ঠুর হতে পারলো কি করে? ক্ষমা করো মা; আমায় তুমি ক্ষমা করো!”

বোকা মেয়ে! তোর মায়ের দুঃখটাই বুঝলি, গর্বটা দেখলি না?

রাণীর মত মেয়ের মা আমি— সাতজনের সংসারের দায়িত্ব আমাকেই সে যাওয়ার আগে দিয়ে গেছে। আমার উপায় একটিই— জন্ম থেকে যা শিখে এসেছি— সেবার কাজ। অর্থাগমের জন্য সে পথেই যেতে হবে।

রাণীর বাবার চাকরি গেল। চোখের মণি মেয়ের মৃত্যুসংবাদ সইতে পারলেন না, আর কোনদিন সুস্থতা ফিরে পাবেন বলে মনে হয় না। অসংলগ্ন কথা বলতে থাকেন, কনককে রাণী ভেবে কখনও হুকুম করে বসেন। তা হোক্; এই যদি মূল্য হয়, তবে তাই হোক। শ্মশানরাজ্যে কালীর পূজায় এ-ই নিবেদনের রীতি। আরো যদি দিতে হয়, আরো দেব। আমার প্রতিটি সন্তান রাণী হোক।

।। পাঁচ ।।

সূর্য সেনের কথা


রাণী, আমার ভুল হয়েছিল।

তখন বুঝতে পারিনি। আত্মহত্যার পক্ষপাতী যে আমি কোনোকালেই হতে পারিনি! মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরে অম্বিকা-গণেশ-অনন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে তাদের প্রতিটি পরবর্তী পদক্ষেপে। তোর মত কর্মীর প্রাণও যে বিপ্লবের অমূল্য সম্পদ! এমন হেলায়, এত অল্পেই তাকে কি নষ্ট হতে দেওয়া যায়?

তখন তো বুঝিনি রাণী, কত ভেবে, কতখানি নিশ্চিত হয়ে এই স্থিরমৃত্যুর পথে তুই গিয়েছিলি। কতখানি নির্মোহ চোখে বুঝেছিলি আমাদের সাধনার পথ মসৃণ করতে তোর আত্মত্যাগের প্রয়োজন। বুঝতে পারিনি কত শত রাণীদের অনুপ্রেরণার দীপ জ্বেলে যেতে তোর এই স্বেচ্ছানির্বাণ।

বুঝিনি বলেই রাগে, অভিমানে তোকে আঘাত করেছিলাম। আমার মুহূর্তের মতিভ্রম, অন্ধ আবেগ সেদিন আমার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেছিল। যে অভিঘাত তুই সৃষ্টি করে গেলি, একশত অভিযানেও তার সমতুল্য আমরা হয়ে উঠতে পারতাম না।

না, হয়তো এটুকুই সব নয়। যুদ্ধে ঠেলে দিতে পারি বলে কি সকলকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও ঠেলা যায়? নিষ্ঠুরতা নয়— অতখানি মনোবল তোর মুখ চেয়েই আমি সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি।

তোকে যে বড় আপন করে নিয়েছিলাম! কতবার কত ব্যথা দিয়েছি তোকে, রাণী— তুই কিছু মনে রাখিসনি, তোর আপন গুণে সর্বদা ক্ষমা করেছিস। কতবার কত গাল দিয়েছি। আবার তোর ভগবৎনিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়েছি, তোর ব্যবহারে তোকে শ্রদ্ধা করেছি— প্রাণ খুলে অসঙ্কোচে আপন ভগ্নীর জায়গায়, কন্যার জায়গায় তোকে বসিয়েছিলাম যে! সেদিন মনে হয়েছিল, অবুঝ জেদে আমার স্নেহকে তুই তুচ্ছ করলি।

বলেছিলি— জন্মের মত যাই!

রাগের বশে প্রণাম নিলাম না। তাও হাসিমুখে চলে গেলি— সে হাসিতে কত দুঃখ আমার কারণে মিশে ছিল তা আমি জানি না। আমার দুর্বলতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে রাণীর মত নিজের সংকল্পে অটল থাকতে পারার শক্তি তুই কোথা থেকে পেয়েছিলি জানি না তাও। আমি জানতাম, রামকৃষ্ণ তোকে এই রাস্তায় এগিয়ে দিয়েছে। আমৃত্যু আমার বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা নির্মল তোকে এ পথে ডেকে নিয়ে গেছে।

বুকপকেট থেকে রামকৃষ্ণর ছবি শনাক্ত করতে পুলিশের বিলম্ব হয়নি। যে চিঠি তারা তোর মৃতদেহের সঙ্গে পেয়েছিল, তা হাজার অত্যাচারীকে আতঙ্কিত করছে, আরও হাজার রাণীর জন্ম দেবে। ইংরেজের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দ্বিতীয় ভিত্তি তুই স্থাপন করে গেছিস; শুধু কীর্তি দিয়ে নয়, প্রাণ দিয়ে। আমার প্রথম জীবনের নারীবর্জিত আন্দোলন পরিকল্পনার মহাভ্রম তুই রক্ত দিয়ে সংশোধন করে গেছিস।

আবৃত্তি করতিস কত, রবিঠাকুরের কথা! মানসীর সেই অমর পংক্তিক’টি —

“এর চেয়ে ভালো প্রখর দহন, নিঠুর আঘাত চরণে ।

যাব আজীবনকাল পাষাণকঠিন সরণে ।

যদি মৃত্যুর মাঝে নিয়ে যায় পথ

সুখ আছে সেই মরণে।।”

আজ বুঝতে পারি, কী অক্ষয় সততায়, কী দীপ্ত ভবিষ্যদৃষ্টিতে তুই নিজেকে তৈরী করেছিলি তিল তিল করে।

আমি ভুল করেছিলাম, কিন্তু তোর সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত হয়নি, আমার প্রতিবাদ তোকে আদর্শ ও কর্তব্য কোনোটা থেকেই একবিন্দু টলাতে পারেনি।

কন্যার আর শিষ্যার কাছে পরাজয়ে গৌরবের বৃদ্ধি হয় জানি। তুই আমার গৌরব, আমাদের গৌরব, চট্টগ্রামের, দেশের গৌরব। কিন্তু আমার এ আক্ষেপের কথা আজ আমি কাকে বলি?

শেষ মুহূর্তে অযথা, অন্যায়ভাবে তোকে আঘাত করেছি, তার জন্য আমাকে ক্ষমা কর্— যেখানেই থাকিস, আজ বিজয়ার দিনে আমাকে ক্ষমা কর তুই। নেতা সূর্যকুমার সেনের মস্তিষ্ক আজ বলছে, স্নেহান্ধ দাদার সেদিন ভুল হয়েছিল। তুই কি বুঝিস নি, নিজের হাতে নিরঞ্জনের আগে প্রতিমা সাজাতে কেমন লাগে! আজকের বিজয়ার সুরে সকল প্রতিমার মুখে তোর মুখ দেখতে পাই, নিজের হাতে সাজিয়ে যাকে দেবীপক্ষ শুরুর আগেই বিসর্জন দিয়ে এসেছি তার কথা সারাক্ষণ বুকে বাজতে থাকে। আমার এতটুকু কষ্ট তুই কোনোদিন হতে দিসনি, আজ আমাকে এই অনুশোচনা থেকে মুক্তি দে।

রামকৃষ্ণর কাছে অমিতার বেশে গিয়েছিলি, নির্মলের কাছে রাণীর সাজে; আজ আমার কাছে বিজয়া হয়ে ফিরে আয়। জগন্মাতার কাছে আজকের পুণ্যতিথিতে প্রার্থনা করি, আমার বিজয়ার সকল গুণ যেন আমার ভাইবোনেদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যেন তার গৌরব আমার সব হারাবার ব্যথাকে ছাপিয়ে আমায় পূর্ণ করে তোলে।


তথ্যসূত্র:

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের দিনলিপি
কল্পনা দত্ত— “Chittagong Armoury Raiders Reminiscence”
শৈলেশ দে— “আমি সুভাষ বলছি”
মনোরঞ্জন ঘোষ— “চট্টগ্রাম বিপ্লব”
সূর্য সেনের “বিজয়া”



(পরবাস-৭০, ৩১ মার্চ ২০১৮)