বিকেল থেকেই আকাশের কোণে মেঘ জমছিলো একটু একটু করে। সন্ধের আগেই তা ছেয়ে ফেললো গোটা আকাশটাকে। রাতের দিকে বাতাস যেন হঠাৎ স্থির হয়ে গেলো। মাঝরাতে বিদ্যুতের রেখা আকাশটাকে নিশব্দে চিরে ফেলতে লাগলো বারবার। আর তারপরেই শুরু হলো অঝোরে বৃষ্টি। আর সেই সাথেই থেকে থেকে সবকিছুকে তছনছ করে দেওয়া ঝোড়ো হাওয়া। অর্থাৎ এই দুর্যোগ এখন চলবে। সবাই ভেবেছিলো। সেই অন্ধকারে। বাইরের দিকে তাকিয়ে।
কিন্তু কি আশ্চর্য! সকাল বেলায় দেখা গেলো অন্যচিত্র। কোন্ মন্ত্রবলে যেন সমস্ত মেঘ উধাও। একটা নরম আলোয় ভরে ছিলো চারিদিক। মাঝে মাঝে নিঃশব্দে ঝরে পড়ছিলো মিহি বৃষ্টির গুঁড়ো। হালকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিলো সমানে। অর্থাৎ দুর্যোগ কেটে গেলো। সবার মনে হয়েছিলো। সেই ভিজে আলোবাতাসের সামনে এসে।
তাই সবাই বেরিয়ে পড়েছিলো বাড়ির বাইরে। জোয়ানরা কাজেকম্মে। অকম্মারা ফূর্তিতে। সেই ভাবেই বেরিয়েছিলো কিছু কিছু বাচ্চাকাচ্চারা। নিছক খেলার হুল্লোড়ে। এমনকি কিছু নড়বড়ে বেহদ্দ বুড়োরাও। অতি উৎসাহে। কিছু-না-কিছু বলতে। যেমন—"এ অতি সুলক্ষণ ... কারণ এইসময়ে ..." ইত্যাদি অবান্তর কথার কথায়।
কারণ এইভাবেই দিন কাটে এদের। সাগরের কোল ঘেঁষে এই সামান্য জোলো জায়গার মানুষজনের। প্রকৃতির খেয়ালের সঙ্গে যুঝে যুঝে। রোজকার নিত্য কষ্টের মধ্যে নিজেদের বানানো খুশিতে। এইভাবেই তাদের বেঁচে-বর্তে থাকা। তাই বিরাট ঝড়জলের হাত থেকে রেহাই পেয়ে ওই মানুষগুলোর খুশি উপছে পড়ছিলো।
ঠিক সেই সময়েই দেখতে পাওয়া গেলো ব্যাপারটা। সবার আগে চোখে পড়েছিলো বাচ্চাদের। ওরা ভেবেছিলো সমুদ্রে ভেসে আসা কোনো মরা শুশুক। কিংবা ওইরকম কোনো জীবজন্তু। কিন্তু কাছে গিয়ে ওরা ঘাবড়ে গেলো। তারা স্পষ্ট দেখতে পেলো একটা মানুষের আদল। কিন্তু বিরাট মাপের। আর কি জমকালো তার গায়ের পোশাক। ওরা ঘুরে ঘুরে হৈ হৈ করে দেখতে লাগলো তাকে।
ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলো খানিক বাদেই। সেখানে এসে হাজির হলো এখানকার যতো জোয়ানমদ্দের দল। "ভাগ এখান থেকে তোরা—এক্ষুনি ভাগ"—বলে ওই বিরাট শরীরটার চারদিকে ঘিরে থাকা কাচ্চাবাচ্চাদের তাড়ালো তারা। তারপর নিজেরাই বলাবলি শুরু করলো—"কি বিশাল চেহারারে বাবা!"
—"কিন্তু এ এলো কোত্থেকে?"
—"যুদ্ধে মরলো না জলে ডুবে?"
—"কিন্তু একে এভাবে এখানে তো ফেলে রাখা যায় না।"
এরপর ওরা ওই বিরাট শরীরটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো ওদের এলাকার মধ্যে। এলাকা বলতে তো কয়েকশো ঘর বাসিন্দার মাথা গোঁজার জায়গা। তাও সব পাকাপোক্ত নয়। চারপাশে নোনা জলের ঢেউয়ের মাঝে এক চিলতে জমি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর এর ওপরই তাদের বসবাস। ঝড়জল আর জোয়ার-ভাঁটার দাপটে তাদের আস্তানাগুলো কখন আছে আর কখন যে নেই তা নিজেরাই জানে না। এই ভাবেই এরা থাকে। এদের বাপ-ঠাকুদ্দারাও ছিলো। এরপর এদের ছেলেপুলে নাতিনাতনিরাও থাকবে।
—"বাপরে! এ যে ঘোড়ার লাশের চেয়েও ভারি।"
—"আর তেমনি দামড়া গতর।"
—"সাতসক্কালে কোত্থেকে জুটে এসে এতো সুন্দর সকালটার বারোটা বাজিয়ে দিলো।"
—"এখন থাক পড়ে এই খোলা জায়গাটায়"—বলাবলি করতে করতে ওই প্রকাণ্ড পাথরের মতো চেহারাটাকে নিয়ে এলো ওদের বসতজমির আরেক ধারে।
এইবার ব্যাপারটা চোখে পড়লো এলাকার মেয়ে-বৌদের। ওরাও একে একে এসে দেখতে লাগলো পাথর হয়ে যাওয়া ওই মানুষটাকে।
'কি চমৎকার চেহারা!'
'কি সুন্দর শরীরের গড়ন।'
'যেন শিশুর মতো মুখটা।'
'ও হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ--'
ফিসফিসিয়ে বলাবলি করছিলো ওরা। ওরা মানে এলাকার সব মেয়েমানুষরা। যারা জড়ো হয়েছিলো ওই চিৎ হয়ে পড়ে থাকা নিথর শরীরটাকে ঘিরে।
এইসময়ে ওদের প্রায় সকলেরই মনে এসে ছিলো নিজস্ব কিছু গোপন ভাবনা।
কেউ ভেবেছিলো—'একে যদি পেতাম আমার জীবনে।'
কেউ ভেবেছিলো—'শুধু একটা রাতেই এ যা করতে পারতো আমার সঙ্গে—আমার সাথে বরাবর রাত কাটানোর মানুষটা সারা জীবনের চেষ্টাতেও তা পারতো না।'
আবার এক থুত্থুড়ে বুড়ি একদৃষ্টে তার বিরাট হাতদুটোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো —'এই হাতে পড়লে আমাদের এই নোনা জায়গাতেও চাষ করা যেতো।'
এইভাবে ওদের দিনের বেলাটা কেটে গেলো ওই পাথরের মতো পড়ে থাকা বিরাট শরীরটাকে নিয়ে। তার মুখ চোখ চুল জামা সব এক এক করে পরিষ্কার করলো তারা সবাই মিলে। অনেক যত্ন করে ঘষে ঘষে তুলতে লাগলো তার সারা শরীরে জড়িয়ে থাকা সমস্ত কাদা-মাটি-শ্যাওলার আস্তর। যেন তাদের এই হাভাতে জীবনে অনেক দিন বাদে সত্যিকারের ভালোবেসে কিছু করার মতো তারা পেয়েছে।
ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগলো না এখানকার কোনো জোয়ানমদ্দের। তারা ঠিক করলো সেই দিনই কি করে এই লাশটাকে নিয়ে তাদের মেয়েমানুষদের এতো আদিখ্যেতার ব্যাপারটা শেষ করে দেওয়া যায়। তাই সূর্য ডোবার আগেই তারা ওই শরীরটাকে যাতে বরাবরের মতো বিদেয় করে দেওয়া যায় তার ফন্দি এঁটে ফেললো।
বিশাল লম্বা অনেকগুলো বাঁশের সঙ্গে ওই লাশটাকে আষ্ঠেপৃষ্টে বেঁধে ওরা চাপালো তাদের সবচাইতে বড়ো ডিঙিনৌকোতে। তারপর সেই নৌকো চললো মাঝদরিয়ায়। আরো দুটো নৌকো গেলো তার সাথে। তারপর গভীর জলে যেখানে কিলবিল করছে ভয়ঙ্কর কুমীররা ঠিক সেখানেই বিসর্জন। নৌকোগুলোর ধার ঘেঁষে কালো জলের ঢেউ ঘোলাটে লাল হয়ে গেলো মুহূর্তেই।
বাড়ি ফিরে তারা বেশ রসিয়ে রসিয়ে বললো সমস্ত ব্যাপারটা তাদের মেয়েমানুষদের। তারপর রোজ রাতের মতো খেয়ে দেয়ে নিয়মমাফিক শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো বৌবাচ্চাদের পাশে। আর তখন তাদের পাশে ওইসব মেয়েমানুষরা অন্ধকারে চোখের জল ফেলে ভাবতে লাগলো—'আর কখনো ও ফিরবে না ....যে জল থেকে এসেছিলো সেই জলেই ফিরে গেলো ....যদি ফিরে আসতো তাহলে এখানকার সমস্ত ঘরবাড়ি নতুন করে বানাতে হোতো .... অনেক উচুঁ করতে হোতো ঘরে ঢোকার দরজা ....ঘরের শোয়ার ব্যবস্থা...'
কেবল একজন—এইসব মেয়েমানুষদের মধ্যে কেবল একজন একফোঁটাও চোখের জল না ফেলে সারারাত কাটিয়ে দিলো এই ভেবে ভেবে—'এ হতেই পারে না ... ওকে আমি জানি...ওর নাম অস্তিমান... ও হলো সাগরের রাজা ... ও আবার একদিন ফিরে আসবে... আসবেই ...'
এ ছিলো এলাকার সবচেয়ে ডাকসাইটে জোয়ানের অল্পবয়সী বৌ।
পরদিন সকালের আলো ফোটার সাথে সাথেই শুরু হলো সব্বার রোজকার কাজ। আগের রাতের আধোঘুমে নতুন করে উঁচুউঁচু ঘরবাড়ি বানানোর আজব স্বপ্ন কখন যে উড়ে গেলো সেই সব চোখের জল ফেলা মেয়েমানুষদের মন থেকে তা তারা ভাববার সময়ই পেলো না। নতুন করে বাচ্চাকাচ্চাদের জন্ম দিতে আর বড়ো করতে গিয়ে তাদের এইসব স্বপ্ন নিয়ে ভাবার সময় ছিলো না।
এইভাবেই সেদিনের অল্পবয়সী মেয়েরা তাদের রঙিন বয়স পেরিয়ে বুড়ি হয়ে গেলো কতো সহজেই। সেদিনের জোয়ানমদ্দেরা থুত্থুড়ে বুড়ো হয়ে বেঁকে গেলো বয়সের ভারে। অনেকেই মরে হেজে গেলো এর মাঝে। চারদিকে নোনাজলের ঢেউয়ের মাঝে মাথা তোলা এই একচিলতে জমিতে কোনোমতে টিঁকে থাকা কিছু মানুষ এভাবেই সময়ের সাথে চলতে থাকে। তাই কবে কোনকালে একটা বিরাট চেহারার মানুষের হঠাৎ ঝড়জলে ভেসে আসার ঘটনা তুচ্ছ হয়ে হারিয়ে যায় তাদের মন থেকে।
ঝড়জল আসে। ঝড়জল যায়। এই জলাজমির উপর দিয়ে। নিয়মমাফিক। এখানকার মানুষজন অভ্যস্ত প্রকৃতির এইসব খেয়ালে। তাই হঠাৎ সবকিছু ভাসিয়ে দেওয়া জল কিংবা চারদিক লণ্ডভণ্ড করা ঝড় খুব সহজ স্বাভাবিক এদের জীবনে। কিন্তু সেদিনের ঝড়জলের সঙ্গে যা ছিলো তা ওদের কাছে মোটেও স্বাভাবিক ছিলো না। ওরা রীতিমতো তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলো এই ব্যাপারটায়। ওরা মানে ওই এলাকার এখনকার ছেলেছোকরার দল।
তিনদিন একনাগাড়ে ঝড়জলের পর জল নেমে যেতে দেখা গিয়েছিলো ব্যাপারটা। সামনের চরে। কোনো মরা গোরুমোষ নয়। একটা আস্ত মানুষ। বিরাট চেহারার। গায়ে জমকালো পোষাক। সারা শরীরের কাদামাটিশ্যাওলার আস্তরের ভিতর দিয়েও ফুটে উঠছে লোকটার দারুণ মজবুত শরীরটার আদল।
—"ডাকাত নাকি?"
—"নাকি দস্যু-টস্যু?"
—"না না ওপারে বোধহয় যুদ্ধ লেগেছে—এ মরা সেনাপতি-টেনাপতি কিছু হবে।" এমন অনেক কথাই ভাসতে লাগলো এদের মুখে।
এদের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠলো—"অনেক কাল আগে নাকি এমন একটা ঘটনা ঘটেছিলো--ছোটোবেলায় শুনেছিলাম দাদুর মুখে।"
তার উত্তরে আরেক জন বললো—"আজ তোর সেই দাদুও নেই—তাই তোর ওই কথার দামও নেই—ভাগ তো--"
আরেক জন মুরুব্বি গোছের লোক বললো—"কবে কি হয়েছে ভেবে লাভ নেই—এখন এই লাশকে নিয়ে কি করা যায় তাই ভাবো।"
এবারও ঘটনাটা রটে গেলো হু হু করে। দিনকাল বদলেছে অনেক। কিন্তু চারদিকের নোনা জলের মধ্যে কোনোমতে মাথা তুলে দাঁড়ানো এই একচিলতে জমিতে কিছু হতদরিদ্রের জীবনে তেমন কোনো বদল হয়নি এখনো। তাই এখনকার ছুকরি মেয়েরা আগের মতোই অবাক চোখে চেয়েছিলো ওই মরামানুষটার মুখের দিকে।
এইসব অল্পবয়সী মেয়েদের থেকেই কথা চলে গেলো এলাকার মাঝবয়সী মহিলাদের কানে। এইভাবেই এখানকার সবচেয়ে বেশি বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বুড়িটার কানেও কথাটা এলো। আর কথাটা শুনেই সে যেন চমকে উঠলো। ঘোলাটে চোখে তার নাতনির দিকে তাকিয়ে বললো—"কি রকম দেখতে বললি? কেমন চেহারাটা?"
সবকিছু শুনে সেই বুড়ি নিজের ছোট্ট ডেরাটায় ঢুকে আপনমনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো—"জানতাম--
—"আমি জানতাম
—"ও ফিরে আসবেই—
—"ও যে সাগরের রাজা —
—"ও কখনো কুমীরহাঙরের পেটে যেতে পারে?
—"ওদের কথা কোনোদিনই বিশ্বাস করিনি
—"তাই আজ পেলাম এই বিশ্বাসের দাম।"
এই বুড়িই ছিলো বহুকাল আগের এই এলাকার সবচাইতে জোয়ানমদ্দের অল্পবয়সী বৌটি। যে সারা রাত কাটিয়ে ছিলো এইভেবে—'ও ফিরে আসবেই--ও যে সমুদ্রের রাজা।' এতো বছর বাদে এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি খুশি হলো সে-ই।
অন্যেরা যে এ-ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখালো তা নয়। জোয়ানমদ্দেরা সবাই মিলে চাদর গোছের কিছু একটা টাঙিয়ে দিলো ওই চিৎ হয়ে পড়ে থাকা শরীরটার উপর। "আজ রাতটা কাটুক, তারপর কাল সকালে একটা বন্দোবস্ত করা যাবে।"-- বলে যে যার ঘরমুখো হলো। আর সেই প্রকাণ্ড লাশটা পড়ে রইলো খাঁ খাঁ জমির উপর—হু হু করে বয়ে যাওয়া বাতাসে—গোটা রাতটার জন্যে।
সেই রাতে বোধহয় দূর আকাশের চাঁদটা ওই সামান্য চরাচরের খুব কাছে চলে এসেছিলো। এবং বিরাট আকারে সম্পূর্ণ হয়ে যেন ঝুঁকে পড়েছিলো ওই পরিত্যক্ত মৃতদেহটির উপর। সেই সময় ওই ভরাজ্যোৎস্নায় সবার চোখের আড়ালে একটা লাঠি হাতে ঠুক ঠুক করে বেরিয়ে পড়েছিলো এলাকার সবচেয়ে বয়স্কা ওই নুয়ে পড়া মহিলাটি। এবং এদিক ওদিক হাতড়াতে হাতড়াতে ঠিক পৌঁছে গিয়েছিলো ওই শায়িত দেহটির সামনে। আর তখনই যেন চারিদিকের সমস্ত আলো হঠাৎ কেউ শুষে নিলো আশ্চর্যভাবে। অর্থাৎ কোত্থেকে উড়ে আসা একটা বিরাট কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিলো ওই বিপুল পূর্ণিমা।
এতে কিন্তু বৃদ্ধাটি একেবারেই বিচলিত হলো না। বরং ধীরস্থিরভাবে এগিয়ে গেলো মৃতদেহটির মাথার দিকটায়। তারপর তার কাঁপা হাতের আঙুলগুলো সেই হিমশীতল মুখটির উপর বুলিয়ে বুলিয়ে অস্ফুটে আপনমনে বলতে লাগলো—"অস্তিমান! অস্তিমান! জানতাম তুমি আসবে--" আর তখনই মেঘ সরে গিয়ে জ্যোৎস্নার ঢেউ যেন আছড়ে পড়লো চারদিকে।
বৃদ্ধাটি তার ক্ষীণদৃষ্টিতে তখনই দেখতে পেলো চাঁদের আলোয় মাখা সেই মুখশ্রীটি। যেন পাথরে খোদাই করা ঠোঁট নাক চোখ। বিরাট বড়ো বড়ো বন্ধ চোখ দুটির উপর এসে পড়েছে মাথার একগোছা কোঁকড়া চুল। বৃদ্ধাটি যেন পরম যত্নে সরিয়ে দিতে গেলো সেই চুলের গোছাটি। আর তখনই যেন ওই শীতলতার ভিতর এক আশ্চর্য উষ্ণ স্পর্শ পেলো তার শুকিয়ে যাওয়া আঙুলগুলোর ডগায়। চমকে উঠে তাকিয়ে দেখলো তার হাত ছুঁয়ে আছে আরেকটি হাতের আঙুল।
নিখুঁত নিটোল সেই হাতটি কার? বৃদ্ধাটি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ওই হিমশীতল মানুষটির একরাশ ভেজা চুলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে মুখ নীচু করে যেন পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে রয়েছে এক সদ্যতরুণী। কোথাও যেন তার কোনো হুঁশ নেই। যেন সম্পূর্ণ মগ্ন হয়ে রয়েছে নিজস্ব অতল সুখে কিংবা দুঃখে। অতএব সামনে এসে বসা বৃদ্ধাটিকে সে লক্ষ্যই করেনি।
বৃদ্ধাটি তার ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলো মেয়েটিকে। মেয়েটিও যেন মুহূর্তের জন্য সম্বিৎ ফিরে তাকালো সামনের দিকে। তখনই এদের নয়নপথে এক বিপুল বিস্ময় স্থির হয়ে গেলো।
—'একি! আমার দিদা!
—'এইভাবে! এতো রাতে!
—'অন্ধকারে লাঠি হাতে একা!
—'এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে!
—'এই লোকটির পাশে--
—'নিশ্চুপে,
—'আমার মতো
—'কেন? কিসের টানে?'
চমকে উঠে মনে হলো সেই অল্পবয়সী মেয়েটির।
—'এ তো আমার নাতনি....!
—'ঠিক আমার মতো....!
—'দুহাত বুলিয়ে দিচ্ছে মানুষটার চুলে....!
—'কতো যত্নে....!
—'ঠিক যেন আমি.....!
—'সেই কবেকার.....!
—'কিন্তু কেন?'
স্তম্ভিত হয়ে ভাবলো সেই বৃদ্ধা।
ওরা পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো মুহূর্তের জন্য।
নির্বাক—নিরুত্তর হয়ে।
তখনই আবার ঘনমেঘে ঢেকে গেলো ওই প্রকাণ্ড পূর্ণিমা। অর্থাৎ ওই দুই অসমবয়সী নারীর এই আশ্চর্য বিপন্নতার উপর নেমে এলো এক অন্ধকার কিংবা অমর্ত্য।
(গল্পটি Gabriel Garcia Marquez এর The Handsomest Drowned Man গল্পের দ্বারা প্রাণিত।)
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)