Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines



পরবাসে
ভাস্কর বসুর

লেখা


ISSN 1563-8685




‘সত্যকাম’ – ছায়াছবিতে সত্য ‘রচনা’


-১-

সামগ্রিক ভাবে ভারতীয় এবং বিশেষ ভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে সাহিত্যের একটা দারুণ মেলবন্ধন আছে। এই সম্পর্ক এক বিশেষ মাত্রা পায় যাঁর হাতে তিনিই বাংলা এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে।

তবু খোদ সত্যজিতেরও এই পথচলা কিন্তু পুরোপুরি কুসুমাস্তীর্ণ নয়। আসলে ‘ঘটে যা তা সব’ সত্য নয়, রবি-ভাষ্যে সত্য ‘রচিত’ হয় লেখকের হাতে। আবার সাহিত্যের ‘সত্য’-কে চলচ্চিত্রায়নে কতটা স্বাধীনতা পরিচালক নিতে পারেন, এই নিয়ে স্বয়ং সত্যজিৎকেও চূড়ান্ত বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘অপরাজিত’-তে লীলার অনুপস্থিতি, 'চারুলতা'-তে অশোক রুদ্রর সঙ্গে তুমুল বাদানুবাদ, 'চিড়িয়াখানা'-তে শরদিন্দুর বিরাগভাজন হওয়া, 'অরণ্যের দিনরাত্রি'-তে খোদ সুনীলের অভিমান, জীবনের শেষপর্বে ইবসেন বিচ্যুতি - অনেক ঘটনাই আমাদের জানা। জনশ্রুতি, কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমা করে খুব তৃপ্তি পেয়েছিলেন, কারণ কাহিনী ছিল তাঁর নিজস্ব কাজেই এখানে কেউ আর তাঁকে সেরকমভাবে বিচ্যুতির দায়ে দোষারোপ করতে পারবেন না।

শুধু সত্যজিৎ-ই বা কেন? “দাদাঠাকুর” শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের জীবনী নিয়ে যে কাহিনি হয় তা নাকি তাঁকে খুশী করতে পারেনি। অথচ সিনেমাটি একাধারে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং একই সঙ্গে তুমুল জনপ্রিয়। শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখছেন, ছবি বিশ্বাসের স্মৃতি রোমন্থনে,-

“চরিত্র ধরলে ধরতেই হয় ‘দাদাঠাকুর’-এর দাদাঠাকুর। যদিও যাঁর চরিত্র ভিত্তি করে ছবি সেই দাদাঠাকুরের পছন্দের হয়নি এই দাদাঠাকুর, তবু বাঙালি দর্শক বেজায় মুগ্ধ হয়েছিল তাদের প্রিয় ছবি বিশ্বাসের এই অপূর্ব বিবর্তনে।”

সত্যজিৎ-এর ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ কিন্তু সিনেমা হিসেবে খুবই আকর্ষণীয়। সত্যজিৎ-এর নিজের খুব প্রিয় এর ভাষা এবং চিত্ররূপ। লিখেছেন, “চিত্রভাষার দিক দিয়ে আমার মতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি যদিও এ ছবি এদেশে বিশেষ সমাদর পায়নি।”

লেখক সুনীল জানিয়েছিলেন যে তিনি জানেন, চলচ্চিত্র হিসেবে এটি খুব উঁচু মানের, বিভিন্ন ফিল্ম শিক্ষাঙ্গনে তা দেখানো হয় পাঠ্য হিসেবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, বিভিন্ন লেখাতে ও সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, যে কাহিনীর এই রূপান্তর তিনি মেনে নিতে পারেননি।


-২-

অশোক রুদ্রর চিঠির প্রত্যুত্তরে লেখা তাঁর চিঠিটিতে সত্যজিৎ খুব সুন্দরভাবে সাহিত্য আর সেই সাহিত্য অবলম্বনে রচিত ছবির সম্পর্ককে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সেই চিঠির বিষয়বস্তু কোন সাহিত্যানুরাগী চিত্রপরিচালকের কাছে বেশ কিছু নতুন তাৎপর্য নিয়ে আসতে পারে। যেমন গল্পের পরিণতিতে বিচ্ছেদকে কিভাবে দেখানো যেতে পারে দুই মাধ্যমে – তা বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে –

“এ দৃশ্যে তাই হাত মিলতে পারে না। ভবিষ্যতে মিলবে কি? জানিনা। জানার প্রয়োজন নেই। রবীন্দ্রনাথও জানার প্রয়োজন বোধ করেননি। আজকের মত ঘর ভেঙে গেছে, বিশ্বাস ভেঙে গেছে, ছেলেমানুষি কল্পনার জগৎ থেকে রূঢ় বাস্তবের জগতে নেমে এসেছে দুজনেই। এটাই বড় কথা। এটাই নষ্টনীড়ের থীম।”

পরিশেষে তাঁর আত্মসমর্থনে সবথেকে চূড়ান্ত, প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য – “আমার মতে চারুলতাতে এ থীম অটুট রয়েছে।”

এই কথাটি আমাদের মর্মমূলে গেঁথে যায়। অর্থাৎ যখন কোন পরিচালক কোন সাহিত্যাশ্রিত চলচ্চিত্র করতে উদ্যত, তাঁকে অবশ্যই এই ‘থীম অটুট’ রাখার ভাবনাটি মাথায় রাখতে হবে। অর্থাৎ অনেকটা কাহিনীকার পরিচালকের প্রতি এক অলিখিত আর্জি জানাতে চান, রবিঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে-
“আমার পরানে যে গান বাজিছে, তাহার তালটি শিখো—তোমার চরণমঞ্জীরে।”

কাহিনীর কিছু পরিমার্জন অবশ্যই করতেই পারেন, দুই মাধ্যমের তফাতের কথা মাথায় রেখে – তা অনেক সময়ই শিল্পসম্মত। কিন্তু মূল থীমকে পাল্টানো চলবে না কারণ তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে লেখক সৃষ্ট আখ্যানটির আত্মা। আর বাহ্যিক পরিবর্তন করা যেতে পারে, কিন্তু মূল আত্মাটিকে পাল্টানো – নৈব নৈব চ!


-৩-

প্রখ্যাত লেখক আর কে নারায়ণের “গাইড” অবলম্বনে সৃষ্ট নবকেতন ফিল্মসের ‘গাইড’ ছবিটিতেও অনুরূপ সমস্যা হয়েছিল। সিনেমাটি ভীষণভাবে সমাদৃত ভারতে ও ভারতের বাইরে। কিন্তু লেখক একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সিনেমাটি দেখে তিনি সর্বসমক্ষেই জানিয়েছিলেন যে ছবিটি তাঁর মনঃপূত হয়নি কারণ সেটি তাঁর কাহিনীর থেকে আলাদা। ফিল্মে কাহিনীর চরিত্রায়ন, গতি-প্রকৃতি থেকে উপসংহার, সব কিছুই ভীষণভাবে আলাদা ছিল। বিখ্যাত “Life” ম্যাগাজিনে তিনি এক প্রবন্ধ লেখেন। তা নিয়ে ম্যগাজিনের কভারস্টোরি-ও হয় – “How a Famous Novel Became an Infamous Film”

এই নিয়ে সাধারণের মতানৈক্যও প্রবল ছিল। 'গাইড' ইংরেজি ও হিন্দি দুই ভাষাতেই হয়েছিল। ইংরেজির চিত্রনাট্য লেখেন নোবেলজয়ী লেখিকা পার্ল বাক। তা মোটামুটিভাবে আর কে নারায়ণের গল্পকেই অনুসরণ করে হয়েছিল। হিন্দি সংস্করণটির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন পরিচালক বিজয় আনন্দ। এখানে তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাহিনীর পরিবর্তন করে ভারতীয় জনতার উপযোগী করে তুলতে চেয়েছিলেন। অথচ ইংরেজি সংস্করণ একেবারেই দর্শকগ্রাহ্য হল না। তুলনাতে হিন্দি সংস্করণটি আশাতীত সাফল্য লাভ করেছিল। ষাটের দশকের শেষাশেষি ভারতীয় জনতা যে এইভাবে এক আধুনিক কাহিনীকে মেনে নেবে তা কেউ ভাবতে পারেননি। কেউ কেউ বলেন যে এটাও হয়ত নারায়ণকে আঘাত করে থাকবে। তাঁর প্রত্যাশা ছিল বিপরীত, হয়তো এই কাহিনীর মাধ্যমে তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতিরও তিনি আশা করে থাকবেন। সেই হতাশা থেকেই তিনি “Life” ম্যাগাজিনে ঐ বিখ্যাত প্রবন্ধ লেখেন।

দেবানন্দ কিন্তু তাঁর তরফ থেকে সবসময় আর কে নারায়ণ সম্পর্কে শ্রদ্ধার মনোভাবই পোষণ করেছেন। ২০০১ সালে নারায়ণের মৃত্যুর পর শোকপ্রকাশ করে বলেছিলেন--
“If only we had managed to ignore the commercial aspects, Guide could have made a milestone in the history of cinema…and the author would have been a happier man”

এবার মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে আমরা একটু আলোচনা করতে চাই উপরে উল্লিখিত ‘গাইড’ সিনেমাটি নিয়ে। মূল বইটি নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে ও হচ্ছে। এমনকি বইটি পাঠ্য বই হিসেবেও পঠিত হয়। বিভিন্ন আলোচনাতে বইটির বেশ কিছু ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে। আমরা বইটি ও ছায়াছবি – দুটোকেই নিয়ে একটু আলোচনা করব। ভাবতে চেষ্টা করব মূল বইটি অনুসারে যে ছবিটি হয়েছিল, তাতে এই “থীম অটুট রয়েছে” কিনা।

সাহিত্যের এক অনুরাগী পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে যে লেখক বইটিতে এমন এক মানুষের জীবনযাত্রার কথা বলতে চেয়েছেন যে জীবনে চটজলদি সাফল্য চেয়েছিল। তার জন্য ঘোরালো রাস্তার সাহায্য নিতেও সে দ্বিধাহীন। খুব অগভীর চরিত্রের এই মানুষটিকে এক দিগদর্শক হিসেবে কাহিনীর নায়ক করে তিনি কিন্তু একটু চমকই দিয়েছেন। অন্যদিকে কাহিনীর নায়িকা কিন্তু প্রকৃত শিল্পী। তার কাছে নাচ প্রায় পূজার সামিল। সেই নাচের জন্য সে তার স্বামীকে ছাড়তেও দ্বিধা করেনা। পাঁচের দশকের উপন্যাস হিসেবে এক সম্ভ্রান্ত গৃহবধূর এরকম এক নামগোত্রহীন মানুষের সঙ্গে ইলোপ করাও বড় সাহসী মনোভাবের পরিচয়। কিন্তু নায়িকা নির্দ্বিধায় বেছেছিল। এই পথে যেতে রাজুকে চেয়েছিল তার “পথপ্রদর্শক” বা “গাইড” রূপে। যে বুঝবে তার শিল্পকলাকে, যে সত্যিকারের তার আপন সাথী, বন্ধু হবে। তার জন্য নায়িকা রোজির চেষ্টার ত্রুটি ছিলনা। রাজুকে সে শিল্পের পাঠ পড়িয়ে শিল্পের বড় সমঝদার করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই পথে যেতে রাজু পিছিয়ে পড়ল। তার কাছে শিল্পের বহিরঙ্গ বড় হয়ে ধরা দিল, শিল্পের মান, আড়ম্বর, জাঁকজমক তার মন কেড়ে নিলো। এই মোহ তার মধ্যে অদ্ভুত অপরাধপ্রবণতার জন্ম দেয়। সে পাপের ফলও তাকে ভোগ করতে হয়। কারারুদ্ধ হয়ে এবং মুক্তি পেয়েও গভীর অনুশোচনাতে তার জীবন কাটে। মোটামুটিভাবে এটি কাহিনীর মূল থীম।

ছায়াছবি একটি ‘চাক্ষুষ’ মাধ্যম। স্বাভাবিক ভাবেই তা সাহিত্যের চেয়ে বেশী জনপ্রিয় এবং সেজন্য তার প্রভাবিত করার ক্ষমতা অনেক বেশী। সর্বোপরি ফিল্মের আর্থ-সামাজিক দিকটি উপেক্ষা করা খুব শক্ত। সময়টা ষাটের দশকের গোড়ার দিক আর দর্শকরা সনাতন ভারতীয় মূল্যবোধে ভীষণ ভাবে জারিত। সেই কথা মনে রেখে চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক বিজয় আনন্দ যখন চিত্রনাট্য রচনা করেন তখন তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন দর্শকের মূল্যবোধকেই।

ফলে গাইড-এর দুই নায়ক-নায়িকার অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা, নায়কের ভ্রান্ত দর্শন, বা নায়িকার শিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগ, সেই কারণে ঘর ছাড়া, আবার পরিত্যক্ত স্বামীর জন্য গভীর অনুশোচনার বৈপরীত্য--কাহিনীর এই অসাধারণ দ্যোতনা যেন পর্দায় প্রাণই পেল না। তার বহিরঙ্গের জৌলুষ বড় হয়ে দেখা দিল। দর্শকদের আকর্ষণ করতে গিয়েই এই রকমফের ঘটাতে হয়েছিল পরিচালক, প্রযোজককে। ওপরে দেখেছি দেবানন্দ তা মেনেও নিয়েছেন অকুণ্ঠচিত্তে। কিন্তু সেখানেই তার কেটে গেল, ‘থীম অটুট’ আর রইলো না। স্বয়ং নারায়ণ বলেছেন, তাঁর আত্মজীবনী, “My Days”-এ--
“I did not expect the heroine, the dancer, to be more than a local star, but the film heroine became a national figure whose engagements caused her to travel up and down hundreds of miles each day in a Boeing 707 ---

এই প্রসঙ্গে একথা সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে সত্যজিৎ রায় গাইড করবেন ভেবেছিলেন। আর কে নারায়ণ-এর সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। আর ওয়াহিদাকে গাইড বইটি পড়ার পরামর্শও তিনিই দেন। এক সাক্ষাৎকারে ওয়াহিদা স্বয়ং এই কথা জানিয়েছিলেন যে সত্যজিৎও রোজি-রূপে ওয়াহিদাকেই চেয়েছিলেন--
“It was Mr. Ray who asked me to read the novel (R K Narayan’s ‘Guide’) because he was considering adapting it. He told me if the film ever took off, he would cast me as Rosie. “She had to be a good dancer and he knew south Indians were usually good dancers, and so he had thought of me,” recalls Rehman about what would possibly have been a totally different approach to the novel had Ray been its director.”


-৪-

কিছু ভূমিকার পর আমরা এসে পড়েছি মূল বিষয়ে। ‘সত্যকাম’ বইটি নারায়ণ সান্যাল লিখেছিলেন ১৯৫৫ সালে। বইটি এক সত্যবাদী মানুষ ‘সত্যপ্রিয় আচার্য’র বিফল জীবনের কাহিনী। লেখক ও সত্যপ্রিয় ছিলেন সহপাঠী। সত্যপ্রিয়র জন্ম যে-বংশে সেখানে সত্যবচন শুধুমাত্র মৌখিক আদর্শ নয়, একেবারে অবশ্যপালনীয় ধর্ম। সেই বংশের ছেলেদের নামকরণও হয় ‘সত্য’ দিয়ে। সত্যপ্রিয় সারা জীবন সেই ব্রত পালন করেছে, এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এক বছর সে পেছিয়ে পড়ে শুধু এই কারণেই। কিন্তু তাতেও তার মনোভাবে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। তার পিতামহর কাছে ধর্মরক্ষার যে প্রতিশ্রুতি সে করে এসেছে তাকে যে-কোন মূল্যে রক্ষা করতে প্রস্তুত।

ছাত্রজীবন শেষ করে চাকরী জীবনে আরো বেশী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সত্যপ্রিয়কে। সেখানে তো “চালাকির দ্বারাই মহৎ কার্য” সম্পাদিত হয়। তার ফলে চাকরি জীবনে ছেদ পড়তে থাকে বারংবার। অবশেষে একটি চাকরিতে গিয়ে সে এক বিরাট বিপদের সম্মুখীন হয়। এক বিপর্যয় থেকে এক নারীকে উদ্ধার করতে গিয়ে তার জীবনের ভার নিতে হয়। তারপরেও তার জীবন চলে সংঘাতপূর্ণ ভাবে। তার অনমনীয় মনোভাব তাকে বারংবার চাকরি পাল্টাতে বাধ্য করে। নিয়তি তার সঙ্গে আরো মজা করে যখন ধরা পড়ে সে দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত। এইবার জীবনে প্রথমবার সত্যপ্রিয়কে দ্বিধার সম্মুখীন হতে হয়। তার মৃত্যুর আগে সে এক বড় মিথ্যের সঙ্গে আপোষ করে, শুধু তার স্ত্রী, পুত্রের মুখ চেয়ে। সে একটি মিথ্যা কাগজে স্বাক্ষর করে। নায়কের মৃত্যুর পর তার ঠাকুর্দা সেই কাগজটি দেখতে পান, আর সেটি ছিঁড়ে ফেলে বংশের মান-মর্যাদা রক্ষা করেন।

পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় যথাসম্ভব কাহিনীর মূল কাঠামোটি বজায় রেখে শেষ দৃশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটান।

তাঁর চিত্রনাট্য অনুসারে নায়কের মৃত্যুর আগেই স্ত্রী ঐ কাগজখানা দেখে ফেলবে এবং সে নিজেই কাগজখানা ছিঁড়ে ফেলবে। কাহিনীতে আভাসে বলা আছে যে, ঘটনাচক্রে সত্যরক্ষার্থে সত্যপ্রিয় বিয়ে করলেও তাঁর স্ত্রীকে কখনোই যোগ্য সহধর্মিণীর মর্যাদা দেয় নি। স্ত্রীকে এভাবে স্বামীর মর্যাদা রক্ষা করতে দেখে মৃত্যুশয্যায় সে তার ভুল বুঝতে পারবে। আনন্দে আবেগে, সে স্ত্রীকে বুকে টেনে নিতে যাবে আর সেই ক্ষণিকের উত্তেজনাতে তার মৃত্যু ঘটবে।

কাহিনীকার তাঁর যুক্তি পেশ করেছিলেন -- এ যুদ্ধ সত্যপ্রিয়র সঙ্গে মিথ্যার নয়, এ সংগ্রাম আচার্য বংশের পাঁচপুরুষের সত্যধর্ম বনাম অসত্য। সত্যপ্রিয় হয়ত সাময়িক পরাজয় বরণ করেছিল, তার চূড়ান্ত জয় এল তার ঠাকুর্দার হাত দিয়েই। সেটাই কাহিনীকার দেখাতে চেয়েছিলেন।

পরের অংশ লেখকের নিজের কথায়--
“হৃষীবাবু উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন-- ‘আপনি কি দেখাতে চেয়েছিলেন সেটা বড় কথা নয়, নারায়ণবাবু-- তার চেয়ে অনেক – অনেক বড় কথা দর্শক কি দেখতে চাইছে। তার কাছে পাঁচপুরুষের ঐ তথাকথিত ঐতিহ্যটা গৌণ, মুখ্য আবেদন হচ্ছে নায়ক নায়িকার জীবন সংগ্রাম। আপনি লেখক হিসাবে এখানে অত্যন্ত কৃপণ, অত্যন্ত নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছেন। কি দিয়েছেন সত্যপ্রিয়কে? বলুন লোকটার অপরাধ তো মাত্র একটাই: সে সৎ। মরবার আগে একটা সান্ত্বনা তাকে নিয়ে যেতে দিন।’

"মনে আছে একথায় একটু বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। তবে কি আমিই অবিচার করেছি সত্যপ্রিয়ের প্রতি! সত্যিই তো – কি ক্ষতি হয় যদি সে মৃত্যুর আগে জেনে যায় যে তার হার হয়নি, জেনে যায় – রঞ্জনা তার উপযুক্ত সহধর্মিণী ছিল?

'- তা ছাড়া রিঙ্কুর কথাটাও ভেবে দেখুন! তার চরিত্রের ‘কালমিনেশন’ আপনাকে দেখাতে হবে না?'

'- রিঙ্কু! রিঙ্কু আবার কে?'

'- আমি শর্মিলার কথা বলছি – মানে আপনার নায়িকা, রঞ্জনা!'

"আবার ভাবতে থাকি।

"হৃষীবাবু দৃঢ়স্বরে বললেন, 'না, না আমি আপনার সঙ্গে একমত নই। ওখানে সিকোয়েন্সটা ওভাবেই সাজাতে হবে।'

"উনিই যে ঠিক, আমিই যে ভুল – এটা সেদিন ঠিকমত বুঝিনি; বুঝেছিলাম অনেক পরে। ছবিটা দেখতে দেখতে।” ৮

এরপর ছবি মুক্তি পেয়েছে। কলকাতায় চলছে সদর্পে। কোন কারণে প্রিমিয়ার শো দেখা হয়নি। এমনকি কলকাতাতেও কাজের চাপে দেখা হয়ে ওঠেনি। ওদিকে কর্মসূত্রে নারায়ণবাবুর জাপান যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে। জাপান থেকে ফিরে আসার পর যদি চলে যায়? কোনক্রমে একদিন ব্যবস্থা করে সপরিবারে গেলেন সিনেমা দেখতে। কিন্তু বিধি বাম, হাউস-ফুল! এমনকি অগ্রিম টিকিটও সব বিক্রি হয়ে গেছে। ভগ্ন-মনোরথ হয়ে ফিরে আসছিলেন, হঠাৎ আবির্ভাব এক ব্ল্যাকারের। রফা করে টিকিট কিনে ফেলতে যাচ্ছিলেন –-

“হঠাৎ নজরে পড়ল অপর দেওয়ালে একটা পোস্টার: মৃত্যুশয্যায় শায়িত সত্যপ্রিয় আচার্য দু-হাত বাড়িয়ে তার ধর্মপত্নীকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছে। চরম সর্বনাশের সম্মুখীন হয়েও ওর স্ত্রী অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেনি।

"থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি আমি। --------

"করুণ স্বরে বলি, আমার শেষ কথাটা যে তোমাকে বোঝাতে পারব না ভাই! ‘ব্ল্যাকে’ টিকিট কিনে আমি ‘সত্যকাম’ দেখতে পারব না।

"লোকটা আমাকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিলো। তারপর একটি স্বগতোক্তি ঝাড়ল, আজীব চিড়িয়া! মানুষ না পায়জামা?

"তিরস্কৃত সত্যকামের বাপ তখন হনহনিয়ে চলতে শুরু করেছে। শুনতে পাচ্ছি লোকটা পিছন থেকে একটি দার্শনিক উক্তি করছে: ‘কত কিসিমের পাগলই না পয়দা করেন ভগবান।’”

আমার মনে হয় একজন কাহিনীকারের কাছ থেকে এরকম দরাজ শংসাপত্র খুব কম পরিচালকের ভাগ্যেই জুটে থাকবে। এক্ষেত্রে প্রশংসা প্রাপ্য লেখক ও পরিচালক দুজনেরই। লেখক বুঝেছিলেন যে পরিচালক ছবির ‘থীম’ বা মূল আত্মার একেবারে কাছে পৌঁছে গেছেন। এছাড়াও পরিচালক তাঁর মাধ্যমের শক্তি সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিবহাল। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে সিনেমার মতো ‘দৃষ্টিবাহিত’ মাধ্যমে সত্যপ্রিয়র এই আচরণ যে চূড়ান্ত অভিঘাত দর্শকের মনে তৈরী করবে তা অনবদ্য।

দুটি মাধ্যমের তফাতের কথা এখানে আমরা একটু ভাবতে পারি।

‘চারুলতা’ গল্পের থেকে চিত্রনাট্য রচনার ব্যাপারে যে তফাৎ থাকে তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সত্যজিৎ বলেছিলেন,
“আগেও বলেছি, আবার বলছি, ভাষার গুণে পড়ার সময় এসব খটকা মনে লাগেনা। কিন্তু চিত্রনাট্য রচনার প্রয়োজনে যখন মূল কাহিনীর নির্মম বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়, যখন চরিত্রগুলিকে রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে কল্পনা করতে হয়, গল্পের পরিবেশ চোখের সামনে মূর্ত করে তুলতে হয়, সময়ের পরিষ্কার সূত্র ধরে ঘটনাবলীর একটা ধারাবাহিকতা তৈরী করতে হয় – তখনই এ জাতীয় ত্রুটি চোখে পড়ে। কাহিনীর অদলবদল যে হয় তা এ কারণেই – খামখেয়ালবশত নয় বা পরের কাহিনীর ভিত্তিতে ছবি তৈরী করে মৌলিক রচনার বাহবা নেওয়ার জন্য নয়।”১০

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে খোদ হৃষীকেশ ছিলেন ভীষণভাবে সত্যজিৎ-ভক্ত। কাজেই স্বাভাবিক ভাবেই তিনিও এই একই পথের পথিক। ‘তখনই এ জাতীয় ত্রুটি চোখে পড়ে’ – তাঁর পড়েওছিল।

‘সত্যকাম’ উপন্যাসটি শেষ হচ্ছে এভাবে,--

“তর্করত্ন একহাতে জড়িয়ে ধরেছেন তাঁর সত্যকামকে। অন্য হাতে রঞ্জনাকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন: --না দিদি এখনই বের হলে রাতের গাড়িটা ধরা যাবে। যাও চট করে তৈরী হয়ে নাও তোমরা।

বিস্ময়াহত রঞ্জনা বলে: আমরা?

বৃদ্ধ তার জবাবে আমাকে বলেন: কই সে কাগজখানা কই?

মন্ত্রমুগ্ধের মত টাইপ করা কাগজখানা বাড়িয়ে ধরি আমি। নব্বই বছরের নৈয়ায়িক কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন সেখানা।

দশরথ দাঁড়িয়ে ছিল পাশেই। তাকে বলেন; হাতে একটু জল দে তো বাবা!

দশরথ ঘটি থেকে জল ঢেলে দিল।

বৃদ্ধ নোংরা হাতটা ধুয়ে ফেললেন।”১১

উপন্যাসে পঠন কালে এর এক অন্য অভিঘাত থাকবে। ‘তর্করত্ন’, ‘নব্বই বছরের নৈয়ায়িক’, ‘নোংরা হাতটা’ – ইত্যাদি আমাদের পাঠকের মনে যে অনুরণন তোলে তা কিন্তু দর্শনকালে তোলা সম্ভব নয়। অথচ ‘সত্যপ্রিয়’ র জীবনে ক্ষণিকের মূঢ় মিথ্যাপ্রিয়তা এবং তার থেকে তার মুক্তিলাভই কাহিনীর ক্লাইম্যাক্স। এই মুহূর্তকে অনেক ভালোবাসা, অনেক যত্নে সাজাতে হবে যাতে তা সিনেমা দর্শকের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই করেছিলেন পরিচালক।

সিনেমাতে দৃশ্যটি ছিল এই রকম - মৃত্যুশয্যাতে শায়িত সত্যপ্রিয় তার স্ত্রীকে সেই কাগজটি যখন তুলে দেয়, স্ত্রীর চোখে পড়ে সেই মানুষটির স্বাক্ষর! সারা জীবন সে মিথ্যার সঙ্গে লড়ল, শেষ শয্যায় তাকে হার স্বীকার করতে হচ্ছে তার আদর্শের সাথে? এ যেন মানুষটি তার নিজের মৃত্যুদণ্ডে নিজেই স্বাক্ষর করল। তার স্ত্রী ও শরাহত! সাশ্রু নয়নে তাকে বলে, ‘যে তুমি শুধু আমার কথা ভেবে এই আপোষ করছ – না এ আমি পারব না হতে দিতে!’ তারপরই সে নিজের হাতে কাগজটি ছেঁড়ে এবং মৃত্যুপথগামী সত্যপ্রিয়কে তার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখে বলে –‘তুমি জানতে না, এ কাগজ আমি ছিঁড়ে ফেলব, আমি তোমাকে হারতে দেব না?”

বলা বাহুল্য, দ্বিতীয় অংশের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে আমাদের মন অনেক বেশীমাত্রায় আলোড়িত হয়। সত্যজিৎ যা বলেছিলেন, ‘যখন চরিত্রগুলিকে রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে কল্পনা করতে হয়, গল্পের পরিবেশ চোখের সামনে মূর্ত করে তুলতে হয়’ -- তার অসাধারণ এক প্রয়োগ এখানে আমরা লক্ষ করি।

শুধু আমরা, দর্শক বা পাঠকরাই বা কেন, খোদ লেখকই তো বলছেন, - “তিরস্কৃত সত্যকামের বাপ তখন হনহনিয়ে চলতে শুরু করেছে।” এই ‘তিরস্কৃত’ শব্দটি আমাদের মুগ্ধ এবং অভিভূত করেন। এখানে যেন আসল পিতা স্বীকার করে নিচ্ছেন পালিত পিতার কাছে তাঁর পরাজয়ের কথা, বড় আনন্দের সেই পরাজয়। “উনিই যে ঠিক, আমি ই যে ভুল – এটা সেদিন ঠিক বুঝিনি; বুঝেছিলাম অনেক পরে। ছবিটা দেখতে দেখতে।”

তাঁর “সাহিত্য এবং সিনেমা” প্রবন্ধের উপসংহারে সাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্র পরিচালক পূর্ণেন্দু পত্রী খুব প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছেন--
“--সাহিত্যের ভাষাকে অন্য মাধ্যমে রূপান্তরিত করার জন্য সবার আগে যা প্রয়োজন তা হলো এমন এক অনুভূতিশীল ব্যক্তিত্বের যিনি ‘সেম কাইন্ড অব পারসেপশন’-এর যোগ্য। এবং যিনি লেখকের অক্ষরের দিকে না তাকিয়ে তাকাবেন তাঁর মূল অভিপ্রায়ের দিকে। আর ভাষার অসীম ক্ষমতার প্রমাণ ঘটে তখনই যখন তা শুধু একের কথা অন্যকে জানায় না, অন্যের মধ্যে সঞ্চার করে দেয় অনুভূতির, ধারণার, সৃষ্টির অন্তঃশীল স্পন্দন।”

বলাবাহুল্য, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে সেই অনুভূতিশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ‘সেম কাইন্ড অব পারসেপশন’ বিষয়ে তাঁর যোগ্যতা তর্কাতীত। আর পুরস্কার হিসেবে তিনি পেয়েছেন খোদ স্রষ্টার প্রাণঢালা প্রশংসা।

কোন মূল স্রষ্টার আর এক স্রষ্টার প্রতি এই দরাজ শংসাপত্র শুধু তাঁর উদারতার কথাই বলে না, অন্য স্রষ্টার অনন্য প্রতিভার এক অনবদ্য স্বাক্ষর হিসেবেও তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকে।

১ -- http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/%E0%A6%9C%E0%A6%B2%E0%A6%B8-%E0%A6%98%E0%A6%B0-1.46703

২ – বিষয় চলচ্চিত্র – অষ্টম মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর – ২০০৯ – পৃ = ১২৭

৩ – বিষয় চলচ্চিত্র – অষ্টম মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর – ২০০৯ – পৃ = ৯৯

৪ - http://www.rediff.com/movies/report/little-known-facts-about-guide/20111208.htm

৫ - http://maddy06.blogspot.in/2013/02/the-writer-showman-and-guide.html

৬ - My Days – R. K. Narayan, Indian Thought Publication, Birth Centenary Edition, Page - 197

৭ -http://indianexpress.com/article/entertainment/bollywood/satyajit-ray-wanted-to-make-guide-waheeda-rehman/#sthash.t2Q6nEyI.dpuf

৮ পঞ্চাশোর্ধ্বে– নারায়ণ সান্যাল – দে’জ পাবলিশিং, চতুর্থ সংস্করণ, আগস্ট ২০১২ – পৃ – ১৩১ - ১৩২

৯ পঞ্চাশোর্ধ্বে – নারায়ণ সান্যাল – দে’জ পাবলিশিং, চতুর্থ সংস্করণ, আগস্ট ২০১২ – পৃ – ১৪২ - ১৪৩

১০ বিষয় চলচ্চিত্র – অষ্টম মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর – ২০০৯ – পৃ = ৯৮

১১ সত্যকাম – নারায়ণ সান্যাল – করুণা প্রকাশনী, নবম মুদ্রণ, এপ্রিল ২০১৫ – পৃ – ১৭৬

১২ – সিনেমা সংক্রান্ত, পূর্ণেন্দু পত্রী, দেজ পাবলিশার্শ, জুলাই, ২০০৫ পৃ = ২৪




(পরবাস-৭১, ৩০ জুন ২০১৮)



সব ছবিগুলিই ইন্টারনেট থেকে গৃহীত