সাত তারা হোটেলের ঘরে লক খুলে ঢুকেই সমর্পণ দেখল ওপাশের ওয়াল টু ওয়াল বিরাট জানলার চওড়া পর্দাটা নিচের থেকে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে নিজের থেকেই। আর জানলার ওপাশে অনেক নিচের থেকে একটা দিগন্তপ্রসারী নীল ফেনিল সমুদ্র প্রায় ঘরের মধ্যে ঢুকে আসছে। চোখের ওপর থেকে পর্দা সরে গিয়ে সে যেন পৌঁছে গেল এক বিশাল প্রসারতার মাঝে। একেই বলে উষ্ণ অভ্যর্থনা। মন ভরে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হোটেলের ছেলেটি তার সুটকেস ও ল্যাপটপ ট্রলি-ব্যাগদুটি পৌঁছে দিয়ে গেল। ভেতরের দুর্দান্ত ইন্টিরিয়র ও অত্যাধুনিক আসবাবপত্র দেখতে দেখতে নিজের নতুন হাতে পাওয়া ব্রুকলিনের এপার্টমেন্টটা সাজাবার কথা মনে পড়ে গেল। এ’ তো শুধু আসবাব নয়। কিছু নতুন আইডিয়া।
আবার চোখ চলে গেল অনেক নিচের সমুদ্রে। ঘরটা একুশ তলায়। বিছানায় গা এলিয়ে মনে হচ্ছে যেন একটা হেলিকপ্টারে চড়ে সমুদ্রের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সে। নু-ইয়র্ক থেকে মুম্বাই-এর লম্বা না-থামা যাত্রার ক্লান্তি অনেকটাই মিলিয়ে গেল। মনের ভেতর থেকে কে যেন খুশিতে বলে উঠল, বাঃ।
কাল সকালেই কোম্পানির নতুন খোলা ইন্ডিয়া অফিসের বড়কর্তাদের সঙ্গে মিটিং। ইন্ডিয়াতে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা ফ্যাক্টরি বানানো হবে। মাস দুয়েক আগে কোম্পানির ছোট অফিসটাতে বেশ কিছু রিক্রুটমেন্ট হয়েছে এই কারণে। হোটেলের রিসেপসনে ঢুকতেই ফোনে কথা হয়ে গেছে এখানকার অফিসের হেডের সাথে। তাকে যে রিসিভ করতে এসেছিল সেই ছেলেটি এজেন্ডার কপি ও অন্যান্য ডিটেল দিয়ে দিয়েছে। ছেলেটি কাল সকাল নটায় তাকে নিতে আসবে।
চান করে রুমের ছোট বার থেকে একটা হাল্কা ড্রিঙ্ক বানিয়ে তারিয়ে তারিয়ে পান করছিল আর সমুদ্র দেখছিল সে। কিছু লোক স্নান করছে, কয়েকটা গাঙচিল মাছ ধরার জন্য উড়ে বেড়াচ্ছে। এমন সময় রুমের ফোনটা বেজে উঠল।
- ‘হ্যালো’
- ‘রিসেপসন স্যার, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো।’
- ‘না। সব ঠিক আছে।’
- ‘আপনার জন্য কিছু ডকুমেন্ট পাঠানো হচ্ছে আপনার অফিস থেকে, সেগুলো আসলেই আপনাকে দেওয়া হবে স্যার। আর হোটেলের ব্যাপারে কোন ফিডব্যাক থাকলে জানাবেন স্যার।’
ঘড়ি দেখল। নু ইয়র্কে এখন সকাল হচ্ছে। ফোন করে স্ত্রী শিরিনকে নিজের পৌঁছ-সংবাদ জানিয়ে একটু গড়িয়ে নেবার জন্য বোতাম টিপে পর্দা ফেলে সমুদ্র আড়াল করল সে।
----------------------------------------
- ‘কি রে বলটা নতুন মনে হচ্ছে।’ একটা সবুজ মাঠে লম্বা ছেলেটা রোগা ছেলেটাকে বলল।
- ‘হ্যাঁ, কাল রাতে বাবা কিনে এনেছে।’ রোগা ছেলেটার আওয়াজে কুণ্ঠা।
- ‘খেলবি তো? নাকি বলটা হাতে করেই রাখবি?’ ব্যাট হাতে লম্বা ছেলেটার গলায় কর্তৃত্বের সুর।
- ‘চল খেলি, তবে সাবধানে, যাতে হারিয়ে না যায়।’ রোগা ছেলেটি যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হোল।
দুজনেই বল ও ব্যাট হাতে তৈরি। রোগা আর লম্বা দুজনেই ক্লাস এইট। লম্বাটি ফার্স্ট বয় আর রোগাটি কোনওরকমে পাশ করে। মাস্টারমশাইরা বলেন ওর কোন জিনিস বুঝতে বা পড়তে সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। ক্লাস নাইনে ও উঠতে পারবে কিনা সেটা অনিশ্চিত। হয়ত স্কুল থেকেই ওঁকে এই ক্লাসে আর এক বছর রেখে দেবে।
রোগা ছেলেটি বলটা খুব আলতো করে ছুঁড়ে দিল তার দিকে অতি সাবধানী ভঙ্গিতে। সজোরে, নির্দয়ভাবে ব্যাট চালাল লম্বা ছেলেটি। বলটা ব্যাটে লেগে ক্রমাগত আকাশপথে ওপরের দিকে উঠতে লাগলো। আরও ওপরে, আরও ওপরে। তারপর মিলিয়ে গেল মহাশূন্যে, মেঘের ওপারে। কিছুক্ষণ কাটল। কিন্তু বলটা আর নেমে এলো না। দুজনেই অবাক হল। লম্বা ছেলেটি হাসতে লাগলো আর অন্য ছেলেটির দুচোখ বেয়ে নেমে এলো জলের ধারা। ওর বাবা অনেক কষ্ট করে, হয়ত পয়সা জমিয়ে এই দামী বলটা কিনে দিয়েছে। হয়ত এটাই ওকে ওর বাবার দেওয়া শেষ বল, যেটা মিলিয়ে গেছে মহাশূন্যে। হয়ত লম্বা ছেলেটি একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে দিল একজনের। অন্ধকার নামছে চরাচরে, কোথাও একটা পথহারা পাখি ডাকছে তার সঙ্গীদের।
কলিং বেলের আওয়াজে দিবানিদ্রা ভঙ্গ হল সমর্পণের। উঠে দরজা খুলে দেখল তার ডকুমেন্টগুলো দিতে এসেছে। বেশ কিছু কাগজপত্র কালকের মিটিঙের জন্য।
ঘণ্টাখানেকের ঘুমে শরীরটা ঝরঝরে লাগছিল। জেট-ল্যাগ অনেকটা কেটে গেছে। নিজের আগামীকালের এজেন্ডা, ডিসকাশন পয়েন্টস কয়েকবার দেখে নিল। একবার ফোনে এখানকার হেড মিস্টার দেশপাণ্ডের সাথে কথাও বলে নিল সে। তার এবারের আসার ওপর কোম্পানির অনেক কিছু নির্ভর করছে। তার নিউ ইয়র্কের মালটিন্যাশনাল কোম্পানি ইন্ডিয়াতে দুটো ফ্যাক্টরি খুলতে চায়। যাতে এখানে বানানো জিনিস এদেশে বেচে বেশি লাভ করা যায়। একটা হবে মহারাষ্ট্রে আর একটা গুজরাটে। এখানে তারা শুরুতে শুধু আসেম্বল করে প্রডাক্ট তৈরি করবে। কিছু লেবার এখান থেকে নিতে হবে যদিও। তবে স্কিল্ড লোকজন আসবে অন্য কাছের দেশ থেকে। ল্যান্ড অ্যাকুইজিসন ইত্যাদি নিয়ে সরকারের সাথে নেগোসিয়েসন হয়ে গেছে। সে এসেছে এখানকার স্টাফদের তাদের কাজের পুরো প্রজেক্ট ব্লু-প্রিন্টটা জানাতে। কারো যদি কোনও সাজেশন থাকে সেটা নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে এখানকার স্টাফদের বোঝান যে তাদের কি কি সুবিধে হবে বা কি কি ইনসেন্টিভ দেওয়া হবে ইত্যাদি। কতদিন লাগবে এখানে জানা নেই তাই ফেরার টিকিটটা ওপেন রাখা আছে।
ইন্ডিয়াতে আসলেই বাবলার কথা মনে পড়ে ওর। যেন মনের গভীর থেকে ভুস করে ভেসে ওঠে সে। কতদিন? প্রায় তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর দেখা নেই। কিন্তু এদেশে আসলেই হাওয়ার মতো জড়িয়ে ধরে তার স্মৃতি। কোন অপরাধ বোধ? হবেও বা।
রিসেপসনে রাতের খাবারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে ওঁরা বলল যে একেবারে সাতাশ তলার ওপরে রুফটপে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। যেটা প্রিমিয়াম। আজ সেখানকার থিম হল বেঙ্গল। তার ভাল লাগবে।
অনেকদিন অভ্যেস না থাকাতে সর্ষে ইলিশ ভাপাটা সামলাতে প্রথমদিকে অসুবিধে হচ্ছিল। স্বাদ অসাধারণ। দু পেগ সিঙ্গল মল্ট স্কচ নেওয়া আছে। পুরো রেস্টুরেন্টটা কাঁচের হওয়াতে চারদিকের ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। নিচের সমুদ্র আর অন্যদিকে বম্বের রাতের স্কাইলাইন, সব মিলিয়ে পরিবেশটা বেশ স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। আজ এরা দুজন বাউলকে নিয়ে এসেছে। এখন আর বাউল মানে শুধু মাঠ-ঘাটের গান নয়। অন্যান্য যন্ত্রানুসঙ্গ মিলিয়ে এরা ব্যাপারটাকে এই বিলাসবহুল হোটেলের সাথে মানানসই করে তুলেছে। অনেক উঁচুতে এই আলোআঁধারিতে অসীম আকাশের শূন্যতায় বাউল-দুজন গেয়ে চলেছে ‘কি ঘর বানাইনু আমি শূন্যের মাঝার, লোকে বলে, বলে রে ঘরবাড়ি ভালা না আমার।’ সমুদ্র দেখতে দেখতে সুর ও শব্দের গভীরে ডুবে যেতে লাগল সে।
রুমে ফিরে শিরিন ও মেয়েকে ফোনে গুড নাইট কিস করে জানলার পাশে বসল। নিচের কালো সমুদ্র দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলো দুপুরে দেখা সেই গাংচিলগুলো কোথায় গেল? সবাই কি মাছ ধরে চলে গেছে? নাকি দুএকটা সকলের সাথে মাছ ধরতে না পেরে এখনো উড়ে বেড়াচ্ছে, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু অভুক্ত বাচ্চার ক্ষুধা মেটানোর জন্য। এত উঁচু থেকে বোঝা যাচ্ছে না। হয়ত আছে দুএকটা এখনও।
দুগ্ধফেননিভ বিছানার গভীরে চলে যেতে যেতে মনে পড়ল দুপুরের স্বপ্নের কথা। মনে পড়ল বাবলার কথা। বাবলা ছিল তার ছোটবেলার বন্ধু। খুব যে প্রিয় বন্ধু তা বলা যায় না। সেভাবে দেখলে প্রিয় তার কেউই ছিল না। সে চিরকালই একাই থাকতে পছন্দ করত। নিচু ক্লাসে বোঝা যায় নি। তবে ফাইভের পরে বোঝা গেল কোন কিছু বুঝতে বা শিখতে বাবলার অনেক বেশি সময় লাগে। নিচু ক্লাসে বাবলা অনেক সময়ই তার কাছে না-বোঝা পড়া বুঝে নিত। বাবলা সব ব্যাপারেই তার ওপর নির্ভরশীল ছিল তখন। সবসময় একটা কৃতজ্ঞতার প্রলেপ লেগে থাকত তার মুখে। কিন্তু একটু উঁচু ক্লাসে উঠেই তাদের মধ্যে ফারাকটা যে অনেক, সেটা বোঝা গেল। বাবলা ক্লাসের পড়া বিশেষ বুঝতে পারত না। এদিকে বাড়ির থেকে তাকে বোঝানো হল যে বাবলাকে বুঝিয়ে নষ্ট করার মত সময় তার নেই। তাকে ফার্স্ট হতে হবে। বোর্ডে ভাল ফল করতে হবে। সে বাবলাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। সে আরও ভাল রেজাল্ট করতে লাগলো আর বাবলা ক্রমাগত পিছিয়ে গেল। আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার সাথেও বাবলা কিছুতেই তাল রাখতে পারছিল না। ওঁরা ছিল খুব গরিব। ক্লাস এইটে ওর বাবা বাবলাকে কোনমতে একটা চালু কোচিনে ভর্তি করে দিল যাতে ও কোনওরকমে পাশ করে যেতে পারে। ওদের গরীব ঘরে মাসে মাসে এতগুলো কোচিনের টাকা বের করাও বেশ কষ্টের। তাছাড়া ওর মায়ের শরীরও বিশেষ ভাল ছিল না। ওনারও চিকিৎসার খরচা আছে। তবু ছেলে পাশ করলে কোন চাকরি জোটানো যাবে বা দোকানটা ভালভাবে দেখতে পারবে এই আশাও ছিল।
আর তার নিজের উচ্চাশা ছিল, তাকে স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক অনেক দূর যেতে হবে। নম্বর পাবার জন্য সে ছিল পাগল। অনেক পড়ার পরেও যদি কোন প্রস্তুতি সময়ের অভাবে বাকি থেকে যায় সেগুলো সে গোপনে ছোট কাগজে লিখে নিয়ে যেত। দরকার পড়লে বাথরুমে যাবার নাম করে গিয়ে সেগুলো দেখে আসত আর পরীক্ষার খাতায় লিখে ফেলত। বেশিরভাগ সময়ই দরকার হত না অবশ্য। দু-একবারই সে করেছিল এরকম। ব্যাপারটা কেউ জানত না। সে ভাল ছেলে বলে তাকে কোনদিন কেউ সন্দেহ করে নি। এই পাগলামিগুলো সে করত যাতে তাকে একটা নম্বরও কম পেতে না হয়।
বোর্ডের পরীক্ষায় তাদের সিট পড়েছিল অন্য স্কুলে। বাবলা বসেছিল তার একেবারে পাশেই। বাবলা যতটা পারছিল নিজের মত করেই পরীক্ষাগুলো দিচ্ছিল। তার কাছ থেকে কোনরকম সাহায্য সে চাইছিল না। বাবলা জানত পরীক্ষার হলে ও কাউকে কিছু সাহায্য করে না। তবে বাবলা কিন্তু দেখত ওর যাতে কোনরকম অসুবিধে না হয়। আর সে জানত যে বাবলার পাশ না করার সম্ভাবনাই বেশি। এতে তার অবশ্য কিছু এসে যেত না। সেদিন ছিল অঙ্ক পরীক্ষা। শেষ পরীক্ষা। বাবলা কোনরকমে গোটা কয়েক অঙ্ক করে মোটামুটি বসেই ছিল। আর পারছিল না। ওদিকে সে বাকি সবকটা অঙ্ক ঠিক করে শেষে একটা ছোট অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। সে জানে অঙ্কটা তার পকেটে একটা ছোট কাগজে করা আছে। একবার একটু দেখলেই খাতায় নামিয়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু আর মাত্র পাঁচমিনিট বাকি আছে বাথরুমে যাবার সময় নেই। একবার ভাবল কি আর করবে, তিন নম্বর কম পাবে। কিন্তু তার ভেতর থেকে অন্য কেউ যেন সেই ছোট কাগজটা পকেট থেকে বার করে অঙ্কটা এক ঝলক দেখল। মনে পড়ে গেছে। ঠিক সেই সময় ‘ইউ’ বলে একটা গর্জন শুনতে পেল সে। দেখল হলের ইনভিজিলেটর স্যার তার দিকেই এগিয়ে আসছেন। একটু দূরে থাকলেও বোধহয় কিছু দেখেছেন। কাগজটা খাতা দিয়ে ঢেকে ফেলল সে। মনে হল তার চলমান জীবন যেন সেখানেই থেমে গেল। চোখ বুজল সে। সব শেষ, সারা জীবনের মত। পরীক্ষার খাতাটা তুললেই উনি পেয়ে যাবেন সেই কাগজটা। সারা জীবনের ভাল ছেলের তকমা তার ঘুচে যাবে। সব স্বপ্ন শেষ। চোখ বুজল সে। ইনভিজিলেটর এলেন খাতা, প্রশ্নপত্র তুলে জিওমেট্রি বক্স খুলে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। নিচে কিছু পড়েছে কিনা তাও দেখলেন। কোথাও পেলেন না কাগজটা। সবাই অবাক বিস্ময়ে ক্লাসের উজ্জ্বল নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। এক এক পল যেন এক এক ঘণ্টা। হঠাৎ ‘ইয়েস দেয়ার ইট ইজ’ বলে উঠলেন ইনভিজিলেটর। সবাই দেখল পাশে বসা বাবলার খাতার তলা থেকে তিনি বের করে আনলেন সেই কাগজের টুকরোটা যাতে করা আছে একটা অঙ্ক। বাবলাকে নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ওর পরীক্ষা ক্যান্সেল হয়ে গেল। আর সে বাকি তিন মিনিটে অঙ্কটা সঠিকভাবে করে, পুরো উত্তর দিয়ে বুকের থেকে একটা বিরাট ভার নামিয়ে হল থেকে বেরিয়ে এল।
এর পরে বাবলার সাথে আর বিশেষ দেখা হয় নি। তারা চলে এসেছিল কলকাতায়। আরও নতুন নতুন চূড়া স্পর্শ করতে লাগল সে। মাঝে মাঝে শুনত বাবলা পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে। ওর বাবা মারা গেছেন। কিন্তু একটা কথা আজও তার কাছে খটকার মত। কাগজটা বাবলার খাতার নিচে গেল কি করে। সে-ই কি কোনভাবে কাগজটা পাশে সরিয়ে দিয়েছিল। নাকি বাবলা নিজেই কাগজটা ... । সারা জীবন এই চিন্তাটার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে সে। কিন্তু ইন্ডিয়াতে এসে বাবলার খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছে বা সাহস তার হয় নি কোনদিন।
রাতের অন্ধকারে গাঙচিল খুঁজতে খুঁজতে ঘুমের জগতে ঢলে পড়ল সে।
————————————————
ঝকঝকে নতুন অফিস আর বোর্ডরুমটা ততোধিক সুন্দর ও আধুনিক। তাকে ইমপ্রেস করার জন্যও এরা অতিরিক্ত যত্নবান। বোর্ডরুম যেন তার নিজের জায়গা। তার ইউ এস এর সহকর্মীরা মজা করে বলেন সে নাকি বোর্ড রুম ক্রিয়েচার। সে জানে কি করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কি করে সমস্ত কন্ট্রোল নিজের হাতে রেখে সবাইকে কনভিন্স করতে হয়। পুরো আলোচনা কিভাবে নিজের মত করে চালনা করতে হয়। তার কোম্পানির সুপ্রিম বস থেকে শুরু করে সবাই ভরসা করে তাকে। জুনিয়ররা তাকে দেখে শেখে এসব।
কিন্তু আজ ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হচ্ছে যেন। আজকে সে-ই সভাপতি। প্রথমেই মুখবন্ধে পুরো টিউনটা বেঁধে দিয়েছিল সে। বলেছিল, এখানকার ফ্যাক্টরিতে যে প্রডাক্ট তৈরি হবে তার কাঁচামাল আসবে বিদেশি ভেন্ডরদের কাছ থেকে। প্রজেক্ট টাইমলাইন, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, ট্রেনিং, ম্যানপাওয়ার রিক্রুটমেন্ট সবই তার ওপেনিং রিমার্ক এবং তারপরের একটা অনবদ্য ক্রিস্পি প্রেজেন্টেশনে বলেছিল সে। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। কিন্তু শেষ হবার পর একটি যুবক হাত তুলল, অনুমতি নিয়ে অত্যন্ত নম্রভাবে কথা বলতে শুরু করে পুরো আলোচনার মুখটা ঘুরিয়ে দিল। সে বলতে চাইল। সাপ্লায়াররা লোকাল হওয়া উচিত। ভেন্ডররা যাতে তাদের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাঁচামাল তৈরি করতে পারে সেইজন্য তাদের শিখিয়ে নেওয়া উচিত। আর তাছাড়া জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে কম্পেন্সেসনের দিকটা আরও অনেক স্বচ্ছ হওয়া উচিত। সেটা না হলে লোকাল লোকেদের সাথে প্রব্লেম হবে। এককথায় ছেলেটি বোঝাতে চাইল যে তার আলোচনায় অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে, অনেক কিছুই ক্লিয়ার নয়। সেও বুঝল যে কোম্পানি যে ফাঁকগুলো রেখেছিল এবং যেগুলো সে কথার চাতুরিতে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছিল। সেগুলোই ছেলেটা হাইলাইট করছে। তার অনুমতি নিয়ে ছেলেটিও একটা ছোট সাবলীল প্রেজেন্টেসন করল। বোঝা গেল সেও ভাল হোমওয়ার্ক করে এসেছে। দেশের লাভ লোকসান এবং এখানকার মানুষের কর্মসংস্থান ও উন্নতির কতগুলো পয়েন্ট সে রাখল যেগুলোর জবাব তার কাছে ছিল না। সে বলল রাতে হেডঅফিসের সাথে কথা বলে কাল আবার আলোচনা করবে।
ছেলেটির কথায় সে প্রথমে কিছুটা বিরক্ত হলেও মুগ্ধও বড় কম হোল না। এই দামী দামী স্যুট-বুটের অরণ্যে, সাধারণ পোশাকের এই ছেলেটির উজ্জ্বলতা চোখে পড়ে তার কথায়, তার ভাষায়, তার বক্তব্যে। পরে স্টাডি করবে বলে ওর পিপিটি-টা নিজের কাছে রাখল।
- ‘ছেলেটি কে মিঃ দেশপাণ্ডে?’ লাঞ্চে জিজ্ঞেস করল এই অফিসের হেড কে।
- ‘ও তো বিবেক।’ এ বছরই জয়েন করেছে। খুব ব্রাইট। খুব খাটে। নিজস্ব চিন্তা ভাবনা আছে। শুনলে আশ্চর্য হবেন ওর বাবা মা কেউ নেই। ও ছোটবেলা থেকেই অনাথ।’
- ‘তাই নাকি?’
- ‘হ্যাঁ, বেঙ্গলের গ্রামের কোন স্কুল ওকে সাহায্য করেছে, স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি শেষ করতে।’
- ‘খুব ইন্টারেস্টিং লাগল। পরে আলাপ করা যাবে। তবে কাল একটা ছোট মিটিং রাখবেন। তাতে থাকবেন আপনি ও আপনার বিশ্বস্ত আরও দু তিনজন সিনিয়র স্টাফ। ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টের সাথে কোম্পানির সব ফাইনাল হয়ে গেছে। অন্য কোনরকম বাধা যেন না থাকে। আশা করি বুঝতে পারছেন যে প্রজেক্টটা ফাইনাল করতে হবে। হেড অফিস তাই চায়। তারপর আফটারনুনে সাইট ভিজিট রাখবেন। পরশুদিনের ফ্লাইটের রিটার্ন জার্নির টিকিট কনফার্ম করে দেবার প্ল্যান করছি।’
----------------------------
হোটেলের নিজস্ব বালুকাবেলায় রাতের পার্টিটা জমে উঠেছে। এই অফিসের গোটা চল্লিশজন তাকে পার্টি দিচ্ছে। প্রজেক্টটা ফাইনাল হয়ে গেছে। বিচটা সরু লম্বা। কিছুটা দূরে অন্ধকারে ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ শোনা যাচ্ছে। একপাশে একটা রক ব্যান্ড পারফর্ম করছে। দারুণ সুন্দর আলোর ব্যবস্থা জায়গাটাকে মায়াময় করে তুলেছে। নেশাটাও বেশ জমে উঠেছে।
সমর্পণ একটু আড়ালে চলে এল, নিজের ড্রিঙ্ক-এর পেগ-গ্লাস হাতে নিয়ে। মৃদু হাওয়া বইছে অন্ধকার সমুদ্র থেকে। সকাল থেকে সারাদিন খুব হেক্টিক কেটেছে তাদের। মাথাটা জ্যাম হয়ে ছিল। সমুদ্রের হাওয়াতে সেটা ছেড়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। বেশ হাল্কা লাগছে নিজেকে।
কাল রাতেই ভিডিও কনফারেন্সে কথা হয়েছিল নিউ ইয়র্কে কোম্পানির সুপার বসের সাথে। সেই অনুযায়ী সেই রাতেই দেশপাণ্ডেকে জানিয়ে দিয়েছিল যে, শুরুতেই কোম্পানি ভেন্ডর ডেভেলপমেন্টের কথা ভাবছে না। সেটা সাবসিকয়েন্টলি হবে। আপাতত আমরা আমাদের নিজস্ব বিদেশি ভেন্ডরদের থেকেই কাঁচামাল নেব। কারণ কোয়ালিটির সাথে কম্প্রোমাইস করা যাবে না। এখানে নতুন করে কিছু করতে গেলে অনেক খরচের ধাক্কা। তাছাড়া মুনাফার ব্যাপারটাও দেখতে হবে। লোকাল লেবার রিক্রুট করা হবে ঠিকই কিন্তু স্কিলড হ্যান্ড আসবে আমাদের থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুর অফিস থেকে। এরাই রেগুলার বেসিসে মনিটরিং করবে। মোদ্দা কথা, সমস্ত কন্ট্রোল আমাদের হেড অফিসে থাকবে। জমি অধিগ্রহণ ও অন্যান্য টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন এখানকার গভর্নমেন্টের সঙ্গে ফাইনাল হয়ে গেছে। জমি অধিগ্রহণ ওরাই করে দেবে। এর বাইরে কোনও ‘সি এস আর’ এর কাজ আমাদের কোম্পানি করবে না। কোম্পানি এখানে ব্যবসা করতে এসেছে সেটা মনে রাখতে হবে। এই স্টেজে কোম্পানির কেউ যদি অন্যরকম ভাবে বা কাজ করতে না চায় তবে তার জন্য বেরিয়ে যাবার রাস্তা খোলা আছে।
সে নিজে যদিও কিছুটা বিবেকের ফেভারে কথা বলেছিল কিন্তু বস একদম রাজি হয় নি। মনটা খারাপ লাগছে বিবেকের কথা ভেবে। সে নিজের কেরিয়ারের কথা ভেবে হয়ত দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করেনি ওদের বোঝাতে।
আজ সকালের ছোট মিটিঙে টাইমলাইন, ওয়ার্ক-ফ্লো ফাইনাল হয়ে গেছে। চল্লিশ কিলোমিটার দূরে সাইট ভিজিটেও কোন প্রব্লেম হয় নি। যদিও সাইটে কিছু লোক পোস্টার ব্যানার নিয়ে বসেছিল। তবে লোকাল গভর্নমেন্ট ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা ব্যাপারটা অনেকটাই সামলে নিয়েছে কোম্পানির ফেভারে। কোম্পানিও ওদের সবাইকে খুশি করেছে। কিছু বস্তি ভাঙ্গা পড়ছে। বলা বাহুল্য বিবেককে এই ব্যাপারগুলোর মধ্যে আর ইনভল্ভ করা হয় নি।
সমুদ্রের ঢেউ একেবারে পায়ের কাছে চলে এসেছে। জল বাড়ছে। তখনি সে দেখতে পেল একটা সাজানো ঝোপের আলোছায়ায় বিবেক নরম পানীয়ের গ্লাস হাতে একা একা দাঁড়িয়ে আছে। কিছু ভাবছে বোধ হয়। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল সমর্পণ।
- ‘কি ব্যাপার, এখানে একা দাঁড়িয়ে। প্রজেক্ট তো ফাইনাল হয়ে গেল। পার্টি এনজয় করছ না?’ হাওয়ায় যেন সে ভাসিয়ে দিল কথাগুলো।
- ‘এনজয়মেন্টের কি আর আছে স্যার। মিঃ দেশপাণ্ডে আমাকে সব বলেছেন। এব্যাপারে আমার নিজস্ব কিছু মতামত আছে, আর আমি সেগুলোকে গুরুত্ব দিই।’ কিছুটা আশাহত শোনাল ওর আওয়াজ।
- ‘তোমার কথাগুলো আমি হেড অফিসে জানিয়েছিলাম। ওরা এখনই সেসব নিয়ে ভাবছে না। অবশ্য তারা বছর দুই পরে প্রজেক্টটা রিভিউ করে এসব ভাবতে পারে।’ সমুদ্রের শব্দে অস্পষ্ট হয়ে এলো শেষের দিকের কথাগুলো।
- ‘জানিনা ওনাদের চিন্তাধারা কি? তবে আমি কিন্তু বেশ হতাশ। আমাদের দেশ আর এখানকার মানুষ এই প্রজেক্ট থেকে বিশেষ কিছু পাবে না। অথচ কর্মসংস্থান আর অন্যান্য ডেভেলপমেন্টই ছিল এই প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য।’ বেশ স্পষ্ট উচ্চারণে বলল সে।
- ‘তুমি এখানে কাজ করতে থাক। তোমার চিন্তাধারা ও কাজের স্টাইল আমার ভাল লেগেছে। বাই দা ওয়ে, একটা কথা জানতে চাই তোমার ব্যাপারে।’
- ‘বলুন কি জানতে চান।’
- ‘তোমার কি আগামী বছরখানেকের মধ্যে রিলোকেট করতে কোন সমস্যা আছে?’
- ‘কেন কি ব্যাপার একটু খুলে বলবেন স্যার?’
- ‘আমাদের নিউ ইয়র্ক অফিসে আমার সাথে কাজ করার জন্য তোমার কথা ভাবছিলাম। এখানে তোমার আগামী কয়েকমাসের কাজকর্ম দেখে আমি বস-কে বলতে পারি।’ একটা যেন বিরাট অফার দিল সে গলায় বেশ উত্তেজনা ফুটিয়ে তুলে।
- ‘কি বলছেন স্যার?’ বিবেক বেশ বিস্মিত।
- ‘হ্যাঁ। আর তাছাড়া মাইনে এবং অন্যান্য ব্যাপার মিলিয়ে তোমার রেমুনারেসন প্রায় পাঁচগুণ বেড়ে যাবে।’
কিছুক্ষণ নৈঃশব্দের পর হাওয়ায় ভেসে এল ওর শীতল কণ্ঠস্বর।
- ‘আমি বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে। বাবা মা আত্মীয়স্বজন আমার কেউ নেই।’
- ‘বর্ধমানে কোথায়? আমিও একটা সময় বর্ধমানে স্কুল জীবনে কিছুদিন পড়াশুনো করেছিলাম।’
- ‘গুস্করা থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে।’
- ‘আচ্ছা? তাই নাকি? বহু যুগ হয়ে গেল ওদিকে যাওয়া হয় না। কোন যোগাযোগও নেই। যাকগে তোমার কথা বল।’
- ‘ওই গ্রামে একটা অনাথদের স্কুলে আমি পড়াশুনো করেছি। একজন মানুষ প্রায় একার চেষ্টায় নিজের সব কিছু দিয়ে, এখানে-সেখানে ভিক্ষে করে চার-পাঁচটা বাচ্চাকে নিয়ে শুরু করেছিলেন। প্রথমে এইসব গরিব বাচ্চাদের শুরুর দিকে অনেকদিন তিনি নিজের কাছেই রেখেছিলেন। পড়াবার জন্য দু এক জন গ্রামের ছাত্রকে নিযুক্ত করেছিলেন। তার নিজের সংসার ছিল না। কেবল একটা মুদীর দোকান ছিল। যা রোজগার হত এই কাজেই ব্যয় করতেন।’
- ‘আচ্ছা? তাই নাকি?’
- ‘স্যার, আপনাকে এত কথা বলছি, কারণ আপনি এতে আমার প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারবেন।’
- ‘নিশ্চয়ই, বল।’
- ‘কিন্তু এভাবে তো স্কুল চলে না। কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার এক এন জি ও স্কুলে পয়সা দিল, অনাথ বাচ্চাদের নামে। এরপর ভালোই চলল স্কুল। হরিশ স্যার নিজে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন স্কুলের জন্য।’
- ‘ওনার নাম কি? হরিশ?’
- ‘হ্যাঁ। হরিশ চন্দ্র হাজরা। খুব ছোটবেলায় আমার বাবা মা দুজনেই মারা যাবার পর গ্রামের লোক আমাকে ওই হাজরা স্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ওখান থেকেই আমি স্কুল পাশ করে পরে ইঞ্জিনিয়ারিং করেছিলাম। হরিশ স্যার নিজেই আমার পড়ার খরচ বহন করতেন।’
- ‘এখন কি অবস্থা সেই অনাথ স্কুলের?’
- ‘এখন আর এন জি ও নেই। কিছু সরকারী অনুদান আছে। অনেক বাচ্চাও পড়ে। আমরা ওখানকার ছাত্ররা যারা চাকরি করি। তারাই চালাই। আমাদের মাইনেপত্র পুরোটাই ওই কাজে ব্যয় হয়। ওখানে প্রচুর কাজ থাকে ছুটিছাটায় সেখানে গিয়ে কাজ করি। হরিশ স্যার অসুস্থ। অত দৌড়ঝাঁপ করতে পারেন না। স্কুলেই যেতে পারেন না। এরকম অবস্থায় আমিও যদি বিদেশে চলে যাই তবে আমার এই মিশনটা ভীষণ ধাক্কা খাবে। বাচ্চাদের কি হবে? আমার যাওয়া হবে না স্যার।’
- ‘কেন? ওখানে বেশি মাইনে পেলে তোমার স্কুল চালাতে তো সুবিধেই হবে। তাছাড়া নিজের কেরিয়ারটাও দেখ তুমি। অনেকদূর যেতে পারবে।’
- ‘সে কি হয় স্যার। আমিই হরিশ স্যারের ডান হাত এখন। তিনি আমাকে জীবন দিয়েছেন। তাকে অসুস্থ অবস্থায় এখানে ফেলে নিজের কেরিয়ার? না স্যার, সেটা পারব না।’
অবাক হল সমর্পণ। হয়ত বা নিজের যুক্তিও হারিয়ে ফেলেছিল। এত ঋজু একজন মানুষ দেখে কিছুটা যেন নুইয়ে গেল সে।
- ‘ঠিক আছে বুঝেছি। তাহলে এখানেই ভালোভাবে কাজ কর। তোমার প্যাকেজ যাতে বাড়ান যায় সেটা আমি দেখব। বিশেষ করে তুমি যখন একটা মিশনের সাথে যুক্ত আছো।’
- ‘কি জানেন স্যার। দেশপাণ্ডে স্যারের কাছে আমি পুরো ব্যাপারটা শুনেছি। কিন্তু যে কোম্পানি শুধুমাত্র মুনাফার জন্য দেশের মানুষকে ঘরছাড়া করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে, সেই কোম্পানিতে আমি নিজে কতদিন টিকতে পারব জানিনা। হয়ত এরাই ‘আমার অসাধু যোগসাজশ আছে’ বলে কেস তৈরি করে আমাকে ছাঁটাই করে দেবে। তাই তার আগেই আমাকে রেজিগনেশন দিতে হবে। চাকরির অভাব আমার হবে না। হয়ত কিছু রসদ জোগাড় করে নিজেই কিছু করব।’ সমুদ্র বাতাস কি আরও জোরে বইছে এখন। কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ছে নতুন নতুন দিগন্তে।
- 'আশ্চর্য লাগছে তোমার কথা। যিনি তোমাকে জীবনে এতটা ইনফ্লুয়েন্স করেছেন সেই হরিশ স্যার সম্পর্কে কিছু বল। উনি নিশ্চয়ই বিদ্বান মানুষ।’
- ‘না না। ওনার কোন কারণে পড়াশুনো হয় নি। শুনেছি বোর্ডের পরীক্ষা দিতে দিতে শেষ করতে পারেন নি।’
- ‘কি বললে? বোর্ডের পরীক্ষা শেষ করতে পারেন নি? কি হয়েছিল বলত?’ হঠাৎ হৃদপিণ্ড যেন দ্রুতবেগে ছুটল তার।
- ‘তা তো ঠিক জানিনা। তবে অন্যের সেবাই যার ধর্ম, তার চেয়ে ধার্মিক আর বিদ্বান মানুষ কি আর আছে।’
- ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। অন্যের জন্য, বিশেষ করে অনাথ বাচ্চাদের জন্য নিজের জীবন কজন দিতে পারে? যাদের সাহায্য করেন তারা বড় হয়। তাদের কথা সবাই জানতে পারে। অথচ সাহায্যকারী নিজে থেকে যান প্রদীপের নিচের অন্ধকারে।’
- ‘হ্যাঁ, উনি অন্যদের সাহায্য করলেও, নিজের কোন প্রচার চান না। নিজে কারও সাহায্য নিতে চান না। গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই চিকিৎসা চলছে তার। বড় ডাক্তার দেখাবার কথা বললেই বলেন। “টাকাপয়সা বাজে খরচা করিস না। অনাথদের স্কুলেই দিয়ে দে। অনেকের সাহায্য হবে।” আর অনাথ স্কুলের বাইরে ওনাকে এখন বিশেষ কেউ চেনেও না। নীরবে অজান্তেই অন্যের জন্য কাজ করে যান তিনি। শরীর খারাপের কারণে এখন স্কুলেও যেতে পারেননা।’
- ‘যদি কখনো বর্ধমানে যাই, কি ভাবে দেখা হতে পারে ওনার সঙ্গে?’
- ‘দেখা? ওনার শরীর খুব খারাপ। প্রায় মৃত্যুশয্যায়। সাস্পেকটেড ক্যান্সার। যদি কখনো যান, গুস্করায় অনাথ স্কুলে গিয়ে হরিশ স্যারের নাম বললেই হবে। কাছাকাছিই থাকেন। তবে যা অবস্থা কিছুদিন পরে সবাই ভুলে যাবে তাকে। সবার অগোচরেই অন্যদের জন্য নিজের পুরো প্রচেষ্টা আর জীবন দিয়ে গেলেন তিনি।’
হরিশ বলে কাউকে কি সে চিনত ওখানকার? নিজে সব কিছু ভুলে গেছে শুধু বাবলা নামটা মনে পড়ছে। সে জানেনা ইনিই বাবলা কিনা। তবে কি এসে যায়। এদের নাম বাবলাই হয়। যে একসময় তাকে ভাসিয়ে রেখে গেছিল নিজে সকলের অগোচরে ডুবে গিয়ে। বালির মধ্যে পা দুটো গেঁথে যাচ্ছিল। ছেলেটা কিছু বলে যাচ্ছিল। কানে ঢুকছিল শুধু হাওয়ার শব্দ। ও চলেও গেল এক সময়। দূরের গান বাজনার আওয়াজ ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছিল। বোধহয় ডিনারের আয়োজন শুরু হচ্ছে। আস্তে আস্তে জুতোজোড়া খুলে সে সমুদ্রের জলে নামল। আরে! দূরে ঢেউয়ের মাথায় অন্ধকারে ওটা কি? একটা গাঙচিল না? দিনের বেলা পারে নি তাই রাতের বেলা সকলের দৃষ্টির অগোচরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে খুঁজে যাচ্ছে মাছ যা কিনা অভুক্ত বাচ্চাদের রসদ। কেউ জানবে না, অন্ধকারে কষ্ট হবে। কিন্তু বাচ্চারা তো খেয়ে পরে বাঁচবে, বড় হবে।
কি সুন্দর লাগছে। ঢেউ এর মাথায় ভেসে রয়েছে অপার্থিব এক শ্বেতপক্ষী। একটা ঘোরের মধ্যে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। রাতের গাঙচিলের সাথে কিছু কথা আছে তার। তাকে খুঁজতে আসা, তীরে দাঁড়ানো দেশপাণ্ডে সাহেব এবং অন্যান্যদের উচ্চকণ্ঠে নিষেধ কানে যাচ্ছে না তার। সে শুধু দেখছে ঢেউ এর মাথায় অন্ধকারে উড়ছে, ভাসছে এক অক্লান্ত গাঙচিল।
(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)