Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে
বন্দনা মিত্র-র

লেখা


ISSN 1563-8685




কমলঝিল

পুকুরটার বয়স, তা হবে দেড়শ দুশো বছর। কলকাতা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হেড কোয়ার্টার, চারপাশের জলা জমি বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন শহর, তৎকালীন গভর্নর জেনারেল রিচার্ড ওয়েলেসলির নক্সা ধরে ধরে গঙ্গার পার ঘেঁষে আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুকুটমণি, প্রাচ্যের রত্ন, কলকাতা নগরী। পুরোনো মারাঠা ডিচ বুজিয়ে তৈরী হয়েছে আজকের সার্কুলার রোড – সেই লক্ষণরেখা পেরোলেই ঘন জঙ্গল। পার্কস্ট্রীটে তখন সাহেব-সুবোরা দল বেঁধে হরিণ শিকার করতে যেত প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পের ডিয়ার পার্কে, যে কারণে পরবর্তী কালে অঞ্চলটির নাম হয় পার্কস্ট্রীট। গঙ্গা বইত স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে, কাল ক্রমে নদীর ধারা সরে যায় আরো পশ্চিমে। কলকাতার ছিল দুটি ভাগ, সাহেব পাড়া মানে আজকের চৌরঙ্গী ও ডালহৌসী স্কোয়ার এবং নেটিভ পাড়া মানে বাগবাজার, শোভাবাজার, আহিরিটোলা অঞ্চল। ১৭৯৩ সালে নবাবদের হাত থেকে বাংলা শাসনের ভার পুরোপুরি কেড়ে নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। ব্যবসা বাণিজ্য সামলে-সুমলে তার সঙ্গে আবার দেশ চালাতে সমানে হোঁচট খেতে হচ্ছিল তাদের। অনভিজ্ঞ সাহেবরা বুঝতে পারে নেটিভদের শাসন করতে গেলে লেখাপড়া জানা নেটিভ লাগবে, লাগবে প্রচুর অর্থ। এই দুই চাহিদা মেটাতে তখন বাংলায় এল এক নতুন শ্রেণী, বাবু। যাঁরা আগে পুরুষানুক্রমে গ্রামে জমিদারী করে এসেছিলেন, তাঁরাই তখন রাজা, রায়বাহাদুর, এই সব তকমা লাগিয়ে কলকাতায় সাহেব-সুবোর সঙ্গে ওঠাবসা করতে লাগলেন। জাঁকিয়ে বসল বাবু কালচার। এক পুরুষ টাকা কামাচ্ছেন ও পরের পুরুষ টাকা পয়সা ওড়ানোর নিত্য নতুন পথ খুঁজে নিচ্ছেন। নব্য বাবুরা কলকাতার উপকন্ঠে খুঁজতে যেতেন নিজ নিজ বিলাস ক্ষেত্র। জমির তখন জলের দর - অট্টালিকার মত বাগানবাড়ি, অরণ্যের মত বাগান আর দিঘির মত পুকুর – নয়তো আর মাইফেল জমবে কেন! এমনই এক বাবু ছিলেন অনাদিশংকর রায়, বর্ধমানের জমিদার - কলকাতা আসতেন মাঝে মাঝে, সাহেবদের ভেট দিতে। ইয়ার দোস্ত, মোসাহেবরা আর্জি জানালো, “হুজুর, কলকাতায় একটা বাগানবাড়ি না থাকলে আর সেই বাড়িতে কমলবালার নাচ না বসালে আর তো মান থাকে না। সেদিনের ছোঁড়া উমাপতি অবধি একটা রাজা খেতাব জুটিয়ে তিন মহলা হাঁকিয়ে ফেলল, রোজ জুড়িগাড়ি চেপে বিজলীবালার গান শুনে আসে, আমরা তো মুখ দেখাতে পারছি না।” “কি, এতবড় কথা?” হুংকার দিয়ে উঠলেন অনাদিশংকর, নায়েবকে তখুনি ডেকে পাঠিয়ে হুকুম দিলেন জমি কেনার, মোসাহেব বলল দমদমার দিকে হলেই ভাল হয় হুজুর, ওখানেই সব বাবুরা এখন ডেরা বাঁধছে।” হুকুম তালিম হতে দেরি হল না, এক লপ্তে কয়েক শ বিঘে জমি কেনা হল, প্রমোদ প্রাসাদের নক্সা করা হল সাহেব আর্কিটেক্ট দিয়ে, ধবধবে পঙ্খের কাজ, ইটালিয়ান মার্বেল, বেলজিয়াম কাচ, হগ মার্কেটের নার্সারী থেকে বিলিতি পাম, দালাল লাগিয়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পুরো মাপের চামড়া – অনুষ্ঠানের ত্রুটি রইল না কোন। এক বিশাল বাগান, বাগান পেরিয়ে কাটা হল এক প্রকাণ্ড দিঘি, তার পাথরে বাঁধানো ঘাট, ঘাট পাহারা দিচ্ছে এক জোড়া নগ্নিকা অপ্সরা, দিঘির তীরে জলের ধার ঘেঁসে বিলাসবহুল বজরার আদলে তৈরি হল প্রমোদ প্রাসাদ, তার একতলা জুড়ে নাচঘর, বজরা ঘিরে দুলকি চালে ভেসে চলে রাজহাঁস, হাওয়ায় দুলে দুলে ওঠে পদ্মপাতা - অনাদিশংকরের ভাবী প্রণয়ী কমলাবালার সম্মানে দিঘির নাম রাখা হল কমলঝিল। একদিন পাঁজিপুঁথি দেখে, কলকাতার সব রাজা-রাজড়ার উপস্থিতিতে শুভ উদবোধন হল বজরাবাড়ির সেই নাচঘরের, কলকাতার সব তাবড় বাবুরা নিমন্ত্রিত হলেন, ল্যান্ডো, ব্রুহাম আর ফিটনের ভিড় লেগে গেল অনাদিশংকর রায়ের প্রমোদভবনের সামনে। কমলবালার লীলাচঞ্চল চরণবিভঙ্গে কেঁপে উঠল পার্সিয়ান গালচে, দামী শ্যাম্পেন, স্কচ, এমনকি দিশি ধেনোর (অনাদিবাবুর ধেনো না খেলে ঠিক নেশা হয় না) স্রোত বয়ে গেল। মুহুর্মুহু প্যালার স্বণর্মুদ্রার ঝনঝনিতে দুলে উঠল হাজারবাতির ঝাড়লন্ঠন, কলকাতার বাবুমহলে, বাবু অনাদিশংকরের নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদাই হয়ে গেল। সাতদিন সাতরাত দিঘির ধারে বজরাবাড়িতে অনাদিশঙ্কর কমলাবালার সঙ্গে মধুযামিনী যাপন করলেন, নাচ দেখলেন, গান শুনলেন, পানসি চলল বেলঘরিয়া; বর্ধমানের গোটা দশেক গ্রাম বাঁধা পড়ল চড়া সুদে। কমলদিঘি অবাক চোখে সাক্ষী রইল সেই মাইফেলের।

এরপর থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে আসর বসত নাচঘরে, কমলদিঘির ঘাট সাজানো হত আলোয়, মালায়, গন্ধে। একটি কচুরিপানা, একটি শুকনো ঝরাপাতাও তুলে ফেলে দিত অনুচরের দল, কমলদিঘি অহংকারে মটমট করতে করতে, হালকা হাওয়ায় ছোট ছোট ঘুর্ণি তুলে এঘাট ওঘাট কানাকানি করত। বছর কাটতে লগল, অনাদিবাবুর বাবুয়ানা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের জমিগুলো বিকিয়ে যেতে লাগল বেনামী নীলামে, আর ওনার নায়েবের ভূ-সম্পত্তি ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল। ক্রমশঃ অনাদিবাবুর সঙ্গে কমলবালার নিয়মিত ঝগড়া বিবাদের শব্দে মুখরিত হতে থাকে কমলঝিল। বাঁধা স্যাকরার কাছে প্রতিশ্রুতিমত চন্দ্রহার, রতনচূড়ের ফরমাস আর যায় না আগের মত। মালী, চাকর, দাসীদের মাইনে বাকি পড়ে, তাদের কাজে অযত্ন অবহেলার ছাপ ফুটে ওঠে। এই সময় মামলা আলোচনার নাম করে সপ্তাহান্তে নায়েবের তরুণ পুত্রের আনাগোনা শুরু হল বজরাবাড়িতে, সেই সঙ্গে কমলবালার গায়ে ঝিকঝিক করতে লাগল নতুন অলংকারের সোনালী আভা। তারপর যা হওয়ার তাই হল, একদিন অনাদিবাবু অসময়ে বাগানবাড়িতে এসে শুনতে পেলেন ঘুঙুরের আওয়াজ, দেখলেন তাঁর শখের ভৃঙ্গার থেকে দামী ফরাসী সুরা তাঁরই সুরাপাত্রে ঢেলে আদর করে নায়েবপুত্রের মুখে ঢেলে দিচ্ছে কমলবালা, তার বিলোল চরণে ছন্দ উঠছে নাচের তালে। সঙ্গে ছিল বন্দুক ও উঠতি বাবুর খানদানি মেজাজ। সে রাতে কমলঝিলের জলে তলিয়ে গেল দুটি নরনারীর দেহ, গ্রামে রটে গেল বাবুর রক্ষিতা সব গয়নাগাঁটি নিয়ে নায়েবের ছেলের সঙ্গে বেনারস পালিয়েছে। সেই প্রথম মানুষের রক্তের স্বাদ পেল কমলঝিল, খারাপ লাগল না – বেশ টক টক ঝাঁঝ ঝাঁঝ।

এরপরে যতদিন বেঁচে ছিলেন, অনাদিবাবু এদিকে বড় একটা আসেন নি, মেয়েমানুষ রাখার টাকাও আর ছিল না, একটা মালী কেয়ার-টেকার ছাড়া লোকজনও তেমন রইল না কেউ। খুন, অপহরণ, সম্পত্তিগ্রাস, বকেয়া কর ইত্যাদি অনেক ছোট বড় মামলা মকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, জলের মত খরচ হয়ে গেল যে-টুকু অর্থ তখনও তলানি পড়ে ছিল। ধীরে ধীরে বজরাবাড়ির পংখের কাজে ফাটল ধরল, পাথরের মূর্তির গায়ে ছ্যাতলা, ইতালিয়ান মার্বেল, মেহগিনির আসবাব, বেলজিয়াম কাচের আয়না চুরি হতে লাগল এদিক ওদিক। কমলঝিলের বুকে কলমীদামের আস্তরণ পড়লো, তীরে ঝুঁকে থাকা বৃদ্ধ বট অশথ মোটা মোটা ঝুরি নামিয়ে দিল কালো ঘন জলের তলায়, বন্য লতার দল ভারী শরীর নিয়ে ঝিলের নীচে সাপের মত ফণা তুলে রইল সুযোগ পেলেই ছোবল দেবে বলে।

তখন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক, বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা হয়ে গেছে, অনুশীলন সমিতির কাজ চলছে পুরোদমে। উল্লাসকর দত্তের তৈরি দেশি বোমা ছুঁড়ে ডগলাস কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে বিফল হয়ে ধরা পড়েছে ক্ষুদিরাম বোস, ফাঁসী হয়েছে তার, প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেছে নিজের রিভলভারে। বারীন দত্ত গ্রেপ্তার হয়েছে আলিপুর বোমা মামলায়, উল্লাসকর দত্তকে পাঠানো হয়েছে কালাপানি পার করে আন্দামানে সেলুলার জেলে। এই সময় কমলঝিলের জঙ্গল ছিল বাংলার বিপ্লবীদের নিরাপদ আস্তানা। তারা এখানে পুলিশের তাড়া খেয়ে আহত অবস্থায় লুকিয়ে থাকত, বোমা বাঁধত, বন্দুক তৈরি করত, অস্ত্র শস্ত্র জোগাড় করে লুকিয়ে রাখত, পুলিশকে গুমখুন করার ঘটনাও কম নেই। কমলঝিলের জলে সেই দেহগুলোর সদ্গতি হত চুপিচুপি। তখন ভালই রক্ত খেয়েছে কমলঝিল, কেমন একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষায় থাকত কবে নতুন লাশ পড়ে। এর মাঝে মালিকানা বদল হয় তার, অনাদিশংরের পরিবার জমে ওঠা ঋণ মেটাতে না পেরে কোন জমিদারকে বেচে দিয়েছিলেন সম্পত্তি। সে জমিদার সম্পত্তি দখল নিয়ে অনেক খরচপত্র করে বজরাবাড়ি সারিয়ে সুরিয়ে নাচের দু একটা আসর বসাতে না বসাতেই অনাদিবাবুর বংশধরেরা স্টে অর্ডার নিয়ে আসে কোর্ট থেকে, জাল দলিলের অভিযোগ এনে। আদালত বাগান বাড়ির সীমানা জুড়ে তারের বেড়া তুলে প্রবেশ নিষেধের নোটিশ টাঙিয়ে দেয়। ভবঘুরে আর কুখ্যাত সমাজ বিরোধীদের আখড়া হয়ে যায় ঝিলের আশপাশের জমি জায়গা। দিনেমানে দুষ্কৃতিরা খুন জখম করে লাশ পুঁতে দিত জঙ্গলের মাটিতে, ঝিলের জলেও নিয়মিত ভাসত রক্তমাখা মৃতদেহ। জায়গাটার বদনাম হয়ে যায়, সন্ধের পর কেউ এদিকে ঘেঁসত না। বজরাবাড়ি সহ কমলঝিল একা একা পোড়ো বাড়ি, মজা পুকুর হয়ে যাচ্ছিল, চারদিকে বন জঙ্গল, বলতে গেলে অরণ্য। আস্তে আস্তে ভাব হয়ে গেল আশেপাশের গাছগাছালির সঙ্গে, পাখি-পাখালির সঙ্গে। বুনো শুয়োর, শেয়াল, মহিষ, খরগোশ, বেঁজি জল খেতে আসত ভোরের বেলা, তাদের সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেল, ভেঙে পড়া বজরাবাড়িতে পায়রা, ঘুঘু বকবকম করে, চড়ুই, শালিখ, কাঠবেড়ালী বাসা বানায়, কমলঝিল সবাইকে নিয়ে বৃদ্ধ পিতামহীর মত আপন কর্তৃত্বে সংসার করে চলে। চল্লিশের দশকে এল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর তার সঙ্গে পঞ্চাশের করাল আকাল। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মন্বন্তর, ম্যান মেড ফেমিন - একদিকে প্রাচুর্যের সমারোহ অন্যদিকে পিঁপড়ের মত মানুষ মরছে না খেতে পেয়ে। সেইসময় দলে দলে ক্ষুধিত মানুষ এসে ফল, পাতা, শিকড় – যেটকু যা খাবার মত পেত, উপড়ে নিয়ে যেত। বিষাক্ত ফল পাতা খেয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও কম ছিল না। জঙ্গলে ছড়ানো থাকত তাদের মৃতদেহ, কুকুর শেয়াল ছিঁড়ে খেত, পচা গন্ধ একটা লেগে থাকত সর্বক্ষণ, গা বমি বমি লাগত কমলঝিলের। এই সময় একদিন কয়েকজন মিলে ধরে আনল একটা কমবয়েসী মেয়েকে, সেই আকালের দিনে কয়েক মুঠো চাল দিলে অনায়াসে পাওয়া যেত কুমারী কিশোরী শরীর। মেয়েটির মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে ভদ্রঘরের মেয়ে, পেটের দায়ে এসেছে। খুব রাগ হয়েছিল কমলঝিলের, অসহায় দেখেছিল মেয়েটির নিরুপায় আত্মসমপর্ণ, কটা বুনো জানোয়ার যেন তাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিল। তখনও কিন্তু দিঘি কিছু বলে নি, গণ্ডগোল বাঁধল পরে যখন নিজেদের লালসা মিটিয়ে মেয়েটার টাকা ফাঁকি দিতে গেল তারা, স্রেফ চোখ রাঙিয়ে। টাকার জন্য শরীর বেচা মেয়েটার বোধহয় এই প্রথম। কি ভাবে দরদস্তুর করতে হয়, টাকা না দিলে কিভাবে আদায় করতে হয়, কিছুই জানে না। শুধু পায়ে ধরে মিনতি করে হাপুস কেঁদে যাচ্ছে “ওগো বাবু আমার মা আর ভাইগুলো না খেয়ে আছে দুদিন, যা বলেছিলে সব তো করেছি, এবার আমার টাকা কটা দাও।“ কমলঝিল রাগে ফুঁসছিল, মেয়েটার অনেক কাকুতি মিনতিতেও যখন ওরা শুনলো না, সে নিঃশব্দে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো বটকে মৃদু এক জলের টোকা দিয়ে ইশারা করল, একটা শব্দ হল ছলাৎ, বটের ঝু্রির গায়ে জড়িয়ে থাকা কালচিতি গা ঝাড়া দিয়ে পড়ল মাটির ওপর, বনের পথে। একটু পরেই তীব্র জ্বালায় আর্তনাদ করে উঠল দলের পাণ্ডা, সকালে দেখা গেল নামকরা ধানু গুণ্ডার মৃতদেহ পড়ে আছে জঙ্গলে, সাঙ্গোপাঙ্গরা আগেই পালিয়েছে। সেই প্রথম খুন করল কমলঝিল, দারুণ উত্তেজনা জাগে শরীরে, মনে, চাঙ্গা করে দেয়, মন্দ লাগল না ব্যাপারটা, রক্তের নেশার চেয়েও জবর নেশা। তক্কে তক্কে রয়ে গেল সে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বোমার ভয়ে কাঁপতে থাকা কলকাতা প্রথম হাত বাড়িয়েছিল শহরতলীর দিকে। এরপর দাঙ্গা-বিধ্বস্ত শহর সারা গায়ে রক্ত মেখে দিশেহারা হয়ে পালাতে গেল যেদিকে আশ্রয় পাওয়া যায়, ততদিনে নিয়মিত ট্রেন চলতে শুরু করেছে এদিকের লাইনে, এ অঞ্চলে লোকের আনাগোনা বাড়তে লাগল। অবশেষে মহা সমারোহে এল স্বাধীনতা, তার সঙ্গে দেশভাগ। সীমান্তের ওপার থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষজনে ছেয়ে গেল সর্বত্র। বনজঙ্গল সাফ হচ্ছে, দু চারটে ঘরবাড়ি উঠছে। কমলদিঘির আশেপাশের জঙ্গলে হাত পড়ল। পতিত জমি জবরদখল করে তেরপল বাঁশ দিয়ে ডেরা বাঁধতে লাগল ওরা যেখানে সেখানে। অনাদিশংকরের আমলের সম্পত্তির জট তখনও কাটে নি, অনেকবার হাত ফেরতা হয়ে এখন এক মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীকে বেচে দেওয়া হয়েছে জমি জায়গাশুদ্ধ বজরাবাড়ি ও কমলঝিল, কিন্তু একা নিজের চেষ্টায় এই জবরদখলীদের হঠিয়ে জায়গা নিজের কাবুতে আনার সামর্থ্য ছিল না সেই ব্যবসায়ীর। এতদিন একলা পড়ে থাকা কমলঝিলের এই লোকজনের ভিড় বেশ ভালই লাগল। মেয়েদের হাসি, গল্প, ঝগড়া, পুরুষের নেশাজড়িত গালাগালি, শিশুর কান্না – এই প্রথম মানুষের সংসার কি তা কাছ থেকে দেখার সুযোগ হল তার। ওপার থেকে আসা ওদের দলটা নিজেরাই একটা বাঁশ দরমার মন্দির গাঁথল অশথগাছের তলায়, নারায়ণ, বালগোপাল, কালী, শিব কেউই আর বাদ গেল না – যে যা ঠাকুর দেবতা আগলে আনতে পেরেছে পূর্বপুরুষের ভিটে থেকে, সবাইকে প্রতিষ্ঠা করে দিল মন্দিরে। কমলঝিলের ঘাটের কাছটা একটু আগাছা কেটে পরিষ্কার করে নিজেদের বাসন মাজা, স্নান করা, কাপড় ধোয়া চলতে লাগল। পুরোহিত মশায় বিনা বাক্যব্যয়ে কমলঝিলের জল বিশুদ্ধ গঙ্গাজল বলে চরণামৃত, শান্তির জল, পুজোআচ্চা, গ্রহশান্তি সবেতেই চালিয়ে দিলেন। বজরাবাড়ির দেওয়ালে নোংরা হাতের ছাপ, আঁকিবুকি, মেঝের অবশিষ্ট যে কটি মার্বেল আছে তাদের কোণায় কোণায় পুরু ময়লা, ছেঁড়া পার্সিয়ান গালচের ওপর পুরোনো মাদুর গামছা পেতে পরিপাটি সুখশয্যা - এভাবেই গড়ে উঠল অস্থায়ী এক জবরদখল কলোনী, জনা কুড়ি পঁচিশ পরিবার মিলিয়ে। বেচারা সিংঘানিয়া বাবু আবার মামলা করলেন সরকারের বিরুদ্ধে নিজের জমি ফেরত পেতে, চলতে লাগল মামলা, “স্পর্শকাতর বিষয়” তকমা দিয়ে সরকার মামলাকে শামুকের পায়ে হাঁটাতে লাগলেন। অনেক সময় ও টাকার শ্রাদ্ধ করে যখন সিঙ্ঘানিয়া পরিবার জমির সত্ত্ব ফিরে পেলেন ততদিনে কলকাতা পৌঁছে গেছে ষাটের দশকে। সিংঘানিয়াবাবুর পুত্রের ইচ্ছা ছিল মামলায় ডিক্রি পেলে এক ঢালাই লোহার কারখানা বসাবেন সেই জমিতে। প্ল্যানমত কাজও এগোচ্ছিল – তখনকার পারমিটরাজে লাইসেন্স জোগাড় করা সোজা নয়, কারখানার শেড বসানো, মেশিন কেনা এসব তো তার পরের কথা। কিন্তু স্বাধীনতার বয়েস কুড়ি-বাইশ হতে না হতেই, শুরু হয়ে গেল এক ভয়ংকর উত্তাল সময়। তখন কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হচ্ছে “নকশালবাড়ি লাল সেলাম।“ “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।” হাওয়ায় উড়ছে ঝোড়ো তত্ত্ব - গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা, রাইফেলই ক্ষমতার উৎস, অধিকার কেউ দেয় না, ছিনিয়ে নিতে হয়। মাঝে মধ্যেই শহরের রাস্তায় পিঠে গুলি লাগা তরুণের লাশ পড়ে থাকে, কাগজে খবর বেরোয় পুলিশের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে সমাজবিরোধীর মৃত্যু, বাংলার জনগণনায় তালিকা থেকে এক লপ্তে নিখোঁজ হয়ে যায় চোদ্দ থেকে চব্বিশ বছরের ছেলেগুলো। চোরাগোপ্তা, সরকারী, বেসরকারী -সেই মৃত্যুর মিছিল চলাকালীন বজরাবাড়ির আশপাশের নিরিবিলি বনজঙ্গল ও কমলদিঘির পান্না জল আবারও অপর্যাপ্ত রক্তের স্বাদ পায়। প্রশাসনের অতিসক্রিয়তায় খুব তাড়াতাড়ি নকশালবাড়ির নাম রাজপথে দেয়ালের গা থেকে মুছে গিয়ে ইতিহাসের পাতায় উঠে যায় কিন্তু সেই আন্দোলনের ফলে প্রচুর অস্ত্র বাজারে চলে এসেছিল, অতএব গুলিগোলা, খুনজখম চলতেই থাকে। আইন শৃংখলার লেশমাত্র ছিল না এইসব উপান্ত অঞ্চলে। কাজেই কমলঝিলের মাটিতে কারখানা খোলা নেহাতই সুখস্বপ্নে পরিণত হল। অনেক জলঘোলা করে সিংঘানিয়া রণে ভঙ্গ দিলেন, খদ্দের খুঁজতে লাগলেন ঐ অপয়া জমি বেচে পাপমুক্ত হওয়ার জন্য। এর মধ্যেই এল পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধ, আবার ছিন্নমূল মানুষের ঢল, আবার মাঠে ঘাটে বাঁশ তেরপল দিয়ে ছাউনি। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ নামে মাথা তুলে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেশ জুড়ে ঘোষণা হল জরুরী অবস্থা। সিংঘানিয়ার উকিলবাবু পরামর্শ দিলেন এখন কিছুদিন বেচা কেনার মধ্যে না যেতে, বলা যায় না, যদি গত কুড়ি বছরের সব দলিল আর ট্যাক্স রিটার্ন চেয়ে বসে, জমি তো যাবেই, বেনো জলে ঘরের জল বেরিয়ে যাবে। জরুরী অবস্থার পর সরকার বদল হতেই আগের মালিকের কোন জ্ঞাতির বংশধরেরা সিংঘানিয়া পরিবারের নামে এক মামলা ঠুকে দিল, যে জমির দলিল ঠিকমত রেজিস্ট্রি হয় নি, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অতএব আবার আদালতের লোহার তারের বেষ্টনী, আবার কাঠবেড়ালী, বেজী, সাপ, গিরগিটি, শুয়োর, মোষের আনাগোনা, বজরাবাড়িতে পাখ-পাখালির বাসা – কমলঝিল নিশ্চিন্তে কচুরিপানার তলায়, প্রাচীন রুই কাতলা মৃগেলের ঘাই খেতে খেতে, সূর্যের কড়া রোদ বাঁচিয়ে আধো অন্ধকারে মুখ ঢেকে আকাশ দেখতে লাগল।

ভেবেছিল এভাবেই চলে যাবে, বয়স হচ্ছে, আর হৈ চৈ ঝগড়া ঝামেলা ভাল লাগে না। বলতে নেই রক্তের নেশাটাও অনেক কমেছে, এখন ভাল লাগে পানকৌড়ি, মাছরাঙা, বালিহাঁস – এদের সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে, জলফড়িং, সোনা ব্যাঙ, জলঢোঁড়া, কাদায় আটকে থাকা শামুক গেঁড়ি গুগলিদের খেলা দেখতে দেখতে রোদ পোয়াতে।

বেলা গড়ায়, কলকাতা তখন হাত পা ছড়াচ্ছে উত্তর, দক্ষিণ আর পূবে – পশ্চিম আগলে রেখেছে ভাগীরথী। অবস্থা ভাল নয়, শিল্প নেই, চাকরি নেই, দু দুবার ছিন্নমূল আশ্রয়প্রার্থীর বন্যায় আর তার কোমর ভেঙে গেছে, মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। তার কপালে তকমা জুটছে দুঃস্বপ্নের নগরী, মিছিল নগরী, মুমূর্ষু নগরী। শহর জুড়ে উপচে পড়ছে লোক, অন্য সমস্ত জেলা থেকে, আশপাশের প্রদেশ থেকে জীবিকার সন্ধানে অনন্যোপায় মানুষ জড়ো হচ্ছে কলকাতায়। ফুটপাথ দখল করে, মাঠ, ঘাট দখল করে বাঁধা হচ্ছে ঝুপড়ি, বস্তি, বাঁশ টিনের আস্তানা। আর তার পাশেই লজ্জায় ম্লান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভিক্টোরিয়া যুগের স্থাপত্যের নিদর্শন কোন অপরূপ সৌধ - সাদা পাথরের বড় বড় থাম, ফ্রেঞ্চ উইনডো, আর্চ বাঁধানো দেউড়ি, টানা গাড়িবারান্দা। আদি বাসিন্দারা দুবেলা কাদা চিংড়ি চচ্চড়ি ও শাক ভাত খেতে খেতে গল্প করে কবে কার প্রপিতামহ নাতির অন্নপ্রাশনে লক্ষ্ণৌএর বাবুর্চি এনে আসল নবাবী বিরিয়ানি ভোজ দিয়েছিল। এদিকে মেরামতির অভাবে প্রাচীন অট্টালিকার দখল নেয় নিম বট অশ্বত্থ। এমত অবস্থায় জন্ম নিল এক সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লাভজনক ব্যবসা – প্রোমোটা্রি। অচেনা কিছু লোকজন, দেখলেই বোঝা যায় হাতে পয়সা আছে, পাড়ায় কানা কানি করে, বুঝে নেয় পুরোনো ঘর বাড়ির হাল হকিকত, ধরে ফেলে পরিবারের সবচেয়ে অশক্ত দুম্বাটিকে। টাকার ছালা নিয়ে পৌঁছে যায় তার কাছে, দুঃস্থ কিন্তু বনেদী ভদ্রলোক থেকে সে দালাল বনে যায় রাতারাতি। অন্য দুম্বাদের বুঝিয়েসুঝিয়ে একত্র করে। ক্রমে ক্রমে কলকাতার আদি বাসিন্দারা ছেঁড়া কাঁথাকানি গুছিয়ে, পিতৃপুরুষের ভিটে বিদেশী ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে বেচে জড়ো হয় শহরের উপকণ্ঠে, যেখানে জমির দাম এখনও নাগালের মধ্যে। কলকাতায় ভেঙে পড়ে আরেকটি অপরূপ সৌধ, আরো একটু কুশ্রী, কুৎসিত হয় আমাদের(??) বেচারা শহর। এদিকে জমির দাম হু হু করে বেড়ে চলে মফস্বলে, কিছুদিন আগেও যে-সব জায়গা অজ পাড়া-গাঁ বলে চিহ্নিত ছিল তারাই এখন সস্তা প্রসাধনী মেখে, আমূল সবুজ উপড়ে শহুরে সাজে। কমলঝিলের আশে পাশে অনেক ঝাঁ-চকচকে বহুতল বাড়ি উঠছে, স্কুল, হাসপাতাল, সিনেমা-হল তৈরি হচ্ছে, রাস্তা চওড়া হচ্ছে, সন্ধেবেলা সারি সারি বাস ট্রেন এসপ্ল্যা্নেড ও শেয়ালদা থেকে হাজার হাজার কর্মক্লান্ত মানুষ উগরে দিচ্ছে এই শহরতলীর একান্তে নতুন গড়ে ওঠা উপনগরীতে। কমলঝিলের দিকেও নজর পড়েছিল বই কি জমি-হাঙরের, কিন্তু হিসেব করে দেখা গেল জমিটা এতবেশি মামলার পাকে জড়িয়ে আছে যে তাকে ছাড়াতে যা খরচ হবে সে পড়তায় পোষাবে না। কমলঝিল শান্ত হয়ে কচুরিপানার নীচে ঘুমোয় নিশ্চিন্তে, বোঝে না চারদিকে কত পালটে যাচ্ছে সবকিছু। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় চারপাশটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে, বাতাসটা তেমন শীতল নয় আর, ধোঁয়া ডিজেলের গন্ধ আসে, আকাশে তেমন করে নক্ষত্র চমকায় না, পূর্ণিমার রাতে বুকের ওপর যখন চাঁদের ছায়া পড়ে, সে ছায়া কেমন পানসে, ফিকে। শেয়াল, বুনো শুয়োর জল খেতে আসে না বহুদিন, পানকৌড়ি, মাছরাঙার আনাগোনাও কমেছে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না সে।

দিন কেটে যায়। একবিংশ শতাব্দীতে এগিয়ে দেখা গেল নামকরা খ্যাঁদা-গুন্ডা টাকাপয়সা জমিয়ে, এক এমএলএ দাদার সঙ্গে ফিফটি-ফিফটি শেয়ারে প্রোমোটারির ব্যবসা খুলেছে। লোকে তাকে ডাকতে লাগল খ্যাঁদাবাবু। এমএলএ দাদার গিন্নির নামে বিজনেস, নিজের নামে করলে আইন আটকাবে। পার্টনারের লাল টুপি লাগানো গাড়ি চেপে কলকাতার উপকণ্ঠে ঘুরতে ঘুরতে খ্যাঁদার সন্ধানী চোখে পড়ল বজরাবাড়ি আর কমলঝিল। বেশ কয়েকশ বিঘা জমি নিয়ে গা এলিয়ে পড়ে আছে, আজকের দিনে কিছু না-হোক কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি, মালিকানা কার কে জানে। আর মালিকানা নিয়েই যদি মাথা ঘামাতে হয় তবে এমএলএ দাদার সঙ্গে বিজনেসে নামা কেন! অতএব ময়দানে নেমে পড়ল খ্যাঁদা, খুঁজে পেতে বার করল জমির হাল হকিকত। বহু সরিকিতে ভাগ হয়ে গেছে সম্পত্তি, যারা এখন মালিক তারাও ঘাড় থেকে নামাতে পারলে বাঁচে এই শ্বেতহস্তীকে। সামান্য কলকাঠি নাড়তেই তাদের কাছে নোটিশ গেল বহুদিন জমির ট্যাক্স দেওয়া হয় নি, এক বড় অঙ্কের মূল্য সরকারের ঘরে জমা না দিলে জমি বাজেয়াপ্ত তো হবেই, জেলও হতে পারে। মাথায় আকাশ ভাঙা অবস্থায় যখন বেনোজলে ঘরের জল বেরিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার আশঙ্কা, ঠিক তখন খ্যাঁদা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল, প্রায় বিনা মূল্যে সম্পত্তিটা কিনে নিল সে, কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসে গেল মালিকদের, এমএলএ দাদার ভোটব্যাংকে জমা পড়ল বেশ কিছু লগ্নী।

আদালতের অর্ডার নিয়ে তারের বেড়া ভেঙে মাঠে নেমে পড়ল খ্যাঁদা, কীভাবে এরিয়াটা ডেভেলপ করা যায়। একটা ভাঙাচোরা প্রাসাদ, খুঁজলে এখনও কিছু মেহগনি আসবাব, ইটালিয়ান মার্বেল, বেলজিয়াম কাচ পাওয়া যাবে, তার লাগোয়া একটা মজা পুকুর, যেটা বুজিয়ে অন্তত একশ ফ্ল্যাটের হাউসিং তোলা যাবে। আশেপাশের জঙ্গল সাফ করে আরো এমন গোটা চারেক হাই রাইজ – ব্যাস, একেবারে খুল যা সিম সিম। পরের সপ্তাহ থেকেই কাজে হাত দিতে হবে। দলের ছেলেদের সেই ভাবে তৈরি থাকতে বলল ও। দু চার দিন ঘোরাঘুরির পর খ্যাঁদার দলবল এসে নালিশ জানালো দাদার কাছে, মজা পুকুরের ধারে জঙ্গলে কয়েক ঘর ছিন্নমূল বাসা বেঁধেছে সেই দেশ ভাগের সময় থেকে, উঠতে বললেও উঠছে না। কি করা যায়? আর পুকুরের ধারে কি একটা মন্দির বানিয়ে রেখেছে, রাজ্যের দেবদেবী – ভাঙতে গেলে কেস হতে পারে। মন্দিরের পাশে বিশাল এক বটগাছ, হাজারটা ঝুরি – সেও নাকি কোন দেবতা, কাটতে গেলে ঝামেলা বাঁধবে। পুকুর বোজাতে দেবে বলেও মনে হয় না, পাড়ার লোকেরা ঐ পুকুরটা দেবস্থান বলে মানে। ভাঙাচোরা বাড়িটার বারান্দা সিঁড়িতে রাজ্যের ভিখিরি সংসার পেতেছে, কীভাবে কাজ এগোবে? খ্যাঁদা ফোন করল এমএলএ দাদাকে, এক তুড়িতে এসব ভুজুং উড়িয়ে দেবে। দাদা কিন্তু সতর্ক হয়ে বললেন, দেখো ভাই, ছ মাস পর পঞ্চায়েত ইলেকশন, রিস্ক নিতে যেও না, পাবলিক খেপে গেলে আমার সীট চলে যাবে। যা করবে ভেবেচিন্তে ধীরে সুস্থে কোরো। তার ওপর এখন পরিবেশ নিয়ে খুব মাতামাতি, পুকুর বুজিয়ে হাউসিং বানাতে গেলে কাগজে টিভিতে হেড-লাইন হয়ে যাবে। খুব সাবধান। হতাশ হয়ে খ্যাঁদা বুঝল, আবার বেশ কিছু খসবে। কি আর করা, যে পুজোর যে মন্ত্র। দলের ছেলেরা দরদস্তুর করতে লাগল পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে, খ্যাঁদা নির্দেশ দিল আগামী কালীপুজোয় আশপাশের পঁচিশ কিলোমিটার দূরত্বে যত প্যান্ডেল আছে সবাইকে ঢালাও চাঁদা দেওয়ার ও তার সঙ্গে নির্দেশ গেল সবাই যেন কমলঝিলের জলে প্রতিমা বিসর্জন দেয়। কিছুদূরে খ্যাঁদার আরেকটা বড় কন্সট্রাকশন চলছিল, সেখানে নির্দেশ গেল যাবতীয় ইঁট, সিমেন্ট, জঞ্জাল, ঘেঁষ যেন রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি কমলঝিলে ফেলা হয়। আর জঙ্গল পরিষ্কার করার ফাঁকে নিয়মিত পাওয়ার হ্যাকশ-র কোপ মারা হয় ঐ ঝুপসি বটগাছের আগায়, ঝুরির ঘাড়ে – শিকড় যতটা আলগা করা যায়। বজরাবাড়ি ভাঙা হবে একেবারে শেষে, দিনে দিনে কাজ সারতে হবে, যখন কেউ থাকবে না। নেতার গ্রীন সিগনাল পেয়ে এবার দলবল নেমে পড়ল কাজে, চারপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে জলাজায়গা বোজাতে। বজরাবাড়ির লম্বা পাথরের স্তম্ভ, পঙ্খের কারুকাজ, ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে, হাতভাঙা শ্বেতপাথরের অপ্সরা, কড়িকাঠে ঝুলে থাকা বাদুড়, চামচিকে শিউরে উঠল জেনারেটরের গর গর আওয়াজে। রোজ নিয়ম করে একগাদা রাবিশ ফেলা হতে লাগল কমলঝিলের জলে। কচুরিপানা শ্যাওলার স্তর ভেদ করে অনেকদিন পর তীব্র সূর্যের আলো চোখে এসে পড়ল কমলঝিলের, আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল সে। এত শব্দ কিসের? হচ্ছেটা কি? চারদিকে গাছ কাটার শব্দ, ইঁট সিমেন্ট লোহা গুঁড়িয়ে ফেলার শব্দ, বজরাবাড়ির মরণ আর্তনাদ – কমলঝিল কেমন হকচকিয়ে গেল। দিন সাতেকের মধ্যে যে কয়েকজন বাসিন্দা ছিল, তল্পিতল্পা নিয়ে সরে যেতে লাগল আরো উপান্তে, মনের মত ক্ষতিপূরণ ও সামান্য পেশী সঞ্চালনের ফলস্বরূপ। চারপাশটা কেমন হালকা হয়ে যাচ্ছে, কাঠবেড়ালী, খরগোশ বেজী ফিসফাস করে না আর, রোজ ইঁট চুন সুরকি পড়ে পড়ে হাত পা মেলার জায়গাও যেন সংকীর্ণ হচ্ছে ক্রমাগত, কমলঝিলের হাঁফ ধরে আসে, চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, হাতে পায়ে খিল ধরে। খুব রাগ হলেও রাগটা কার ওপর করবে ঠিক বুঝতে পারে না। আচ্ছন্ন অসার শরীরে পাঁচসেরি রুইএর ঠোক্কর খেতে খেতে একটা কথাই মাথায় ঘোরে, কোনো একটা কিছু অঘটন ঘটছে, রুখতে হবে, না হলে নিশ্চিত মৃত্যু। জীবনে এই প্রথম ভয় পেল দুশো বছরের কমলঝিল, দিশেহারা লাগল নিজেকে। অতিকষ্টে মাথা তুলে, জলে ডুবে থাকা প্রাচীন বটের ঝুরি ধরে নাড়া দেয়, জানতে চায় কি হচ্ছে ওপরে, বজরাবাড়ির ঘাটের ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়িতে দুর্বল জলের ঘা দিতে দিতে জানতে চায় এত কোলাহল কেন, কি হচ্ছে নাচঘরের ভাঙা দেয়ালের আড়ালে? বজরাবাড়ির জীর্ণ কলেবর আতঙ্কে কেঁপে ওঠে, রাতে শুতে আসা মানুষগুলো এক এক করে উধাও হয়ে যাচ্ছে, কারা এসে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যে কটা ভাঙা শ্বেতপাথরের মূর্তি ছিল, ভাঙা পালঙ্কের কারুকাজ করা কাঠের পুতুলগুলো অবধি বাদ যাচ্ছে না। প্রাচীন বট বুঝতে পারে রোজ নিয়ম করে তার চারদিকে মাটি খুঁড়ে শিকড় আলগা করা হচ্ছে, চুপিচুপি, শাখা থেকে লুটিয়ে পড়া গর্ভজাত সন্তানের মত যে ঝুরিগুলো তাকে আগলে রাখত, তাদের একে একে কেটে ফেলা হচ্ছে। তিন জনে ফিসফিস অনেক পরামর্শ হয়, বন্ধুস্বজনদের পাঠানো হয় এদিক ওদিক খবর নিতে। বটের ডালে বাসা-বাঁধা কাক, চিল, ফিঙে, কোটরে থাকা লক্ষীপেঁচা, গোখরো সাপ, মাথায় বসে বিশ্রাম করা শকুন, শিকরে বাজ জানিয়ে গেছে কেন রোজ ঘেঁষ ফেলা হচ্ছে কমলঝিলের জলে, কেনই বা বজরাবাড়ির ভবঘুরেরা এক এক করে সরে পড়ছে, নাছোড়বান্দা

হাঘরেদের রাতে কারা এসে তাদের শাসিয়ে যায়। জল খেতে আসা মাছরাঙা, ডাহুকের দল বলে গেছে আগামী কালীপুজোই শেষ পুজো বজরা বাড়ি, কমলঝিল আর প্রাচীন বটের। যত শোনে, যেমন আতঙ্ক হয়, দুঃশ্চিন্তা হয়, তেমনই হয় রাগ, অন্ধ রাগে জড়তাটা কেটে যায়, কমলঝিল ভাবতে বসে – কি করা যায়! সেদিন বজরাবাড়ির হাতায় থাকা শেষ পরিবারটি দরমা ঘেরা টালির ঘরটা ভেঙে দিয়ে একটা ভ্যান রিক্সায় সংসারের খুদকুঁড়ো ছেঁড়া মাদুরে বেঁধে ছেঁদে প্রাচীনবটের তলায় বাঁশ দরমার মন্দিরে এসে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো। ছোট্ট ছেলের হাতধরা পুরুষটির চোখে রাগ, পুঁচকে মেয়ে কোলে নেওয়া বউটির চোখে জল। প্রণাম শেষ হলে ভাঙা ঘাটে নেমে কমলঝিলের জল তুলে মাথায় ঠেকালো, বাচ্ছাদের মাথায় ছিটিয়ে দিল শান্তির জল বলে। তারপর এতদিনের ঘরকরনা পিছনে ফেলে রেখে চলে গেল নতুন সংসার পাততে।

অসম্ভব রাগে এক ঝাঁকি মেরে উঠে দাঁড়ালো কমলঝিল, তার নিজের হাতে পাতা সংসার, যা কিনা বৃদ্ধা পিতামহীর মত একটু আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখত, প্রাণের চেয়ে ভালবাসত প্রতিটি সদস্যকে, সেই সংসার একেবারে চুরমার হয়ে গেল! মানুষদের সব চাই! এই একটুখানি বন জঙ্গল, কয়েকটা বুনোশুয়োর, খরগোশ, কাঠবেড়ালী, সাপ, বেজী, এক ঝাঁক মাছরাঙা, টিয়া, খঞ্জনা, ডাহুক, একটা ভাঙাচোরা বাড়ি, একটা মজা পুকুর – এটুকু ছেড়ে দিলে কি এমন তাদের ক্ষতি হত ! কতটাই বা জায়গা জুড়েছিল তারা? দুনিয়াটা কি মানুষের একার! আমাদের কোন ভাগ নেই?

আজ কালীপুজোর ভাসান। চারদিকে বোমাবাজি ফাটার প্রচণ্ড আওয়াজ। তুবড়ি, হাউই, চরকি রংমশালের চোখ ঝলসানো আলো। ব্যন্ডপার্টি নিয়ে, তাসা বাজিয়ে, কান ফাটানো আওয়াজে প্রতিমাদের বিসর্জন যাত্রা শুরু হয়েছে। পাড়ার সবচেয়ে ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিমা নিয়ে মিছিল করে আসছে খ্যাঁদা নিজে, প্রথম বিসর্জন কমলঝিলের বুকে সে নিজের হাতে করবে – তবে আর কেউ অবাধ্য হতে সাহস পাবে না। এমনিতেই পুকুর অনেক শুকিয়ে এসেছে, এতগুলো চালচিত্র, ভৈরবী, ডাকিনী হাঁকিনী সহ কালীমূর্তি পড়লে যেটুকু জল আছে তাও শুকিয়ে যাবে। বর্ষা নেই এখন। জমিটা তৈরি করে রাখতে হবে, যাতে জানুয়ারিতে ইলেকশনের পরেই পুকুর পুরো বুজিয়ে মাটি ফেলে ভিতপুজো করে ফেলা যায়। আবাসনের নাম দেবে কমলঝিল, দুশো বছর আগের সেই কমললতার গল্প বেশ কায়দা করে আবাসনের ব্রোসারে ছাপানো হয়ে গেছে। একটা এমন রোমহর্ষক গল্পের টানে হেসেখেলে বিক্রি হয়ে যাবে অর্ধেকের বেশি ফ্ল্যাট। মিছিল পৌঁছে গেল কমলঝিলের ধারে, এতদিনে বেশ কাজ চালানো রাস্তা হয়ে গেছে একটা।

খ্যাঁদা আকণ্ঠ কারণসেবা করেছে বিসর্জন উপলক্ষে, পা টলছে, মাথাও ভাল কাজ করছে না। গলা খুলে ঘন ঘন আওয়াজ দিচ্ছে “ব্যোম কালী।” প্রতিমাকে টেম্পো থেকে নামিয়ে, পাড়ার মেয়ে-বউরা বরণ করে ধুনুচিনাচ নাচছে। দলের ছেলেরা সংগত দিচ্ছে, যদিও ধূম নেশা করে হাত পায়ের ওপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই আর। খ্যাঁদা ও আরো তিন চার সাকরেদ এবার হাত লাগালো প্রতিমা তুলতে, নীচে নেমে জলে ভাসিয়ে দিতে হবে। খ্যাঁদা কারণ রসে ভেজা ভক্তিবিহ্বল কন্ঠে জড়ানো গলায় চিৎকার করে উঠল, “বলো কালী মাঈ কি” অন্যরা সমস্বরে বলল “জয়”। কমলঝিল প্রস্তুত ছিল তার দুশো বছরের বৃদ্ধ সেনাবাহিনী নিয়ে। প্রতিমা ঘাড়ে নিয়ে ভাঙা ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে টলমল পায়ে নামতে নামতে জলে ডুবে থাকা বুড়ো বটের এক মোটা ঝু্রিতে পা আটকে গেল খ্যাঁদার, সজোরে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল শ্যাওলা ঢাকা ধাপে, কালী প্রতিমার মাটির ভারী কাঠামো উলটে পড়ল তার ওপর। সেই বিপুল ভারের ধাক্কায় খ্যাঁদার দেহটা পৌঁছে গেল একেবারে কমলঝিলের কালোজলে। দলের অন্যরাও যেহেতু আকন্ঠ তরল পানে টইটম্বুর ছিল, কেউই তেমন সাহায্য করতে পারল না, হৈ চৈ করে, ছুটোছুটি করে, অবস্থা আরো সঙীন করে তুলল।

খ্যাঁদা প্রাণপণ শক্তিতে শেষ চেষ্টা করল উঠে দাঁড়াতে, নেশাজর্জর পায়ে কোনমতে জোর এনে। কমলঝিল তৈরী ছিল, ঘন কচুরিপানা শেষনাগের মত হাজার ফণা মেলে তার পা টেনে নামিয়ে নিল জলের নীচে, রাবিশের গাদার মধ্যে। কালীপুজোর রাতে পেশাদার সাঁতারু খুঁজে পেতে পেতে, লোকজন জোগাড় করতে করতে, জাল ফেলতে ফেলতে, ভোর হয়ে গেল। সাধারণ সময়ে মজা পুকুরে কোন অঘটন ঘটে না, কিন্তু দুশো বছরের পুরোনো কমলঝিলের তলায় সাপের মত কিলবিলে কচুরিপানার ঝাড় আর ইঁট বালি সিমেন্টের জঞ্জাল সরিয়ে যখন খ্যাঁদার নাগাল ওরা পেল, ততক্ষণে লর্ড কার্জনের সমবয়সী পুরোনো মহাশোল তার চোখের মণি খুঁটে খেয়ে গেছে।

আবার কচুরিপানার নীচে মুখ ডুবিয়ে আকাশ দেখে কমলঝিল, তবে আগের মত নিশ্চিন্তে নয়। এখন ও অনেক সতর্ক, কিছুদিন অবশ্য কেউ আর বিরক্ত করবে না ওকে, অপয়া বলে নাম রটে গেছে একটা। কিন্তু মানুষ আসবে, আবার কোন লোভী, শিকারী, হিংস্র মানুষ আসবে তার সংসারের শেষ সবুজটুকু শুষে নিতে। আসুক, কমলঝিল এবারে তার

সেনাবাহিনী নিয়ে তৈরী। আঃ কতদিন পর আবার নোনতা, ঝাঁঝ ঝাঁঝ, টক টক রক্তের স্বাদ পেল জিভে, শিরায় ছড়িয়ে গেল সেই তীব্র আনন্দ, উত্তেজনা, পরিতৃপ্তি – আরামে চোখ বোজে কমলঝিল ।



(পরবাস-৭১, ৩০ জুন ২০১৮)