ISSN 1563-8685




কালো হাত

“আমার বন্ধু পরশের একটা রোগ ছিল, অদ্ভুত রোগ!” বলেছিল ছেলেটা। রোগা পাতলা চেহারা, গোল গোল চোখ দুটো উজ্জ্বল। আমার চেয়ে বছর দু তিনেকের ছোট হতে পারে, বা সমবয়সী।

আমি কফিশপে বসেছিলাম। দুপুরবেলা। সীমা হঠাৎ ফোনে বলেছিল দেখা করতে। অলস দুপুর সেই কফিশপে তখন। ছেলেটা এসে বিনা কোনও মন্তব্যে আমার সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ল। অথচ আরো অনেক চেয়ার ফাঁকা ছিল আশেপাশে।

আমি চোখ কুঁচকে ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম। আমার ইচ্ছা ছিল না এই মুহূর্তে কারো সঙ্গ পাওয়ার। সীমা কেন দেখা করতে চায় এই অসময়ে, আমি জানি মনে মনে।

যে সুন্দরী কিশোরী মেয়েটি বসেছিল উল্টো দিকের টেবিলটাতে, প্রিয়া প্রকাশ ভ্যারিয়ারের মত দেখতে তাকে, তুলির ছোঁয়ায় নিপুণ দক্ষতায় আঁকা তার নিখুঁত ভুরু দুটোর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম আমার সামনে রাখা কফি কাপের কফির উপর সন্তরণরত, মরণরত একটা পিঁপড়ের সঙ্গে কীই বা পার্থক্য মেয়েটার? চাঁদ একটা বিকট বিশ্রী জড়পদার্থ, অথচ আমার চেয়ে কত বড় আর কত বেশি অসাধারণ তার অস্তিত্ব!

এই রকম সময়ে ছেলেটা এসে বসে পড়ল সামনে।

বলল, আমার বন্ধু পরশের রোগ ছিল একটা।


সীমার বিয়ের কথা চলছে আমি জানি। চলবেই কখনো না কখনো, আমি জানতাম। সীমাকে ছাড়া আমার চলবেই না, বাঁচতে পারব না ওকে ছাড়া, এমন অদ্ভুত বিদঘুটে চিন্তা করার কথা আমার মাথাতেও আসে না কস্মিনকালে...

তবু এই যাই যাই গ্রীষ্মে এয়ারকন্ডিশন্ড কফিশপে বসে দামী বিস্বাদ কফিতে চুমুক দিয়ে আমি কিশোরী, প্রিয়া, পিঁপড়ে, চাঁদ, আর নিজের রসায়ন নিয়ে ভাবছিলাম নিবেদিত প্রাণ হয়ে।


ছেলেটা এসে সব গুলিয়ে দিল।

আমি ভুরু কুঁচকে আবার তাকালাম ওর মুখের দিকে। পরশের রোগ বা অন্যকিছুর প্রতি আমার যে কোনরকম কোন আগ্রহ নেই সেটা ওকে বুঝিয়ে দেওয়ার স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার সেই চাউনিতে।

সেই চাউনি দেখে ছেলেটা একটুও ঘাবড়েছে বলে মনে হল না যদিও। বরং আরো উৎসাহিত হয়ে উঠল যেন!

এদিক ওদিক সাবধানে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল কেউ আমাদের লক্ষ করছে কিনা। তারপর একটু নিচু হয়ে একটু ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল, “পেট থেকে কালো হাত বেরোত ওর!”

চমকে উঠে ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম আমি। এক চুমুক গরম কফিতে সবে আরাম করে জিভ ভিজিয়েছিলাম, আর একটু হলে বিষম-টিষম খেয়ে ভয়ানক কাণ্ড হত একটা।

আমার কালো হাত রোগ নেই। কোনও কালে ছিল না। কিন্তু এই ছেলেটা এত লোক থাকতে হঠাৎ এই টেবিলে এসে বসে এ প্রসঙ্গ তুললো কেন?

আমাকে টার্গেট করার মানে কী?


আজকাল ফিসফিস গুজগুজ শোনা যায়। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটগুলোতে অল্পবয়সী মেয়েরা নেকিয়ে নেকিয়ে, আর অল্পবয়সী ছেলেরা চাপা বিষণ্ণতার সুরে পোস্ট করে, “পেট থেকে হাত বেরোনো কোন রোগ নয়। জানার চেষ্টা করুন। আপনার কোনো আপনজনও…”, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সেসবের বেশিরভাগই দেখানে ব্যাপারস্যাপার। কেউ সামনে এগিয়ে এসে এখনও স্বীকার করতে চায় না সত্যিই ওই রোগ হলে।

অদ্ভুত জটিল রহস্যময় রোগ একটা। লজ্জার! অন্তত জনমানসে।

আমার পেট চুলকাচ্ছিল হঠাৎ। কিন্তু ছেলেটার সামনে চুলকানো ঠিক হবে না ভেবে চুপ করে রইলাম।

কিছু বললাম না।

এখন আমার পরশের ব্যাপারে একটু কৌতূহল হচ্ছিল।

আমি চামচটাকে কফি কাপে ডুবিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করলাম অন্যমনস্কভাবে, ছেলেটার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকানোর আমার ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু আবার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটা বিকর্ষণও অনুভব করছিলাম আমি।

এখন একে কিছু জিজ্ঞাসা করলে সেটা কেমন সন্দেহজনক দেখাবে!

একমুহূর্ত আগে পর্যন্ত আমি সীমার আসা নিয়ে ভয়ে ভয়ে ছিলাম।

এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে ও এসে পড়লে বাঁচি!

শুকনো গলা ভেজাতে কফিকাপটাকে ঠোঁটে তুললাম আবার।

ছেলেটা বলল, "প্রথমদিকে এমনিই ছিল হাতটা, কালো ছিল না। পেটের কাছ থেকে বেরিয়ে থাকত। বুঝলেন? সবার যেমন হয় বলে শোনা যায়, তেমনই আরকি! কিন্তু তারপরে হাতটা আস্তে আস্তে কালো হয়ে উঠতে লাগল।"

ছেলেটা এসে বসে আছে কফি শপে, একটা চেয়ার জুড়ে, এবং কিছু অর্ডার করছে না। অথচ কোন ওয়েটার এসে তাড়াও দিচ্ছে না ওকে! দেখে আমি একটু অবাকই হচ্ছিলাম। কিন্তু বললাম না সেসব কথা কিছু। ছেলেটার কথার দিকে মনোযোগ না দিলেই হবে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম।

কাচের জানলার বাইরে তাকিয়ে আমি জিন্স-টপে সজ্জিতা এক সুন্দরী এবং তার পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত বয়ফ্রেন্ডের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ছেলেটা কিন্তু দমল না। বলে চলল, "খুব ছোটবেলার বন্ধু ছিল পরশ আমার। যাকে লোকেরা..." মাথা ঝাঁকিয়ে একটু হাসল আদর ভরা হাসি, বলল, "যাকে লোকেরা ন্যাংটো বেলার বন্ধুত্ব বলে তাই, বুঝলেন?"

"একটু অন্যরকম ছিল ও। যা কিছু অন্য ছেলেরা হাতে নিত না, তাই ঘাঁটত দুহাতে। তাইতেই ওর দিকে ছেলেবেলা থেকে আমার ছিল কৌতূহল।"

"ওই রকম ছিল বলে ওর বন্ধুও ছিল না কোন আর। এক আমিই--তা সেটাকে খুব উপভোগই করতাম আমি। পরশ আসলে... ও আসলে... হি ওয়াজ আ জিনিয়াস। অ্যান্ড হি ওয়াজ সো ফন্ড অফ মি! জানেন?"

ছেলেটা একটু উত্তেজিত হয়ে উঠছিল বলে মনে হল আমার। সাবধানী চোখে অপাঙ্গে একবার দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলাম ছেলেটার মুখ। কিন্তু সে গুড়ে বালি। আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল ছেলেটা। চোখে চোখ পড়ে যেতে মিষ্টি করে হাসল শুধু। কন্ঠস্বরের উত্তেজনা মুখে ছাপ ফেলেনি।

আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। ছেলেটা বলে চলল, “যখন আমাদের তেরো চোদ্দ বছর বয়স হবে, তখন আস্তে আস্তে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল আর পাঁচটা ছেলের সঙ্গে ওর পার্থক্যটা। তখন থেকেই ওর হাতটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল পেটের কাছটায়, বুঝলেন? সবসময় মোটা সাদা জামা পরে থাকত ও, যাতে ওই হাতটা অন্যদের কাছে প্রকাশ না হয়ে পড়ে, তবু…”

একটা শ্বাস টেনে নিয়ে কেমন মধুর করুণ একটা হাসি হাসল ছেলেটা, “আসলে কি আর সে জিনিস লুকোনো যায়? মানুষ দেখতে চায় না বলেই দেখে না।”

বলে ছেলেটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল একটু। আমি বুঝতে পারিনি এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়েছিলাম ওর মুখের দিকে। ধরা পড়ে গিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম অপ্রস্তুত হয়ে।

ছেলেটা বলে চলল, “সেই প্রথম আমি চাক্ষুষ দেখেছিলাম এমন একজনকে যার ওই রোগ আছে, বুঝলেন? তার আগে তো ভাবতাম মিথ একটা। বিদেশে হয় ওসব জিনিস... কিন্তু আমাদের দেশেও যে...আমারই বেস্ট ফ্রেন্ডের… পরশ বলেনি অবশ্য আমায় কিছু। কিন্তু ও জানত মনে মনে যে আমি জানি। আমিও জানতাম যে ও জানত যে আমি জানি।”

আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। কিন্তু ছেলেটার সামনে কফি কাপে চুমুক দিতেও অস্বস্তি হচ্ছে আমার।

কফির উপরে এতক্ষণ সাঁতার কাটছিল যে পিঁপড়েটা তাকে আর দেখতে পাচ্ছি না! গিলেই ফেললাম নাকি সেটাকে? তখনই ওয়েটারকে ডেকে ঝামেলা করা উচিত ছিল আমার, কেন করলাম না কে জানে! এত দামী কফিশপে কফি খেতে আসে কি মানুষ পোকা-মাকড় সাথে ফ্রি খাওয়ার জন্য?

ছেলেটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল তো ছিলই। চোখ সরাচ্ছিল না। যেন আমার মনের মধ্যে পর্যন্ত পড়ে নেবে শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়েই।

এখন হঠাৎ বলল, "ঘামছেন আপনি।"

আমি ঘামছিলাম। কেন তা জানি না। ছেলেটা পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। বলল, "নিন, কপালের ঘামটা মুছে নিন।"

ওর হাত থেকে রুমাল নিয়ে আমি মুছে নিলাম কপাল, চোখের কোণ, নাকের পাশ।

ছেলেটা হাসল। রুমালটা ফেরৎ নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে বলল, "এরপরেই আসল গল্প। পরশের সঙ্গে মুখে এ নিয়ে কোনও কথা না হলেও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছিল খুব। আমি ওই হাতে হাত বোলাতাম। আমাকে বারণ করত না ও। আমার হাতে ধরে থাকতাম ওই হাত। সেই থেকে..."

কথা না শেষ করে অন্যমনস্কভাবে ছেলেটা তাকাল বাইরে দিকে। মনের মধ্যে ঘটনাগুলোকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য বোধ হয়।

ছেলেটা কিছু না বললেও আমি জানতাম কী বলতে চলেছে ও।

আমারও গলা শুকিয়ে আসছিল।

ছেলেটা গলা খাঁকারি দিয়ে কন্ঠস্বর পরিষ্কার করে নিল একটু। তারপর বলল, "তারপর কী হল নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন। পরশের হাতটা সবসময় লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হত তো! আমার কাছে অল্প হলেও প্রকাশিত হতে পেরে আমাকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা বাড়ছিল হাতটার। …তারপর আস্তে আস্তে ডালপালা মেলে সে হাত আমায় জড়িয়ে ধরতে লাগল, আমি পরশের আশপাশে গেলেই। পরশের ওকে ঢেকে রাখার, চেপে রাখার সব চেষ্টা সত্ত্বেও আমি বুঝতে পারতাম, জামা ছিঁড়ে, ওই ভদ্র পোষাকের মধ্যে থেকে ওই হাত বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আস্তে আস্তে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল হাতটা। ঘামে ভিজে উঠতে লাগছিল। ওই চেপে থাকা অস্বাভাবিক অবস্থার থেকে বেরিয়ে বাইরের পৃথিবীর রূপে রসে গন্ধে মলিনতায় ওর হাতের প্রকৃতি ডানা মেলছিল আসলে। আমি বুঝতাম। কিন্তু কিছু বলতাম না। আমি ভাব দেখাতাম যেন বুঝতে পারছি না কিছু। আমি পরশকে এড়িয়ে যেতাম না। কিন্তু ওর ওই হাতের নাগালের বাইরে থাকতাম সবসময়ই।"

“আমি যেটা বুঝতে পারিনি, তা হল, আমার কাছে যা খুব হালকা ছিল, পরশের কাছে তা হালকা ছিল না। আমি ভাবতাম পরশ ভাল, পরশ সুন্দর। ওর পেটের উপর উঁচু হয়ে থাকা, ওকে একটু ঝুঁকে চলতে বাধ্য করা হাতটাকে আমি খুব সামান্য একটা অস্বাভাবিকতা ভাবতাম। ওটার দিকে নজর না দিলেই হবে ভাবতাম। আমি বুঝিনি, ওটা পরশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওটাকে বাদ দিয়ে পরশের যে অস্তিত্ব তা খণ্ডিত। আমি যাকে অস্বাভাবিকতা ভাবছি সেটাই আসলে পরশের স্বাভাবিকতা। সে সব কিছুই আমি বুঝিনি। তার ফলে যা হওয়ার তাই হল।"

একটু থামল ছেলেটা। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল একটা। তারপর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিজের শার্টের কোণ ধরে সেটায় ঘষে ঘষে কাঁচটাকে পরিষ্কার করতে করতে বলল, "নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কী হল তারপর? হ্যাঁ, ওর ওই একটু অদ্ভুত, কিন্তু সুন্দর, ওই বাকিদের থেকে ওকে আলাদা করে তোলা হাতটা আস্তে আস্তে কালো হয়ে উঠতে লাগল। আমি বুঝতে পারিনি সেটা। আমি জানতাম না। পরে জেনেছি। ওই কালো হয়ে যাওয়া হাত গলা টিপে ধরত পরশের। গলা চেপে ধরে ওকে ঘরের কোণে আটকে থাকতে বাধ্য করত দিনের পর দিন। বাইরে বেরোতে দিত না। আর কিছুকে, আর কাউকে জড়িয়ে ধরতে না পেরে আঁকড়ে-পাকড়ে ধরেছিল সে হাত দিনে দিনে পরশকেই। ওর দমবন্ধ করে দিচ্ছিল ওই কালো হাত। ওকে মেরে ফেলছিল দিনে দিনে তিলে তিলে। আমি কি করে জানতে পারলাম জানেন ওই হাতের কালো হয়ে যাওয়ার কথা? একদিন দেখি, পরশের গলায় গভীর ফাঁসের দাগ একটা। চেপে নীল হয়ে বসেছে পাঁচ আঙুলের স্পষ্ট দাগ। ওর চেহারাটা শুকিয়ে যাওয়া। চোখের কোলে কালি। আমি যখন আমার বন্ধুত্ব দিয়ে পরশকে ঘিরে রেখেছি ভেবে মনে মনে আত্মতুষ্টি লাভ করছিলাম, পরশের হাতের কালি তখন ততই ঘনীভূত হচ্ছিল। আমি জানতেও পারিনি। আমার মনে হল পরশ এতদিন ধরে ঠকিয়েছে আমাকে। রাগের চোটে বললাম, ‘হাতটা না থাকলে তো কালোও হত না তা! কেটে ফেল ওটাকে! তোর সর্বনাশ করছে আর সঙ্গে সঙ্গে যারা তোকে ভালবাসে তাদেরও।’”

“আমি ভুলে গেছিলাম যে দোষটা হাতটার নয়। বা পরশের নয়। দোষটা যারা ওই স্বাভাবিকতাকে চেপে রাখতে চায় তাদের।”

একটু থেমে আমার মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ছেলেটা। চোখের পলক না ফেলে বলল তারপর, “তারপর একদিন, ওই হাত গলা চেপে ধরে সত্যি সত্যিই মেরে ফেলল পরশকে। ওর মা আমাকে ডেকে ওর ঘর দেখিয়েছিলেন সেদিন। সে ঘর ভর্তি কালো হাতের কালো থাবার দাগ। আর আমার নাম লেখা কালো কালিতে।”

এতক্ষণ ধরে একনাগাড়ে কথা বলে ছেলেটা থামল এবার। টেবিলের উপর রাখা জলের বোতলটার সিল ভেঙে জল খেল আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই। জিজ্ঞেস করলেও অবশ্য মানা করতাম না আমি।

শুকনো ঠোঁটদুটোকে জিভ দিয়ে চেটে একটু ভিজিয়ে নিলাম আমি। কিছু একটা বলতে চাইলাম। কিন্তু স্বর বেরোল না গলা দিয়ে।

ছেলেটা বুঝতে পারল মনে হয় সেটা। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল একটু তাই। বলল, "আপনি ভাবছেন এসব গল্প কেন আপনার কাছে করতে এসেছি তাই না?" দুয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল তারপর, "আপনার গোপন হাত অলরেডি বিষে নীলচে হয়ে আসছে। এখনই না সামলালে ছড়িয়ে পড়বে, কালো হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে। আপনি ভাবছেন, কী করে আপনার হাতের খবর জানলাম? ওটা কী জানেন? পরশের মৃত্যুর পর থেকে আমি লক্ষ করি মানুষদের, আমি জানি তো, লক্ষণগুলো থাকে আমাদের চোখের সামনেই। শুধু আমরা লক্ষ করি না, এড়িয়ে যাই বলে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক কত মানুষকে অস্বাভাবিক বলে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিই আমরা।"

পকেট থেকে একটা কার্ড বের করল ছেলেটা। বলল, "এটা রাখুন। এটায় আমাদের সংস্থার ঠিকানা লেখা আছে। হাতটাকে বাড়তে দিন। ছড়িয়ে দিন। লুকোবেন না। লুকোলেই, চেপে রাখলেই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অঙ্গটা বিকৃত হয়ে যাবে। পরশ বেঁচে থাকতে বুঝিনি। এখন বুঝি। আমরা ওই হাত অ্যাকোমোডেট করা যায় এমন জামা বানাচ্ছি আমাদের সংস্থায়। প্রথম প্রথম একটু চোখে লাগবে লোকেদের, তারপর চোখ সয়ে যাবে। আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি সেখানে।”

ছেলেটা হাসল। তারপর যেমন না অনুমতি নিয়েই এসে বসেছিল আমার টেবিলে তেমনই অনুমতি না নিয়ে উঠে চলেও গেল।

আমার পেটের কাছে হাতটা সুড়সুড় করে উঠতে চাইল আবার। সত্যিই কি কালো হয়ে উঠছে আমার গোপন হাত। আমি হাত বুলিয়ে দেখে নিলাম জায়গাটা। আজ সীমা আসবে। ওকে দেখলেই আমার হাত জড়িয়ে ধরতে চাইবে ওকে। আমি জানি। সীমা প্রশ্রয়ের হাসি হাসবে, আর তার পরে খবর দেবে আমাকে, কেমন করে ও বিজনের হাত ধরতে চলেছে শিগগিরই। বলবে, "আমি খুশি তৃপ্তি। খুউব খুশি! তোকে কিন্তু আসতেই হবে। ম্যাচিং শাড়ি পরব দু’জনে।"

তাই শুনে আমি হাসব। আমার 'অলরেডি নীলচে’ হয়ে আসা গোপন হাত ওকে ছুঁতে না পেরে, কোনো কিছুকে ছুঁড়ে ভাঙতে না পেরে, লুকোতে লুকোতে আরো কালো হবে! না না না!

ছেলেটার দিয়ে যাওয়া কার্ড হাতে চেপে ধরে, আমি সীমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

একটু পরে উইন্ড চাইমে টুং টাং আওয়াজ তুলে সীমা ঢুকল কফি শপে।




(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)