মিহির সেনগুপ্ত বাংলা ভাষার এক আশ্চর্য লেখক, যিনি তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা সমূহে বাংলা স্মৃতিসাহিত্যের খালে জোয়ারের স্ফীতি এনে দিয়েছেন। ছিন্নমূল মানুষের যন্ত্রণা আর জীবনের নড়ে যাওয়া ভরকেন্দ্রের কাহিনি নেহাৎ কম নেই। তবু সেই সব কাহিনিতে কোথাও খানিক নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব, কোথাও মনের মাধুরীর টানে আবেগের স্রোতে ডুবুডুবু শান্তিপুর। কিন্তু জীবনের মাদারিকা খেল দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠা মিহির সেনগুপ্ত জীবন সম্পর্কে অদ্ভুত এক প্রশান্ত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছেন। কোনো অভিযোগের ত্রিসীমানায় না থেকে বরং ধরেছেন স্মৃতির হাত। যে-স্মৃতি বাঙালির গত সত্তর বছরের সমষ্টিগত স্মৃতিরই অংশ।
সদ্য-শরতের এক দুপুরে লেখকের ভদ্রাসনে পরবাসের পক্ষে হাজির হয়েছিলেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়, অরণি বসু, রাজীব চক্রবর্তী আর সিদ্ধার্থ সেন। গোটা দুপুর জুড়ে চলল স্মৃতিযাপন। পরবাসের পাতায় কয়েক কিস্তিতে সেই কথাবার্তা।
পরবাস: আপনি লেখা শুরুর ব্যাপারে ১৯৯২ সালের কথা বললেন। মানে ‘বিষাদবৃক্ষ’ যখন লিখছেন।
মিহির সেনগুপ্ত: ১৯৯৩-এ আমি লিখতে শুরু করেছি। কিন্তু 'ভাটিপুত্রের বাখোয়াজি পত্র' যে লেখাটা মানে তপনদার কাছে যে চিঠিটা সেটা 'রোমন্থন অথবা ভীমরতি প্রাপ্তর পরচরিত চর্চা' পড়ে চিঠি লেখা। তার আগে আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচিত ছিলাম না। নামও শুনিনি আমি। বাড়ি চিনতাম, তাদের ফ্যামিলি জানতাম কিন্তু উনি দেশে থাকতেন না, সুতরাং চেনার সুযোগ হয়নি। লেখাটা পড়ে আমি দেখলাম, যে ছড়াগুলি উনি লিখেছেন তার ছন্দ-টন্দ ঠিক নেই। তো সেগুলো ঠিকঠাক করে আমি একটা রিজয়েন্ডার করলাম। সেই রিজয়েন্ডারটাই চিঠি হিসেবে পাঠালাম। তার আগে আমি অবশ্য একটা এমনি চিঠি লিখলাম অক্সফোর্ডে। যে আপনার বইটা পড়ে আমার কিছু চৈতন্য হয়েছে। কিছু ভুলভ্রান্তিও নজরে পড়েছে। তথ্যগত কোনো ভুল নেই কিন্তু ছড়াগুলোতে এই ছন্দ চলবে না। এই ছন্দ মেলে না, বরিশালি একটা আলাদা ব্যাপার আছে। এইসময় কিন্তু একই সাথে আমার ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ লেখা হচ্ছে। তাই বললাম, আমি লেখাটা আপনাকে পাঠাতে চাই, পাঠাবো কি? উনি সাধারণত চিঠিপত্র লেখায় বিশ্বাস করতেন না। যাইহোক বেশ কিছুদিন বাদে একটা অত্যন্ত কদর্য হাতের লেখায় দুলাইন, আপনি কোন বাড়ির ছেলে ইত্যাদি প্রশ্ন করে। জানালেন, লেখাটা অবশ্যই পাঠাবেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠাবেন। তখন আমি লেখাটা পাঠালাম।
পরবাস: আপনার 'বিষাদবৃক্ষ' লেখা একধরনের ট্রমা-মোচনের দিকে এগোনোর প্রয়াস। জীবনের নিবিড় অনুভূতিমালার ইতিহাসে এভাবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু লেখক হিসেবে গড়ে ওঠার যে একটা পদ্ধতি, সেটা তো আপনার মধ্যে আগে থেকে ছিল।
মিহির সেনগুপ্ত: না, ছিল না। কারণ আমি কোনো লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্টের মধ্যে দিয়ে আসিনি।
পরবাস: না, তা আপনি আসেননি। কিন্তু লেখালিখির জগতে তো আপনি ছিলেন।
মিহির সেনগুপ্ত: হ্যাঁ, সে আমি লেখালিখি বা শিল্পকে পছন্দ করি, পড়াশোনাটা করতাম। অভিজিৎ লিখত। অভিজিতের আমি খুব মুগ্ধ পাঠক। তো অভিজিতের লেখা পৌঁছে দেওয়া। নির্মাল্য আচার্যর সঙ্গে কফি হাউসে দিনের পর দিন আড্ডা মারা। অভিজিতের লেখা নিয়ে ‘এক্ষণ’-এ বার করা। এই ব্যাপারগুলো ছিল।
পরবাস: অভিজিৎ সেনের লেখা তো একসময় ‘এক্ষণ’ পত্রিকার মাধ্যমে বহু মনস্ক পাঠকের কাছে পৌঁছেছিল। বিশেষ করে ধরুন ‘বর্গক্ষেত্র’-র মতো একটা লেখা, কেবলমাত্র 'বর্গক্ষেত্র' ছাপা হবে বলে ‘এক্ষণ’-এর একটা সংখ্যা হয়েছিল। এটা তো একজন লেখকের পক্ষে বিরাট সম্মানেরও বটে।
মিহির সেনগুপ্ত: সে তো বটেই। আর ওইরকম একজন এডিটর আবার কতদিনে আমরা পাবো জানিনা। ওই সময়ে নির্মাল্যদার সঙ্গে আমার যোগাযোগটাও হত কারণ আমি এখানে থাকতাম। আমি হয়তো বালুরঘাটে গেলাম, অভিজিৎ তখন বালুরঘাটে থাকে। আমি লেখাটা নিয়ে এলাম। বা কখনো ও কারুর মারফতে আমার কাছে পাঠিয়ে দিত। ‘রহু চণ্ডালের হাড়’-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুব চমকপদ হয়েছিল। ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ প্রথমে একটা গল্প ছিল। গল্পটা কোথাও প্রকাশ হয়নি। এক্ষেত্রে প্রকাশ করার জন্য আমাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে, ‘নির্মাল্যদাকে দিস,’ এই বলে। নির্মাল্যদা তখন একটি ইংরেজি প্রকাশনায় কাজ করেন। উনি আমাকে আমার অফিস নম্বরে টেলিফোন করে বললেন, ‘তুমি একবার এসো তো।’ তার আগেই আমি গল্পটা দিয়ে এসেছি। ওনার কাছে যেতে উনি বললেন যে, ‘তুমি অভিজিৎকে জানিয়ে দাও যে গল্পটা আমি এই অবস্থায় ছাপতে রাজি আছি। কিন্তু আমার মত হচ্ছে যে ও ছ-মাস লেখাটা ফেলে রাখুক, ফেলে রেখে এটাকে উপন্যাস হিসেবে লিখুক।’ আমার পরিষ্কার মনে আছে আমাকে বলেছিলেন, যে তোমার যদি এখন যাবার অসুবিধে থাকে তোমাকে আমি ভাড়া দিচ্ছি তুমি বালুরঘাট যাও। হাতে হাতে দিয়ে আসবে এবং বলবে ছ’মাসের মধ্যে আমি এই লেখাটা চাই। যাইহোক তার মধ্যে অভিজিৎই আসুক বা আমি গিয়েছিলাম সে কথা এতদিনে আর মনে নেই। প্রায় ৭০-এর দশকের শেষ দিকের কথা হবে। এই কাজগুলো আমি করতাম।
পরবাস: আমরা ওই সময়টা আর একটু শুনতে চাইব, মানে আপনার লেখা তখনও শুরু হয়নি এবং আপনি প্রায় ক্যুরিয়ারের ভূমিকা পালন করেছেন। অভিজিৎদা যা লিখছেন সেগুলো নিয়ে আপনি বিভিন্ন মানুষের কাছে যাচ্ছেন, বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন ওদের সঙ্গে মোলাকাত হচ্ছে...
মিহির সেনগুপ্ত: না, না। প্রথম কথা হচ্ছে যে অভিজিৎ ইজ মোর এ ফ্রেন্ড দ্যান এলডার ব্রাদার টু মি। তো অভিজিতের লেখার ব্যাপারে আমার প্রচেষ্টাটা শুরু হয়েছে যখন আমি কলকাতা অফিসে কাজ করি। আমি যে ডিপার্টমেন্টে ছিলাম সেখানে কবিতা সিংহের হাজব্যান্ড বিমল রায়চৌধুরী কাজ করতেন। আরও এই ধরনের লোকেরা কাজ করতেন। ‘কালি ও কলম’ বলে একটা পত্রিকা ছিল তখন।
পরবাস: হ্যাঁ, প্রকাশভবনের শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়রা করতেন।
মিহির সেনগুপ্ত: কারা করতেন আমি জানি না, তবে তখন ছিল। এই ধরনের পত্রপত্রিকাগুলো তখন বিজ্ঞাপনের জন্য আমার ডিপার্টমেন্টে আসত। অভিজিতের গল্পগুলো আমার কাছেই থাকত বেশিরভাগ। কারণ ওর ওদের সঙ্গে ডাইরেক্ট কনট্যাক্টে আসার সুযোগ কখনোই ছিল না। তখন ওর প্রথম যে গল্পটা প্রকাশিত হয়, যার কপিটা আমি পরে পাইনি, নাম ছিল ‘বিস্ফোরণের পরে’।
পরবাস: এটা কোনো বইতে নেই?
মিহির সেনগুপ্ত: না, কোনো বইতে নেই। অভিজিতের নিজের কাছেও নেই। ‘সম্পর্ক’ বলে একটা গল্প, সেগুলো সব ছোট ছোট পত্রিকায়, অফিসে থেকে যেমন বার করে, এই ধরনের পত্রিকায় বেরিয়েছিল। তারপরে কলেজ স্ট্রিটের সম্পর্কটা তৈরি হল ওর নিজের চেষ্টায়। তখন এইসব গল্পগুলো পৌঁছনোর একটা দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। নির্মাল্যদা বলেছিলেন আমি নাকি অনেকটা ভূদেব ভাদুড়ীর মতো। আমি জিগ্যেস করলাম ভূদেব ভাদুড়ী কে! বললেন সতীনাথ ভাদুড়ীর বড় ভাই। আনফরচুনেটলি আমি অভিজিতের ছোট ভাই হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সবাই বড় ভাই বলে জানে, অন্তত বালুরঘাটে। যাই হোক এগুলো হল ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং ভালোবাসার কথা। তখন এইরকম সুযোগ আমাদের হত। ইন্দ্রদার (সুবর্ণরেখা) ওখানে যোগাযোগটা অভিজিতের মাধ্যমেই হয়েছে আমার। নির্মাল্যদার সঙ্গেও প্রাথমিক পরিচয় ওর মাধ্যমেই হয়েছিল, তারপর আমি যোগাযোগটা বজায় রেখেছিলাম।
পরবাস: ৭২-এ আপনি বিয়ে করতে গেলেন বাংলাদেশে। ছিলেন মাসখানেক বরিশালে। গ্রামের বাইরে, মূলত ঢাকা-কেন্দ্রিক যে শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সমাজ সেখানে আপনার বন্ধুত্ব তৈরি হয়নি?
মিহির সেনগুপ্ত: না, বন্ধু ছিল না। গ্রামের কেউ ঢাকায় চাকরিসূত্রে পদস্থ হয়ে গিয়ে থাকলে তাদের দু-একজনের সঙ্গে একটু পরিচয় ছিল। কিন্তু কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না। ৭২-এ আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু সেটা ছিল সদ্য বিবাহিত এক দম্পতির স্টিমার-ভ্রমণ গোছের। তারপরে যাই ১৯৮৮ সালে। ৮৮-তে আমি ফুলকোর্স ঢাকা ঘুরলাম। এখানে একটা বড় কথা আছে। এখলাসউদ্দিন আহমেদ বলে একজন শিল্পী বা ছড়াকার ছিলেন, তিনি কলকাতায় আসতেন। উনি অরিজিনালি এখানকারই লোক। খুব সম্ভবত ৬৪-এর দাঙ্গায় ওদিকে চলে গিয়েছিলেন। রমেনদা মানে কবি রমেন আচার্য আর এখলাসউদ্দিনরা এক গ্রুপের লোক ছিলেন। ওই গ্রুপের অনেকেই মারা গেছেন। এখলাসদাই নেই। এখলাসদাকে আমরা সবাই গোরাদা বলে ডাকতাম। তখন ওই সময়টায় তরুণ পাইন, আমি, আর অসিত সেন মানে একুশে-র প্রতিষ্ঠাতা, সব ছিলাম। তরুণ একদিন ধরল আমাকে যে একটা বইয়ের দোকানের এস্টাবলিশমেন্ট করা যায় কিনা, যেখানে এপার-ওপারের সাহিত্যচর্চা হতে পারে। যেটা মূলত একটা আড্ডার জায়গা হবে। অসিতদার চাকরিজীবনের শেষে যা পুঁজিপাটা ছিল তাতে হচ্ছিল না। তখন বলল ব্যাঙ্ক লোনের ব্যবস্থা করতে। আমি তখন কলকাতায় ব্যাঙ্কে নেই। আমার এক বন্ধু তখন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর ওখানে একটা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। সেখানে আমার মেজো ভগ্নিপতিও অফিসার হিসেবে কাজ করছে, সে লোনের দিকটা দেখত। তাকে বলে-টলে ব্যবস্থা করলাম। অসিতদাকে আমি বললাম কত টাকা আপনার প্রয়োজন জানান, আর একটা হিসেব আপনাকে করে দিতে হবে, মানে যাকে বলে প্রজেক্ট। একটা প্রজেক্ট তো ব্যাঙ্ক চাইবে। কারণ এগুলোতে তখন ডাইরেক্ট ব্যাঙ্ক থেকে লোন দেওয়া যেত না, একটা ব্যাকডোর দিয়ে যেতে হত। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল শুরু করতে প্রথম যে টাকাটা লাগবে সেটা অসিতদাই দেবেন। তারপরের খরচ ব্যাঙ্ক লোন থেকে হবে। অসিতদা হচ্ছে বেসিক্যালি আড্ডা মারার লোক। সেইখানে এখলাসদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। দোকানটা হল এবং লোনটা আমি sanction-ও করিয়েছিলাম। কিন্তু উনি তার থেকে মাত্র ছ’হাজার টাকা নিয়েছিলেন। তারপর তো আর চলল না ব্যাপারটা। কলেজস্ট্রীটে ভারবি-র পাশে ছিল একুশে-র দোকান। অসিতদা, নীলুদা মানে নীলরতন মুখোপাধ্যায়, গোরাদা এরা সব কনফার্মড ব্যাচিলর। এখলাসদার সঙ্গে আমার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। পরে জানলাম উনি আবার অভিজিতের বাল্যবন্ধু। ৮৮-তে যখন ঢাকা গিয়েছিলাম তখন এখলাসদা আমাকে প্রায় সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। পরিচয় হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। আমি চেয়েছিলাম কেবলমাত্র এই লোকগুলোকে দেখব। বললাম যে বরিশাল বি.এম. কলেজের অধ্যক্ষ কবীর চৌধুরী, তিনি কি বেঁচে আছেন? বললেন, হ্যাঁ আছে। তুমি কি দেখা করবে? আমি বললাম যদি দেখা করতে পারি তাহলে দেখা করব। তখন প্রথমে কবীর চৌধুরীর কাছে নিয়ে গেলেন। আমার পরিচয় দিলাম, উনি অসম্ভব স্নেহে আমাকে নিলেন। কবীর চৌধুরী মারা গেছেন কয়েকবছর হল। তারপরে লেখক সওকত আলি। তখনও সুফিয়া কামাল জীবিত, ওনার বাসায় গেলাম। তারপর শামসুল হক কবি এবং আর্টিস্ট। তাঁর বাসায়। এঁদের প্রত্যেকের বাসায় আলাদা আলাদা করে গেছি এবং আড্ডা মেরেছি। এই সময় আমায় এখলাসদা চূড়ান্তভাবে ঢাকা ঘুরিয়েছিলেন। তখন আমার প্রথম সামনাসামনি আলাপ হয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে। সে কথা তো আমি ইলিয়াসের লেখায় লিখেছি। ইলিয়াসের ওপর লেখাটা বোধহয় সবচেয়ে বেশি পড়েছে আমার পাঠকরা দু-দেশেই।
পরবাস: ইলিয়াসের ওপর লেখাটা তো ‘অনুষ্টুপে’র ক্রোড়পত্রে প্রথমে বেরিয়েছিল...
মিহির সেনগুপ্ত: হ্যাঁ, ‘অনুষ্টুপে’ই বেরিয়েছিল। এটা তো শঙ্খ ঘোষের ওয়াদায় লেখা আর কি। শঙ্খবাবু একদিন আমাকে নেমন্তন্ন করলেন, তখন সবে আমি পুরস্কার পেয়েছি। তার আগেই ‘বিষাদবৃক্ষ’ আমি তাঁকে দিয়েছিলাম, তিনি পড়েছিলেন। এবং বহু বন্ধুজনকে বইটা কিনতে বলেছিলেন। তো ওনার বাড়িতে যাবার পর উনি আমাকে ইলিয়াসের ওপর লিখতে বললেন।
পরবাস: ৮২ সালে যখন আপনি গেলেন, তখন তো এরশাদের জমানা চলছে। তখন তো বাংলাদেশের অবস্থা খুব ভাল নয়। তার কিছু প্রতিফলন কি আপনি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখলেন?
মিহির সেনগুপ্ত: বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারটা অন্যরকম। সব জায়গায় যেরকম... একদল সরকার পক্ষে থাকে। মানে আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি আল মাহমুদ, উনি এরশাদের বন্ধু। এবং তার কবিতার ভূমিকা লেখেন। এগুলো তো খুব কষ্টদায়ক হয়।
পরবাস: [আমাদেরও...] খুব প্রিয় একজন প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, তিনি এরশাদের সময় একটি ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে গেলেন।
মিহির সেনগুপ্ত: না, সে তো হয়েইছে। তবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে আমি বহুদিন ধরে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যখন আমাকে সংবর্ধনা দেয় তখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সবচেয়ে বয়:জ্যেষ্ঠ এবং পণ্ডিত মানুষ হিসেবে ওইখানে উপস্থিত ছিলেন। তখন তাঁকেই সভাপতি করা হল। আনিসুজ্জামানকে বলেছিল, উনি বললেন যে না, আমি সভাপতিত্ব করব না। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আর একজন যার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি কিন্তু আগ্রহ ছিল, বদরুদ্দিন উমর।
পরবাস: আপনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আক্রম হোসেনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল?
মিহির সেনগুপ্ত: না, আমার বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বিশেষ আলাপ পরিচয় নেই। আসলে ওই গণ্ডীটায় আমি ঢুকিনি খুব বেশি। একেবারে ঢুকিনি তা নয়, একদিন ক্লাস করেছিলাম ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে। সে বড় দু:খের কথা । প্রসঙ্গান্তর হলেও গল্পটা শেষ করে নিই। ক্লাসে মাস্টারমশাই ব্রাউনিং-এর একটি কবিতা পড়াচ্ছিলেন। আমার এম. এ.-এর প্রথম দিন, প্রথম ক্লাশ এবং শেষও। তিনি কবিতাটা পড়লেন। শুনে আমার অত্যন্ত বিতৃষ্ণা হল। কবিতা ওরকম করে পড়া উচিত কিনা সেই প্রশ্ন ছিল মনে। কবিতা পড়ার পর উনি জিগ্যেস করলেন কে কি বুঝেছ বলো। তো যারা ভাল স্টুডেন্ট, রেগুলার ক্লাস করে তারা সব তাদের মতো করে উত্তর দিল। আমাকে জিগ্যেস করলেন তুমি কি বুঝেছ? আমি বললাম, আপনি আগে বলুন। উনি বললেন, একজন মানুষের মনে যুগযন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। যুগযন্ত্রণা কথাটা শুনেই না আমার কী রকম গা-পিত্তি জ্বলে গেল। চ্যাংড়ামি, ছেঁচড়ামি বুদ্ধি আমার বরাবর। সেটা আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল জানে আমার স্ত্রী। যাইহোক আমি ক্লাশে দাঁড়িয়ে বললাম যে যুগযন্ত্রণা সব যুগে থাকে, ওটা কোনো বড় কথা নয়। একজন কবি লেখার সময় অনেক কিছু অনুভব করেন, তারপরে সেটা লেখেন। এটা ব্রাউনিং-এর অনুভূতির প্রকাশ। কবিতার কোনো অর্থ হয় না। যিনি পড়াচ্ছিলেন ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেলেন। আমারও সেই প্রথম ও শেষ ক্লাশ।
পরবাস: আপনি তো ওখান থেকে শিকড় ছিঁড়ে আসা মানুষ এবং তার ট্রমা আপনাকে দীর্ঘদিন বহন করতে হয়েছে। হয়তো এখনও করতে হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, সে বাংলাদেশ আপনাকে আকর্ষণ করে?
মিহির সেনগুপ্ত: হ্যাঁ, করে। কথাটা হচ্ছে কেন করে? করে এইজন্য বাংলাদেশে গেলে তো আমি ঢাকায় গিয়ে আড্ডা মারতে যাই না। খুব কম যাই। ঢাকার পরিচিত লোকেরা এইজন্য আমার ওপর খুব বিরক্ত। আমি সোজা এখান থেকে বর্ডার ক্রস করে একটা গাড়ি নিই, একটু বেশি পয়সা খরচা হলেও একদম গ্রামের কাছে গিয়ে নামা যায়। গ্রামে এখন আমার বাড়িতে থাকার মতো অবস্থা নেই। সুতরাং শ্বশুরবাড়িই ভরসা। ওরা এখনো আছে, ওখানে গিয়েই উঠি। আর আশপাশের গ্রামে খবর পাঠাই যে আমি এসে গেছি। এবং তারা কেউ চাষি, কেউ জেলে। তারা সব আসে, পুরোনো দিনের গল্প করি। তাদের সঙ্গে আড্ডা মারি। আমার দিব্যি লাগে, বেশ লাগে। এবং পুজোর সময় গেলে তো কথাই নেই।
পরবাস: আপনার শ্বশুরবাড়ি কি একই গ্রামে?
মিহির সেনগুপ্ত: একই গ্রামে নয়। কাছাকাছি গ্রামে। ওনার আমার সম্পর্ক নিয়ে রোমান্টিক কল্পনা করার সুযোগ নেই (হাসি)। তবে এতদিন যখন সহ্য হয়েছে তখন বাকি কটা দিনও হয়ে যাবে। ওনারও হবে আমারও হবে।
পরবাস: মানে জীবন সম্পর্কে একটা সেলিব্রেশনের ভঙ্গি আপনার চিরকালই ছিল।
মিহির সেনগুপ্ত: হ্যাঁ। তপনদা আমাকে বলেছিলেন, ‘আমিও না জীবনটাকে খুব সিরিয়াসলি নিইনি’। আমি বললাম, ‘বাজে কথা। সিরিয়াসলি নেননি, তাহলে এত পড়াশোনা করলেন কী জন্য?’ বললেন, ‘সেই তো ভালভাবে পারিনি করতে....।’ আমি বলেছিলাম, ‘সত্যিই আপনারা এত মূর্খ না... এই রবিদা তিনি পড়াশোনা করেননি। আপনি পড়াশোনা করেননি।’
পরবাস: মানে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত?
মিহির সেনগুপ্ত: ওই সবচেয়ে ভাল মানুষটি দেখেছি আমি রবিদাকে। রবিদা এই বইটা একজন লিখেছে, খারাপ লেখেনি। যদি পড়েন তাহলে বই-এর দেশে বা কোথাও দু-এক লাইন যদি লিখে দেন। বইটা দিয়ে আমি তো নিশ্চিন্ত, কারণ রবিদা তো লিখবেনই। রবিদা টেলিফোন তুলেই ‘চিন্ময় কাউকে একটা পাঠাও তো লেখা দেব ছোট’। বইয়ের আলোচনায় একটা লাইন ছিল কমন, ‘এমন একখানি বই বাংলা ভাষায় আর পড়ি নাই’। ব্যস, সে মিহির সেনগুপ্তর বই হোক বা অন্য কারুর।
পরবাস: জীবনটা তো শেষপর্যন্ত যাপনেরই, এবং আপনার সমস্ত লেখাতে এটাই আমরা পাই। যে মার্কেজের কথা শুরুতে আপনি বলছিলেন, সেই মার্কেজই বলেছিলেন Life is not what one lived, but what one remembers. ইলিয়াসের মতো মার্কেজও তো আপনার খুব প্রিয় লেখক!
মিহির সেনগুপ্ত: হ্যাঁ, এগজ্যাক্টলি এইটাই লেখা আছে ইংরেজি বইটায়। অবশ্যই মার্কেজ আমার খুব প্রিয়, যেমন ইলিয়াস প্রিয়। ইলিয়াস সম্পর্কে তো তেমন কিছু বলা হয়নি...
পরবাস: ইলিয়াস সম্পর্কে কিছু বলবেন? বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের যে সৌধ তার থেকে যে-দুটি উপন্যাস খসিয়ে নিলে সৌধটা ভেঙে পড়তে পারে সেই দুটি উপন্যাস ইলিয়াসের লেখা।
মিহির সেনগুপ্ত: ইলিয়াস ছিল একেবারে দুর্দান্ত প্রকৃতির। অশ্লীল কথার চূড়ান্ত বন্যা বইয়ে দেবে। ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা মানত না। ইলিয়াসের স্ত্রী, সুরাইয়া ইলিয়াস আমার স্ত্রীর বন্ধু। সুরাইয়ার একটা চিঠি আছে আমার কাছে। সেটা অবশ্য ছাপা হয়েছে। যেদিন ইলিয়াসের মৃত্যু সংবাদ পাই, সেদিনই চিঠিটা বাড়িতে এসেছে যে ও ভালো আছে। চিঠিটা বাড়িতে এসেছে, আর আমি অভিজিতের একটা গল্পের তথ্য সংগ্রহের জন্য গৌতমের (গৌতম ভদ্র) সঙ্গে সুবর্ণরেখায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি। সেখানে গেছি। গৌতম এসে প্রথম খবরটাই দিল, মিহির তোমার বন্ধু ইলিয়াস আজ সকালে মারা গেছে। আমি দাঁড়িয়েছিলাম মুহূর্তের মধ্যে ইন্দ্রদার ওই বই-টইয়ের মধ্যে হুড়মুড় করে নেমে বসে পড়লাম।
পরবাস: অদ্ভুত ব্যাপার তো, সকালে চিঠিটা পেয়েছেন ভালো আছেন। আর বেলায় ওই খবর পেলেন!
মিহির সেনগুপ্ত: এগুলো ইলিয়াসের লেখার মধ্যে আমি দিয়েছি।
পরবাস: ‘আনন্দ পুরস্কার’-এর দিন ইলিয়াসের বক্তৃতাটাও খুব ভালো ছিল।
মিহির সেনগুপ্ত: হ্যাঁ, ওই লেখাটা আমি পড়েছিলাম। আমি তো ওই অনুষ্ঠানে যাইনি। ইলিয়াসের পুরস্কারটা পাওয়ার ব্যাপারে তপন রায়চৌধুরী, আনিসুজ্জামান এঁদের খুব ভূমিকা ছিল।
পরবাস: কিন্তু ওঁকে রাজি করানোর ব্যাপারে আপনার একটা বড় ভূমিকা ছিল।
মিহির সেনগুপ্ত: আমার শুধু একার নয়। তরুন পাইন, ওর বউ বৈশাখী, আমি। শেষপর্যন্ত শ্রীপান্থ মানে নিখিল সরকারকে ইলিয়াসের কাছে পাঠিয়ে রাজি করানো হয়েছিল। মানে ইলিয়াস রীতিমতো আমাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল।
পরবাস: আনন্দবাজারের দেওয়া পুরস্কার নেবেন না....
মিহির সেনগুপ্ত: হ্যাঁ, কারণ তারা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় খারাপ ভূমিকা পালন করেছিল। আমি যত বলি যে তুমি তো আর ইন্ডিয়ান স্টেটের কাছ থেকে কিছু নিচ্ছ না। তুমি একটা ইন্ডিভিজুয়াল সংবাদসংস্থার কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছ, তোমার অসুবিধে কোথায়? আনিসুজ্জামান আমাকে পারসোনালি পিয়ারলেস ইন-এ দেখা করতে বলেছেন। আমি গেলে উনি আমাকে বললেন যে এটা তোমাদের দায়িত্ব। তুমি আর তরুণ যদি এটা করতে পারো, তাহলে কিন্তু কাজের কাজ হবে। নাহলে এত পয়সা তো...। এদিকে আমরা তো চাঁদা তুলছি প্রায়। তবে আমি একটা ব্যাপারে খুশি যে ইলিয়াস ‘বিদুর’ এবং ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ এই দুটোর ম্যানাস্ক্রিপ্ট পড়ে গেছে। ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’-এর রিভিউটা ওর করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সময় তো আর হল না। যেটুকু সাহিত্য বিষয়ক কথা ওর সঙ্গে হয়েছিল, ওর ধারনা ছিল ও পুরোপুরি আত্মপ্রকাশ করতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের ওপরে একটা বই লিখে। সময় সে সুযোগ দিল না তাকে। (বলতে গিয়ে গলা বুজে আসে) ‘খোয়াবনামা’ এখানকার পাঠকরা অনেকে ধরতেই পারেনি। অনেকেই আমাকে বলেছে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ বেস্ট লেখা। ব্যাপারটা তা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের লোকেরাই ইলিয়াসকে একেবারে গ্রহণ করেনি।
পরবাস: বাংলাদেশেও তো ইলিয়াসের কোনো জনপ্রিয়তা ছিল না। আর ওঁর লেখা তো মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হত পত্রপত্রিকায়।
মিহির সেনগুপ্ত: নাঃ। ও অসম্ভব খামখেয়ালি প্রকৃতির ছিল। এখলাসের সঙ্গে আমারও বন্ধুত্ব, ওরও ছিল। এখলাস যে পত্রিকায় কাজ করছে, ‘জনকণ্ঠ’, সেখানে সিরিয়ালি বেরচ্ছিল ইলিয়াসের লেখা। হঠাৎ দুম করে বন্ধ করে দিল। এই নিয়ে পারস্পরিক মন কষাকষি।
পরবাস: আপনার আগামী লেখা সম্পর্কে কিছু বলুন, কি লিখতে চান?
মিহির সেনগুপ্ত: আর লিখতে পারব কিনা সেইটেই তো সন্দেহ। কেননা এখন আর খাতা-কলম নিয়ে বসার মতো কনসেনট্রেশনটাই খুঁজে পাই না। শারীরিক অবস্থার জন্য। তবে আমার ‘সম্বুদ্ধ’ স্টাইলে বরিশালী গল্প লিখতে ইচ্ছে করে। আমার ইচ্ছে কিছু হালকা চালের লেখা লিখব। সেটা জীবনকেন্দ্রিকই কিন্তু খুব সিরিয়াস বড় বই নয়।
পরবাস: আর আপনার ২০০০ থেকে ২০১৮ এই যে সময়টা, বড় মিহির সেনগুপ্ত এই লেখাটা...
মিহির সেনগুপ্ত: (হাসি) এই ভাবে তো এখনও ভাবিনি। দেখ লেখার ব্যাপারটা তো তোমরা জান। তুমি তো নিজে লেখক। এটা তো প্রাক্চিন্তার উপর নির্ভর করে না সবসময়। তবে পুরাণ স্টাইলে লেখা আমার খুব পছন্দ। পুরাণের গদ্যের মত। সম্প্রতি আমার একটা বই বেরিয়েছে ‘অশ্বমেধ দত্তের আত্মকথা’।
পরবাস: আমরা বাংলাতে (দুই বাংলা মিলিয়ে) যাদের লেখা পড়ছি, আপনাকে স্ট্রাইক করছে কেউ?
মিহির সেনগুপ্ত: না, আমি খুব বেশি পড়ছিও না। বাংলাদেশের কিছু ইয়ং লেখক-লেখিকা তাও ভালো লিখছে। জাকির হোসেন তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা, সালমা বাণী, হরিশংকর জলদাস প্রমুখ।
পরবাস: অনেক ধন্যবাদ মিহিরদা।
(শেষ)
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)
ছবিঃ রাজীব চক্রবর্তী ও সিদ্ধার্থ সেন এবং উকিপেডিয়া থেকে