ISSN 1563-8685




ঋণ


|| ১ ||

বাঁ-দিকের রাস্তাটায় একটা বড় অশথ গাছ দেখতে পেয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হল না অনীকের।

ঝুপসি অন্ধকারে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে তখন নিজের দ্রুত শ্বাসের শব্দটুকু সংযত করার চেষ্টা করছে সে আপ্রাণ। হৃৎপিণ্ড গলার কাছ অবধি উঠে এসে তাতে ক্রমাগত বাধা দিচ্ছে। বৃষ্টিটা আবারও শুরু হয়েছে। তবে স্কুলের গেট থেকে বেরিয়ে ত্রিশ-চল্লিশ সেকেন্ড তারই মধ্যে দিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে আসার পরও, দশ বছর আগের জেলা চ্যাম্পিয়ন রানার অনীক বোসের কাঁপুনি যে থামেনি, সেটার জন্য বাইরের পরিবেশ দায়ী নয়। যতক্ষণ না পাশ দিয়ে কিছু ভারী পদক্ষেপ দ্রুত পেরিয়ে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণ আড়ষ্ট করে মুহূর্ত গুনছিল সে। রাস্তায় কোনো গাড়িঘোড়াও নেই, সন্ধে সাড়ে ছ’টার মধ্যেই পঞ্চুর চক একেবারে নির্জন নিশুতি হয়ে উঠেছে।

“মিঠার লোভে তিতো মুখে সারা দিনটা গেল...”

এতক্ষণ ধরে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরটা খেয়াল করার সময়ই পায়নি অনীক। মেদিনীপুর কলেজিয়েটের মাঠের এককোণায় শান্ত হয়ে বসে থাকা দুটো মাস্‌ল্‌ম্যানের শ্যেনদৃষ্টি তার মাথা থেকে এক মুহূর্তও বেরোচ্ছিল না। হৃৎস্পন্দন সামান্য ধীর হতে এতক্ষণে তার পারিপার্শ্বিক অনুভব করবার ক্ষমতা ফিরে এসেছে।

না, কোন শিল্পীকণ্ঠ নয়, বেতার তো নয়ই। সন্ধ্যা না হতেই ঝাঁপ ফেলা দু-একটা দোকান আর স্বেচ্ছা-ব্ল্যাকআউটের কিছু গৃহস্থ বাড়ির মাঝে একানিয়া দাঁড়িয়ে দশগজ দূরের যে দোতলা মাটির বাড়িটার জানলা থেকে একটা হ্যারিকেন বা সলতেপিদিমের আভা ভেসে আসছে, কাঁপধরা বুড়ো কণ্ঠস্বরের উৎস সেটা হওয়াই স্বাভাবিক।

“খেলবি বলে ফাঁকি দিয়ে নামালি ভূতলে...”

গোধূলি-অন্ত সবে। তারই মধ্যে ভয়স্তব্ধ, আঁধারে লুকোনো নিঃঝুম তল্লাটে শান্তগম্ভীর শব্দে আর মিঠে আলোয় অদ্ভুত বৈপরীত্য নিয়ে জেগে থাকা বাড়িটা হঠাৎ কেমন ভরসা জাগায় অনীকের মনে।

শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল সে, ডাইনে বাঁয়ে না চেয়ে। যথাসাধ্য স্বাভাবিক ভাবে।

“প্রসাদ বলে, ভবের খেলায় যা হবার তা হল

এখন সন্ধ্যাবেলা...”

চারপাশটা আবারও সভয়ে জরিপ করে নেয় অনীক। এ বাড়ির সামনে অপেক্ষা করার প্রতিটি পল তার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হচ্ছে, অথচ গান থামার আগে দ্বারে করাঘাত করাটা সমীচীন হবে বলে মনে হয় না। অনুভূতি বলছে, কণ্ঠের অধিকারী এখন একা আছেন। এ নির্ভীক অথচ কম্পিত, আকুল স্বর বার্ধক্যের নির্জনতাকে আশ্রয় করে লতিয়ে উঠছে। অনাহূত, সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এর মাঝে বাধা দিলে, তার হিতে বিপরীতই হতে পারে।

“এখন সন্ধ্যাবেলা কোলের ছেলে, ঘরে নিয়ে চলো,

আশা-মাত্র হল...”

গানের মুখড়ায় ফিরে আসেন না দরজার ওপারের ব্যক্তিটি। অনীক দ্বিধাগ্রস্ত হাত তোলে, কিন্তু দরজায় শব্দ তোলার আগেই প্রায় নিঃশব্দে দরজাটা খুলে যায় মুখের ওপর।

শ্বেতশ্মশ্রু, দীর্ঘকায় মানুষটির চেহারা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করার আগেই মরিয়া হয়ে সে বলে ওঠে, দেখুন, বড় বিপদে পড়ে...যদি একটু ভেতরে আসতে পারতাম...আমি বুঝিয়ে বলব...

স্থির দুটি চোখ এক মুহূর্ত তাকে মাপে। তার পর দরজা ছেড়ে দেয়।

*****

ভিতরে ঢুকে দরজায় দ্রুত আগল তুলে দেওয়ার পর নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না অনীক। এতক্ষণের জমে থাকা স্নায়বিক চাপ যেন বিদ্রোহে ফেটে পড়তে চাইছে। সামনের একটা জলচৌকিতে অনুমতির অপেক্ষা না করেই বসে পড়তে বাধ্য হয় সে।

বৃদ্ধ নিশ্চুপ লক্ষ্য করেন তাকে। তাঁর সেই দৃষ্টির সামনে আরও অস্বস্তি বোধ করে অনীক। কোনোমতে বুঝিয়ে বলতে চায় নিজের অবস্থাটা, কিন্তু ঠোঁট কাঁপলেও তার গলা শুকিয়ে একটিও শব্দ বেরোয় না। সে শুধু নির্নিমেষ লক্ষ্য করে, দরজার পিছনে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা পাকা বাঁশের লাঠিগাছটা হাতে নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে পাশের দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে অন্তর্হিত হন।

কতখানি সময় একা বসে ছিল, অনীক তা জানে না। উলটোদিকের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে রাখা প্রদীপের শিখাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সে নিজের ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিল, অভ্যাস করছিল কেমন করে গৃহস্বামীর কাছে নিজের বিপদের বর্ণনা দিয়ে, অন্যায় আতিথেয়তার অনুরোধ রাখবে। সম্বিৎ ফিরল ঘরের দরজায় বৃদ্ধের পুনরাবির্ভাবের পর।

তাঁর হাতে একটি কেটলি ও দুটি চায়ের ভাঁড়। বিস্মিত অনীকের উদ্দেশ্যে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন আসে, “এখানেই বসবেন? ভিতরে এলে কিঞ্চিৎ সুবিধা হত।”

মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর পিছু পিছু ভিতরের ঘরে ঢুকে মেঝেয় পাতা একটা সতরঞ্চির উপর বসে, হাতে মাটির ভাঁড়টা নেওয়ার পর অনীকের গলায় প্রথম স্বর ফোটে, “আ-আপনি আবার কষ্ট করে...”

“কষ্টের কিছু নেই। সারাদিনই এ কাজ করছি। আপনি শান্ত হয়ে বসুন।”

সে কণ্ঠস্বরে আন্তরিকতার চেয়ে সৌজন্যের ভাগ বেশি। অনীক কথা বাড়ায় না। গরম চায়ে চুমুক দেয় দ্রুত।

“আপনিই বুঝি প্রিসাইডিং অফিসার?”

অকূলে কূল পাওয়ার মত মুখে অনীক বলে, “আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি তা হলে সবই দেখেছেন, মানে আমার হয়েছে কি...”

“আমি দেখিনি, তবে আন্দাজ করতে পারি।” একইরকম শান্ত স্বরে উত্তর এল, “আমি ভোট দিতে যাই না।“

অনীক একটু থমকে যায়। দ্বিতীয় ভাঁড়টায় চা ঢেলে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ বলেন, “গত ভোটেও একইরকম সমস্যা হয়েছিল। সে বার অবশ্য ফার্স্ট অফিসার সঙ্গে ছিল। শুনেছিলাম পুলিশ লাইনের কাছেই রাত্রিবেলা দুজনকে খুঁজে বার করে গুণ্ডার দল।”

বাকিটুকু জিজ্ঞেস করতে ভরসা পায় না সে। বৃদ্ধ অনুমান করেই বলেন, “না, ওখান থেকে স্টেশন কাছেই। অক্ষতদেহে না হলেও, ভোরের ট্রেনটা ধরতে পেরেছিল দুজনেই। স্রেফ সবার পরিচয়পত্র দেখার জন‍্য জোর করেছিল বলেই...”

অনীক একরাশ আর্তি নিয়ে বলে ওঠে, “আজ্ঞে আমার অপরাধ আরও গুরুতর। ভোটার আই ডি নিয়ে অন্যায্য আবদার খারিজ করার রাগ তো ছিলই। তারপরেই নির্দল এজেন্টটি একটিবার বাইরে গিয়েছিল, জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম তাকে মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে দুটো লোক। মাথায় কী খুন চেপেছিল, ছাড়াবার চেষ্টা করার জন্য ছুটে গেলাম, উত্তেজনার মাথায় বেশ জোরেই মেরে বসেছি। রক্তারক্তি কাণ্ড। কয়েকজন পুলিশ ছিল বলে তখন বুথ অবধি ...”

“হুঁ, বীরপুরুষ!” শ্রোতা ব্যঙ্গ করেন কিনা বোঝা যায় না, অনীক একনিঃশ্বাসে বাকিটুকু শেষ করে, “তারপর থেকে স্কুলের মাঠের পাশে ওরা দুটো লোককে পাহারায় বসিয়ে গেছে। অন্ধকারে বৃষ্টি শুরু হতে যখন কোণের ছাউনিটার দিকে উঠে যাচ্ছিল, সেই সুযোগে পালিয়ে এসেছি। পিছু নিতে দেরি হলেও, নিয়েছে। এখন যদি –”

“মশায়ের নাম? নিবাস?”

“আজ্ঞে, অনীকেন্দ্র বসু। বাসা কলকাতা ভবানীপুরে।”

“এ বারেই প্রথম?”

“না, চাকরিতে ঢুকেছিলাম বিরাশির ইলেকশনের আগে। সে বার কলকাতাতেই, পোলিং অফিসার ছিলাম। এমন ঝামেলা আসলে, আগে দেখিনি। এটা তৃতীয়বার; প্রথম প্রিসাইডিং, আর কী, তাই চারদিকে লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব পেয়ে একটু...” অনীকের স্বরে খানিক অনুশোচনাই ফুটে ওঠে যেন।

“হুঁ।” গম্ভীর কণ্ঠের অভিব্যক্তিতে কথার তোড় থমকে যায় তার। একই সঙ্গে শুনতে পায়, জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ। এ-দরজায় নয়, সম্ভবতঃ পাশের বাড়িতে। শব্দটা রূঢ়, দ্রুত, অসহিষ্ণু।

চাপা গলায় যথাসাধ্য করুণ স্বরে অনীক বলে ওঠে, “দেখুন, যে বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল, সে এখনও মিনিট পনেরো হাঁটাপথ দূরে। কোনোভাবে সেখানে পৌঁছলেও তাঁরা যে আজ আর আমাকে দেখে দরজা খুলবেন সে আশা রাখি নে। এর পরেই হয়তো এ বাড়িতেও কড়া নাড়বে, ভেতরে এসে খুঁজতেও চাইতে পারে। এখন আপনি যদি একটিবার...”

তার গলার ক্ষীণ হয়ে আসা অনুনয় ঢেকে দিয়ে দুটি কণ্ঠের উত্তেজিত আস্ফালন শোনা যায়।

“এ গলিতে না ঢুকলে আর গেল কোথায় শুয়োরের বাচ্চা! অন্য রাস্তা হলে তো বহুৎ দূর চলে গেছে!”

কণ্ঠস্বর দুটি এগিয়ে আসে, ঠিক যেখানে অনীক দাঁড়িয়ে কড়া নাড়তে ইতস্তত করছিল সেইখানে। কিন্তু কই, এরাও তো দরজা ধাক্কায় না!

“শোন, এখানে বিরক্ত করিস না! বুড়ো মানুষ, একা থাকেন!”

“তাহলে তো বুড়োটাকে ভজিয়ে সিওর এখানেই ঢুকেছে! তুই ওকে আটকে রাখবি, আমি ভেতরে দেখে আসব...”

“কথা শোন, এখানে ঝামেলা করিস না। এ বাড়িটা আমি চিনি। এটা ছেড়ে দে।”

পরস্পরের কথা-কাটাকাটি হলেও, দরজায় টোকাটা পড়ল, তবে অনেকটা দেরিতে, অনেকটা শান্তভাবে। আর তার দু-তিন সেকেন্ড পর অনীকের অন্তরাত্মা হিম করে দিয়ে বৃদ্ধ দৃঢ় স্বরে সাড়া দিলেন, “কী চাই এখানে?”

চায়ের ভাঁড় চলকে সবজেটে সতরঞ্চির কোণাটা পুরো কালো হয়ে যাওয়ার পরেও ওপার থেকে আর কোনো সাড়া আসে না। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, মনকে প্রাণপণে তাই বুঝিয়েও অনীকেন্দ্র স্পষ্ট শুনতে পায়, প্রথমজন মৃদুস্বরে সঙ্গীকে কিছু একটা বলে, তারপর দুটি ভারী পদশব্দ আস্তে আস্তে দূরে চলে যায়।

নীরবতা ভঙ্গ করে বৃদ্ধই প্রথম বলেন, “স্টেশনের মুখেই ওদের একটা আখড়া আছে, সারারাত সেখানেই তাস-ক্যারম নিয়ে জেগে থাকবে। অধমের বাড়িতে টেলিফোন নেই, এবং বিগত বেশ কয়েক বছর এখানে ভোটের দিন গাড়ি প্রায় বেরোয় না বললেও চলে।”

তার মুখের থেকে কথা কেড়ে নিয়ে তিনি যোগ করেন, “এ বাড়ি ছাড়াটা এখন আপনার পক্ষে নিরাপদ নয়।”

একটা নিশ্বাস পড়ে অনীকের। সকৃতজ্ঞ চোখে চেয়ে বলে, আপনাকে যে কী বলে...

এ বার বৃদ্ধের মুখের বলিরেখাগুলির স্থানচ্যুতি হয়। মৃদু হাসি ফোটে। স্নেহময়, আন্তরিক এক হাসি।

“আই নো অ্যাবস্কন্ডিং, ইয়ং ম্যান! আই হ্যাভ বীন দেয়ার!”

এতক্ষণে অনীক খেয়াল করে, তার ত্রাণকর্তার পরিচয়টিই নিতে ভুল হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে একঝলকে মনে পড়ে, এ বাড়িতে দুই পশ্চাদ্ধাবনকারীর প্রবেশ করতে দ্বিধার কথা।

অন্তর্যামীর মত বৃদ্ধ আবারও হেসে বলেন, “নমস্কার। আমার নাম বিমল দাশগুপ্ত।”


|| ২ ||

নামটা শোনা-শোনা লাগলেও হাজার মাথা খাটালেও যে এখন আর কিছু মনে পড়বে না সেটুকু অনীক বিলক্ষণ জানে। সে চুপ করে থাকে। বিমল বলে চললেন, “যত রাত অবধিই পাহারা দিক, ভোরের দিকে সব নজরদারিই শিথিল হয়। মেদিনীপুর স্টেশন থেকে প্রথম ট্রেন পাঁচটা আটে। সূর্যোদয় চারটে পঞ্চাশ, আমার হিসেবমত তার এক ঘণ্টা আগেই ওখানে পৌঁছনো নিরাপদ। ট্রেনটা আপ, অর্থাৎ অন্য স্টেশনে নেমে সেখান থেকে গাড়ি বদল করে...”

অনীকের মাথার মধ্যে সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল। দিনের শেষভাগটুকু যে সমস্ত দুর্ভাবনায় কাটছিল, সবকিছুরই যেন আগে থেকেই সমাধান করে রেখেছেন তীক্ষ্ণধী, সহৃদয় এই বৃদ্ধ। তার হঠাৎ মনে হতে লাগল, এই চোরপুলিশ খেলাটার মধ্যে সে একাই যেন কেমন বেমানান। এমন পরিস্থিতির সম্ভাবনা চব্বিশ ঘন্টা আগে দুঃস্বপ্নেও সে কল্পনা করেনি। কিন্তু তবু এ রাতে একদিকে পেশাদার সমাজবিরোধীরা বাইরে ঝড়জলের মধ্যে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর একদিকে যেন বহু পূর্ব-অভিজ্ঞতাপ্রসূত বিদ্যায় সম্ভাব্য সব আক্রমণকে অবলীলায় খণ্ডন করে চলেছেন এই রহস্যময় মানুষটি।

ওঁর কথা কখন ফুরিয়েছে, অনীক খেয়াল করেনি। গলাখাঁকারির শব্দে চমকে উঠে লজ্জিত মুখে বৃদ্ধের দিকে চেয়ে সে চোখ নামিয়ে ফেলে। বিমল দাশগুপ্ত হেসে বলেন, “চিন্তার মধ্যে হারিয়ে গেলে চলবে? যত জায়গা দেবেন, ভয় তত জাঁকিয়ে বসবে। ওতে স্থিরবুদ্ধি নষ্ট হয়!”

“আপনি আমাকে তুমি করেই বলতে পারেন।” এতক্ষণে একটা স্বাভাবিক কথা বলতে পেরে নিজের মনেই কিছুটা স্বস্তিবোধ করল অনীক।

বিমল বোধকরি প্রসন্ন হলেন। ভিজে জামাটা গায়েই শুকোবে নাকি, বলে মৃদু ধমক দিয়ে উঠে গিয়ে সাদা ধুতি-চাদর বার করে সামনে এনে রাখেন।

“এ বুড়োর জিনিসই আজ ভাগ করে চালাতে হবে, ভাই। আমার শ্রীহস্তের হবিষ্যান্নে আপত্তি থাকলে আমি নাচার।”

অনীক এ-হেন অহেতুক বিনয়ের প্রতিবাদ করে, বারংবার ক্ষমা চেয়ে নেয় অনিচ্ছাকৃত এ উপদ্রবের জন্য। তাকে পোশাক পালটানোর কথা বলে বিমল বেরিয়ে যান, সম্ভবতঃ রান্নার আয়োজন করতেই। অনীক এতক্ষণে চারপাশটা ভাল করে দেখবার সুযোগ পায়। এ ঘরের কুলুঙ্গিতেও কেরোসিনের একটা কুপি জ্বলছে, সে আলোয় সবকিছুই আবছা দেখা যায়। মাটির ঘরে ছড়ানো-ছিটানো একা মানুষের সামান্য কিছু সম্বল। পোশাক-আশাক একখানা আলনায় সামান্যই। তবে চোখে পড়ার মত হল খাটের নীচে ও ঘরের অন্য কোণায় রাখা পুরোনো একরাশ বই। সে দিকে এগিয়ে যেতেই চোখ পড়ে, বইয়ের স্তূপের দিকের দেওয়ালে, অনেকখানি উপরে একহাত তফাৎ করে লাগানো আছে দুটি ছবি। দুটিরই বৈশিষ্ট্য তাদের দর্শকের দিকে নিবদ্ধ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে। মাথায় পাগড়ি, গেরুয়া পোশাকে পদ্মাসনে বসে অতি-পরিচিত রূপে স্বামী বিবেকানন্দ, এবং বারান্দার রেলিঙে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে সুভাষচন্দ্র বসু। দ্বিতীয় ছবিটা অনীক আগে কখনও দেখেনি। সৌম্যকান্তি মানুষটির মুখের মৃদু হাসিটুকু ছবিতে এতই জীবন্ত, সে তন্ময় হয়ে দেখছিল।

“ওঁরা ছিলেন বলেই এতগুলি দিন ধরে সূর্য ওঠা সার্থক হয়েছে,” ঘরে ঢুকে আচমকা মন্তব্যে বিমল কিছুটা চমকেই দেন ওকে। তারপর খাটের উপর উঠে গুছিয়ে বসে কণ্ঠে পরিতৃপ্তির রেশ নিয়ে বলেন, “তোমরা তো এ মানুষটাকে দেখোনি, এই ফোটোগ্রাফে আর কতটুকুই বা ধরা পড়বে? সামান্য এক আমার জন্যও অতবড় প্রাণের সেদিন কী ভাবনা, কী চেষ্টা!”

“আপনি তাঁকে... নেতাজী আপনাকে চিনতেন?”

“তখনও তিনি আজাদ সেনার নেতাজী হননি বটে। তিনি আমাদের জি.ও.সি. সুভাষচন্দ্র।”

অনীক পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বিমলের পায়ের কাছে বসে পড়ে সতরঞ্চির উপরে। ব্যগ্র প্রশ্ন করে, “আমায় বলবেন?”

“সে কী কথা!” অনাবিল হেসে ওঠেন বিমল, বুড়ো বয়সের দোষ তো জানো, মুখ খোলালে নিজেকে নিয়েই হাজার গল্প এসে পড়ে। তোমরা হচ্ছ ভাই আজকালকার ছেলে, এ সবে তোমাদের কাজ কী?”

“সারারাত আপনার বাড়িতে উৎপাত তো কম করছি না, এটুকুতে আর কেন নিরাশ করবেন?” নিজের বাকপটুতা ফিরে পেয়ে অনীক নিজেই মোহিত।

“সময়ের অনেক ফারাক হয়ে গেছে, ভাই।” বিমলের মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়ে সেই শান্ত অপরিচয়ের দৃঢ়তা ফিরে এসেছে, “আমার পৃথিবী এখন গতযৌবনা। সেকালের গল্প আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ফিরে দেখলে সবই পরিহাস বলে মনে হবে না কি?”

“কে আপনি?”

“আমি আপাতত সামান্য ব্যবসায়ী। মেদিনীপুর কলেজের সামনের চা-দোকানটা আমিই চালাই।”

ছলটুকু প্রশ্রয় দেয় না অনীক, জেদী গলায় বলে ওঠে, “আমায় বলুন না! আমি শুনতে চাই!”

“তুমি আজ একটা প্রাণ বাঁচিয়েছ না, অনীকেন্দ্র? তোমার বয়সে আমি নিজের হাতে একটা প্রাণ নিয়েছিলাম।”


|| ৩ ||

খুন? অনীকের বুকে ধাক্কা লাগে একটা হঠাৎ। কিন্তু এ মানুষটির তেজস্বী দৃষ্টির সাথে একটু আগের দেখা দুটো অপরাধীর ঠান্ডা চাউনি কিছুতেই যেন মেলাতে পারে না ও। ওঁর চোখ থেকে চোখ সরাতেই আবার দেওয়ালে বিবেকানন্দ-সুভাষের ছবিদুটোর দিকে দৃষ্টি পড়ে অনীকের, আর সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুচ্চমকের মতো মাথায় খেলে যায় উত্তরটা।

“আপনি বিপ্লবী?”

“প্রাণ দিতে গেলে প্রাণ নিতেও হয় কখনো কখনো। আমরা তাই বিশ্বাস করতাম। আমি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের মেদিনীপুর শাখার সৈনিক, দীনেশ গুপ্তর মন্ত্রশিষ্য।

এতক্ষণে চেনা নাম খুঁজে পেয়ে কিছুটা থই পায় অনীক। ডালহাউসি চত্বরে দাঁড়িয়ে ত্রিমূর্তির মধ্যে এঁকে সে বহুবার দেখেছে। সাগ্রহে প্রশ্ন করে, “তিনি কি আপনাদের স্কুলে, না কলেজে পড়াতেন?”

বিমল এবার হো-হো করে হেসে উঠলেন। “দীনেশদার জন্ম যে অগ্রহায়ণে, আমি সে-বছরেরই বৈশাখে। পদমর্যাদায় বি.ভি.র ক্যাপ্টেন, তাই দাদা বলার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বয়স দেখে কি বিদ্যার বিচার হয় ভাই? কুড়ি না পেরোতেই দীনেশদার যে সাংগঠনিক শক্তি বা লেখার পরিণত টান, আজকের এই বুড়ো বিমলও আয়ত্ত্ব করতে পারবে কি?”

সদ্য আঠাশ-পূর্ণ-করা অনীক চুপ করে থাকে। সে জানে এই যৎসামান্য জ্ঞান নিয়ে নীরব শ্রোতা হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও ভূমিকা তার নেই। তার সব প্রশ্নের উত্তর ইনি নিজেই দিয়ে যাবেন।

“বড় সুন্দর সময়ে জন্মেছি আমি। কাজের বয়স যখন হল, তখন নতুন করে জোয়ার আসবার দিন। ত্রিশের দশক, ওপেনিং অফ দ্য ফ্লাডগেট অফ রেভলিউশন!”

একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলেন বিমল।

“সে দিনটার কথা মনে পড়ে। উনিশশো আঠাশ সাল, ডিসেম্বরের এক রবিবারের বেলায় ক্লাবের বাগানের জন্য মাটি ভাঙছি, হঠাৎ ছুটতে ছুটতে কচি, মানে প্রদ্যোৎ এসে হাজির। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বিমলদা, ফণীদা তোমায় ডাকছে। কাঁসাইপাড়ে জলার মাঠে ফুটবল খেলা হচ্ছে, শিমুলগাছটার কাছে এসো। আমি প্রভাতকে খবর দিতে চললুম।

প্রদ্যোৎ ভট্‌চাজ আমাদের এ তল্লাটের জলপানি পাওয়া ভাল ছেলে। তবে ওই, মেদিনীপুরের মাটি! দেশের সে উত্তাল সময়ে কিছু-একটা করবার ছটফটানি যে ক’জনের মধ্যে ছিল, ও-ও তাদেরই একজন। প্রভাত অর্থাৎ প্রভাংশুশেখর পালও কলেজিয়েটের ছেলে।

আমি যখন পৌঁছলাম, তখন শিমুলগাছের নীচে দশ-বারোটি ছেলের জমায়েত হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে ও-বাড়ির যামিনীকাকার তিন ছেলে টিয়া, পায়রা আর শালিক রয়েছে, “কমেট্”, মানে শশাঙ্ক দাশগুপ্তও আছে। সকলকে চিনি না, তবে মধ্যমণি আমাদের ফণীদা-- ফণীভূষণ দাস, আর তাঁর পাশেই গত বছর আমাদের কলেজে ভর্তি হওয়া ঢাকার ছেলে দীনেশ।”

স্বপ্নালু চোখ দুটো অনীকের মুখের পানে নামিয়ে এনে বিমল বললেন, “আমাদের ইচ্ছা ছিল, উদ্যম ছিল, লক্ষ্য আর কর্মপন্থা ছিল না। ঢাকার ভলান্টিয়ার আঠেরো বছরের দীনেশ গুপ্তকে মন দিয়ে পড়াশোনার নামে মেদিনীপুর কলেজে ট্রান্সফার করে দিয়ে শীর্ষ নেতারা আমাদের কাছে সেই আগুনের শিখাটুকু পৌঁছে দিয়েছিলেন।

“দীনেশদা সেই প্রথম আলাপে যে ক’টা কথা বলেছিলেন তা এখনও হুবহু তোমায় বলতে পারি। বলেছিলেন, ‘আমাদের মানুষ হতে হবে। মানুষের আত্মমর্যাদা বোধই বলে দেবে সঙ্কটকালে তার কী করণীয়। জননীর শৃঙ্খলমোচন করার দুঃসাহসিক কাজে,পদে পদে নতুন বিপদের মাঝে একমাত্র মানুষই এগিয়ে এসে বলতে পারবে, তার অসাধ্য কিছু নেই।’

“কী করে বোঝাই ভাই তোমায়? গোল ফ্রেমের পড়ুয়া চশমা-চোখে নিরীহ চেহারার একটা সমবয়সী ছেলের কয়েকটা কথা শুনেই আমরা সবাই প্রথম দর্শনেই তাকে ভাই বলে, বন্ধু বলে, গুরু বলে মেনে নিলাম কী করে? সঠিক উত্তর আজও জানি না, কেবল এইটুকু বলতে পারি, সে মুহূর্তের মত মূল্যবান আমার কাছে আজ আর তেমন কিছুই নেই। উদ্দেশ্যহীন অশান্ত জীবনে যখন একটা অন্তিম লক্ষ্য, একটা পারপাস্ পাওয়া যায়, তার চেয়ে মধুর আর কিছুই নেই। বিশ বছরের সন্ধান কয়েক পলকে কেমন করে শান্তি পেল, ভাবলে বড় বিস্ময় লাগে আজও।”

দম নিতে থামলেন বিমল। সেই সুযোগে ঠোঁটের ডগায় এসে যাওয়া কথাটা উচ্চারণ করে ফেলে অনীক, “পরশপাথর!”

“মানবজমিনে সোনা ফলাতে না পারলে তারও একটা দরকার আছে বইকি,” বলে ওঠেন বিমল, “এমনি করেই তো এক একটা প্রাণ হঠাৎ উল্লাসে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। আমাদের এই যাত্রাটা রিলে রেসের মত, বিবেকানন্দ-তিলক-অরবিন্দ-বাঘাযতীন-রাসবিহারী-সুভাষ হয়ে ত্রিশের দশকে সে দৌড়ে মেদিনীপুরকে সামিল করতে দীনেশদার এই আসা। সেই মশালের… যা হোক, তাঁর কথা বলতে শুরু করলে আর শেষ হবে না। তুমি বরং বোসো, আমি ভাতটা দেখে আসি।”

আচমকা বাধা পড়ায় একটু ক্ষুণ্ণই হয় অনীক। একলা ঘরে বসে বসে তার হঠাৎ মনে হতে থাকে, আজকের কাজটা হয়তো অতটাও বোকামি হয়নি। তা ছাড়া, চোখের সামনে লোকটাকে পিটিয়ে মারা হাত গুটিয়ে বসে দেখলে কি নিরাপদে ঘরে ফিরেই শান্তি পেত সে? পরক্ষণে আপনমনেই হেসে ওঠে। সাহসী ব্যক্তির সান্নিধ্যে, নিরাপত্তায় বসে থাকলে মানুষের ভাবনা কতই না ভিন্ন খাতে বয়! এ ঘরে আতিথ্যলাভ আর বাইরের অবিশ্রান্ত বর্ষণের মধ্যে বিপদের সামনাসামনি হওয়ার দুই চিন্তাধারার মাঝে যেন এক অলঙ্ঘ্য প্রাচীর উঠে গেছে।

“এখন দুটি খেয়ে নেবে, না পরে?” ভিতর-বাড়ি থেকে বিমলের গলা শোনা যায়।

ক্ষুধাতৃষ্ণা জিনিসটা অন্যদিনের মত অনুভব না করলেও, ফের গল্প শোনায় ছেদ পড়ার ভয়ে অনীক তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, “আজ্ঞে অসুবিধে না হলে, এখনই... ”

সামান্য আয়োজন পরিপাটি করে শেষ করতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। বাড়ির অন্যত্র সব আলো নিভিয়ে এসে বিমল আধশোয়া হয়ে বসলেন আগের জায়গাতেই। অনীকও এবার উঠে বসে, তাঁর বিপরীতে। একটাই মাত্র কেরোসিনের কুপির আলোয় বিমলের মুখের ডানপাশটা দেখা যাচ্ছে। অনীক লক্ষ্য করল, কানের নীচ থেকে শুরু হওয়া একটা কাটা দাগ তাঁর মুখময় সাদা দাড়ির মধ্যে আত্মগোপন করেছে। সে প্রশ্ন করে, “তার পর? আপনি কী করলেন?”


|| ৪ ||

“আমাদের আদর্শ ছিলেন বাঘা যতীনের সমগোত্রীয় বিপ্লবীরা,” বিমল হাত তুলে বিবেকানন্দের ছবির দিকে নির্দেশ করলেন; “ওই মানুষটির কাছে আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতারা গিয়েছিলেন জীবনধারণের জন্য ধর্মোপদেশ নিতে। হেমদাদার কাছে শুনেছি, সে কথা শুনে রাগে তিনি জ্বলে উঠছিলেন। ধর্মের খোঁজে ঘুরে বেড়ানো শক্তসমর্থ যুবকবৃন্দের প্রতি অগ্নি-বর্ষণ করেছিলেন বহুক্ষণ ধরে। তিনি বলছিলেন, ‘পরাধীন জাতির কোন ধর্ম নেই। তোদের এখন একমাত্র ধর্ম হচ্ছে মানুষের শক্তি লাভ করে আগে পরস্বাপহারীদের দেশ থেকে তাড়ানো। তারপর আমার কাছে আসিস ধর্মের কথা শুনতে। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী – সব অকেজো দেবতাকে বাদ দিয়ে এখন তোরা শুধু দেশজননীর সেবা কর।”

একটানা এতখানি বলে ক্লান্ত হয়েই যেন বিমল থেমে যান। চোখ বুজে বিরতি নেন কয়েক পল। অনীক আন্দাজ করল, বন্ধ চোখের পটে উনি সেই ভাষণের স্মৃতি রোমন্থন করছেন। সে কথা বলে না।

বিমল আবার বলতে শুরু করেন, “বছরখানেকের মধ্যেই আইন অমান্য আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ল। কিন্তু আমরা অহিংসবাদী নই, শরীরচর্চা, আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ আর বিদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে শরীর-মনকে তৈরি করছি ক্রমাগত, আমরা মুখ বুজে মার খেয়ে আন্দোলন করব কেন? তবুও, দীনেশদা তাতে রাজী নয়। তার স্পষ্ট নির্দেশ, খদ্দর-পরাদের দলে আমাদেরও ভিড়ে যেতে হবে। সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে কোনো ভাল ছেলে উদ্দেশ্যহীন হয়ে এ পথে এসেছে কিনা, আদ্যন্ত যাচাই করে দল ভারী করতে হবে তাদের নিয়ে। আন্দোলন দমনের নামে কোথাও নিরীহ নারীপুরুষের উপর অত্যাচার হলে সেটা রুখে দেওয়ার দায়িত্বও আমাদেরই উপরে বর্তায়। এ-রকম দূরদর্শী সিদ্ধান্ত আমাদের মত ছটফটে তরুণদের পক্ষে নেওয়া কখনোই সম্ভব হত না। দীনেশদা ছিল উঁচুমাপের সংগঠক, মেদিনীপুরের ঘরে ঘরে বিপ্লবের বীজ বুনে দেওয়া তার তীক্ষ্ণবুদ্ধির সহায়তা ছাড়া এত দ্রুত আমরা করে উঠতে পারতাম না। এরই মধ্যে সে ঢাকার সঙ্গেও সংযোগ রাখত, দুই পৃথিবী সমান তালে সামলে নিয়ে চলত। তারপর কলকাতার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে, কমেট্ আর ফণীদাদের হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দিয়ে সে হঠাৎ করে হারিয়ে গেল।”

“হারিয়ে গেল!” অনীক না বলে পারে না, “কিন্তু তারপর যে...”

হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করেন বিমল, “ততদিনে চট্টগ্রামের আগুন কলকাতায় এসে লেগেছে। জালালাবাদ যুদ্ধের খবর চেপে রাখা যায়নি, তেরো-চোদ্দ বছরের কিশোররা সেখানে প্রাণ দিয়েছে সম্মুখযুদ্ধে। আমরা কাজে নামার জন্য উত্তেজনায় ফুটছিলাম, শীর্ষ নেতাদের নীরবতাতে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলাম, কিন্তু তাঁদের আদেশ লঙ্ঘন করা আমাদের নীতিবহির্ভূত। নইলে আমাদের বুকের উপর বসে ম্যাজিস্ট্রেট জেমস পেডি যে-হারে সত্যাগ্রহীদের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছিল তাতে ধৈর্যের বাঁধ প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। শুধু কংগ্রেস কর্মীই নয়, প্রায় সাধারণ গ্রাম্য মেয়েদের বিশাল মিছিলের উপরও এক ঘন্টা টানা লাঠিচার্জ করাবার আদেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে সে। শুধু আমিই নয়, প্রভাত, কচি, মৃগেন, এমন-কি শান্তশিষ্ট টিয়া, মানে আমার বন্ধু জ্যোতিজীবনও অধীরভাবে প্রহর গুনছিল লোকটাকে শেষ করে দেওয়ার আদেশের জন্য।

“নেতৃত্বের নীরবতা যে ঝড়ের আগের নৈস্তব্ধ্য, সেটা বুঝতে পারলাম ঝড়টা আছড়ে পড়ার পর। আগস্টের পঁচিশ তারিখে ডালহাউসি স্কোয়্যারে প্রকাশ্য দিবালোকে বোমা পড়ল অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার টেগার্টের গাড়িতে। শহীদ হলেন অনুজা সেন, টেগার্ট বেঁচে গেল। আর তার ঠিক পাঁচদিনের মাথায় ঢাকায় মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে দিন-দুপুরে কমিশনার লোম্যানকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়ে পালিয়ে গেলেন বিনয় বসু।”

“বিনয় বসু মানে...” অনীকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বিমল বললেন, “তোমার অনুমান সঠিক। তার তিনমাস পরেই কলকাতা থেকে সেই ভয়ঙ্কর খবরটা এল। ব্রিটিশের সিটাডল্ রাইটার্স বিল্ডিংকে রক্তে লাল করে দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে বাদল, বিনয়দা আত্মঘাতে মৃত্যুশয্যায়, এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে বিচারের প্রতীক্ষা করছে আমাদের দীনেশদা।”

“আমাদের” শব্দটা এমন ভাবে উচ্চারণ করলেন, অনীকের বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল। কী অপরিসীম ভালবাসা আর গর্ব লালন করলে এমন করে বলা যায়!

“আসলে, পুরোদস্তুর উপক্রমণিকা না করলে আমার ব্যাপারটা তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না। ঠিক কোন্ অবস্থায়, কেন আমরা এ পথে পা বাড়ালাম।”

অনীক আগ বাড়িয়ে বলে, “আপনি পুরোটা বলুন। আমি শুনতে চাই।”

“ইংরেজ তখন দিশাহারা। কয়েক মাসের মধ্যে এহেন পরপর আঘাতে আহত সিংহের মত ক্ষেপে উঠেছে তারা। ইতিমধ্যেই জানা গেল, কলেজিয়েটের এক ছেলের বাড়িতে কলকাতা-দলের কারোর চিঠি পাওয়া গেছে বলে আই.সি.এস. পেডিসাহেব তাকে বাংলোয় তলব করে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন। তারপর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তার পিঠোপিঠি বোনটিকেও।

“এই মুহূর্তে চরম নির্দেশ না এলে আমরা একটা অনর্থ বাধিয়ে বসতাম। সংবাদটা নিয়ে এসেছিল প্রদ্যোৎ। ম্লান মুখে বলল, তোমার ডাক এসে গেছে বিমলদা!

“আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর আবেগ কিছুটা প্রশমিত হতে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তোরও একদিন ডাক পড়বে কচি! দেখিস্!”


|| ৫ ||

“মার খাওয়া নয়, মার দেওয়ার ইতিহাস লেখার সুযোগ সমাগত। অ্যাকশন স্কোয়াডকে দীনেশদা তিনটি জিনিস শিখিয়েছিলেন – এক, ক্যামোফ্লাজ; দুই, অনারেবল রিট্রিট এবং তিন, চুজিং দ্য টাইম ফর ফাইনাল স্ট্রাইক। তৃতীয়টি এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১০ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৩১। কমেটদা আর ফণীদার সামনে বাল্যবন্ধু জ্যোতিজীবন আর আমি শপথ করলাম, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেমস পেডিকে ধ্বংস করব।

“১১ই মার্চ অনুগত রাজপুরুষদের নিয়ে জেলা বোর্ডের মিটিঙে পেডির উপস্থিত হওয়ার পর আমাদের প্রথম অ্যাটেম্পট নেওয়ার কথা। শেষ মুহূর্তে আচমকা মিটিঙের সময় দু’ঘন্টা এগিয়ে যাওয়ায় অনারেবল রিট্রীট ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। তাতেও নিরাশ হলাম না আমরা। পয়লা এপ্রিল জেলাস্কুলের মাঠে প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে পেডির আসবার কথা। রিভলবার লুকিয়ে আমরা সারাক্ষণ ঘুরলাম প্রদর্শনীর দ্বারপ্রান্তে। উদ্বোধনে এলেন একজন এ.ডি.এম। দাঁতে দাঁত ঘষে ফিরে আসতে হল সেবারেও। জ্যোতি আমায় বলল, ‘দ্যাখ, বার বার তিনবার! স্কুলের ছেলেদের প্রাইজ দিয়ে মন টানবার সুযোগ পেডি ফেলবে না। শেষ দিন ওকে মান রক্ষার জন্য হলেও,আসতে হবেই।’

“সাতই এপ্রিল। সরকারী চাকুরে কাকাবাবু ব্যস্ত হয়ে তৈরি হচ্ছেন বেরোবার জন্য। জিজ্ঞাসা করতে জানলাম, এস.ডি.ও. শঙ্কর সেন ছুটি কাটিয়ে ফিরে এসেছেন, তাই আজ তাঁর বিশেষ তাড়া। কিন্তু আমি যে ডি.এম. এবং এ.এস.পি.-র গাড়িও আলাদা আলাদা ভাবে ঢুকতে দেখেছি সকালবেলাই! দুইয়ে দুইয়ে চার করে আমি যামিনীকাকার বাড়ি থেকে জ্যোতিকে ডেকে আনলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম ডি. এম. বাংলোর ঠিক বিপরীতে ডায়মন্ড গ্রাউন্ডে। আমাদের অনুমান নির্ভুল প্রমাণ করে বিকেল পাঁচটায় পেডির গাড়ি একরাশ ধুলো উড়িয়ে প্রদর্শনীর দিকে বেরিয়ে গেল।

“ওটুকু দূরত্ব তখন যেন হেঁটে নয়, মার্চপাস্ট করে চলেছি। বড় হলঘরটায় যখন ঢুকলাম, পেডি তখন প্রদর্শনী দেখতে ব্যস্ত। ঘরে আরও অফিসাররা আছেন, ছড়িয়েছিটিয়ে। আমরা এগিয়ে গেলাম, অনেকটা কাছে। পেডি মাথা তুলে আমাদের দেখতেই দুজনে একসঙ্গে রিভলভার তুলে ফায়ার করলাম।

“একবার, দুবার, তিনবার। পেডির শরীরটা মাটিতে পড়ে যখন কেঁপে কেঁপে উঠছিল, আশ্চর্য একটা শান্তি ছড়িয়ে যাচ্ছিল আমাদের দেহে-মনে।”

বিমল থামলেন। কৌতূহল চাপতে না পেরে বলে অনীক বলে উঠল, “পুলিশ ছিল না? ধরা পড়েননি?”

“সে ভাবনা আমাদের ছিল না। পরম তৃপ্তিতে দৃশ্যটা দেখার পর আমি পকেট থেকে বার করলাম পটাশিয়াম সায়ানাইডের অ্যামপুল। কিন্তু জ্যোতির দিকে চেয়ে দেখি, সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে হাসছে।

তখনই প্রথম খেয়াল করলাম, সাদা চামড়ার রাজার যত সেপাই-সান্ত্রী-আমলা, ত্রিসীমানায় কারোর চিহ্নমাত্র নেই।”

“পালিয়ে গেছে?” উত্তেজনায় বলে ওঠে অনীক, “সবাই? একজনও ছিল না?”

বিমল স্মিতমুখে বললেন, “সঙ্কটকালে কেবল বিপ্লবীরাই শেষ মুহূর্ত অবধি লড়ে, সাধারণ মানুষ প্রাণ বাঁচায়! স্বাধীনতার সৈনিক জীবন বাজি রাখতে পারে, কিন্তু ভাড়াটে সৈন্যের আনুগত্য জীবনের উপরে নয়!”

অনীকের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না তখনও। “আপনারা সোজা বাড়ি ফিরে এলেন? যেন কিছুই হয়নি?”

“হয়নি কেমন করে বলি? সায়ানাইড হাতে মৃতদেহটার সামনে দাঁড়িয়ে আচমকাই পালটে যাওয়া পরিস্থিতিটা অনুধাবন করতে ভারী অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল যে! তারপর ঠিক করলাম, সুযোগটা শেষ অবধি যাচাই করে দেখাই যাক!

“জনপ্রাণীহীন চৌহদ্দি পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম, একটিমাত্র লোক সাইকেল নিয়ে আমাদের দিকে আসছে। জ্যোতি আচমকাই চলন্ত সাইকেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আরোহী-সমেত সেটিকে ভূমিসাৎ করল। সেটা হস্তগত করার পর বুঝেছিলাম, আরোহী আমাদের পরিচিত, স্কুলেরই সীনিয়র খেলোয়াড় ধঞ্চিদা। জ্যোতি আমাকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে দ্রুত প্যাডেলে চাপ দিল। চেনা মানুষের সামনে পড়ে যাওয়ার বিপদ নিয়ে সে পথে দুজনের কেউই কোন উচ্চবাচ্য করলাম না। আমরা ক্রমাগত চলেছি উত্তরমুখে। সন্ধে সাতটা। দূরত্ব মেপে বুঝলাম, এই জীর্ণ সাইকেলে এত খানাখন্দ পেরিয়ে বাঁকুড়া অবধি পৌঁছনো যাবে না। তবু আমরা একটানা চললাম, যতদূর সম্ভব। রাত দশটায় এসে পৌঁছলাম শালবনি স্টেশনে।”

বিমল উঠে হাত বাড়িয়ে জলের গ্লাসটা টেনে নেন। অনীক সুযোগ পেয়ে বলে ওঠে, “এতখানি রাস্তায় কেউ আপনাদের চিনে ফেলেনি?”

“চিনবে না কেন! ধঞ্চিদা সমেত অন্ততঃ দশ-বারোজন আমাদের দুজনকে স্পষ্ট একসাথে যেতে দেখেছে! তবে সে-সব নিয়ে চিন্তা করবার অবকাশ আমাদের ছিল না। শালবনি থেকে মধ্যরাতের আপ ট্রেনে চড়ে বসলাম। গন্তব্য পুরুলিয়া হলেও, টিকিট দুজনেরই আলাদা জায়গার কাটা। সেখান থেকে ফিরতি ট্রেনে সোজা কলকাতা। শ্যামবাজারের শৈলেন কুণ্ডুর বাড়ি, তার পর মনোরঞ্জন সেনের ডেরা, তারপর পার্কস্ট্রীটে দীনেশদার শেষ আস্তানা হয়ে শেষমেশ মেটিয়াবুরুজে রাজেনদার শেল্টারে এসে পৌঁছলাম।

“সেদিন ভাবতেও অবাক লাগছিল, নিশ্চিত মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘর ছেড়ে, শেষটায় অ্যাবস্কন্ডিং লাইফই আমাকে টেনে নিল। আমাদের এক দাদা বলতেন, পালিয়ে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা হচ্ছে ওয়র্স দ্যান ডেথ। প্রতি পদে মৃত্যুর চেয়ে বড় বিপদকে এড়ানোর দুঃসহ চিন্তা! সঙ্গীসাথী আশ্রয়দাতা সকলকে বিপন্ন করে স্বাধীনতাটুকু জলাঞ্জলি দেওয়া কেবল জীবিত থাকার জন্য!”

“আপনি পালালেন কেন তবে?” প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে অনীক যেন আরও সাহসী হয়ে উঠছে।

“রাজেনদার সঙ্গে পরিচয় করানো হয়নি, না?” ঈষৎ হেসে বিমল বললেন, “ওঁর আশ্রয়ের মর্যাদা রাখব বলেই হয়তো!”

হেঁয়ালির মানে খোঁজবার চেষ্টা করে না অনীক। চুপচাপ শুনতে থাকে।

“রাজেন্দ্রকুমার গুহ এক অসাধারণ চরিত্রের মানুষ। উনি আর ওঁর স্ত্রী, আমাদের সরযূবৌদি, কতগুলি অশান্ত ছেলেকে যে তাঁদের স্নেহের ছত্রছায়ার রাজরোষ থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন তার সঠিক হিসাব আমার আজও জানা নেই। সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন দশ হাজার টাকা মাথার দাম নিয়ে ফেরারী আসামী বিনয়কৃষ্ণ বসু। আর রাইটার্সে ত্রয়ীর সেই অভিযানটি হল মেজর বিনয় বসুর জীবনে দ্বিতীয় পি.এম.”, অনীকের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে বলে চললেন বিমল, “অর্থাৎ পলিটিক্যাল মার্ডার। সাড়ে তিন মাসের মধ্যে দু-দুটো অ্যাকশন, সফল অ্যাকশন!

“পালিয়ে আসার পর থেকেই আমার মাথায় সারাক্ষণ এই চিন্তা ঘুরতে লাগল। শয়নে-জাগরণে একই স্বপ্নের হাতছানি, ডাবল অ্যাকশন, ডাবল অ্যাকশন!”

“আপনি একই সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছেন, আবার নতুন বিপদে এসে পড়ার পরিকল্পনাও করছেন?” অনীককে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখায়।

“পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার!” বিমলের জবাব আসতে একমুহূর্ত বিলম্ব হয় না, “আমৃত্যু কাজ করতে না পারলে জীবনটার অর্থ কী, অনীকেন্দ্র? তবে পেডি-হত্যায় আমি পরিতৃপ্ত না হলেও, সুখী হয়েছিলাম বটে। আর তা আমার বন্ধু, আমার শিক্ষক দীনেশ গুপ্তর জন্য...”

একটু সময় নিয়ে বিমল আবার বলেন, “আসলে কী জানো ভাই, প্রতিটা মানুষই চায় তার উত্তরাধিকার রেখে যেতে। সে চায় কর্ম-অন্তে তার স্বপ্ন, কর্তব্য, এবং হৃদয়বেত্তা নিয়ে আরও একজন নতুন মানুষ আসবে, সে আত্মজই হোক বা সন্তানতুল্য শিষ্য। নিভে যাওয়ার আগে সে চায় ওই রিলে রেসের বেটনটা কারোর হাতে তুলে দিতে, তার জীবনচারণ যেন অতর্কিতে থমকে না যায়। দীনেশদাকে আমি সেটুকু গুরুদক্ষিণা দিতে পেরেছিলাম, সেই মশাল তুলে দেওয়ার তৃপ্তিটুকু। পরে শুনেছি, পেডির সংবাদ পেয়ে আলিপুর জেলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে দীনেশদা কেবল সবাইকে বলে চলেছিল, ‘মেদিনীপুর, আমার মেদিনীপুর জবাব দিয়েছে!’ এ প্রাপ্তির মূল্য এক বিপ্লবীর কাছে অপরিসীম যে!”

মৃদু আলোয় বিপরীতে বসে থাকা বৃদ্ধের মুখে হঠাৎ যেন কোন গোপন বেদনার একটা ছায়া দেখতে পায় অনীক। অজান্তেই বুকের ভিতরটা কেমন মুচড়ে ওঠে তার।

বিমল ধীরে ধীরে বলতে থাকেন, “এক সপ্তাহ পর, যখন কোনোদিক থেকেই নতুন কোন বিপদের সম্ভাবনা টের পাওয়া গেল না, তখন ঠিক হল, আমি বাড়ি ফিরে যাব। সন্দেহমুক্ত জীবনযাপন করব, যতদিন না দ্বিতীয় মিশনের ডাক আসে।”

“আর আপনার সঙ্গী?” অনীক প্রশ্নটা না করে পারে না।

“কে, জ্যোতি? জ্যোতি কোথায় আমি তো জানতাম না!”

“জানতেন না?”

“না। নিকুঞ্জদা আমাকে নিয়ে এসেছিলেন রাজেনদার কাছে, আর রসময়দা নিয়ে গিয়েছিলেন জ্যোতিকে। সে কোথায় আমি জানতাম না, কারণ জানবার অধিকার আমার ছিল না।” এক মুহূর্ত থমকে বিমল যোগ করলেন, “যে রাস্তায় একটি ভুল মানেই মৃত্যু, সেখানে মন্ত্রগুপ্তিই আমাদের স্বীকৃত রক্ষাকবচ। কে জানে কোথায় কে বিশ্বাসঘাতক বা পুলিশের চর! মারের মুখে, অসুখের ঘোরে, কে কার নাম বলে দেবে! আমরা বিশ্বাস করতাম, দলীয় কার্যাবলীর যতটুকু জানবার প্রয়োজন, তার বেশি জানতে চাওয়া আমাদের মত সৈনিকের কাছে অশিষ্টতা। নিয়মবিগর্হিতও বটে। Theirs not to reason why,/ Theirs but to do and die!”

দৃঢ় উচ্চারণের রেশটুকু মিলিয়ে যাওয়ার পরেও অনীক খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “বাড়ি ফিরলেন?”

“ষোলোই এপ্রিল, ভোর পাঁচটা। সদরদরজাটা খুলেছিলেন আমার বাবা নিজেই। আমায় দেখে তাঁর চেহারা নিমেষে বিবর্ণ হয়ে গেল। অস্ফুটে শুধু একবার বললেন, ‘কেন এলি তুই?’


|| ৬ ||

“আমার বাবা অক্ষয় কবিরাজ এ এলাকার সকলেরই পরিচিত। নির্বিবাদী, নিষ্ঠাশীল এই চিকিৎসকটিকে পাড়ার সকলেই শ্রদ্ধাভক্তি করত। বেপরোয়া ছেলের মেলামেশা, কীর্তিকলাপ তাঁর চোখে ধরা পড়লেও, তাকে ধমক-ধামকে শুধরোবার কোনো প্রয়োজন বাবা কোনোদিনই বোধ করেননি। সেই তাঁর আজ এমন প্রতিক্রিয়া শুনে আমি হয়তো হতবুদ্ধি হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতাম। সে অবসর না দিয়ে বাবা টানতে টানতে আমাকে অন্দরে নিয়ে এলেন। আমার মুখের দিকে কয়েক পলক চেয়ে বললেন, ‘তুই জানিস না, পুলিশ তোর অপেক্ষায় এ বাড়ির উপর সারাক্ষণ নজর রেখে বসে আছে? তুই ফিরে আসবি আশা করেই ওরা কাগজে কিছু ছাপতে দেয়নি, রটতে দেয়নি। দু-বেলা এসে খবর নিয়ে যায়… তুই এভাবে ফাঁদে পা দিলি খোকা?’

“অনীক, আমি স্বীকার করছি, বাবার মুখ থেকে এই কথাটা শুনে আমার সর্বাঙ্গে যে শিহরণ খেলে গেল সেটা নিখাদ ভয়ের। কারণ শুধু যে আমার একার পালাবার পথ বন্ধ তা-ই নয়, এ অবস্থায় ধরা পড়লে পেডির হত্যাকারীর বাড়ির প্রতিটি মানুষকে জীবন্ত দগ্ধ হতে হবে। একটা ভুল-বোঝাবুঝির জন্য আমার দুই দাদা, পিসিমা, এবং এই অনন্যচরিত্র মানুষটি...

“আমার ভাবনার সূত্রটুকু ছিঁড়ে দিয়ে দরজার কড়া নড়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গেই।”

অনীক বিমলের চোখের দিকে চেয়ে থাকতে পারে না। কয়েক ঘন্টা আগের কোণঠাসা-করা ভয়টা হঠাৎ করেই যেন তাকে চেপে ধরেছে আবার। দমবন্ধ করে শুনতে থাকে সে, ভয়ঙ্করতম কোনো সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত হয়ে।

বিমলের সে দিকে খেয়াল নেই; তিনি বলে চলেন, “আমার নিরীহ ভালোমানুষ বাবা ততক্ষণে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন দরজাটা খুলতে। সশব্দে ঘরে ঢুকে আসা পুলিশ চিৎকার করে বলল, ‘আপনার ছেলে এসেছে? কোথায় সে?’

“শান্তভাবে বাবা তাঁদের বসতে বলে ঘরে এসে ডেকে নিয়ে গেলেন আমার বড়দাকে। তারপর অকম্পিত কণ্ঠে বলে গেলেন, ‘এই আমার ছেলে বিজয়। কলকাতায় ডাক্তারি পড়ে। বিমলের খোঁজ নিতে ওকে আজ সকালেই খবর দিয়ে আনিয়েছি। পৌনে পাঁচটার ট্রেনে এসেছে...’

“অনীক, বাবার নার্ভ কত শক্ত, তাঁর উপস্থিতবুদ্ধি কত প্রখর, আমি সেদিন বুঝেছিলাম। ঝানু দারোগা বাবার বয়ানে কোথাও ফাঁকির রেশ পেলেন না। বড়দাকে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করে বৃথা ফিরে যেতে হল তাঁকে।”

অনীকের চোখেমুখে এতক্ষণে কিছুটা স্বস্তির আভাস ফুটে ওঠে। সে শুধোয়, “তারপর? বেরোলেন কেমন করে?”

“পুলিশ তখনকার মত বিদায় হতেই মেজদা খবর দিতে গেলেন বসুদের বাড়িতে। শহীদ সত্যেন বসুর ভাই ভূপেন্দ্র তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিলেন প্রতিবেশী, বিশ্বস্ত এক গোয়ালাকে – সে জীবনপণ করে আমাকে লুকিয়ে রাখতে সম্মত। রঘুনন্দন গোপ – রঘু-ভাই আমাদের কাছে এসে রুদ্ধদ্বার কক্ষের আলোচনায় প্রথমে সে প্রস্তাবই দিল। কিন্তু আমি অনুভব করছিলাম – মেদিনীপুরে আসবার সংবাদ একবার রটে যাওয়ার পরে এ-শহরে কোথাও আমি নিরাপদ নই। প্রদর্শনীর মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ই একটি বাচ্চা ছেলে “বিমলদা” বলে চিৎকার করে উঠেছিল – সেইই আমার কাল হয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশ লোভ দেখিয়ে সাক্ষীসাবুদ সংগ্রহ করছে, একবার ধরা পড়লে আমি-সহ আমার কাছের প্রতিটি মানুষের সর্বনাশ অনিবার্য!

“‘দেখুন, পুলিসওয়ালা তো বাঙ্গালী ছেলে ঢুন্ডছে! তো খোকাবাবুকে আমি আমার বেটা সাজিয়ে কলকাতা নিয়ে চলে যাই?’

“রঘুর এই সরল বুদ্ধির সহজ উক্তিতে ঘরশুদ্ধ লোক হঠাৎ চুপ করে গেল।

“বাবা চিরকালই অন্তর্মুখী মানুষ। তাঁকে দেখলাম, কিছুক্ষণ নিশ্চুপে বসে থাকার পর ধীরপায়ে উঠে এসে রঘুভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। স্নেহের এমন বহিঃপ্রকাশ...” বিমলকে অন্যমনস্ক দেখাল ক্ষণিকের জন্য।

“বিহারী গোয়ালার ছদ্মবেশ নেওয়াটা খুব সহজ। ঝুলকালি মেখে গায়ের রঙ কালো করে, মাথায় ফেট্টি বেঁধে, রঘুর ময়লা ধুতি পরে, পোঁটলা হাতে অন্য মানুষ হয়ে যেতে বেশি সময় লাগল না। রাত তখন দশটা। ভোরের দিকে কলকাতায় পৌঁছে, প্রহরার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জনারণ্যে মিশে যেতে পারলেই মুক্তি।

“শেষ মুহূর্তে বাবাকে প্রণাম করতে গেলাম। তিনি অদ্ভুত মায়াময় দৃষ্টিতে সোজা তাকালেন আমার চোখের দিকে; অতি মৃদুস্বরে, ধীরে ধীরে বললেন, ‘তুমি যা করেছ তা সব বিচারের ঊর্ধ্বে। এর পরিণতি তোমার আগেও জানা ছিল, সে আমি জানি। তোমাকে আমি শুধু একটি কথা বলব – যদি জীবিত ধরা পড়ো, এমন কিছু কোরো না যাতে তোমার আদর্শের অপমান হয়, তোমার সহযোদ্ধাদের ক্ষতি হয়!’”

অনীকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “যদি জীবিত ধরা পড়ো! বাবা এ কথা বললেন?”

“ঠিক এ-কথাই,” বিমল দৃঢ় উচ্চারণে বলেন, “তারপর নমো নারায়ণায় বলে আমার প্রণাম ঈশ্বরকে নিবেদন করে অস্ফুটে শুধু যোগ করলেন, ‘ভগবান তোমায় কর্তব্যে অবিচল থাকার শক্তি দিন!’

“খিড়কিদরজাটা খুলে দিলেন তারপর। চারদিক দেখে রঘু গোয়ালা আগে এগিয়ে গেল, জড়িত কণ্ঠে দেশোয়ালী গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে। আশেপাশে দেখে আমিও এগিয়ে চললাম। পিছনের দিকটায় আর ফিরে তাকানো হল না।”


|| ৭ ||

“কলকাতায় আমি তৈরী হচ্ছিলাম পরবর্তী মিশনের জন্য। সাতই জুলাই দীনেশদার ফাঁসি হয়ে গেল। জনগণের বিক্ষোভ, আইনী জটিলতা – কোন কিছুই টলাতে পারল না বিচারক গার্লিককে। অতএব, বিপ্লবীদের আদালতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা ছিল। অবশেষে একদিন রাজেনদা এসে বললেন – ‘তোমার ভাগ‍্যেই শিকে ছিঁড়েছে, ভাই। বাক্সপ‍্যাঁটরা গোছানো শুরু করো।’

“আমা-হেন ভাগ‍্যবানের বোঝা যিনি এতকাল সস্নেহে বয়ে চলেছিলেন, সেই সরযূবৌদিই কেবল ম্লান হয়ে গেলেন এ প্রতীক্ষিত সংকেতে। মায়ের মন জানত, এ বার সুইসাইডাল মিশন নিশ্চিত। আদালতের মধ্যেই প্রকাশ্য দিবালোকে রাজশক্তির চোখের সামনে গার্লিককে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার পর পালিয়ে যাওয়া এবার সত্যিই সম্ভব নয়। কিন্তু অ্যাকশনের আগের দিন, আনন্দে উত্তেজনায় আমি যখন প্রতিটি প্রহর গুণে চলেছি, বিনা মেঘে বজ্রপাত হল। অজ্ঞাত কারণে আমার সেদিন গৃহবন্দী থাকার আদেশ এসেছে।”

“কেন?”

“এ প্রশ্নের অধিকার আমার ছিল না। দলীয় সিদ্ধান্ত। মন্ত্রগুপ্তি। সৈনিকের কর্তব্য। ভুলে গেলে?”

“তা হলে গার্লিকের মৃত্যুদণ্ড খারিজ হল?”

“তখন তেমনটাই মনে হয়েছিল বটে। কলকাতা থেকে আমায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল ঝরিয়ার কোলিয়ারীতে। সেখানেই খবর পেলাম, আমায় না পেয়ে রাতের বেলা আমাদের বাড়িতে ঢুকে আমার হদিশ জানতে চেয়ে পিসিমার গলায় ছুরি ধরেছে পুলিশ, আমার বাড়িতে-পাড়ায়-বন্ধুমহলে প্রতিটি মানুষকে আমার সন্ধান চেয়ে অতিষ্ঠ করে মারছে। আর এসবের মাঝে শেষ একটা বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে সবকিছুতে পূর্ণ ইতি টানার জন‍্য অধীর হয়ে উঠছি আমি। কিন্তু দু’সপ্তাহ পর যখন বিচার-চলাকালীনই গার্লিককে গুলিতে ঝাঁঝরা করে মারল এক অপরিচিত যুবক, তখন নেতাদের প্ল্যানের নৈপুণ্য দেখে আমাকে স্তম্ভিত হতে হয়েছিল,” বিমলের মুখে ম্লান হাসি ফুটে ওঠে, “এক ঢিলে দুই পাখি মারার সার্থক উদাহরণ সেটা।”

অনীক শেষ কথাটা অগ্রাহ্য করে বলে ওঠে, “কিন্তু যিনি মেরেছিলেন তাঁর কী হল?”

“যা হবার ছিল।” নির্লিপ্তকণ্ঠে বিমল বলেন, “আমি হলে যা হত।”

“পুলিশ ধরে ফেলল?”

“পাগল? তা হলে আর মজাটা কোথায়! সে ছেলেকে জ্যান্ত ধরে সাধ্য কার! সার্জেন্ট গুলি করে তক্ষণি না মেরে ফেললে সে যে আরও কত কী...”

“মজা!” বিড়বিড়িয়ে বলে অনীক।

বিমলের হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে। স্মৃতিতে ডুব দিয়ে স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞান সাময়িকভাবে হারিয়েছিলেন বুঝি তিনি। কিছুটা অনুতপ্ত কণ্ঠে বলেন, “রাগ কোরো না ভাই। আমাদের কাছে ওটা মজার খেলাই ছিল কিনা। না হলে এমনি করে ...”

“এমনি করে কয়েকটা ছেলে মিলে কেবল দুঃসাহস দেখিয়েই এই দুনিয়া পাল্টে দেবে, এত অহংকার?” অনীকের এতক্ষণের চাপা অসহায়তা ফেটে পড়ে, “ছেলেগুলোর প্রাণের দাম, পরিবার পরিজনের চিন্তা - এগুলো বোধহয় আপনাদের ওই নেতাদের মাথাব‍্যথা ছিল না? এক-একটা মরলে কাটা বোড়ের মত বাতিল করে দিতেন, তাই না? মজার খেলা বটে!”

“হ্যাঁ, মজার বইকি!” সহসা কঠিন হয়ে ওঠে বিমলের কণ্ঠস্বর, “ঘরের কোণে বসে বসে যারা মনে করে কোনো মিরাকলে একদিন হঠাৎ করে সুদিন এসে যাবে, তাদের আমি করুণা করি। শুধু অভিযোগ, দুর্ভোগ নিয়ে কাটিয়ে যাওয়া, শক্তি থাকা সত্ত্বেও অবলা জন্তুর মত পড়ে পড়ে মার খেয়ে, চোখের উপর সর্বস্ব উচ্ছন্নে যাচ্ছে দেখেও পরিবারের কথা ভেবে ভয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে কাটানো নিস্পৃহ জীবনকে আমি ঘৃণা করি। আর বেঁচে থাকার অর্থ কী, যদি প্রতিমুহূর্তে নিজের মান-সম্মান-স্বাতন্ত্র্য অধিকার সমস্তকিছুকে অত্যাচারী প্রভুর কাছে গচ্ছিত রেখে ক্লীবের মত শুধু দিনগত পাপক্ষয় করতে থাকি? অনেক সহ্য করে, বড় জ্বালায় জ্বলে এ-পথে এসেছি যে! মরার কথা জানতে চাও? আমরা অহিংস ভিক্ষাজীবী নই – আমরা মৃত্যুকে মাথায় নিয়ে কাজ করতে নামতে জানি। জিন্দগী তো অপনী মেহমান মওত কে মেহ্‌ফিল মে হ্যয়! বীরদর্পে মরণকে আলিঙ্গন না করতে পারলে জীবনের অর্থ কী?”

অনীক প্রাণপণে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে, দৃকপাত না করে বিমল বলে চলেন, “এক ঢিলে দুই পাখির মজার কথাটা বলছিলাম, না? গার্লিকের এজলাসে যে সেদিন মরেছিল, সে-ও মজা পেয়েছিল খুবই। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে করে দেখিয়েছিল একটা মস্ত বড় রসিকতা, আ ডেডলি জোক! ওর নাম ছিল কানাই ভট্টাচার্য, সে কথা অনেক পরে জেনেছি। জয়নগর-মজিলপুরের কানাইলাল, পকেটে একটা কাগজের টুকরো নিয়ে গিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল – ‘ধ্বংস হও, দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসি দেওয়ার পুরস্কার লও। ইতি-- বিমল গুপ্ত’,” প্রদীপ্ত চোখে তাকিয়ে বিমল বললেন, “শুধু জীবনে নয়, মৃত্যু দিয়েও সে সংগ্রাম করে যাবে, পুলিশের সন্ধানী চোখের থেকে আমায় বাঁচিয়ে দিয়ে যাবে এই ছিল তার লক্ষ্য। এই ছিল আমাদের ‘চতুর’ নেতাদের ‘নিষ্ঠুর’ পরিকল্পনা! বিপ্লবের সহস্র বলির মধ্যে অনামী একটি তারা-প্রদীপ হয়ে জ্বলেছে সে সৈনিক, নামের জন্য না, জীবনের ভোগসুখ-প্রিয়জন-ভবিষ্যতের আশার জন্য না, ভাইয়ের জন্য, দেশের জন্য!”

উলটোদিকের কুলুঙ্গিতে বাতিটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। অনীক সেইদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে, আর জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে না। তার মধ্যে এখন দুটি ভিন্ন শক্তির টানাপোড়েন চলছে। তার নিরাপত্তা-সন্ধানী সুসভ্য শহুরে প্রাণ, তার মস্তিষ্কে সংকেত দিচ্ছে কঠিন ভাষায় এই রক্তক্ষয়ী তত্ত্বকে খণ্ডন করতে, এর হৃদয়হীন দিকটিকে তুলে ধরে, ভ্রান্ত প্রমাণ করে ওই বৃদ্ধকে নির্মম আঘাত করবার। কিন্তু নিজের জীবন রক্ষা করাটা যে কোনো মানুষের প্রাধান্যের তালিকায় একেবারে নীচে থাকতে পারে, এই সত্যটা হঠাৎ সামনে প্রকট হতেই সে আর লড়তে পারছে না মৃত্যুহীন যুক্তির সঙ্গে। ধীরে ধীরে অবচেতনের সাহস-শক্তি-অনুপ্রেরণা আর বড় কিছুর জন্যে বাঁচবার ইচ্ছের ঘুমন্ত অংশটুকু জেগে উঠছে, অধিকার করে নিচ্ছে তার চেতনাকে।

বেশ কিছু সময় এভাবে কেটে যাওয়ার পর ঘরের একটানা নৈঃশব্দ্য, বৃদ্ধের বেদনাহত মুখচ্ছবি অনীককে অস্বস্তিতে ফেলে। ধীরে ধীরে, কণ্ঠে অনেকখানি অনুরোধ মিশিয়ে সে বলে ওঠে, “তার পর আপনি কী করলেন? ডাবল অ্যাকশন হয়েছিল?”

“হয়েছিল, তবে বিনয় বোসের মত হয়তো নয়।” কতটা নিজের তাগিদেই বিমল আবার বলতে শুরু করেন।


|| ৮ ||

“পেডির পরের ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট ডগলাস হিজলী জেলে রাজবন্দীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মেরেছিল। আমি তখনও অ্যাবস্কন্ডিং; কচি আর প্রভাত মিলে তাকে দিন-দুপুরে শেষ করে দিল। প্রভাংশুশেখর পালাতে পারল, ধরা পড়ে বীরের মত ফাঁসির দড়ি নিলে প্রদ্যোৎ।

“ইওরোপীয়ান অ্যাসোসিয়েশনের একচ্ছত্র প্রেসিডেন্ট ভিলিয়ার্স সাহেব ওই ডগলাসেরই সমগোত্রীয়। কালো চামড়ার কুকুরদের জেলের মধ্যে গুলি করে মেরে ফেলা- ইত্যাদি ইওরোপীয় যা কিছু নির্যাতন তাকে মুক্তকণ্ঠে অকুণ্ঠ প্রশংসা করা ছিল তাঁর পবিত্র কর্তব্য। ইতিমধ্যে পেডি হত্যার পর আমার অজ্ঞাতবাসের ছয় মাস কেটে গেছে। বিজয়া দশমীর দিন সংকেত এল, পনেরো দিনের মধ্যে অ্যাকশন। তৈরী হও!

“সেদিন ঊনত্রিশে অক্টোবর, সকালের কাগজে খবর বেরিয়েছে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ডুর্নো বিপ্লবীদের বুলেট উপহার পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি, শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক। মনে হল, যাত্রা শুরুর আগে এ যেন ঈশ্বরপ্রেরিত শুভলক্ষণ! ঠিক বেলা বারোটায়, পার্কসার্কাস থেকে সর্বাদা, মানে বিনয় সেনগুপ্ত আমায় নিয়ে পৌঁছলেন গিলিন্ডার্স হাউজে। আমি উঠলাম তেতলায়, পশ্চিমা মুসলমান ব্যবসায়ীর বেশে দাঁড়িয়ে কষ্টেসৃষ্টে সিগারেট ফোঁকার অভিনয় করতে লাগলাম। বাংলার বিপ্লবীরা যে ধূমপানাদি নেশা পছন্দ করে না এ খবর গোয়েন্দাদের কাছে ছিল। আর চারতলায় ভিলিয়ার্সের কামরার কাছে পোজিশন নিলেন নিরস্ত্র, সাক্ষাৎপ্রার্থী-বেশী সর্বাদা। একে একে লোক বেরিয়ে ঘর খালি হয়ে যেতেই আমাকে সিগনাল দিয়ে সোজা বেরিয়ে যাওয়ার কথা তাঁর।

“চেইনস্মোকারের মত একটার পর একটা সিগারেট ধ্বংস করে চলেছি। অধীর হয়ে ভাবছি, তবে কি এবারেও হবে না? ষষ্ঠ সিগারেটটি ধরাতেই দেখলাম, সর্বাদা ঘড়ি দেখতে দেখতে বিরক্তমুখে মাথা নেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন কোনোদিকে না তাকিয়ে। এই-ই সেই সিগন্যাল! সিগারেটটা যথাসাধ্য দ্রুত পুড়িয়ে, যথাসাধ্য স্বাভাবিক পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে ক’মিনিটেরই বা দেরি! খোলা দরজার দিকে সোজাসুজি এগিয়ে যাই। দৃষ্টিসীমায় একজন, দাঁড়িয়ে দেখছেন টেবিলে বিছানো ম্যাপ, আমার দ্রুত ছায়া দেখে চোখ তুললেন চমকে উঠে।

“রিভলভার আগে তুলেছিলাম না ঘরের চৌকাঠ আগে ডিঙিয়েছি, মনে নেই। শুধু মনে আছে, পরমুহূর্তেই লক্ষ্য করলাম, ঘরে আমার দু’পাশে আরও দুই শ্বেতাঙ্গ রয়েছে! কয়েক মুহূর্তের দ্বিধা, তারপর সটান ফায়ার করলাম আমার সামনের জনের দিকে। ফার্স্ট বুলেটে হতচকিত করে দিয়ে যদি কাজ হয়! কিন্তু না! আমার লক্ষ্যের বক্ষভেদ করা হল না – সে তখন টেবিলের নীচে আত্মগোপন করার জন্য ঝাঁপ দিয়েছে। পাঁজরের পাশ ছুঁয়ে আমার গুলিটা বেরিয়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গেই ডানদিকের জন আমার ডান কাঁধে আঘাত করল। রিভলভারটা পড়ে যেতেও একহাতে রোখার চেষ্টা করলাম, জখমও করলাম, কিন্তু দ্বিতীয় সাহেবটি তখন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আমাকে আক্রমণ করেছে। দু-জনে মিলে কব্জা করে ফেললে, টেবিলের উপর সজোরে মাথার পাশটা ঠুকে গেল।” কানের নীচে কাটা দাগটায় বিমলের আঙুল উঠে আসে, “পালাবার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছিলাম বলেই মরিয়া হয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া তাদের আর কোনো পথ ছিল না।”

অনীক উত্তেজনায় বলে ওঠে, “পারলেন না? হাত ছাড়িয়ে বেরোতে?”

“বেরোনো সম্ভব হত না,” বিমল জবাব দেন, “ধ্বস্তাধ্বস্তি করে হাত ছাড়িয়ে তখন শুধু সায়ানাইডের অ্যামপুলটা বার করার চেষ্টা করছিলাম। ততক্ষণে নীচের তলা থেকে পুলিশ এসে গেছে। তারই মধ্যে দুই সাহেবের আতঙ্কিত কণ্ঠে দুটি বাক্য শুনতে পেলাম। প্রথমজন বলেছিল, ‘Yesterday Durnoe, today Villiars?’ আর দ্বিতীয়জন কাঁপাগলায় বলল, ‘God has saved us!’”

“আর তৃতীয়জন? ভিলিয়ার্স কোনজন ছিলেন?”

“লক্ষ্য নির্ণয়ে আমার কিছু ভুল হয়নি,” বিমল সরল হাসেন। “ভিলিয়ার্স তখন বুলেটের প্রথম ধাক্কাটা সামলে টলতে টলতে উঠে বসেছেন একটা চেয়ারে। ক্ষীণ প্রশ্ন করলেন পাঁজর চেপে ধরে ‘Why? Why me?’”

আমি জবাব দিলাম, “to settle accounts! The President must pay for inspiring the police brutality in Midnapore, Chittagong, and last but not the least, Hijli Camp!”

“তারপরের কথা আমার মনে থাকবার কথা নয়। বেলা একটায় পুলিশভ্যানে করে লালবাজার লক্-আপে পৌঁছানোর পর থেকে জ্ঞান ছিল খুব সামান্য সময়ই। সে অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে তোমায় আর বিব্রত করব না, তবে এটুকু বলতে পারি, একেবারে সন্ধ্যা সাতটায় অর্ধ-অচৈতন্য অবস্থায় আমাকে ওখান থেকে স্ট্রেচারে শুইয়ে বার করা হয়েছিল। বেশ মনে আছে আমার চেহারা দেখে কমিশনার কলসন্ শিউরে উঠে একটি প্রশ্নও না করে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের কাছে পাঠানোর আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর...তার পর যখন আমি সার্জেন্ট-পরিবৃত হয়ে ভ্যান থেকে নেমে পুনরায় লালবাজারের দরজায় এসে দাঁড়ালাম, কী-যেন একটা পরিবর্তন হয়ে গেল আমার মধ্যে। স্থানকালপাত্র ভুলে আমি হঠাৎ আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠলাম।”

“হেসে উঠলেন?”

“হ্যাঁ ভাই! এ ঘটনাটা এতই অবাস্তব, হয়তো মনের ভুল ভেবেই পরে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু ‘What! The boy is laughing!’ বলে ছুটে এসে পাঁচ শ্বেতাঙ্গ সার্জেন্ট আমাকে মাটিতে ফেলে যে উন্মত্তের মত লাথি মেরেই চলেছিল, এ আমার স্পষ্ট স্মরণে আছে যে! পুলিশ-কম্পাউন্ডের মাটিতে আমার অসুস্থ দেহটাকে নিয়ে ফুটবল খেলে চলেছে, তবু আমি কিছুতেই সংযত করতে পারছি না সেই সর্বনেশে হাসি! জানি না কী কারণে! হয়তো অক্ষয় কবিরাজ, রাজেন গুহদের আশীর্বাদে অত মার খেয়েও মুখ না খোলার আনন্দ! পুলিশের ব্যর্থতা দেখে স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস-ব্যঞ্জনা!”

অনীক মনে মনে ঠিক করল, এই আশ্চর্য রাতের বাকিটুকুতে সে আর কিছুতেই অবাক হবে না।


|| ৯ ||

“জেরা করেছিল তারপরেও?”

“হ্যাঁ, তবে মৌখিক। শারীরিক অত্যাচারে যে আমাকে ভাঙা সম্ভব হবে না সেটা পূর্ণমাত্রায় অনুধাবন করেই বুদ্ধির প্যাঁচে পেড়ে ফেলবার নতুন চেষ্টা শুরু হল। সন্ধে সাতটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত পালা করে জেরা করতেন দু’জন, জগৎ ভট্টাচার্য আর শশধর মজুমদার। দ্বিতীয়জনের বিপ্লবী-সহানুভূতির ভড়ং যতটা না বিরক্তিকর, প্রথমজনের ব্যক্তিগত দরদ আরো অতিষ্ঠ করে তুলেছিল আমাকে।”

“কীরকম?” অনীক সাগ্রহে সামনের দিকে ঝোঁকে। এ-জগতের সঙ্গে দূরত্বের জড়তা হঠাৎ করেই যেন কেটে গেছে তার।

“সে এক কৌতুকনাট্য বটে! আমার নীরবতা ভাঙানোর জন্য জগৎবাবুর সে কী সহৃদয়তা! একদিন তো সামনে একখানা কৌটো মেলে ধরে বললেন, ‘দেখুন, আপনার উপর মারধোরের খবর পেয়ে আমার গিন্নী তো কেঁদেই আকুল! আমার পানের কৌটো থেকে পান ফেলে দিয়ে রসবড়া ভর্তি করে পাঠিয়েছেন আপনার জন্য। আপনারা হলেন গিয়ে আমাদের দেশের গৌরব! নিন, খেতে শুরু করুন, দেশের কাজের গল্প নয় আমায় পরেই বললেন!’”

“মিষ্টিগুলো ছেড়ে দেননি তো?” উচ্ছ্বসিত হাস্য দমন করার চেষ্টা করতে করতে অনীক বলে।

বিমল এবার হেসে ফেলেন। “শুধু তাই নয়, বিনিময়ে ওঁর একটি অনুরোধও রক্ষা করেছিলাম। ছলে-কৌশলে মুখ খোলাতে না পেরে আমার দুটি হাত ধরে তিনি অনুনয় করে গিয়েছিলেন, ‘দেখুন, আমায় কিছু বললেন না ঠিক আছে, তবে দোহাই আপনার, শশধরবাবুকেও বলবেন না!’ দুঃখের বিষয়, তার ঠিক পরেই শশধরবাবুও আমাকে একই কথা...”

দুজনের সমবেত উচ্চহাস্যের মধ্যে বাকি অংশটা ডুবে যায়। হাসির ফাঁকে ফাঁকে অনীক কোনোরকমে বলে, “আপনি তো মশাই ভয়ঙ্কর লোক! এমনি করে কোর্টে উকিলদেরও নাকাল করেছিলেন নাকি?”

“না না, তা কেন,” মৃদু হাসির রেশ লেগে থাকা বৃদ্ধের মুখটি বড় ভালো লাগে অনীকের, “দু’বার ফাঁসির হুকুম হয়ে বিনয় বোসকে টপকে যাব কিনা, সেইটা কেবল জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম একবার। তবে মজার ঘটনা আপনা থেকেই ঘটেছিল। যেমন ধরো, নভেম্বর মাসে আলিপুর কোর্টে প্রথমেই উঠল ভিলিয়ার্স মামলা। সেখানে একজিবিট হয়ে ভিলিয়ার্সের রক্তমাখা জামা এল বটে, কিন্তু সাক্ষ্য দিতে তাঁর টিকিটিও আলিপুরের চৌহদ্দিতে দেখা গেল না!”

“কেন, আপনার ভয়ে?”

বিমল তৎক্ষণাৎ মেনে নেন, “আমাদের ভয়ে বৈকি! একবার বিপ্লবীদের টার্গেট হলে ভূ-ভারতে কি তার রক্ষা আছে? কালা আদমীদের উপর ছড়ি ঘোরানোর আসনটি ছেড়ে ভিলিয়ার্স তাই চম্পট দিয়েছেন ব্রিটিশরাজের আপন দেশে! প্রাণে মারতে না পারি, ভারতের মাটি থেকে তাকে উচ্ছেদ তো করেছি! যাইহোক, একেবারে রায় বেরোনোর দিন জজ বার্টলার সাহেব আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ভিলিয়ার্স হত্যায় আমি জড়িত কিনা। অতি স্পষ্ট ভাষায় আমি জবাব দিলাম, যে ভিলিয়ার্স-নিধনের স্থির সঙ্কল্প নিয়েই আমি সেদিন ওই ঘরে ঢুকেছিলাম।”

“ফাঁসির রায় পেলেন না? এ তো স্পষ্ট অপরাধ স্বীকার!”

“নাঃ, দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড,” বিমল মাথা নেড়ে বলেন। “তোমার মত আমিও একটু অবাক হয়েছিলাম। তবে তখন আমি জানতাম না, এর পিছনে কার অবদান। জানলে নিশ্চুপে তখনই তাঁর আদেশের প্রতীক্ষা করতাম।”

“সুভাষচন্দ্র!” জটিল অঙ্ক মেলানোর আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে বলে অনীক।

“ভুলো না, তাঁর মেজদাদা শরৎ বসু মশায়” বিমলের ডানহাতটা আলগোছে কপাল স্পর্শ করে, “ছিলেন মস্ত বড় আইনজ্ঞ! বাদীপক্ষের উকিল এন.এন. সরকারকে আড়ালে আইনের ফাঁকফোকর তুলে ভুল বুঝিয়ে শাস্তির পরিমাণটা কমিয়ে নিতে তাঁর মোটেই অসুবিধা হয়নি। সঙ্গে পেডি-মামলায় আমার নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ডের কথা তুলে রাজি করানোটা ছিল বিপ্লবীদের একমাত্র সহমর্মী নেতা সুভাষ বোসের কীর্তি।”

“পেডি মামলায় আপনাকে কি তিনিই বাঁচালেন?” অনীক অভিভূত হয়ে শিশুর মত প্রশ্ন করে, “তাতেও জেল হয়েছিল?”

“হল না, হল না,” বিমলের দৃষ্টিতে একরাশ স্নেহ ঝরে পড়ে, “দীনেশদা যাদের মধ্যে মিশে গিয়ে কাজ করতে বলতেন, আমায় বাঁচিয়েছিল তারাই। হ্যাঁ, আমার পক্ষ সমর্থন করে জোরালো উকিল দিয়েছিলেন বসু-ভাইয়েরা। আমার মত তুচ্ছ মানুষের জন্য অনাবশ্যক বিনিদ্র রাতে অসংখ্য পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা – এ আমার পরম গৌরব। কিন্তু আদালতে একরোখা মেদিনীপুরই যেন অলঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল আমার আর ফাঁসীমঞ্চের মাঝখানে! সাক্ষ্য দিতে এসে ধঞ্চিদা দৃঢ়স্বরে বলে গেলেন, তিনি আমাকে চেনেন না। এদিকে নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খাঁ পুলিশের হস্তগত সাক্ষীদের অর্থমূল্যে বিদায় করে চলেছেন, বিপ্লবী সতীর্থরা ক্রমাগত প্রচার করে চলেছেন, বিফলে ভয়ও দেখাতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু পুলিশের হাতে তখনও একটি মারণাস্ত্র ছিল। সুশীল দাস নামক একটি ছেলে আমার কীর্তির প্রত্যক্ষদর্শী, আদালতে উঠে সে মিথ্যা বলতে নারাজ। নাড়াজোলের দরবারে কর্মচারী তার বাবাকে ডেকে দেবেন্দ্রলাল তখন জানিয়ে দিলেন, কোনো দেশদ্রোহী পরিবার তাঁর রাজ্যের সংস্পর্শে থাকতে পারবে না।”

“অমনি রাজী হয়ে গেল?” একটু সন্দেহ মিশে থাকে অনীকের প্রশ্নে।

“কী যে হবে, তা সেদিন বেলা বারোটায় কোর্ট বসার আগে পর্ষন্ত কেউই জানতাম না। আদালতে পিনপতনের নৈঃশব্দ্যে উকিল আমার দিকে তর্জনীনির্দেশ করে তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘এ ছেলেটিকে চেনো?’

“সুশীল সংক্ষেপে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ।’

“তারপরের একটি ঘন্টা জুড়ে সরকারী উকিল ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা ধরে জেরা করে গেলেন, অম্লানবদনে সুশীল তার সাক্ষ্য দিয়ে চলল। অন্তিম মুহূর্তে বিজয়োল্লাসে উকিল প্রশ্ন করলেন, ‘হত্যাকারী দুটি ছেলের মধ্যে একজন কি আদালতে উপস্থিত আসামী?’

“সুশীল নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে না।’”

অনীকের চিবুকের কাছে শক্ত করে জড়ো করা হাতদুটো আস্তে আস্তে নেমে এল। বিহ্বল কণ্ঠে সে বলল, “কিন্তু আপনাকে যে চেনে বলেছিল?”

“একই প্রশ্ন রাগে কাঁপতে কাঁপতে উকিলও তাকে করেছিলেন,” বিমল হেসে ফেলেন। “সুশীল ভারী অবাক হয়ে বলল, ‘অত ভালো খেলোয়াড়কে চিনব না? উনি যে আমাদের স্কুলটীমে ক্যাপ্টেন ছিলেন!’

“সুশীলের একটি কথায় সরকারপক্ষের সকল কর্মচারীরা হতবাক হয়ে দেখল, জেমস পেডি-হত্যার নিশ্ছিদ্র মামলা প্রমাণাভাবে খারিজ হয়ে গেছে।”

অনীক নিজের দুই হাতের মধ্যে মাথাটা নামিয়ে ফেলে। বিমল বলেন, “সমুদ্রপার করে আমায় সেলুলার জেলের তীর্থে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তবে তার অভ্যন্তরে যখন খবর পেতাম, প্রদ্যোৎ-প্রভাংশু-অনাথবন্ধু- মৃগেন-নবজীবন-নির্মলজীবন একে একে রক্তপাতে ধন্য করছে মেদিনীপুরের মাটিকে, তখন যে গর্ব হত, সেটা নিজের কাজের চেয়ে কম নয়। উত্তরাধিকার খোঁজবার চেষ্টা!” ম্লান হাসি ফোটে তাঁর মুখে।

অনীক মাথা নীচু করেই পরের প্রশ্নটা করে। “বিয়াল্লিশে জেল থেকে বেরোলেন তো? তার পর?”

“সে কথা আর না-ই বা শুনলে।” বিমলের বিষণ্ণ হাসিটা হঠাৎ বদলে যায় ব্যস্ততায়। “ঘড়িটা দেখেছ? তিনটে বাজে। ওঠো ওঠো। তৈরি হয়ে নাও ভাই।”


|| ১০ ||

মাথার ফেট্টিটা নিজের হাতেই বেঁধে দিচ্ছিলেন বিমল। অনীকের শহুরে-ছাঁট চুলটা যথেষ্ট এলোমেলো করে দিতেই ম্যাজিকের মত অনেকটা বয়স যেন বেড়ে গেল তার চেহারার। তোরঙ্গের নীচ থেকে বার করে দেওয়া পুরোনো জামাকাপড় অনীকের গায়ে কিছু ঢিলে হয়। ছোট করে পরা সাদা ধুতি আর ফতুয়ার উপর জায়গায় জায়গায় চায়ের জল ঢেলে দেওয়ায় আরো পুরোনো দেখাচ্ছে সেটাকে। কয়েকটা লাল সুতো দুই হাতে বেঁধে দেন বিমল, ভিজিয়ে কালো করে দেওয়া সেগুলোও। দেহাতি ফেরিওয়ালা হয়ে উঠতে প্রয়োজন আর কেবল একটু অভিনয়।

“আপনার ঋণ যে কী করে শোধ করব আমি!” অনীক আস্তে করে বলল। উত্তরের আশা সে করেনি, কিন্তু উত্তর এল অপ্রত্যাশিত আকুলতায়।

“আমার একটা কথা রাখবে?” বিমলের চোখে অপরিচিত এক অনুনয় ভেসে উঠেছে, “আমি তো ও-পারের দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছি। স্বাধীন ভারতের স্বাধীন সরকারের স্বাধীন অনাচার আর আমায় স্পর্শ করে না। কিন্তু যে মাটির বুকে এতটুকু অন্যায় দেখলেও একদিন সর্বস্ব দিয়ে রুখেছি, আজ সেইখানে চোখের উপর একের পর এক সর্বনাশ হতে দেখছি অথর্ব অবস্থায়, একা! কী রেখে গেলাম? পরিবার, পরিজন, প্রতিবেশী, আর সেই সব সহযোদ্ধাদের কালের গর্ভে হারিয়ে ফেলে... এখন একটা স্বপ্ন ছাড়া আমি কী করে বাঁচি বলো তো?”

শেষ দিকে বৃদ্ধের স্বর একটা হাহাকারে মিলিয়ে যায়। অনীক তাঁর হাতটা দুই হাতে ধরে বলে ওঠে, “আমি কী করব? আদেশ করুন!”

“আমাকে একটা সুস্থ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে পারো? কাঁচা বয়সে যখন জীবন দিতে পথে নেমেছিলাম, চোখে স্বপ্ন ছিল স্বাধীন ভারত এক স্বর্গরাজ্য হবে। কই, পেলাম না তো! আগামীর জন্য কিছু রেখে যাওয়া ছাড়া মানুষের জীবনের সার্থকতা কই, ভাই?”

তদ্গত ভাবে বিমল বলতেই থাকেন, “এখন দীনেশদার, এবং তাঁর বহু আগে থেকে যে-কথা আমাদের পরম্পরায় চলে আসছে, সেটুকু ছাড়া আর তোমায় কিছুই বলার নেই আমার। একটা সম্পূর্ণ মানুষের মত মানুষ তো হতেই পারো তুমি, অনীকেন্দ্র? সুস্থ, সবল, ঋজু মেরুদণ্ডের একটা মানুষ? যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শুধু রুখে দাঁড়াবে না, শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত অবিচল লড়ে যাবে? মানুষ হয়ে ওঠা, মানুষ গড়ে তোলা, একটা সুস্থ সমাজ, একটা শিক্ষায়-চেতনায় দীপ্ত পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে পারো না তোমরা?”

জবাব দিতে গিয়ে অনীকের গলাটা হঠাৎ কেন বুজে আসে তা সে জানে না। সে মাথা নীচু করে ফেলে। বৃদ্ধ এতক্ষণে সংযত করেছেন নিজেকে অনেকটা। তিনি পুরোনো জামা-কাপড় বাঁধা গাঁটরিটা তুলে দেন ওর হাতে। বলেন, “এ বার তোমার ভাগ্য আর সাহসের পরীক্ষা। স্টেশনের বেঞ্চে শুয়ে থাকবে, লাইনের দিকে পিছন ফিরে। ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার আগে অবধি নজর রাখবেই ওরা। ট্রেন চলতে শুরু করার আওয়াজ পেলে ওদের বিপরীত দিকে ছুটে ট্রেনে উঠে পড়তে পারলেই...”

“পারব।” নকল বোঝা কাঁধে তুলে নিয়ে অনীক তাঁর চোখে চোখ রাখে। সে দৃষ্টিতে একরাশ আত্মপ্রত্যয়।

অনীকের বদলে যাওয়া চেহারাটার দিকে তাকিয়ে বিমলের হঠাৎ মনে পড়ল, ঘর ছাড়ার আগে হাত-আয়নায় নিজের মুখ দেখে চিনতে না পেরে সন্তুষ্ট সেদিনের সেই বিশ বছরের তরুণটির কথা। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তাঁর।

“তবে যাই।” সহসা প্রণাম করতে নীচু হয় অনীক, ততোধিক ক্ষিপ্রতায় বিমল তাকে ধরে ফেলেন, দেওয়ালের ছবিদুটোর দিকে দেখিয়ে বলেন, “ওঁদের সামনে আমার পা ছুঁয়ো না।”

অনীক বিচলিত হল না। নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত-দুটো একবার জড়ো করল। বিমল শক্ত হাতে তার দুটি কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে দেন, “সাবধানে যেও!”

পিছনের দরজাটা খুলে দেন তিনি। বাইরে বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেছে। তারই মধ্যে ধীর পদক্ষেপে অনীক পেরিয়ে গেল দৃষ্টিসীমার চৌকাঠ। তারপর আচমকাই যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

খিড়কিদুয়ারে আরও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন বিমল। অনীক চোখের আড়াল হয়ে যাওয়ার পরেও। অদ্ভুত একটা ব্যথার অনুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে তাঁর শিরায় শিরায়। চেনা কিছুর সঙ্গে এই বেদনাকে মিলিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি। না, স্বাধীন ভারতে গণতন্ত্রের অবক্ষয়, মানুষের না-বদলানো দুর্দশা এ-সব তাঁকে এখন আর ভাবিত করছে না। বরং পুরোনো স্মৃতি উথালপাতাল হয়ে ভেসে আসছে আরেকটা বয়স্ক মানুষের মুখ।

রঘু গোয়ালার সঙ্গে সেদিন এ দরজা দিয়ে অন্ধকারে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনীকের মতই আর ফিরে তাকাননি সেদিন তরুণ বিমল। আর এই জায়গায়, বিপদসঙ্কুল পথ দিয়ে তাঁকে চিরবিদায় দিতে পাথুরে কঠিন মুখে এমনি করেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সেদিন তাঁর বাবা। অক্ষয়কুমার দাশগুপ্ত।

আজ হঠাৎই তাঁর কেমন মনে হতে লাগল, ছেলেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে দিয়ে কী ভাবছিলেন অক্ষয় কবিরাজ? কীসের জোরে আমৃত্যু কর্তব্যে অটল থাকার আশীর্বাদ করেছিলেন রাজদ্রোহী পুত্রকে? লক-আপে ছয়-সাত ঘন্টার টানা অত্যাচারের মাঝে কেমন করে তাঁর স্মৃতি রক্ষা করেছিল অসুস্থ বিমলের জ্বরতাড়িত মস্তিষ্ককে? কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের মারের চোটে বিকৃত চেহারা প্রথমে শনাক্ত করতে না পেরেও কেমন করে স্থিতপ্রজ্ঞ নীরবে বসে সহ্য করেছিলেন আদালতের অবিচার? সরকারের রোষে জর্জরিত বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন বিনা অভিযোগে। এই পিতৃঋণ কি এ জীবনে শোধ হয়েছে তাঁর? আজ সর্বস্ব মন্থন করে এই প্রশ্নটা উঠে আসছে বিমলের – শেষ বয়সে কেমন করে তিনি সয়েছিলেন উত্তরাধিকারীর জাগিয়ে তোলা ঝড়ের তোলপাড়?

দরজা বন্ধ করে বিমল ভিতরের ঘরে আসেন। দেওয়ালে টাঙানো ছবিদুটির পানে চেয়ে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করেন প্রাণপণ।

তারপর চোখ বুজে দর্শন করেন পিতার মুখ। পিতৃস্নেহ। হৃদয় সমাহিত হয়। আত্মস্থ স্বরে, আর্দ্রকণ্ঠে চিরতরুণ বিপ্লবী বিমলকুমার দাশগুপ্ত জীবনের প্রথম আশীর্বাণী উচ্চারণ করেন।

বিশ্বাস রাখলাম, অনীকেন্দ্র। সফল হও, সার্থক হও। আমার সকল শক্তি, সাহস, পুণ্যফল ─ তোমাদের দিলাম।



(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)