Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে
হাসান জাহিদের

লেখা


ISSN 1563-8685




একটুকরো ঘেসো লন

‘আজকাল তুমি রোবোটের মতো আচরণ করছ কেন? ঘরে দু’দুটো কাজের লোক, তোমাকে তো কিছুই করতে হয় না। তুমি একটু হাসিখুশি থাকতে পারো না? একটু সেজেগুজে থাকলে কী হয়? সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে আমি ফিরে আসি, তোমার হাসিমুখ দেখি না।’

‘কই না তো, আমি ঠিক আছি।’

‘আমার মনে হয় তুমি বদলে গেছ।’

‘আমি বদলে গেছি?’ মুখে হাসি ফুটিয়ে নীলা বলল, ‘প্লিজ রাগ করোনা। কাল থেকে আমি সেজে থাকব। শরীরটা কেমন করছিল, তাই একটু অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলাম। কাল থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি মুখটা রাগী করে রেখো না; তোমাকে রোমান্টিক দেখতে আমার ভালো লাগে।’

‘ফালতু কথা রাখো। অফিসে গাধার মতো খেটে রোমান্টিক হতে আমার সাধ জাগছে না।’

নীলা জবাব দিল না। বিছানা গুছাতে লাগল। বেডরুমের হালকা আলোয় বিমর্ষ লাগছে নীলাকে। মাজনুন চেয়ে দেখে নীলাকে। বিছানা গোছাচ্ছে কিন্তু তাকে আনমনা লাগছে–মুখ মলিন। মাজনুনের মনে হচ্ছে নীলা যেন নিরাসক্ত ভঙ্গি দিয়ে তাকে উপহাস করছে। নীলা বিছানা গুছিয়ে হাই তুলল। বলল, ‘সকালে অফিস তোমার। শুয়ে পড়ো।’

...নীলা পরদিন থেকে সেজে বসে থাকতে শুরু করল। নীলার চোখে কৌতুক, এমনকি অবজ্ঞা দেখতে পায় মাজনুন। ক’দিন পর মাজনুন বলল, ‘তুমি সেজে বসে থাকলেও তোমাকে কেমন ফ্যাকাসে দেখায়।’

‘বোধহয় বয়স হয়ে গেছে, সেজন্য।’

‘স্টপ ইট, তোমার কাটা কাটা কথা শুনছি অনেকদিন ধরে। তুমি এভাবে আর কথা বলবে না আমার সাথে।’ মাজনুন উচ্চস্বরে বলল।

‘আস্তে কথা বলো, শুভ’র পরীক্ষা চলছে। আর আমি আজকাল একনাগাড়ে কথা বলতে পারিনা। হাঁপিয়ে যাই।’

‘হাঁপাও কেন, আমার বাড়িতে কি খাবারদাবার নেই? বেশি করে খাও। নাকি বাপের বাড়ি যেতে চাচ্ছ, সেকথা মুখ ফুটে বললেই পারো।’

‘শুভ’র পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাব না আমি।’

‘পরীক্ষা শেষ হলে যেয়ো। ভালো কথা, আজকাল দেখছি তুমি কোথাও যাও না। দু’জন ড্রাইভার রেখে লাভ কী? তোমার গাড়িটা গ্যারেজে থেকে বসে যাচ্ছে। ড্রাইভারকে এত বেতন দিয়ে রাখলাম কেন? বসে বসে খাওয়ানোর জন্য?’

‘ড্রাইভার তো শুভ’র ডিউটি করে। বসে বসে খাবে কেন?’

মাজনুন স্ত্রীর দিকে ঠান্ডা চোখে তাকায়। কিন্তু কিছু বলল না। চিন্তিত দেখায় তাকে।

মন বিদ্রোহ হয়ে ওঠে, সেইসাথে একটা দানা বাঁধে মাজনুনের মনে। নীলা কি কিছু জেনে গেল নাকি? কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। নীলার কোনোভাবেই জানার কথা নয় এমন একটা গোপন বিষয়। তাহলে নীলা কি তার অফিস থেকে দেরি করে ফেরাটা ভালো চোখে দেখছে না?

গত কিছুদিন অফিসে অনেক ব্যস্ততা গেছে। এই ক’দিন নীলা বা বিবিন–কারুরই খোঁজ রাখা সম্ভব হয়নি। বিবিন ফোনে ওকে না পেয়ে অফিসে হাজির হয়েছিল। আর নীলা ফোন কম করে। নীলা কোনো গুরুতর কিছু ঘটে গেলেও ফোন করে না। মাজনুন বাসায় ফিরলে বলে। মাজনুন বুঝে উঠতে পারে না নীলার এটা ভালো, না খারাপ দিক। এক অর্থে হয়তো ভালো। অফিসে কাজের চাপে অনেক স্বামীই স্ত্রীর ফোনে বিরক্ত হয়। অফিসের কোনো ব্যস্ততা বা অবসর কিংবা সিরিয়াস বা কৌতুককর দিক তারা শেয়ার করতে চায় না। তবে একটা কাজ তারা করে, নিজেদের কোনো বীরত্বগাথা না থাকলেও বাড়িতে ফিরে তারা স্ত্রীর কাছে স্ব স্ব বীরত্বের ফিরিস্তি তুলে ধরে। মাজনুনের এই অভ্যাস অবশ্য নেই।

বিবিন অন্যরকম। যখন তখন ফোন করে, হেড অফিসে চলে আসে। বিবিনের স্থানে অন্য কোনো মেয়ে হলে চাকরি চলে যেত। আর মাজনুনই চাকরিচ্যুত করত তাকে। এই জায়গাটায় মাজনুনের একটু বিবেক দংশন আছে। এত স্বেচ্ছাচারিতার পরও বিবিনের চাকরি সে খাচ্ছে না। অথচ ক’দিন আগে গাজীপুরের গার্মেন্টসে সামান্য অজুহাতে এক মেয়েকে সে বরখাস্ত করেছে।

অফিসের পেন্ডিং কাজ সেরে, মিটিংয়ে হাজিরা দিয়ে মাজনুন কিছুটা অবসরের স্বাদ গ্রহণ করছে। বড়কর্তা বিদেশে গেছেন। এটা বাড়তি পাওনা। মাজনুন বিবিনকে ফোন দিয়ে তারপর বেরিয়ে পড়ে, অফিস ছুটি হওয়ার কিছু আগে ফিরে আসে আবার অফিসে।

…আজ সে বিবিনকে ডেকেছে। সে তার কামরায় চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। তার মানসপটে ভেসে উঠল সংসদ অধিবেশনের চিত্র। একদিকে নীলা, অন্যদিকে বিবিন। কে বিরোধীদল আর কে সরকারিদল–এটা সে ঠিক না করতে পারলেও নিজের আসনটা সে ঠিকই ভেবে নিতে পারল। সে স্পিকার।

নড়েচড়ে বসে সে চোখ খুলল, তার মনের পর্দায় পার্লামেন্ট ভেসে উঠল কেন!

এই অফিসে বিবিনের আনাগোনা কেউ বাঁকা চোখে দেখেনা। মাজনুনদেরই আরেকটা সিস্টার কোম্পানিতে বিবিন চাকরি করে। অনেকদিন যাবৎ বিষয়টা জানত না মাজনুন। একটা মিটিংয়ে দেখা হয়ে যায়। এরপর থেকে দু’জনের মধ্যে গোপন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটা বাইরে গিয়ে একসাথে লাঞ্চ করা থেকে বেড়ানোতে এসে গড়ায়। বিবিন শিক্ষিতা, স্মার্ট ও সুন্দরী।

…মাজনুনের অস্থি-মজ্জায় কাঁপন জাগে। অদম্য ইচ্ছা ও একটা আকুলতা গ্রাস করে তাকে। বোধহয় একই ফাঁদে পড়েছে বিবিনও। চাকরি রক্ষা, প্রোমোশন, বেতন বৃদ্ধি–ইত্যকার বিষয়াদি তার মধ্যবিত্ত মানসের রক্ষাকবচ।

অফিসের বড়কর্তা আর কেউ নন। এই গ্রুপ অভ কোম্পানিজ এর কর্ণধার মাজনুনের বাবা সামিউল আলম। পারিবারিক পরিমণ্ডলে তিনি যেমন স্নেহশীল পিতা ও অভিভাবক, তেমনি কড়া শাসক তিনি দাপ্তরিক পরিমণ্ডলে। এই বেড়াজাল টপকে ওদের চলল গোপন সাক্ষাৎ ও অভিসার। বিবিনের চালচলন ও ভঙ্গিতে আজকাল একটা অলিখিত আজ্ঞা ছলছলায়। তাতে মাজনুন খানিকটা বিচলিত হলেও তা সে প্রকাশ করেনা।

‘বাহ্ কী মজা, তোমার আমার কারুরই বড়কর্তা নেই, কী বলো?’ বিবিন মাজনুনের মুখোমুখি আসনে বসে বলল।

‘তোমার বস কিছু বলে না?’ মাজনুন বলল।

‘তোমার কথা বলে এসেছি। যখনই তোমার কথা বলি, বস দেখি খালি টয়লেটে ছোটে।’ বিবিন হাসতে লাগল। ‘ধন্যবাদ, তোমার বড়কর্তা, মানে আংকেলকে, আমাকে এমন একটা চাকরি দেবার জন্য।’

‘তুমি এসে আমার সাথে প্রেম করার জন্যও কিন্তু বাবা তোমাকে এই চাকরি দেননি।’

‘তা দেননি। কিন্তু প্রেম যখন হয়ে গেছে, সেটা তো উনি ঠেকাতে পারবেন না।’

‘প্রেমটা বুঝি কর্পোরেট কালচারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে উঠল?’

‘হয়েছে।‘ স্মিত হেসে বলল বিবিন। ‘হয়েছে, খুব হয়েছে। এবার গাত্রোত্থান করো। বাইরে যাব।’

মাজনুনের মনে ভেসে উঠল নীলার পাণ্ডুর মুখ। আনমনা হয় সে। ‘কী ভাবছ?’ বিবিন প্রশ্ন করল।

‘কিছু ভাবছি না।’

‘তাহলে চলো।’

বাইরে এসে দু’জন গাড়িতে চড়ে। বিবিন বকবক করে যাচ্ছিল। মাজনুন থেকে থেকে আনমনা হয়। সবকিছু কৃত্রিম মনে হয় তার কাছে। এই মুহূর্তে বিবিনকেও তার মনে হয় আগাগোড়া একটা কৃত্রিম টকিং বার্বিডলের মতো। সে জানে, তাকে ঘিরে অনেক প্রত্যাশা জমেছে বিবিনের মধ্যে। এর জন্য বিবিন দায়ি নয়; এটাও সে জানে। অন্যদিকে, বিবিনের মতো রূপসী-গুণবতী মেয়ের প্রেমে নিপতিত হবার জন্য নিজকেও সে পুরোপুরি দায়ি করতে পারেনা।

…জীবনে সুখের সব উপাদানের ভেতরে থেকেও মানুষ দুঃখবোধে আক্রান্ত হয়। এই মুহূর্তে বিবিন তার দুঃখের কারণ, নাকি সে-ই দুই দু’টি নারীর কাছে দুঃখবোধের একটা স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে?

মাজনুন ডুবে যায় গভীর চিন্তায়। সে ভাবতে পারেনা–বিবিনের মতো একটি রূপবতী মেয়ে অন্যের ঘরনী হবে। দেবীর মতো মেয়েটি ওকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে আজ প্রায় একটি বছর। অনেক ঘোর, অনেক আবিলতায়-শিহরনে কেটেছে একটি বছর। স্বপ্ন-জগতে বিচরণ করেছে। বিবিনকে ঘিরে তার কল্পজগৎ আরো বিস্তৃত হয়েছে। সে ভুলে গিয়েছিল নীলা নামের শান্ত এক মেয়েকে, যে একান্তে পুত্র সন্তান ও স্বামী নিয়ে আবেশে দিন কাটিয়েছে। তার কোনো উচ্চাশা নেই, স্বপ্ন নেই, নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে কোনো পদচারণা নেই। নীলা একান্তে-নিভৃতে বিচরণ করে। শুভ হওয়ার কিছুদিন পরে বলেছিল নীলা– ‘আমার সময় কেটে যায় তোমার আর শুভ’র মুখের দিকে চেয়ে। আমি অনেক সুখি। ভাবছি, এই সুখ আমার কপালে সইবে কিনা।’

নীলার হাত দু’টো টেনে ওকে পাশে বসিয়ে মাজনুন বলেছিল, ‘তুমি বড় বেশি ভালো। মাঝেমধ্যে একটু ঝগড়াও তো করতে পারো। তা করবে না। জীবনটাকে একদম বোরিং করে ফেলেছ তুমি।’

কাচভাঙা হাসিতে গড়িয়ে পড়েছিল নীলা। তারপর বলেছিল, ‘তুমি যে কতটা ভালো, তা তুমি নিজেও জানোনা ।’

‘জানি, তবে তোমার কাছে তা নস্যি।’

…দামি রেস্তরাঁয় পছন্দের খাবার খেতে খেতে বিবিন প্রশ্নটা ছুড়ে দিল, ‘আমি জানি, তোমার ভেতরে রক্তক্ষরণ চলছে। শুরু থেকেই আমি তা জানি।’

‘তোমার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই?’

‘তোমাকে চাওয়ার পর থেকে আমার ভেতরে কনফ্লিক্ট চলছে। তোমাকে চেয়ে হয়তো ভুল করেছি আমি। জানিনা, নিজের অজান্তেই কেন যেন জড়িয়ে গেলাম।’ বিবিন উদাসীন কন্ঠে বলল।

‘বিবিন, তোমার বয়স আটাশ, আমার আটত্রিশ। অসম প্রেম, হয়তো দূর থেকে পূজা করার মতো। হয়তো কোনো ঐশ্বরিক ইশারা। বিবিন, তুমি আমাকে ভুলে যাও।’

‘ভুলে যাব? আমি ভুলে গেলে কি তুমি ভুলতে পারবে?’

অসহায় চাহনি মেলে তাকায় মাজনুন। বিবিন একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলল, ‘আমার মনে হয়, নীলা আপুই তোমাকে একদিন বলবে–গো এহেড।’

‘কী বললে তুমি!’ মাজনুন বিষম খেল, তারপর সামলে নিয়ে বলল, ‘নীলা এর বিন্দুবিসর্গ জানেনা।’

‘জানে না? বোকার মতো কথা বললে, স্বামী প্রেমে পড়লে প্রত্যেক নারীই তা জানতে পারে। বিশেষ করে নীলা আপুর মতো স্বামীভক্ত নারী যদি হয়।’

মাজনুন খাবারের প্লেট ঠেলে দিল আলগোছে। তার চোয়াল ঝুলে পড়েছে। বিবিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

‘আমি জানি, তোমার মন খারাপ। তুমি বরং বাসায় গিয়ে রেস্ট করো।’ বিবিন উঠে দাঁড়ায়।

বাসায় ফিরতেই নীলা বলল, ‘তোমার কিছু একটা হয়েছে।’

‘না, না। কী হবে আমার?’ দেঁতো হাসল মাজনুন, ‘বাবু কী করে? ওর পরীক্ষা শেষ?’

‘না, আর দু’টা বাকি আছে।’

‘ঠিক আছে, পরীক্ষা শেষ হলে আমরা কক্সবাজারে ঘুরতে যাব।’

‘আমি কোথাও যাব না।’

‘কেন?’

‘এমনি। কোনো কারণ নেই।’

‘তোমার মন খারাপ?’

‘মন ভালো আছে। কিন্তু কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।’

মাজনুন চুপ করে থাকে, মাথায় ঘুরছে বিবিনের কথাগুলো। ওর কথাগুলো কাঠখোট্টা গোছের মনে হলেও ওর যুক্তির কাছে মাজনুন হেরে যায় প্রতিবারই।

***

মানসিক দ্বন্দ্বে, উৎকন্ঠায় দিনাতিপাত করে মাজনুন। বিবিন যেন ওকে জাগতিক সবকিছুর বাইরে রহস্যঘেরা কোনো অচেনালোকে নিয়ে যায়। এক অচেনা বিবরে সে প্রবেশ করছে কোনো এক মায়াবিনীর হাতছানিতে।

মাজনুনের আলুথালু বেশ, হঠাৎ চমকে ওঠা, আনমনা থাকাটা নজর এড়াল না নীলার।

‘তুমি দিনদিন এমন হয়ে যাচ্ছ কেন?’ নীলা এক ছুটির দিনে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় মাজনুনের পাশে বসতে বসতে বলল।

‘চুপ থাকো, একদম চুপ থাকো।’ মাজনুন চিৎকার করে উঠল।

নীলার হাতের চা চলকে পড়ল, সে বেতের সোফায় বসতে গিয়েও বসল না। বিস্মিত চোখে তাকাল মাজনুনের দিকে–মাজনুনের এমন রুদ্র রূপ নীলা আগে দেখেনি। দুর্বল কন্ঠে বলল, ‘আমি ভয় পাচ্ছি মজনু, তুমি এমন হয়ে গেলে কেন! তোমার কী হয়েছে?’

‘সরে যাও আমার সামনে থেকে। তোমার রোবোট-স্টাইল আমার ভালো লাগছে না। তুমি আমাকে খেপানোর জন্য ভেক ধরেছ। তুমি অনেক চালাক। আমার সাথে প্রহসন করছ তুমি।’

‘ঠিকই বলেছ তুমি, তোমার সাথে চালাকিই করে এসেছি আমি। আমার ষড়যন্ত্র তুমি ধরতে পেরেছ বলে ধন্যবাদ তোমাকে।’ বিড়বিড় করে বলল নীলা।

খ্যাপা কুকুরের মতো খেঁকিয়ে উঠল মাজনুন, ‘তুমি বিদেয় হও, তোমার সাথে ঘর-সংসার আমি আর করব না।’ মাজনুন বারান্দা ছেড়ে উঠে বেডরুমে চলে গেল।

নীলা টলটলে চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

গভীর রাতে মাজনুন কথাটা আবার বলল। মাজনুন বিছানায় শুয়ে ছিল। নীলা অগ্রসর হচ্ছিল, বিছানায় মাজনুনের সাথে শুতে।

‘আমার ফাইনাল ডিসিশন। তুমি থাকবে না আমার সাথে।’

নীলা থমকে গেল। ‘তুমি সিরিয়াসলি বলছ?’

আবার খেপল মাজনুন। ‘তুমি নিজ কানে শুনেছ, কী বলেছি। এই গভীর রাতে ফাউ কথা বলে ফান করার ইচ্ছা আমার নেই।’

‘আমাকে ক’টা দিন সময় দাও।’ নীলা শান্ত কন্ঠে বলল, ‘আমি চলে যাব।’

‘মানে!’

‘কয়েকটা দিন সময় দাও, এতদিনের গড়া সংসার ভাঙতে মনের সাথে যুদ্ধ করতে হবে আমাকে।’

মাজনুন জবাব দিল না। পাশ ফিরে শুলো।

মাজনুন পরদিন অফিস থেকে ফিরে এলে নীলা চা নিয়ে এসে বলল, ‘একটা কথা বলব।’

‘বলো।’

‘আমাকে একটা মাস সময় দাও।’

‘দিলাম।’

‘আরেকটা কথা।’

‘আবার কী কথা!’

‘বিয়ের পর তুমি আমাকে নিয়ে ভোরে লনের ঘাসে হাঁটতে, সেটা তুমি করবে। একটি মাস তুমি এই কাজ তুমি করবে। প্লিজ, না করো না। এই ছোট্ট কাজটা করলে তুমি আমার বদলে বিবিনকে পাবে।’

মাজনুনের হাত থেকে রিমোট পড়ে গেল। হাঁ হয়ে গেল সে। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ক্রিকেট খেলা দেখছিল সে টিভিতে।

‘প্লিজ।’ নীলা বলল।

‘ঠিক আছে, করব। এখন বিদায় হও তুমি।’

নীলা ঠোঁট টিপে হাসল। তারপর চলে গেল। মাজনুন ক্রিকেট দেখল না। সে বারান্দায় এসে সিগারেট ধরাল। মনের ভেতরে ঝড় খেলে যাচ্ছে। সে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করে।

…পরদিন লনে পায়চারি করতে করতে শ্লেষের স্বরে বলল মাজনুন, ‘আমরা অভিনয় করে যাচ্ছি।’

নীলা হেসে বলল, ‘অল দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ আ স্টেজ, অ্যান্ড অল দ্য ম্যান অ্যান্ড উইমেন মেয়ারলি প্লেয়ার্স।’

থমকে গেল মাজনুন। নীলাকে অচেনা মনে হয়। সে কি সত্যিই রক্তমাংসের মানুষ, না রোবোট? নাকি ভিনগ্রহের কেউ?

পরের রাতে মাজনুন বিছানায় আধশোয়া নীলাকে জিজ্ঞেস করল, ‘শুভ কার কাছে থাকবে?’

‘তোমার কাছে।’ নীলা সাথে সাথে জবাব দিল।

‘তোমার কাছে থাকবে না!’

‘না।’

‘না, কেন?’

নীলা নিরুত্তর রইল। তার দৃষ্টি ঘরের কোনো একটা দিকে স্থির নিবদ্ধ।

মাজনুন অফিসের ব্যস্ততার মাঝেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলল বিবিনের সাথে। রোখ চেপে গেল তার–অভিনয় আর ভালো লাগছে না। এর শেষ দেখবে সে।

বিবিন! ওর স্বপ্ন, ওর ধ্যান এতদিনে বুঝি চোরা হাওয়ার মতো পরশ বুলিয়ে দিল!

…ভোরে নীলার সাথে লনে পায়চারি করতে করতে সতেরো দিনের মাথায় মাজনুন একটা পরিবর্তন অনুভব করল। একটা অলৌকিক বোধ যেন তার ভেতরে বেদনার নীলাভা ছড়িয়ে দিল। নীলা হাঁপিয়ে গিয়ে ঘাসে বসে পড়ল। ওর পাশে বসে পরম মমতায় নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল মাজনুন, ‘খারাপ লাগছে?’

‘না, বরং এই ক্লান্তিটুকু উপভোগ করছি। জানো, দরিদ্র বাবা-মায়ের ঘর থেকে এই বাড়িতে প্রথম যেদিন পা দিলাম, সেদিন মনে হয়েছিল, এই একটুকরো ঘেসো ভূমি যেন আমার সব সুখের আধার। পৃথিবীতে আর কোনো সুখ খুঁজতে যাব না আমি।’

‘এটা সত্যি, নীলা। তোমার সেদিনের সুখ দেখে আমিও সুখি হয়েছিলাম।’

নীলা কিছু বলতে গেল। কিন্তু বলতে পারল না। গড়িয়ে পড়ল ঘাসে।

…মাজনুন বুঝতে পারে, বিবিনের সাথে একটি বছরের হৃদ্যতায় নীলা ক্ষয়িত করতে থাকে নিজকে। নিজের সুখ-দুঃখের কথা বলতে চায়নি; হয়তো বলার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছিল।

***

বিবিন ও মাজনুন বসে ছিল লনে এক বিকেলে। মাজনুন কথা বলতে বলতে তোতলাচ্ছিল। আজকাল তার অনবরত কথা বলার অভ্যেস হয়েছে। মাজনুনকে হঠাৎ থেমে যেতে দেখে বিবিন বলল, ‘কী হলো!’

‘না, কিছু হয়নি।’ মাজনুন জড়ানো স্বরে বলল।

‘নিয়ে আসব ভোদকা? আরো খাবে?’

‘না।’

‘ওই কথাটা বলতে চাও? ওই যে, ডাক্তার জানিয়েছিল, কেমো দেয়ার অবস্থাও ছিলনা। ফলে নীলাকে দিতে হয়েছিল লাইফ সাপোর্ট। কৃত্রিমতায় ওর হৃৎপিণ্ড সচল হয়েছিল, মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত অক্সিজেন পেয়ে কয়েকদিন সচল থেকে ফের মৃতবৎ হয়ে পড়ে। উঠিয়ে নেয়া হয় লাইফ সাপোর্ট…।’

‘না। আর বলব না, বিবিন।’

‘আর ওইটা বলবে না–ওই যে, এই একটুকরো ঘেসো লন ছিল নীলার পৃথিবীর সব সুখের আধার।’

অসহায় চোখে তাকায় মাজনুন বিবিনের দিকে। বিবিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপমাখা চোখে মাজনুনকে দেখল কয়েক মুহূর্ত। তারপর তেজী পদক্ষেপে বাড়ির ভেতর চলে গেল।

মাজনুন ঘোলাটে চোখে তাকায়। তার চোখের সামনে সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে যায়। লনের সবুজ ঘাস, গাছ, সীমানা প্রাচীর, নীলাকাশ–সবকিছু একাকার হয়ে যায়।

তার মনে হয়: সে এত মনকাড়া সব রং দিয়ে একটা সুন্দর ছবি আঁকতে চেয়েছিল। কিন্তু সব রং কেমন লেপ্টে গেল।



(একটি বিদেশী সত্যি ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)



(পরবাস-৭১, ৩০ জুন ২০১৮)