পার্কটি অন্যান্য বড় শহর থেকে বেশ দূরে। সব থেকে কাছের শহর সুন্দর দিউ। সেখান থেকে গাড়িতে ঘন্টা দুয়েকের পাড়ি। আমরা গেছিলাম জামনগর থেকে — প্রায় পাঁচ ঘন্টার রাস্তা, তবে মন্দ নয়। বেশি ভিড় নেই। আরামসে দু’ধারে কাঁটাবন, ছোট ছোট গাঁ, রাস্তার ধারে গুজরাটি ধাবা — যেখানে গাছের ডাল থেকে খাটিয়া ঝুলিয়ে পথ ক্লান্ত যাত্রীদের দিবানিদ্রার ব্যবস্থা। এই সব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম সাশানগিরি জেলায় বনের রাজার রাজত্বে।
ইদানীং গিরের আশে পাশে অনেক নতুন ট্যুরিস্ট হোটেল ও রিসর্ট তৈরি হয়েছে। অবস্থাপন্ন চাষীরা নিজেদের জমিতে অনেক জায়গা নিয়ে বাগানবাড়ির মত বিরাট হোটেল তৈরি করেছেন। রাজের ফার্ম, শ্যামের ফার্ম, অম্বরের ফার্ম ইত্যাদি সব নাম। রাস্তার ধারে ধারে তাদের সরব বিজ্ঞাপন।
খাওয়া দাওয়ারও এলাহি ব্যবস্থা। ভারতীয় থেকে বিলিতী খানা--অর্ডার দিলেই গরম গরম রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসবে। আমরা ইচ্ছা ছিল স্থানীয় কাথিয়াওয়াড়ি-গুজরাটি খাবার টেস্ট করার। তাই আমরা ব্রেকফাস্টে পেলাম গরম হাতে-গড়া মেথি ঠেপলা--পরোটার মত, সঙ্গে সুখা আলু, পুরী ও নানা রকম আচার, চাটনির সম্ভার। দুপুরের খাওয়ায় দিল ভর্তু (বেগুনের ভর্তা), খিচড়ী, ও সঙ্গে দইয়ের কারি। পাতের পাশে এক বাটি গাওয়া ঘি--খিচুড়িতে ঢালবার জন্য। প্রচুর ঘি। দেখলাম সব কিছুতেই ঘি দেবার প্রচলন। আর খাবার তো সবই নিরামিষ।
পুরনো ব্রিটিশ জমানায় গিরের জঙ্গল ছিল জুনাগড়ের নবাবদের শিকারভূমি। চুটিয়ে ব্রিটিশ ও নবাবী শিকারের ফলে সিংহের সংখ্যা মাত্র কুড়িতে পৌঁছেছিল। ব্রিটিশরাই সংরক্ষণের কাজ শুরু করে। ১৯৬৫-তে ভারত সরকার জাতীয় পার্কের উদ্বোধন করেন। তখন সিংহ সংখ্যা মাত্র ১২৫। সম্প্রতিকালে ২০১০ ও ২০১৫ পরিসংখ্যায় দেখা যায় সিংহের সংখ্যা ২৭% বেড়ে গেছে। ভারতের অন্যান্য পার্কের তুলনায় এ এক অতুলনীয় সাফল্য। বর্তমানে এই ৫০০ বর্গমাইল পার্কে প্রায় ৫২৭ সিংহের বাস।
গিরের এক কোণে একটুখানি জমি আলাদা করে রাখা আছে। নাম দেবালিয়া। সেখানে বাসে করে আধঘণ্টার মধ্যে জঙ্গলে ঘুরে আসা যায়। টিকিট খুব সস্তা। যাঁরা জীপসাফারি করতে পারেন না তাঁদের জন্যই এই ব্যবস্থা। এটা একরকম দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার মতই কিন্তু কপাল ভাল থাকলে সিংহমামার দেখাও পাওয়া যেতে পারে।
একবার আমরা সবাই জীপে ঠেলাঠেলি করে ঝোপের মধ্যে একটা সিংহীর ছবি তোলার চেষ্টা করছি, হঠাৎ নজরে পড়ল জীপের ঠিক সামনেই একটা ল্যাপউইং এক পায়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে স্থির চোখে চেয়ে রয়েছে। ভাবটা যেন-- একবার আমার দিকেও তাকাও একটু!
আফ্রিকার সিংহদের তুলনায় গিরের সিংহের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে এরা মানুষখেকো নয়। সিংহদের সংখ্যা বেশ বাড়ছে। কোর এলাকা ছাড়িয়ে প্রায়ই এরা আশেপাশের গ্রাম, লোকালয়ে ঢুকে পড়ে ও দু-একটা গরু বা ছাগলও মেরে খায়। গাঁয়ের লোকেরা কিন্তু আশ্চর্যরকম ক্ষমাশীল। এরকম ক্ষতি তারা দেবীর বাহনের জন্য উৎসর্গ করা মনে করে। হয়ত এইজন্যই সিংহরাও গাঁয়ের লোকেদের প্রতি বেশ উদাস। এরকম পাশাপাশি সিংহ ও মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। (তা বলে জীপ থেকে নামবেন না কিন্তু।) দেশের অন্যান্য পার্কে বাঘ, হাতি, গণ্ডার ইত্যাদি সংরক্ষণের খবর খুব আশাপূর্ণ নয়। তাদের তুলনায় গিরের সিংহরা বেশ শান্তিতে আছে। হয়ত এইরকম সহাবস্থানই এদের ভবিষ্যতে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায়।
(ভ্রমণকাল---নভেম্বর ২০১৭)
(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)