১
দিনের আলো ফুটিতে না ফুটিতেই পাড়ার ভিতরটা অস্বাভাবিক রকম উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। সংবাদটা চাউর হইয়া গেলো; ইতস্ততঃ বিস্ময়াবিষ্ট চাহনি, শোকচ্ছটা, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জটলা তৈরী হইয়া বেশ একটা শোরগোল পড়িয়া গেলো। পুকুর পাড়ে, উন্মুক্ত মাঠে, শ্যাওলা আচ্ছাদিত বাড়ির পিছনে ভীড় জমিয়া গেলো এক নিমেষেই। সুধন্য মিস্তিরির বৌ গলায় দড়ি দিয়াছে। দেহ খুঁজিয়া পাওয়া গিয়াছিলো সকালে বড়বিলের রাস্তায় খেজুর বাগানের ধারে, একটি নাতিউচ্চ চারা আমগাছের ডালে ফাঁস লাগাইয়া ঝুলিয়া ছিলো চল্লিশোত্তীর্ণা গৃহবধূটি ... হয়তো সংসারের প্রতি তীব্র ঘৃণায় চোখে কয়েক বিন্দু জলের শুষ্ক দাগ; ঈষৎ শ্যামবর্ণ মুখে রক্তচাপজনিত কোন ছাপ নাই, জিভটা একদিক হইতে একটু বিসদৃশ বাহির হইয়া আছে, আর ঠোঁটের কোণ দিয়া গড়াইয়া আসা গ্যাঁজলা।
সুধন্য মিস্তিরির বাড়িটি ছিল পাড়ার মধ্যস্থিত, বেশ ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায়। সম্মুখ দিয়া চলিয়া গিয়াছে বড়বিলের লালমাটির রাস্তাটি ... লাল ধূলায় আচ্ছাদিত হইয়া থাকে রাস্তার পার্শ্বস্থ গাছপালাগুলি। ক্রমে ঐদিকটায় বসতির ঘনত্ব কমিয়া শেষের দিকটাতে একেবারে ফাঁকা হইয়া গিয়াছে। সুধন্য মিস্তিরি তার পিতৃপুরুষের কাঠের ব্যবসা ধরিয়া রাখিয়াছে, সে বাজারে তার ক্ষুদ্র কাঠঘরে কাঠের কাজ করিয়া থাকে, কিন্তু ক্ষুদ্র হইলেও পসার নিতান্ত মন্দ নয়। হাতে কাজ প্রায় সবসময়ই থাকে। একমাত্র পুত্রটি কখনো কখনো সাহায্য করিয়া থাকে বটে, কিন্তু সে একটি রত্নবিশেষ। বাপ হাতে টাকা দিবামাত্র সেটি দিশীর ঠেকে ইয়ার-দোস্ত লইয়া উড়াইয়া আসাই একমাত্র লক্ষ্য তার। বাড়িতে তার বৌ আছে, এ গ্রামের মেয়ে, কাজলী; পিতা সন্তানকে তড়িঘড়ি সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ করিতে গিয়া দেশের মেয়ে, সর্বদা চোখের সম্মুখে বাড়িয়া উঠিতে দেখা কাজলীকেই পছন্দ করিয়া বৌ করিয়া আনিয়াছিলো। গৃহিণী দুই একদিন বাচ্চা মেয়েটিকে পরখ করিয়াই বুঝিয়াছিলেন, জলবৎ তরলং বৌমাটি। মুখঝামটা এ দিতে পারিবেনা আর যাহাই হোক; শাশুড়ি বৌমার চিরন্তন পরস্পরকে মাপিয়া লওয়া ... ঘর গৃহস্থালির কর্মে তত সড়গড় নয় বৌমাটি, বয়সে কাঁচা, কিন্তু সুদর্শনা ও প্রিয়ংবদা। শাশুড়ি বৌমা মেলবন্ধন ঘটিতে দেরি হয় নাই বেশি, ছেলের চোখে পড়িয়া যায় নাই হয়তো, সে চরিতে গিয়া বেশি ফুরসৎ পাইতো না বাড়ির কিছু লক্ষ্য করিবার, কিন্তু সুধন্য দেখিয়াছিলো। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যে উভয়ের বাক্যালাপের কিছু কিছু অংশ নজর এড়াইতো না সুধন্যর এবং সে খুশি হইয়া পড়িতো, সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল; কতকিছু ভুল করিয়া থাকে সারাদিন ... এই একটা ঠিক কাজ করিয়াছে সে।
মাঠপাড়ার জনাদ্দনের সহিত সুধন্যর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিলো ... শুধু প্রতিবেশী বলিয়া নয়, সারাদিনে একবার হইলেও তাহার সহিত আড্ডা সময় করিয়াই দিয়া থাকিতো সে। তাহারই সমবয়সী, মাছের আড়ৎ এ অংশীদারি আছে বাজারে, জনাদ্দনের সাক্ষাৎ বিকেলের দিকে ঘোরাঘুরি করিতে গেলেই পাওয়া যাইতো সুধন্যর বাড়ির চত্বরে। হাতে গামছাটা লইয়া মুখে পান দিয়া জনাদ্দন একটু একটু করিয়া আসিয়া সুধন্যর বাড়ির বাহির হতে হাঁক দিত,
—"কইগো বোঠান, লোক বাড়ি আছে নাকি?"
অমনি সুধন্যর বৌ হাসি চাপিয়া উত্তর দিত,
—"আরে এসো ঠাকুরপো, লোকও আছে, জনও আছে।"
এখানে বলিয়া রাখা ভালো, জনাদ্দনের কথা বিশদ আলোচনা করিবার কারণ; যাহা শুনা গেল কয়েকদিনের ভিতরে, কেবল জনাদ্দন না, দুর্ঘটনার আশেপাশে সকল সংশ্লিষ্ট বাঁকা চোখের আওতায় চলিয়া আসিলো।
সুধন্যর বৌ গলায় দড়ি দিয়া মারা যায় নাই। মানে দড়ি আদৌ নিজে দেয় নাই, মৃত মানুষ নিজ গলায় ফাঁস লাগাইয়া ঝুলিবার পরিস্থিতিতে থাকেনা বলিয়াই মনে হয়, আগে তাকে গলা টিপিয়া নৃশংস ভাবে খুন করা হইয়াছিলো সেই রাতে বাড়ির বাহিরে, অতঃপর পুরাতন একটা শাড়ি দ্বারা ফাঁস লাগাইয়া টাঙাইয়া দেওয়া হইয়াছিলো, অতীব করুণ সে দৃশ্য। ইহার পর যাহা সুধন্য ও বাড়ির আর সবাই শুনিয়াছিলো, উহা প্রকাশ্যে বলিয়া বেড়ানোর মত নয় বলিয়াই তাহাদের ধারণায় ছিলো--
শি ওয়জ রেপড্ বিফোর মার্ডার।
এমনিতেই দৃশ্যতঃ ইহা সুইসাইড কেস, ঘটনাস্থলে ধস্তাধস্তির কোনোরূপ চিহ্ন পুলিশ বা কেহই পায় নাই, ফলে গ্রামগঞ্জের চিরন্তন "গলায় দড়ি"র তত্ত্ব সাজাইতে দেরি হয় নাই। পরিস্থিতি বদলাইয়া গেলো পুলিশি খবরে। সুধন্য ভাঙিয়া পড়িলো একেবারে, পুলিশ তাকেও সন্দেহের তালিকায় উপরেই রাখিলো। নোট নেওয়া চলিতে থাকিলো, আসামী সন্দেহে লোক তুলিয়া নেওয়া চলিলো ... গ্রামে সন্দেহের বিষবাষ্প ছড়াইয়া পড়িলো।
২
বিশ্বেশ্বর দত্ত বারান্দায় বসিয়া সম্মুখে ঈষৎ ঝুঁকিয়া খবরের কাগজটা পড়িতেছিলেন; আজ বড়ো করিয়া প্রথম পাতা জুড়িয়া খেলার খবর। গতকাল ন্যাট ওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালে টিম ইন্ডিয়ার অসাধারণ চেজ বাড়িতে বসিয়াই প্রচণ্ড উত্তেজিতভাবে দেখিয়াছিলেন। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা গিয়াছিলো দেশের গৌরবগাথা, আর তাহার পরে পরদিন সকালে জমাইয়া ম্যাচ রিপোর্টটা না পড়িলে ঠিক মজাটাই মাটি হইয়া যায়।
ধীরে সুস্থে চায়ে চুমুক দিয়া তিনি খবরে চোখ বোলাইতে থাকেন; এ সময়টিতে হাঙ্গামা-হট্টগোল বড় একটা পছন্দ নয় বিশুবাবুর, কিন্তু কখনো কখনো হাঙ্গামার জিনিস না চাইতেই আসিয়া পড়ে, এবং তার গতিও থাকে অপ্রতিরোধ্য; মাঠপাড়ার নিকু উদোম গায়ে ঘাড়ে একটা গামছা ফেলিয়া উঠোনে আসিয়া হাজির হইলো। নিকুর চেহারা ভীষণদর্শন এবং উপরি একটা বিশ্রী চওড়া কাটা দাগ কানের পাশ হইতে গালের মাঝামাঝি আসিয়া থামিয়াছে, যেটা আর যাহাই হউক শ্রীবৃদ্ধি করে নাই; তথাপি চেহারার সাথে নিকেতনের প্রকৃতিগত ভাবে কোনোরূপ সাদৃশ্য আছে, এইকথা মানিয়া নেওয়া যায়না। যারপরনাই ভীতু ও সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকাই তার স্বভাব। কেউ দু-চার ঘা বসাইয়া দিলেও তাহার পক্ষ হইতে প্রতিআক্রমণের সম্ভাবনা নাই বলিলেই চলে। মুখমণ্ডলে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ ... কিছু বলিতে চায় সে,
—"কত্তা, কি কইরছেন গো?"
নিকু কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট গলায় কথাটা বলিলো, বিশু দত্তের মুখপানে সরাসরি না তাকাইয়া ... সাতসকালেই এমন দরবার লইয়া হাজির হইয়া কত্তাকে জ্বলাতন করিবার স্বাভাবিক কুন্ঠাবোধ কাজ করিতেছিলো নিকুর মধ্যে।
বিশুবাবু মুখ তুলিলেন; অন্যসময় হলে খেঁকাইয়া উঠিতেন হয়তো, সকালের নির্মল পরিবেশের গুণে বা দেশের বিজয় গৌরবের কারণেই হোক, কিন্তু প্রতিক্রিয়াটি সেইরূপ দেখা গেলো না। ভাবলেশহীন মুখে বলিলেন,
—"বল নিকু, কি ব্যাপার রে?"
—"থানা আইসিছে তো আমাদের পাড়ায়। মুংলা আর গনা পাইল্যে গেছে ... শুইনিছেন তো সব। আমি বাড়িত থাকতাম না, বৌ বুললে কত্তাকে একবার জাইনি আসো গা, পালাইলে আবার সন্দ কইরবে না তো! পুলিশের কথায় কাজে কিছু বিশ্বাস নাই - ইয়ার লেগি আসা--"
হাত কচলাইতে থাকিলো নিকু, কাঁচুমাচু মুখ তাহার... নিরপরাধ পিকনিকপ্রদত্ত মুরগি আচমকা মুক্তি পাইয়া বাঁশের ঝাড়ে শুষ্ক পাতায় লুকাইয়া থাকিবার হুবহু মানবিক প্রতিচ্ছবি যেন।
প্রৌঢ় বিশু দত্ত চিত্রার্পিতের মতো স্থির হইয়া গেলেন। তিনি শুনিয়াছেন। পাড়ার সকলেই সকালেই শুনিয়াছে ঘটনাটা; মাঠপাড়ার সুধন্যর বৌ কয়েকদিন পূর্বেই মারা গিয়াছিলো গলায় দড়ি দিয়া; পোস্ট মর্টেম হইবার পর জানা গিয়াছিলো, গলা টিপিয়া আগে মারা হইয়াছিলো তাকে, পরে ফাঁস লাগাইয়া ঝুলাইয়া রাখা হইয়াছিলো দেহটা। ঘটনার পরদিন সকালে বড় বিলে যাওয়ার পথে খেজুরতলায় খুঁজিয়া পাওয়া গিয়াছিলো মৃতদেহ। ছোট জায়গা হারুডাঙা, নিস্তরঙ্গ পুকুরের মতোই। একটা ঢিল পড়িলেও তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। জটলা, শোরগোলের পালা শেষ আপাতত, এখন গুজগুজ ফুসফুস চলিতে থাকিবে সারাদিন। ইহাই নিয়ম এই স্থানে। এই পাড়ার সকলেই জানিয়া যায়, কিন্তু কেহই এসব জিনিসের ভিতরে ঢুকিতে আগ্রহ দেখায়না কারণ কখন কি কার ঘাড়ে আসিয়া পড়ে - বলা যায়না ঠিক ... সৎকার হইলেই মিটিয়া যায়।
দত্তবাবুর মুখের স্থির ভাবে চিন্তাস্রোত ... নিকুর মুখে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,
—"তোর সমস্যা কি? তোকে কেন পুলিশে ধরবে খালি খালি?"
নিকুর বিশাল শরীরটা নড়িয়া উঠিলো এইবারে, হঠাৎ দুপা আগাইয়া বারান্দায় বিশু দত্তের পায়ের নিকটে ধুপ্ করিয়া বসিয়াই হাউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিলো সে,
—"আমি কিছু জানি না কত্তা ... আমাকে বাঁচান ...আমার নামটাও কইরিছে গো ঐ মাগী ..."
—"আহ্! দাঁড়া না বাপু ... উল্টোপাল্টা বকছে খালি —"
বিশ্বেশ্বর দত্তের বিরক্তি কেন বুঝিবার অসুবিধা থাকার কথা নয় কাহারো, মাত্রাবোধহীন নিকুর অশ্লীল ভাষা প্রয়োগেই বিরক্তি; গজগজ করিতে করিতে দত্তবাবু খবরের কাগজটি ভাঁজ করিতে থাকেন ...
—"এখন বাড়ি যা। পরে আসিস। পুলিশ তোকে তো আর এমনি এমনি ধরবে না ... তোর নাম বললেই তো আর তুই দোষী হয়ে যাবি না রে বাবা!
"যা এখন। তাছাড়া যা শুনলাম, ওটা আদৌ মার্ডার না সুইসাইড - সেটাই এখনো পরিষ্কার নয়। এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামাস নে।"
—"বুইলছেন কি কত্তা! খুন ... এ পোষ্কার খুন!! মাডার!! গলায় ফাঁস দিছে পরে, আগে তো মাইরিছে ... পুলিশ রেপোটে বুলিছে তো!"
নিকুর চোখগুলি বড়ো বড়ো হইয়া উঠিয়াছে ... কথা বলিতে বলিতে হাঁপ ধরিয়া যাইতেছে যেন, খালি গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমিয়াছে।
বিশু দত্ত নিশ্চুপ চাহিয়া ছিলেন, এইবারে কঠিন স্বরে বলিলেন,
—"কে বললো রে এসব তোকে হতচ্ছাড়া! তুই এতসব জানলি কিভাবে?"
আচমকা বোমার মতো আওয়াজে বারান্দা কাঁপিয়া উঠিলো যেন, দত্তবাবুর মুখ শক্ত হইয়া গিয়াছে ... ভয়ঙ্কর দেখাইতেছে কপালের ভাঁজ; খবরের কাগজটা হাতে মুষ্টি পাকাইয়া উদ্যতফণা সাপের মতো নিশ্চল হইয়া আছেন প্রৌঢ় ... বেচারা নিকু ক্যাবলার মতো চাহিয়া থাকে ফ্যালফ্যাল, ঘটনার আকস্মিকতায় সে সম্পূর্ণ হকচকাইয়া গিয়াছে, কম্পিত গলায় বলে,
—"কত্তা, আমি তো শুইনিছি ... দেখিনি কিছু কত্তা!"
বিশু দত্ত সামলাইয়া নিয়াছেন তার ক্ষণিকের উত্তেজনা ... পরিষ্কার থিতাইয়া যাওয়া স্বরে বলিলেন,
—"হতভাগা, এসব কথা কখনো বলতে নেই, পুলিশ যদি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করে, এসব বললেই তুই যাবতীয় জেরার মুখে পড়বি, সেটা ভালো হবে? যা এখন। আমার কাজ আছে এখন। বিকেলে আসিস ... যা।"
ধীরে বারান্দা হইতে নামিয়া পোষমানা জীবের মতোই নিকু লঘুপায়ে বাহির হইয়া গেলো কাঠের তৈরি সদর দরজাটা দিয়া ... ভূতে ধরা বিশু দত্ত আগে অনেক দেখিয়াছেন, সব মানসিক রোগ - নিকুর কাঠের দরজা দিয়া নিষ্ক্রমণ অনেকটা ভূতগ্রস্তের লোকের মতো লাগিলো দেখিতে; বিশু দত্ত নিশ্চুপ বসিয়া রহিলেন খবরের কাগজটা মুষ্টিতে পাকাইয়া। সত্যই বড়ো অদ্ভুত; হঠাৎ করিয়া সাংসারিক অশান্তি হইতে চিরকালীন মুক্তি লাভের সহজতম উপায় হল এই নিজেকে সরাইয়া নেওয়া ... স্ত্রী জাতিই অধিক বাছিয়া লয় এই পথ; কিন্তু পরে তিনিও শুনিয়াছেন অন্যরকম, তাঁর মনে হইয়াছে--কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার।
সুধন্য লোকটাকে চিনিতেন বিশ্বেশ্বর দত্ত। ছোট একটা কাঠমিস্ত্রির দোকান চালাইয়া থাকে সে বাজারে, পঞ্চাশোর্ধ বয়স হইবে, তবে পরিচয় তেমন নাই, ঐ মুখ চেনা অবধিই, অবশ্যি সুযোগও যে বড়ো পাইয়াছেন এরূপ নয়, এইখানে আসা দত্তবাবুর বড়জোর বৎসর চারেক হইবে, সবার সহিত তেমন পরিচয় নাই তাঁর, কেহই তাহাকে মিশুকে বলিয়া দাবী করিতে পারেনা।
এই নিকু বলিয়া ছেলেটি কিন্তু তার বড়োই ন্যাওটা, সময়ে অসময়ে কত কাজই না করিয়া দেয় ... ফাইফরমাশ খাটিয়াও অম্লান হাসি লাগিয়া থাকে মুখে। দত্তবাবু নিকুকে প্রায়শ:ই হাতে কিঞ্চিৎ 'জলখাবার'-এর টাকা দিয়া থাকেন; বিশ-পঞ্চাশ-একশো। ইহাতেই খুশি নিকেতন। ভীষণ চেহারা ও ষণ্ডা গোছের চেহারা হইলেও দত্তবাবুকে নিকু ভয় পায়, সমীহও করিয়া থাকে; যে-কোনো সমস্যায় সে দত্তবাবুর কাছেই আসিয়া দাঁড়ায়, ওয়াকিবহাল থাকিয়া মনে মনে যে কত্তা নিশ্চয়ই উপায় বাতলাইয়া দিবেন, সরল সহজ গ্রাম্য নিকুর অগাধ বিশ্বাস।
তবে নিকু যাহার নামে অশ্রাব্য গালাগালটি দিয়াছিলো, তাহার লক্ষ্য যে সুধন্য মিস্তিরির পুত্রবধূ, এ ব্যাপারে বিশু দত্তের কোন সন্দেহ রহিল না। সুধন্যপুত্রকে নিকু ভালো চোখে দেখিয়া থাকেনা; প্রকৃতপক্ষে কেহই না। কিন্তু তাহার বৌটি হঠাৎ নিকুর নাম জড়াইতে চেষ্টা করিবে কেন, তাহার বহু ভাবিয়াও কোন কূলকিনারা করিতে পারিলেন না বিশু দত্ত।
৩
সুধন্যর বৌকে জনাদ্দন বৌঠান বলিয়া ডাকিত, বয়সে হয়তো সমবয়সীই হইবে বা জনাদ্দন কয়েক বৎসরের ছোটও হইতে পারে। জনাদ্দনের খোশগপ্পো চলিত বেশ কিছু সময় ধরিয়া ... এই অবসরে বৌমাটি কখনও আসিয়া এককাপ লিকার চা দিয়া যাইতো। মেয়েটি বয়সে কাঁচা হইলেও চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাইতো। তাহার শাশুড়ি মাতা যখন জনাদ্দন কাকার সহিত আলাপচারিতায় ব্যস্ত, সে সেখানে দাঁড়াইতো না। কখনও জনাদ্দন ইচ্ছা করিয়াই বলিত,
—"বৌমা, এট্টুখান বসো না। আমরা শ্বশুর বইলি তো আর রাক্কস না যে ভয় পাবে এতো!"
কিছু না বলিয়া আবার সে চলিয়া যাইতো। রাক্ষস নয়, বরং জনাদ্দনকে সুপুরুষই বলা চলিত। বয়স চল্লিশ প্রায়, অথচ নির্মেদ
বাহুল্যবর্জিত স্বাস্থ্য ও প্রমাণ উচ্চতায় তার একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাইত। সে নিশ্চিত রূপেই বলিষ্ঠ এক পুরুষ, বয়সের ছাপ তার শরীরে পড়েনি। উভয়ের রসিকতা চলিতো, মাত্রা ছাড়াইয়া চলিয়া যাইতো কখনো কখনো,
—"বৌঠান, তোমার লোক এত সকাল সকাল আজ চইলি গিছে দুকানে দেখছি!"
—"হ্যাঁ, আমার কথা আর কেই বা ভাবে ঠাকুরপো ... আমার কপাল।"
—"না না, সে এখুন তুমার কথা ভেবি করবেই বা কি, সেতো রাইতে ভাইবলেই চইলবে।"
—"চুপ করো। সেদিনও আর আছে মনে করেছো?"
জবাবে জনাদ্দন হাসিত ... আর কেহ শুনিতে পাইতো কিনা বলা যায়না, তবে অসতর্কতার সহিত ইয়ার্কির কথা চলিতে থাকিলে তা পার্শ্ববর্তী ঘরটিতে নবীনা গৃহবধূটির কানে যাইত; সে ব্রীড়াবনত হইয়া চুপ করিয়া থাকিত।
একদিন একটি ঘটনা ঘটিয়া গেলো সহসা, একজন ছাড়া কাহারো নজরে পড়িলোনা। জনাদ্দন সেইদিনও সুধন্য মিস্তিরির দাওয়ায় বসিয়া রঙ্গ-তামাশায় মশগুল হইয়া ছিলো ... একবার হাসিয়া সুধন্যর বৌ গড়াইয়া পড়িলো; পুত্রবধূটি চা লইয়া আসিতেছিলো, সে দেখিয়াই থমকিয়া গেলো। স্বাভাবিক লজ্জা ও কুন্ঠাবোধ হইতে ইতস্ততঃ করিতে লাগিলো ... বিরক্তও হইলো বোধ করি। তাহাকে দেখিয়া সুধন্যর বৌ ও জনাদ্দন উভয়েই বিব্রত হইয়া পড়িয়াছিল, সামলাইতে সামান্য সময় লাগিলো। এরপরে রাত্রিবেলা সুধন্য তার বৌকে শাসাইলো, তার বিরক্তির কথা প্রকাশ করিয়া দিলো গৃহিণীর কাছে - জনাদ্দনের সাথে কোনরূপ মেলামেশা করা চলিবেনা। সুধন্য কিন্তু বাড়িতে বৌমার নিকট হইতে কিছুই শুনে নাই, সে বাতাসের মুখে শুনিলো হয়ত। বাস্তবিক পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই লক্ষ্য করিয়া ছিলো জনাদ্দনের আনাগোনা।
জনাদ্দন তার পরদিনও আসিয়াছিলো, সুধন্যর বৌ গম্ভীর মুখে তাহাকে পত্রপাঠ বিদায় করিয়া দিলো ... এই বয়সে আসিয়া আর দাম্পত্য কলহে সে রাজি নয়। এইখানে সুধন্য মিস্তিরির বৌ-এর সামান্য শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা প্রদান করা প্রয়োজন। চল্লিশের কোঠায় যাইয়াও ফিমেল হরমোনের ব্যতিক্রমী অদ্ভুত কৃপায় হইবে হয়তো, তাহার আঁটসাঁট শরীরের গড়ন ঈর্ষণীয় ছিলো। মিষ্টতা ঢালিয়াই বিধাতা গড়িয়াছিলেন তাহাকে, তাই যৌবনপ্রান্তে আসিয়াও লাবণ্যের ছটায় ভাঁটা পড়িয়াছিলো, কিন্তু মুছিয়া যায় নাই। স্থির বিশ্বাস পাওয়া যায়, নিজসময়ে অনেক অবিবাহিত পুরুষের কল্পকামনায় ইনি উপস্থিত থাকিয়া গরল নির্গমনে সহায়তা করিয়াছেন।
জনাদ্দন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাইয়া আর কথা বাড়ায় নাই ... সে চলিয়া গিয়াছিলো সেই মুহূর্তেই।
এই ঘটনা ঘটিয়া যাইবার পর প্রায় একমাসকাল কাটিয়া গিয়াছিলো। সংসারের চাকা আগের মতোই স্বাভাবিক ঘুরিতে থাকায় কোনকিছুই ঠাহর করা যায় নাই। সুধন্য মিস্তিরির বাড়িতে অশান্তির আগুন স্তিমিত হইয়া গিয়াছিলো সম্পূর্ণরূপে ... কিঞ্চিৎ পূর্বে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হইয়াছিলো, তাহার লেশটুকুও রহিলনা। শুধু একটা নিঃশব্দ পরিবর্তন ঘটিয়া গেলো, সকলের চক্ষুর অন্তরালে, সকলে বলাটা ঠিক হইবেনা কারণ যিনি ইহা উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাহাকে বাইরে রাখা চলিবেনা। পুত্রবধূটি বুঝিয়া নিল। সুধন্য মিস্তিরির বাড়িতে শাশুড়ি-বৌমা সম্পর্কটি বিষাক্ত স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হইয়া গেল। বাড়ির ভিতরে পরস্পর পরস্পরকে নিশ্চুপ মাপিয়া নিত, কিন্তু কিছু বলিত না কেউ কাউকে। শুধু দুই চোখ দিয়া অনেক কিছু বলিয়া যাইত উভয়ে উভয়কে। ঠান্ডা লড়াই জারি থাকিয়া গেল কেবলমাত্র এই কারণে, বৌমাই যে শ্বশুরের কাছে হাঁড়িটা ভাঙিয়াছে, এ-ব্যাপারে সুধন্যর স্ত্রী প্রায় নিশ্চিত হইয়া গিয়াছিলো। সুধন্যপুত্রটি প্রায় অজ্ঞাত রহিলো সম্পূর্ণ বিষয়ে কারণ বাড়িতে কাহারো সাথে তাহার কোনসময়েই বিশেষ বাক্যালাপ ছিলোনা, নিভৃত আলাপ তো নয়ই। স্ত্রীর সহিত দাম্পত্য নৈকট্য ছিলো না বলিলেই চলিত, শুধু শারীরিক প্রয়োজন মিটাইয়া তফাত হইয়া যাইতো সে, পুত্রবধূটির পক্ষে ইহা নিতান্ত পীড়াদায়ক হইয়া উঠিয়াছিলো, কিন্তু সে প্রকাশ করে নাই। তাল কাটিয়া গেলে সঙ্গীত শ্রুতিকটু হইয়া যায় ...
৪
হারুডাঙ্গা থানার ওসি দিলীপ সরকার মুচকি হাসিয়া চায়ের কাপটি নামাইয়া রাখিলেন। কৌতুক খেলা করিতেছিল তার মুখমণ্ডলে ... বেতের চেয়ারটিতে পুনরায় গা এলাইয়া বলিলেন,
—"কিন্তু আপনার মত অভিজ্ঞ লোক যে এতখানি কাছে, নাগালের মধ্যেই আছেন জানতাম, তবে আর খামোখা দেরী করার মুর্খামি করতাম না। সে আপনি যাই বলুন, আর এই কেসটা একটু গুলিয়ে গেছে আমাদেরও, বুঝছি কে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না ..."
কথা বলিতে বলিতে দিলীপবাবু মুখটা নামাইয়া আনিলেন হঠাৎ, গলা নীচু করিয়া বলিলেন,
—"মশাই, ও বাড়ির সক্কলের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি ... বয়সে কচি বৌমাটিরও একজন মাঝবয়সী নাগর আছে, বুঝলেন! কে তা আর উদ্ধার করতে পারছিনা। একই লোক শাশুড়ি-বৌমা উভয়কেই দুহাতে বাজাচ্ছিল, এ তত্ত্ব গাঁজাখুরি বলেই মনে হচ্ছে ... যাক গে বাদ দিন, এখন কাজের কথায় আসি--"
দু হাত মুখের সামনে উল্টাইয়া বিশ্বেশ্বর দত্ত পাল্টা হাসিলেন। বলিরেখা বয়সের ছাপ নির্দেশ করিতেছে ... তবুও বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটিকে ঢাকিতে পারে নাই। তিনি সরকারী চাকুরি আমলে অপরাধ বিভাগের তদন্তশাখায় থাকার দরুন বহু এমন দুরূহ কেস দেখিয়াছেন, কোনটার সমাধান হইয়া দুর্দান্ত আসামী সাজা পাইয়াছে, আবার কোনটায় সে বুক ফুলাইয়া ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে অকাট্য অ্যালিবাই ও তাহার বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে। সে রাজত্বও গিয়াছে, সে রামও আর নাই। শহরতলির জীবন ছাড়িয়া এই যে গ্রামের জীবন স্বস্তির জন্য বাছিয়া নিয়াছেন, তা আর যাই হোক তাহার প্রকৃত পরিচয় গোপন করিতে পারে নাই ... থানার ওসি কোন গূঢ় উপায়ে এ সন্ধান পাইয়া সকাল বেলা উপস্থিত হইয়াছিলেন। নির্জন সংসারে গৃহিণী ব্যতীত লোকজন কেউ থাকেনা, তাই বাহিরের লোকের সাড়াশব্দে বিশ্বেশ্বর দত্তের বাড়িটি খাপছাড়া লাগিবার মতোই।
—"আমি শুনেছি, মানে যেদিন ঘটনাটা ঘটেছে, সেদিনই শুনেছি। প্রথমে আমার কিন্তু ঘরোয়া অশান্তির জেরে মামুলি আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। পরে ঐ ফাঁসের গপ্পোটা শুনে কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার--এটাই মনে হয়েছে। সবটাই অনুমানে চলে, আর পাঁচজন যেখানে, আমিও সেখানেই আর কি!"
—"আপনি পুরো ঘটনাটাই শুনেছেন কি মিস্টার দত্ত? ঐ মহিলা রেপড্ হয়েছিলেন আগে ... অদ্ভুত শোনালেও সত্যি। কি ধরনের মিশ্র প্রবৃত্তি প্রশমণে এরকম যুগপৎ কীর্তি ঘটিয়েছেন সেই কীর্তিমান, তা অনুমান করা যায়নি, কিন্তু সন্দেহের তীর কার কার দিকে ছিলো, তা আপনাকে বলতেই পারি।"
বিশ্বেশ্বর দত্ত নড়িয়া বসিলেন। আজ তাঁহার কাজের তাড়া বড় একটা নাই, সকাল সকাল নিকু আসিয়া বাজার করিয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাঁহার কাজ বলিতে বাড়ির সামনের একফালি ছোট্ট বাগানটি পরিচর্যা করা এবং তা আরো কিয়ৎক্ষণ পরে করিলেও খুব চলিবে, এই ফাঁকে সরকার মশাইয়ের কথাগুলি শুনিয়া ফেলা যাক।
—"বাড়ির সবার বয়ান মিলিয়ে সন্দেহজনক বলে যে চারজনকে তল্লাশ করা হয়েছিলো, তারা হলো-- জনার্দন হালদার, গণপতি দাস, মঙ্গল দাস আর নিকেতন মণ্ডল।"
এই অবধি শুনিয়া বিশ্বেশ্বর দত্ত হাসিয়া ফেলিলেন, তাহার মনে পড়িয়া গিয়াছিলো নিকুর করুণ আর্তি, বেচারা সাতে পাঁচে থাকেনা, তাহার ফাইফরমাশ খাটিয়াই দিন কাটে, এইরূপ জটিল ও হিংস্র হত্যাকাণ্ডের সাথে তাহার নাম কিরূপে জড়াইয়াছিলো, তাহাও তিনি অল্পবিস্তর জানিতেন বইকি, কিন্তু অর্থ খুঁজিয়া পান নাই। আর জনার্দন বলিয়া ব্যক্তিটির মুখটুকুই চিনেন তিনি, মাছের ব্যাপারী, তবে তাহাকে দেখিয়া কখনোই দুর্দান্ত খুনী বলিয়া সন্দেহ করা অসম্ভব। আর যে বাকি দুজন, তাহাদের কাউকেই তিনি চিনেন না।
—"জনার্দন বলিয়া লোকটির সাথে ঐ মৃত ভদ্রমহিলার অবৈধ সম্পর্ক ছিলো বলেই শুনলাম আশেপাশে, সত্যতা যাচাই করবো যে, তার সময় এখনো পাইনি। আর গণপতি ও মঙ্গল বলে যে দুই ব্যক্তি পলাতক, তাদের সন্ধান চলছে। তারা নিজেরাই পালিয়ে কাজ সহজ করছেনা কি?"
—"না। তারা তো শুনেই ফেলেছে যে তারা অভিযুক্ত, কাজেই লুকিয়ে থাকাটাই শ্রেয় মনে করেছে হয়ত। আর যাই বলুন, পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা, এ বড়ই প্রাচীন প্রবাদ। তাই ভয়ে পালিয়ে গেলেই যে তারাই আসামী একথা জোর দিয়ে বললে অত্যাচার হয়ে যাবে না?"
দিলীপ সরকার হাসিয়া ফেলিলেন। কপালে হাত দিয়া মাথা টিপিবার ভঙ্গিতে বলিলেন,
&mdash"আপনাকে সবরকম ভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত আমি, কিন্তু, আপনি একটু তলিয়ে দেখুন ... খুব দরকার। এরকম ঘটনা আমার চোখে এ অঞ্চলে পড়েনি কখনো, এই প্রথম। আপনাকে পাশে পেলে, আমাদের ভীষণ উপকার হবে বলেই মনে করছি।"
—"বেশ বেশ। হবে খন। কিন্তু ইনস্পেক্টর সাব, আমাকে ঐ বাড়িতে একবার ইন্ট্রোডিউস করে দিলে ভালো হয়। মানে গ্রামগঞ্জ জায়গা, আর অফিসিয়াল লোক নই যে হুট্ করে ঢুকে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালাবো, বুঝতেই পারছেন মশাই, বুড়ো বয়সে মার খাবার বিস্তর সম্ভাবনা আছে আর কি!"
—"নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো।"
দিলীপ সরকার সজোরে হাসিয়া উঠিলেন, তাহার পরেই শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া হাতজোড় করিয়া নমস্কারের ভঙ্গিতে বলিলেন,
—"আচ্ছা, আজ উঠি, আমি নাহয় কাল আরেকবার এসে দুজনে মিলে ওখানে যাবো। এই তো কাছেই, জানেন তো সবটাই।"
—"আচ্ছা। নমস্কার।"
বেলা হইয়া গিয়াছিলো, এবারে বাগান পরিচর্যা করিবার আবশ্যিক শর্তটি স্মরণ করিয়া বিশ্বেশ্বর দত্ত খুরপি, ঝাঁঝরি ইত্যাদি আনিবার জন্য উঠিয়া গেলেন।
৫
—"আচ্ছা, জনার্দনকে আপনার সন্দেহের কারণ?"
ভরাট গলায় প্রশ্ন ছুটিয়া গেল সুধন্য মিস্তিরির দিকে। এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনিতেছিল সে, এবারে যেন অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়িল, এই নামটারই যেন সে অপেক্ষা করিতেছিল,
—"ঐ খান্ - ঐ জনাদ্দন শুয়োরের বাচ্চাটা আমার সংসারটা পুড়িয়ে খাক্ করে দিলে গো ... বৌকে কতোবার মানা করিছি ... উয়ার সাথে মিশোনা, এরা লোক সব ভালোনা, বয়স হইছে, ছুকছুকানি কমেনি, উয়াকে পাইলে একবার ... আমার সব শেষ করি দিল গো ..."
—"দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনার ছেলেটি কোথায় এখন? তাকে দেখছিনা যে ..."
সুধন্য মিস্তিরির মুখে চুন পড়িয়া গেল বলিয়া মনে হইলো, সে হতভম্ব কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিল, তারপরে বলিল,
—"সে তো এই সময়ে বাড়ি থাকেনা কত্তা, সে বাইরে আছে।"
বেলা দশটা বাজিয়া গিয়াছিল প্রায়, পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দিলীপবাবু আর বিশ্বেশ্বর দত্ত সুধন্য মিস্তিরির বাড়িতে হাজির হইয়া ঘটনার খুঁটিনাটি খোঁজ করিতেছিলেন, বাড়ির বাহিরে জীপ গাড়িটায় দুইজন কনস্টেবল রাতে রোঁদের অনিবার্য ফলস্বরূপ ঝিমাইতেছিল। বিশ্বেশ্বর দত্তের সাথে পুলিশের কিরূপে যোগাযোগ, তাহা বুঝিতে ইতিউতি কৌতূহলী চোখের উঁকিঝুঁকি দেখা যাইতেছিল।
জনার্দন লোকটি অমিতসাহসী, সে কিন্তু গ্রাম ছাড়িয়া পালায় নাই, নিজে সবচাইতে সন্দেহভাজন জানিয়াও, গ্রামেই থাকিয়া গিয়াছিল। সুধন্য মিস্তিরি মুখে আস্ফালন করিলেও, জনার্দনের টিকিটিও ছুঁইয়া দেখিতে পারে নাই, বাস্তবিকই সকলেই নিঃসন্দেহ হইয়াছিলো জনার্দনের কুকীর্তি সম্পর্কে। তবে তাহার অসুস্থ মনোবিকার যে বিকৃতকামে পরিণত হইয়া গিয়াছিল, তাহা কেহই আঁচ করিতে পারে নাই।
—"আপনি সেদিন রাতে টের পাননি যে আপনার স্ত্রী উঠে বাইরে বেরিয়েছেন?"
—"রোজ রাতেই বেরোয়। আমাদের বাড়ির বাথরুম তো দেখছেন, ঐ যে--"
সুধন্য মিস্তিরি বাড়ির দক্ষিণ দিকে পলেস্তারা খসা, রংচটা বাথরুমটি দেখাইয়া দিলো। শয়নকক্ষ হইতে আন্দাজ হাত পনেরো-বিশ দূরেই হবে ... তার পিছন দিকেই একটু ফাঁকা জমি, তারপরেই বড়বিলে যাইবার রাস্তাটা নজরে আসিয়া যায়।
—"হুম। তা বটে। অনেকক্ষণ ধরে না আসার পরও আপনি ওঠেননি কেন?"
—"আজ্ঞে আমার ঘুম সহজে আসেনা আর আসলে আর ভাঙেনা ... আমি যদি জানতাম, আমার এতবড় সব্বোনাশ ঘটবে, আমি কি ঘুমাতাম ... কক্ষনো না হুজুর ... আমি যতক্ষণে জানতে পেয়েছিলাম, ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে ... সব ... সব শেষ।"
তিনজনের বাক্যালাপে বাধা পড়িল হঠাৎ, একজন কনস্টেবল ভিতরে আসিয়া ঢুলু ঢুলু চোখে বিশ্বেশ্বর দত্তের দিকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিল,
—"আপনাগে বাইরে ডাকচে একজুন। ভিতরে আইলোনা তো।"
তিনজনেই ফিরিয়া সেইদিকে তাকাইলো একসাথে ... বিশ্বেশ্বর দত্ত উঠিয়া পড়িলেন।
—"কত্তা, এইদিকে ..."
বাহিরে দাঁড় করানো জীপের পিছন দিক হইতে সদা কাঁচুমাচু নিকু বাহির হইয়া আসিল। দত্তবাবু হাসিয়া ফেলিলেন,
—"বল, কি হয়েছে?"
—"মা ঠাগরুনের শরীলটা খারাপ, আপনি বাড়ি যান এট্টু।"
৬
—"হ্যাঁ, আমি বিশ্বেশ্বর দত্ত বলছি, কে, দিলীপবাবু? হ্যাঁ, আমি জনার্দনকে আজ কিছু জিজ্ঞেস করবো ভাবছি। আপনি কি আসছেন?"
...........................
...........................
—"না না, তা নয়, আসলে জনার্দনকে বড্ড খারাপ সময়ে ধরতে হবে, মোটামুটি রাত আটটার পর; তার আগে ব্যাটাকে পাওয়া যাবেনা, আমি খবর নিয়েছি। আপনি ঐ সময়েই আসুন। তবে একটা খটকা নিরসনের জন্য সুধন্য মিস্তিরির বাড়ি আগে একটু ঘুরে যাবো ... না না, আমি একাই যাবো ... আচ্ছা, আচ্ছা, আসুন, রাখছি ... ধন্যবাদ।"
বাজারের টেলিফোন বুথের ঝুলাইয়া রাখা ফোনটি ঘটাং করিয়া আবার রাখিয়া দিলেন বিশ্বেশ্বর দত্ত। আজ নিকু সকালে আসে নাই, তাই তিনি নিজেই সব্জী বাজার ঘুরিয়া যাইতেছিলেন; সহসা গতকালকের অসমাপ্ত জিজ্ঞাসাবাদ স্মরণ হইয়া পড়ায় হারুডাঙ্গা থানার ওসিকে কল করিবার ইচ্ছা আর দমন করিতে পারেন নাই, তিনিও অবসর জীবনের এই রোমাঞ্চটুকু শুষিয়া লইতে চান।
সুধন্য মিস্তিরির বৌমাটি, যার নাম কাজলী, আগের দিনই শুনিয়াছেন, সে জনার্দনকে সবিশেষ লক্ষ্য করিয়াছে যখন জনার্দন আসা যাওয়া করিত, প্রকৃতপক্ষে সে নিজেই শ্বশুরের কানে হয়তো বা এই কথাটি তুলিয়া থাকিবে। স্ত্রীলোকের বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়া যায় গৃহের অভ্যন্তরে, তাই বিশেষ কোনকিছু সে দেখিয়া থাকিলে, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে কাজে আসিতে পারে - অনুমান করিলেন তিনি।
***
শেষ বিকালের ছায়া ছায়া ভাবটা ততক্ষণে চলিয়া গিয়াছিলো। কালো প্রায়ান্ধকার ঘরের ভিতরে নিভৃত কথোপকথন বিশ্বেশ্বর দত্ত ও কাজলী চালাইয়া যাইতেছিল ... প্রায় একতরফাভাবে, কারণ বিশ্বেশ্বর দত্ত কোন প্রশ্নেরই উত্তর সব গুছাইয়া পান নাই।
বিশ্বেশ্বর দত্ত এতক্ষণের জিজ্ঞাসাবাদ শেষেও কোনরূপ স্থির সিদ্ধান্তে আসিতে পারিলেন না। যে সন্দেহে তিনি জাল গুটাইয়া আনিয়াছিলেন, সে মাছও ধরা পড়ে নাই বলিয়াই ধোঁয়াশা লাগিতেছে এখন ... যাই হোক, এ কাজে আর কালবিলম্ব না করিয়া ইস্তফা দিবেন প্রায় মনস্থির করিয়া আনিয়াছেন। তিনি পুনরায় আর একবার জিজ্ঞাসা করিলেন,
—"জনাদ্দন এর মধ্যে কোনদিন তোমাদের বাড়িতে এসেছিলো কি? সত্যিটা বল।"
—"না।"
—"তুমি কিছু দেখোনি সন্দেহজনক?"
—"না। দেখিনি।"
—"তোমার শ্বশুর রাতে কখন ঘুমোতে যান?"
—"দেরী হয়। দোকান থেকে এসে কিছুক্ষণ সময় এমনি বসে থাকেন, আর তারপর দশটায় খেয়ে নিয়ে আরো একটু বসে তারপর ঘুমোতে যান।"
—"ঘটনার দিন তোমার শাশুড়ি ঘর থেকে কখন বেরিয়েছিলেন, টের পেয়েছিলে?"
—"না।"
—"খুব জানাশোনা কেউ না ডাকলে এতরাতে কেউ উঠবেনা, সেটা তো বোঝো নিশ্চয়ই, তাহলে কাকে তোমার সন্দেহ হয়?"
—"আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।"
—"শাশুড়ি নিজেই উঠে বাইরে গিয়েছিলেন না কেউ তাকে ডেকেছিল? তুমি কিন্তু বয়ানে বলেছো, শাশুড়ি নিজে উঠে বাইরে গিয়েছিলেন, তুমি কিভাবে জানলে? আর সবচে বড় কথা, তোমার শ্বশুর টের পাননি? বাথরুমে যেতে গেলে তো বাইরে বেরোতেই হয়, তখন কি কেউ তাকে ফলো করে থাকবে?"
কাজলী সামান্য হকচকাইয়া গেল, একবার অস্ফুটে বলিল,
—"আমি কিভাবে জানবো? আমার মনে হয়েছিল, তাই বলেছিলাম। বিশ্বাস করুন কাকাবাবু, আমি কিছুই জানি না, এমনিতেই বাড়ির এই অবস্থায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছি ... প্রিয়জন বিয়োগের ব্যথা না সামলাতেই এসব তত্ত্বতালাশে আমাকে চাপাচাপি করে আরো মুচড়ে দেবেন না দয়া করে ..."
গলা ধরিয়া আসে কাজলীর ... বিশ্বেশ্বর দত্ত অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলেন, কিন্তু পেশাদারি গাম্ভীর্যের সাথে বলিলেন,
—"তাহলে মুংলা, গনা, নিকু--এদের নাম বলেছো কেন?"
—"ওরা লোক ভালো নয়, আর আমার শাশুড়ির সাথে প্রত্যেকের যোগাযোগ ছিলো। উনি এদের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছেন, মেলামেশাও করতেন।"
—"নিকু? কি বলছো তুমি?"
—"হ্যাঁ, প্রথমে বলেছিলাম, পরে ওর ওপর সন্দ কেটে গেছে। ও না ... জনাকাকা ছিলো একাজে, এবং আরো কয়েকজন সঙ্গে ছিলো বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।"
অন্ধকার ঘরে বিশ্বেশ্বর দত্ত ভুরু কুঁচকাইয়া তাকাইয়া রহিলেন কাজলীর মুখপানে ... সহসা বিদ্যুচ্চমকের মত যেন একটা কিছু মাথায় আসিয়াই আবার হারাইয়া গেলো। কাজলী হঠাৎ যেন চঞ্চলা রাই হইয়া উঠিয়াছে ... ঘন ঘন দক্ষিণ দিকের জানালাটার বাহিরে ঘোর অন্ধকারে বার বার তাকাইয়া কিছু একটা লক্ষ করিতেছিল, মাঝেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হইতেছিল ...
—"তুমি যে ব্যাপারটা বলছো, তাতে বিস্তর অসঙ্গতি আছে বাপু। আমি যা জানলাম, সবটাই খুলে বলবো কাল থানাতে। তুমি সহযোগিতা করলে আমরা আসামীকে সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম হয়ত। যাই হোক, তুমি কি কিছু বলবে আর?"
চোখেমুখে একবার দ্রুত মুছিয়া নেওয়ার ভঙ্গিতে হাত চালাইলেন বিশ্বেশ্বর দত্ত।
—"না।"
—"বেশ। তাহলে আমি আসি এখন। তবে একটা কথা, আমি তোমাকে এটুকু আশ্বস্ত করতে পারি যে প্রকৃত আসামী কে, আমি কিন্তু--"
এই অবধি বলিয়াই বিশ্বেশ্বর দত্তের কথায় ছেদ পড়িল ধুপ করিয়া একটা ভারী পায়ের শব্দে ... বাড়িতে আর কেহই নাই সন্ধ্যাবেলা, কেউ কি আসিয়াছে হঠাৎ?
বিশ্বেশ্বর দত্ত পিছনে চট করিয়া ঘুরিয়া কিছুই দেখিতে পাইলেন না ... সন্ধ্যাবাতিটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয় নাই আজকে। কৌতূহলী হইয়া অন্ধকারেই ঠাহর করিয়া দুই-তিন পা পিছনে চৌকাঠ ডিঙাইয়া ঘরের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন বিশ্বেশ্বর দত্ত। গ্রামের সন্ধ্যা নামিয়াছে, থমথমে বিষন্ন স্তব্ধতা যেন। ঘরের ভিতরের নিশ্ছিদ্র কালিমা বাহিরে ছিলোনা, দত্তবাবুর চোখ উঠোনে পড়িতেই বিস্মিত চোখে তাকাইয়া রহিলেন ... হৃৎপিণ্ড একবার লাফাইয়া উঠিলো। একটা দীর্ঘ মূর্তি যেন দাঁড়াইয়া আছে উঠোনে ... আদলটা ভীষণ, ভীষণ চেনা। এখানে এসময়ে এ কি করিতে আসিয়াছে?
—"কত্তা! কি কইরছেন গো এত সাঁঝে?"-- গলায় একরাশ বিদ্রুপ মিশাইয়া বলিল অবয়বটি।
নিকু! তাজ্জব ব্যাপার!
হতবুদ্ধির মতো দাঁড়াইয়া রহিলেন কয়েক লহমা প্রৌঢ় বিশ্বেশ্বর দত্ত ... সব তালগোল পাকাইয়া গেল নিমেষেই।
কয়েক মুহূর্তের চমক ভাঙিয়া বিশ্বেশ্বর দত্ত সামলাইয়া উঠিয়াছিলেন ততক্ষণে, সব হিসাব যেন মিলিয়া যাইতেছে হঠাৎ করিয়াই। অষ্পষ্ট যা কিছু, স্পষ্ট হইয়া যাইতেছে। ফাঁকা বাড়িতে নিঝুম সন্ধ্যায় নিকু কাজলীর কাছে বিশেষ প্রয়োজনেই আসিয়াছে। সুধন্য মিস্তিরির অভাগা বৌটি কি কিছু দেখিয়াছিলো, যা তাহার দেখা উচিত হয় নাই? কিন্তু রেপ? নিকু কি তবে অসহায়তার শেষ সুযোগটুকু কাজে লাগাইয়া এই ঘৃণ্য কাজটি করিতেও পিছপা হয় নাই! গায়ের রোঁয়া দাঁড়াইয়া গেল বিশ্বেশ্বর দত্তের। সুধন্যপুত্রটি অকর্মণ্য, সবদিকেই। কাজলী কেবলই ধোঁকা দিবার উদ্দেশ্যে নিকুর নাম নিয়াছিলো পুলিশের কাছে; সে জানিত সকল তীর জনার্দনের দিকেই যাবে শেষ পর্যন্ত! নিকুই কাজলীর সেই অদৃশ্য প্রেমিক! একটু আগেই ঘরে নিকুর নাম বলিতেই কাজলী "ও" বলিয়া অনুরাগ সম্বোধন করিয়াছিল ...হায় ভগবান! কিন্তু এই মুহূর্তেই এই জায়গাটা হইতে সরিয়া যাওয়া আশু প্রয়োজন ... অস্বস্তিকর অনুভূতি গ্রাস করিতেছে বিশ্বেশ্বর দত্তকে ...
তিনি বলিলেন,
—"এই একটু দরকার ছিলো রে নিকু। তা তুই এখন এখানে? তুইও কাজে এসেছিস বুঝি?"
পাল্টা বিদ্রুপ মিশাইয়া দিলেন বিশ্বেশ্বর দত্ত।
আবছায়া অন্ধকারেও নিকুর অবস্থানটা ঠিক কতদূরে, বিশ্বেশ্বর আন্দাজ করিতে পারিলেন। তাহার উত্তরের অনতিবিলম্বেই নিকুর সহিত বিশ্বেশ্বর দত্তের আলাপ ইস্তক যে শান্তশিষ্ট মুখোশটি ছিল, তা খসিয়া পড়িলো; তীব্র ঘৃণা আর রাগে সে প্রায় হিসহিস করিয়া বলিল,
—"শোন কত্তা, আর যাই করি, জেল খাইটতে পাইরবোক লাই ... আপনে যখন বুইঝিই লিইছেন, আপনাকে ছাইড়ি দিলে আমার সব্বোনাশ হয়ি যাবে গোওওওও ...."
মুখে ভয়ঙ্কর জান্তব শব্দ করিয়া একটা হিংস্র শ্বাপদের মত লাফ দিয়া নিকু দাওয়ায় উঠিয়া আসিলো, খাটো করিয়া পরা লুঙ্গির ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে বাঁশের বাখারি চাঁছিবার ঝকঝকে নতুন কাটারিটা ... দ্রুত পাশ কাটাইবার চেষ্টা করিলেন বিশ্বেশ্বর দত্ত ...
পরিশিষ্ট
পুলিশ রাতেই আসিয়া জনার্দন হালদারকে ধরিয়া ফেলিলো। এইবারে আর সে নড়িতে পারে নাই। হিংস্র সে নরপশুকে দেখিতে আশে পাশের গ্রামের লোকও জুটিয়া গেলো। তবে বিশ্বেশ্বর দত্তকে খুন করিয়াও জনার্দনের মুখে কোনো বিকার ছিলোনা, প্রকৃত খুনীর সব গুণাবলী আছে লোকটির মধ্যে। মার্ডার ওয়েপন্ কোথায় লুকাইয়া রাখিয়াছে, পুলিশ হাজার গুঁতাইয়াও সে খবর বাহির করিতে পারিলোনা। দু দুটো খুনের ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক আসামী ধরা পড়িল।
তবে পাশাপাশি দু-একটা ছোট ঘটনাও ঘটিয়া গেল, খুনখারাপির গনগনে আঁচে ততটা কেহই লক্ষ্য করিলনা। সুধন্য মিস্তিরির পুত্রবধূ আর স্বামীর ভাত খায় নাই, ঘর ত্যাগ করিয়াছিলো এবং নিকেতন মণ্ডল, বিশ্বেশ্বর দত্তের অনুগত ফাইফরমাশ খাটিয়া দেওয়া ছেলেটিও কয়দিন শোকসন্তপ্ত হইয়া থাকিয়া কোথায় চলিয়া গেল কেহ জানিলনা আর। হারুডাঙা আপন খেয়ালেই কয়েকদিনের ভিতরে স্বাভাবিক হইয়া গেল পুনরায়।
(পরবাস-৭১, ৩০ জুন ২০১৮)