সূর্যবংশের রাজা আদিত্য অবশেষে চন্দ্ররাজ্য জয় করতে সফল হলেন। অতীতে বহুবার তাঁর পূর্বপুরুষেরা চন্দ্ররাজ্য আক্রমণ করেছেন, কিন্তু চন্দ্ররাজ্যের সৈনিকেরা সূর্যরাজেদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। এতদিন ধরে তাঁর পূর্বপুরুষেরা যা পারেন নি আজ তা রাজা আদিত্য করে দেখালেন। চন্দ্রবংশের রাজা তৃতীয় চন্দ্রেশ শুধু যে যুদ্ধে হেরেছেন তা নয়, রাজা আদিত্যের সেনার হাতে প্রাণও গিয়েছে তাঁর।
সূর্যবংশের সেনারা সারা চন্দ্ররাজ্যের দখল নিয়েছে। চন্দ্ররাজ্যের সমস্ত অস্ত্র, সমস্ত সম্পদ আজ তাদের কব্জায়। নিরস্ত্র, পরাজিত চন্দ্রবংশীয়দের ভাগ্যও এখন নির্ভর করছে সূর্যবংশীয়দের কৃপার উপরে।
রাজা আদেশ দিলেন, “সমস্ত চন্দ্রবংশীয়দের আম্রপালির মাঠে একসাথে জড়ো করো।” সৈন্যরা সকলে মিলে একজোট হয়ে আম্রপালির বিশাল প্রান্তরে তাড়িয়ে নিয়ে এলো চন্দ্রবংশীয়দের। কম্পিত বক্ষে আম্রপালির মাঠে জড়ো হলো তারা। রাজা আদেশ করলেন, “হত্যা করো সবাইকে। একজন চন্দ্রবংশীয়ও যেন জীবিত না ফেরে।” সেনাপতি দ্বিধাভরে রাজাকে প্রশ্ন করলো, “মহারাজ, নারী আর শিশুদের-ও?” মহারাজ ক্রুদ্ধ চোখে সেনাপতির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, নারী আর শিশুদেরও, চন্দ্রবংশীয়েরা মানুষ নয়, মনুষ্যেতর জীব। দিনের সূর্যকে ছেড়ে রাতের চন্দ্রকে যারা উপাসনা করে, সেই অন্ধকারের উপাসকদের জীবিত রাখা মানে পৃথিবীকে কলুষিত করা। যাও, পৃথিবীকে কলুষমুক্ত করো।”
খোলা তলোয়ার হাতে নিরস্ত্র চন্দ্রবংশীয়দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সূর্যবংশের সৈন্যরা। রক্তের নদী বয়ে গেলো সারা মাঠ জুড়ে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, কেউ রেহাই পেলো না।
শুধু অল্প কয়েকজন চন্দ্রবংশীয়, যারা আগে থাকতেই পালিয়ে যেতে পেরেছিলো সূর্যবংশীয়দের হাত থেকে, তারা বেঁচে গেলো নিশ্চিত মৃত্যু থেকে। চন্দ্ররাজ্যের পাশের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিলো তারা।
আম্রপালির সুবিশাল প্রান্তরে পড়ে রইলো হাজার হাজার মৃতদেহ। অনেকদিন ধরে ভুরিভোজ হলো শেয়াল আর শকুনদের। শেষে যখন লাশগুলোতে আর হাড় ছাড়া অন্য কিছু রইলো না তখন আবার একদিন রাজার সৈন্যরা এসে একটা বিশাল গর্ত খুঁড়ে সব হাড়গুলোকে মাটিতে পুঁতে দিলো।
***
যুদ্ধে জেতার পর রাজা আদিত্য আদেশ দিলেন, “চন্দ্ররাজ্যের সমস্ত সম্পদ সূর্যবংশীয়দের মধ্যে বণ্টন করো।”
সারা সূর্যরাজ্যে রাজা আদিত্যর জয়জয়কার পড়ে গেলো। চন্দ্ররাজ্যের পাহাড় কেটে পাথর আনিয়ে রাজা আদিত্য সূর্যরাজ্যের সব রাজপথ প্রশস্ত করালেন, চন্দ্ররাজ্যের বিশাল খননযন্ত্র ব্যবহার করে সূর্যরাজ্যের সব গ্রামে পুষ্করিণী খনন করালেন। বড় বড় প্রাসাদ, অট্টালিকা তৈরী করানো হলো রাজ্যের জনসাধারণের বিনোদনের জন্য ঠিক চন্দ্ররাজ্যে যেমন যেমন ছিলো। রাজপথের দুধারে চন্দ্ররাজ্যের অনুকরণে দামি দামি ফলের গাছ লাগানো হলো। রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাবার পথের দুপাশে সরাইখানা আর জলসত্র স্থাপিত হলো, চন্দ্ররাজ্যের মতন।
সারা রাজ্যে সুখ, শান্তি আর ঐশ্বর্য।
কিছুদিন পরে সূর্যরাজ্যের লোকে ভুলে গেলো তাদের এত সম্পদ আগে কাদের ছিলো আর ঠিক কাদের অনুকরণ করে তারা নিজেদেরকে সাজিয়েছে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা শুরু করলো যে এই সমস্ত সম্পদ তাদের নিজেদের, সমস্ত উদ্ভাবনও আসলে তাদের নিজেদের ও তাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি।
চন্দ্রবংশীয়দের সব কীর্তিকে -- পৃথিবীও এখন থেকে জানলো -- সূর্যবংশীয়দের বলে।
***
কালের নিয়মে রাজা আদিত্য একদিন মারা গেলেন।
প্রজাদের সুখ আর সমৃদ্ধির মুখ দেখিয়েছেন তিনি। কৃতজ্ঞ প্রজারা মৃত্যুর পর আম্রপালির মাঠের একপ্রান্তে তাঁর এক বিশাল মূর্তি স্থাপন করলো।
***
তিনশ বছর কেটে গেলো।
এখন রাজা আদিত্য আর শুধু আদিত্য নন, তিনি হলেন দেবাদিত্য। মানুষ নন, দেবতার অবতার তিনি। যুগে যুগে যাঁরা দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করে আর্তের ত্রাণে নিজের জীবন সমর্পণ করেছেন দেবাদিত্য তাঁদের একজন।
আম্রপালির মাঠে তাঁর যে মূর্তিটি ছিলো সেটিকে ঘিরে বিশাল এক মন্দির গড়েছে তাঁর বংশধরেরা। তাঁর জন্মতিথি আজ সূর্যরাজ্যের সচেয়ে বড় উৎসবের দিন। লক্ষ লক্ষ লোক ঐদিন ফুল নিয়ে আম্রপালির মন্দিরে যায়। সেই ফুল তাঁর পায়ে রেখে পরিবারের মঙ্গলকামনা করে। দেবাদিত্য দয়া, মায়া আর ভালোবাসার প্রতীক, সম্পদের প্রতীক, ন্যায়ধর্মের প্রতীক। পুজোর মন্ত্রে তাঁর অপর নাম ধর্মাদিত্য।
বিগত দুশ বছর ধরে সূর্যরাজ্যের কবিরা লিখে গেছেন -- বিশাল দেবাদিত্যের হৃদয়, ভক্তের আকুতি তিনি নাকি গ্রহণ করেন নিজের সেই হৃদয় দিয়ে, কাউকে ফিরিয়ে দেন না। অসংখ্য প্রেম আর ভালোবাসার গান রচিত হয়েছে তাঁর নামে। সূর্যরাজ্যের কবিদের একদল তাদের গানে দেবাদিত্যকে এখন প্রেমাদিত্য বলে ডাকেন।
সূর্যরাজ্যে চন্দ্রবংশীয়দের গণহত্যার কথা আজ আর কেউ জানে না। তাদের ইতিহাসের বইয়ে শুধু আম্রপালির যুদ্ধের কথা লেখা, অসভ্য চন্দ্রবংশীয়দের পরাস্ত করে ধর্মরাজ্য স্থাপনের কথা লেখা।
***
পুরোনো দিনের হারিয়ে যাওয়া গণহত্যার কথা ভুলতে পারে নি শুধু আম্রপালির মাঠের প্রাচীন বটগাছ।
যেদিন সূর্যরাজ্যের সৈন্যরা রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছিলো আম্রপালির প্রান্তরে, বটগাছ সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো বিস্ময়ে। বারংবার শাখা আন্দোলিত করে সে বলতে চেয়েছিলো, “না, না, এ ঠিক নয়। এমনি করে নিরস্ত্র শিশু, নারী, বৃদ্ধকে খুন করতে পারো না তোমরা।”
সেদিন কেউ তার কথা কানে তোলে নি, কেউ বুঝতেই পারে নি ঠিক কি বলতে চেয়েছিলো সে। যখন শেয়ালে শকুনে মৃতদেহের পরে মৃতদেহের রক্ত চেটেছে, মাংস চিবিয়েছে, ঘৃণায় নিজের সমস্ত শাখাকে কুঞ্চিত করে নিজের বৃক্ষজন্মকে ধিক্কার দিয়েছে বটগাছ। শেষ সময়ে মুমূর্ষুদের সে জল পর্যন্ত দিতে পারে নি, এ যন্ত্রণা সে কোথায় লুকোবে? সূর্যরাজ্যের সৈন্যরা যেদিন চন্দ্রবংশীয়দের হাড়গুলোকে মাটিতে পুঁতেছে, নিজের উপর রাগ হয়েছে তার এই ভেবে যে ওই মাটি থেকেই সে তার সার জুগিয়ে বেঁচে থাকছে। নিজের হতাশাকে বটগাছ ব্যক্ত করে চলে গভীর রাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বন্ধু দক্ষিণ হাওয়া তার বার্তা পৌঁছে দেয় দূর দূরান্তে। কিন্তু কেউ বোঝে না সেই উথালপাথাল হাওয়া আসলে কি বলতে চাইছে সবাইকে।
দেবাদিত্যের মন্দির হবার পরে প্রাচীন বটের যন্ত্রণা যেন আরও বেড়ে গেছে।
যে রাজা এক নিষ্ঠুর খুনি দস্যু, কালের লীলায় সেই রাজা আজ দেবতা, শুধু তাই নয়, সেই দেবতা আবার কিনা ন্যায়ধর্মের প্রতীক, দয়া, মায়া আর ভালোবাসার প্রতীক!
আজকাল গভীর রাতে দেবাদিত্যের বিগ্রহ বটগাছকে ব্যঙ্গ করে। বলে, “দেখো, ওহে বট, দেখো, সবাই কেমন আমায় পুজো করে, সবাই কেমন আমার পায়ে ফুল রাখে। তুমিও তাই রাখো, বট। অসভ্য, ধর্মহীন কিছু চন্দ্রবংশীয়ের জন্য আর কতদিন এমন চোখের জল ফেলবে?”
বটগাছ তার শাখাগুলি আন্দোলিত করতে করতে বলে, “যতদিন বাঁচি!”
***
দেখতে দেখতে আরও দুশ বছর কেটে গেলো।
যে কজন চন্দ্রবংশীয় গভীর অরণ্যে পালাতে পেরেছিলো, সেখানেই জঙ্গল কেটে এক ছোট নগর স্থাপন করেছে তারা। চন্দ্ররাজ্যের সূক্ষ্ম হাতের কাজের এক সময়ে খুব সুনাম ছিলো পৃথিবীতে। যারা বেঁচেছিলো, এই শিল্পকে তারা হারিয়ে যেতে দেয় নি, বরং বংশপরম্পরায় সেই শিল্পকে আরো উন্নত করেছে। নিজেদের ছোট্ট নগরকে সেই হাতের কাজ দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়েছে তারা।
আর বেঁচে আছে তাদের গান।
জঙ্গলে যখন সন্ধ্যা নামতো, একসাথে সবাই মিলে গান গাইতো তারা। আজও সন্ধ্যাবেলা সেই নগরের কেন্দ্রীয় চত্বরে জড়ো হয়ে একসাথে গান গায় তারা।
দুঃখের গান -- সমস্ত প্রিয়জনকে একসাথে হারানোর গান।
শান্তির গান -- প্রিয়জনের আত্মার মঙ্গলকামনার গান।
আশার গান -- আবার চন্দ্ররাজ্যে পূর্ণিমার চন্দ্রোদয়ের গান।
একদিন সূর্যরাজ্যের এক পণ্ডিত অরণ্যের মধ্য দিয়ে ভিনরাজ্যে যেতে যেতে এই গানের সন্ধান পেলেন। স্তব্ধ হয়ে গেলেন পণ্ডিত সুরের মূর্ছনায়। কথাগুলো কি এই গানের? কি গাইছে এই অসভ্য চন্দ্রবংশীয়রা? কেন ওদের গানে বারংবার উচ্চারিত হচ্ছে বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনকে হারাবার বেদনা? কেন উচ্চারিত হচ্ছে এক ভয়াবহ গণহত্যার কথা, যে হত্যা নাকি ঘটিয়েছিলেন রাজা আদিত্য, বর্তমানে সূর্যরাজ্যের ইষ্টদেবতা দেবাদিত্য?
ভিনরাজ্যে যাওয়া হলো না আর। চন্দ্ররাজ্যে থেকে গেলেন পণ্ডিত। এক বছর ধরে সেখানে থেকে যত্নভরে তাদের প্রাচীন দিনের ভাষা শিখে পড়লেন তাদের লেখা ইতিহাসের বই আর যাবতীয় স্মৃতিকথা। পৃথিবী উল্টে গেলো তাঁর।
নিজগৃহে ফিরে এসে, পাঠাগারে ঠাঁই নিলেন পণ্ডিত। সূর্যবংশের লেখা ইতিহাসের কোথাও কি এই গণহত্যার বর্ণনা নেই? এই রহস্য না ভেদ করলে তাঁর শান্তি নেই।
খুঁজতে খুঁজতে প্রাচীন এক সৈনিকের স্মৃতিকথা পেয়ে গেলেন পণ্ডিত সূর্যরাজ্যের পাঠাগারে। উইপোকাতে পাতার কিনারা কেটে ফেলেছে, অনেক জায়গায় লেখা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে, তবু পড়তে কষ্ট হয় না।
চন্দ্ররাজ্য জয়ের বর্ণনা পড়লেন পণ্ডিত। আম্রপালির যুদ্ধের ইতিহাস তাঁর অজানা নয়, সে যুদ্ধ অশুভ-শক্তির সাথে শুভ-শক্তির যুদ্ধ। শিষ্টের জয়, দুষ্টের পরাজয় ঘটেছে সেই যুদ্ধে। তাঁর জানা সূর্যবংশীয় সব বই, সব পুঁথি তাই বলছে। আজ কিন্তু নতুন চোখে সেই সৈনিকের লেখা পুঁথি পড়তে পড়তে চমকে উঠলেন তিনি, এই তো পরিষ্কার লেখা রয়েছে, “ ...সমস্ত চন্দ্রবংশীয়দের তাড়িয়ে আম্রপালির মাঠে এনে জড়ো করলাম আমরা। আমার দলনায়ক আমাদের সবাইকে ডেকে বললেন, অন্ততঃ পঞ্চাশজনকে নিজের হাতে হত্যা করতে হবে তোমাদের এক এক জনকে। যাকে হত্যা করবে তার হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দুটি কেটে নিজের ঝোলায় রাখবে। দিনের শেষে অন্তত: পঞ্চাশ জোড়া বুড়ো আঙুল দেখাতে না পারলে কঠোর শাস্তি পাবে।”
আরও লেখা রয়েছে, “যুবতী বৌটি তার শিশু সন্তানটিকে বুকে আঁকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমার তলোয়ারের ঘায়ে লুটিয়ে পড়লো সেই বৌ। শিশুটি অবাক হয়ে আমার দিকে চাইলো একবার। কিন্তু নিজের মনকে কঠোর করলাম আমি, সূর্যরাজ্যের মঙ্গলের জন্য দরকার পড়লে কঠোর তো হতেই হবে আমার মতন সৈনিককে। ফের তলোয়ার চালালাম আমি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম শিশুর ছিন্নমুণ্ড বয়স্কদের থেকে অনেক বেশি গড়িয়ে যেতে সক্ষম …”
শুধু এই লিখেই সেই সৈনিক থামে নি, তার স্মৃতিকথা শেষ হয়েছে বিলাপে, “... আজ আমার শিশুপুত্র মৃত্যুর মুখ দেখলো। সে কি আমার পাপে? মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি।”
মনে হয় সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলো সেই সৈনিক। পুঁথির নাম “এক পাগল সৈনিকের আত্মকথা”।
কিন্তু স্মৃতিকথাটা, কোনো সন্দেহ নেই, পাগলের প্রলাপ নয়।
***
রাজসভায় নিজের আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করলেন পণ্ডিত। ফল হলো মারাত্মক।
সমবেত বাকি পণ্ডিতেরা উপহাস করলেন তাঁকে, অসভ্য চন্দ্রবংশীয়দের আর এক পাগল সৈনিকের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে তাঁর যুক্তি সাজানোর জন্য। বন্ধুস্থানীয় বাকি পণ্ডিতদের এমন ব্যবহার, এত ব্যঙ্গ, এত বিদ্রুপ আশা করেন নি সত্যান্বেষী পণ্ডিত। মন ভেঙে গেলো তাঁর।
শুধু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ নয়, দেবতার উপর কলঙ্করোপণের অভিযোগ এলো তাঁর উপরে। বন্দি করা হলো তাঁকে আর তাঁর পরিবারকে। রাজাদেশে প্রাণদণ্ড হলো তাঁর। আম্রপালির মাঠে মন্দিরের পাশে ফাঁসির মঞ্চ গড়ে সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো তাঁর আর তাঁর পরিবারের সকলের দেহ।
আবার সব দেখলো বটগাছ।
গভীর রাতে তার দীর্ঘশ্বাসে বিরক্ত হলো দেবাদিত্যের বিগ্রহ।
-- দেখলে তো বটগাছ, দেবাদিত্যকে যারা অপমান করে তাদের কি হয়। মূঢ়! এখনো সময় আছে, দীর্ঘশ্বাস ফেলা বন্ধ করো। দেবাদিত্যের অনেক ক্ষমতা, তাঁর কাছে মাথা নোয়ালে মঙ্গল হবে তোমার।
একগুঁয়ে বটগাছ শাখা দুলিয়ে প্রতিবাদ করে, “না! না! কক্ষনো নয়! কক্ষনো নয়!”
***
কেটে গেল আরো কিছু শতাব্দী।
বৃদ্ধ হয়েছে বটগাছ। সারারাত ধরে শাখা দোলানোর জোর আর নেই তার শরীরে। বটগাছ এখন সারারাত ধরে মৃত্যুর স্বপ্ন দেখে।
দেবাদিত্যের বিগ্রহ-ও এখন বৃদ্ধ, কিন্তু চেহারাতে সে এখনো যুবক। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রসঙ্ঘ তাকে পৃথিবীর বিস্ময় খেতাব দিয়েছে। বড় বড় পণ্ডিতেরা আর শিল্পীরা এসে তার লোলচর্ম মেরামত করেছে বিভিন্ন ধরনের ধাতু, সিমেন্ট আর কেমিক্যাল দিয়ে। দেবাদিত্যের এই বিগ্রহ নিয়ে সূর্যবংশীয়দের গর্বের সীমা নেই। বুক ফুলিয়ে তারা সারা পৃথিবীকে বলে বেড়ায় যে এত বিশাল আর সুন্দর বিগ্রহ পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।
দেবাদিত্যের বিগ্রহ দেখতে এখন এত লোক জড়ো হয় যে আম্রপালির রাস্তায় রোজ ট্র্যাফিক জ্যাম হয়। সরকার সিদ্ধান্ত নিলো যে আম্রপালিতে আরো অনেক বেশি বহুতল হোটেল দরকার।
কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লো উদ্যমী মানুষেরা। মাটি খুঁড়ে বহুতল হোটেলের ভিত বানানোর কাজ শুরু হয়ে গেলো পুরোদমে।
কিন্তু কি সব বেরোচ্ছে মাটি খুঁড়তে গিয়ে? এগুলো কি হাড়? নাকি হাড়ের জীবাশ্ম? কাদের হাড় এগুলো? মানুষের না অন্য কোনো প্রাণীর? এত হাড় একসাথে এক জায়গায় কেন?
কৌতূহলী হয়ে এই নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন এক নামী বিজ্ঞানী। অভ্রান্ত তাঁর গণনা। গবেষণাগারে পরীক্ষা করে জানালেন মানুষের হাড় ওগুলো। শুধু তাই নয়, জিন মিলিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওই হাড়গুলো চন্দ্রবংশীয় ছাড়া আর কারুর হতে পারে না।
নিজের গবেষণার ফল প্রকাশ করলেন বিজ্ঞানী, বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরলেন বহু শতাব্দী আগের এক গণহত্যার কথা। বিশ্বসেরা এক জার্নালে প্রকাশিত হলো তাঁর গবেষণাপত্র। সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত হলো তাঁর গবেষণা।
অসম্ভব! গর্জে উঠলো সারা সূর্যরাজ্য।
বিজ্ঞানীটা হয় গাধা, নয়তো দেশদ্রোহী। কে না জানে ওর বৌ-টা খাঁটি নয়, ওর বৌ-এর বংশে চন্দ্রবংশীয় রক্তের ছোঁয়া রয়েছে! দেশদ্রোহিতার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে?
চাকরি চলে গেল বিজ্ঞানীর। অন্য কয়েকজন সূর্যবংশীয় বিজ্ঞানী আদালতে সাক্ষ্য দিলেন যে জিন নিয়ে ঐ বিজ্ঞানীর সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ভুল। ক্রুদ্ধ জনতা হত্যা করতে এলো বিজ্ঞানীকে। অবশেষে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে একদিন সপরিবারে বিদেশের প্লেনে তুলে দেওয়া হলো সেই বিজ্ঞানীকে। অপর এক দেশে আশ্রয় নেবেন তিনি ও তাঁর পরিবার।
***
ক্লান্ত বটগাছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শ্বাসেও যেন আগের মতো জোর নেই আর। দিন ফুরিয়ে আসছে তার। বিজ্ঞানের অভ্রান্ততায় বড় ভরসা ছিলো তার। শেষবয়সে এ কি দেখতে হচ্ছে? বিজ্ঞান-ও কি তাহলে মানুষের ইচ্ছার দাস?
বটগাছের অবস্থা দেখে উদ্ধত দেবাদিত্যর বিগ্রহ হাসে। বলে, “জানো হে বটগাছ, একশ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে শুধু আমাকে আবার নতুনের মতন গড়ে তুলতে। জানো, আমার হারানো যৌবন ফিরে পাবো আবার!”
বটগাছ শোনে, কোনো কথা বলে না।
-- কি বললাম শুনলে? আমি তো যৌবন ফিরে পাবো আবার, তোমার কি হবে হে? দেখো, ঐ দেশদ্রোহী বিজ্ঞানীটাকে না হয় বলে দেখো, বিদেশ থেকে তোমার জন্য কোনো ওষুধ-টোষুধ যদি পাঠাতে পারে!
বটগাছ কোনো জবাব দেয় না। হাই তোলে। ঘুম পাচ্ছে তার। বিশ্রামের সময় নষ্ট হচ্ছে। তবে মন তার বিদ্রোহ করে, “না, না, এ ঠিক নয়! যে নিয়মে চলছে পৃথিবী, তা ঠিক নয়। মস্ত বড় কোনো ভুল হয়ে গেছে কোথাও।”
***
মৃত্যুর পরোয়ানা এসে গেছে।
বুড়ো বটগাছকে কেটে ফেলে রাস্তা চওড়া করা হবে। দেবাদিত্যর মন্দিরে এখন এত ভিড় হয় যে আরো বড় রাস্তার দরকার মানুষের।
গভীর রাতে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে দেবাদিত্যের বিগ্রহ: “কি বটগাছ, পারলে আমাকে নিচে নামাতে? আমি ধর্মরাজ দেবাদিত্য, আমাকে আসনচ্যুত করা অত সহজ নয়। তুমি অমর হলে তবু না হয় কথা ছিলো, কিন্তু তুমি তো মরবে এবার! তুমি আর তোমার মহাসত্য, একই সাথে মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে তোমরা দুয়ে, চিরকালের মতন!”
হাসলো বটগাছ।
-- মহারাজ, কি মনে হয় তোমার? এক বুড়ো বটগাছের মৃত্যু মানে সত্যের মৃত্যু? সত্য অত সহজে মরে না, মহারাজ! আমার বীজে আমি লিখে রেখে গেছি সত্য, লিখে রেখে গেছি সেই ভাষায় যা পড়তে পারে পৃথিবীর সব গাছ। একদিন না একদিন আমার বীজেরা মহীরুহ হয়ে উঠে আকাশ-বাতাস মথিত করে বলে যাবে সেই ইতিহাস! একদিন না একদিন মানুষ বুঝবে তাদের ভাষা! একদিন না একদিন মানুষ জানবে সত্য কি!
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)