Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে সোহিনী রায়-এর
লেখা



ISSN 1563-8685




তিন এক্কে তিন- তিনচুলে, লামহাটা, লেপচাজগৎ

দ্য সদ্য অর্জুন অভিক দত্তের ‘অন্তবিহীন’ এর অন্তে পৌঁছে বৈভবী আর বুবকার হাত ধরে উত্তরবঙ্গে পৌঁছে গেছিলাম। সেই রেশ যাতে না শেষ হয় তাই আবার করে স্মৃতিচারণের হাত ধরলাম আমাদের দার্জিলিং সাফারির। না হাতির পিঠে চেপে ঘুরিনি, তবে মেঘেদের হাত ধরে ধোঁয়াশায় মোড়া, বৃষ্টিস্নাতা এক ভেজা প্রেক্ষাপট চেখে দেখলাম। জার্নির তারিখ ছিল ৬ই মে ২০১৮। দলগত সদস্যরা হলেন পঞ্চপাণ্ডব — অধম যুগল, আমার বাবা, মা, ভাই। কলকাতা মে মাসের ভ্যাপসা গরমে যখন জেরবার তখন সকলকে বুড়োআঙ্গুল দেখিয়ে একটাও ক্যালেন্ডার হলিডে না পেয়েও পদাতিকের পেটের মধ্যে পা সেঁধিয়ে দিয়ে রাতের আকাশ দেখতে দেখতে পাড়ি দিলাম উত্তরবঙ্গের দিকে। রামপুরহাট, মালদা, কিসানগঞ্জ পেরিয়ে ট্রেন যতই এগোতে লাগলো আমার মনও ততই অরিন্দম শীলের ‘ব্যোমকেশ পর্বের’ আনাচে কানাচে ঢুকে প্রাক উত্তরবঙ্গ পরিক্রমা সারতে ব্যস্ত হল।


সবে মাত্র যখন আবিরের পাশে বসে “খোলো দ্বার বঁধুয়া” গানে বিভোর হয়েছি, মায়ের চেঁচামিচিতে স্বপ্নের দফারফা। বাবা জানাল ট্রেন ঠিক সময়েই এগোচ্ছে। যথাসময়ে এন জে পি স্টেশনে নেমে আরো একবার ভগবানকে কুর্নিশ করলাম আমার ভ্রমণের ঝুলিতে আরো একটা অভিজ্ঞতা ভরে দেয়ার জন্য। গাড়ির ড্রাইভার সাহেবের আসতে মিনিট দশেকের দেরি ছিল বলে আমি আমার ভাইয়ের হাত ধরে লোকাল মার্কেটে জুতো খুঁজতে বেরলাম। কারন আর কিছুই না, অলসতার উচ্চ সীমা পেরিয়ে গিয়ে বাড়ি থেকে বেরনোর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আমার জুতো খোঁজার সময় করে উঠতে পারিনি। জুতো পাওয়া গেলনা ঠিকই, বরং বিনামূল্যে আমার কপালে জুটল মায়ের অফুরন্ত বাক্যবাণ এবং ভাইয়ের শ্লেষোক্তি। অযথা মাথা গরম আমার ধাতে নেই আর সামনে যেখানে স্নিগ্ধ শীতল কাঞ্ছনজঙ্ঘা দু হাত বাড়িয়ে ডাকছে তখন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে মাথা না গলানোই শ্রেয়। তাই আসল লোক মানে ড্রাইভার সাহেবের কানে কথাটা তুলে দিয়ে আমি কানে তুলো দিয়ে বসলাম। ড্রাইভার সাহেবের নাম ছিল সিমন। কাকতালীয় কিনা জানিনা, সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় ‘যেখানে ভূতের ভয়’ এর দ্বিতীয় গল্পে সিমন নামক ভূতুড়ে বিড়ালের কথা মাথায় এল যার বিবরণী এবং শ্যুটিং দুটোরই কেন্দ্রস্থল নর্থ বেঙ্গল। এইসব ভাবনার মাঝে নিজেকে যখন ডুবিয়ে দিয়েছি, হাতের লোমেদের স্পর্শকাতরতা জানান দিল আশপাশের শীতশীতানি। বড় বড় শাল গাছেদের মাঝের হাইওয়ে ধরে নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চললাম আমরা। দুপুর বারোটা তিরিশ নাগাদ প্রথম হল্ট দিল তিনচুলে যেখানে সিমন এর দেখানো দোকান থেকে আগামী কয়দিনের পদসাথীকে বগলদাবা করে গাড়িতে উঠে বসলাম। পরবর্তী ৪৫ মিনিটের মাথায় আমাদের পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে নিজস্ব ছন্দে গাড়ি হেলিয়ে দুলিয়ে মেঘেদের হাতে পৌঁছে দিল সিমন। ঘড়িতে যখন একটা কুড়ি আমরা নামলাম তিনচুলের অভিরাজ হোমস্টে-তে। তিনচুলে নিয়ে কিছু তথ্য দিয়ে দিই — দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত এটি Takdah থেকে ৩ কিমি দূরে অবস্থিত। তিনচুলে মানে তিনটি চুলা — তিনটে পাহাড় জায়গাটিকে এমন ভাবে ঘিরে রয়েছে যে দেখলে মনে হবে তিনটে চুলা জ্বলছে। রাস্তার বাঁদিকে হোমস্টে এর বিশাল বড় জায়গা আর ঠিক ডান দিকেই বিশাল বড় বড় পাইন গাছেদের ঘন জঙ্গল, মাঝখানে রাস্তার নিজস্বতা। ঠিক যেন রাজ সিনেমার শ্যুটিং স্পট। গাড়ি থেকে নেমেই টের পেলাম সেঁতানো ঠাণ্ডার শিরশিরানি, সাথে এক অপরিসীম নিস্তব্ধতা।হোমস্টে ছেড়ে বেশ কিছুটা সামনে হেঁটে গিয়ে দেখলাম ধোঁয়া ভরা এক দুপুর। বাঁপাশে যত নীচে চোখ যায় পুরু জনবসতি, চোখ যত উপরে উঠতে লাগলো মেঘের সাথে সখ্যতা শুরু হল। যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেখানেও যেন মেঘ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার মুখ, আমার মন। মনে মনে গুনগুন করে উঠলাম “মন খারাপ করা বিকেল মানে মেঘ করেছে, দূরে কোথাও দুএক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে”। বাবার ডাকে সংবিৎ ফিরল। রুমে ঢুকে চটজলদি স্নান, দুবার নাক কুঁচকে নাপসন্দ জিন্স টপ-এর পরিবর্তন এবং পরিশেষে নিজেকে সীমিত শীতের পোশাকে ঢেকে হাজির হলাম ডাইনিগ হল-এ। গরম ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত, ডাল, তরকারি, ডিমের কারি পেটের কোনায় ঠেলে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম সাইট সিইং-এর জন্য।


প্রথম গন্তব্য ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পয়েন্ট। পেডং থেকে ৬ কিমি উতরাই পেরিয়ে পৌঁছলাম গন্তব্যে। রাস্তা থেকে বেশ অনেকটা পায়ে হাঁটা ছোট রাস্তা পেরিয়ে উঠলাম চূড়ায়। রাস্তার বাঁদিকে স্বল্প গাছপালার বিস্তার আর ডানদিকে চোখ গেলে দেখা যায় তিস্তা তার নৃত্যশলীলা বিভাজিকায় নিজেকে সুসজ্জিত করেছে। এরকম জায়গায় ক্যামেরার প্যানোরমিক ভিউ না নিলে অপমান। অতএব সকলে নিজের মোবাইল ক্যামেরা এবং নিকন, ক্যানন-এর যৌথ উদ্যোগে ছবির পসরা খুলে ফেলল। হঠাৎই বাবার ডাকে দেখলাম, বাবা তিস্তা, মা আমাদের সক্কলকে ফেলে মন মজিয়েছে রাস্তার পাশের গোলাপি ফুলের শোভায়। সে তো যে সে ফুল নয়, বে-রঙিন রাস্তাকে রঙিন করে তোলার দায়িত্ব সে একাই নিয়েছে। দীর্ঘ কুড়ি মিনিটের ফোটোসেশন সেরে আবার একই রাস্তা দিয়ে নেমে গাড়িতে উঠে বসলাম পরবর্তী গন্তব্য তাকদাহ অর্কিড হাউসে যাওয়ার জন্য। আঞ্চলিক ভাষায় তাকদা শব্দের অর্থ হল ‘পরিবৃত বা ঢাকা জায়গা’। অন্যান্য শহরের তুলনায় মেঘেদের বড়ই কাছের এই তাকদাহ। সিডার গাছেদের সারি এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। অর্কিড সেন্টারে নামতে গিয়ে সিঁড়ির স্তর দিয়ে নীচে নামলাম আমরা। তারই মাঝে মাঝে চলল টুকটাক ফোটোসেশন। আশেপাশে রঙ বেরঙের ফুল, ছোট ছোট রকমারি অর্কিড গাছের সাক্ষাৎ পেয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। পরবর্তী গন্তব্য তাকদাহ হ্যাঙ্গিং ব্রিজ। এটি ব্রিটিশ অধ্যুষিত সময়ের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। গাড়ি থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক পায়ে হাঁটা খাড়াই পাথুরে পথে নেমে পৌঁছলাম ব্রিজের সামনে। দুরুদুরু বুকে ব্রিজে পা রাখতেই ফিজিক্সের সাসপেনশন থিয়োরির কথা মনে পড়ল। তাই আমরা সকলে আলাদা ছন্দে পা ফেলে ওপারের উদ্যেশে চলতে শুরু করলাম। ব্রিজের মাঝামাঝি পৌঁছে দেখা হল নিচ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট জলস্রোতের। চারিদিকে সবুজের পর্দা, পাখির হালকা ডাক, জলের বয়ে চলার মিষ্টি সুর — এক অপরিসীম ভাললাগা ঘিরে ধরছিল। মনে হচ্ছিল বাইরের পৃথিবীর সাথে সব কিছু চুকেবুকে যাক চিরকালের জন্য, সময় দাঁড়িয়ে যাক, আর একবার আমি অপেক্ষা করি এখানে দাঁড়িয়ে তার জন্য। আলোর ফিকে হওয়ার সাথে সাথে সিমন ডাক দিল ঘরে ফেরার জন্য। গাড়িতে উঠে গায়ে জড়িয়ে নিলাম পশমিনা, আর মনের কোণে জড় হল একরত্তি মেঘভেজা দুপুর আর বিশালতার কাছে নিজের ক্ষুদ্র অস্তিতের পরিমাপ। সান্ধ্যভোজনে চা, চিকেন মোমো তো ছিলই, সাথে ছিল হাড়কাঁপান উত্তরে হাওয়া। দরজা খুললেই ভেজা হাওয়ায় আবার করে সিঁটিয়ে যাচ্ছিলাম। রাতের খাবার মানেই রুটি আর চিকেন। ডিনার সেরে সেদিনের মত সমস্ত স্মৃতি আবার করে ঝালিয়ে নিয়ে গরম কম্বলের তলায় নিজেকে চালান করলাম।

পরদিন সকালবেলা উঠেই মেঘের পরত সরিয়ে উঁকি দিল ঝকঝকে কালিম্পং। ঝটিতি হাতে আলুর পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আভিরাজকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম লামহাটা পার্ক-এর উদ্দেশে। উল্লেখ্য অভিরাজ হোমস্টে-তে ছিল দুরকমের ঘর — কংক্রিট আর কাঠের। আমরা কাঠেরটিকেই বেছেছিলাম। গাড়িতে ওঠার সাথে সাথেই চারিদিকে সাদা করে ঝুপ্পুস করে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি যে জোরে পড়ছে তা না, কিন্তু চতুর্দিক ভিজে থৈথৈ, আর চারিদিক সফেন কুয়াশায় মোড়া, কে বলবে সময় তখন প্রায় ১০টার কাঁটা ছুঁইছুঁই। সিমন-এর পারদর্শিতায় ঝটিতি পৌঁছে গেলাম লামহাটা পার্কে। লামহাটা দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত রাংলি রাংলিওট ব্লক-এর ছোট্ট গ্রাম। ২০১৫ সালে আমাদের বর্তমান রাজ্য সরকার এই পার্কের উদ্বোধন করেন। টিকিটের মূল্য ২০/-। সিঁড়ির সারি বেয়ে পাহাড়ের গায়ে চড়া আর প্রকৃতির সুধা পান এখানকার উদ্দেশ্য। কপাল ভাল না মন্দ জানিনা — মেঘ আমাদের পিছু ছাড়েনি। টুপটাপ বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে ফোটোসেশন চালাতে চালাতেই উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। বাবা মাঝে রনে ভঙ্গ দিল। চারজনের চরৈবেতির শব্দে গাছেরা ঘুম ভেঙে জেগে যাচ্ছিল। বিশালাকার পাইন গাছেদের মাঝে নিজের ক্ষুদ্রতা ছিল বিস্ময়কর। ভেজা মাটি, সেঁতানো গন্ধ, ঝিঁঝিঁপোকার অবিরাম কলরোল, ফার্নের সংসারপাত — এক অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছিল। Harry Potter & The Soceras Stone এর Forbidden Forest এ পা দিয়েছি বলে মনে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে থেমে দম নিয়ে আবার যাওয়া ছাড়া আর রোমাঞ্চকর কিছুই হচ্ছিলনা। যদিও আমি ভাবছিলাম হঠাৎ অ্যাডভেঞ্চারস কিছু পাতে পড়লে মন্দ হয়না। একদম শেষের সিঁড়িতে পা দিয়ে বুঝলাম সামনে বিশাল সমতল জায়গা জাতীয় কিছু আছে। মেঘের আস্তরন ভেদ করে দেখা দুঃসাধ্য। অদ্ভুত গা ছমছমে পরিবেশ আর ডাহুক পাখির ডাক মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছিল। ভাইরা মাকে আমার জিম্মায় রেখে এগিয়ে গেল। আমরা ধীরেসুস্থে পা বাড়িয়ে পৌঁছলাম একটা লেকের ধারে। দু হাত দূরের মানুষকেও দেখা যাচ্ছেনা এমন কুয়াশা। ভাইদের ডেকেও সাড়া পাওয়া গেলনা। ফোনের টাওয়ার অনুপস্থিত। অগত্যা অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। ১০ মিনিটের অনন্ত অপেক্ষার পর হাজির হল দুই মক্কেল। স্বর্গের পারিজাত হ্রদের মত নাহলেও বেশ স্বচ্ছ জল, সুমিষ্ট পরিবেশ, হলুদ সাদা ধুতরো ফুলের সমাহারে নিরাশ হয়নি কেউই। প্রায় ঝড়ের গতিতে গাড়ির কাছে পৌঁছেই বাতাসিয়া লুপের জন্য পা ঘোরালাম।

বাতাসিয়া লুপের বিশেষত্ব হল এটি একটি পেঁচালো / সর্পিলাকার রেল লাইন। একই জায়গার দুদিকে রেললাইনটি পরিবেষ্টিত, তফাত শুধু উচ্চতায়। হ্যাঁ, পার্বত্য উচ্চতাকে ঝপ করে এক ধাপে কমানো সমস্যা ছিল, তাই এই সমাধান। বাতাসিয়া লুপে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই মোটা পরতের বৃষ্টি গায়ে আয়েশ করে চুমু দিয়ে গেল। তবে ঝোড় হাওয়ার চাবুক আমাদের সকলের মেজাজ তিরিক্ষি করে দিল। বৃষ্টিতে মাথায় ছাতা নিয়ে টুকটুক করে এগোতে লাগলাম বাতাসিয়া লুপের উপরের অংশে যাওয়ার জন্য। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেখলাম ইন্ডিয়ান আর্মির গোর্খা সেনাবাহিনীর মূর্তি বানানো রয়েছে লুপের মাঝখানে, আর তাকে ঘিরেই রেললাইনের বিস্তার। দাঁড়ানোর সাথে সাথে একটি ঘুমগামী ট্রেন বাতাসিয়া লুপে এসে দাঁড়ালো আর আমি গুনগুন করে উঠলাম “ভেজা রেলগাড়ি হয়ত সবুজ ছুঁয়ে ফেলে, আর সারাটা পথ ভীষণ খামখেয়ালে চলে”। গানের সাথে সাথে মেঘের খামখেয়ালিপনা শুরু, বৃষ্টি উধাও হয়ে আস্তে আস্তে রোদের ঝলক, সাথে ডানপাশে ধোঁয়া সরিয়ে পরিষ্কার হল দার্জিলিঙের পুরু জনবসতি। মনখারাপের ঝুড়ি নিয়ে হুস করে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলে গেল আর আমরা দেদার আনন্দে ফোটোসেশন সেরে উঠলাম গাড়িতে। পরের গন্তব্য লেপচাজগৎ। ঘুম স্টেশনকে ডান হাতে রেখে গাড়ি বাঁহাতি রাস্তা ধরল।

ঘুম স্টেশন থেকে মিনিট তিরিশেক দূরের গ্রাম। দার্জিলিং শহর থেকে ১৯কিমি দূরে। লেপচাজগৎ নাম থেকেই স্পষ্ট এটা লেপচাদের নিজেদের জগৎ। যতই গাড়ি শহর ছেড়ে এগোতে লাগলো মেঘেদের দঙ্গল ঘিরে ধরতে লাগল আমাদের। আবার সেই স্যাঁতসেঁতে শীত চেপে বসলো সারা গায়ে। দুপুর শেষ হতে না হতেই নিভে আসা আলোর মত একটা মরচে ধরা বিকেল নাগাদ আমরা পৌঁছলাম আমাদের কাঞ্চনকন্যা হোমস্টেতে। মালিকের নাম পাসাং তামাং। দরকারি আলাপচারিতার পর গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ে হাতের চেটো সেঁকে কাছাকাছি লেপচাজগৎ ভিউ পয়েন্ট দেখতে গেলাম পায়ে হেঁটে। নিছকই মানুষের পায়ে হাঁটা শর্টকাট রাস্তা টপকে পাসাং তামাঙ্গের দুর্দান্ত পাহাড়ি গতির সাথে তাল মিলিয়ে আমরা ক্ষুদে তিনজন উঠলাম লেপচাজগৎ ভিউ পয়েন্ট-এ। পৌঁছে একরাশ হতাশাই মনের কোণে জড় হল। কারণ ঘন কুয়াশায় চারিদিক এতটাই ঢাকা ছিল যে কিছু ঠাহর করা গেলনা। মন খারাপ নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম আর আমাদের পিছন ধরল লেপচাজগতের এক লোমশ দশাসই চেহারার সারমেয়। আমাদের হাতে সন্ধ্যে নামার আগে অফুরন্ত সময় ছিল, তাই পায়ে হেঁটে জায়গাটা চেখে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। হঠাৎই তামাংজি বলল সামনেই ওয়েস্টবেঙ্গল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলো আছে দেখে আসতে। বাংলোটা মূল রাস্তা থেকে ডানহাতি একটা রাস্তায় ঢুকে যেতে হবে। তামাংজি আমাদের বিদায় দিল বটে কিন্তু কুকুরটি আমাদের পথ দেখানোর দায়িত্ব নিল। বাবা তাই চট করে ওকে দু প্যাকেট বিস্কুট খাইয়ে দিয়ে ওর পিছন পিছন চলতে শুরু করল। রাস্তার বাঁপাশে পাহাড়ি গাছপালা ভর্তি। তার মধ্যে উল্লেখ্য কলসপত্রী গাছের মত সাদা বড় বড় কলসির মত পাপড়িওয়ালা ফুলগাছ। বেশ ঝাঁকে ঝাঁকে ওদের অবস্থান জানান দিল ওই রাস্তাতেই ওদের সংসারপাতি। কুয়াশার চাদর সরিয়ে সরিয়ে আমরা পৌঁছলাম WBFDC-র বাংলোর সামনে। পাতায় কুশায়া জমা হওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি এত নিঝুম চারিদিক। চারপাশ সবুজে সবুজে ভরা। আবছা কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে আছে চতুর্দিক। সামনে একলা দাঁড়িয়ে আছে WBFDC-র রিসর্ট। সামনে কোনও লোকজন নেই, ভিতরে যে কেউ আছে তার অস্তিত্ব বা প্রমাণ বা সাড়াশব্দ কিছুই পেলাম না। আমি তো শীতে জবুথবু হয়ে ছিলাম, সাথে ভূতের ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। আমার মা সাহস করে ভিতরে ঢুকে রেজিস্টার দেখে এসে বলল এক মাসের আগের দিনে সব এন্ট্রি আছে। না আছে রিসেপশনে কোন লোক, না আছে কোন লোকের গলার আওয়াজ। গেট থেকে প্রায় পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আমরা যখন আলোচনায় মশগুল হঠাৎই বিশাল আওয়াজ করে গেট বন্ধ হওয়ার শব্দ হল। আরও একবার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জানান দিল কিছু ব্যাপার আছে। কিন্তু আমার আকণ্ঠ ভয়ের আর্তিতে সবাই সাড়া দিল। ফেরার পথে পা বাড়াতেই হঠাৎ চোখে পড়ল বাংলোর বাঁদিকে একটা পোড়ো বাড়িতে সারসার সাদা তোয়ালে ঝুলছে, অথচ ওখানে যাওয়া থেকে আমরা কেউই লক্ষ্য করিনি। কেউ কোন বাক্যিব্যয় না করে কুয়াশার চুপচাপ ঝরে পড়ার শব্দ মাথায় নিয়ে বারবার পিছনে ফিরে তাকাতে তাকাতে ঘরে ফিরলাম। শীতের সেঁতানো বিছানায় গা এলাতেই শুনতে পেলাম বাইরে প্রবল ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কাঁপুনি দ্বিগুণ হল। মনের কোণে অজানা শঙ্কা নিয়ে সেরাতের মত ঘুমের দেশে পাড়ি জমালাম।

পরদিন সকালের গরম গরম ম্যাগি আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে চেপে বসলাম। বাইরে রোদের তাপ প্রায় নেইই। মেঘ, কুয়াশা এতই মিলেমিশে গেছিলো যে কোন জায়গায় হাত দিলেই মনে হচ্ছিল জলে ভেজানো বা বৃষ্টি ভেজা কিছুতে হাত দিচ্ছি। প্রথম গন্তব্য ছিল ঘুম মনাস্ট্রি। লেপচাজগৎ ছেড়ে গাড়ি যত ঘুম-এর দিকে এগোতে লাগলো কুয়াশার জট পাকানো অবস্থা কেটে গিয়ে পরিষ্কার হল আকাশ। শীতের মোলায়েম রোদ মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালো মনাস্ট্রিতে। ঘুম মনাস্ট্রির ভাল নাম গিগা চোলিং। উনিশ শতাব্দীর নির্মিত এই মনাস্ট্রির আরাধ্য দেবতা হলেন মৈত্রী বুদ্ধ। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মূল উপাসনা ঘরে পৌঁছেই তার দেখা মিলল। তার প্রশান্তি ভরা মুখ, কপালের পাথর থেকে বিচ্ছুরিত নীল রঙের আভা মোহিত করে দিল বেশ কিছুক্ষণের জন্য। তবে উপাসনাগৃহের বাইরে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসে থাকা গাড়ি এক লহমায় বুঝিয়ে দিল এই মনাস্ট্রিও আমাদের কনজিউমারিসমের কবল থেকে রেহাই পায়নি। সিঁড়ি বেয়ে ফিরতি পথে উঠে দেখি জোর জোর হুইসেল বাজিয়ে গুটিগুটি পায়ে টয় ট্রেন আসছে। আর রেললাইনের পাশে সাজিয়ে পসরা নিয়ে বসা ভুটিয়ারা সব জিনিস টেনে সরিয়ে দিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যপটের পরিবর্তন। কি অসীম ধৈর্য ওদের। দিনের মধ্যে যতবার ট্রেন যাতায়াত করে প্রতিবার যত্ন করে পসরা তোলা সাজানো নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। ওদের কাছ থেকে শীতের কিছু টুকটাক কেনাকাটি সেরে ওদের মুখের অমলিন লালচেপনা হাসিকে মনের কোণায় রেখে গেলাম পরবর্তী গন্তব্য রক গার্ডেনে। এর আসল নাম বারবটে রক গার্ডেন। ১০কিমি পরিধি বিশিষ্ট এই বাগানের শুরু দার্জিলিং হিল কার্ট রোড থেকে। গোর্খা হিল কাউন্সিল ডিপার্টমেন্টের তত্ত্বাবধানে এর নির্মাণ। কাজ শেষ হওয়ার পর সুবাস ঘিসিং এটির উদ্বোধন করেন। পাহাড় আর ঝরনার মধ্যে পাহাড়ের খাঁজ কেটে মনুষ্যসৃষ্ট সম্পূর্ণ বিনোদনমূলক একটি জায়গা। নতুন বিবাহিতরা গিয়ে ধৈর্যের সাথে ফোটোসেশন সারতে পারেন যদি ঝরনাকে একলা পান। অযথা সময় নষ্ট না করে গাড়িতে চললাম দার্জিলিং মল-এ যাওয়ার জন্য। রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পড়ল তেনজিং নোরগে ন্যাশানাল মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট। দার্জিলিং মল নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। ফোরপয়েন্ট ক্রসিং যেখানে এসে মিশেছে সেখান থেকে নেহরু রোড এর ঠিক উপরের রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম মল-এর মাঝখানে। চারপাশের প্যানোরমিক ভিউ দেখতে পাওয়া বাঁ পাশাপাশি বেঞ্চে বসে নিজের পুরনো দিনের স্মৃতি হাতড়ানো, বা হালকা ম্যান্ডোলিন-এর সুরে নিজেকে বিভোর করতে একমাত্র এই মল-ই পারে। এর আছে সেই জাদুক্ষমতা। তবে হাতে সময় কম, তাই মল-এ এক পাক হেঁটেই কেভেন্টার্সের পথ ধরলাম। নরম রোদের পরত আর সাথে হিলহিলানি ঠাণ্ডার আমেজ, দূরে কপোতকপোতীর আলিঙ্গনবদ্ধ ছবি, একলা বিরহিণীর মোটা বিদেশি বই হাতে সসেজ ভক্ষণ এসব দেখেই আমাদের ওয়েটিং টাইম কেটে গেল। খাওয়ার আসতেই দ্রুত হাতে পেটের কোণায় পুরে দিয়ে গাড়িতে চেপে ছুটলাম স্টেশনের দিকে, কারণ ওখান থেকেই আমাদের ট্রয় ট্রেন ছাড়বে। দৌড়ে ছুটে ঘেমে নেয়ে, ভুল ট্রেনে উঠে নেমে শেষমেশ যখন আসল গাড়িতে উঠলাম তখন এক্কেবারে হাক্লান্ত। কিন্তু ট্রেনের ছোট্ট ছোট্ট কামরা, ক্ষুদে ক্ষুদে বসার জায়গা আর ছোট্ট জানলা দেখে কখন যে ডিসনিল্যান্ডে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না।

ট্রেনের রুট নিয়ে একটু বলে নিই। ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতে প্রথম দার্জিলিঙে ন্যারো গেজ ট্র্যাক পাতা হয়। তখন কিন্তু আসল কারবার ছিল দার্জিলিং পাহাড় এবং নিম্নবর্তী জায়গাগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন। সময়ের হাত ধরে এই রেলগাড়ি পর্যটকের মনের কোন এতটাই রাঙিয়ে দিয়েছিল যে UNESCO কুর্নিশ ভরে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্টেটাস-এর তকমা দিল একে। দু ধরনের ট্রেন চলে এন জে পি এবং দার্জিলিং-এর মধ্যে ডিজেল আর স্টীম। মোট দশটা স্টেশন — শিলিগুড়ি, সুকনা, রংটং, রিনধারিয়া, গয়াবাড়ি, মহানদী, কার্শিয়াং, টুং, সোনাদা, ঘুম। ডিজেল ট্রেনের দুটো ফার্স্ট ক্লাস কোচ থাকে। ফার্স্ট ক্লাসের দাম ৪১০/-, সেকেন্ড ক্লাসের দাম ৩০/(??)-.আমরা দ্বিতীয়টাই বেছেছিলাম। হুইসেল, ঘণ্টি সব বাজিয়ে ট্রেন ছুটতে শুরু করল তার নিজের গতিতে। হালকা দুলুনি সাথে ফোটোসেশন, পাশে দার্জিলিং, বাড়ির পেট চিরে ট্রেন লাইন, হাত বাড়ানো দূরেতে ভুটিয়াদের যাতায়াত সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যেন বরফি-র শ্যুটিং হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ রোদের কড়া নজরের পর আবার একরাশ কালমুখো মেঘ এসে সব আবছা করে দিল। আশপাশ সব সাদা, ক্যামেরা বন্ধ। শুধু ট্রেনের হুইসেল আর হালকা দুলুনি। সময় এগোল, ঘুমও এসে গেল। স্টেশনে নামতেই রাক্ষুসে কুয়াশা ধেয়ে এল, বিকেল ৪টে সবে বাজে, কালো কুচকুচে করে দিল চারিদিক, স্টেশনের মাটি ভিজে একাকার, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না চারিদিকে। মনে মনে বেশ রাগ হল। সিমনকে ডাকার ফাঁকে স্টেশনে কিছু ফোটোসেশন চলল। ঘুমের স্টেশন মাস্টারের ঘর, ছোট্ট লাল জানলাওয়ালা টিকিট কাউন্টার আবছা আলোয় কুয়াশা ভেজা বসার বেঞ্চ সব মিলিয়ে ঘুম বড় ভেজা ভেজা দলা পাকানো কান্না মিশিয়ে দিল মনের কোণে। ঝুপুস করে নামা ঝুজকো অন্ধকারে গরম গরম চিকেন পকোড়া আর চিকেন মোমো সান্ধ্য ভোজনে জমে ক্ষীর। রাতের স্বল্পাহার সেরে মনের কোণে ট্রেনের হুইসেল বাজিয়ে হাইবারনেশনের দিকে পা বাড়ালাম।

পরদিন ছিল ফেরার পালা। তাই সময় নষ্ট নৈব নৈব চ। একদম সক্কালে উঠে গরম ধোঁয়া ওঠা ম্যাগি পেটে চালান করে গাড়িতে উঠলাম প্রথম গন্তব্য জোর পোখরির দিকে যাব বলে। এটি দার্জিলিং শহর থেকে ১৯কিমি দূরে মিরিক যাওয়ার পথে পড়ে। উচ্চতা ৭৪০০ফিট। পাশাপাশি দুটো লেকের অবস্থানই নামের যথার্থতা বহন করে চলেছে। বেশ কিছুটা উঁচুতে উঠে পাশাপাশি দুটো লেকের চারিদিকে সুন্দর করে সাজানো পাইন আর ধুপি গাছের সংসারপাত আর মনুষ্যসৃষ্ট কালনাগের মূর্তি এখানকার বিশেষত্ব। আহামরি বলতে লেকের উপরের ধাপ থেকে দূরে ক্ষুদে চোখে তাকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলে, আর ডান দিকে ঘাড় ঘোরালেই নীচে দেখা যায় সুন্দর সেজে গুজে বসে আছে কার্শিয়াং। বর্ষাকালে Himalayan Salamander-এর দেখা মিললেও মার্চ মাসে আমাদের চোখে পড়লনা।

তড়িঘড়ি ক্যামেরার কারসাজিতে আশপাশকে ধরেবেঁধে ঘন পাইন গাছেদের সারির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললাম নেপাল বর্ডার দেখব বলে। জায়গাটির নাম সীমানা ভিউ পয়েন্ট। দার্জিলিং থেকে মিরিক যাওয়ার পথে পড়ে। গাড়ি থেকে নেমে খাদের ধারে গিয়ে নেপালের লাল রঙের কোন এক বাড়ি দেখে বেশ রাশভারি গলায় বললাম বাহ সার্থক হল তবে। পরের গন্তব্য নেপালের পশুপতি মার্কেট। নিজে বাঙালি তায় মেয়ে হয়ে মার্কেটিং-এর গল্প সক্কলের সামনে পেশ না করাই ভাল। দুপুরের খাওয়ার সেভাবে হয়নি দেখে মিরিকে নেমেই আগে পেটকে শান্ত করলাম। তারপর গেলাম মিরিক লেক পরিদর্শনে। কলকাতায় দুর্গাপুজোর সময় ঠাকুর দেখার ভিড় বোধহয় ওখানে চলে গেছিলো। দূরে চোখ দিলে সবুজের পর্দা আরাম দেয়। লেকের মাঝে গিয়ে সবরকম পারমুটেশন কম্বিনেশন করে ছবি তুলে এক্কেবারে বাড়ির পথ ধরলাম। পাহাড়ি কুয়াশামাখা পথ ধরে ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে লাগলাম আর মনের কোণটা ভরে উঠতে লাগলো মেঘভেজা পরিতৃপ্তিতে। মেঘ পিওনের হাতে দিয়ে আসলাম আবার যাওয়ার প্রতিশ্রুতি।


(ভ্রমণকাল-- ৬ই - ১১ই মে ২০১৮)





(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)