"আয় — এদিকে আয়—
তোকে নিয়ে যাবো এক জায়গায় —
সে এক দেখার মতো জিনিস বুঝলি — "
— কথাগুলো আমিই বললাম। আমার ছেলেকে।
অকম্মার মতো?
"প্রেমাংশু আচার্যির বাড়ি — সে এক দেখার মতো জিনিস বুঝলি খোকা" — ছোটবেলায় বাবার কাছে বহুবার শুনেছিলাম কথাগুলো। মাঝেমাঝেই সাধারণত শনিবার রাতে এই কথাগুলো বলতো আমার বাবা — "কাল তো রোববার — দেখি যদি পারি সময় করতে — তাহলে তোকে নিয়ে যাবো— দেখলে তাজ্জব হয়ে যাবি যে কতো রকমের —"
ঠিক সেই সময়ে মা এসে ধমক লাগাতো — "এবার ছেলেটাকে ঘুমোতে দাও তোমার এই বকবকানি থামিয়ে।"
বাবা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই যেন খুব অন্যায় করে ফেলেছে এমনি মুখ করে বলে উঠতো —"ওহো — কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেলো — বুঝতেই পারিনি — ঘুমিয়ে পড় খোকা"। এই বলে পাশের ছোট ঘরটায় যেন পালিয়ে যেত কোনোমতে।
এইভাবে নানান সময়ে বাবার কাছ থেকে ওই বাড়িটার ব্যাপারে শুনেছিলাম যা কিছু তা ঝকমকে পাথরের মতো মাঝে মাঝে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতো — "বুঝলি খোকা — সে এক দেখবার মতো জিনিস বটে ...বাইরে রূপোলী রঙের বিরাট গেট আর গাঢ় নীল রঙের পাঁচিল... সেই পাঁচিল জড়িয়ে ঝুলছে সার সার লতানে গাছ, যার ফুলগুলো গাঢ় হলুদ...আর পাঁচিলের ওধারে ঘন সবুজ রঙের তিনতলা বাড়ি ...কিন্ত তার জানলাগুলো আবার ঝকঝকে রূপোলী রঙের..।. সেখানে আবার রঙিন কাচের শার্শি...আর ছাদ থেকে নেমে এসেছে সারসার বোগেনভেলিয়া...লাল আর সাদা রঙের... সব মিলিয়ে যেন এক জলছবি..."
সেদিনটা শুরু হয়েছিল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি দিয়ে। যত বেলা বাড়তে থাকলো বৃষ্টির জোরও যেন সেই সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করলো। চারদিকে জল থৈ থৈ। স্কুলে যাওয়ার প্রশ্নই ছিলো না। বাবাও বেরোতে পারলো না কাজে। চুপচাপ জানলার ধারে বসে শার্শির কাচে বৃষ্টির জলের আঁকিবুকি দেখছিলাম। বাবাও এসে বসলো পাশটায়। আস্তে করে বললো — "আজ আমারও ছুটি।" আমিও বলে উঠলাম — "তাহলে গল্প বলো।" বাবা কানে কানে জিজ্ঞেস করলো — "কিসের গল্প?" বাবা যেন জানতো আমার উত্তরটা। তাই এক গাল হেসে আবার জিজ্ঞেস করতো —"প্রেমাংশু আচার্যির বাড়ির?" আমি সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠতাম —"হ্যাঁ হ্যাঁ।"
বাবা চোখ বড়ো বড়ো করে বলতে শুরু করলো —"সেও এইরকম এক বৃষ্টির দিন। বিকেলের দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছে যখন অরুণ বললো —'আজ তো তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলো — স্কুল থেকে চল আমাদের বাড়ি'।"
জিজ্ঞেস করলাম — "অরুণ কে?"
"আরে অরুণ মানে অরুণাংশু আচার্যি। ব্যরিস্টার প্রেমাংশু আচার্যির নাতি। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।" বলেই বাবা আবার বলতে শুরু করলো — "সেই প্রথম গেলাম ওদের বাড়িতে। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় বৃষ্টিভেজা ওই বাড়িটাকে দেখে আমি থ। এটা বাড়ি না আঁকা ছবি! কিন্তু সত্যিকারের তাজ্জব হয়ে গেলাম বাড়ির ভিতরটায় ঢুকে।"
"কেন? কেন?"
"আরে কি নেই সেই বাড়িতে... বাড়ি না মিউজিয়াম..."
আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম বাবার দিকে — বোধহয় সেই মিউজিয়ামে ঢোকার জন্যই। আর বাবাও যেন তৈরি থাকতো সেটা জেনেই — "ঢুকেই তো দেখি বিরাট হলঘর। সেখানে সারসার ছোট ছোট পাথরের মূর্তি... তাদের শরীরটা মানুষের মতো কিন্তু মুখগুলো জন্তু জানোয়ারের মতো..."
"আরিব্বাস! সে তো দারুণ ব্যাপার!"
আসলে অরুণের দাদু প্রেমাংশু আচার্যি ছিলেন এক অদ্ভুত মানুষ ...বিরাট ব্যারিস্টার ... অথচ কত রকমের সখই না ছিলো... নানা দেশ ঘুরে কত কিছুই না সংগ্রহ করেছিলেন... রেড ইন্ডিয়ানদের তীর থেকে শুরু করে..."
"আবার শুরু করলে ওইসব আজগুবি গল্প," — মায়ের গলায় চমকে উঠেছিলাম আমরা দুজনেই। বাবা একটু অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বললো — "আসলে আজ তো রেনি ডে —। আমরা দুজনেই বাড়িতে থাকি না তো কখনো দিনের বেলায় — তাই ভাবলাম ছেলেটার সঙ্গে —"
বাবার কথার মাঝখানেই মা বলে উঠলো — "গল্প যদি বলবেই তো সুকুমার রায় অবনীন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণের গল্প বলো — তা না বলে যত্তোসব —"
বাবা চুপচাপ মাথা নীচু করে বসেছিলো আর মা আবার বলতে লাগলো — "আর তাও যদি না পারো তাহলে বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে আছে সেগুলোর দিকে নজর দাও।"
বাবা আমার মুখের দিকে যেন সামান্য কাতরভাবে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো। তারপরেই মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো — "নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই — আজকেই করবো।" বলে উঠে পড়লো। তার মাঝেই ফিসফিসিয়ে বলে গেলো আমার কানে —"পরে আরেক দিন ভালো করে বলবো অন্য ঘরগুলোর সব ব্যাপার স্যাপার।"
অন্য ঘরগুলোর গল্প আর শুনতে পেলাম না সেভাবে কোনো দিনই। স্কুল আর টিউশনির চাপে দিনগুলো যেন হু হু করে ভেসে চলে যেতে লাগলো। এরই মাঝে একদিন রাতে বাবা এসে বসলো আমার পড়ার টেবিলের সামনে।
"কাল তো রোববার — আর পরের দিন পনেরই আগষ্ট — পরপর দুদিন ছুটি —"
আমি উৎসুক চোখে বাবার দিকে তাকালাম।
"কাল তোর কোথাও পড়তে যাওয়ার আছে না কি?"
মাথা নেড়ে বললাম — "নাহ্..."
সঙ্গে সঙ্গেই বাবা বলে উঠলো — "তাহলে যাবি?"
বললাম — "কোথায়?"
"প্রেমাংশু আচার্যির বাড়ি?"
তক্ষুণি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো — রূপোলী রঙের লোহার গে।।.. ঘন নীল পাঁচিল... আর তার পিছনে গাঢ় সবুজ রঙে মোড়া সেই আশ্চর্য বাড়িটাকে।
পরের দিন বিকেলের অনেক আগেই রওনা হলাম দুজনেই। বাড়ির সামনে মোড়ের মাথায় একটা বিরাট কেক পেস্ট্রির দোকান ছিলো। এই দোকান থেকে কিছু কেনার সামর্থ্য যে নেই আমাদের তা বোঝার মতো বোধবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। তাই আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা ওই দোকানে ঢুকলো। আমি বললাম — "এখান থেকে কিনবে?" বাবা বললো — “এত বছর বাদে যাচ্ছি — তাছাড়াও ওরা এত বড়ো মানুষ — ওদের জন্যে কি আর পাড়ার পঞ্চার দোকানের মিষ্টি নিয়ে যাওয়া যায়?" আমি হাঁ করে দেখতে থাকলাম কতো রকমের কেক পেস্ট্রি আরো কতো কি যার নাম জানিনা।
পেস্ট্রির বাক্সটা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাবা বললো — "অনেক খরচ হয়ে গেলো রে— কিন্তু কি করবো — আমারও তো কিছু সম্মান আছে — ছোট বেলায় এক ক্লাসে পড়তাম —"
তারপর সারা রাস্তায় যেতে যেতে শুনতে লাগলাম বাবার সেই বন্ধু অরুণাংশুর বাড়ির কথা —
"আমায় খুব স্নেহ করতেন ওর দাদামশাই ... খুব বড়ো ব্যরিস্টার ছিলেন — আর খুব দিলদার মানুষ ... কতো রকমের শখ যে ছিলো... বাড়ির হলঘরটা যেন একটা মিউজিয়াম... আর পিছনের বাগানটা যেন চিড়িয়াখানা ... কি নেই সেখানে... রঙিন মাছ— কচ্ছপ — তোতা পাখি — বেজি — আরো কতো কি... লাইব্রেরিটাও ছিলো তেমনি — ফুল চাষ থেকে শুরু করে বন্দুকের ইতিহাস —" বলে এক গাল হেসেছিলো বাবা।
বেলা বাড়ছিলো। আমি বলেছিলাম — "তাড়াতাড়ি চলো — বিকেল তো শেষ হয়ে আসছে — তুমি যে বলেছিলে বিকেলের আলোয় দেখলে রূপকথার ছবির মতো লাগে?"
বাবা বলেছিল —"এই তো এসে গেছি... এই যে এলগিনের মোড়...এখান থেকে দু পা হাঁটলেই..."
সেই দু পা হাঁটা যে কখন দুশো পা হয়ে গেল কিন্তু প্রেমাংশু আচার্যির বাড়ির কোনো চিহ্নমাত্র দেখা গেল না। ইতিমধ্যে আকাশ কালো হয়ে এলো। দিনের পড়ন্ত সোনালী আলোয় যেন কে একরাশ কালি ঢেলে দিলো। বিকট আওয়াজ করে কাছেই কোথাও বাজ পড়লো। চমকে উঠে বাবার হাতটা শক্ত করে ধরলাম। বাবা বলেছিল — "ভয় পেলি নাকি?" আমি মাথা নাড়িয়ে বলেছিলাম — "বৃষ্টি আসছে তো তাই।" বাবা বলেছিল —"তাতে কি? আমরা তো প্রেমাংশু আচার্যির বাড়িতে ঢুকে যাব এক্ষুনি।" এইবার বিরক্ত হয়ে বললাম —"কতক্ষণ ধরে তো শুধু ঘুরেই মরছি — তুমি তো চিনতেই পারছো না।" এইভাবে বাবার সঙ্গে আমি কথা বলিনি কোনোদিন। বাবার মুখটা যেন হঠাৎ কালো হয়ে গেলো। তার পর খুব আস্তে করে বলল — "তুই এই বারান্দার নীচে দাঁড়া। আমি ওপার থেকে আসছি।" বাবার ওই মুখটা দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কারণ বাবাকে আমি এতো ভালোবাসি আর তার মনে আঘাত দিয়ে ফেললাম! বাবার হাতটা আবার ধরে খুব নরম গলায় বললাম —"তুমি তো বলেছিলে এসব রাস্তাঘাট তোমার খুব চেনা — অনেকবার এসেছ এখানে —" বাবা একটু অপ্রস্তুতের হাসি হেসে বললো —"সে তো এসেইছি — কিন্তু অনেককাল হয়ে গেলো তো —রাস্তাঘাট এতো বদলে গেছে কে জানতো — দাঁড়া ওপারটা গিয়ে দেখি।"
এইভাবে এপার ওপার এই রাস্তা সেই রাস্তা করতে করতে সন্ধে নেমে এলো। বললাম — "কাউকে একটু জিজ্ঞেস করে নাও না।"
সামনে একটা চায়ের দোকানে কয়েকজন বয়স্করা জটলা করছিলো — বাবা গিয়ে বললো — "আচ্ছা ব্যরিস্টার প্রেমাংশু আচার্যির বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?" "এ পাড়ায় কোনো ব্যরিস্টার ফ্যরিস্টার থাকে না।" চায়ের কাপে আওয়াজ করে চুমুক দিতে দিতে উত্তর এলো ওদিক থেকে।
"ও ভাই বলতে পারো — সবুজরঙের তিনতলা বাড়ি — নীল রঙের পাঁচিল— বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন —" "না দাদা এদিকে কোনো সবুজ রঙের বাড়ি নেই, এ পাড়ায় সব লাল হো গয়া।"
"মানে আমি এসেছিলাম বছর তিরিশ আগে — বিখ্যাত বাড়ি — ব্যরিস্টার প্রেমাংশু আচার্যি — ওনার নাতি অরুণাংশু আমার বাল্যবন্ধু ছিলো —এক সাথেই পড়েছি সাত বছর — কিন্তু অনেক দিন আর যোগাযোগ নেই--" —"আপনি তো তাজ্জব মানুষ মশাই — তিরিশ বছরের আগেকার বাড়িঘর কি আর কিছু এপাড়ায় আছে— সব তো ভেঙেচুরে নতুন নতুন মাল্টি স্টোরি হয়ে গেছে —"
"ভারি আশ্চর্য কথা তো — এরা তো কেউ —" বাবার কথার মাঝখানেই টুপটাপ করে বৃষ্টি এলো। ওই বৃষ্টি মাথায় করেই নন্দন রোড — চন্দ্রনাথ চ্যটার্জি স্ট্রিট — বেণীনন্দন লেন — চক্কর খেতে লাগলাম। হঠাৎ বৃষ্টিটা ঝমঝমিয়ে এসে গেল। দৌড়ে কোনোক্রমে এসে মাথা গুঁজলাম একটা গাড়ি বারান্দার নীচে। বললাম — "যাহ্। এবার কি হবে?" বাবা একটু হেসে বলল — "অসময়ের বৃষ্টি তো — একটু বাদেই থেমে যাবে — এদিকে আয় তোর মাথাটা মুছিয়ে দিই।"
কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ ওইরকম হোলো না। বৃষ্টির তোড় বাড়তেই লাগলো ক্রমশ। সেই সময় একটা লম্বামতো লোক এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। বাবা যেন মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলো তাকে — "আচ্ছা দাদা বলতে পারবেন প্রেমাংশু আচার্যির বাড়িটা —" বাবা কে থামিয়ে দিয়ে সে বলে উঠলো —"আ্যড্রেস?" বাবা বললো — "আসলে সেটাই তো —" বাবার কথা শেষ হচ্ছে হবার আগেই লোকটা বাবার উদ্দেশ্যে একটা খারাপ কথা বলে পানের পিক ফেললো। এইবার হঠাৎ প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলে উঠলাম — "বাদ দাও — বাড়ি যাবো।" বাবা কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে কেমন একটা বোবা দৃষ্টিতে তাকালো। লোকটা ওইভাবে থুথু ফেলে চলে যাওয়ার পর চারদিক যেন কেমন নিঝুম হয়ে গেলো। বাবা মাথা নীচু করে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো — ক্যালেন্ডারে দেখা সেই পাথরের মূর্তিটার মতো।
আমিও চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে শুধু বৃষ্টি পড়া দেখে যাচ্ছিলাম। এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেলো কে জানে। হঠাৎ দেখলাম বাবা যেন অত্যন্ত সন্তর্পণে ওই পেস্ট্রির বাক্সটা খুলে একটা পেস্ট্রি আমার দিকে এগিয়ে দিলো। বুঝলাম বাবা হেরে গেছে। বাবাকে দেখে খুব কষ্ট লাগলো। বললাম — "তুমি খাবে না?" বাবা কিছু না বলে একটা পেস্ট্রি তুলে নিয়ে প্রায় গোটাটা একসঙ্গে মুখে পুরে চিবোতে লাগল। ব্যাপারটা দেখে আমার আরো বিচ্ছিরি লাগলো। বাড়ি ফেরার সময় বাবা বলেছিল — "তোর মাকে এসব কিছু বলিস নি... আমি ব্যাপারটা ম্যানেজ করে দেবো... বলবো ও বাড়িতে কেউ ছিলো না... না জানিয়ে গিয়েছিলাম তো ...খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে এলাম... রাস্তায় বৃষ্টিতে এতো জ্যাম..."
এরপর থেকেই বাবার সম্পর্কে ধারণাটা আমার কেন জানি না পুরোপুরি ভেঙে গেল। মনে হলো ওই বাড়িতে হয়তো বাবা কখনো গিয়েছিল। কিন্তু সেটাকে রঙচঙ দিয়ে আমায় এতকাল শুনিয়েছে। তখন থেকেই বাবার প্রতিটি কাজেই অবিশ্বাস জন্মাতে লাগলো। মনে হতো মার কথাই ঠিক — ম্যান উইদাউট কোয়ালিটিস — অকম্মা। তখন আমার বেড়ে ওঠার বয়স।
এই বেড়ে ওঠাটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো। অর্থাৎ আমি পুরোপুরি বড়ো হয়ে গেলাম। আর সেই 'ম্যান উইদাউট কোয়ালিটিস' কখন যে এর মধ্যে বুড়ো হয়ে একঘরে হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। ওর ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম — চায়ের কাপ নিয়ে পাথরের মতো বসে রয়েছে সে — বাইরের জানলার দিকে তাকিয়ে —
সেদিন সকালে ওই ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ঠঙ্ করে একটা আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম ওর হাতের কাপটা পড়ে গেল। এর আগেও এমনটা হয়েছে অনেকবার। মনে হলো মায়ের দেওয়া নামটা কত পারফেক্ট ছিলো — অকম্মা। একটা লোক কোনোদিনও কোনও কাজ সঠিকভাবে করতে পারলো না।
এবারে কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম ছিলো। কারণ খানিক বাদে জানতে পারলাম যে শুধু কাপটা নয় — কাপটার পাশে সেও পড়ে আছে — নিঃশব্দে — নিথর হয়ে।
এর পরের কাজগুলো নিয়মমাফিক করতেই হয়। কিন্তু হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসে সব কিছু অনেক দেরি করিয়ে দিলো। আমাদের ক্রিক লেনের বাড়ি থেকে 'শেষ যাত্রা'র গাড়ি নিয়ে বেরোতে বেরোতে দুপুর গড়িয়ে গেল। কিন্তু এর পরেও যেন ছাড় নেই। মল্লিক বাজারের মুখ থেকে গাড়ি যেন আর এগোয় না। কারণ সামনে হাজার লোক। 'রুখছি রুখবো' ... 'চলছে না চলবে না'। বেগবাগানের মুখ থেকে এক্সাইডের মোড় আসতে বিকেল চারটে বেজে গেল। এক্সাইডের মোড়ে এসে ড্রাইভার বলে উঠলো — "এভাবে যাওয়া যাবে না।" বলেই একটু এগিয়ে গিয়ে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়লো। বললাম — "একি করলেন কোন রাস্তায় ঢুকলেন?" ড্রাইভারটি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো — "দেখতে পাচ্ছেন না — বড়ো রাস্তাগুলোর কি অবস্থা? আপনাকে পনেরো মিনিটে কেওড়াতলায় পৌঁছে দিলেই তো হলো। এবার চুপ করুন।" বলে সাপের মতো এঁকেবেকে এই গলি সেই গলি করে কোথায় যে যেতে লাগল তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপর একটা বিকট হর্ন দিয়ে এসে দাঁড়ালো একটা রাস্তার বাঁকের মুখে। সেখানে বেশ কিছু ট্যাক্সির জটলা। মনে হলো কোনো আ্যক্সিডেন্ট। বা কোনো খুচরো ঝামেলা। মানে আবার জ্যাম। শরীরটা কেমন ঝিম ঝিম করে উঠলো। গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখলাম — 'মোহিনীমোহন রোড'। তার পরেই চোখে পড়লো লোহার গেট। রূপোলী রঙের। আর গাঢ় নীল রঙের পাঁচিল। আর পাঁচিলের উপরে একটা ঘন সবুজ রঙের বাড়ি। যার জানলাগুলো আশ্চর্য রকমের রূপোলী রঙের। দিন শেষের পড়ন্ত আলো যেন চুঁইয়ে পড়ছে সেই ভেজা বাড়িটার গা থেকে। আর তখনই চোখে পড়লো বাড়ির সদর দরজাটায় লাগানো পাথরের ফলকটা — যার উপর নির্ভুল ভাবে লেখা — 'ব্যরিস্টার প্রেমাংশু আচার্য'! চমকে উঠলাম! কি দেখছি এটা! গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যাবো — আবার ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি। সেই সঙ্গে ড্রাইভারের চিল্লানি — "কি হলো? নামলেন কেন? উঠে আসুন জলদি।" দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। কাচের গাড়িটা চলতে শুরু করলো সাথে সাথেই।
গাড়ির ভিতরে তাকিয়ে দেখলাম — বিকেলের পড়ন্ত আলো এসে পড়েছে গাড়ির মধ্যে থাকা সেই শীতল শায়িত মুখটিতে। দিনান্তের সেই সোনালী আলোয় অদ্ভুতভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠা মুখটিতে যেন স্মিত হাসি। যেন সেই হাসিতেই বলছে — "কি রে দেখলি তো? প্রেমাংশু আচার্যির বাড়ি?"
আরেকবার বাইরে তাকাতে গেলাম। ওই বাড়িটার দিকে। কাচের উপরে গড়িয়ে আসা জলের ফোঁটায় বাড়িটা যেন তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে পুরোপুরি আবছা হয়ে গেল। সেই বাড়িটাকে সেই রাস্তাটাকে ফেলে গাড়িটা হু হু করে চলতে লাগলো।
গাড়ির ভিতরে আমার সামনে তখনো আশ্চর্য হাসিতে আমার দিকে আমার বাবা — "অকম্মা"।
অনেকক্ষণ বাদে প্রথাগত অন্ত্যেষ্টি সেরে রাতের দিকে বাড়ি ফিরে শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিলাম বাবার ঘরে রাখা পুরোনো বেতের চেয়ারটাতে। ঘরে ঝুলপড়া পুরোনো বাল্ব। পুরোনো ক্যালেন্ডার। অচল ঘড়ি। হঠাৎ দেখলাম আমার সাত বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দরজার ওপারে। হাতের ইসারায় ডাকলাম। ও এক পা এক পা করে যেন খুব অবাক হয়ে আমার কাছে এলো। আমি ওর চুলগুলোয় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম — "আয় — এদিকে আয় — আমি খুব আস্তে করে ফিসফিসিয়ে বললাম — তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো ..." ও আরো অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি প্রায় ওর কানে কানেই বললাম — "সে এক দেখার মতো..."
(পরবাস-৭০, ৩১ মার্চ ২০১৮)