Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines





পরবাসে উদয় চট্টোপাধ্যায়ের
লেখা


ISSN 1563-8685




সাধক কবি কমলাকান্ত

বাঙালির ধর্মচর্চায় শক্তিপূজা বা মাতৃপূজার এক বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। বহু মাতৃসাধক সাধনার অঙ্গ হিসাবে রচনা করেছেন এবং গেয়েছেন মাতৃসংগীত যা শাক্তপদাবলি নামে সাহিত্যে স্থান লাভ করেছে। সাধারণ্যে সেগুলি উমাসংগীত শ্যামাসংগীত নামে প্রচলিত। যাঁদের রচিত শ্যামাসংগীত এখনও বাঙালির হৃদয় ভরিয়ে রেখেছে তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, রামদুলাল নন্দী, দাশরথি রায়, ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল এবং কাজি নজরুল ইসলাম। আমাদের আলোচ্য কমলাকান্ত রচিত ‘সদানন্দময়ী কালী’ কিংবা ‘শ্যামা মা কি আমার কালো রে’ তো সর্বজনবিদিত। শক্তিসাধনার যে ধারাবাহিকতায় এইসব সংগীতের সৃষ্টি সেই শক্তিসাধনার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত দিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা যাক।

মানবসভ্যতার উন্মেষপর্বেই প্রাকৃতিক ঘটনাবলির নিয়ন্ত্রক হিসাবে মানুষ কল্পনা করেছে দেবদেবীর, আরও পরে সবকিছুর নিয়ামক হিসাবে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের। ভারতে প্রাক্‌-আর্য সিন্ধুসভ্যতায় দেবদেবীর মূর্তির ও মন্দিরের নিদর্শন মিলেছে। পরবর্তী আর্যসভ্যতায় এ-দুটোই অনুপস্থিত। আর্য ঋষিরা কল্পনা করেছিলেন ইন্দ্র বরুণ মিত্র পর্জন্যের মতো পরাক্রান্ত দেবতাদের। মূর্তি গড়ে তাঁদের পূজার রেওয়াজ ছিল না। আর্যরা করতেন যজ্ঞ অনুষ্ঠান। বেদি তৈরি, অগ্নি প্রজ্জ্বলন, আহুতি—এ-সবকিছুর জন্যেই ছিল বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন। বৈদিক দেবতাদের মধ্যে ব্রহ্মা মহেশ্বর অনুপস্থিত, বিষ্ণু উল্লিখিত হলেও কোন প্রধান দেবতা হিসাবে নয়। তেমনই অনুপস্থিত কোন পরাক্রান্তা দেবীও। দেবী হিসাবে ঊষার অপূর্ব বর্ণনা আছে ঋগ্‌বেদে, আছে রাত্রি দেবীরও। সরস্বতী নদীর তীরে গড়ে-ওঠা সভ্যতার সুবাদে দেবী সরস্বতী আরাধিতা হয়েছেন বাক্‌-এর অধিশ্বরী হিসাবে—আর তখন বেদবেদান্ত তো বাক্‌-সর্বস্বই। বাগ্‌দেবী সরস্বতী পরবর্তী কালে বেদমাতা-রূপে কীর্তিতা হয়েছেন।

আদিকাব্য ঋগ্‌বেদে পাই ‘নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ’। সৃষ্টির আগে ছিল শুধু এক অখণ্ড, সচ্চিদানন্দের অতিমানস। তিনি ভাবলেন ‘এক: স্যাম্‌ বহুধা ভবেম’, আর সেই সংকল্প থেকেই সৃষ্টি হল আদ্যা পরা চিৎরূপিণী শক্তির। সেই শক্তির কোন প্রতিষ্ঠিত রূপ বা পূজাপদ্ধতি বৈদিক কর্মকাণ্ডে অনুপস্থিত। অথচ একথা কল্পনা করতে কষ্ট হয় না আর্যসংস্কৃতির পাশাপাশি অনার্যসংস্কৃতির ধারা প্রবাহিত হয়েছে অনবচ্ছিন্নভাবে, এবং একে অপরকে প্রভাবিত করেছে। তাই অনিবার্যভাবে পরবর্তী সময়ে অরণ্যচারী বৃষবাহন শিব আর্যসংস্কৃতিতে একাত্ম হয়েছেন বৈদিক রুদ্রের সঙ্গে, আর অনার্য মাতৃমূর্তি শিবানী/রুদ্রাণী হিসাবে—পরে তিনিই চণ্ডী দুর্গা বা অন্যান্য নামে বৃতা হয়েছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এইসব দেবদেবীর পূজকরা বেদনিষ্ঠ ব্রাহ্মণদের কাছে ‘ব্রাত্য’ নামে অবজ্ঞাত হয়েছেন। এর সংশোধন হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে—অথর্ববেদের সমগ্র পঞ্চদশ কাণ্ডে ব্রাত্য-মহিমা বিবৃত হয়েছে, অর্থাৎ ততদিনে লৌকিক পূজাপার্বণ আর্যসংস্কৃতির অনুমোদন লাভ করেছে।

প্রাচীনতম বৈদিক সূক্তে মাতৃদেবীর স্পষ্ট উল্লেখ না-থাকলেও অথর্ববেদে উল্লেখিত হয়েছেন তেজোদীপ্তা এক দেবী—যিনি বায়ু পর্জন্য বরুণের শক্তিদাত্রী, এবং যিনি ইন্দ্রের জন্মদাত্রী। ‘কেন’ উপনিষদে এই দেবীকেই উমা হৈমবতী অভিহিত করা হয়েছে। দার্শনিক দৃষ্টিতে তিনি ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী—তিনিই দেবতাগণকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করেছেন; তিনিই আদিশক্তি, জ্যোতিরূপা হওয়ার জন্য সুবর্ণকান্তি হৈমবতী। হিমবৎ পর্বতের কন্যা হিসাবেও হৈমবতী নামের উৎপত্তি হতে পারে—ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে যেটি বেশি অর্থবহ—‘কেন’ উপনিষদের কালে হিমবৎ-পর্বতকন্যা উমার একটি বিশিষ্ট দেবীরূপে প্রসিদ্ধি ছিল। পরবর্তী কালের পুরাণসমূহে ভারতের নানাস্থানে পূজিতা বহু দেবীর নাম উল্লিখিত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান তত্ত্ববুদ্ধিতে এই সমস্ত দেবীকে একীভূত করে এক মহাদেবী আদ্যাশক্তির ধারণা বিকশিত হয়েছে।

চণ্ডী বা চণ্ডিকা দেবীর প্রথম আবির্ভাব মার্কণ্ডেয় পুরাণে। এই পুরাণের অন্তর্গত দেবী-মাহাত্ম্য নামক ত্রয়োদশ অধ্যায়ই হল প্রসিদ্ধ ‘চণ্ডী’ গ্রন্থ। চণ্ডীতে দুর্গা নাম কয়েকস্থানে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু উমা নামটির উল্লেখ একবারের জন্যও নয়, এবং শিবজায়া হিসাবেও নয়। দেবীকে তিনবার পার্বতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু তা পর্বতকন্যা পার্বতীরূপে নয়—পর্বতবাসিনী পার্বতীরূপে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ রচনার আগেই সিন্ধুসভ্যতার যুগ থেকে প্রবাহিত শক্তিসাধনার ধারায় হিন্দুতন্ত্রে গৃহীত হয়েছেন হরিবংশে বর্ণিতা শবর-বর্বর-পুলিন্দদের পূজিতা বিন্ধ্যবাসিনী, নানান নামে নানাস্থানে পূজিতা বহু লৌকিক দেবী, বৌদ্ধদেবী তারা এবং অরণ্য শ্মশানচারী কালী। কালীভক্ত কাপালিকদের প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় মৈত্রী উপনিষদে, যেখানে ‘কষায়-কুণ্ডলিম:-কাপালিন:’-কে স্বর্গবাসের অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মৈত্রী উপনিষদের রচনাকাল মার্কণ্ডেয় পুরাণের পূর্ববর্তী—শক্তিসাধনা, সতী ও দশমহাবিদ্যার কাহিনি ভারতবর্ষে তখন সুপ্রতিষ্ঠিত।

বঙ্গদেশে শক্তিসাধনার ইতিহাসে প্রথম সুপ্রসিদ্ধ নাম কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তিনি শ্রীচৈতন্যদেবের সমসাময়িক ও সহপাঠী ছিলেন বলে মনে করা হয়। সময়টা পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণ। বর্তমানে কালী যে-রূপে পূজিতা হন সেটা তাঁরই পরিকল্পনা-প্রসূত, এবং সেটা তিনি করেছিলেন বিভিন্ন পুরাণ-অন্তর্গত ‘কালীতন্ত্র’-ধৃত কালীর বর্ণনা ‘করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং...’-এর উপর ভিত্তি করে। তখন বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের জোয়ার, এবং তার পরবর্তী সময়ে সম্রাট শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে শাক্তমন্দির নির্মাণের উপর বাধা আরোপ থাকায় কালীপূজার অনুষ্ঠান প্রছন্নভাবেই প্রবাহিত ছিল। এখানে উল্লেখ্য, বাংলায় দুর্গাপূজা তার পূর্বেই প্রবর্তিত হয়েছিল এবং ষোড়শ শতাব্দীতে আকবরের রাজত্বকালে উত্তরবঙ্গের রাজা কংসানারায়ণ মহাসমারোহে দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান করেছিলেন। তবে দুর্গাপূজায় উৎসবের দিকই প্রবল, শক্তিসাধকের সাধনার কেন্দ্রবিন্দুতে দেবী কালীই সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিতা। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে বঙ্গদেশে পুনর্বার কালীমূর্তি ও কালীমন্দির স্থাপনার জোয়ার এসেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বর্গী মারাঠা সেনাপতি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও অংশগ্রহণ এক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। একটি তথ্য থেকে জানা যায় বঙ্গদেশে প্রাচীন কালীমন্দিরগুলির শতকরা চুরাশি ভাগ স্থাপিত হয়েছিল ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পরে। সাধনার অঙ্গ হিসাবে শ্যামাসংগীত রচনা ও গীত হওয়ার সূত্রপাতও সেই সময় থেকেই। মুর্শিদাবাদের মহারাজ নন্দকুমার কালীভক্ত ছিলেন এবং তাঁর রচিত কয়েকটি শ্যামাসংগীত জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে বঙ্গদেশে শ্যামাসংগীত রচনায় জোয়ার এনেছিলেন দুই কালীসাধক—রামপ্রসাদ সেন (১৭২৩-১৭৭৫), আর কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (১৭৭০-১৮১৮)।

কমলাকান্তের জন্মস্থান বর্ধমান জেলার গঙ্গাতীরস্থ অম্বিকা কালনা। মাতার নামা মহামায়া, পিতার নাম মহেশ্বর। দশ বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। বালক কমলাকান্ত সুগায়ক ছিলেন এবং রামপ্রসাদের গানে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি মাঠে ঘাটে আপনমনে গান গেয়ে বেড়াতেন। শোনা যায়, একদিন রাত্রে গঙ্গাতীরের শ্মশানের অন্ধকারে আত্মমগ্ন হয়ে গান গাইবার সময় এক অশরীরী তান্ত্রিক কাপালিক তাঁকে কালীনামে দীক্ষা দিয়ে যান এবং সেই মন্ত্র জপ করতে করতে সেখানেই আনন্দময়ী নৃত্যরতা ‘স্মেরাননী’ (স্মিত-আননা) শ্যামা মায়ের দর্শন পান। এই ঘটনার পর থেকে তিনি চান্না গ্রামে মাতুলালয়ে থেকে বিদ্যা ও সংগীতচর্চা করতে থাকেন। এখানেই তাঁর বিবাহ হয়, তবে বিবাহজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি—অল্প কিছু সময়ের মধ্যে পর পর তাঁর মাতৃবিয়োগ ও পত্নীবিয়োগ ঘটে। শোনা যায়, চিতাগ্নির মধ্যে জগদম্বার আবির্ভাব দেখে তিনি চিতার চারপাশে নৃত্য করতে করতে গেয়েছিলেন তাঁর সদ্যরচিত গান—

কালী! সব ঘুচালি লেঠা,
তোমার যারে কৃপা হয়, তার সৃষ্টিছাড়া রূপের ছটা
তার কটিতে কৌপিন জোটে না, গায়ে ছাই আর মাথায় জটা
শ্মশান পেলে সুখে ভাসে, তুচ্ছ ভাবে মণিকোঠা।

চান্নার বিশালাক্ষী মন্দিরে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন কমলাকান্ত এবং আচার্যপদে বৃত হন।

কমলাকান্তের কালীভক্তির কথা অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁর রচিত শ্যামাসংগীত জনসমাদর লাভ করে। বর্ধমানরাজ তেজচাঁদ মহতাব সংগীতপ্রেমী ছিলেন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কালনার রাজপ্রাসাদের সভাগৃহে আয়োজিত এক সাংগীতিক জলসায় কমলাকান্ত সংগীত পরিবেশন করেছিলেন, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘আদর করে হৃদে রাখো আদরিণী শ্যামা মাকে’, যা পরবর্তী পাঠান্তরে হয়েছে ‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে’। এর অনতিকাল পরেই রাজা তেজচাঁদ কমলাকান্তকে বর্ধমান শহরে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন এবং বর্ধমান রাজবাড়ির সন্নিকটে কোটালহাটে তাঁর জন্য এক কালীমন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। এভাবেই কমলাকান্ত বর্ধমান নগরীর স্থায়ী বাসিন্দা হন, এবং আনুমানিক ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।

তেজচাঁদের পুত্র প্রতাপচাঁদ মহতাব ছিলেন কমলাকান্তের সাধনপথের অনুগামী। তিনি নিজেও বেশ কয়েকটি শ্যামাসংগীত রচনা করেছিলেন। পরবর্তী বর্ধমানরাজ মহতাবচাঁদের (রাজ্যকাল ১৮৩২–১৮৭৯) উদ্যোগে কমলাকান্ত-রচিত গীতিসমূহের সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম প্রকাশনায় শিব, কৃষ্ণ, চৈতন্য সম্পর্কিত ২৪টি, উমা সম্পর্কিত ৩২টি এবং শ্যামাসংগীত ২১৩টি—সর্বসাকুল্যে ২৬৯টি কাব্যগীতি মুদ্রিত হয়েছিল। কথামৃতের সুবাদে জানতে পারা যায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কমলাকান্তের কয়েকটি শ্যামাসংগীতের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন এবং গাইতেন। কমলাকান্তের গীতিসংগ্রহের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। সেইটির এক কপি সংগ্রহ করে শ্রীরামকৃষ্ণভক্তেরা ডা: মহেন্দ্রলাল সরকারকে উপহার দেন। শ্রীরামকৃষ্ণের গাওয়া গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মজল আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ হৃৎকমলে’, ‘শ্যামা মা কি আমার কালো রে’, ‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে’, ‘শ্যামাধন কি সবাই পায়’ এবং ‘সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনমোহিনী’।

আধ্যাত্মিক সাধকের কাছে সংগীত ভগবৎ-সাধনারই এক অঙ্গ। আউল-বাউল, মীরারাই, নানক, কবীর, তুকারাম সকলেই গানের অর্ঘ্য সাজিয়েছেন তাঁদের উপাস্যের উদ্দেশ্যে। সেই ধারা প্রবাহিত হয়েছে রামপ্রসাদ আর কমলাকান্তের গানে, এবং অনেক পরিশীলিত রূপে রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানে। কমলাকান্ত রামপ্রসাদের উত্তরসূরী, বাল্যকাল থেকেই তাঁর ভক্তিগীতিতে প্রভাবিত। তাই তাঁর কিছু গান, কিঞ্চিদধিক দশ শতাংশ, প্রসাদী সুরে আধারিত। তবে প্রথাগতভাবে রাগসংগীত শিক্ষার কারণে কমলাকান্তের অধিকাংশ গানই রাগাশ্রয়ী এবং যথাযথ তালনিবদ্ধ। রামপ্রসাদের গানের সঙ্গে তাঁর গানগুলির আর একটা পার্থক্য আছে যা অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর উদ্ধৃতিতে—‘রামপ্রসাদের শ্যামাসংগীত সুরে সমর্পিত হইবার অপেক্ষা রাখে, গানে না শুনিলে তাহার অর্ধেক মাধুর্য নষ্ট হইয়া যায়। কিন্তু কমলাকান্তের পদাবলি গীতিকবিতার মতন আস্বাদ্য, কেবলমাত্র আবৃত্তি করিয়াও তাহার মাধুর্য আস্বাদন করা সম্ভব।’

শাক্তসাধনায় দুটি ধারা—একটি কন্যাভাব, অপরটি মাতৃভাব। এই দুটি ভাবকেই উপজীব্য করে রচিত হয়েছে শাক্ত পদাবলি। শাক্ত পদাবলিকে সাধারণত দুভাগে ভাগ করা হয়—লীলা সংগীত ও বিশুদ্ধ সাধন সংগীত। লীলা সংগীতে বর্ণিত হয়েছে উমার স্বামিগৃহ কৈলাস থেকে পিতৃগৃহে গিরিরাজ ও মেনকার সন্নিধানে আগমন এবং সেখানে তিনদিন অবস্থান করে পুনরায় কৈলাসে প্রত্যাবর্তন। সাধন সংগীতে বিধৃত হয়েছে শ্যামামায়ের রূপের ধ্যান ও তন্ত্রসাধনার মর্মকথা। রামপ্রসাদকে আগমনী-বিজয়া সংগীতের পথিকৃৎ গণ্য করা যাতে পারে। মুখ্যত অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে রচিত এই সব সংগীতে সমসাময়িক সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজের বাস্তব রপের এক চিত্র পাওয়া যায়—শারদীয়া পূজায় দুর্গার আগমন যেন বাঙালিঘরের কন্যার পিতৃগৃহে আগমন। কিন্তু কমলাকান্তের আগমনী সংগীতেই সর্বপ্রথম উমা-শ্যামার দার্শনিক, আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক সমন্বয়ের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর কাছে কন্যাই মাতা, উমাই শ্যামা। ‘আমি কী হেরিলাম নিশি-স্বপনে’ গানে তিনি গিরিরানিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন—

যে রূপ হেরিলে তুমি অনায়াসে শয়নে,
ও পদ-পঙ্কজ লাগি শঙ্কর হয়েছে যোগী গো
হর হৃদি-মাঝে রাখে অতি যতনে।

আবার, আগমনী গানের যে মূল সুর—কন্যার জন্য বাঙালি মায়ের মর্মবেদনা—তা রূপ পেয়েছে তাঁর রচনায়:

ওহে গিরিরাজ, গৌরী অভিমান করেছে। মনোদু:খে নারদে কত কয়েছে—
দেব দিগম্বরে সঁপিয়া আমারে, মা বুঝি নিতান্ত পাসরেছে।

মাতৃভাবে রচিত তাঁর সংগীতগুলিতে ব্যক্ত হয়েছে শ্যামামায়ের প্রতি তাঁর অবিচল নির্ভরতা—

শ্যামামায়ের ভবতরঙ্গ, কেমন কে জানে।
কৌতুক দেখিব বলি, মা মোর দিয়েছে ফেলে।
দূর নয়, নিকট তরী অনায়াসে ধরতে পারি
আমি উজান উঠব মনে করি, কে পাছু পানে টানে।
তবে তরি, যদি তারা তরে নিজ গুণে।

তেমনই সন্তানসুলভ অভিমানের এক অপূর্ব অভিব্যক্তি ঘটেছে তাঁর এই গানটিতে—

কুপুত্র অনেক হয়, কুমাতা কখনও নয়,
বঞ্চনা উচিত হয় কি অধীন জনে মা!
কমলাকান্তের প্রতি কিঞ্চিৎ না হের যদি
পতিতপাবনী নাম রাখিবে কি গুণে গো।

সাধকের কাছে ইষ্ট ধরা দেন সাধকেরই অভীপ্সিত রূপে- ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী’। কৈশোরাবধি কমলাকান্ত জলদবরণী মুক্তকেশী মুণ্ডমালিনীর রূপে মুগ্ধ, এবং সে-মুগ্ধতা বিচারের অপেক্ষা রাখে না। সেই অকপট স্বীকারোক্তি বিবৃত হয়েছে তাঁর এই সব গানে—

কেন মন ভুলিল শ্যামারূপ হেরিয়ে আমি তো কিছুই না জানি,
ধন-পরিজন সুখ-বাসনা যত আমার ঘুচিল হেন অনুমানি।
সহজে উলঙ্গ অঙ্গ, নাহি সম্বরে, বামা সজল জলদ তনুখানি,
না জানি কী মন্ত্রতন্ত্র গুণ জানে বামা,
কী গুণে স্ববশ করে প্রাণী।।

****

তেঁই শ্যামারূপ ভালবাসি, কালী জগমোহিনী এলোকেশী।
সবাই বলে কালো কালী, আমি দেখি অকলঙ্ক শশী।।

****

কমলাকান্তের চিত সেই হতে উন্মত্ত
যে অবধি কালো রূপ অন্তরে লেগেছে।।

****

মজল আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে,
কত বিষয়মধু তুচ্ছ হল কামাদি কুসুম সকলে।
চরণ কালো ভ্রমর কালো কালোয় কালো মিশে গেল,
পঞ্চতত্ত্ব, প্রধান মত্ত, রঙ্গ দেখে ভঙ্গ দিলে।
কমলাকান্তেরই মনে আশাপূর্ণ এতদিনে
তার সুখ-দু:খ সমান হল আনন্দ-সাগর উথলে।।

কিন্তু সব সাধকই অদ্বয়বাদী—সমস্ত সৃষ্টির মূলে এক সত্যে বিশ্বাসী। অদ্বৈতবাদের জ্ঞান আর দ্বৈতবাদের ভক্তি সাধকচিত্তে সমান দীপ্তিতে বিরাজমান। বাহিরে পরমাশক্তিকে যে-রূপেই তিনি গ্রহণ করুন না কেন, তাঁর অন্তর উদ্ভাসিত করে থাকেন এক অদ্বৈত ব্রহ্ম কিংবা অদ্বিতীয়া সনাতনী। তাই কমলাকান্তের কাছে প্রতিভাত হয় শ্যাম ও শ্যামার অভিন্নতা—

জান না রে মন পরম কারণ, কালী কেবল মেয়ে নয়,
মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ কখনো কখনো পুরুষ হয়।
হয়ে এলোকেশী করে লয়ে অসি দনুজ-তনয়ে করে সভয়
কভু ব্রজপুরে আসি, বাজাইয়ে বাঁশি, ব্রজাঙ্গনার মন হরিয়ে লয়।।

শ্যামা মায়ের কালো রূপ ঘুচে গিয়ে তাঁর কাছে ধরা দেয় কালীর অনন্ত পরিব্যাপী রূপমাধুরী—

শ্যামা মা কি আমার কালো রে!
কালো রূপে দিগম্বরী হৃদিপদ্ম করে আলো রে।
আমি জানিতে না পারি জননী কেমন, ভাবিতে জনম গেল রে।
মা মোর কখনো প্রকৃতি কখনো পুরুষ, কখনো শূন্য মহাকাল রে,
আরে কমলাকান্ত ও ভাব ভাবিয়ে সহজে পাগল হল রে।

তাঁর আরাধ্যা মহাকালের মনোমোহিনী সদানন্দময়ী কালীমাতাকে অধ্যাত্মচেতনায় উদ্ভাসিত কমলাকান্ত দিব্য নৃত্যরূপা দর্শন করেন, কিন্তু তাঁকে প্রশ্ন করতে ছাড়েন না—

আদিভূতা সনাতনী শূন্যরূপা শশীভালী,
ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?

এমন কী তিনি গালি দিয়ে অনুযোগ করেন যে অনন্তের সাকার কল্পনায় তাঁর এই চিত্তবিভ্রম ঘটিয়েছেন সেই আদিশক্তিই—

অশান্ত কমলাকান্ত দিয়ে বলে গালাগালি
এবার সর্বনাশী ধরে অসি ধর্মাধর্ম দুটো খেলি।।

এই গানের মধ্যে সর্বোচ্চ দর্শন, আধ্যাত্মিক আনন্দ এবং অপূর্ব সংগীতরসের এক সার্থক সমন্বয় ঘটেছে।

তথ্যসূত্র:

১। ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য—শশিভূষণ দাশগুপ্ত (সাহিত্য সংসদ), ১৩৬৭

২। মাতৃসাধনা ও কমলাকান্ত—অরুণকুমার বিশ্বাস (সিগনেট প্রেস), ২০১৩

৩। শাক্তপদাবলী ও শক্তিসাধনা—জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী (ডি. এম. লাইব্রেরি), ১৩৬৩



(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)



অলংকরণঃ সঞ্চারী মুখার্জী