Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines





পরবাসে
সুস্মিতা কুণ্ডুর

লেখা


ISSN 1563-8685




আনন্দকণা

নন্দপুর রাজ্যে মোট্টে আনন্দ নেই। চিন্তায় চিন্তায় শয্যা নিয়েছেন রাজামশাই, রাণীমারও অবস্থা তথৈবচ। রাজপ্রাসাদের পঞ্চব্যঞ্জন রান্নাও আর মুখে রুচছে না।

প্রজারাও ভারি দুশ্চিন্তায়। কারোর মুখে হাসির লেশমাত্র নেই।

আনন্দপুরের রাজামশাই আর রাণীমা যে বড় ভাল মানুষ। প্রজাবৎসল, দয়ালু, শান্তিপ্রিয়। কিন্তু দুঃখের কথা হল ওঁদের কোনও সন্তান নেই। কোনও ছোট্ট রাজকন্যা টলোমলো পায়ে রাজপ্রাসাদময় ছুটে বেড়ায় না। কোনও রাজপুত্তুর আধোআধো স্বরে কথা কয় না।

রাজবৈদ্যমশাই একের পর এক ওষুধ দিয়ে চলেছেন। কিন্তু অসুখ যে রাজামশাই আর রাণীমায়ের মনে। তাই কোনও ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। এদিকে দুষ্টুলোকের তো আর অভাব নেই।

রাজামশাইয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে আশপাশের রাজ্যগুলো সৈন্য সাজাতে শুরু করেছে। আনন্দপুরে হামলা চালিয়ে, দখল করবে সে সোনার রাজ্য।

মন্ত্রীমশাই আর সেনাপতিমশাই মিলে কোনও ক্রমে রাজ্য চালাচ্ছেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন!

অবশেষে দুজনে মিলে পরামর্শ করে চললেন রাজগুরুর কাছে। রাজগুরু অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ। বয়স হয়েছে, তাই রাজসভায় নিয়মিত আসতে পারেন না। মন্ত্রীমশাই রাজগুরুকে প্রণাম জানিয়ে সবিস্তারে বর্ণনা করলেন এই মহা বিপদের কথা। রাজগুরু সব শুনে মাথা নেড়ে বললেন —"মন্ত্রীমশাই, সেনাপতিমশাই, এ আমার কম্মো নয়। আমার ক্ষমতায় থাকলে তো কবে আমি রাজামশাই আর রাণীমাকে সুস্থ করে তুলতাম। ওঁদের মন তো সন্তানের অভাবে, রাজ্যের ভবিষ্যৎ চিন্তায় আচ্ছন্ন। সেই সমস্যাটারই সমাধান করতে হবে। তবেই ওঁরা সুস্থ হবেন। আর এই কাজ একমাত্র পারেন আমার গুরুদেব। তিনি মহাজ্ঞানী, সন্ন্যাসী মানুষ। আমি তাঁকে আহ্বান জানাব আমাদের রাজ্যে এসে আমাদের সাহায্য করতে।"

মন্ত্রীমশাই আর সেনাপতিমশাই আশ্বস্ত হয়ে ফিরে গেলেন, আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় রইলেন তাঁরা, কখন আসবেন সেই মহাসন্ন্যাসী। একদিন দু'দিন করে দিন যায়। ঠিক সাতদিনের মাথায় এলেন মহাসন্ন্যাসী। শান্ত সৌম্য, পক্ককেশ, পক্ক গুম্ফ-শ্মশ্রু মণ্ডিত এক বৃদ্ধ। তিনি রাজামশাই আর রাণীমার চোখের ভাষা বুঝি পড়তে পারলেন। বললেন —"এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে হবে। সেই যজ্ঞে আহুতি দিতে হবে সমস্ত রাজ্যের সবার যত রকমের অস্ত্র আছে, সব। তরোয়াল, তির-ধনুক, কুঠার, বর্শা, ছুরি...
"সেই আহুতির তেজ থেকে প্রকট হবেন মহা শক্তিশালী যুবরাজ।"

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ক্ষণে শুরু হল সেই মহাযজ্ঞ। দলে দলে সৈন্য, প্রজা থেকে শুরু করে মন্ত্রীমশাই, সেনাপতিমশাই, রাজামশাই সকলের যুদ্ধাস্ত্র, বর্ম সব নিক্ষেপ করা হল বিশাল সেই অগ্নিকুণ্ডে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল অগ্নিশিখা। রাজ্যজোড়া লোকের অবাক দৃষ্টির সম্মুখে ধীরে ধীরে সেই অগ্নিকুণ্ড থেকে উঠে এল সূর্যের মত তেজোময় এক তরুণ যুবা। মহাসন্ন্যাসী বললেন —"বীরভদ্র! আনন্দপুর রাজ্যের যুবরাজ।"

সবাই জয়ধ্বনি করে উঠল। বীরভদ্র মা বাবাকে গিয়ে প্রণাম করলেন। রাজামশাই আর রাণীমার যন্ত্রণা-ক্লিষ্ট মুখে হাসি ফুটে উঠল বহুদিন পর। তাঁদের রোগ নিরাময়ের ওষুধ যে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে!

মহাসন্ন্যাসী মন্ত্রপূত জল ঢেলে নেভালেন যজ্ঞের আগুন। সবাই অবাক হয়ে দেখল, সমস্ত অস্ত্র বর্ম অক্ষত অবস্থাতেই রয়েছে। যে যার অস্ত্র নিয়ে, যুবরাজ বীরভদ্র আর মহাসন্ন্যাসীর নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে ফিরে গেল।

আগামী বেশ কয়েকমাস আনন্দপুর রাজ্যে খুশির বন্যা বয়ে গেল। কুমার বীরভদ্র সৈন্যদল নিয়ে সমস্ত শত্রুরাজ্যগুলো, যারা আনন্দপুর দখলের মতলব ভেঁজেছিল, তাদের এক এক করে হারিয়ে দিল যুদ্ধে। রাজামশাই আর রাণীমা আবার একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন।

কিন্তু যত দিন গড়াতে লাগল সবাই একটু একটু করে নিরাশ হতে লাগলেন। কারণ রাজকুমার বীরভদ্র অসীম ক্ষমতার অধিকারী হলে কী হবে, রাজ্যশাসনে তাঁর দক্ষতা মোটেও নেই। সব সমস্যার সমাধান তিনি তরবারির আঘাতে করার চেষ্টা করেন।

রাজামশাই বোঝাতে গেলেই তিনি বলেন —"এই দুনিয়ায় জোর যার মুলুক তার। কাজেই তরোয়ালের ধারের সামনে সব সমস্যাই দু'টুকরো হতে বাধ্য।"

ক্রমশঃ প্রজারাও তাঁর কাছে নালিশ জানাতে আসতে ভয় পেতে লাগল। পাছে লঘুপাপে গুরুদণ্ড হয়! রাজ্যে আবার যেন নতুন করে সমস্যার মেঘ ঘনালো। রাজামশাই আর রাণীমাও অবস্থার অবনতি দেখে ফের শরণাপন্ন হলেন মহাসন্ন্যাসীর।

তিনি তো অন্তর্যামী। তাঁর কিছুই বুঝতে বাকি নেই। তিনি ফের নিদান দিলেন —"শত্রুর হাত থেকে রাজ্যরক্ষার জন্য অবশ্যই অস্ত্রশস্ত্র, লড়াই বিক্রম প্রয়োজন। কিন্তু রাজ্য পরিচালনার জন্য রণনীতি নয়, চাই কূটনীতি। তার জন্য দরকার জ্ঞান আর বুদ্ধি। আমি আরেকটি মহাযজ্ঞ করব। এবারে তাতে আহুতি দেওয়া হবে রাজ্যের যত পুঁথি, পাণ্ডুলিপি আছে সমস্ত।"

ফের শুরু হ'ল দ্বিতীয় মহাযজ্ঞ। রাজ্যের সব মানুষ অনেক অনেক আশা নিয়ে, সমস্ত পুঁথি পাণ্ডুলিপি নিয়ে হাজির হ'ল। রাজ্যের পরিচালনা যাতে সঠিকভাবে হয় এই কামনা মনে মনে করে সবাই আহুতি দিল যজ্ঞের আগুনে। রাশি রাশি পুঁথি আহুতি দিয়ে যজ্ঞ সম্পন্ন হ'লে পরে সেই যজ্ঞকুণ্ড থেকে আবির্ভূত হলেন আরেক তরুণ যুবক। চন্দ্রের মত দীপ্তি তাঁর চোখমুখ ঘিরে। গভীর তাঁর দৃষ্টিশক্তি। মহাসন্ন্যাসী বললেন —"জ্ঞানভদ্র! আনন্দপুর রাজ্যের ছোটো রাজকুমার।"

জ্ঞানভদ্রকে দেখে তো সারা রাজ্যের প্রাণ জুড়োলো। সবার মনে আশার সঞ্চার হল যে এবার দুই ভাই মিলে রাজপাট সঠিক দিশায় চালাবেন। জ্ঞানভদ্র তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটাবেন আর বীরভদ্র তাঁর বাহুবল দিয়ে রাজ্যকে আগলে রাখবেন।

তারপর, দুই ভাই মিলে রাজ্যশাসন করতে শুরু করলেন। প্রজাদের সব সমস্যা নিপুণভাবে মেটান জ্ঞানভদ্র। অন্য রাজাদের সাথে বিভিন্ন কূটনৈতিক আলোচনাও বুদ্ধিমত্তার সাথে সম্পাদন করেন। আর যখন প্রয়োজন পড়ে শক্ত হাতে দুষ্টের দমনের, রাজ্যকে সুরক্ষা প্রদানের, তখন হাল ধরেন বীরভদ্র।

রাজামশাই, রাণীমা, মন্ত্রীমশাই, সেনাপতিমশাই, রাজগুরু সকলেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

কিন্তু সে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হ'লনা মোটেও। ধীরে ধীরে সারা রাজ্য যেন কেমন যন্ত্রচালিত পুতুলমানব দিয়ে ভর্তি, এর’ম মনে হতে লাগল। রাজামশাই থেকে শুরু করে প্রজা অব্দি, সবার যেন দম আটকে আসতে লাগল এই নিয়মে ঘেরা জীবনযাত্রাতে।

তার ওপর আবার প্রজাদের মানসিক বিকাশের জন্য জ্ঞানভদ্র ঘোষণা করেছেন সক্কলকে পাঠশালে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করতে হবে। ইয়া মোটা মোটা সব পুঁথি পড়তে হবে। কচি কাঁচা বুড়ো বুড়ি কারোর ছুটি নেই। রাজ্য জুড়ে গোটা পঞ্চাশেক নতুন পাঠশালা খোলা হয়েছে।

পিছিয়ে নেই বীরভদ্রও। পড়াশোনার সাথে সাথে শরীরচর্চা, অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষাও নিয়ম করে করতে হবে সবাইকে। প্রতিটা পাঠশালার সাথে সাথে যুক্ত হল একটা করে ব্যায়ামাগারও। সেখানে সকাল বিকেল চলে শুধু মুগুরভাঁজা, কুস্তি, তির-ধনুকে লক্ষ্যভেদ আর অসিচালনা শিক্ষা। প্রজারা সবাই তো হাঁপিয়ে উঠতে লাগল এত অনুশাসনের ঠ্যালায়। সকাল বিকেল শুধু বিদ্যাশিক্ষা, নয়তো শরীরচর্চা।

রাজ্যে আর কোনো উৎসব অনুষ্ঠান, পালা পার্বণ মোটেও হয় না।

জ্ঞানভদ্র বলে এসব অর্থের অপচয়, সময়ের অপচয়। বীরভদ্র বলে এইসব উৎসবে মেতে থাকলে, সেই সুযোগে বদমাইশ শত্রু রাজারা আনন্দপুর আক্রমণ করার সাহস পেয়ে যাবে।

কতদিন হ'ল কোনো বাড়ির ভেতর থেকে গুনগুন গানের আওয়াজ, রুমঝুম নূপুরের ধ্বনি ভেসে আসে না। আনন্দপুররাজ্য থেকে ‘আনন্দ’-টাই হারিয়ে গেছে যেন। রাজামশাইও রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরে রাণীমার সম্মুখে বসে দুঃখ করেন —"রাজ্য সুরক্ষিত, সুশাসনে চারিদিকে শান্তি বিরাজ করছে। রাণী, তাও কেন মন এত ফাঁকা লাগে বলো তো! অসুখ সেরে গেল কিন্তু মনে কেন সুখ নেই!"

—"রাজামশাই, চারিদিকে বড্ড নিয়মের বেড়াজাল। আগেরমত সেই হই-হুল্লোড় যে আর নেই। কিছু একটা করতে হবে। এরকম প্রাণহীন রাজ্য হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে আমাদের আনন্দপুরকে।"

আবার মন্ত্রীমশাইদের নিয়ে মহাসন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হলেন সকলে। মহাসন্ন্যাসী গভীরভাবে সমস্ত শুনলেন। বীরভদ্র, জ্ঞানভদ্রের শাসনপ্রণালী, প্রজাদের মনের অবস্থা সবই বিচার করলেন। তারপর বললেন —"শেষবারের মত আমি মহাযজ্ঞ করব। এবার আর শুধু রাজ্যের প্রয়োজনের কথা ভেবে যজ্ঞ করব না। এবার জগতের সবার প্রয়োজনের কথা ভেবে হবে যজ্ঞ।"

—"সন্ন্যাসীঠাকুর, যজ্ঞে তাহলে কী আহুতি দেওয়া হবে?" শুধোলেন রাজগুরু।

স্মিত হেসে সন্ন্যাসী বললেন —"এবার আর কোনো বস্তু আহুতি দেওয়া হবে না। সবাই একমনে শুধু প্রার্থনা করো। কল্পনা করো সব আনন্দের মুহূর্তগুলির। যা-কিছু হাসি, যা-কিছু খুশি দু'চোখ মেলে দেখো, সেগুলোর কথা ভাবতে থাকো একমনে। পাখির গান, ফুলের সুবাস, পাকাফলের মিষ্টতা, রামধনুর রঙ, এইসব দিয়ে গড়ে তুলব আমরা সবাই মিলে আমাদের আদরের সেই ধন।"

নির্দিষ্ট দিনে যজ্ঞ শুরু হ'ল। শুধু আনন্দপুরের মানুষরাই নয়, আশেপাশের সমস্ত রাজ্যের লোক দলে দলে এসে উপস্থিত হ'ল সেই অভূতপূর্ব অসাধারণ মহাযজ্ঞে। শুধু মানুষই নয়, বনের পশুপাখিরাও এসে যোগ দিল। মহাসন্ন্যাসীর মন্ত্রোচ্চারণের সাথে সাথে সবাই কল্পনা করতে লাগল যা কিছু পবিত্র, যা কিছু অমলিন, যা কিছু আনন্দময়, সেইসবের। সবার মনের রঙিন ভাবনাগুলো, রামধনুর আলোকরশ্মির মত রূপ নিয়ে, তাদের হৃদয় থেকে নির্গত হয়ে এসে পড়তে লাগল যজ্ঞকুণ্ডের ভেতর। সন্ন্যাসীর মন্ত্রের প্রভাবে। সে এক অপরূপ দৃশ্য। শত শত রামধনু এসে ঝর্নাধারার মত পড়ছে যজ্ঞকুণ্ডে। পাখিদের কূজনে মুখরিত চারপাশ। ফুলের সুগন্ধে সুবাসিত চতুর্দিক। এক মোহময় পরিবেশ।

ধীরে ধীরে যজ্ঞকুণ্ডের ভেতর থেকে উঠে এল এক কিশোরী। না, না, পরমাসুন্দরী, কোনো দেবীর মত সে নয়। সে যে ভারী মিষ্টি মেয়ে। রাজার বাড়ির মেয়েদের মত নয় মোটেই। আর পাঁচটা রাজকন্যের মত তার গায়ে নেই সোনার আভরণ, নেই রেশমের বস্ত্র। সাধারণ সূতির কাপড় তার অঙ্গে, ফুলের মালা তার গলায়। আর পাঁচটা প্রজার ঘরের মেয়েদের মত'ই, সে মেয়ে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, মায়া-ঢালা মুখশ্রী। তাকে দেখামাত্রই ভালোবাসবে না যে, তার বুঝি পাষাণ-হৃদয়। কন্যে কথা বলে উঠল —"তোমরা, আমার বন্ধু বুঝি সবাই।"

কন্ঠে তার সুরেলা বীণার ঝংকার, গলায় তার সপ্তসুরের মূর্চ্ছনা।

সন্ন্যাসীঠাকুর বললেন —"এই হ'ল তোমাদের রাজ্যের রাজকুমারী, আনন্দকণা।"

রাজামশাইয়ের সব অসুখ এক পলকে সেরে গেল মেয়ের গলায় 'বাবা' ডাক শুনে। রাণীমা যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন, মেয়েকে পেয়ে। আর প্রজারা তো তার থেকেও খুশি। তাদের সকলেরই ঘরের মেয়ে যে আনন্দকণা। সকলের আনন্দের রাশি রাশি কণা জড়ো করেই যে জন্ম হয়েছে 'আনন্দকণা'-র। আর দুই দাদা, বীরভদ্র জ্ঞানভদ্র তো ভারি খুশি এরকম খুনসুটি করার মত বোন পেয়ে। অসিচালনা, বিদ্যাচর্চা সব ফেলে রেখে তারা আব্দার করতে লাগলেন বোনের কাছে গান শোনার। বোনও দুই দাদা পেয়ে একের পর এক গান শোনাতে থাকে তার কোকিল-কন্ঠে।

বহু বছর পর, সারা রাজ্য জুড়ে উৎসব শুরু হয়। তাতে যোগ দেয় পাশের রাজ্যগুলোর রাজা প্রজারাও। আনন্দকণার আগমনে, তার সুমধুর গান শুনে, তারাও শত্রুতা ভুলেছে। আর সে গান তো যেরকম সেরকম গান নয়। সে গান শুনলে, ফুলের কুঁড়ি প্রস্ফুটিত হয়, নদীর স্রোত থেমে থাকে, জলরাশি দুভাগ হয়ে পথ করে দেয়, আগুনের শিখা তার উষ্ণতা কমিয়ে শীতল হয়। সে গানের ভাষা বোঝে পশুপাখিরাও।

আর কোনো সমস্যা নেই, চারিদিকে অখণ্ড শান্তি। কিন্তু সে কতদিনের!! দুর্যোগের মেঘ ঘনায় আকাশের কোণে। বেশ কয়েক বছর আনন্দে মিলেমিশে কাটানোর পর দেখা যায়, প্রতিবেশী রাজ্যগুলো দু'ভাগ হয়ে গেছে। একদলের আনন্দপুরের সাথে সুসম্পর্ক, অন্যদল আনন্দপুরের এই প্রগতিতে ঈর্ষান্বিত। এই দুষ্টু রাজ্যগুলো এবার একজোট হয়ে ষড়যন্ত্র করল যে, আনন্দপুর দখল করবে। একা একা তো কারোর সাহস নেই বীরভদ্রর মোকাবিলা করার।

তারপর একদিন সত্যি সত্যিই, শত্রু রাজ্যগুলোর রাজারা একজোট হয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করল আনন্দপুর। রাতের অন্ধকারে হামলা করল গ্রামগুলোতে। নিরীহ প্রজাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে লাগল। আনন্দপুর রাজ্যকে চারদিক থেকে আক্রমণ করে ধীরে ধীরে শত্রুসৈন্যরা এগিয়ে আসতে লাগল রাজ্যের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত রাজপ্রাসাদের দিকে। তাদের মতলব, কেউ কিচ্ছু বোঝার আগেই বন্দী করবে সকলকে।

এদিকে সব রাজ্যের সাথেই সুসম্পর্ক আছে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বীরভদ্র আর জ্ঞানভদ্র রাজ্যের সুরক্ষা নিয়ে বিশেষ আর কড়াকড়ি রাখেননি। সৈনিকরা বেশিরভাগই নিয়োজিত হয়েছিল কল্যাণমূলক কাজে। নদীতে বাঁধ দেওয়া, রাস্তা বানানো, প্রজাদের কৃষিকার্যের জন্য সেচের জলের ব্যবস্থা করা, এই সব কাজে। এমতাবস্থায় রাজপুরী দখল করা তো খুবই সহজ ব্যাপার।

কিন্তু কথায় বলে না, রাখে হরি তো মারে কে? বনের সব পাখিরা এই অকস্মাৎ হামলায় জেগে গিয়ে শিগগির উড়ে চলে আসে, রাজমহলে ঠিক আনন্দকণার ঘরের জানলার বাইরে। কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙায় রাজকন্যের, তারপর জানায় সব বৃত্তান্ত। আনন্দকণা তো তাদের ভাষা বোঝে, তাই সব শুনে-টুনে এক লাফে ছোটে দাদাদের ঘরের দিকে। আর একটুও সময় নষ্ট করা যাবে না। বীরভদ্র, জ্ঞানভদ্র প্রাসাদে যে ক'জন সৈন্য আছে তাদের নিয়েই রণনীতি স্থির করে, সাজায় ব্যূহ। আদরের বোনকে বলে, মা বাবার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতে। কিন্তু আনন্দকণার মত নির্ভীক মেয়ে কি সে কথা মানার পাত্রী?!

চুপিচুপি বর্মে-অস্ত্রে নিজেকে সজ্জিত করে, ঘোড়ার পিঠে চেপে বেরিয়ে যায় প্রাসাদের বাইরে, গুপ্তদরজা দিয়ে। রাজ্যের প্রজাদের কষ্টের কথা শুনেও চুপটি করে থাকে সে কেমন করে। আনন্দকণাকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু চলতে থাকে বনের পাখিরা, পশুরা। তারা যে ওর বন্ধু হয়। রাজপ্রাসাদের সীমানা ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা আসার পর দেখতে পায় জ্বলতে থাকা গ্রামগুলো। দুঃখে রাগে চোখ ফেটে জল আসে ওর। যে মানুষের কল্পনা, ভালোবাসা দিয়ে ও গড়ে উঠেছে সেই মানুষই যে আবার এরকম নৃশংস হতে পারে এটা ভাবতেও ওর কষ্ট হয়।

বেদনা-মেশা সুর উজিয়ে আসে আনন্দকণার কন্ঠ দিয়ে। সুর ভেসে যায় দূরের গ্রামে। জ্বলন্ত অগ্নিশিখা প্রশমিত হয়, উত্তাপ কমে শীতল হয়ে আসে ধীরে ধীরে।

এদিকে শত্রুসৈন্যরা গানের সুর লক্ষ্য করে এগিয়ে আসে আনন্দকণার দিকে, তাকে বন্দী করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সামনে এসে থমকে যায় তারা। ভোরের আলো আঁধারিতে চেয়ে দেখে সামনে ঘোড়ার পিঠে যেন এক দেবীমূর্তি। তাকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে যত পশু পাখির দল। সে এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য। অস্ত্র ফেলে দেয় আক্রমণে উদ্যত সৈন্যরা। গলায় সুর নিয়ে এগিয়ে চলে আনন্দকণা জ্বলন্ত গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে। তার গানের সুরে নির্বাপিত হয় লেলিহান আগুনের শিখা। ধীরে ধীরে শত্রু রাজাদের শিবিরের দিকে এগিয়ে যায় আনন্দকণা। ততক্ষণে বীরভদ্র, জ্ঞানভদ্রও বোনের নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর পেয়ে দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়েছে। আগুন নিভে যাওয়ার চিহ্ন অনুসরণ করে এসে পৌঁছেছে শত্রুশিবিরে।

কিন্তু ততক্ষণে আনন্দকণাকে বন্দী করছে দুষ্টু শত্রুরাজারা। অবাক কাণ্ড সে নিজেও কোনও বাধা দেয়নি, বা তার অনুগামী পশুদের, সৈন্যদের, গ্রামবাসীদের কাউকেই ওর হয়ে বাধা দিতে দেয়নি। তার সুরেলা কন্ঠে গেয়ে ওঠেনি গান যা গলিয়ে দেবে পাষাণকেও। বীরভদ্র আর জ্ঞানভদ্র উদ্যত তরবারি হাতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন, বোনকে উদ্ধার করার জন্য।কিন্তু আনন্দকণা বলে ওঠে,
—"না দাদা, তোমরা যুদ্ধ কোরো না। এই আক্রমণকারী রাজাদের ধারণা, আনন্দপুর আর তার বন্ধু রাজ্যগুলির সুখ-সমৃদ্ধি আমার কারণে, তোমাদের দুজনের কারণে। আমরা ধ্বংস হলে তবেই ওঁদের উত্থান সম্ভব।
“আমি গান গেয়ে, বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে নিজেদের বাঁচাতে পারি। কিন্তু তাতে সাময়িকভাবে শান্তি আসবে। কিন্তু ফের যখন ঈর্ষা নামক সর্প দংশন করবে ওঁদের মনে, তখন আবার হবে যুদ্ধ, ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি। আমি তা চাই না।"

একটু দম নিয়ে ফের ব'লে আনন্দকণা —"বল, বুদ্ধি আর ভালবাসা, এই তিন দিয়ে আমরা গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম এক স্বর্গরাজ্য। আমরা তিন ভাইবোন তো এই তিনটি গুণের প্রতিরূপ মাত্র। আমাদের প্রাণ দিয়েছেন তো এই রাজ্যবাসীরাই। তাই আজ আমরা নিহত হলেও তাঁরা বেঁচে থাকবেন। ঈর্ষার পরাজয় হয়ত এভাবেই হবে।"

এক রত্তি মেয়ের এই কথাগুলো শুনে, মাথা নত হ'ল শত্রুরাজাদের। সত্যিই তো! ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে এ কী ঘোর পাপ করতে চলেছিলেন ওঁরা। এভাবে রাজ্য দখল করতে পারতেন হয়তো, কিন্তু প্রজাদের মনে স্থান পেতেন কি? অস্ত্র নামিয়ে রেখে, আনন্দকণাকে বন্ধনমুক্ত করলেন তাঁরা।

তারপর .... ?

তারপর শুধুই ভালো থাকা আর সুখে থাকা। বীরভদ্র, জ্ঞানভদ্র আর বাকি সব রাজারা একত্রিত হয়ে বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন। সেখানে 'একজন' কেউ রাজা নয়। প্রজারাও সেখানে রাজার সমান। সবার মতামত নিয়ে, সবার পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে চলল নতুন এই দেশ। সমস্যা কি হয় না? নিশ্চয়ই হয়। সবাই মিলেই তার সমাধান করে। কেউ নিয়েছেন সুরক্ষার ভার, কেউ শিক্ষার, কেউ বা বাণিজ্যের আবার কেউ বা কৃষির। কেউ অর্থনীতির তো কেউ কূটনীতির। এভাবেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবার একসাথে পথচলা শুরু।

আর আনন্দকণা? তার হাতে সাম্রাজ্যের সমস্ত পশু পাখি মানুষ সকলকে খুশিতে ভরে রাখার, সুরে মাতিয়ে রাখার দায়িত্ব। বিরাট দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ছুটে বেড়ায় আনন্দকণা, আনন্দ বিতরণের নেশায়।



(পরবাস-৭১, ৩০ জুন ২০১৮)