তারপর একদিন সে এলো। টলোমলো পায়ে রূপশালি ধানের মতো হাসি ছড়িয়ে এলো এই হলুদ বাড়িতে। অত্রির হাতের মুঠোয় তার সোনালী হাত। রাস্তাও যেন সোহাগে বুক পেতেছে মধুবন্তী রাগে। শাল্মলীর বৃক্ষছায়া ছুঁয়ে আসছে ওরা। ওদের পায়ে পায়ে লালমাটির আবীর। অত্রির বিজয়ী হাসির রেণু মিশছে বিকেলের রৌদ্রফুলে। ময়ূরাক্ষীর জলে তখন বিকেলের রুপো-আলো চিকচিক। আনন্দ বাতাসে ভিজছে কামিনীফুলের বাসর। অবিচল মোলায়েম রোদের স্নেহ শুয়ে আছে শালুকের শাড়িতে। রুরু ছুঁয়ে আছে শালুককে। শালুকের নাড়ি-ছেঁড়া মেয়ে।
ডিভোর্সের পরে শালুক রুরুকে রাখতে পারেনি। বিতান অ্যাডালটারির অভিযোগ এনেছিলো। একদিন রুরুকে চাইতে গিয়েছিলো শালুক। রুরু জড়িয়ে ধরলো তাকে।
শালুককে আড়চোখে দেখছিলো কর্পোরেট সংস্থার সিইও বিতান ব্যানার্জী। চোখেমুখে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ।
বল্লো, অ্যাডালটারির কেসটা হয়তো করতাম না। কিন্তু অই ভিখিরির বাচ্চাটা, তোমার সো কল্ড স্বামী কি আমাদের মেয়েকে পালতে পারতো? রুরু বাড়িতেই থাকবে। বিতানের চোয়াল শক্ত হলো।
মুম্বাইয়ে থাকাকালীন সময়ে, ফ্ল্যাটে ফিরতে রাত হতো বিতানের। সময় কাটতে চাইতোনা শালুকের। রুরু সবেমাত্র পেটে এসেছে। একদিন জুহু রোডের একটি কফি শপে ঢুকে থমকে গেলো তার চোখ। বিতান বসে। তাকে ঘেঁষে একটি মেয়ে বসা। বিতানের একটি হাত মেয়েটির কোমর জড়িয়ে। মোবাইলে কারোর সাথে ব্যস্ত। হঠাৎ শালুককে দেখে একটুকুও না চমকে বল্লো, শালুক তুমি এখানে? এসো পরিচয় করিয়ে দিই। মধুরা সি ইজ শালুক। মাই এক্স ওয়াইফ।
শালুকের পায়ের তলার মাটি সরছে। বিতান এতদূর এগিয়ে গেছে! আর থাকেনি মুম্বাইতে। কয়েকদিন বাদেই বিতান সাফাই গাইতে এসেছিলো কলকাতায়।
সম্পর্কটা ভাঙছিলো অনিবার্যভাবেই।
রুরু জন্মালো। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা। শালুকের নিরলম্ব উদাসীন উত্তর থামতো অন্ধকারেই।
একদিন হঠাৎ গড়িয়াহাটে দেখা হলো অত্রির সাথে শালুকের। শান্তিনিকেতনে ওরা একসাথেই পড়তো কলাভবনে। গভীর বন্ধুত্বও ছিলো। মাস্টার ডিগ্রীর পরে আর দেখা হয়নি।
ছ'বছর বাদে দেখা। শালুক ফ্রী হয়ে কথা বলতে পারছিলো না। ব্যথারা জমা হচ্ছিলো গলার কাছে।
অত্রি জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে তোর?
আর চেপে থাকতে পারলো না শালুক।
পরদিন অত্রির ফোন। বল্লো, শালুক তোকে এই অপমান আর বইতে দেবো না। রুরুকে নিয়ে চলে আয়।
ডিভোর্সের পর থেকে শালুক অত্রির বাড়িতে আছে। আটমাস বাদে বিতান বিয়ে করলো। একদিন ফোনটা এলো। রুরুকে কালিম্পয়ের রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে পাঠানোর কথা বলছিলো বিতান। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো শালুকের। পরদিনই ছুটলো বিতানের বাড়িতে। বিতান বল্লো, আমরা
দু'জনেই সার্ভিস করি। সাফিসিয়েন্ট টাইম নেই আমাদের। নিয়ে যাও, তোমার মেয়েকে। আর প্র্যাকটিকাল হও। মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট আল্টিমেটলি গোল অ্যাচিভ্ করতে পারেনা।
রুরু মাথা নুইয়ে ড্রয়িংরুমে আসছিলো। ঘাড় অব্দি নেমে আসা সিল্কের মতো চুলগুলো কতোদিন আঁচড়ানো হয়নি।
বিতান একটা ঢাউস সুটকেস টেনে আনছিলো। বল্লো, রুরুর সব ড্রেস। আর হ্যাঁ, আমি প্রত্যেক মাসে রুরুর জন্যে ব্যাংকে টাকা দেবো তোমার একাউন্টে।
শালুক রুরুকে কোলে তুলে নিলো। মেয়েটা পাখির মতো হাল্কা হয়ে গেছে।
বিতানকে বল্লো, এসব লাগবে না। আমার ব্যাংক একাউন্টটা উইথড্র করেছি।
বাইরে অত্রি অপেক্ষায়। ওরা বাউন্ডারি ক্রশ্ করে বাইরে এলো। কতোদিন পরে বাতাস বইলো প্রিয় হয়ে। অত্রি রুরুর কপালে স্নেহচুম্বন আঁকছে। রুরুর হাসি ছড়িয়ে পড়ছে মোহর ফুলের মতো।
শালুকের সাথে অত্রির বিয়ে হয়নি। এ'কথা বিতানকে ইচ্ছে করেই বলেনি শালুক। অত্রি শালুকের শুধুই বন্ধু। দু'জন পূর্ণবয়স্ক মানুষ কি একসাথে থাকতে পারেনা শালুক? এ কথাই অত্রি সেদিন বলেছিলো শালুককে। হঠাৎ বৃষ্টি এলো ঝমঝমিয়ে। বর্ষামেঘে ধুয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ দাম্পত্য অসুখ, অপমানের সিঁদুর। আজ বাগানে ফুটেছে শুভ্র কামিনী ফুলেরা।
(পরবাস-৭১, ৩০ জুন ২০১৮)