Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines



পরবাসে ভবভূতি ভট্টাচার্যের লেখা



ISSN 1563-8685




গ্রন্থ-সমালোচনা

|| উস্রি নদীর ঝরনা দেখতে যাব। দিনটা বড়ো ... সুশ্রী! ||

Memories of Madhupur Mid-Century Vignettes from East of India —Samarendra Narayan Roy; Parabaas, USA; 2018; Cover & Illustrations: Dipankar Ghosh; Pp. 127+xv; ISBN: 978-1-946582-01-0

না, বিশ্রী নয় দিনটা—সুশ্রী। এই ‘নারায়ণী’ স্মৃতিকথাটির পৃষ্ঠা উল্টোতে উল্টোতে মনে হলো এমনটাই!

এমনই একটি বইয়ের কথা আগেও একবার পড়েছিলুম, না? দু’বছর আগে, পঁয়ষট্টি সংখ্যায়, এক অনুরণিতার রনন্‌-ঝনন্‌! কোনো বড়বড় কথা নেই, নেই কোনো দেখনদারি, কেবল নদীর মতো বহমান জীবনধারার পাশে থেকে তাকে দেখে চলা নির্ণিমেষ,—চাখা, লেখকের জীবনজিহ্বায়! সমরেন্দ্রবাবু সেই স্মৃতি উস্কে দিলেন। এমন ধাঁচের স্মৃতিকথা পড়ার এক আলাদা আকর্ষণ আছে। বিশেষত, যখন তাঁর এই স্মৃতিকথা এমন এক স্থান ও কালের যা আজ আর থেকেও নেই।

তদুপরি, এ’লিখন ‘নারায়ণী’ তো বটেই। সেটা কি, বুঝলেন না? বলবো।

*

ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বাঙালি (মূলতঃ, উচ্চবর্ণীয় হিন্দু-বাঙালি) এই ভারতীয় উপমহাদেশের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়েছিল, মূলতঃ শিক্ষকতা-ওকালতি-চিকিৎসার মতো বাবুকাজে। আর লাহৌর-সিমলা থেকে রেঙ্গুন যেখানেই সে গেছে, থেকেছে, নিজের ক্লাব-দুর্গাবাড়ি প্রতিষ্ঠা করে মূল জনজাতির থেকে বিচ্ছিন্ন (পড়ুন, উচ্চমার্গে) এক দ্বীপ তৈরি করে রয়েছিলো। ঠিক যেভাবে বৃটিশ এ’দেশের শাসক হয়ে থেকে এক জাত-উন্নাসিকতা নিয়ে ভারতীয়দের দেখে এসেছে, তেমনই তার পেটোয়া বাঙালিরাও, সে যুক্তপ্রদেশে হোক্‌ কি মধ্যে বা বেহারে, সেই সেই প্রাদেশিক মানুষের থেকে উচ্চে থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নিজেদের কোটি বজায় রেখেছে। ‘দেহাতী’, ‘উড়ে’, ‘খোট্টা’-দের প্রতি এই বাঙালির সর্বদাই এক তাচ্ছিল্য ছিল। এইজন্যেই মুঙ্গেরে বরদাদের ক্লাবে যেমন কোনো অবাঙালি দেখিনা, তেমনি উস্রিনদীর তীরে প্রো. শঙ্কুরও সাথী বাঙালি অবিনাশবাবুই, কোনো অবাঙালি চরিত্র নয়। বর্তমান তন্বী কেতাবটি প্রথমেই মনে ধরে যায় এই জাত্যাভিমানের নিগড়টি ভেঙে ফেলায়। যেমন তেমন নয়, বৃটিশ জমানার জজসাহেবের পৌত্র খেলতে খেলতে বড়ো হচ্ছে ভোলুয়া, রাবেয়া, আব্দুলদের সঙ্গে; বাঁশি বাজাচ্ছে, তীরধনুক ছুঁড়ছে সাঁওতালি সখাদের সাথে মিলে, আবার সেই বালকই আইজ্যাক টডহান্টারের বই খুলে অঙ্ক কষছে, পিতামহের কাছে জয়দেব-টেনিসন পড়ছে—এক অন্য উচ্চতায় তুলে দেয় এই ‘সামান্য’ স্মৃতিকথাকে। যে সময়কার গপ্প এ’, মোটামুটি সেই সময় নাগাদই ১৯৬০-এর দশক থেকে রাসডুনি সাহেব (Rousas John Rushdoony , 1916 - 2001) আমেরিকাতে প্রবলভাবে ‘home-school movement’-এর প্রচার করছেন। এ’বইটি ওঁর হাতে পড়লে বড্ড খুশি হতেন। মানুষের আসল শিক্ষা যে আশৈশব আহরিত হয় তার পরিবেশ থেকে, তার চারিপাশে ছড়ানো-ছিটনো মানুষজন থেকে (অর্থাৎ, কেবল প্রথাগত ইস্কুল থেকে নয়), তা অস্বীকার করা যায় নাকি? থামগুলো সেখানেই গড়ে ওঠে আবাল্য। থেকে যায়। যেমন বর্তমান লেখকও ভাবীকালে নামী ম্যানেজমেন্টগুরু হয়ে পড়লেও তাঁর মধুপুরী শিকড়টাকে ভোলেননি। আর তাই তো আজ এই কহানী পড়তে পেলুম।

*

অধ্যায়ের শিরোনামগুলি একটু উল্টে উল্টে দেখি... আব্দুল নারদ, ইউক্লিড, সরস্বতী পূজা, বিগ গেম, উইলার, ...অড়হর ডাল... আরও দুটো...। নাম চোখে পড়লেই পড়তে শুরু করে দিতে সাধ যায় না? দিই-ও। গড়গড়ে কলমের জোরে কখন যে চ্যাপ্টার কাবার! জানলুম, যে ১৯৬০-এর দশকেও, মানে ধর্মভিত্তিক ভারতবিভাগের দেড় দশক পরেও মধুপুর নামক বঙ্গসীমাসমীপস্থ এক বেহারী কসবাতে দল-কে-দল মুসলমান ছাত্র সরস্বতী পুজোর প্রসাদ পেতো পঙ্‌ক্তিভোজনে, নিরক্ষরতা যে তখনও নব্বইয়ের বেশি শতাংশ মানুষকে ঢেকে রেখেছিল সেটাকে স্বাভাবিকই ভাবা হতো, নাশতালিক (উর্দূ) হরফে হিন্দোস্তানী ভাষা লেখার বহুলপ্রচার ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন খর্ব খর্ব বিষয়ে তাবড় তাবড় লেখকরা কলম ধরেন না সাধারণত, ভাগ্যিস আইআইটি–রচেস্টার-শিক্ষিত সমরেন্দ্রবাবু ‘তাবড়ের’ মধ্যে পড়েন না হয়ত, তাই ধরলেন কলম ও আমাদের মতো অভাজনেরা এমন এমন স্বাদু বিষয় নিয়ে দু’কথা পড়তে পেল।

*

এই পরবাসের গ্র.স.-কলমেই যখন ‘নদীপথে’-র গল্প পড়েছি (সং. ৫৮), বা ‘আত্মজন’ (সং. ৫৩), বা ‘বাজার সরকার’ (সং. ৫৬) চারিভিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা মানুষজনের কথাই বড় উপজীব্য, বড় আকর্ষণীয় হয়ে উঠে এসেছে সেই সেই গল্পে। সেইটাই এমন ‘অখ্যাত’ ‘অখ্যাত’ লেখকদের লিখন ভালো লেগে যাওয়ার কারণ। এই বইটিতেও সেই ধারা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। নৈলে, ফুটবলপ্রেমী গোমস-চাচা, লাঠিয়াল গোলাম বা কামার ভোলুয়ার বাপের গল্প এতো ভালো লেগে যাবে কেন? পাঠশেষে ভাবি তাই, এ’ কি মধুপুরের গল্প, না তার মানুষের গল্প? শেষবিচারে, অবশ্য, সকল স্থানের গল্পই সেখানকার মানুষেরই গল্প। সেটাই যে যত উপজীব্য করে পেশ করতে পারে তার গল্প ততটাই উৎরোয়। সমরেন্দ্রনারায়ণ তাই এখানে পাশ, উইদ ডিস্টিঙ্কশন! আরও কত কত নতুন পাওয়া তথ্যের কথা আর না-ই বা বললাম। যেমন, বইয়ের পাশাপাশি এ. এচ. উইলারের অন্য (অলিখিত) সাপ্লাই-চেইন ব্যবসা, কতরকম রেল-ইঞ্জিনের কথা, যাত্রায় নারদ-সাজা আব্দুল মিঞা ওয়গরহ্‌ ওয়গরহ্‌ । ভাগলপুরের দাঙ্গা হয়ে গেছে এখান থেকে বেশি দূরে নয়, বেশি আগেও নয়, তবু সেই সময়েও হিন্দু-মুসলিম কেমন আনন্দে একসাথে মিলেমিশে বাস করতো মধুপুরে সেটা জেনেও আনন্দ লাগে।

*

বইয়ের প্রোডাকশনটি মনকাড়া। চমৎকার ছাপাই-বাঁধাই। মুদ্রণপ্রমাদ নিল্‌ (লিখনপ্রমাদ একটি, পৃ.১০৫, লাইন ১৫, প্রথম ‘was’টি)। ভিতরের ছবিগুলি বেশ, প্রচ্ছদটি তো বে-শ (যদিও ৯৯ পৃষ্ঠার ঐ উত্তমকুমারীয় ছবি অপ্রযুক্ত লেগেছে)। মধুপুর সেকালে উচ্চবিত্ত কলকাতাবাসীর পশ্চিমা চেঞ্জালয় ছিল, স্যর আশুতোষের ‘গঙ্গাপ্রসাদ হাউজ’-এর মত নামী হাউজ/পরিবার বেশ কিছু ছিল সেথায়। লেখকের পড়শী হিসেবে তাঁদের কিছু এনিকডোট পড়তে পেলে ভালো লাগত। যেমন, উস্রি নদীর ঝর্‌না-খ্যাত (বা, প্রো. শঙ্কু-খ্যাত) গিরিডি তো অনতিদূরেই। তারও কিছু খাস গল্প হলে বেশ হতো।

*

আমার কথাটি ফুরলো। তবে তো আর বলে দিতে হবে না, নিশ্চয়ই ধরতে পেরে গেছেন, সুধী পাঠক, কেন ‘নারায়ণী’ এ’বই। এ’ কেতাব পড়তে পড়তে অবধারিতভাবে আর কে নারায়ণ সাহেবের কিংবদন্তী ‘মালগুড়ি ডেইজ’ মনে পড়ে যাবে না, এমন পাঠক নেই।

আফশোষ কেবল, আমাদের রায়-সাহেব এতো পরে কলম ধরলেন?



|| আমি কবি হতে চাই ... যতক্ষণ না দ্রষ্টা হই ||

আর্ত্যুর র‍্যাঁবোঃ প্রিয় ২৫ —অনুবাদঃ তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী; প্রকাশনাঃ শব্দহরিণ, কলকাতা; প্রথম প্রকাশঃ ২০১৬; ISBN: নেই

সে-পুরনো সাফাই ফের দিইঃ নিজে কবিতা লিখতে না জানলে যদি কবিতার গ্রন্থ-সমালোচনা না করা যায় তবে স্যর নেভিল কার্ডাস তো ক্রিকেট নিয়ে লিখে ভুল করেছিলেন, বা নীলাক্ষ গুপ্ত সঙ্গীত নিয়ে [সংখ্যাঃ ৬৭]। সমালোচনা না হোক্, নিদেন কবিতাপাঠের আনন্দটা তো যে কোনো গোলা-পাঠকই উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করতে পারে, যদি সে কবিতা এক বিশ্বশ্রেষ্ঠ কবিরও হয় এবং এক অজানা ভাষায়। তবে? তবে আর কী? কাব্যানুবাদের সৃষ্টিই তো হয়েছিল এ’কারণে—একভাষার কবিতার স্বাদ আর-ভাষার পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তাতে, পাঠককে দুই ভাষাতেই পারদর্শী হয়ে তবে অনুবাদের রসাস্বাদন করতে হবে সেটা কে বল্লে? কাব্যপাঠসুখটাই প্রধান। সেই নিরিখে এই গ্রন্থ দশে আট পায়, কেবল পর-ভাষার এক অ-কবির কাছে র‍্যাঁবো-র রস পৌঁছে দিয়ে।

*


ছবিঃ অমিতাভ সেন
বয়সে রবীন্দ্রনাথের চাইতে সাত বছরের বড় (উদা. বা তুলনাটা জুতসই হলো না যদিও), ফরাসী কাব্যজগতে যখন তাঁর উদয়, বোদল্যারের কলমে ‘ডিকাডেন্ট মুভমেন্ট’ জোরদার ততদিনে, আর সতের থেকে একুশ (১৮৭১-১৮৭৫)—এই যে মাত্র সাড়ে তিনবছর কবিতা লিখে গেছেন আর্ত্যুর র‍্যাঁবো তাতেই প্রভাবিত করে গেছেন বিংশ শতকের একদল কবি-শিল্পী-সুরকারকে। র‍্যাঁবো সম্পর্কে এরচে’ বেশি জ্ঞান আর নাই এ কলমচি-র।

*

এবার দুটি কবিতা পড়বোঃ [আংশিক]

মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা,
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে , কবিদের সুখী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন
কী লাভ যুদ্ধ করে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন?
আধিপত্যে এত লোভ? ……….
……..সুধীবৃন্দ, তবু জীবনে কয়বার বলুন তো
আমরা আমাদের কাছে বলতে পেরেছি,
ভালো আছি, খুব ভালো আছি?

[কবিতাঃ 'জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন', কবিঃ আবুল হাসান], এবং


হায় ঋতু আর হায় দুর্গের প্রাসাদ,
ত্রুটিহীন কোন আত্মা আর নিষ্প্রমাদ?
হায় ঋতু আর হায় দুর্গের প্রাসাদ,
সুখের বিষয়ে ঐন্দ্রজালিক কার্য
যা নিয়ে আমার বিদ্যা, সে অপরিহার্য।
বেঁচে থাক নিয়ে আসে সে সুসমাচার
গল-এর মোরগ গান গায় যতবার।

[কবিতাঃ ‘হায় ঋতু, হায় দুর্গের প্রাসাদ’ , কবিঃ আর্তুর র্যাঁবো। অনুবাদঃ তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী]

সাতাশ বছর বয়সে প্রয়াত কবি আবুল হাসান (১৯৪৭ - ১৯৭৫ খৃ.) ছিলেন ‘কবিদের কবি’। তাঁর চেয়ে শতবছরের অগ্রজ র‍্যাঁবো (১৮৫৪ - ১৮৯১ খৃ.) যদিও আবুর চাইতে বছর দশেক বেশি বেঁচেছিলেন, তবু একুশ বছর বয়সের পর থেকে আর লেখেনইনি র্যাঁবো! আবুল হাসান র‍্যাঁবো পড়েছিলেন কিনা জানি না, তবু দু’জনের মূলসুর কোথায় যেন এসে মিলে যায়, র‍্যাঁবো এসে ছুঁয়ে যান পূর্বমহাদেশের এক অনুজ কবিকে।

*

বাঙালির ফরাসীচর্চার ধারা সুপ্রাচীন (উদা. জ্যোতি ঠাকুর)। র‍্যাঁবোর বঙ্গানুবাদও কম হয়নি, কবি লোকনাথ ভট্টাচার্য তাঁর মধ্যে প্রধান। সফিউদ্দিন আহমেদ, গৌতম গুহরায়, বিনয় বর্মণ প্রমুখ অনুবাদক-কবি প্রিয় ও মান্য বঙ্গানুবাদ করেছেন র‍্যাঁবোর । তৃণাঞ্জনের এই আলোচ্য বইটি এখানে লেটেস্ট সংযোজন।

*

(হয়তো, যথেষ্ট অনধিকার থাকা সত্ত্বেও) কাব্যানুবাদ সম্বন্ধে দু’কথা বলার আগে দুটি চিঠি সম্পর্কে লিখিঃ

ষোল বছরের কিশোর র‍্যাঁবো তাঁর কাব্যদর্শন নিয়ে দু’টি চিঠি লেখেন, ১৩ই মে ১৮৭১ তারিখে গুরু জর্জ ইজঁবার-কে, দ্বিতীয়টি পনের তারিখে কবিবন্ধু পল দ্যমেনি-কে। পত্রদুইটি বিশ্বকাব্যের ইতিহাসে ‘দ্রষ্টার পত্র’ বলে মান্য, যার খণ্ড খণ্ড হেথায় হোথায় পড়া ছিল। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ অনুবাদটি পড়ে অবাক বিস্ময়ে নত হই এই কিশোর প্রতিভার সামনে, যাঁর সুরেই শতাধিক বছর পরে এক বাঙালি কবি বলবেন, ‘শুধু কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি’। এই ‘দ্রষ্টার পত্র’দ্বয়ের সার্থক বঙ্গানুবাদের জন্যেই বর্তমান সংকলনটি প্রিয়বইয়ের আলমারিতে স্থায়ী আসন নেবে।

*

গ্রন্থ-সমালোচনাতে অনুবাদকের মেহনতী ফসল হুবহু তুলে দিলে তিনি অসন্তুষ্ট হতে পারেন জেনেও দু’একটি নমুনা এখানে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না (একটা তো ইতোমধ্যে দিয়ে ফেলেছি)ঃ

“একটাও বলব না কথা, ভাববো না কিচ্ছুটি নিয়ে;

সীমাহীন প্রেমভাব উঠে আসে আত্মার ভিতরে,

আমি দূরে চলে যাব, ভবঘুরে, বহু দূর গিয়ে,

প্রকৃতিতে ডগমগ, এক রমণীর হাত ধরে” [পৃ ২৭].

১৮৭০এ’ লিখিত ‘Sensation’ র‍্যাঁবোর এক বহুপঠিত রোমান্টিক কবিতা। এর প্রথম লাইনে sentier এর অনুবাদে তৃণাঞ্জন ‘শুঁড়িপথ’ লিখলেন, যেখানে অলিভার বার্নার্ডের মতো নামী ইঙ্গ-অনুবাদক শুধু path লিখে গেছেন। বেশ লাগল!

বা,

কবির প্রখ্যাত ‘ইল্যুমিসনেশন্স’ কাব্যগ্রন্থের ‘শৈশব’ কবিতাটিঃ

‘বনে আছে এক পাখি, তার গান তোমাকে থামিয়ে দেয়, তোমাকে আরক্তিম করে তোলে।/একটা ঘড়ি আছে যা বাজে না। একটা গর্ত আছে—শ্বেত পশুদের বাসা সমেত।/একটা ক্যাথিড্রাল আছে—যা নেমে আসে/একটা হ্রদ আছে যা উঠে যায়....’ ।

মন ছুঁয়ে গেল।

"Le bateau ivre" (‘মাতাল তরণী’) তো র‍্যাঁবো-র এক অতি বিখ্যাত ও বহুচর্চিত কবিতা।কিন্তু একশ’ পংক্তির এক দীর্ঘ কবিতা। পুরোটা এই তন্বী কেতাবে পাবার আশা ছিল না, কিন্তু পেয়ে ও পড়ে মাথা নুইয়ে টুপি খুলি অনুবাদকের উদ্দেশ্যে। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সেই অমর পংক্তির সঙ্গে সাযুজ্যের উল্লেখে (উদা. ‘বুঝি বা এই বজ্ররবে/নূতন পথের বার্তা কবে....’)—নিমেষে মন কেড়ে নেন অনুবাদক, এবং এক বিশেষ উচ্চতায় উত্তীর্ণ হয় সংকলনটি।

*

আর্তুর র‍্যাঁবো উদ্দাম যৌনাচারী ছিলেন, সমকামী ছিলেন, শেষজীবনে আবিসিনিয়াতে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের বেআইনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন—এ’সব অনুযোগ গৌণ হয়ে থাকবে। তাঁর চেয়ে প্রায় শতাধিক বৎসরের অনুজ প্রবাদপ্রতিম সুরস্রষ্টা জিম মরিসনের গানে, বা নোবেলজয়ী বব ডিলানের গীতিকাব্যে, বা পিকাসোর তুলিতে বেঁচে আছেন, থাকবেন র‍্যাঁবো—এটাই সত্যকথা।

আর ততদিন র‍্যাঁবোর এই বঙ্গানুবাদ আমরাও পড়ে চলবো।


|| এসে গেলেন নির্ভীক অভীকঃ বাংলার ড্যান ব্রাউন ||

এবং ইনকুইজিশন—অভীক সরকার; দ্য কাফে টেবল, ব্যাণ্ডেল, হুগলি; প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০১৮; ISBN--978-93-87753-04-4

একটা কী হয় কী হয় ভাব, অর্থাৎ উত্তেজনা, নতুন নতুন অজানা-অনালোকিত পথে গল্পের সর্পিল গতি, আর শেষটায় কী হলো? বলে দোব? উঁহুঃ। মানে, আনপ্রেডিক্টেবল সমাপ্তি—এই যে ধরনের গল্পের গোত্র, তাকে কী বলি? আর গল্পের গতিটার কথা বললে না? গতিটা যদি তরতরে না হয়, কী করে তবে এতসব উত্তেজনা বা অজানাপথের দোলাচলে এগিয়ে এগিয়ে ঐ সমাপ্তিতে পৌঁছবে? ইঙ্গভাষায় এ’-জাতেরে কয় ‘থ্রিলার’; উইকি কহেন, আইরিশ ঔপন্যাসিক আর্স্কিন শিল্ডার্সের ‘দ রিড্‌ল অব দ স্যান্ডস’(১৯০৩)-ই হলো প্রথম সার্থক ‘থ্রিলার’। অর্থাৎ, ইহা সাহিত্যের এক নব্য জঁর। কিন্তু ভাবি মনে, এই উত্তেজনা এই দোলাচল এই গতি কি আমাদের মহাভারতে কম ছিল? রামায়ণেও? তা বলে রামায়ণ-মহাভারত কি ‘থ্রিলার’ ? য্‌ঝ্যাঃ, এ’সব উল্টোপাল্টা বলে মার খাবো নাকি? এ’সব সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনা রেখে মূল কথায় আসিঃ যে বই পড়ে ঘোরে ঘোরে এই কলম ধরেছি, —- যে ঠগী আর বৌদ্ধবিহার আর মধ্যযুগীয় চার্চ আর সুলেমানী তন্ত্র আর ইসলামী আফঘানিস্তানের ঘোর মাথা থেকে নামছে না, সে বিষয়ে লিখি দু’কথা।

*

বাঙলাভাষায় কি থ্রিলার লেখা হয়েছে? উত্তরটা অনেক লম্বা আসবে, কারণ ‘থ্রিলার’-এর সংজ্ঞাটা এর সঙ্গে জড়িত। আমার এক্ষুণি যে নামটা মনে আসছে, সেটা মধ্য-১৯৯০তে লিখিত তথাগত মুখোপাধ্যায়ের ‘পিচ্ছিল’ (কোনো অজ্ঞাত কারণে উনি আর কিচ্ছু লেখেননি)। আজকের তরুণ নভেলা-লেখক শ্রীমান অভীক সরকারের বর্তমান বইখানি পড়ে সেই পুরনো পাঠসুখ ফিরে এলো, আর গর্বের সঙ্গে মনে হলো, দ্যাখো, চেতন ভগত বা রবি সুব্রাহ্মনিয়ান বা অমীশ ত্রিপাঠীর মতো আইআইটি আইআইএম গ্রাজুয়েটরা শুধু ইংরিজিতেই কলম ধরেননি, বঙ্গভাষায় লেখার জন্যে আমাদের অভীক সরকার মশাইও আছেন!

*

অত্যন্ত আনন্দের কথা, বর্তমান বাঙলার নবীন লেখককুল দেখছি যথেষ্ট পড়াশুনো করে গবেষণা করে তবেই কলম ধরছেন — এটা গত বেশ কয়েক সংখ্যায় লিখে আসছি। সে গবেষণা ও পড়াশুনোর মান যে কত সুউচ্চে উঠতে পারে বর্তমান গ্রন্থপাঠে প্রতীত হবে তা, কারণ প্রাচীন বৌদ্ধসাহিত্য থেকে তন্ত্রসাধনা থেকে স্লীম্যানের ঠগীদমন থেকে আধুনিক মার্কিন সমরাস্ত্রভাণ্ডারের উপর অগাধ পড়াশুনো বর্তমান লেখকের। এবং এতদ্‌সত্ত্বেও তথ্যভারাক্রান্ত হয়নি নভেলা চারটি, সেই কলমের সামনেই কুর্নিশ!

(১) শোধ, (২) রক্তফলক, (৩) ভোগ ও (৪) ইনকুইজিশন—সওয়া-দু’শো পৃষ্ঠার মধ্যে এই চারিটি নভেলা, যদিও গুণমানে সমান নয়। গল্প ধরে ধরে আমি কদাচই আলোচনা করিনে, তাতে ভবিষ্যৎ পাঠকের প্রতি অবিচার করা হয়, তবু সাধারণভাবে বলিঃ

প্রতিটি নভেলাতেই দূরবীনের মতো কাছে-দূরে অতীত-বর্তমানের মধ্যে বিচরণ রয়েছে। তার অনায়াস গতায়াত মন মাতায়।

দুই. ভাষার ব্যবহার। যেমন, ‘রক্তফলক’ উপন্যাসের ঘটি ব্যবসায়ী মাধববাবু যেমন ‘গেসলুম’ ‘ছান-টান’ বলেন, ‘ইনকুইজিশন’-এ’ তেমনি ফার্নান্দো যে প্রাচীন পুঁথি পাঠ করেন তাতে অভীক সাধুবাঙলা ব্যবহার করেন। চমৎকার পরিমিতিবোধ! আর ষোড়শ শতকের পর্তুগীজ নাবিক গোয়া-অঞ্চলের যে ভারতীয়ের সঙ্গে কথা বলেন সেটা যে ভাঙা ভাঙা কোঙ্কনীতে, সেটার উল্লেখ করতে ভোলেন না লেখক। এই ডিটেইলস মন কাড়ে। তবে, সেকালের পর্তুগীজ শাসকের মুখে দীর্ঘ ইঙ্গবাক্য (পৃ ১৩৮) কিন্তু অপ্রযুক্ত লেগেছে, সেটাও বলতে হয় (যদিও, লেখক যে মুডটা আনতে এর ব্যবহার করেছেন, সেটা মানছি)। ‘শোধ’ নভেলাটিতে বহু বহু ফার্সি শব্দের ব্যবহার রসভঙ্গ করেনি, সেটাও বলি।

তৃতীয় হচ্ছে, স্থানোপযুক্ত তথ্যের ব্যবহার। যেমন, পর্তুগীজনাম ‘বম-বেইম’ (ভালো উপসাগর) থেকে ‘বম্বে’ (মুম্বাই) নামের আগমন, বা গ্রিমোয়ার (ব্ল্যাক আর্ট) বা, সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের চুরাশিজন সিদ্ধাচার্য (তার মধ্যে দ্বারিকপা বেশ্যার দারোয়ান ছিলেন) বা, বৌদ্ধধর্মের হাত ধরে ভারতবর্ষে মূর্তিপূজার প্রচলন ইত্যাদি। গোলাপের গুলদস্তার মধ্যে মাঝে মাঝে গোঁজা যুঁইয়ের মতো এহেন তথ্য বড্ড আকর্ষণ করলো। খুঁতধরা সমালোচক বটি তো, নেটফেট ঘেঁটেও কিছু তথ্যবিচ্যুতি পেলুম না, এই আক্ষেপ।

*

নতুন প্রকাশনা হাউজটির কাজ ভালো। যদিও মুদ্রণপ্রমাদ দু’একটি চোখে পড়েছে [উদা. রূপে পৃ ১৩৪, শিউড়ে পৃ ১৮১-একাধিকবার ইত্যাদি ]। ১৮৪ পৃষ্ঠায় ওটি কুবের+ঈর্ষিত=কুবেরের্ষিত হবে না, অভীক? [উদা. ভব+ঈশ=ভবেশ] . আর, ম্যাকাউ কি দ্বীপ (পৃ. ১৭৭), উপদ্বীপ নয়? চারটির মধ্যে শেষেরটি, ‘ইনকুইজিশন’ অবশ্যই শ্রেষ্ঠতম; এই মানের থ্রিলার বাঙলায় বেশি হয়নি (অতি সম্প্রতি প্রীতম বসু মহাশয়ের তিনটি ছাড়া)।স্থানে স্থানে প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোকের ব্যবহার সুপ্রযুক্ত, যদিও তাদের সঠিকত্ব বিচারের বিদ্যে আমার পেটে নাই। দ্বিতীয় ‘রক্তফলক’ নভেলাটি যে সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয়েছিল শেষের দিকটা যেন.....একটু, মানে....ইয়ে..... (তাড়াহুড়োর ফল?)। গ্রন্থের প্রথমে দীর্ঘ মুখবন্ধ না লিখে নয়জন গুণীর প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করেছেন লেখক দেখে ভালো লাগল, তার মধ্যে রাজা ভট্টাচার্য মহাশয় গ্রন্থটির ‘সম্পাদক’ (উপন্যাসে সম্পাদকের কাজটা কী?) ছোট্ট ভূমিকাতে বলেছেন, ‘মানুষের প্রথম ও আদিম, সমস্ত ধর্মাচর্যাই আসলে তন্ত্র’!! হ্যাঁ, এ’ কাহিনীগুলিতে অভীক তন্ত্রকে পরতে পরতে ঢুকিয়ে নিয়েছেন বটে, এবং যথেষ্ট মনোজ্ঞভাবেই। এবং ‘নায়ক’ নবদ্বীপী ব্রাহ্মণ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তখন আর তাঁর কলমে ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থের রচয়িতা থাকেন না, পর্তুগীজ কমান্ডো মার্টিনেজকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন ২০১৬-র মুম্বাই নগরীতে!

শান্তনু মিত্র-কৃত প্রচ্ছদচিত্র ভালো লেগেছে, কিন্তু কালোরঙের নিকষ ব্যবহারটা ... (মলাটের চেয়ে জ্যাকেটে বেশি)।

অতো দীর্ঘ ব্লার্ব পড়তে ভালো লাগে না।

সবশেষে, এ’গ্রন্থপাঠের শেষে লেখকের যে নির্যাস-‘বাণী’ মনে ধরে যায়, থেকে যায়, সেটি ভালোবাসার, প্রেমের! সকল ধর্ম সকল তন্ত্রসার হলো মানবপ্রেম, ভালোবাসা—জাতধর্মের ঊর্ধে উঠে। এটিই জীবনের চালিকাশক্তি, এটি না থাকলেই বাকি সব তুচ্ছ, মিথ্যা। এটি বড় মনোলোভা লিকেচ গো লেখকমশাই। বারেবার!



|| ‘আজো তারা পিছু ডাকে’ ||

শ্রীশ্রী অন্নপূর্ণা ভাণ্ডার—যশোধরা রায়চৌধুরী; ‘ছোঁয়া’, কলকাতা-১২; ISBN: 978-93-82879-61-1

একটা নতুন বই হাতে নিয়ে তার লেখা পড়বো কি, অলংকরণের ছবিগুলির দিকেই আগে নজর চলে যায় আর পুঙ্খেপুঙ্খে দেখি সেই ক্যানভাসে চারকোল ঘষা ছবিগুলি। তন্ময় হয়ে। গতসংখ্যাতেই এমন এক বইয়ের কথা লিখেছিলাম, প্রথমটাই, যার অনবদ্য অলংকরণ প্রথমেই মন কেড়ে নিয়েছিল। বর্তমানেরটিও তাই। তফাৎ হলো এই যে এই বইটি বই হয় বেরোনোর বহু আগেই অংকনশিল্পী চলে গেছেন অনন্তলোকে। পরে লেখিকা যখন লিখেছেন, যেন গুঁজে গুঁজে দিয়ে চলেছেন মায়ের আঁকা সেই অপূর্ব ছবিগুলি।

তাহলে এ’বইয়ের লেখিকা আসলে কে? গ্রন্থপাঠ শেষে স্থির প্রত্যয়, সেই তিনিই, ইনি নন।

*

এবার ঢুকি ‘অন্নপূর্ণা ভাণ্ডার’-এ।

স্মৃতিচারণাপাঠ সাধারণতঃ একটু বোরিং লাগে না কি? কারণ এই জঁরের লেখা তো কম হয়নি, কম পড়িনি। তার উপর উত্তমপুরুষে লেখা স্মৃতিচারণা আরও....মানে....ইয়ে..। পাঁচ সংখ্যা আগে এমন এক স্মৃতিচারণা পড়েছিলাম—‘তোমার পরশ আসে’— যা উত্তমপুরুষে লেখা হলেও লেখার গুণে প্রাণপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তেমন আজ এই এটি। লেখিকা একজন কৃতবিদ্য কবি ও ভারতসরকারের উচ্চপদাধিকারী আমলা। কিন্তু তাঁর ‘মানুষ দেখা’ বা ‘জীবন দেখা’-র মধ্যে অবলীলায় এসে যায় এক ঘরঘরে সেলাইকল থেকে ডিমের ডালনা থেকে সেফটিপিন! এ’সব নিয়েই তো জীবনযাপন! মানুষ দেখা= জীবন দেখা! কৃতবিদ্য বৈজ্ঞানিক+সাহিত্যিক পিতৃদেব তাঁর চল্লিশ-না-ছুঁয়েই যখন সুরলোকে পাড়ি দিলেন কচিটি তখন দু’বছরেরও নয়। শিল্পী-গায়িকা মাতৃদেবী তাঁর অঙ্কন ছেড়ে সঙ্গীত ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে দুই শিশুকন্যাকে মানুষ করায় ব্রতী হলেন সেই ষাট-সত্তর দশকের কলকাতায় তখন নকশাল আন্দোলন, ইলাস্টিকবিহীন ইজের, তুমুল লোডশেডিং, ম্যাটিনি শো-র উত্তমকুমার আর আর...... আরও কতশত জন। হ্যাঁ, এ’সবই এই বইটির কুশীলব, চরিত্রাবলী—সাদায়-কালোয়। ঊনিশশ’ ষাট-সত্তর-আশির দশকের কলকাতায় শৈশব-কৈশোর কাটানো যে কোনো মানুষের কাছে এ’বই বয়ে আনবে সেই সুর—-‘আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম’! রেডিওতে দেবদুলালের দেববিনিন্দিত কণ্ঠস্বর—মুজিব-হত্যা! আরও আরও কত সব হারিয়ে যাওয়া দুপুর-বিকেল—-বোরোলীনের সংসার, বোর্নভিটা কুইজ কনটেস্ট!

*

কবি যশোধরা রায়চৌধুরী কি ‘নারীবাদী’ লেখিকা? এ’ তকমা পেতে উনি নিশ্চয়ই ঘোর অনাগ্রহী! ফুঁসে উঠবেন! কিন্তু পড়ে দেখুন কবির হাতের গতিময় এ’ গদ্য, তাতে দিদু-মা-সুজনী-সেফটিপিনের যে সাদাকালো ছবিগুলি ফুটে ফুটে উঠেছে তা বড্ড ঘরোয়া আর তাই বড্ড মা-মা! সেকালে পুরুষমানুষের বেশিক্ষণ ঘরে থাকাটাকেই মেনিমুখত্বের লক্ষণ বলে ভাবা হতো যে! অফিস-কাছারি ছাড়া তাঁরা সময় কাটাবেন পাড়ার ক্লাবে বা তাসের আড্ডায় নয় গলির মোড়ে। ঘর তাই মা-কাকী-পিসিদেরই স্ট্রংহোল্ড। তাই কবয়িত্রীর এই লেখায় এতো পরিপাটি মেয়েলি হাতের ছোঁয়া। ১৯৩০ বা পঞ্চাশের দশকের যে যে সব অসাধারণ গল্প স্মৃতি মিত্র বা কল্যাণী দত্ত শুনিয়ে গেছেন [সংখ্যা ৫২ , সংখ্যা ৫৯] তার চাইতে আজকের যশোধরার মূলসুর পৃথক নয় মোটেই। আর এই ভাণ্ডারের ঝাঁপি খুলে বসতে উনি ‘সেবানিবৃত্তি’ পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি তাই ধন্যবাদ, কারণ তাতে সোয়েটারের পুরনো উল খুলতে খুলতে আঁচল ভত্তি হয়ে যেতো গো!

*

লুপ্তপ্রায় শব্দের ব্যবহার এঁর গদ্যের এক মেগা আকর্ষণঃ একটেরে, হতচ্ছেদ্দা, খোঁপা-চাউ, গরগরে ঝোল, কাঁথাকানি....। এই এই শব্দ ঠিক ঠিক জায়গায় সুপ্রযুক্ত হবার যে দ্যোতনা সেটা আর অন্য কোনভাবে আসতে পারে না। শব্দের এমন ব্যবহার প্রকৃতই কবিসুলভ। তাই না বলে, কবির হাতের গদ্য বড্ড খোলে!

অনামী নতুন প্রকাশনালয়ের কাজ ভালো লেগেছে। ছিমছাম ছাপাই-বাঁধাই। মুদ্রণপ্রমাদ কয়েকটি (দাগ দিয়ে রেখেছি)। পাঠশেষে ফের ফিরে পড়িঃ কী সব এক এক নিবন্ধের নামঃ ‘ছাতের আলিশা....’, ‘ইলাস্টি সেফটিপিন সেলাইকল’, ‘দিদুযাপন’....। শেষের ‘বাইশে শ্রাবণের...’ নিবন্ধটিই শ্রেষ্ঠ, যেখানে অতীব নৈর্ব্যক্তিকভাবে কবি তাঁর মৃত্যুচেতনার কথা বলেছেন, ....তোমার অলৌকিক কণ্টেন্ট মুছে যাচ্ছে.....

বই-পিঠে একটা ব্লার্ব থাকলে বেশ হতো।

আর প্রচ্ছদের ঐ ছবিটি দ্যাখোঃ নারীবাদী বই বলবে না এটাকে?

*

শেষে লেখিকার লেখিকার কথা না বললেই নয়। ১৯০৩ সালে জন্ম। বিবাহের পর বিশের দশকে বেথুন কলেজে পড়তে যেতেন ঘেরাটোপে ঘোড়াগাড়িতে চড়ে। মুখস্ত রাখতেন অসংখ্য সংস্কৃত শ্লোক! লেখিকার মাতামহী! বলতেন, ‘সারা জীবনে এত ঝড় ঝাপটা, বই হারাবে খাতা হারাবে....যখন নিঃসঙ্গ সময় আসবে, একাকী, নিঃসম্বল, তখন হাতের কাছে কিচ্ছু না থাকলেও, স্মৃতি থেকে -এই সব বলবি, উচ্চারণ করবি, -আবৃত্তি করবি। মুখস্তের মত জিনিস আর কিছু আছে রে?’--চোখটা বুজে এলো। এ’সব শিক্ষা জীবন থেকে নেওয়া।

-এঁর লেখা আত্মজীবনীঃ ‘আজো তারা পিছু ডাকে’।





(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)